Sunday, July 3, 2016

চলিষ্ণু

পুব-পশ্চিম বোঝা যায় না। ধু ধু দিগন্ত আর দিগন্ত। ছেয়ে থাকে শুধু শূণ্যময় ভাসতে থাকা ধূলো। হঠাৎ কোন একদিক থেকে হু হু করে ধেয়ে এল হাওয়া। ধূলোর কণাগুলো আরও চঞ্চল, আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল; তাদের নিজেদের মধ্যে লাগল বোধ হয় বেদম ঠোকাঠুকি; কে যে কোথায় কার সাথে জুড়ে গেল, কোনটা যে কীভাবে ঠিকরে গেল……


* * * * * * *


     কল্পনা মাঠ থেকে ঘরে ফিরে আজও দেখল শাশুড়ি হেঁসেলে বসে কাঁদছে। হাতের দাটা ছুঁড়ে উঠোনে ফেলে দিল। কোনো সাড়াই দিল না শাশুড়ির কান্নার জবাবে। মেয়েদের গায়েও হাত তুলল না রাগ মেটাতে। রোয়াকের কড়ি থেকে শুকনো কাপড়টা নিয়ে চলে গেল নাইতে।
     রাতে মথুরা ঘন হয়ে এলে কল্পনার মেজাজে চড়ে বসে দাটা। ধড়মড় করে উঠে বসে ঘোষণা করে কালই জমির বাঁটোয়ারা না হলে তিন ছেলেমেয়েসুদ্ধ সে জলে ডুবে মরবে।
     পরের কোজাগরী পূর্ণিমায়, হারু মাঝির থেকে সদ্য কেনা নৌকায় সংসার পেতে কল্পনা ভেসে পড়ল নতুন দেশের সন্ধানে। সঙ্গে তিন ছেলেমেয়ে, স্বামী মথুরা, দেওর দেবকী; মথুরার ভাগের দশ বিঘা জমি বেচে পাওয়া ষাট হাজার টাকা, আর পথ চেনাবার পরিতোষ মিস্ত্রি। চাঁদের আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠছে কল্পনার হাসি।
     দ্বিতীয়রাতে খাঁড়ি ছেড়ে মোহনায় পৌঁছোল নৌকা। ডাইনে বাঁক নিয়ে নৌকা চলল বীনার ছায়ায় মিশে মিশে। কালাচের ভয়ে শিউরে ওঠা কল্পনা ডাকতে লাগল মনসা আর বনবিবিকে। মথুরা দু দিন দু রাত দাঁড় বাওয়ার ক্লান্তিতে প্রায় চুপচাপ যদিও, তবুও মাঝে মাঝে ঠাট্টা করতে ছাড়ল না, যদি দক্ষিণারায়েও ডাকতি তাইলে ডাঙার বাঘের থিক্যাও রক্ষা পাওয়া যাইত; তবে এ্যা দ্যাশে মগর থিক্যা বাঁইচবার উপায় নাই কো কিসুই
     ভোররাতে নৌকা আবার খাঁড়িতে ঢুকল এবং প্রথমবার নোঙর করা হল। রোদ চড়ে যখন দূরের সমুদ্র ঝাপসা হয়ে গেল তখন গোলাম আলি এসে উপস্থিত হল। বাটা দেওয়া নেওয়া সারা হয়ে গেলে পরিতোষ গোলামের আনা নৌকাটা নিয়ে চলে গেল কল্পনার বাপের দেশের দিকে; সেখান থেকেই কল্পনার যাত্রা শুরু হয়েছিল। কল্পনাদের নৌকার হাল ধরলে গোলাম আলি। নৌকা গভীর রাতে পৌঁছে গেল ঝড়খালির ঘাটে।
     রাত পোয়ালে গোলাম আসল কথাটা পাড়ল। শুরু করল এই বলে যে সে এবার ছুটি নেবে; তার মজুরী বাবদ এখনই তাকে তিনহাজার টাকা দিতে হবে, মাথাপিছু এক হাজার করে ধরে, কুচোগুলো বাদ। টাকাটা দিলে তবেই সে কল্পনাদের পুরো দলটাকে পঞ্চায়েতের হাতে তুলে দেবে।
কল্পনা পড়ল মহা ফাঁপড়ে। পরিতোষ তো তাদের একথাটা বলে নি। অনেক আশায় ছেলে মানুষ করার জন্য সে এসেছে সর্বস্ব বাজি ধরে। সব বুঝি গেল ভেস্তে। মথুরাকে ছইয়ের নীচে ডেকে কল্পনা বলল, অনাকে বুঝাইয়া কও; জ়মি কিনতি পারবা না অনারে অ্যাখন কিসু দিলে। আমাগো ইহানে রওনের কি হইব অনার লগেই জ়িগাও...
গোলামের সাথে কথা বলে মথুরা ঠিক করল যে কুচোগুলোকে গোলামের বিবির কাছে রেখে তিনজনে গোলামের সাথে যাবে পঞ্চায়েতের কাছে। পঞ্চায়েত রবি মণ্ডল বিবেচক লোক। কিছু একটা উপায় যা হোক ঠাওরাবেন। রওনা হওয়ার আগেই কল্পনা দেবকীকে শুনিয়ে রাখল, দেবু ভাই, জ়মি ইহানে আর জ়ড়্যাইব না ভাবসি। আমরা দশ বিঘা নিতাসি; তুমি আলদা জ়মিন লও। হিসেব সবই আল্‌দা আল্‌দা কইর‌্যো
বেলা বাড়তে কল্পনারা হাজির হল পঞ্চায়েতের গদিতে। সেখানে অনেক লোকের ভিড়। অনেক শলা চলছে। কল্পনাদের পালা আসতে পঞ্চায়েত রবিবাবু সব শুনে বললেন, জমি নিতি চাও বাদাবনের দিকে দু ভাইকে দশ দশ কুড়ি বিঘা জমি দেওয়া যাবে। এখন আমার থিক্যা নিয়া গোলামের পাওনা মিটায়ে দ্যাও। জমির টাকাটা অ্যাখন দে দাও। কাগজটা আমার কাছে থাকবে; গোলামের বাবদে ধার শুধে জমির কাগজ নিয়্যা যেও। তবে জমির কাগজটা ভোটার কার্ড বানাতে লাগবে; তা না হয় ভোটার কার্ড বানায়েই জমির কাগজ দেব। আর ভোটার কার্ড বাবদ মাথাপিছু হাজার টাকা দে কার্ড ছাড়াইয়্যা নে যাবে
      পঞ্চায়েতের বিবেচনায় মুগ্ধ কল্পনা-মথুরা-দেবকী গদগদ হয়ে সব শর্ত মেনে নিল। দেবকীর জমি বাবদ টাকার বাটাও তিনিই ব্যবস্থা করে দিলেন। দু ভাইয়ের আলাদা আলাদা খাতার ব্যবস্থাও তিনিই করলেন। গোলামের সাথে কল্পনাদের তিনজনকে পাঠিয়ে দিলেন বাদাবনের দিকে জমিটা দেখে নিতে, যাতে পয়সার লেনদেন করে কাগজ বানানোর আগেই ওরা বেছে নিতে পারে মনমত দাগগুলো।
কল্পনারা যে বনের পাশে ক ছটাক ঘাসজমি দেখল তার মাপ মোটেই বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু শিকড় গাড়ার অমোঘ আকর্ষণে চোখের সামনের জমি মাত্রই নিতে রাজি হয়ে গেল। জমিটা জঙ্গল কেটে বাগাতে যে হবে সেটা বুঝল; কিন্তু জমির বুক চিড়ে নদীর থেকে আসা নালাটা বেয়ে জমিতে ঢোকা জোয়ারের জল, বেনোজলে যে মাটি নোনতা করে দেবে, অনেক খরচ করে বাঁধ না দিলে ধান কোন দিন হবেই না এসব তারা বুঝতেই পারল না ডাঙা দেশের লোক বলে। উল্টে কল্পনা খুব খুশি হল যে দু ভাইয়ের জমির সীমা চিড়ে বয়ে চলা খালটার জন্যই কোন দিন জমির সীমা নিয়ে বিবাদ হবে না; মথুরা খুশি হল নালার জলে সহজে সেচ করা যাবে দেখে, ফসল অনাবৃষ্টিতে মরবে না আশা করে। দেবকী ভাবছিল এবার বিয়ে করবে একটা; দশ বিঘা জমি তার একার; কেউ নেই মাথা গলাবার !
পঞ্চায়েতের গদিতে ফিরে গিয়ে দেখা গেল যে তিনি আপিসে গেছেন। কল্পনারা গোলামের সাথে আপিসে গিয়ে জানাল যে জমি তাদের পছন্দ হয়েছে। সেখান থেকে বেরোবার আগে রবিবাবু বারবার করে বুঝিয়ে দিলেন জমি বাগাবার সময় কোনো লোক সাকিন বা ভোটার কার্ডের কথা জানতে চাইলে কি বলতে হবে; জঙ্গল কাটতে মানা করলে কী করতে হবে এইসব। সবশেষে আশ্বাস দিলেন বিপদ মনে হলেই তাঁর কাছে চলে আসতে; খুব ঝামেলা হলে তিনি সব সামলে দেবেন, না হলে তিনি পঞ্চায়েত কিসের।
দুপুরের খাওয়া গোলামের ঘরেই সেরে নিল কল্পনারা। তারপর ফিরে এল তাদের নৌকায়; যদ্দিন না জমির কাগজ হচ্ছে তদ্দিন থাকতে হবে নৌকাতেই। কুচোগুলো ছইয়ের ভেতর গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে; দু রাতের নৌকা বাওয়ার ক্লান্তিতে ঘুমোচ্ছে মথুরা-দেবকী দু ভাইও, পড়ন্ত রোদে শুয়েই, মড়ার মত। হালের কাছে বসে কল্পনা আকাশ-পাতাল ভাবছিল। বেলা আর একটু পড়ে আসতে দু-চারটে করে নৌকা ভিড়তে লাগল ঘাটে। এর মধ্যে একটা নৌকা নোঙর করল কল্পনাদের নৌকার গা ঘেঁসে।
নৌকা থেকে কল্পনারই বয়সই একটা মেয়ে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলল, দিদির বুঝি আজই আসা হল? সংক্ষেপে ঘাড় নাড়ল কল্পনা। মেয়েটা আবার বলল, আমি জবা। আমাদের ছ মাস হল
লজ্জা ভেঙে কল্পনা বলে ফেলল, জবাদি এহানে কোনো জানা শুনা নাই। আমার নৌকায় কাল অব্দি খোরাকি আছে; তারপর ব্যবস্থা করতেই হবে; ইদিকে হাতের টাকাও-
জবা মাঝপথেই জবাব দেয়, পঞ্চায়েতের বউ বন্ধকী কারবার করে; কানের দুল দুটো তোমার বোধ হয় রূপোর; হয়ে যাবে হপ্তা খানেকের যোগাড়
কল্পনা ককিয়ে উঠল প্রায়, একটা কাজেরও যোগাড় চাই আমার; মরদ দুটা ত জমি বাগাতে লাগবে। আমাদের খোরাকির জন্য আমাকেই যেতে হবে কাজে…………। দিদি গো! একটা পথ তুমি ঠিকই জাইনবা!

    
* * * * * * *
    

দরজায় টোকা পড়ছে। ঘুম ঘুম আবেশটা কেটে গেল রমিতার। অভ্যেস মত সাড়া দিয়েই দেখে নিল কটা বাজে। চেক-ইন আর কেবিন লাগেজ নেড়ে চেড়ে নিয়ে, হাত ব্যাগ হাতড়ে টিকিটটা দেখে নিয়ে রমিতা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ল্যাণ্ডলেডি দাঁড়িয়ে আছেন ডাইনিং-এ। খেতে বসতে বসতে রমিলা চেকটা দিয়ে দিল ওঁর হাতে। ঝলমলিয়ে উঠে উনি একটা ফেয়ারওয়েল স্পীচও দিয়ে দিলেন।
     দু-প্রস্থ লাগেজ নিয়ে পিজি থেকে বেরিয়ে এসে রমিতার মনে পড়ল ট্যাক্সি ডাকা হয় নি। ফিরে গেল আবার গলির মধ্যে। সামনের বাড়িটায় কেউ থাকে না অনেক দিন। বাড়িটার সামনে কোন ল্যাম্পপোস্টও নেই। বাড়িটাকে ঘিরে জমে ওঠা অন্ধকারে ঢুকে পড়ল রমিতা। চটপট চারপাশে কেউ দেখার সম্ভাবনা আছে কি না দেখে নিয়ে লাগেজ দুটোকে একে একে মাথার ওপর তুলে পার করে দিল বাড়িটার পাঁচিলের ভেতর। তারপর চলল অটো স্ট্যান্ডে।
     মিনিট পনের লাগল ট্যাক্সি নিয়ে ফিরতে। ভীষণ টেনশন নিয়ে ট্যাক্সিটা আলোর শেষ প্রান্তে রেখে এসে রমিতা আবার ঢুকে পড়ল একলা বাড়ির অন্ধকারে। ঠিকঠাক মনে করতে পারল না কোথায় রেখেছে লাগেজ দুটো। অগত্যা টপকে নিল পাঁচিলটা। তারপর পাঁচিলের একমাথা থেকে আরেক মাথায় হাতড়ে হাতড়ে পেয়ে গেল লাগেজ দুটো। আবার সেগুলোকে একে একে এবং নিজেকে পগার পার করে ফিরে গেল ট্যাক্সির কাছে।
     সারা রাস্তা যেতে যেতে রমিতার কেবলই মনে হচ্ছিল রাত দুটোর ফ্লাইট; অফিস পিক আপ দিতে পারত। না দেওয়ায় পাওয়া থ্রিলটা সাংঘাতিক; কিন্তু এতটারও দরকার ছিল না। এবং ভাবতে ভাবতে কোম্পানীর বিরুদ্ধে মনে মনে অভিযোগের পাহাড় জমিয়ে তুলল। অথচ, চাকরি-বাকরি করতে হলে এ সব ঝামেলা পোয়াতেই হবে বোধটাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে সয়ে নিল।
     এয়ারপোর্ট পৌঁছে রমিতা লাগেজদুটো নিয়েই গেল ফোন বুথে। ফোনটা রমিতার মা-ই ধরলেন। অনেক আতঙ্কের মধ্যে মুখ্য ছিল পড়শী টুকলুর মায়ের ভবিষ্যত বাণী। কয়েকবার এড়িয়ে গেলেও শেষ অবধি রমিতা বলতে বাধ্য হল, হ্যাঁ, মা, ডিগ্রী পাওয়ার পর টুকলু আর তোমার মেয়ে রু সমান সমান। ফার্স্ট-সেকেণ্ড পজিশনগুলো কিংবা পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর ইস্কুল কলেজ টপকাবার পর গৌণ হয়ে যায়। আর চাকরি পাওয়া না-পাওয়াটা অনেক বেশী বাজার নির্ভর। বাজার ভালো থাকলে ক্লাসের শেষতম ছাত্রেরও চাকরী জুটে যায়। সুতরাং আমি টুকলুর সাথে কম্পিট করতে গেলে চারপাশের কম্পিটিশন থেকে পিছিয়ে পড়ব। সুতরাং টুকলুর মায়ের সাথে আর কোন তর্ক নয় ক্যারিয়ার নিয়ে, বুঝলে?
ফোঁস করে মায়ের দীর্ঘশ্বাস পড়তে শোনা গেল, তা হলে মেধার আর কী মূল্য রইল বল; যে মাথার জোরে পড়ল আর যে বাবার পয়সার জোরে দুজনেরই মান সমান হয়ে যাবে?
রমিতা হাসি চেপে, ছদ্ম গাম্ভীর্যে বলে, তুমি আমাকে টুকলুর সাথেও তুলনা করবে? তোমার চোখে আমিই বেস্ট বাচ্ছা যেমন তেমনি টুকলুও তার মায়ের কাছে; ভদ্রমহিলা তোমার ওপর না হয় খানিক চালই নিয়েছেন তাই বলে দুনিয়ার হাজার কিসিমের মাপের সামনে আমি আর টুকলু ছোট বা বড় হয়ে যাই কি? তুমি যার সাথেই তুলনা করবে দেখবে আইম দ্য বেস্ট; প্রতিপক্ষ টুকলু, ইন্দিরা গান্ধী বা আইনস্টাইন যেই হোন না কেন। কিন্তু সত্যি কি মাপা যাবে আমাকে বা অন্য কাউকে? টুকলুর সাথে তুলনা করে আজ দুঃখ পাচ্ছো। কাল দেখবে জনার্দনের মত ক অক্ষর গোমাংসও আমার আপিসে কাজ করে। এত অহংকার কোর না
মা বললেন, তা তো বুঝলাম যে আমার মন ছোট, আমি অহঙ্কারী। কিন্তু টুকলুর মা যে বলল প্রাইভেট চাকরির কোন ভবিষ্যত নেই; বিদেশে যদি তোর চাকরী চলে যায়?
রমিতা একটু জোরে শব্দ করেই হেসে ফেলল; চারপাশের কেউ কেউ ঘুরেও তাকাল তার দিকে; দেখে মাউথপিস আর ঠোঁট যথা সম্ভব হাত দিয়ে ঢেকে নিয়ে বলল, কামন মা, বিদেশে চাকরী গেলে কোম্পানি দায়িত্ব নিয়ে আমাকে দেশে ফিরিয়ে খাতা থেকে নাম কেটে পাওনা-গণ্ডা বুঝিয়ে মুক্ত হবে; বিদেশে বেকার হয়ে মোটেও ভিক্ষে, চুরি কিংবা বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য হব না বাতুলতার সভ্যসীমা অতিক্রম করায় মা প্রবল বকা-ঝকা শুরু করলেন। সেই গজগজানির মধ্যেই রমিতা প্রগলভতার জন্য মাফ চেয়ে নিয়ে বলতে থাকে, তোমার ভালো মেয়ে ভাও মেয়েতাই থাকবে গো! কাজের কথা শোন ওখান থেকে রোজ ফোন করতে পারব না; দেখ বাড়ির কাছাকাছি কোন সাইবার কাফে আছে কি না; ছুটির দিনে ভিডিও চ্যাট করতে পারি। তোমার থেকে আমি তের ঘন্টা পিছিয়ে চলব। না হলে বাবাকে বোলো রোজ অফিস থেকে ই-মেল চেক করে নিতে; আমার জরুরী কিছু বলার থাকলে তোমাদের, তোমরা জেনে যাবে। না হলে ভাইকে রোজ ফোন কোরো। ওর সাথে আমার রোজ যোগাযোগ থাকবে আশা করছি ………………… ফোনের অন্যপারের আভাস মেলে, রমিতাই বলতে থাকে, মা, তুমি কাঁদছ? কেন? ফোঁপাতে ফোঁপাতে মা জবাব দেন, কত দূরে চলে যাচ্ছিস! কবে আবার দেখা হবে তোর সাথে কে জানে; বলিস নি তো রোজ ফোনও করা যাবে না!……………………জবাব দেয় রমিতা, জানলে যদি যেতে না দিতে চাও? তাই বলিনি; এটাই তো চেয়েছিলে যেন তোমার মত বন্দীত্বের জীবন না হয় আমার; যেন রোজগেরে হই। হয়েছি। হ্যাঁ তুমি ভেবেছিলে নিদেন পক্ষে সরকারী আপিসের স্টেনো টাইপিস্ট যেন হই। তার বদলে অন্য কিছু হয়েছি। ভাল না মন্দ হয়েছি সে তর্কে যাচ্ছি না; কিন্তু রোজগার করছি, নিজের খেয়ালে ভাসতেও পারছি; তোমার বাঁচার শর্তের থেকে আমার বাঁচার শর্তগুলো আলাদা। ঘরে-বাইরের রোজকার লড়াইটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়ত কঠিনতর হয়ে উঠবে ক্রমশ, কিন্তু আমি তো আমার মেয়ের চোখে তার বাবাকে শত্রুশিবিরের লোক ভাবতে শেখাব না। ফ্যামিলি হলে মোর ব্যালান্সড হবে। শেষ কথা গুলোয় আবার আমাকে শত্রু বানিও না। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো। আমি সিকিউরিটি চেক সেরে একটা বই পড়ব। ফ্লাইট রাত দুটোয়; আমি এরপর আর যোগাযোগ করতে পারব না। আর স্যান ফ্র্যান্সিস্কো পৌঁছে সময় মত ফোন করব। আজ থেকে ঠিক চার দিন পর সকাল বেলায়। ঠিক আছে ?
ধরা গলায় মা বললেন সাবধানে যাস, দুগ্‌গা, দুগ্‌গা
     পাশের সিটের ছেলেটা বলল, আপনি বাঙালী? হাতে ধরা কালকূটের শাম্ব, রমিতা অস্বীকার করার কোন রাস্তাই খুঁজে পেল না। তারপর নাম কি, কোথায় বাড়ি ক ভাইবোন, কোন কোম্পানি, ক্লায়েন্ট কে, ফ্লাইং-এর কারণ ওয়াই-টু-কে কি না, প্রথমবার ফ্লাইং কি না - ঝালাপালা অবস্থা হল রমিতার; মনে মনে নিজেকে গাল পাড়তে লাগল, ট্র্যাভেল টাইমে কালকূট না পড়লেই চলছিল না? বুদ্ধুরাম! এখন ঠেলা সামলাও।
ছেলেটির নাম সৌরভ। আর্মহার্স্ট স্ট্রীট সিটিতে কমার্স করেছে; তারপর চাকরির ফিকিরে সি এম সি থেকে পি জি ডি সি এ। তারপর বছর তিনেক ধানবাদ, রাঁচি, সেকেন্দ্রাবাদ করে এখন স্যান ফ্র্যান্সিস্কো যাচ্ছে। টিকিট দিয়েছে ওয়াই টু কে।
     একফাঁকে বইটা বদলে নিল রমিতা। তারপর সুযোগ বুঝে সৌরভকে শুনিয়ে দিল, দেখেছেন, গাইডবুকে লিখেছে উড়ানের সময় ঘুমোন ভাল? সৌরভ শাম্বটা রমিতাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে, গাইডটা নিল; জবাবে জিজ্ঞেস করল, বললেন না তো, কোথা থেকে বি ই করেছেন? রমিতা বলল, বলিনি বুঝি? এই অল্প সময়ে এত কথা বলেছি……; শিবপুর বি ই থেকে কম্পিউটার সায়েন্স পড়েছি। আরও একটু জল খেয়ে রমিতা হাই-টাই তুলে, আড়ামোড়া ভেঙে ঘুমিয়ে পড়ল।
     ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকে স্যান ফ্র্যান্সিস্কো অবধি পথে মেম বুড়ির পাশে বসে দিনের বেলার রোদ ঝলমল আকাশ দেখে কাটিয়ে দিল রমিতা। প্রথমত, মেম দিম্মা খিটখিটে নন মোটেই; কালো চামড়া যুবতীটিকে তিনি কোনো বিরক্তি কিংবা কৌতুহল উপহার দেন নি। রমিতার কেবলই আনন্দ হতে লাগল ছোটোবেলায় নতুন খেলনা পাওয়ার মত; আবার থেকেই থেকেই মনে হচ্ছে , কত বড় হয়ে গেলাম! দুবছর আগেও মনে হয় নি মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে আমি আট হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছি একদম একা একা! কিন্তু তবু মেঘের মধ্যে ভাসছি বুঝতে পারলেই ছোট্টোবেলার থ্রিল!
     স্যান ফ্র্যান্সিস্কো থেকে মন্টেরি পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। হোটেলে চেক ইন করে বাড়িতে ফোন করল রমিতা। শুধু বহাল তবিয়তে পৌঁছনোর খবর দিতেই তিরিশ ডলার গলে গেল। সুতরাং দুধ-পাঁউরুটির ডিনার সেরে ঘুমোতে যেতে হল রমিতাকে।
     পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল নতুন জীবন, নতুন যুদ্ধ ; বসতি বিস্তারের ব্যস্ততা আর অফিসে ক্ষমতা প্রমাণের আপ্রান চেষ্টা। দিন গুলো কেটে যেতে লাগল হৈ হৈ করে।



* * * * * * *


     দিশার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সে আর অ্যাস্ট্রনমার হচ্ছে না। স্বপ্ন ভাঙার দুঃখ উদযাপণেরও কোনো সুযোগ নেই। রোজগার তো করতেই হবে; তাই কাল থেকে সে চাকরি জোটাবার জন্য উঠে পড়ে লাগবে বলে ঠিক করেছে।
আজ নয়; কারণ আজ প্রিয় বন্ধুদের সাথে দেখা করার শেষ দিন। তাই উতলা মনে প্রমোদদার ক্যান্টিনে বসে মেয়েটা টিং টিং পা নাচাচ্ছে; উত্তেজনায় না বিরক্তিতে বোঝার কোনই উপায় নেই; হাতে ধরা বইটা থেকে চোখ তুলছে না একবারও।
     মায়াঙ্ক আর মিলিন্দ এসে বসল ওর টেবিলে; বেশ তর্ক চলছিল দুজনের। দিশা মুখ তুলে তাকালও না একবারও। মায়াঙ্ক তর্ক ছেড়ে কেড়ে নিল দিশার বইটা। মিলিন্দ বলল, চল ডিপ্‌ থেকে ঘুরে আসি। তারপর কোথাও বসব।
ঝাঁই ঝাঁই করে উঠল দিশা, আমাকে আসতে বলে এক ঘন্টা বসিয়ে রাখার ফাইন দে; তবে যাব।
স্বভাবসিদ্ধ মিনমিনে স্বরে মিলিন্দ বলল, আজও ফাইন নিবি ? তুই একটা বাজে মেয়ে!
এই সময় মায়াঙ্ক এক টুকরো কাগজ দিল দিশার হাতে; দিশা রাগ রাগ মুখে দেখল কাগজটায় লেখা আছে ফাইন। তারপর দিশার ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে বলল, পা দুটো ব্যবহার করবি ? না কি -?
আর বকিস নি; তোর একমাত্র প্রেমিকার কানে গেলে আমাকে শূলে দেবে। বলে খ্যাক খ্যাক হাসতে লাগল দিশা। এবং মিলিন্দ একটা পয়েন্ট পেয়ে বলল, ওর প্রেমিকা তোকে শূলে দেবে কেন? ওকে দিয়ে ব্যাগ বওয়ালি বলে?
না তো; ওর প্রেমিকা শূলে দেবে একটা বাজে ছেলের সাথে প্রেম করার জন্য আমি ভদ্রমহিলাকে বার খাইয়ে টং করেছিলাম বলে।
ও আমি কিছুই করিনি, সব ক্রেডিট তোমাদের, না! কিন্তু দিশা, তুই আমাকে বাজে ছেলে বললি কেন?
     এই সব কূট তর্কে তর্কে কেটে গেল দিনটা। সূর্যাস্তের আলো মেখে তিন তরুণে এগোচ্ছিল শহীদ মিনার থেকে চাঁদপাল ঘাটের দিকে; মায়াঙ্ক বলল, তুই তা হলে, পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াই ঠিক করলি?
দিশা বলল, রাতভোর পড়ার পরে যদি দেখি রেজাল্টে পারফরমেন্সের রিফ্লেকশন আনার জন্য নতুন পরতে শেখা মিনিস্কার্ট কিংবা ট্যাবিউলেটারের দয়াই ভর্সা, তখন রেজাল্ট ভালো রাখার পড়াশোনা করতে আর সাহস হচ্ছে না। এই নিয়ে কতবার বললাম তোকে? মিলিন্দ জবাব দেয়, চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মানে আছে? তোকে এখানেই যে পড়তে হবে তাও না; পুনে-তে যাওয়া হলো না, অন্য কোথাও যেতিস; তুই অ্যাডমিশন টেস্টগুলোই দিলি না। চাকরি খুঁজবি ভাল কথা; কিন্তু এত পেসিমিস্টিক অ্যাপ্রোচে হবে না; এলিজিবিলিটি শোকেস করতে গেলে পজিটিভ অ্যাটিচ্যুডটাও লাগবে।
এবার আমি ভোট অফ থ্যাঙ্কস্‌ দিচ্ছি আমাদের বড়দা মিলিন্দ মহারাজকে। দিশা বলা মাত্রই তিন জনে হেসে ফেলল। তারপর দিশাই বলল, আমি প্রেসির আই এ এস ট্রেনিং সেন্টারে গিয়েছিলাম। খরচের বহরে সাহসে কুলোল না। শুরুও হয় সন্ধে সাতটার পর। রাতে কলকাতায় থাকার জায়গা বাগাতে হবে। বাড়িতে সাপোর্ট চাওয়ার সাহস নেই; ইচ্ছেও নেই; আবার শর্ত পালন না করতে পারলে টেকা দায় হবে। অতএব বন্ধু আমার রেস্ত পাঁচটা টিউশন রেখে আমাকে ময়দানে নামতে হবে। জবাব দিল মায়াঙ্ক, তুই অপদার্থ! তোর মিনিস্কার্ট আর ট্যাবিউলেটারের ল্যাং খাওয়াই উচিৎ।
তুইও অপদার্থ; কেরিয়ারিস্ট! মনে করে দেখ তিন দশক আগে এই রাস্তায় তোর বাবা ভিয়েতনামের পক্ষে কিসিংগারকে গালি দিতে দিতে হেঁটেছিলেন আর মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদের গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো করেছিলেন; আর তুই তাঁর ছেলে হয়ে কেবল ফার্স্ট হওয়ার খোয়াব দেখিস!
মায়াঙ্ক প্রতিশোধে পেছপা নয়; জবাবে বলল, সে তো তোর বাবাও হেঁটে ছিল; কিন্তু আপিসের পর নিজের দুপায়ে; আর তোর ছেলে যে তোর পয়সায় ইন্টারনেট ফোরামে ফোরামে ব্লগিয়ে পৃথিবীতে যুদ্ধ বন্ধের শ্লোগান তুলবে তখন কি তুই নিজের দোষ দেখবি? বলবি তোর ছেলেও অপদার্থ।
     এলোমেলো আলোচনাতেই তিন বন্ধু ভেসে গেল।
     পরদিন থেকে নতুন পরিবেশ। কম্পিউটার ক্লাসের ষোলটা মেয়ের সামনে কৌশিক নামে একটা লোক হাত-পা নেড়ে সমান তালে চল্লিশ শতাংশ পড়াচ্ছে আর ষাট শতাংশ ফ্লার্ট করছে। দিশা সব দেখে শুনে আধঘন্টা পর থেকে আর চাপতে পারল না হাসিটা; চশমা পর্যন্ত রুমাল ঢাকা দিয়ে হাসতে লাগল। কৌশিক দেখে খুশি যে হয় নি তাও বোঝা গেল। এবং প্র্যাকটিক্যাল সেশনে পড়া বোঝাবার অজুহাতে মাউসের ওপর রাখা দিশার হাতটাকে দিল ভীষণ মুচড়ে, ঘাড়ের ওপর দিল দীর্ঘ নিশ্বাসের জ্বালা, মুভেবল চেয়ারটা কিছুতেই দিশা নাড়াতে পারল না; ওটার ব্যাকরেস্টটা কৌশিক ধরে রেখেছিল শক্ত হাতে।
     তারপর থেকে মাথা ঝিম-ঝিম, গা-গোলানো যখন তখন নাস্তা-নাবুদ করে ফেলত দিশাকে; অস্বস্তির আবির্ভাবটা দিশার নিয়ন্ত্রণে ছিল না; বই-খাতা বাইসাইকেল কখন কোনটা ছুঁলে গা গুলিয়ে উঠবে বেচারি বুঝত না।
মাস ছয়েক পরে ক্লাসের চেহারা ছোটো হতে হতে অর্দ্ধেক যখন, তখন সুস্মিতার সাথে দিশার বন্ধুত্ব প্রায় পূর্ণ; একটা অপ্রত্যাশিত ক্লাস ছুটি হয়ে যাওয়া দুপুরে দুই বন্ধু আলোচনা করছিল কেন কৌশিক দিশার ওপর খাপ্পা, কেন কৌশিক জোর দেখিয়ে হেনস্থা করতে আসে দিশাকে বারবার। এলোমেলো অনেক কথার পর দিশা বলে ফেলল সব কথা সুস্মিতাকে। মেয়েটা রেগে গেল; কিন্তু পরদিন থেকে নিজেই দিশার ঢাল হয়ে দাঁড়াল।
এবং দিশা সাহসে দুর্নিবার হয়ে কৌশিকের হাতে তার যৌন হেনস্থা হওয়ার কথা জানিয়ে কৌশিকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানাল কর্তৃপক্ষের কাছে । এরপর প্রিপেইড কোর্সের দিনগুলো আরও দুরূহ হয়ে উঠল; কিন্তু শারিরীক ভাবে ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে পড়তেও দিশার সাহস বেড়ে চলল অগাধ। মনপ্রাণ জুড়ে টের পেতে লাগল বেদনাতে জেগে ওঠা চেতনা।
এর মধ্যে শনি-রবির ছুটিতে দিশা শিখতে শুরু করেছে ফরাসি। ওখানেই আলাপ হল আকাশের সাথে। তখন আবার দুজনেই চাকরি খুঁজছে। তাই বন্ধু হতে বেশী সময় লাগে নি। তারপর সুদীর্ঘ দূরভাষালাপে ভাসতে ভাসতে দুটি প্রাণী ভয়ানকভাবে সামিল হয়ে গেল পরস্পরের দুঃখে, সুখে। তারপর ক্রমশ দাবী জন্মাল একের ওপর অন্যের; এসে গেল চাওয়া-না-পাওয়ার খেলা; অভিযোগ অভিঘাতের দিন।
দিশার বাড়িতে যেসব দিন কোন সুপাত্রের সন্ধান আসে তারপর সাতদিন বাড়িতে সবার সাথে দিশার কথা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা অবধারিত। অথচ আকাশের সাথে এমন কোনো কথা হয় নি যে দিশা একটা প্রতিবন্ধক দেখাতে পারে বাবা-মাকে। এরকমই একটা দ্বন্দ জর্জরিত সন্ধেবেলা দিশা আকাশের কাছে বাড়িতে সুপাত্রজনিত ঝামেলার কথা বলে ফেলল; এবং আকাশের জবাবে ভীষন হতাশ হল; কেবলই ভাবে কী করে বলল বিয়ে করে ফেলতে অন্য লোককে? গত এক বছরে যতটা সময় আমরা একে অপরকে দিয়েছি সেটা কি শুধুই পরীক্ষার প্রিপেরেশনের জন্য; আর কোন আবেগ অনুভূতি ছিল না?
প্রশ্ন শুনে সুস্মিতা বলল, ওরে আমার বস্তা-পচা আবেগের সোনা, জীবনের সার হল ব্যবহার করা, নিজেকে এবং অন্যকেও। নিজেকে ব্যবহার করার নাম ব্যবহৃত হওয়া বলেই কি এতটা ফিলোসফিক হয়ে যাবি ? দেখ আমাকে, যদি স্ট্রেট না হতাম, তোর মেনি মুখো আকাশের ঢের আগে আমি তোকে নিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যেতাম এবং দুজনে রেল স্টেশনে জুনের শেষ দুপুরের রোদে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
পরের রোববারে পরীক্ষা শেষে, আকাশ পি এস সি বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে বলল, চল, এস্‌প্ল্যানেড হয়ে যাই, বাড়িতে ফোন করে দে আমার সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরবি  আশা নিরাশার চমকে দিশা বলল, এস্‌প্ল্যানেড হয়ে গেলে দেরী কেন হবে? ও তো রাস্তাতেই পড়বে আকাশ জানাল একটা রেস্তরাঁতে বসব, খানিকক্ষণ, তোর আপত্তি আছে? ভয় পাওয়া মুখে দিশা ঘোষণা করল, আমার পকেট ফাঁকা রে আজ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে আকাশ জানাল, আমি আছি না! এস্‌প্ল্যানেডে মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়েই আকাশ যাবতীয় হকারকে ডেকে ডেকে জানতে চাইছিল, মিটিং কি শেষ হয়ে গেছে? লোক জন কোন দিক দিয়ে বের হচ্ছে বলুন তো? দিশা এত ভোরে এলাকাটা দিয়ে গেছে যে মিটিং-এর কিছুই টের পায় নি। কিন্তু আকাশের সঙ্গে ঘুরে এত নতুন কিছু জানতে পেরেছে দিশা যে নতুন ঘটনার আকর্ষণে ও আকাশকে অনুসরণ করতে লাগল। গান্ধীমূর্তির কাছে এসে দেখল একটি লম্বা কালো বেশ সুন্দর দেখতে মেয়ে অফ হোয়াইট স্লিভলেস সালোয়ার-কামিজ পরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ জানাল মেয়েটির নাম বন্যা। তিনজনে গিয়ে বসল মাদ্রাজ ক্যান্টিনে। দিশা বন্যাকে জিজ্ঞেস করল, তুই কি সক্রিয় রাজনীতি করিস নাকি? বন্যা বলল, আমার কাকু অ্যাকটিভ মেম্বার পার্টির; বাবা-ও পলিটিক্স করেন দিশা বলল, অত দূর থেকে এলি, তুই কি রাতের কোনো এক্সপ্রেসে ফিরবি? বন্যার হয়ে আকাশ জবাব দিল, ও একা ফিরতে পারবে না, আমি ওকে কাল পৌঁছে দেব দিশা বলল, ও তাহলে তোদের বাড়ি থাকবে আজ রাতে? হি হি করে হাসতে লাগল বন্যা, আকাশও। এবার বেশ বোকা লাগছে নিজেকে দিশার। হাসি থামিয়ে আকাশই বলল, না শরৎ বোস রোডে স্যামিলটন বলে একটা হোটেল আছে, আমরা আজকে ওখানে থাকব দিশা চোখ গোল গোল করে বলল, ডেটিং। তবে যে বললি তোরা বিজনেস পার্টনারস? বন্যা আকাশের শরীরের আনাচকানাচে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমার বাড়িতে সবাই জানে; ওর বাড়িতে ও এখনও জানায় নি; তা ছাড়া জানলে তো বিয়ে অবধি আমাদের যখন-তখন একসাথে থাকার অসুবিধে হবে। আমি আজ মিটিং-এ এলাম, তারপর বিজনেসের কাজ করলাম, কাল ও আমার সাথে বিষ্ণুপুর যাবে নতুন অর্ডার দিতে……। এভাবেই চলছে। মুচকি হাসিটা মেয়েটার চোখে চিবুকে ঝলমল করছিল। আকাশ বলল, ও বি এ পাশ না করা অবধি বাড়িতে জানাতে পারব না রে; তা ছাড়া আমি সত্যিই হ্যাণ্ডিক্রাফ্‌ট এক্সপোর্টের ব্যবসা করি। ওর সাথে আলাপ যখন তখন কলেজে পড়ি; বিষ্ণুপুর গিয়েছিলাম বেড়াতে; ওর সাথে পেন ফ্রেণ্ডশিপ ছিল, প্রেমটা মাস চারেকের, হ্যাণ্ডিক্রাফ্‌ট এক্সপোর্টের কাজটা শুরু করার পরের; নতুন করে বিষ্ণুপুর যাতায়াতে-। আমার পুরোন প্রেমটা রিভাইভড হয়ে যায়। আকাশকে মাঝ পথে থামিয়ে বলে দেয় বন্যা। তবে বন্যার মধ্যে ক্রমশঃ আনা কুর্নিকোভাকে এনরিকের  অ্যালবামের বাইরেও জেগে উঠতে দেখে উত্থাপামটা আধখানা রেখেই উঠে পড়ে দিশা; খরচা তো আকাশের এক্সপোর্ট কোম্পানির। তবুও চৌরঙ্গী স্ট্রীটটা পেরোতে গিয়ে বার তিনেক বাসে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যায় দিশা। একটা মিনি বাসে চড়ে হাওড়া আসার পথে বাসের শব্দে গলা ছেড়ে গান ধরে দিশা, আরো আরো প্রভু, আরো আরো। কেন তা আর বোঝার চেষ্টা করে না।
তারপর পূজোর সময়ে মায়াঙ্ক, মিলিন্দের সাথে দিশা আলাপ করিয়ে দিল সুস্মিতার। সেদিন খুব জমাটি খাওয়া-দাওয়া হল; মিলিন্দর থেকে দুবছর আর মায়াঙ্কের থেকে এক বছরের খাওয়া দিশার পাওনা ছিল, দুজনের চাকরি বাবদ; দিশার চাকরি শুরু হতে মাস দুয়েক বাকী, তাই তিনবন্ধু ওকেও ছাড়ল না। সুস্মিতাও গুড়্গাঁওতে তখন চাকুরিরতা; সেও তাই নতুন আলাপের উদযাপণে সামিল হল দরাজ মনে।


* * * * * * *


রমিতা ব্যাঙ্গালোর অফিসের লিফটে মুখোমুখি হয়ে গেল সৌরভের । ছ-সাত বছর পর; ঠিক চিনে উঠতে পারল না দুজনেই। সাধারণ হাই-হ্যালোর থেকে কোথায় যেন দেখেছি-র গবেষণা করতে করতে খুঁজে পাওয়া গেল ও আপনিও ক্যালিফোর্নিয়ায় ছিলেন, তখন!  তারপর ফ্লাইটের কথা মনে পড়তে বেশি অপেক্ষা করতে হয় নি। এলিভেটর মাটি ছুঁলে রমিতা লাউঞ্জে বসে থাকা এক যুবকের দিকে এগিয়ে গেল; আলাপ করিয়ে দিল, মিট মাই ফিয়ন্সে রামকি তারপর রামকির দিকে ঘুরে বলল, রামকি, দিস ইস সৌরভ, অ্যান ওল্ড অ্যাকোয়ান্টান্স কারুরই তাড়া না থাকায় ওরা গিয়ে বসল কফি নিয়ে।
কথায় কথায় জানা গেল সৌরভ ২০০১-এই ফিরে এসেছিল দেশে। ওর এইচ ওয়ান-টা রিনিউয়াল হয় নি। তারপর কয়েক বছর ধানবাদ-মোরাদাবাদ-কলকাতা করে আজ এসেছিল রমিতাদের ওখানেই ইন্টারভিউ দিতে। তখনই জানা গেল রমিতাও কোম্পানি ছেড়ে দিল । রামকি যদিও ২০০২ থেকেই আমেরিকান ফার্মে কাজ করছে, যদিও রমিতা প্রায় দুবছর যাতায়াত করেই চালাল, এবারে ও নিজেও একটা কাজ পেয়েছে রামকির অফিসের কাছাকাছি এক জায়গায়। এবারে ওরা একটা সংসার পেতে ফেলবে ঠিক করেছে।


 * * * * * * *


     মিলিন্দর সাথে দিশার দেখা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। মিলিন্দ খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছে; বাবার এই অপরেশনের সময়ে সব খরচা তো কোম্পানীর ইন্সিওরেন্স থেকেই হয়ে গেল; এখন চাকরিটা ছেড়ে ইউ এস গিয়ে রিসার্চ করতে শুরু করলে-। বক্তব্য শেষ করল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
 দিশা বলল, বাবার ব্যাপারটা তোর দায়িত্ব আবার রিসার্চটা তোর অ্যাম্বিশন; দেখ কি ভাবে ব্যালান্স করা যায়। আমার তো রিসার্চ করার ইচ্ছে নেই; কিন্তু চাকরিতেও এত নিরাপত্তা নেই যে আটকে থাকা যায়; আমি আর তিন বছর পরে যখন ছাড়ব তখন এত দ্বিধায় বোধ হয় পড়ব না
মিলিন্দ কৌতুহলী হয়ে উঠল, কেন তোদের মেডিক্যাল কভারেজ দেয় না? এবার দীর্ঘশ্বাস পড়ে দিশার, মাসে একশ টাকা মেডিক্যাল অ্যালাউন্স, থ্রু  রাঙ্ক অ্যাণ্ড ফাইল; চাকরি যায় না বলে সিকিওরিটি দেখে সবাই; কিন্তু মেডিকেল এমার্জেন্সীতে নিরাপত্তা নেই
প্রসঙ্গ বদলে মিলিন্দ বলে, ডিভোর্সের পর শুভ্রা বা মায়াঙ্ক কেউ যোগাযোগ করেছে? নাহ্‌, কি যে হল, মায়াঙ্ক কত ব্যস্ত থাকত যে শুভ্রা অ্যানিভার্সারিতে গিফ্‌ট হিসেবে ডিভোর্স দিল! বুঝি না কিছুই……। তুই তো কাছেই থাকতিস, টের পেয়েছিলি কিছু? জানতে চাইল দিশা।
মিলিন্দ যেটুকু জানত তাই বলল, দেখা হলেই শুভ্রা গজ গজ করত মায়াঙ্ক ওকে সময় দিচ্ছে না বলে; সে তো সব মেয়েই বরের নিন্দে করে। এত ভয়ানক রূপ নেবে অভিযোগগুলো মায়াঙ্কও টের পায় নি আবার প্রসঙ্গ বদলাল মিলিন্দই, তোর আকাশের কী খবর ? তুই কবে সেটল্‌ করবি ?
দিশা একটু চোখ গোল গোল করে তাকাল মিলিন্দর দিকে, সে কী রে তোর মনে আছে? আমি তো নিজেই সব পাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি
মিলিন্দ জিজ্ঞেস করল, মানে?
দিশা খুব দায়সারাভাবে জবাব দিল, বছর খানেক আগে জানিয়েছিল বিয়ে করছে ক্লাসমেট সম্পূর্ণাকে। আমি বিয়ের পর ফোন করে কন্‌গ্রাচুলেট করি আর বলে দি ভবিষ্যতে আমার সাথে সুস্থ বা মাতাল অবস্থায়, সশরীরে বা ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা যেন না করে, আমি ওকে আর চিনতে চাই না
মিলিন্দ অবাক হল, মেনে নিল?
 দিশা বলল, হিটলারী খাটিয়েছিলাম; স্টেটমেন্টটা রেখেই মোবাইলটা স্যুইচড্‌ অফ করে দিয়েছিলাম খানিক হেসে নিয়ে আবার বলল, আর মনেও পড়ে না; তোর খবর কি? কাউকে না পেয়ে হ্যাপিলি সিঙ্গল স্টেটাস অব্যাহ ? মিলিন্দ কোন জবাব দিল না। দিশাই আবার বলল, চল, কাল ভোরে আবার আরণ্যক ধরতে হবে মিলিন্দ এবার জবাব দিল, কাউকে পেতেই হবে এমন তো জরুরী নয়, না পেলেও জড়িয়ে পড়া যায়, আবার পেলে কি সব সময় জড়ানো যায়? বাদ দে; মেল-টেল করিস হতাশ গলায় দিশা বলল, আগে পাহাড়ে তবু উইক ডেস-এ আউটিং নিয়ে মিনিট কুড়ি নেট সার্ফ করা যেত। এখন যেখানে আছি সেখানে আমার অফিস ক্যাম্পাসটাই টেলিফোনিক বা ইলেক্ট্রিক কানেকশন আইল্যাণ্ড; ছুটির দিনেও ছুটি নেই তো ইউক ডেস-এ ব্রেক! ইন্টার নেট অনেক দূরের ব্যাপার। বাড়ি এলে দু-তিন মাস অন্তর মেল করতে পারি, তবে তুই তো পড়বিও না, জবাবের আশাও করিনা; তবু মায়াঙ্কর থেকে কিছু খবর পেতাম তোদের, তা সে ব্যাটা নিজেই এমন ঘেঁটে ঘ হয়ে আছে যে আরও কিছু একথা সেকথার পর যে যার রাস্তা ধরল।
     মাস তিনেক পরে, দিশা একটা চিঠি লিখল সুস্মিতাকে।
সু,
     তুই খুব চমকে যাবি এই চিঠিটা পেয়ে। কিন্তু আমি একমাত্র তোর কাছেই নিরাপদ। কারণ তুই এ রাজ্যের বাইরে থাকিস।
     আমি মরে গেলে হত্যা না মৃত্যু সেই তর্কের অবকাশে মৃত্যুর দলের লোকেরা হয়ত আমার পৈতৃক ভিটাকে তছনছ করবে, প্রমাণ লোপের তাগিদে। কিন্তু সে দলের লোকেরা ভাবতেও পারে না তোর মত বন্ধু আছে আমার।
     মরে গেলে কী করতে হবে তুই জানিস; এই চিঠিটার আসলটা রেখে বাকি কপিগুলো যুযুধান মিডিয়াগুলোতে পাঠাতে হবে। তবে মরব না বলেই এখনও বিশ্বাস রাখি।
     আমি ভাবছিলাম এতদিন বেনিফিসিয়ারিস বা টার্গেট গ্রুপের কথা না শুনেই সমস্যা তৈরী হয়েছে। টার্গেট গ্রুপের মানুষের সাথে মিশে বুঝতে পারলাম যে ওরা আমাকে বাইরের লোক এবং অবশ্যই ঝাড়ের বাঁশ বলেই মনে করে; বিশ্বাস করে না এক্কেবারেই। যত মিশলাম তত বিপদ ডাকলাম; প্রথমত, আমার ঝাড়ে আমি বেয়াড়া হয়ে গেছি; কারো কাজে (পড় স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে) আসছি না; মানে, ঝাড়ের বাকিদের থেকে আমার অবস্থাণ পৃথক হয়ে যাওয়ায় আমি ধোবি কা কুত্তা, না ঘাটকা না ঘরকা। দ্বিতীয়তঃ, বেনেফিসিয়ারিসদের মধ্যে আবার ওদের লোক আমাদের লোক আছে। মুণ্ডু বাঁচাবার তাগিদে এই ভাগের ফাটলটা আমি নিজেও খানিক চওড়া করে ফেলেছি।
     ফল সাংঘাতিক কিছু একটা হতে পারে। যেরকম রাজনৈতিক টাল-মাটাল অবস্থা এখানে, পাঁচ টাকা দিলে, এক ভাঁড় হাঁড়িয়ার লোভে যে কোন মাতাল আমার মুণ্ডুটা খসিয়ে দিতে পারে; ঘটনাটাকে দুর্নীতি পরায়ণ মানুষকে বিপ্লবীদের দেওয়া শাস্তি বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে; আমার মিনতি দি চেঁচামেচি করে একটা বড় রাজনৈতিক খেয়োখেয়ি বাধিয়ে দিতে পারে। হতে পারে অনেক কিছু। পাঁচ টাকা খরচা হবে নিশ্চয়ই সরকারী সিন্দুক থেকে, ওদের লোক বেনেফিসিয়ারীর হাত দিয়ে। ঠিক কে যে কখন কোনটা করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।
     যা হোক আমি চেষ্টা করছি ছুঁচো সেজে ঘুরতে। যাতে হাতের গন্ধ এড়াতে সবাই আমাকে এড়িয়ে যায়।
     চিঠিটার মানে তুইই বুঝবি তোকে অনেক কিছু ফোনে আর মেলে জানিয়েছিলাম তাই। এটা কাগজে লেখার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে ঘোষণা করা, আমি খুন হয়ে যেতে পারি কার হাতে জানি না, জানাও যাবে না; আমার সন্দেহ তালিকার সাপেক্ষে কোন প্রমাণ দাখিল করা মুস্কিল। হয়তো মামলার সাক্ষী শুরু হতে এত দেরী করবেন পি পি সাহেব যে তার আগেই সবার ন্যাচারাল ডেথ বা রিটায়ারমেন্ট হয়ে যাবে।
     নতুন কিছু শোনাতে পারলাম না বলে রাগ করিস; কিন্তু তিনমাসে আমি একদম ঘুমোই নি; প্রাণের এবং মানের ভয়ে। খুব ক্লান্ত হয়ে শুই, পাশ ফিরলেই টের পাই ঘুমোচ্ছিলাম না। একদিন খাতায় দেখলাম লিখেছি:
বনের মাথায় ঝলমলে চাঁদ ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকে। একসময়ে মনে হত, কোনো এক পূর্ণিমাতে চাঁদ বুঝি নেমে আসবে ছাদে, বসবে পাশে। এখন চাঁদ বড্ড দূরে; মনে হওয়াটা ক্লিশে হতে হতে মন থেকে মুছে গেছে। এত রং, এত রস, এত গন্ধ মহুয়া আর কাজুর সবে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে চৌর্য বৃত্তি। চোর বনা আর চোর ধরা এই দুটোই রয়ে গেছে অস্তিত্বের লড়াইয়ে স্পষ্ট হয়ে। আর সব বর্ণ, গন্ধ হারিয়ে গেছে লড়াইয়ে চুরমার ধূলোর মত। একা চাঁদ আর কত জ্যোৎস্না ঢালবে! না কি সব গন্ধ ছাপিয়ে ওঠা পচনের গন্ধে বিরক্ত চাঁদ পণ করেছে কখনও আসবে না নেমে নিজে থেকে; চোরের সাধ্যে কুলোয় আকাশের বুক থেকে ছিনিয়ে আনুক চাঁদ
     ভীষণ ভালো থাকবি।
দিশা


* * * * * * *


     তখন প্রায় বেলা দুপুর। কল্পনা মীন ধরে ফিরে এল নৌকায়। মেয়েগুলো এখনও লেগে আছে, যদি আরও কেজিটাক পাওয়া যায়। ছেলেটা এখনও মাঠে ধূ ধূ রোদে।
এত সাপের উপদ্রব চারদিকে; একরত্তি ছেলের কোন ভয় নেই। কাকেই বা দোষ দেবে সে? হুঁস তো তার নিজেরই গায়েব হয়েছিল। না হলে শাশুড়ি-ননদের দুটো খোরাকির জন্য তার ছেলের খোরাকিতে টান পড়ে বলে মনে হয়! এখন তো আর কেউ নেই; দেবকীও রবি মণ্ডলের ভাইঝি জামাই। কল্পনা নিজে দুবেলা খেটে, গলা অবধি ধারে ডুবে পারছে কোথায় ছেলের দুবেলার খোরাকি আনতে!
বড় মেয়েটা দিনে দিনে তাল গাছ হয়ে উঠছে; দেবকীর হিসেব যা হোক গেল তো মেয়ের মাথায় হাজার টাকার খরচা লেগে গেল; সেদিন রবির বউ ডেকেই বলল যে অনুর তো ভোটার কার্ড করানোর সময় হয়ে গেল। খেতে পায় না, তার ভোটার কার্ড! রানীটাও পিঠোপিঠি; ছেলেটাকেও ইস্কুলে দেওয়ার দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। এক এক সময় পাগল হয়ে যাবে বলে মনে হয় কল্পনার। মনে হয় শাশুড়ি-ননদের চোখের জলের শাপ লেগেছে। হাজারো ভাবনায় ডুবে কল্পনা হাতে হাজার মলম লাগাচ্ছিল; চিন্তার চাপে যত ডলছিল আঙুলের ফাঁকে তত জ্বালা বাড়ছিল, আঙুলের ত্বকে, বুকে, মাথায়।
হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল,বলি ও কল্পনাদি আছো নাকি? চমকে ওঠে কল্পনা, জবাদি? সন্দেহ নিয়েই ছই থেকে বেরিয়ে আসে সে; এবং দেখে যে ঠিকই , জবা-ই বটে। ওরে বাবা! তা এদ্দিন পরে আমাদের মনি পড়ল? দাদার শরীল কেমন? একলা আসছ নাকি? জবা বলল, এসেছিলাম রবিবাবুর দেনা মিটিয়ে কাগজ-পত্তর সব নিয়া যেতে
মানে জমির কাগজটাও? কৌতুহলী হয়ে পড়ে কল্পনা। জবার ঘাড় নাড়ায় সম্মতি দেখে আশায় চকচক করে ওঠে কল্পনার চোখ; সে জানতে চায়, কী করে এত পয়সা জোগাড় করলে গো?
জবা মিষ্টি হেসে বলল, তোমার দাদার চিকিচ্ছের সময় শহরে গিয়ে দেখলাম সেখেনে খাটলে অনেক পয়সা। রবিবাবু সেখানে পঞ্চাবাবু বলে একজনার কাছে ভিড়িয়ে দিয়ে ছেল। তেনার কাছেও কিছু দেনা করিছিলাম। সেটি শুধতে হাসপাতালের সময় বাদে বাকি সময়ে কাজে লাগিছিলাম। তারপর মেয়ে দুটাকেও খাওয়া-পরাতে দিলাম বাচ্চা আগলাতে, মেয়েদের পিজিতে। অনেক খরচ কমি গেল; তোমার দাদাও সুস্থ হয়ে কাজে লাগল। পঞ্চাবাবুর দেনা পেরায় শোধাও হয়ে গেল। ত্যাখন তিনি বুদ্ধি দিলেন সেখানেই থেকে যেতে। রোজগার করে রবিবাবুর দেনা শুধে দিতে। তাই এসেছিলাম। কল্পনা যেন চোখের সামনে স্বর্গ দেখতে পেল। জবাকে ধরে পড়ল, আমি সেখেনে গেলে আমার কাজ হবে? জবা বলল, রবিবাবুর সাথে কথা কও, ভোটার কার্ড হইয়েছে তোমাদের? কল্পনা কেঁদে ফেলল প্রায়, না গো দিদি, খাবার জোটাতেই ধারে একগলা হয়ে গেছি, যে জবা বলল, দুপুরের খাবার সব গুছিয়ে নাও, দাদা ঘরে এলে কথা কয়ে নিয়ে আমার সাথে এসো; রবিবাবুর গদিতে যাব
     শেষ দুপুরে রবিবাবুর সাথে কল্পনার রফা হয়ে গেল। জমির কাগজ থাকবে রবিবাবুর ঘরে। নৌকাটাও না হয় সারিয়ে সুরিয়ে রবি বাবু কাজে লাগাবেন। কল্পনার জমিকে বাগান, রোওয়ান সব রবিবাবু দেখে দেবেন; কল্পনা শুধু লোক লাগাবার খরচা দিয়ে যাবে। ভোটার কার্ড হলেই কার্ডের ছবি নিয়ে কল্পনারা শহরে চলে যাবে। কার্ডের খরচ এখন রবিবাবুই দেবেন, টাকা শোধ হলেই কল্পনারা আসল কার্ড পেয়ে যাবে। সব কথা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল কল্পনা, তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। বুঝতে পেরে রবিবাবু বললেন, জবারেই জিগাও না, সত্যি বলতাসি না সব বাজে কথা? ঢক ঢক করে ঘাড় নেড়ে জবা কল্পনাকে বলল, তুমি ভেতর বাড়িতে খবরটা দিয়ে এসো, আমি কিছু কাজ সেরে আসছি কল্পনা চলে যেতে জবা রবিবাবুর থেকে তার নিজের জমির কাগজটা চাইল। রবিবাবু বললেন হিসেবে একটু ভুল ছিল যে! পাঁচ বৎসরে জনের মজুরিটা বেড়েছে অনেক; ডিস্টি ম্যাজেস্‌টিকের আপিস থিক্যা খবর করে কবে কত মজুরী ছেল জেনে তোমায় হিসেবটা দেব দিদি। চিন্তা নাই কিছু, সে সামান্য কটা টাকা হবে। হিসেব হলেই পঞ্চাকে খবর দিব। কাগজটা ছাড়ায়ে লইয়্যা যেও


* * * * * * *
    

সিটি সেন্টারের সামনে পৌঁছে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দিশা দেখতে পেল কালো জিনস্‌ আর মস গ্রিন টি-শার্ট পরা একজন ভদ্রলোক স্মোক করছেন। ভদ্রলোকের দিকে দিশা এগোতে এগোতে তিনিও তাকালেন দিশার দিকে; ওয়েভ করতে করতে দিশা জিজ্ঞেস করল, আপনিই তমাল তো? ভদ্রলোক কর মর্দনের জন্য হাতটা এগিয়ে দিয়েই জানতে চাইলেন যে দিশা কোনো আইডেন্টিটি প্রুফ দেখতে চায় কি না। দিশা নেতিবাচক ঘাড় নেড়ে প্রস্তাব দিল হ্যাং আউটে গিয়ে বসার। ভদ্রলোক রাজি হয়ে গেলেন।
     প্রথমেই ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আজ যে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন বাড়িতে বলে এসেছেন? দিশা সোজাসুজি জবাব দিল, না, কিছু ফাইনালাইস হলে জানাব। আপনি জানিয়ে এসেছেন বাড়িতে? তমালও বললেন, না, বলি নি কিছু; তার মানে এই নয় যে আমি ক্যাসুয়াল; আপনার বাড়িতে জানে যে ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে অ্যাড দিয়েছেন? দিশা একটু নড়ে চড়ে বসল, আমিও ক্যাসুয়াল নই, তবে আমার ফ্যামিলি স্ট্রাকচার তো প্রোফাইল-এই পড়েছেন; আমি অনর্থক কথা বলে বাড়িতে টেনশন বাড়াতে চাই না। মা গত হওয়ার পর থেকে বাবা নেহাত সহজ স্বাভাবিক বিষয়েও যথার্থ পরামর্শের অভাববোধ করতে থাকেন । তাই বিয়ে করব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বন্ধুরা, কাজিন্‌সরাই এগিয়ে আসে আমাকে পাত্র পছন্দে সাহায্য করতে থেমে একটু জল খেল দিশা। তমাল বলল, তাহলে বিয়ের সিদ্ধান্ত আপনি হালেই নিয়েছেন? দিশা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে জানতে চাইল, আপনার দেরীর কারণ কি? মানে সাধারণতঃ আপনার প্রফেশনে লোকজন সাতাশ-আটাশে সংসারী হয়ে যায় দেখেছি। তবে আপনার প্রোফাইল আই ডি নাম্বার দেখে মনে হল আপনি অনেক দিন প্রোফাইল বানিয়েছেন তমাল একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, চাকরির ব্যস্ততায়……। তারপর সেদিন ঘন্টা তিনেক, সপ্তাহ দুয়েক পরে আবার ঘন্টা পাঁচেক, এবং তারপর রোজ রোজ আড্ডা দিতে দিতে তমাল এবং দিশা ঠিক করল বিয়েটা করেই ফেলবে।
     সেই সুবাদে সেক্টর ফাইভের গায়ে ফ্ল্যাট ভাড়া করল দুজনে। দুদিকে হলেও, দুজনের অফিসই ফ্ল্যাট থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে। ফ্ল্যাটটা যে ফাঁকা সে খবর পাওয়া গিয়েছিল তমালের কলিগ সৌরভের থেকে। সৌরভ থাকে ঐ ফ্ল্যাটটার উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে একই ফ্লোরে স্ত্রী স্বাতী আর ছেলে শৌনককে নিয়ে। সৌরভ ফ্ল্যাটের মালিকের ব্যাপারে আবাসনের কো-অপরেটিভে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেই ব্রোকার হরিহর মাইতি যোগাযোগ করে তমালের সাথে। যদিও তমাল বা সৌরভ কেউই বুঝতে পারে নি যে এমনটা ঘটল কেমন করে। কিন্তু ফ্ল্যাটটা শেষ অবধি পাওয়া যেতে দুজনেই নিশ্চিন্ত হয়েছিল।
     স্বাতীই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল যে তমাল-দিশার জন্য জবা রান্না করবে আর কল্পনা রান্নাঘরের বাইরের সব কাজ, যেমন করে স্বাতীর বাড়িতে। সব কিছু ঝামেলা ছাড়াই ব্যবস্থা হয়ে যেতে একটা রবিবারে দিশা আর তমাল ঢুকে পড়ল ফ্ল্যাটে। একদিন সকালের চায়ে সৌরভ হানা দিয়ে তমালদের দুজনকে নেমন্তন্ন করল পরের শনিবার ওদের নতুন ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়ার জন্য।
     সেদিন স্নানের পর পুজোয় বসে স্বাতী কিছুতেই দেশলাইটা খুঁজে পেল না; সৌরভ কোনো দিনই স্মোকার নয়; তার মানে দেশলাই ফুরিয়ে গেছে স্বাতীর বেখেয়ালে। স্বাতী ভাবল, ভাগ্যিস কল্পনা দি থাকে এই সময়! ঝটপট করে স্বাতী কল্পনাকে পাঠায় পঞ্চার পানের দোকান থেকে দেশলাই আনতে। পুজো সময় মত সেরে শৌনককে স্কুল থেকে আনতে হবে।
     কল্পনা পঞ্চার দোকানে আসতে, পঞ্চা কুশল বিনিময়ের পর জানতে চাইল, কার লাগবে গো দেশলাই, তোমার বউদির না দিদিভাই-এর ?| কল্পনা সাবলীল উত্তর দেয়, বউদির, দিদিভাই-এর ঘরে পুজোর যোগাড় নেই তো পঞ্চার ভ্রূ অল্প কুঁচকে আবার সোজা হয়ে গেল; আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার বউদির তো একবছরের বেশি হয়ে গেল; যাচ্ছে কবে শুনেছ কিছু? কল্পনা ফিক করে হেসে বলল, ঢং, বললে কি আমাকে ভাগা দেবেন না কি? পঞ্চা খুব অবাক হয়ে থতমত খায়, তারপর হেসে ওঠে, মঁমঁমঁহ, ভাগা চাইছে? ধার কত হল হিসেব আছে? ভাগাতে ধারেতে সমান সমান, এখন বলো দিকি, জান কি না তারা কবে নড়তিছে এই ঘর থিক্যা? কল্পনা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, দেশলাইটা দ্যান দিকি, বউদির দেরি হয়ে যাবে, সোনাকে ইস্কুল থিক্যা আনতি যাবে দেশলাই দিতে দিতে পঞ্চা বলতে থাকে, মাসের শেষে ধার নেওয়ার সময় যেন মনে থাকে তাড়ার কথাটা যেতে যেতে কল্পনা বলে যায়, সে পাড়ে পাকা ঘর নিছে। যাবে মাস-দুমাসে এক্কে-আরে। ইখানে আর ঠাঁই নাড়া হবে নাকো
     সকালে রোজই পঞ্চার দোকানের সামনে লোকাল এম্‌প্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ বসে। মথুরা আর সতীশ বসে বিড়ি ফুঁকছিল পাশাপাশি। সতীশ জবার বর। আগের দিনটা ভালই গেছে সতীশের পাঁচটা আলমারি তুলে আই বি এম-এ হাজার টাকা পেয়েছে। মথুরা অবশ্য গা গতরের ব্যাথায় কাহিল হয়ে পড়েছে; আগের দিন সারাদিন নতুন বাস টার্মিনাসের ভিতের মাটি কেটেছে। সবারই মোটামুটি হয়ে গেল। মথুরাও একটা ডাক পেয়ে গেল; রাস্তার মাঝের পাঁচিলে ছবি আঁকিয়েদের রঙের ডাব্বা পুরণের কাজ; সারাদিন রোদে ঘুরতে হবে, কিন্তু বসে থাকতে হবে রং বওয়া গাড়িতে।
     জায়গাটা শুনশান হয়ে যেতে সতীশ পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো পঞ্চার দোকানে। পঞ্চার বউ তখন দোকানের চার্জ হ্যাণ্ড ওভার করছে পঞ্চাকে। হিসেব-নিকেশ বোঝা হয়ে গেলে, সতীশকে নজর করল পঞ্চা। সতীশ গলা খাঁকারি দিয়ে আকর্ণ হেসে বলল, একটা বিড়িই দ্যান পঞ্চাদা, কাজ যখন দেতি পারলেন নি আজ…… বিড়ির ডিব্বাটা হাতে ধরে খুলতে গিয়েও খুলল না পঞ্চা। সতীশের বাক্যের শেষটুকু শুনে, ভ্রূ কুঁচকে উঠল এক মুহূর্ত; তারপরই সৌমভঙ্গীতে হেসে বলল, তা কাল খুব খেটিছ; আজ না হয় একটু রেসই নিলে একটু থেমে আবার বলল, তা নতুন জোড়ার খবর দিছে গো জবাদি? সতীশ বললে বোঝলেন আমাদের দে হবে নি। ছেলেরা ইংরিজি না পড়লে বাবুদের কথাও বোঝা যাবে নি পঞ্চা খুব অবাক হল না; অ, তেনেরা অবাঙালি? তেমনটা তো হরিহরও বলে নি; সিকিউরি সঞ্জীবও বলে নি পঞ্চার কথার মাঝেই বলে ওঠে সতীশ, তেনেরা অবাঙালি তো নন, তবে কি না কম কথা কন; জবা থাকতি থাকতি যেটুক কন তাও ইংরিজিতে। জবা শেষ অবধি ছেলের মাষ্টারকে ধরেছে, মাইনে একশ টাকা বাড়িয়ে দেলি যদি সে জবারে ইংরেজী শেখায় এইসময় পঞ্চার মোবাইল বেজে উঠল। কোমরের গেঁজেল থেকে সেলফোনটা বার করে নিয়ে দু-চারবার আচ্ছা, দেখছি বলে সতীশকে বলল, সাইকেলটা নিয়ে একবার কর্পোরেশনের মাঠে যাও; সেখানে ডম্বরু নামে একটা ছেলে থাকবে; তাকে আমার কথা বলবে। ওর সাথে ভ্যাট থেকে সাদা দুধের প্যাকেট উঠিয়ে আনবে। ওপাড়ে গণেশের দুধের কারখানায় এক্ষুনি পৌঁছে দিলে কেজিতে পঁচিশটাকা পাবে। কোন মজুরি নেই, কিন্তু ঝামেলাও নেই
     শনিবারে দুপুর দুপুর সৌরভ আর তমালরা সবাই মিলে দুটো রিক্সা নিয়ে ডি এল এফ এলো। ওখান থেকে একশ টাকা দিয়ে একটা অটো রিজার্ভ করে পৌঁছোল সৌরভদের অ্যাপার্টমেন্টে। ওদের রান্নাঘরের কাজ চলছিল। স্বাতী-সৌরভ কন্ট্রাকটরের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বারান্দায় এসে তমাল জানতে চাইল, স্বাতী কন্ঠ্‌দের কথা কী বলছিল? খুব হতাশ গলায় দিশা বলল, গত রবিবারে না কি কন্ঠ্‌দের নীচের ফ্ল্যাটের দিলীপ সাহা এসে চন্দ্রচূড় বাবুকে বিহারী-টিহারি বলে খারাপ খিস্তি-টিস্তি করে মারতে গিয়েছিল। রোজ এসে অপমান করে যায় ছেলে কেন লাফায় বলে, সেদিন চন্দ্রচূড়ও মেজাজ রাখতে পারেন নি। এদিকের চ্যাটার্জীরা দুজনকেই থামাবার চেষ্টা করছিল; ছেলের ভোকাবুলারি স্ল্যাংসমৃদ্ধ হওয়ার ভয়ে স্বাতী গিয়ে চন্দ্রচূড়দের বাড়ির ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলে। চন্দ্রচূড় উত্তেজনা এড়াতে না পারার ভুলটা বুঝতে পেরে স্বাতীর কথা শোনে; ফলে এখন সাহাদের বাড়ি থেকে সবাই স্বাতীর পেছনে লেগেছে। কটা মাত্র দিন পরে চলে আসবে, তাই বাঁচোয়া। তমাল বলল, তাই চন্দ্রচূড় আজকে ফ্ল্যাট বদলাল আবাসনে ! দীলিপ ব্যাটা নিশ্চয়ই সিকিউরিটির দীনেশের থেকেও কমিশন নিয়েছে। এবার ডিল আবাসনের মধ্যে বলে হরিহর মাইতি নেই, দীনেশ জানাই ম্যাট। দীলিপের কষ্ট রে; ভাগের পেট্রলপাম্প থেকে বোধ হয় ভাইরা খেদিয়েছে কিংবা ওর ওখানকার আয়ের থেকে সফো চন্দ্রচূড়ের রোজগার বেশি বলে বোধ হয় জ্বলে গেছে দিশা চোখ বড়োড়ো করে জানতে চায়, তুই জানলি কি করে দীলিপ অ্যাণ্ড ব্রোস পেট্রলপাম্প আছে ? তমাল চালাক চালাক হেসে বলে পঞ্চা আছে না, আমাদের দাদা! দিশা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল , এমন সময় মালিকানায় ঝলমলে স্বাতী এসে খলখল করে বলল, আজ ভাঁড়েই চা খেতে হবে কিন্তু দিশা বলল, ছেলে বাড়ি থাকলে বারান্দা বন্ধ রাখিস রে; এখান থেকে পড়লে আমিও সামনের মাঠটায় ঘাসে মিশে যাব, তারপর নরমাংস খেয়ে গরুটা সোঁদরবনের বাঘ বা গোকুলের ম্লেচ্ছ- কিছু একটা হয়ে যাবে চায়ের ভাঁড় আর হাসাহাসি শেষ করে দরজায় চাবি লাগাতে লাগাতে সৌরভ তমালকে বলল, উল্টোদিকেরটাও বুক হয়ে হয়ে গেছে । আমারই যোগাযোগ দিশা যেন ঈষৎ অহঙ্কারী হাসি খেলে যেতে দেখল সৌরভের মুখের আনাচে কানাচে। রমিতা বলে একটা মেয়ের সাথে আটানব্বই-এ প্লেনে আলাপ হয়েছিল। ওর তেলেগু বরের ইচ্ছে এখানে একটা ফ্ল্যাটে ইনভেস্ট করার। ওরা অবশ্য এখনও আটলান্টাতেই আছে। তোমরা দেখো, পরে বোলো কিছু ভাবলে কিনা। তমাল জিজ্ঞেস করে, এখানে এখন দর কি ?
চল্লিশ, তবে রমিতার যোগাযোগের জন্য আমাকে কিছু কমে দিয়েছে। সংক্ষেপে সারে সৌরভ।
     রাস্তায় নেমে ফেরা এক ঝকমারি। এখানে বাস, সাইকেল রিক্সা অটোরিক্সা কিচ্ছু চলে না। শেষে জাস্ট ডায়ালে ফোন করে কাছের কারপুল থেকে ভাড়ার গাড়ি ডেকে তাতে চড়ে টেকনোপোলিস পৌঁছে দলটা নিশ্চিন্ত হল।
     টেকনোপোলিস থেকে রবীন্দ্রসদন ট্যাক্সিতে আসার পথে তমাল দিশাকে বলল, ভাবছি আমিও একটা বুক করে ফেলি, কি বল? দিশা তীক্ষ্ণ হুল ফুটিয়ে জবাব দিল, নুভু রিশদের ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানে আমি কি ইনপুট দিতে পারি? তমাল বিরক্ত হল, থাকার তো একটা ডেরা লাগবে! দিশা বলল, যেখানে ডেরা বানাবি সেখানে আগামী তিরিশ বছরের তিনভাগের বেশী থাকবি তো? ঠিক জানিস? দীর্ঘশ্বাস ফেলে তমাল বলল, নাহ্‌, প্রজেক্টের পিছনে দৌড়োও, টেকনোলজি চেঞ্জ কর। আবার দৌড়োও’’। এরপর নৈরাশ্য বেয়ে ট্যাক্সির গহ্বরে ছেয়ে গেল নৈশঃব্দ।
     মাসদুয়েক পরে দিশা ই-মেল লিখছিল তমালকে।
কেন রোজ জিজ্ঞেস করিস মন খারাপ কি না। তোর মন কি ভাল আছে? হয় তো আছে। তোর প্রিয় স্টেস-এ আছিস তো।
     মন খারাপ নিয়ে বেশি কথা বলছি না। বাবা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন; ছাপতে দেওয়া কার্ডগুলো ফিরিয়ে এনেছি বলে। তুই কি চালাক না কি অলস যে এখনও কার্ডের অর্ডার দিস নি, ড্রাফট রেডি করিস নি এ তর্কটাই আজকাল কুরে কুরে খায়।
     তোর সই ছাড়াই যাতে ব্রডব্যাণ্ড ইত্যাদি কানাকশন কেটে যায় তার জন্য একটা লোক ধরেছি। কাজ আধখানা এগিয়েও গেছে। বাড়িওয়ালা মিত্রমশাই তোর সাথে ফোনে কথা বলতে চান ফ্ল্যাটটা ছাড়ার ব্যাপারে। বিবেচকের মত কথা বলিস।
     আমার জিনিসপত্র আমি বাবার ওখানে পৌঁছে দিয়েছি। তোরগুলো তোর মায়ের জিম্মায় জমা করে দিয়ে এসেছি।
     লোডিং-এর সময় পঞ্চা এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বলছিল কবে নাকি তুই ওর দোকান থেকে দৈনিক দু প্যাকেট নেভিকাটের রসদ নিতে গিয়ে বলেছিলিস স্ট্যাণ্ডের সব রিক্সাওয়ালাদের জন্য ইংলিশ শেখার ব্যবস্থা করতে; এখানে তো এখন অনেক অবাঙালী ইংলিশ স্পিকিং মানুষ, এমনকি লালমুখো, হলুদমুখো ভিনদেশি সাহেবও; সব নাকি সংখ্যায় বাড়বে। তুই ওকে না বলে চলে যাওয়ায় ও বড়ই দুঃখ পেয়েছে। আফটার অল তোর মত দরদী কাস্টমার আর একটাও পায় নি যে।
     আমি হানিমুনের ছুটি ক্যান্সেলের দরখাস্ত দিতে গেয়ে দেখলাম ফরেন যাওয়ার নো অবজেকশন লেটার এসে গেছে। পাটায়া তো যাচ্ছি না আর এখন, ঐ লেটারে অন্য কোথাও যাওয়াও যাবে না, অন্য কোনো ডেটেও যাওয়া যাবে না। আবার পরে পারমিশনের ঝক্কি, মেলা প্রশ্ন চিহ্ণ সব ভেবে রেসিগনেশন দিয়ে দিলাম। নতুন বছরে আর ঐ আপিসে যাব না।
     মার্চ সেশনে অলবেরীতে লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির উদুঙ্গা ইন্সটিটিউটে এনভায়রনমেণ্টাল ম্যানেজমেন্ট এবং ইকোলজি স্কুলে পি এইচ ডির জন্য ভর্তি হব। স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এখন তো প্রচুর লোক পালিয়ে আসছে। তাই বোধ হয় সোজা হল খানিক ফাণ্ডিং পাওয়া।
     অতএব পরের জুনে আমি আসতে পারছি না। বিয়ের দায়িত্ব বইতে প্রস্তুত থাকলে তুই তার পরের মার্চে আসিস। আমি দেশে আসব তখন।
     অলবেরী মিনিয়াপোলিসের থেকে ষোল ঘন্টা এগিয়ে চলে। ইচ্ছে হলে মেল করিস।
……………………………………
     সেদিনই কল্পনার মেয়ে অনু পালিয়ে গেল বাপ্পার সাথে। বাপ্পার বাবা ছেলেমেয়েদের নিজেদের পছন্দ মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু কল্পনার কাছে কন্যাপণ হিসেবে চেয়েছিলেন এক বিঘা জমি। কল্পনা রাজি হয় নি দাবি মেনে মেয়ে দিতে।
     * * * * * * *

     ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছুটতে থাকা ধুলোর কণাগুলোর কয়েকটা পরস্পরের সাথে ধাক্কা লেগে জুড়ে যেতে লাগল। কয়েকটা কখনওই ধাক্কা খেল না; ছুটেই গেল দিকহীন ব্রহ্মাণ্ডে। জোড়া লাগা কণা থেকে ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠল তারা, গ্রহ, স্থল-জল-ফলের, ডারউইনের পৃথিবী। আবার জোড়ালাগা কয়েকটা কণা পরের ধাক্কায় ঠিকরে পড়ল সীমাহীন দিগন্তে। মিলিয়ে গেল ব্ল্যাক হোলে কিংবা সুপারনোভার ঝড়ে। বারবার।

Tuesday, May 10, 2016

ররঙ্গার অপেক্ষা

একটা বন ছিল অমলতাসের। সেখানেই ঘুমিয়ে ছিল ররঙ্গা। তার গায়ে ছিল অমলতাসের ঝরে পড়া পাপড়ির চাদর। তার বিছানাও ছিল অমলতাসের ঝরে পড়া পাপড়িতে ঢাকা। দিনের বেলা সূর্যের আলো সেখানে আগুন জ্বালাত না, সোনা ঝরাত। সেই সোনার একটা ফোঁটা যখন ররঙ্গার গায়ে এসে পড়ত তখন তার গায়ের অখন্ড সোনার চাদরখানা অসংখ্য টুকরোতে ছড়িয়ে দিয়ে সে জেগে উঠত। 
তারপর অভ্যেস মতো দাগ কাটতে যেত যে গাছে তার বাস তার গুঁড়িতে। তারপর হাত গুটিয়ে নিত। তার স্পষ্ট মনে পড়ে যেত প্রথম যেদিন সে রুরুর নৌকার বাইরে বেড়িয়েছিল সেদিন ছিল পূর্ণিমা। তার চারপাশে ছিল ইলাওয়ারা শিখার রক্তিমা, দিনে রাতে। সে অমলতাসের স্বর্ণালির মতো এমন নরম নয়। তাতে মনে প্রচুর উত্তেজনা, অশান্তি, কৌতুহল তৈরি হয়। 
আবার এও মনে হতো যে সেই সময়টাই তো অমন ছিল। ইলাওয়ারার রক্তিমার আর দোষ কী! তখন সবে সে রুরুকে বিয়ে করেছে। রুরু তাকে লুকিয়ে রেখেছে নৌকার খোলে, মায়ের কাছে ফিরে ভাইদের আর ভাইবউদের চমকে দেবে বলে। তখন ররঙ্গার মনের মধ্যে ছিল ফুলশয্যার আবহ। যখন সে ঠাহর করল যে সে ইলাওয়ারা বনের মধ্যে তখনও ভাবছিল এই বুঝি রুরু আসবে, ইলাওয়ারার রক্তিমাটাই বুঝি রুরুর দারুণ আবেগরাঙা ফুলশয্যার উপহার।
না নাওয়া, না খাওয়া, কেটে গিয়েছিল দুটো রাত আরও। তৃতীয় দিনে তেষ্টায় চোখে অন্ধকার দেখে ররঙ্গা চলতে শুরু করেছিল জমির ঢাল বেয়ে। শেষে পৌছেছিল সমুদ্দুরে। অত জল, কিন্তু তেষ্টা মেটেনি। তখন আবার চোখ মেলে খুঁজে ছিল মোহানা। মোহানা খুঁজতে তাকে চড়তে হয়েছিল এক বালিয়াড়ির মাথায়। সব কিছু সে যেন কেমন অদ্ভুত নিচু থেকে দেখছিল। তার সন্দেহ হচ্ছিল বিয়ে হলে মেয়েরা সত্যিই খাটো হয়ে যায় নাকি!
যা হোক মোহানা থেকে কিছু উপরে গিয়ে সে নদীর পাশে জমা জলের পুকুর পেয়েছিল। সে পুকুরে মুখ চুবিয়ে জল খেয়ে যেই মুখ তুলেছিল, তখনই সে নিজের ছায়াটা খেয়াল করেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে নি। জলটা বার বার ঘুলিয়ে দিয়ে, এ পুকুর সে পুকুর ছুটে যখন সে দেখেছিল যে তার ছায়া কিছুতেই বদলাল না, তখন সে কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল যে সে আর মানুষ নেই, কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে।
তারপর থেকে তিনটে পূর্ণিমা সে গুণতে পেরেছিল। কারণ তিনটে পূর্ণিমা পরে এসে উপস্থিত হয়েছিল একটা টুনটুনি। সে কেবল গান গাইত,
“ও ওরে ও ররঙ্গা,
চারিদিকে মারদাঙ্গা।
চানু নিল কী পাঙ্গা!
রাজা হবে না চাঙ্গা।” - ররঙ্গা কিছুই বোঝে নি। আর পরের পূর্ণিমা আসার আগেই এক ভোরে তার ঘুম ভেঙেছিল সাদা সবুজে প্রাণবন্ত এক গজদন্ত কুণ্ডলি বনে। আর ঘুম ভেঙেছিল সূর্যের আলোর ছোঁয়ায় নয়, টুনটুনির গানে। সেই এক ঘেয়ে একটানা গান, “ও ওরে ও ররঙ্গা, ......” 
টুনটুনিকে এড়িয়েই যেত ররঙ্গা। তাছাড়া তার মাথায় হরেক দুঃশ্চিন্তা ছিল। মূলতঃ সে কী করে তার মানুষী রূপ ফিরে পাবে, কী করেই বা রুরু তাকে চিনবে, তার সাথে রুরুর দেখা হবে কবে। ভেবে ভেবে তার ক্রমাগত ওজন কমে যাচ্ছিল। তারপর তার দিন গোনার ধরতাই খোয়া গিয়েছিল। সে উদ্‌গ্রীব ভাবে অপেক্ষা করছিল পরের পূর্ণিমার। তারপর তার মাথায় এসেছিল যে সে তো সময়ের হিসেব রাখতে পারে তার শারীরবৃত্ত দিয়েও। পূর্ণিমার ব্যবধান সাতাশ দিনের, আর আটাশ দিনান্তর তার নারীত্বের ক্ষরণ। সেই সূত্রেই সে টের পেয়েছিল যে যতগুলো পূর্ণিমাই কাটুক, তার শরীর তাল মেলায় নি।
তার শিরদাঁড়া জুড়ে হিমপ্রবাহ বহে যেত কথাটা মনে পড়লেই। সে মাত্র একবেলার বিবাহিত, না হয়েছিল তার বাসর, না ফুলশয্যা। তার কুমারীত্বও অক্ষত ছিল। তবু তার রজোচক্রে যতি পড়ার কী কারণ সে ঠাহর করতে পারছিল না। তার মনুষ্যত্বের মতো তার নারীত্বও গেছে কিনা তাই নিয়ে সে বিব্রত হচ্ছিল থেকে থেকেই। আবার বিরক্তও হচ্ছিল যে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সে দিনরাত মনোসংযোগও করতে পারছিল না সারাদিন থেকে থেকে তার খিদে পেতে থাকার কারণে।
রান্নার উপায় নেই, উনুন নেই, রান্নাঘর নেই, বাড়িই নেই। কাঠবেড়ালি হয়ে গাছের ওপর থাকা, খাবার খোঁজো, খুঁজে পেলে উদরস্থ করো, পেট ভরুক না ভরুক আবার দৌড়োও। যত পারো দিনের আলো থাকতে থাকতে পেট ভরে নাও ঠেসে। আর রাতে কোনো বিনোদন নেই। কেবল গাছে চড়ে ঘুমিয়ে পড়ো, চেনা তারামণ্ডল বার বার দেখে, চেনা তারা বার বার গুণে, একঘেয়েমির ক্লান্তিতে। এখন ভাবলে তার সন্দেহও হতো যে ক্লান্তি সারাদিন এ গাছে, ও গাছে চড়ে, নেমে, খাবার খুঁজে ছুটে বেড়ানোর জন্য নাকি একঘেয়েমি থেকে।
এরকম সময় টুনটুনিতে গাইতে শুরু করেছিল, 
“ররঙ্গা, ররঙ্গা, ররঙ্গা
রাজা তো এবারে একবগ্‌গা
চানুকে পেলেই ফাঁসির আজ্ঞা
টুনটুনিও ছাড়বে এ জায়গা।” – এ গানেরও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারে নি ররঙ্গা। কিন্তু আবারও এক ভোরে সে আবিষ্কার করে যে সে শুয়ে আছে সাদা সবুজের থোকায় ভরাট একটা শ্বকাষ্ঠকুঞ্জে। এবার আর বিস্ময় নয়, ভয় নয়, সে আক্রান্ত হলো বিরক্তিতে। জমির ঢালে ছুটে গেলে পাওয়া যায় শুকনো নালা। অনেক খুঁজে সে একটা বিশাল হ্রদ আবিষ্কার করল যাতে সাদা চিবুক আর পেট কিন্ত কালো মাথা, গলা আর বাদামী ডানার হাঁসেরা সাঁতার কাটে। যে রাতে ঠান্ডা বাড়ে সে রাতে হাঁসগুলো বিকট ডাকে পাড়া অতিষ্ঠ করে উড়ে যায়। রাতের ঘুম চুরমার হয়ে যায় ররঙ্গার। 
ফলে দিনের বেলা তার আর বিরক্তি কমতেই চায় না। নতুন এলাকায় জলের পর চলে খাবারের খোঁজ। ররঙ্গার বিরক্তি আসে এটা ভাবলেও যে এই নতুন এলাকায়, নতুন আবহাওয়ায় মানিয়ে নেওয়া মাত্রই, গুছিয়ে নেওয়া মাত্রই তার ঘুম ভাঙবে নতুন এলাকায়, নতুন আবহাওয়ায়। আবার তাকে খুঁজতে হবে, জল, খাবার, আর বাসা বানানোর উপযুক্ত গাছ। ঠিক কবে এমনটা হবে সে জানেও না। কেন হবে তাও জানে না। জানলে অন্তত সে এরকম হওয়ার কারণটাকে প্রভাবিত করতে পারত নিজের সুবিধা মতো। নিজের অসামর্থ্য আর অপারগতার ওপর রাগতে রাগতে সে ভয়ানক হতাশ হয়ে পড়ল। 
ররঙ্গার কেবল মনে হতে লাগল যে যদি সে রুরুকে বিয়ে করে রুরুর দেশে যাওয়ার জন্য রুরুর নৌকায় না উঠত তাহলে এমন করে নিজের জীবনের ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণটুকু সে খোয়াত না। সমস্ত যুক্তি দিয়ে বিচার করলেও সিদ্ধান্ত যে আবেগতাড়িতই হয় সে কথা বুঝতে পেরে তার আরও হতাশ লাগতে লাগল, আরও বিরক্তি আসতে লাগল তার মনে। সকাল সন্ধে সে গাল পাড়তে লাগল নিজের বুদ্ধিকে। এর মধ্যে আবার একদিন শুনতে পেল টুনটুনি গাইছে,
“রাজা ধরেছে চানুকে, সঙ্গে সাতটা ভাই
ভাইগুলো সব চোর নাকি তা বোঝার উপায় নাই” – সাত ভাইয়ের কথা শুনে ররঙ্গা চমকে ওঠে। তাছাড়া তার রজঃস্রাব শুরু হওয়ায় সে বিশেষ হুটোপাটি করে খাবার জোগাড় করতেও পারছিল না, খুব খিদেও তার ছিল না। দিনের ব্যস্ততা উপে যাওয়ায় তার আরও একঘেয়ে লাগছিল। রাতে তবু তারা গোনা যায়, দিনের বেলাটা আরও নির্জন লাগে তার। তাই গানের কথাগুলো তার মনে পাক খেতে লাগল। 
“টুনটুনিতে টুনটুনাবে
যবে চানু রাজা হবে
রাজা রাগী আর শক্তিমান 
জমিদারকে ধমক লাগান
জমিদারই চানুর শ্বসুর
চানুকে তাঁর ভরসা প্রচুর
‘নাক কাটা রাজা জব্দ কী?’
পারে নি বলতে রানির ঝি।
তাই রাজাকে শাস্তি দিতে
লাগল চানু দল পাকাতে
মিলল সে সাত চোরের সাথে
বুড়ি গেল রাজবাড়িতে
সেখানে সে দাসী হলো
চানুকে রোজ খবর দিল
রানির ঝি যেই টেরটি পেল
রাজা বুড়ির গর্দান নিল”
এই অব্দি শোনার পর ররঙ্গার দিন গোনা ভেস্তে গেল আবার। নিজের শরীরের খবর রাখতে সে গাছের গুঁড়িতে আঁচড় দিচ্ছিল রোজ। কিন্তু এক ভোরে সে জাগল ম্যাগনোলিয়া বনে। সারা বন বেগুনি, গোলাপি, সাদা বিশাল বিশাল একক ফুলে ছয়লাপ। দীর্ঘশ্বাস পড়লেও ররঙ্গা আর বিরক্ত হয় নি। চমক হলেও শুধুই বসন্ত আর সৌন্দর্য ছিল তার প্রত্যেক স্থানান্তরণে। তাই নতুনে মুগ্ধতা সে মেনে নিয়েছিল। নিজের ভালো লাগাকে নিজে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অনুরাগ প্রেমে পরিণতি পাওয়ার আগেই যে বিরহ পেয়ে শোকে, দুঃখে সে ডুবে গিয়েছিল, তার থেকে যেন একটু ভেসে উঠেছিল, যেন চিৎ সাঁতারে অল্প বিরাম খুঁজেছিল।
এর মধ্যে টুনটুনির থেকে আরও বেশি গান শোনার আশায় সে অনেকবার টুনটুনিকে বাদাম বা দানা খেতে দিয়েছে। টুনটুনি সেসব খায় নি। ভাবও করেনি। ঝগড়াও করে নি। খুব নিঃস্পৃহভাবে নিজের খেয়ালে গান গেয়েছে আর লম্বা বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে ফুলের মধু শুষে নিয়েছে। তাই প্রথমবার ম্যাগনোলিয়া বনে ররঙ্গা টুনটুনির অপেক্ষা করছিল। সে যে অপেক্ষা করছে সে কথা নিজে বুঝতে পারার অনেক আগে থেকেই।
আবার একদিন শুনতে পেল,
“বুড়ির মাথা কাটা যেতে চানু গেল খেপে
চাল সাজাল ভীষণ রকম এদিক ওদিক মেপে
রুরুরা গেল বিয়ে করতে ররঙ্গার দেশে
রূপোসীরা ঠকিয়ে দিল ছয় ভাইকে কষে
রুরু ছাড়া আর কোনো ভাই বোঝে নি সে কথা
নৌকা চড়ে ফিরছিল সব মায়ের বাড়ি যেথা
এক রাতে চানু করল চুরি সেই নৌকাখানা
কাঠবেড়ালি হলো বটে মানুষ চোদ্দখানা
নৌকাখানা উড়ছে এখন মস্ত ঘুড়ির পিঠে
সাত চোরে তার ধরছে লাটাই জলে ডাঙায় ছুটে” – খটকা লাগছিল ররঙ্গার। সাতভাইকে নাকি রাজা ধরেছিল! তাহলে তারা ঘুড়ির পিঠে নৌকা কী করে ওড়াচ্ছে? আবার নৌকার চোদ্দজনই যদি কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে তাহলে চানুর সাথে ধরা-পড়া সাতটা ভাই কারা? টুনটুনি মিথ্যে বলছে কী?
তক্কে তক্কে থেকে একদিন টুনটুনির গলাটা থাবা দিয়ে চেপে ধরেছিল ররঙ্গা একটা গাছের গুঁড়িতে। সে চিল চীৎকার করেছিল, “আমাকে যদি আজ মেরে ফেলিস, তোকে বাকিটা কে বলবে?” ররঙ্গা তাতে ঘাবড়ায় নি, সে থাবাও আলগা করে নি, বলেছিল, “বাঁচতে হলে শিগগির বল বাকিটা।” কিন্তু টুনটুনি আর কিছুই বলে নি তখন। একটু কাতরে ছিল, খানিক পরে তার শরীরটা শক্ত হয়ে মাথাটা এলিয়ে পড়েছিল। ররঙ্গা তাতে বেশ হতাশ হয়েছিল। এরপর আর কোনো খবরই পাবে না ভেবে যখন সে দুশ্চিন্তায় ঘেমে উঠছিল য়ার ঝাপসা চোখে বেগুনি রঙের ফুল দেখছিল, তখন থাবাটা যে কী করে আলগা হয়ে গিয়েছিল সে টের পায় নি। তার হুঁশ হয়েছিল,
“ঝড়বাদলে ছিঁড়ল ঘুড়ি নৌকা গেল উড়ে,
তার টুকরো ছড়িয়ে গেল রাজার বাগান জুড়ে” - শুনতে পেয়ে। সে বুঝেছিল যে চতুর পাখিটা মরার অভিনয় করে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর পাখিটা আবার গায়েব হয়েছিল। তারপরে যে অমলতাসের বনে ররঙ্গা ছিল সেখানে সে একদিনও আসেনি। 
ঘুম ভেঙে যেদিন ররঙ্গা দেখেছিল যে সে পলাশবনে সেদিন সে ভেবেছিল যে রুরুও যদি কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে তো কাঠবেড়ালির স্বরে, কাঠবেড়ালির ভাষায় তাকে ডাকলে নিশ্চয়ই সে শুনতে পাবে যদি সে আশেপাশে থাকে। উত্তেজনা উদ্দীপণায় ঝটপট করে সে একটা ঝোরা খুঁজে বার করেছিল। তাতে স্নান করে, দাঁত মেজে, চোখমুখ ডলে ডলে ধুয়ে নিজেকে ঝকঝকে করে ফেলেছিল। তারপর পলাশ পাতায় বাদাম সাজিয়ে ডেকেছিল, “রুরু, রুরু” বলে। সেই ডাক পলাশের রক্তিমা, স্বর্ণাভা, শুভ্রতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল বনান্তরে। তারপর সূর্য যখন পাটে বসেছিল, তখন হাঁপাতে হাঁপাতে একটা কাঠবেড়ালি এসে ররঙ্গার নাম ধরে ডেকে ছিল। ররঙ্গার কোনো ভুল হয় নি রুরুকে চিনে নিতে। তারপর তারা উদ্‌যাপণ করেছিল তাদের বকেয়া বাসর, ফুলশয্যা। আর সকালে জেগে উঠেছিল আবার মানুষের বেশে।
নিজেদের মগ্নতা থেকে অবকাশ পেলে শুনেছিল টুনটুনি গাইছে,
“ছেলে, বউ সব গায়েব হতে মা ছুটেছিল রাজদরবারে
প্রজা নাকাল হচ্ছে শুনে রাজা মেতেছিল সংহারে
মন্ত্রী, সান্ত্রী, যন্ত্রী মিলে ধরেছিল সব চোর ডাকাতকে
সেই সঙ্গে ধরেছিল নিজেদের উটকো যত স্যাঙাতকে
ঠ্যাঙিয়ে স্যাঙাত জেনেছিল তারা চানুর দলের খবর
চালিয়ে হানা চানুর ঠেকে পেয়েছিল প্রমাণ জবর
চানুও কিছু কম নয় বটে, তারও ছিল গুপ্ত সেনা
কিছু ফেরার, কিছু নাচার যারা শুধতে পারেনি দেনা
সবাই মিলে রে রে রে করে তেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল 
রাজার বাহিনীও তাদের পিটিয়ে ঠান্ডা করেছিল
নাকের শোকে কাতর রাজাকে ঠুকরে আসতাম আমি নিজে
জাদুবলে পালাতাম ধূলোর ঝড়ে বালি দানার সাজে
তাই তো আমিও ছোট্টো সিপাই ছিলাম চানু চোরের দলে
একলা কী করে লড়ি বলো রাজার সঙ্গে পাঙ্গা নিলে?
তারপর এক রাতে জাদুকর গেল রাজার হাজতে মরে
নাওয়ের টুকরো ঝরল রাজার বাগানে জাদুর ঘুড়ি ছিঁড়ে
সেই টুকরোতে লেগে থাকা সুতো ধরিয়ে দিল সাত চোর
তাদের শপথে পড়ল ভেঙে সেরা চোর চানুর যত জোর
জানি না কী করে আমার প্রাণ বাঁচবে চানুর সাজা হলে
এ আবার কী! কে জড়াল, কী করে এমন রঙিন জালে!” – টুনটুনির গান গেল থেমে। আসলে বিভোর হয়ে টুনটুনি যখন বিলাপ গাইছিল, তখন নিঃসাড়ে জড়ো হয়ে ছিল রুরু আর তার সাত ভাই। রুরুর সাথে ররঙ্গা। সাত ভাইয়ের সাথে ছিল তাদের বউয়েরা। জাদুকর মরে যেতেই সবাই কাঠবেড়ালি থেকে মানুষ হয়ে গিয়েছিল। আর খুঁজে পেয়েছিল বাকিদের। তারপর সাত বউ মিলে খোঁপার জাল জুড়ে জুড়ে একটা জাল বানিয়েছিল। সাত ভাই একে অপরের কাঁধের ওপর চড়ে পৌঁছেছিল সেই পলাশ গাছের মগডালে, আর সন্তর্পণে জাল ছুঁড়ে ঢেকে ফেলেছিল পাশের গাছের মগডালে শোকসঙ্গীত বিভোর টুনটুনিকে।
জালে আটকা পড়ে টুনটুনি সন্ধি প্রস্তাব দিয়েছিল। পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাজদরবারে, যেখানে চানুর বিচারসভা চলছিল। সেখানে সে কবুলও করেছিল, নৌকাসুদ্ধ চোদ্দোজনকে চুরি করে কেমন মায়া কাননে লুকিয়ে রাখা হতো কাঠবেড়ালি করে, নানান দেশের বসন্তের পরিবেশে। টুনটুনি কিন্তু ছাড়া পায় নি শেষে। রুরুরা টুনটুনিকে রাজার লোকের হাতে তুলে দেওয়ার পর টুনটুনির সাথে তাদের সন্ধির কথা নিশ্চয়ই কেউ আমল দেয় নি। তাই বিচার শেষে চানু বা টুনটুনির কী হয়েছিল তাও জানা যায় না।


ঋণঃ ছোটো ভাই, ঝানু চোর চানু, টুনটুনি ও রাজার কথা, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি।

Sunday, April 3, 2016

সংসদীয় গণতন্ত্র নাকি মনসবদারির রকমফের

প্রতি পাঁচবছরে ভারতীয় ভোটাররা নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে থাকেন সংসদে ও বিধানসভায় যথাক্রমে দেশ ও রাজ্যের পরিচালনভার সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দের প্রতিনিধির উপর ন্যস্ত করার জন্য। কিন্তু এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাজ-সাজ রব কাড়া-নাকাড়া বাদ্যির মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে পরিচালনভারের দায় নয় , শাসনক্ষমতার দম্ভ তাই বোধ হয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে অক্লেশে , সমাজতন্ত্রের নামে ধনতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র কবলিত পড়শী  রাষ্ট্রটি , মানে চীন , সামন্ততান্ত্রিক বলে গালাগাল করে কে গাল পাড়ছে তা উপেক্ষা করে যদি তলিয়ে দেখা যায় যে কেন গাল পাড়ছে , তাহলে হয়তো গোড়ার গলদে পৌঁছোনোও যেতে পারে। তাই পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল স্বাধীন সমাজতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বের নির্বাচন পদ্ধতি , দায়িত্ব ও ক্ষমতা , তাঁদের অপসারণের নীতি যেভাবে ভারতীয় সংবিধানে বিধৃত তা নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখা যাক কোথাকার জল কোন খাতে বয়ে কোথায় দাঁড়িয়েছে  
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের গঠনে নানান দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ছিলেন সংবিধান রচয়িতারা ব্রিটিশ ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রনেতার ক্ষমতা ও দায়িত্ব সেই ব্যবস্থানুসারে রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রনেতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনি নিয়োগ করেন মন্ত্রীসভা এই মন্ত্রীসভা আবার দায়বদ্ধ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংসদে অথচ রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনতার কাছে কিংবা তাঁদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদে দায়বদ্ধ ননকারণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচকদের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত হন না, নির্বাচিত হন প্রতিনিধিনিত্বমূলক মতদানের মাধ্যমে মূলত বিভিন্ন রাজ্যের জনতার দ্বারা নিজের নিজের বিধানসভায় নির্বাচিত বিধায়কদের এবং জনতার দ্বারা নির্বাচিত সাংসদদের দেওয়া ভোটের ভিত্তিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন প্রত্যেক বিধায়কের ভোটের পরিমাণ নির্ধারিত হয় তিনি যে রাজ্যের বিধায়ক সেই রাজ্যের জনসংখ্যাকে সেই রাজ্যের বিধানসভায় নির্বাচিত বিধায়কদের মোট সংখ্যার হাজারগুণ দিয়ে ভাগ করে এতে একটি রাজ্যের প্রত্যেক নির্বাচিত বিধায়কের ভোটের মান সমান হয় অর্থাৎ যেকোনো একটি রাজ্যের প্রত্যেক বিধায়ক সমসংখ্যক রাজ্যবাসীর হয়ে মতদান করে থাকেন নির্বাচিত সাংসদদের ভোটের পরিমাণ নির্ধারিত হয় সমস্ত রাজ্যের সমস্ত বিধায়কের ভোটের সমষ্টিকে নির্বাচিত সাংসদদের সর্বমোট সংখ্যার যোগফল দিয়ে ভাগ করে , যাতে এঁরাও প্রত্যেকে সমপরিমাণ দেশবাসীর হয়ে মতদান করতে পারেন যদিও আইনত প্রত্যেক বিধায়ক বা প্রত্যেক সাংসদ নিজের পছন্দের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর সপক্ষে মত দিতে পারেন , কিন্তু সাধারণত প্রত্যেক বিধায়ক ও সাংসদ তাঁদের নিজেদের দলসমর্থিত প্রার্থীর সপক্ষেই মত দিয়ে থাকেন। ফলে রাষ্ট্রপতি নিতান্তই প্রতীকী রাষ্ট্রনেতা কিংবা কাগুজে বাঘ
এই ব্যবস্থা প্রভূত সমালোচিত এবং সমালোচনার মোকাবিলায় সংবিধানকাররা জোরালো সওয়ালও করেছেন। সংবিধান প্রণেতাদর যুক্তি ছিল যে প্রতীকী রাষ্ট্রনেতার নির্বাচনে পাঁচকোটি দশলক্ষ ( তৎকালীন ) মতদাতার অংশগ্রহণ বিপুল পরিমাণ অর্থ , সময় ও শক্তির অপচয় এছাড়াও তাঁদের যুক্তি ছিল যে , সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত দায়িত্বশীল সরকারের প্রকৃত ক্ষমতা নিহিত থাকবে মন্ত্রীত্বে অথচ পাঁচ বছরের সংবিধান নির্ধারিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের প্রক্রিয়াটি বেশ শক্তপোক্ত ।  রাষ্ট্রপতি স্বহস্তে উপরাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে লেখা পদত্যাগ পত্র উপরাষ্ট্রুতির দপ্তরে জমা দিতে পারেন কিংবা সংবিধান অবমাননার অপরাধে তাঁকে ইমপিচ করা হতে পারে লোকসভা বা রাজ্যসভার যে কোনো একটি কক্ষ রাষ্ট্রপতির সংবিধান অবমাননার অভিযোগটি সংসদের অপর কক্ষে উপস্থাপণ করতে পারে মানে লোকসভা যদি রাষ্ট্রপতির সংবিধান অবমাননার অভিযোগ আনে তবে তা আনা হবে রাজ্যসভার কাছে বা রাজ্যসভা রাষ্ট্রপতির সংবিধান অবমাননার অভিযোগ আনতে পারে লোকসভায় কিন্তু এই অভিযোগ আনার আগে অভিযোগ উত্থাপণকারী কক্ষে মানে হয় লোকসভাতে নয় রাজ্যসভাতে অভিযোগটির সপক্ষে একটি সঙ্কল্প উত্থাপণ করতে হবে সঙ্কল্প উত্থাপণ করার কম করে চোদ্দোদিন আগে সঙ্কল্পটির ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে এবং বিজ্ঞপ্তিটিতে কক্ষের মোট সদস্যদের ন্যূনপক্ষে চারভাগের তিনভাগের সই থাকতে হবে তারপর সেই সঙ্কল্পটি কক্ষের মোট সদস্যের ন্যূনপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে গৃহীত হতে হবে তবে সঙ্কল্পটি সংসদের অপর কক্ষে অভিযোগ হিসেবে পাঠানো যাবে। তদন্তের সময়ে সংসদের যে কক্ষ অনুসন্ধানে নিয়োজিত সেই কক্ষে অভিযুক্ত রাষ্ট্রপতি নিজে অথবা প্রতিনিধি মারফত অভিযোগের মোকাবিলা করতে পারেনএই দ্বিতীয় কক্ষেও যদি মোট সদস্যসংখ্যার ন্যূনপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন করেন অভিযোগ, তবে সেই কক্ষে সঙ্কল্পটি গৃহীত হওয়ার দিনই রাষ্ট্রপতি বরখাস্ত হবেন
অন্যদিকে মন্ত্রীসভার শীর্ষে থাকেন প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রীকে ও মন্ত্রীসভার বাকি সদস্যদের কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমেই বাকি সব মন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন তাই প্রধানমন্ত্রী সমানদের মধ্যে প্রথম বলে বিবেচিত হন অর্থাৎ পুরো মন্ত্রীসভার গঠনটি দাঁড়িয়ে থাকে প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার উপর এইভাবে মন্ত্রীদের অপসারণের সিদ্ধান্তটিও মূলত প্রধানমন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশেই রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার সদস্যদের বরখাস্ত করেন প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদটি রাষ্ট্রপতি দিয়ে থাকেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠদলের নেতাকে কিংবা সেই সাংসদকে যিনি সংসদের আস্থার্জনে সক্ষম শুধুমাত্র লোকসভার আস্থা হারালেই মন্ত্রীসভা পদত্যাগে বাধ্য হয় অথবা লোকসভার পাঁচ বছরের মেয়াদ ফুরোলে মন্ত্রীসভারও মেয়াদ ফুরোয় বা রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভা খারিজ করেও দিতে পারেন পাঁচ বছরের স্বাভাবিক মেয়াদের আগেই আবার রাষ্ট্রব্যাপী জরুরী অবস্থার সময় মন্ত্রীসভার মেয়াদ রাষ্ট্রপতি বাড়িয়েও দিতে পারেন সেক্ষেত্রে লোকসভার মেয়াদও বেড়ে যেতে পারে, কিন্তু সবই সংবিধান নির্ধারিত দেড় বছরের সময়সীমার মধ্য এই সময়সীমার অংশটি কোনো দলই সংশোধনের চেষ্টা করেন নি কারণ এ জাতীয় সংবিধান সংশোধনের সময় বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মানে সংবিধান সংশোধন করার সমর্থনে সংসদের উভয়কক্ষে উপস্থিত নির্বাচিত সদস্যদের ন্যূনপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন ও সমস্ত রাজ্যের অর্ধেকের বেশি বিধানসভায় ( মানে এখনকার ঊনত্রিশটা রাজ্যের মধ্যে নিদেনপক্ষে পনেরটা রাজ্যের বিধানসভায় ) সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন। যদিও রাষ্ট্রব্যাপী জরুরী অবস্থাতে রাজ্যগুলির বিধানসভার বিবেচ্য সমস্ত আইনের ওপর লোকসভার বিবেচনাই প্রাধান্য পায় তবুও সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব যেহেতু আইন নয়, সেহেতু সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে বিধানসভার মতামতের ওপর লোকসভার খবর্দারি চলবে না বলেই এখনও অবধি মানা হয় এইভাবে সংবিধানেই নিহিত আছে যথেচ্ছ সাংবিধানিক রদবদল আটকানোর উপায় তাই অধিকাংশ সময়েই মনে করা হয় ভারতবর্ষে সংবিধানেই সমূহ ক্ষমতা নিহিত আছে
অথচ তবুও টের পাওয়া যায় সংসদীয় গণতন্ত্রের হাত ধরে রাজনীতিকরাই ক্ষমতা ট্যাঁকস্থ করে ফেলেছেন এমনটা হওয়ার কারণ কী সমানদের মধ্যে প্রথম বলে বিবেচিত প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় গুরুত্ব ? কারণ সংসদে তিনিই সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা বলে সংসদের মতামত তাঁরই আঙুলের আগায় ঘোরাফেরা করে তারওপর আছে সংবিধানেরই দশম তপশীল, বাহান্নতম সংবিধান সংশোধনের ফসল, যার বলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তাঁর নির্বাচিত হওয়ার সময়ের সমর্থক রাজনৈতিক দলের বদলে অন্য রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে নির্বাচিত প্রতিনিধির পদাধিকার খারিজ হয়ে যায় চালু সংসদ বা বিধানসভার চলতি মেয়াদে ফলে রাজনীতিকে জীবিকা করে যাঁরা বিধায়কবৃত্তি বা সাংসদবৃত্তি নেন, তাঁদের পক্ষে নীতির বা স্বার্থপ্রশ্নে দলবদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া কল্পনাতীত একই কারণে বৃত্তি রক্ষায় তাঁরা গরিষ্ঠের দলে ভিড়ে থাকার চেষ্টাও করেন তাই হয়ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে বা আস্থা ভোটের সময়ে তাঁরা কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করার দলীয় সিদ্ধান্তকে আদেশের মতো পালন করেন না হলে তাঁরা দল থেকে বহিষ্কৃত হতে পারেন এবং জনপ্রতিনিধিত্বও খোয়াতে পারেন
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীত্ব বা মুখ্যমন্ত্রীত্ব নিতান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের উপর নির্ভর করে সেই হিসেবে প্রধানমন্ত্রীত্ব পেতে হলে লোকসভায় কোনো মতে পাঁচশো তেতাল্লিশ ( ৫৪৩ ) - টা আসনের ( বাকি দুটো আসন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান কমিউনিটির থেকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত প্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত ) অর্ধেকের বেশি মানে নিদেনপক্ষে দুশো একাত্তরটা ( ২৭১ ) টা আসন দখল করা । কোনো মতে আসন দখল করতে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে উপায় হলো মোর্চা গঠন করা কিংবা নিজের দলের লোকেরা মারপিট এবং খুনোখুনি করে হলেও যদি সংখ্যাওগরিষ্ঠতা তৈরি করতে পারে তো তাতে উৎসাহ দেওয়া
তাহলে নির্বাচনে মারকুটে লোক বা অপরাধীদের পরোক্ষ ব্যবহার করা এবং কালক্রমে এই সব লোকেদের প্রত্যক্ষে রাজনৈতিক দলে যোগদান করা এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল কারণ এই অপরাধীদের আনুগত্য স্বীকার করে তাদের সাহায্যে নির্বাচন জেতা যায় এবং সংসদে ও বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করা যায় এদের হাতযশে জিতে আসা প্রার্থীদের গুণতিতে রেখে আবার কালক্রমে এদেরকেই নির্বাচনে জয়ী জনপ্রতিনিধি হিসেবে ব্যবহার করার চলও হয়েছে তাই উচ্চাভিলাষী নেতা বশংবদ মারকুটে অপরাধীদের লালন , পোষণ এবং পালন করে থাকেন , তাদের নির্বাচনে জেতাতে উদ্যোগী হন বা নির্বাচনে জেতার যে প্রক্রিয়াই অপরাধীরা গ্রহণ করুন না কেন সেটাকেই নেতারা সমর্থন করেন অন্যথায় এইসব মারকুটে অপরাধীরা উচ্চাভিলাষী নেতাদের রাজনৈতিক বিরুদ্ধপক্ষে যোগ দিলে প্রধানমন্ত্রীত্ব বা মুখ্যমন্ত্রীত্ব পেতে চাওয়া নেতাদের শক্তিহানি ঘটে অর্থাৎ তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় তাই অপরাধী ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পারস্পরিক তোষণ ও পোষণ চলতে থাকে, কখনও নিজের দলের সদস্যপদ দিয়ে, কখনও সমর্থনভিত্তিক মোর্চা গঠন করে
মধ্যযুগের ভূমিভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় চালু মনসবদারিও কতকটা এমনই ছিল কেউ একটা এলাকার শাসক আর সৈন্যদলের নিয়োজক হলেই অপেক্ষাকৃত বড়ো এলাকার বা বেশি শক্তিশালী শাসক এবং বৃহত্তর সৈন্যবাহিনীর নিয়োজকের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতেনবিনিময়ে  প্রথম শাসক সৈন্যপিছু শস্য বা শস্যের মূল্য পেতেন এবং দ্বিতীয় শাসকের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য থাকতেন প্রথম শাসক নিজের এলাকায় উৎপাদিত ফসল ও অন্যান্য দ্রব্যের নির্দিষ্ট ভাগ কর হিসেবে দ্বিতীয় শাসকের কোষাগারে জমা দিতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতেনবদলে প্রথম শাসকের দখলী এলাকা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে দ্বিতীয় শাসক প্রতিশ্রুতি বদ্ধ থাকতেন প্রথম শাসকের দেওয়া করের ও সৈন্যবাহিনীর মাপ দিয়ে নির্ধারিত হতো তাঁর ক্ষমতার মাপঅর্থাৎ তিনি পাঁচ হাজারী কী দশ হাজারী নাকি বিশ হাজারী মনসবদার শক্তির এই জনসংখ্যাভিত্তিক লেনদেন ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে অটুট আছে বলেই দেখা যাচ্ছে বরং এই লেনদেনের মানাবনয়ন হয়েছে কারণ এই লেনদেনে শস্য ও অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্যের কোনো জায়গাই এখন নেইতার জায়গা নিয়েছে শাসনক্ষমতা আর সুবিধে , যেমন পঞ্চায়েত সদস্যপদ ও হাইওয়ের কন্ট্রাক্টরি , বিধায়ক পদ ও নির্বাচন ক্ষেত্রের সমস্ত প্রাইভেট সম্পত্তি হস্তান্তরের ওপর দুই শতাংশ দালালি ( নিষ্কর ) এবং সমস্ত সরকারি পরিকল্পনা ও নির্মাণের কাজের ওপর দশ শতাংশ দালালি ( নিষ্কর )চৌথ ( কৃষিজ উৎপাদনের একচতুর্থাংশ ) এবং সরদেশমুখী (কৃষিজ উৎপাদনের একদশমাংশ ) সেকালে আইন স্বীকৃত কর ব্যবস্থা ছিল একালের সামন্তরা বেআইনকেই যুগসিদ্ধ করে নিয়েছেন
ভারতে যদি রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি নির্বাচিত করে তাঁকে সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে যাবতীয় সরকারি সিদ্ধান্ত (বা সিদ্ধান্তহীনতা ) এবং কাজাকাজের জন্য দায়বদ্ধ করা হতো বা হয় তাহলে হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠের মনসবদারি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেত। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাথে রাষ্ট্রপতির আঁতাত হতে অসুবিধা থাকত না ফলে প্রাথমিকভাবে বিধ্বস্ত মনসবদারি পুনর্কায়েম হতে বেশি সময় লাগত নাপ্রধানমন্ত্রীর বদলে রাষ্ট্রপতিকে শীর্ষে রেখে রমরমিয়ে চলত মধ্যযুগীয় শক্তিচর্চা, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মোড়কে।
এই ব্যবস্থা থেকে নিস্তার পাওয়া যায় যদি বেআইনিগুলোকে অপরাধ হিসেবে মেনে নেওয়া হয় ও তার নিরসনে উদ্যোগী হওয়া যায়। সাংসদদের অপরাধ দমনের সাংবিধানিক প্রক্রিয়াটি সরলসাংসদদের যে কোনো ফৌজদারি মামলায় যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা যায়।  শর্তাধীন অব্যাহতি তাঁরা পেতে পারেন কেবল সিভিল মামলায়সেক্ষেত্রে সাংসদ অপরাধে লিপ্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করাটা তাঁর নির্বাচকদের এবং তাঁর নির্বাচক নন এমন নাগরিকদেরই অবশ্য কর্ত্তব্যএমনকি সাংসদ/বিধায়ক মন্ত্রী হলেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে কোনো অসুবিধে নেই শুধু খেয়াল রাখতে হবে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টাটা সংসদ বা বিধানসভা ভবনে না করে যেন তাঁর আবাসে বা ব্যক্তিগত কাজের জায়গায় করা হয় ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধে উঠে নাগরিকরা এমন একটা কাজ করে ফেলবেন সেটা ভাবাটা সোনার পাথরবাটিতে দুধ খাবার সামিল কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে অবশ্য
তাছাড়া অপরাধী বা প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ জনপ্রতিনিধিকে পাঁচ বছর সময় দেওয়ার বদলে পাঁচ বছরের মধ্যেই বরখাস্ত করার সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার অর্জন করলেও মনসনবদারি ব্যবস্থাটি প্রকৃত গণতন্ত্র হয়ে উঠতে পারে করছি , করব করে পাঁচ বছর কাটিয়ে ভাগ্য , কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের নামে দোষারোপ করে অনেক প্রতিনিধিই সমবেদনা কুড়িয়ে নির্বাচনের পর নির্বাচন জিততে থাকেনঅনেকে এই কাজটাতেও মনসবদারিমূলক পেশীশক্তিই ব্যবহার করেনএই দুরকম হিসেবেই অযোগ্য জনপ্রতিনিধিদের কবল থেকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হতে পারে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে প্রত্যাহার করার সাংবিধানিক ব্যবস্থা ব্যবস্থা এরকম হতে পারে যে একটি নির্বাচন ক্ষেত্রের ন্যূনপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিক সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনের কাছে কোনো একজন প্রতিনিধিকে প্রত্যাহারের লিখিত আবেদন জানালে  প্রত্যাহারের সপক্ষে মতদান / নির্বাচন আয়োজন করা হবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতটি প্রতিষ্ঠিত হবে
আরেক দফা নির্বাচনকে খরচ সাপেক্ষও মনে হবে না যদি নির্বাচনে কমিশন নিয়ম করে দেন বা সংবিধানের নির্বাচনী ধারাগুলোতেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যে যে কোনো নির্বাচনী ক্ষেত্রের যাবতীয় নির্বাচন হবে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে যেমন, এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় রবিবার কারণ এই সময়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্ভাবনা আসমুদ্র হিমাচলব্যপী ভারতবর্ষে সবচেয়ে কম হিংসাত্মক ঘটনা যাঁরা ঘটান তাঁদের প্রতিহত করার জন্য অবশ্য অনেক অনেক পরিমাণে নিরাপত্তা বাহিনী লেগে যাবে তাতে সেক্ষেত্রে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ রবিবারকে ব্যববহার করা যায় নির্বাচনের দিন হিসেবে এছাড়াও চালু বিধানসভাগুলোর মেয়াদ চার বছর থেকে পাঁচ বছর ছমাসের মধ্যে বেঁধে ঊনত্রিশটা বিধানসভা এবং সাতটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ছত্রিশটা নির্বাচনকে প্রতি বছরে তিনটে করে রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নির্বাচনে সীমিত করে ফেলা যায় আরেকটা বছরে লোকসভা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যায়। পঞ্চম বছরকে রাখা যায় সমস্ত পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচনের জন্য অথবা এই শেষদুটো নির্বাচনকেও সংশ্লিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচন বা লোকসভা নির্বাচনের সাথে একই দিনে ঘটানো যায় তাতে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর প্রয়োজন কিছুটা কমানো যায় কারণ হিংসার লগ্নীকারীদেরও একই দিনই একাধিক প্রতিনিধির নির্বাচনে পর্যাপ্ত হিংসুটে/মারকুটে লোক জোটাতে খানিকটা বেগ পেতে হবে তারওপর এক নির্বাচনী ক্ষেত্রে দায়িত্বপালনে ব্যর্থ কিংবা পরাজিত প্রার্থীকে একাধিক পদে মনোনীত করা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও মুশকিল হবে ও তাদের সমর্থনে পর্যাপ্ত হিংসুটে/মারকুটে লোক জোটাতে আরও বেশি বেগ পেতে হবে তাদের কারণ দেখা যায় যে পঞ্চায়েতসফল নেতাকে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হলে তাঁরা অনেকসময় ব্যর্থ হন ও পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় ফিরে নিজ এলাকায় দখল আর শাসন কায়েম রাখার স্বাচ্ছন্দ্যে ফিরে যানএকই দিনে পঞ্চায়েত / পৌরসভা এবং বিধানসভা বা লোকসভার নির্বাচন হলে কোথায় কোন প্রার্থীকে দেওয়া হবে সেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আভ্যন্তরীণ অশান্তিতেও জেরবার হয়ে যেতে পারে ও, ফলে , তাদের পক্ষে প্রশাসনিক অশান্তি বাঁধানোও দুরূহ হয়ে যেতে পারে মানে আভ্যন্তরীণ মনসবদারি কোন্দলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় যোদ্ধৃ পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠতে পারেতাছাড়াও এক এলাকার গুণ্ডাবাহিনী সেই এলাকার স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন ছেড়ে অপর এলাকায় বিধানসভার  লোকসভার নির্বাচনে গিয়ে অশান্তি পাকাবার সময় ও সুযোগ দুটোই নাও পেতে পারে এতে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর প্রয়োজন কমতে পারেসেক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত পঞ্চম বছরে সমস্ত অন্তর্বর্তী নির্বাচন করে ফেলা যেতে পারে
এটাও সোনার পাথরবাটিতে চাটনি চাটার মতো লাগলে নাগরিক ম্যানিফেস্টো বানানো যায়একেক নির্বাচন ক্ষেত্রের নাগরিকরাই কী কী চাই আর কী কী চাই - নার ফর্দ বানিয়ে পাড়ায় ফেস্টুন/ হোর্ডিং লাগাবেন, স্থানীয় কেবল নেটওয়ার্কে ( নেটওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিঊটরের দাবিও ফর্দে রেখে) জনস্বার্থে ( নিঃখরচায়? ) প্রচার করবেন, তা বাদে সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রচার করা যায় বিভিন্ন দলের নানান প্রার্থীর মধ্যে যাঁরা নাগরিক পছন্দের সঙ্গে একমত হয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যেকার দলগুলির নিজেদের খরচে করা প্রাথমিক নির্বাচনে জিতে সমগ্র নির্বাচন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করবেন নির্বাচন কমিশন পরিচালিত নির্বাচনে তাঁকেই প্রতিনিধিত্বে বরণ এবং প্রয়োজনে বরখাস্ত করা যাবে
যতদিন না এসব করা যাচ্ছে ততদিন প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ জনপ্রতিনিধিকে প্রতারণার ফৌজদারি মামলায় ফাটকে পোরার ব্যবস্থা করাই যায় অর্থাৎ প্রত্যেক জনপ্রতিনিধিকে তাঁদের নির্বাচকসমষ্টির প্রতি, নির্বাচনক্ষেত্রের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলার জন্য ব্যবস্থা নেওয়াই যায় সমষ্টিগতভাবে সেই দুঃসাহসটা করতে হলে বুঝতে হবে যে মিলিটারি ক্যাম্প করার জন্য আমাদের মাঠটা ছেড়ে দিতে হলেও তাত্র দেশ সুরক্ষিত হব, কিংবা আমার বাগান আর ক্ষেতের খানিকটা হাইওয়ের জন্য দিলে কাল আমার বসত ভিটাটা ঢাবা, ঢাবা থেকে হোটেল হতে পারে ভবিষ্যতের লাভের দিকে তাকিয়ে বর্তমানের ক্ষতি স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিলের ব্যবস্থা ছেড়ে যুক্তি দিয়ে হক আদায়ের চেষ্টায় লাগতে হবে জনপ্রতিনিধিকে দায়িত্ব বোঝাবার আগে নিজেদের দায়িত্ববান হতে হবে
অতএব সোনার পাথরবাটিটা যতক্ষণ না কাঁচ / প্লাস্টিক / ইস্টিলের মতো বাস্তব হয়, সে পর্যন্ত না হয় গলা মেলাই আর তাল দিয়ে যাই , তুমিই আমার সিপিএম , তুমিই আমার এটিএম , তুমিই আমার সিরিজ প্রেমের শেষটা , তুমিই আমার তৃণমূল , তুমিই আমার টোপাকুল , তুমিই আমার সিরিজ ভুলের শেষটা কিংবা তুমিই আমার বিজেপি, তুমিই আমার জিলাপি, তুমিই আমার সিরিজ লোভের শেষটা
ঋণঃ
১। Introduction to the Constitution of India, 18th Edition, Acharya Durga Das Basu,
২। http://rajyasabha.nic.in/rsnew/rsat_work/chapter-8.pdf

৩। চন্দ্রবিন্দু।

Sunday, February 14, 2016

আমার ভ্যালেন্টাইন

অয়স্কান্ত চেহারা তাঁর বয়স কম তো নয়
ডাবল চিনে ঢেকে রাখেন নীচের ঠোঁটের ক্ষয়
ভীষণ রাগী মুখের ভেতর ফিচেল হাসির বাণ
চুলের কালো মুছে গিয়ে সাদার দিকেই টান

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

মধ্যভাগে উচ্চ তিনি উচ্চভাগে ভারী
চশমা দিয়ে শুষতে থাকেন যত দেখনদারি
কোলে রাখেন বালিশটা তাঁর সামনে খোলা বই
খুলে রাখা ল্যাপটপে ফের লাগান খোঁচা দুই

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

রাতে তাঁকে জাগিয়ে রাখে সিনেমার বাই
দিনের বেলা ঘুমোন তিনি রাত জেগেছেন তাই
তাইতো তিনি পান না সময় খান না সারা দিন
সারা রাতে খালি করেন বিস্কুটের সব টিন

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

তাঁর কাষ্ঠ কাশিখানা বাঁশির মত লাগে
আওয়াজখানা ফিরতে থাকে তাঁরই আগে-ভাগে
ঠোঁটের আগে ঝুলিয়ে রাখেন যত্নে সিগারেট
এটার সংখ্যা ছাপিয়ে যায় সকল এস্টিমেট

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

ছিলেন তিনি সঞ্জীব কাপুর ব্যাচেলর কালে
বউয়ের হাতে চিকেন খেয়ে রাঁধতে গেছেন ভুলে
ভুলে গেছেন কেমন করে কুটো করতেন দুটো
হাঁকাহাঁকি করেন শুধু বুজিয়ে কানের ফুটো

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

গুণের কথা বলব কত হাঁপিয়ে গেলাম প্রায়
তাঁর পাঁচালী লিখতে গেলে কবজি মোচড় খায়
আসছে বছর লিখব আবার তাঁর নামে এক পুরাণ
ভাল থাকুন তিনি, তাতে জুড়োক আমার পরাণ

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

Readers Loved