একটা বন ছিল অমলতাসের। সেখানেই ঘুমিয়ে ছিল ররঙ্গা। তার গায়ে ছিল অমলতাসের ঝরে পড়া পাপড়ির চাদর। তার বিছানাও ছিল অমলতাসের ঝরে পড়া পাপড়িতে ঢাকা। দিনের বেলা সূর্যের আলো সেখানে আগুন জ্বালাত না, সোনা ঝরাত। সেই সোনার একটা ফোঁটা যখন ররঙ্গার গায়ে এসে পড়ত তখন তার গায়ের অখন্ড সোনার চাদরখানা অসংখ্য টুকরোতে ছড়িয়ে দিয়ে সে জেগে উঠত।
তারপর অভ্যেস মতো দাগ কাটতে যেত যে গাছে তার বাস তার গুঁড়িতে। তারপর হাত গুটিয়ে নিত। তার স্পষ্ট মনে পড়ে যেত প্রথম যেদিন সে রুরুর নৌকার বাইরে বেড়িয়েছিল সেদিন ছিল পূর্ণিমা। তার চারপাশে ছিল ইলাওয়ারা শিখার রক্তিমা, দিনে রাতে। সে অমলতাসের স্বর্ণালির মতো এমন নরম নয়। তাতে মনে প্রচুর উত্তেজনা, অশান্তি, কৌতুহল তৈরি হয়।
আবার এও মনে হতো যে সেই সময়টাই তো অমন ছিল। ইলাওয়ারার রক্তিমার আর দোষ কী! তখন সবে সে রুরুকে বিয়ে করেছে। রুরু তাকে লুকিয়ে রেখেছে নৌকার খোলে, মায়ের কাছে ফিরে ভাইদের আর ভাইবউদের চমকে দেবে বলে। তখন ররঙ্গার মনের মধ্যে ছিল ফুলশয্যার আবহ। যখন সে ঠাহর করল যে সে ইলাওয়ারা বনের মধ্যে তখনও ভাবছিল এই বুঝি রুরু আসবে, ইলাওয়ারার রক্তিমাটাই বুঝি রুরুর দারুণ আবেগরাঙা ফুলশয্যার উপহার।
না নাওয়া, না খাওয়া, কেটে গিয়েছিল দুটো রাত আরও। তৃতীয় দিনে তেষ্টায় চোখে অন্ধকার দেখে ররঙ্গা চলতে শুরু করেছিল জমির ঢাল বেয়ে। শেষে পৌছেছিল সমুদ্দুরে। অত জল, কিন্তু তেষ্টা মেটেনি। তখন আবার চোখ মেলে খুঁজে ছিল মোহানা। মোহানা খুঁজতে তাকে চড়তে হয়েছিল এক বালিয়াড়ির মাথায়। সব কিছু সে যেন কেমন অদ্ভুত নিচু থেকে দেখছিল। তার সন্দেহ হচ্ছিল বিয়ে হলে মেয়েরা সত্যিই খাটো হয়ে যায় নাকি!
যা হোক মোহানা থেকে কিছু উপরে গিয়ে সে নদীর পাশে জমা জলের পুকুর পেয়েছিল। সে পুকুরে মুখ চুবিয়ে জল খেয়ে যেই মুখ তুলেছিল, তখনই সে নিজের ছায়াটা খেয়াল করেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে নি। জলটা বার বার ঘুলিয়ে দিয়ে, এ পুকুর সে পুকুর ছুটে যখন সে দেখেছিল যে তার ছায়া কিছুতেই বদলাল না, তখন সে কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল যে সে আর মানুষ নেই, কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে।
তারপর থেকে তিনটে পূর্ণিমা সে গুণতে পেরেছিল। কারণ তিনটে পূর্ণিমা পরে এসে উপস্থিত হয়েছিল একটা টুনটুনি। সে কেবল গান গাইত,
“ও ওরে ও ররঙ্গা,
চারিদিকে মারদাঙ্গা।
চানু নিল কী পাঙ্গা!
রাজা হবে না চাঙ্গা।” - ররঙ্গা কিছুই বোঝে নি। আর পরের পূর্ণিমা আসার আগেই এক ভোরে তার ঘুম ভেঙেছিল সাদা সবুজে প্রাণবন্ত এক গজদন্ত কুণ্ডলি বনে। আর ঘুম ভেঙেছিল সূর্যের আলোর ছোঁয়ায় নয়, টুনটুনির গানে। সেই এক ঘেয়ে একটানা গান, “ও ওরে ও ররঙ্গা, ......”
টুনটুনিকে এড়িয়েই যেত ররঙ্গা। তাছাড়া তার মাথায় হরেক দুঃশ্চিন্তা ছিল। মূলতঃ সে কী করে তার মানুষী রূপ ফিরে পাবে, কী করেই বা রুরু তাকে চিনবে, তার সাথে রুরুর দেখা হবে কবে। ভেবে ভেবে তার ক্রমাগত ওজন কমে যাচ্ছিল। তারপর তার দিন গোনার ধরতাই খোয়া গিয়েছিল। সে উদ্গ্রীব ভাবে অপেক্ষা করছিল পরের পূর্ণিমার। তারপর তার মাথায় এসেছিল যে সে তো সময়ের হিসেব রাখতে পারে তার শারীরবৃত্ত দিয়েও। পূর্ণিমার ব্যবধান সাতাশ দিনের, আর আটাশ দিনান্তর তার নারীত্বের ক্ষরণ। সেই সূত্রেই সে টের পেয়েছিল যে যতগুলো পূর্ণিমাই কাটুক, তার শরীর তাল মেলায় নি।
তার শিরদাঁড়া জুড়ে হিমপ্রবাহ বহে যেত কথাটা মনে পড়লেই। সে মাত্র একবেলার বিবাহিত, না হয়েছিল তার বাসর, না ফুলশয্যা। তার কুমারীত্বও অক্ষত ছিল। তবু তার রজোচক্রে যতি পড়ার কী কারণ সে ঠাহর করতে পারছিল না। তার মনুষ্যত্বের মতো তার নারীত্বও গেছে কিনা তাই নিয়ে সে বিব্রত হচ্ছিল থেকে থেকেই। আবার বিরক্তও হচ্ছিল যে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সে দিনরাত মনোসংযোগও করতে পারছিল না সারাদিন থেকে থেকে তার খিদে পেতে থাকার কারণে।
রান্নার উপায় নেই, উনুন নেই, রান্নাঘর নেই, বাড়িই নেই। কাঠবেড়ালি হয়ে গাছের ওপর থাকা, খাবার খোঁজো, খুঁজে পেলে উদরস্থ করো, পেট ভরুক না ভরুক আবার দৌড়োও। যত পারো দিনের আলো থাকতে থাকতে পেট ভরে নাও ঠেসে। আর রাতে কোনো বিনোদন নেই। কেবল গাছে চড়ে ঘুমিয়ে পড়ো, চেনা তারামণ্ডল বার বার দেখে, চেনা তারা বার বার গুণে, একঘেয়েমির ক্লান্তিতে। এখন ভাবলে তার সন্দেহও হতো যে ক্লান্তি সারাদিন এ গাছে, ও গাছে চড়ে, নেমে, খাবার খুঁজে ছুটে বেড়ানোর জন্য নাকি একঘেয়েমি থেকে।
এরকম সময় টুনটুনিতে গাইতে শুরু করেছিল,
“ররঙ্গা, ররঙ্গা, ররঙ্গা
রাজা তো এবারে একবগ্গা
চানুকে পেলেই ফাঁসির আজ্ঞা
টুনটুনিও ছাড়বে এ জায়গা।” – এ গানেরও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারে নি ররঙ্গা। কিন্তু আবারও এক ভোরে সে আবিষ্কার করে যে সে শুয়ে আছে সাদা সবুজের থোকায় ভরাট একটা শ্বকাষ্ঠকুঞ্জে। এবার আর বিস্ময় নয়, ভয় নয়, সে আক্রান্ত হলো বিরক্তিতে। জমির ঢালে ছুটে গেলে পাওয়া যায় শুকনো নালা। অনেক খুঁজে সে একটা বিশাল হ্রদ আবিষ্কার করল যাতে সাদা চিবুক আর পেট কিন্ত কালো মাথা, গলা আর বাদামী ডানার হাঁসেরা সাঁতার কাটে। যে রাতে ঠান্ডা বাড়ে সে রাতে হাঁসগুলো বিকট ডাকে পাড়া অতিষ্ঠ করে উড়ে যায়। রাতের ঘুম চুরমার হয়ে যায় ররঙ্গার।
ফলে দিনের বেলা তার আর বিরক্তি কমতেই চায় না। নতুন এলাকায় জলের পর চলে খাবারের খোঁজ। ররঙ্গার বিরক্তি আসে এটা ভাবলেও যে এই নতুন এলাকায়, নতুন আবহাওয়ায় মানিয়ে নেওয়া মাত্রই, গুছিয়ে নেওয়া মাত্রই তার ঘুম ভাঙবে নতুন এলাকায়, নতুন আবহাওয়ায়। আবার তাকে খুঁজতে হবে, জল, খাবার, আর বাসা বানানোর উপযুক্ত গাছ। ঠিক কবে এমনটা হবে সে জানেও না। কেন হবে তাও জানে না। জানলে অন্তত সে এরকম হওয়ার কারণটাকে প্রভাবিত করতে পারত নিজের সুবিধা মতো। নিজের অসামর্থ্য আর অপারগতার ওপর রাগতে রাগতে সে ভয়ানক হতাশ হয়ে পড়ল।
ররঙ্গার কেবল মনে হতে লাগল যে যদি সে রুরুকে বিয়ে করে রুরুর দেশে যাওয়ার জন্য রুরুর নৌকায় না উঠত তাহলে এমন করে নিজের জীবনের ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণটুকু সে খোয়াত না। সমস্ত যুক্তি দিয়ে বিচার করলেও সিদ্ধান্ত যে আবেগতাড়িতই হয় সে কথা বুঝতে পেরে তার আরও হতাশ লাগতে লাগল, আরও বিরক্তি আসতে লাগল তার মনে। সকাল সন্ধে সে গাল পাড়তে লাগল নিজের বুদ্ধিকে। এর মধ্যে আবার একদিন শুনতে পেল টুনটুনি গাইছে,
“রাজা ধরেছে চানুকে, সঙ্গে সাতটা ভাই
ভাইগুলো সব চোর নাকি তা বোঝার উপায় নাই” – সাত ভাইয়ের কথা শুনে ররঙ্গা চমকে ওঠে। তাছাড়া তার রজঃস্রাব শুরু হওয়ায় সে বিশেষ হুটোপাটি করে খাবার জোগাড় করতেও পারছিল না, খুব খিদেও তার ছিল না। দিনের ব্যস্ততা উপে যাওয়ায় তার আরও একঘেয়ে লাগছিল। রাতে তবু তারা গোনা যায়, দিনের বেলাটা আরও নির্জন লাগে তার। তাই গানের কথাগুলো তার মনে পাক খেতে লাগল।
“টুনটুনিতে টুনটুনাবে
যবে চানু রাজা হবে
রাজা রাগী আর শক্তিমান
জমিদারকে ধমক লাগান
জমিদারই চানুর শ্বসুর
চানুকে তাঁর ভরসা প্রচুর
‘নাক কাটা রাজা জব্দ কী?’
পারে নি বলতে রানির ঝি।
তাই রাজাকে শাস্তি দিতে
লাগল চানু দল পাকাতে
মিলল সে সাত চোরের সাথে
বুড়ি গেল রাজবাড়িতে
সেখানে সে দাসী হলো
চানুকে রোজ খবর দিল
রানির ঝি যেই টেরটি পেল
রাজা বুড়ির গর্দান নিল”
এই অব্দি শোনার পর ররঙ্গার দিন গোনা ভেস্তে গেল আবার। নিজের শরীরের খবর রাখতে সে গাছের গুঁড়িতে আঁচড় দিচ্ছিল রোজ। কিন্তু এক ভোরে সে জাগল ম্যাগনোলিয়া বনে। সারা বন বেগুনি, গোলাপি, সাদা বিশাল বিশাল একক ফুলে ছয়লাপ। দীর্ঘশ্বাস পড়লেও ররঙ্গা আর বিরক্ত হয় নি। চমক হলেও শুধুই বসন্ত আর সৌন্দর্য ছিল তার প্রত্যেক স্থানান্তরণে। তাই নতুনে মুগ্ধতা সে মেনে নিয়েছিল। নিজের ভালো লাগাকে নিজে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অনুরাগ প্রেমে পরিণতি পাওয়ার আগেই যে বিরহ পেয়ে শোকে, দুঃখে সে ডুবে গিয়েছিল, তার থেকে যেন একটু ভেসে উঠেছিল, যেন চিৎ সাঁতারে অল্প বিরাম খুঁজেছিল।
এর মধ্যে টুনটুনির থেকে আরও বেশি গান শোনার আশায় সে অনেকবার টুনটুনিকে বাদাম বা দানা খেতে দিয়েছে। টুনটুনি সেসব খায় নি। ভাবও করেনি। ঝগড়াও করে নি। খুব নিঃস্পৃহভাবে নিজের খেয়ালে গান গেয়েছে আর লম্বা বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে ফুলের মধু শুষে নিয়েছে। তাই প্রথমবার ম্যাগনোলিয়া বনে ররঙ্গা টুনটুনির অপেক্ষা করছিল। সে যে অপেক্ষা করছে সে কথা নিজে বুঝতে পারার অনেক আগে থেকেই।
আবার একদিন শুনতে পেল,
“বুড়ির মাথা কাটা যেতে চানু গেল খেপে
চাল সাজাল ভীষণ রকম এদিক ওদিক মেপে
রুরুরা গেল বিয়ে করতে ররঙ্গার দেশে
রূপোসীরা ঠকিয়ে দিল ছয় ভাইকে কষে
রুরু ছাড়া আর কোনো ভাই বোঝে নি সে কথা
নৌকা চড়ে ফিরছিল সব মায়ের বাড়ি যেথা
এক রাতে চানু করল চুরি সেই নৌকাখানা
কাঠবেড়ালি হলো বটে মানুষ চোদ্দখানা
নৌকাখানা উড়ছে এখন মস্ত ঘুড়ির পিঠে
সাত চোরে তার ধরছে লাটাই জলে ডাঙায় ছুটে” – খটকা লাগছিল ররঙ্গার। সাতভাইকে নাকি রাজা ধরেছিল! তাহলে তারা ঘুড়ির পিঠে নৌকা কী করে ওড়াচ্ছে? আবার নৌকার চোদ্দজনই যদি কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে তাহলে চানুর সাথে ধরা-পড়া সাতটা ভাই কারা? টুনটুনি মিথ্যে বলছে কী?
তক্কে তক্কে থেকে একদিন টুনটুনির গলাটা থাবা দিয়ে চেপে ধরেছিল ররঙ্গা একটা গাছের গুঁড়িতে। সে চিল চীৎকার করেছিল, “আমাকে যদি আজ মেরে ফেলিস, তোকে বাকিটা কে বলবে?” ররঙ্গা তাতে ঘাবড়ায় নি, সে থাবাও আলগা করে নি, বলেছিল, “বাঁচতে হলে শিগগির বল বাকিটা।” কিন্তু টুনটুনি আর কিছুই বলে নি তখন। একটু কাতরে ছিল, খানিক পরে তার শরীরটা শক্ত হয়ে মাথাটা এলিয়ে পড়েছিল। ররঙ্গা তাতে বেশ হতাশ হয়েছিল। এরপর আর কোনো খবরই পাবে না ভেবে যখন সে দুশ্চিন্তায় ঘেমে উঠছিল য়ার ঝাপসা চোখে বেগুনি রঙের ফুল দেখছিল, তখন থাবাটা যে কী করে আলগা হয়ে গিয়েছিল সে টের পায় নি। তার হুঁশ হয়েছিল,
“ঝড়বাদলে ছিঁড়ল ঘুড়ি নৌকা গেল উড়ে,
তার টুকরো ছড়িয়ে গেল রাজার বাগান জুড়ে” - শুনতে পেয়ে। সে বুঝেছিল যে চতুর পাখিটা মরার অভিনয় করে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর পাখিটা আবার গায়েব হয়েছিল। তারপরে যে অমলতাসের বনে ররঙ্গা ছিল সেখানে সে একদিনও আসেনি।
ঘুম ভেঙে যেদিন ররঙ্গা দেখেছিল যে সে পলাশবনে সেদিন সে ভেবেছিল যে রুরুও যদি কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে তো কাঠবেড়ালির স্বরে, কাঠবেড়ালির ভাষায় তাকে ডাকলে নিশ্চয়ই সে শুনতে পাবে যদি সে আশেপাশে থাকে। উত্তেজনা উদ্দীপণায় ঝটপট করে সে একটা ঝোরা খুঁজে বার করেছিল। তাতে স্নান করে, দাঁত মেজে, চোখমুখ ডলে ডলে ধুয়ে নিজেকে ঝকঝকে করে ফেলেছিল। তারপর পলাশ পাতায় বাদাম সাজিয়ে ডেকেছিল, “রুরু, রুরু” বলে। সেই ডাক পলাশের রক্তিমা, স্বর্ণাভা, শুভ্রতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল বনান্তরে। তারপর সূর্য যখন পাটে বসেছিল, তখন হাঁপাতে হাঁপাতে একটা কাঠবেড়ালি এসে ররঙ্গার নাম ধরে ডেকে ছিল। ররঙ্গার কোনো ভুল হয় নি রুরুকে চিনে নিতে। তারপর তারা উদ্যাপণ করেছিল তাদের বকেয়া বাসর, ফুলশয্যা। আর সকালে জেগে উঠেছিল আবার মানুষের বেশে।
নিজেদের মগ্নতা থেকে অবকাশ পেলে শুনেছিল টুনটুনি গাইছে,
“ছেলে, বউ সব গায়েব হতে মা ছুটেছিল রাজদরবারে
প্রজা নাকাল হচ্ছে শুনে রাজা মেতেছিল সংহারে
মন্ত্রী, সান্ত্রী, যন্ত্রী মিলে ধরেছিল সব চোর ডাকাতকে
সেই সঙ্গে ধরেছিল নিজেদের উটকো যত স্যাঙাতকে
ঠ্যাঙিয়ে স্যাঙাত জেনেছিল তারা চানুর দলের খবর
চালিয়ে হানা চানুর ঠেকে পেয়েছিল প্রমাণ জবর
চানুও কিছু কম নয় বটে, তারও ছিল গুপ্ত সেনা
কিছু ফেরার, কিছু নাচার যারা শুধতে পারেনি দেনা
সবাই মিলে রে রে রে করে তেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল
রাজার বাহিনীও তাদের পিটিয়ে ঠান্ডা করেছিল
নাকের শোকে কাতর রাজাকে ঠুকরে আসতাম আমি নিজে
জাদুবলে পালাতাম ধূলোর ঝড়ে বালি দানার সাজে
তাই তো আমিও ছোট্টো সিপাই ছিলাম চানু চোরের দলে
একলা কী করে লড়ি বলো রাজার সঙ্গে পাঙ্গা নিলে?
তারপর এক রাতে জাদুকর গেল রাজার হাজতে মরে
নাওয়ের টুকরো ঝরল রাজার বাগানে জাদুর ঘুড়ি ছিঁড়ে
সেই টুকরোতে লেগে থাকা সুতো ধরিয়ে দিল সাত চোর
তাদের শপথে পড়ল ভেঙে সেরা চোর চানুর যত জোর
জানি না কী করে আমার প্রাণ বাঁচবে চানুর সাজা হলে
এ আবার কী! কে জড়াল, কী করে এমন রঙিন জালে!” – টুনটুনির গান গেল থেমে। আসলে বিভোর হয়ে টুনটুনি যখন বিলাপ গাইছিল, তখন নিঃসাড়ে জড়ো হয়ে ছিল রুরু আর তার সাত ভাই। রুরুর সাথে ররঙ্গা। সাত ভাইয়ের সাথে ছিল তাদের বউয়েরা। জাদুকর মরে যেতেই সবাই কাঠবেড়ালি থেকে মানুষ হয়ে গিয়েছিল। আর খুঁজে পেয়েছিল বাকিদের। তারপর সাত বউ মিলে খোঁপার জাল জুড়ে জুড়ে একটা জাল বানিয়েছিল। সাত ভাই একে অপরের কাঁধের ওপর চড়ে পৌঁছেছিল সেই পলাশ গাছের মগডালে, আর সন্তর্পণে জাল ছুঁড়ে ঢেকে ফেলেছিল পাশের গাছের মগডালে শোকসঙ্গীত বিভোর টুনটুনিকে।
জালে আটকা পড়ে টুনটুনি সন্ধি প্রস্তাব দিয়েছিল। পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাজদরবারে, যেখানে চানুর বিচারসভা চলছিল। সেখানে সে কবুলও করেছিল, নৌকাসুদ্ধ চোদ্দোজনকে চুরি করে কেমন মায়া কাননে লুকিয়ে রাখা হতো কাঠবেড়ালি করে, নানান দেশের বসন্তের পরিবেশে। টুনটুনি কিন্তু ছাড়া পায় নি শেষে। রুরুরা টুনটুনিকে রাজার লোকের হাতে তুলে দেওয়ার পর টুনটুনির সাথে তাদের সন্ধির কথা নিশ্চয়ই কেউ আমল দেয় নি। তাই বিচার শেষে চানু বা টুনটুনির কী হয়েছিল তাও জানা যায় না।
ঋণঃ ছোটো ভাই, ঝানু চোর চানু, টুনটুনি ও রাজার কথা, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি।
তারপর অভ্যেস মতো দাগ কাটতে যেত যে গাছে তার বাস তার গুঁড়িতে। তারপর হাত গুটিয়ে নিত। তার স্পষ্ট মনে পড়ে যেত প্রথম যেদিন সে রুরুর নৌকার বাইরে বেড়িয়েছিল সেদিন ছিল পূর্ণিমা। তার চারপাশে ছিল ইলাওয়ারা শিখার রক্তিমা, দিনে রাতে। সে অমলতাসের স্বর্ণালির মতো এমন নরম নয়। তাতে মনে প্রচুর উত্তেজনা, অশান্তি, কৌতুহল তৈরি হয়।
আবার এও মনে হতো যে সেই সময়টাই তো অমন ছিল। ইলাওয়ারার রক্তিমার আর দোষ কী! তখন সবে সে রুরুকে বিয়ে করেছে। রুরু তাকে লুকিয়ে রেখেছে নৌকার খোলে, মায়ের কাছে ফিরে ভাইদের আর ভাইবউদের চমকে দেবে বলে। তখন ররঙ্গার মনের মধ্যে ছিল ফুলশয্যার আবহ। যখন সে ঠাহর করল যে সে ইলাওয়ারা বনের মধ্যে তখনও ভাবছিল এই বুঝি রুরু আসবে, ইলাওয়ারার রক্তিমাটাই বুঝি রুরুর দারুণ আবেগরাঙা ফুলশয্যার উপহার।
না নাওয়া, না খাওয়া, কেটে গিয়েছিল দুটো রাত আরও। তৃতীয় দিনে তেষ্টায় চোখে অন্ধকার দেখে ররঙ্গা চলতে শুরু করেছিল জমির ঢাল বেয়ে। শেষে পৌছেছিল সমুদ্দুরে। অত জল, কিন্তু তেষ্টা মেটেনি। তখন আবার চোখ মেলে খুঁজে ছিল মোহানা। মোহানা খুঁজতে তাকে চড়তে হয়েছিল এক বালিয়াড়ির মাথায়। সব কিছু সে যেন কেমন অদ্ভুত নিচু থেকে দেখছিল। তার সন্দেহ হচ্ছিল বিয়ে হলে মেয়েরা সত্যিই খাটো হয়ে যায় নাকি!
যা হোক মোহানা থেকে কিছু উপরে গিয়ে সে নদীর পাশে জমা জলের পুকুর পেয়েছিল। সে পুকুরে মুখ চুবিয়ে জল খেয়ে যেই মুখ তুলেছিল, তখনই সে নিজের ছায়াটা খেয়াল করেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে নি। জলটা বার বার ঘুলিয়ে দিয়ে, এ পুকুর সে পুকুর ছুটে যখন সে দেখেছিল যে তার ছায়া কিছুতেই বদলাল না, তখন সে কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল যে সে আর মানুষ নেই, কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে।
তারপর থেকে তিনটে পূর্ণিমা সে গুণতে পেরেছিল। কারণ তিনটে পূর্ণিমা পরে এসে উপস্থিত হয়েছিল একটা টুনটুনি। সে কেবল গান গাইত,
“ও ওরে ও ররঙ্গা,
চারিদিকে মারদাঙ্গা।
চানু নিল কী পাঙ্গা!
রাজা হবে না চাঙ্গা।” - ররঙ্গা কিছুই বোঝে নি। আর পরের পূর্ণিমা আসার আগেই এক ভোরে তার ঘুম ভেঙেছিল সাদা সবুজে প্রাণবন্ত এক গজদন্ত কুণ্ডলি বনে। আর ঘুম ভেঙেছিল সূর্যের আলোর ছোঁয়ায় নয়, টুনটুনির গানে। সেই এক ঘেয়ে একটানা গান, “ও ওরে ও ররঙ্গা, ......”
টুনটুনিকে এড়িয়েই যেত ররঙ্গা। তাছাড়া তার মাথায় হরেক দুঃশ্চিন্তা ছিল। মূলতঃ সে কী করে তার মানুষী রূপ ফিরে পাবে, কী করেই বা রুরু তাকে চিনবে, তার সাথে রুরুর দেখা হবে কবে। ভেবে ভেবে তার ক্রমাগত ওজন কমে যাচ্ছিল। তারপর তার দিন গোনার ধরতাই খোয়া গিয়েছিল। সে উদ্গ্রীব ভাবে অপেক্ষা করছিল পরের পূর্ণিমার। তারপর তার মাথায় এসেছিল যে সে তো সময়ের হিসেব রাখতে পারে তার শারীরবৃত্ত দিয়েও। পূর্ণিমার ব্যবধান সাতাশ দিনের, আর আটাশ দিনান্তর তার নারীত্বের ক্ষরণ। সেই সূত্রেই সে টের পেয়েছিল যে যতগুলো পূর্ণিমাই কাটুক, তার শরীর তাল মেলায় নি।
তার শিরদাঁড়া জুড়ে হিমপ্রবাহ বহে যেত কথাটা মনে পড়লেই। সে মাত্র একবেলার বিবাহিত, না হয়েছিল তার বাসর, না ফুলশয্যা। তার কুমারীত্বও অক্ষত ছিল। তবু তার রজোচক্রে যতি পড়ার কী কারণ সে ঠাহর করতে পারছিল না। তার মনুষ্যত্বের মতো তার নারীত্বও গেছে কিনা তাই নিয়ে সে বিব্রত হচ্ছিল থেকে থেকেই। আবার বিরক্তও হচ্ছিল যে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সে দিনরাত মনোসংযোগও করতে পারছিল না সারাদিন থেকে থেকে তার খিদে পেতে থাকার কারণে।
রান্নার উপায় নেই, উনুন নেই, রান্নাঘর নেই, বাড়িই নেই। কাঠবেড়ালি হয়ে গাছের ওপর থাকা, খাবার খোঁজো, খুঁজে পেলে উদরস্থ করো, পেট ভরুক না ভরুক আবার দৌড়োও। যত পারো দিনের আলো থাকতে থাকতে পেট ভরে নাও ঠেসে। আর রাতে কোনো বিনোদন নেই। কেবল গাছে চড়ে ঘুমিয়ে পড়ো, চেনা তারামণ্ডল বার বার দেখে, চেনা তারা বার বার গুণে, একঘেয়েমির ক্লান্তিতে। এখন ভাবলে তার সন্দেহও হতো যে ক্লান্তি সারাদিন এ গাছে, ও গাছে চড়ে, নেমে, খাবার খুঁজে ছুটে বেড়ানোর জন্য নাকি একঘেয়েমি থেকে।
এরকম সময় টুনটুনিতে গাইতে শুরু করেছিল,
“ররঙ্গা, ররঙ্গা, ররঙ্গা
রাজা তো এবারে একবগ্গা
চানুকে পেলেই ফাঁসির আজ্ঞা
টুনটুনিও ছাড়বে এ জায়গা।” – এ গানেরও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারে নি ররঙ্গা। কিন্তু আবারও এক ভোরে সে আবিষ্কার করে যে সে শুয়ে আছে সাদা সবুজের থোকায় ভরাট একটা শ্বকাষ্ঠকুঞ্জে। এবার আর বিস্ময় নয়, ভয় নয়, সে আক্রান্ত হলো বিরক্তিতে। জমির ঢালে ছুটে গেলে পাওয়া যায় শুকনো নালা। অনেক খুঁজে সে একটা বিশাল হ্রদ আবিষ্কার করল যাতে সাদা চিবুক আর পেট কিন্ত কালো মাথা, গলা আর বাদামী ডানার হাঁসেরা সাঁতার কাটে। যে রাতে ঠান্ডা বাড়ে সে রাতে হাঁসগুলো বিকট ডাকে পাড়া অতিষ্ঠ করে উড়ে যায়। রাতের ঘুম চুরমার হয়ে যায় ররঙ্গার।
ফলে দিনের বেলা তার আর বিরক্তি কমতেই চায় না। নতুন এলাকায় জলের পর চলে খাবারের খোঁজ। ররঙ্গার বিরক্তি আসে এটা ভাবলেও যে এই নতুন এলাকায়, নতুন আবহাওয়ায় মানিয়ে নেওয়া মাত্রই, গুছিয়ে নেওয়া মাত্রই তার ঘুম ভাঙবে নতুন এলাকায়, নতুন আবহাওয়ায়। আবার তাকে খুঁজতে হবে, জল, খাবার, আর বাসা বানানোর উপযুক্ত গাছ। ঠিক কবে এমনটা হবে সে জানেও না। কেন হবে তাও জানে না। জানলে অন্তত সে এরকম হওয়ার কারণটাকে প্রভাবিত করতে পারত নিজের সুবিধা মতো। নিজের অসামর্থ্য আর অপারগতার ওপর রাগতে রাগতে সে ভয়ানক হতাশ হয়ে পড়ল।
ররঙ্গার কেবল মনে হতে লাগল যে যদি সে রুরুকে বিয়ে করে রুরুর দেশে যাওয়ার জন্য রুরুর নৌকায় না উঠত তাহলে এমন করে নিজের জীবনের ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণটুকু সে খোয়াত না। সমস্ত যুক্তি দিয়ে বিচার করলেও সিদ্ধান্ত যে আবেগতাড়িতই হয় সে কথা বুঝতে পেরে তার আরও হতাশ লাগতে লাগল, আরও বিরক্তি আসতে লাগল তার মনে। সকাল সন্ধে সে গাল পাড়তে লাগল নিজের বুদ্ধিকে। এর মধ্যে আবার একদিন শুনতে পেল টুনটুনি গাইছে,
“রাজা ধরেছে চানুকে, সঙ্গে সাতটা ভাই
ভাইগুলো সব চোর নাকি তা বোঝার উপায় নাই” – সাত ভাইয়ের কথা শুনে ররঙ্গা চমকে ওঠে। তাছাড়া তার রজঃস্রাব শুরু হওয়ায় সে বিশেষ হুটোপাটি করে খাবার জোগাড় করতেও পারছিল না, খুব খিদেও তার ছিল না। দিনের ব্যস্ততা উপে যাওয়ায় তার আরও একঘেয়ে লাগছিল। রাতে তবু তারা গোনা যায়, দিনের বেলাটা আরও নির্জন লাগে তার। তাই গানের কথাগুলো তার মনে পাক খেতে লাগল।
“টুনটুনিতে টুনটুনাবে
যবে চানু রাজা হবে
রাজা রাগী আর শক্তিমান
জমিদারকে ধমক লাগান
জমিদারই চানুর শ্বসুর
চানুকে তাঁর ভরসা প্রচুর
‘নাক কাটা রাজা জব্দ কী?’
পারে নি বলতে রানির ঝি।
তাই রাজাকে শাস্তি দিতে
লাগল চানু দল পাকাতে
মিলল সে সাত চোরের সাথে
বুড়ি গেল রাজবাড়িতে
সেখানে সে দাসী হলো
চানুকে রোজ খবর দিল
রানির ঝি যেই টেরটি পেল
রাজা বুড়ির গর্দান নিল”
এই অব্দি শোনার পর ররঙ্গার দিন গোনা ভেস্তে গেল আবার। নিজের শরীরের খবর রাখতে সে গাছের গুঁড়িতে আঁচড় দিচ্ছিল রোজ। কিন্তু এক ভোরে সে জাগল ম্যাগনোলিয়া বনে। সারা বন বেগুনি, গোলাপি, সাদা বিশাল বিশাল একক ফুলে ছয়লাপ। দীর্ঘশ্বাস পড়লেও ররঙ্গা আর বিরক্ত হয় নি। চমক হলেও শুধুই বসন্ত আর সৌন্দর্য ছিল তার প্রত্যেক স্থানান্তরণে। তাই নতুনে মুগ্ধতা সে মেনে নিয়েছিল। নিজের ভালো লাগাকে নিজে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অনুরাগ প্রেমে পরিণতি পাওয়ার আগেই যে বিরহ পেয়ে শোকে, দুঃখে সে ডুবে গিয়েছিল, তার থেকে যেন একটু ভেসে উঠেছিল, যেন চিৎ সাঁতারে অল্প বিরাম খুঁজেছিল।
এর মধ্যে টুনটুনির থেকে আরও বেশি গান শোনার আশায় সে অনেকবার টুনটুনিকে বাদাম বা দানা খেতে দিয়েছে। টুনটুনি সেসব খায় নি। ভাবও করেনি। ঝগড়াও করে নি। খুব নিঃস্পৃহভাবে নিজের খেয়ালে গান গেয়েছে আর লম্বা বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে ফুলের মধু শুষে নিয়েছে। তাই প্রথমবার ম্যাগনোলিয়া বনে ররঙ্গা টুনটুনির অপেক্ষা করছিল। সে যে অপেক্ষা করছে সে কথা নিজে বুঝতে পারার অনেক আগে থেকেই।
আবার একদিন শুনতে পেল,
“বুড়ির মাথা কাটা যেতে চানু গেল খেপে
চাল সাজাল ভীষণ রকম এদিক ওদিক মেপে
রুরুরা গেল বিয়ে করতে ররঙ্গার দেশে
রূপোসীরা ঠকিয়ে দিল ছয় ভাইকে কষে
রুরু ছাড়া আর কোনো ভাই বোঝে নি সে কথা
নৌকা চড়ে ফিরছিল সব মায়ের বাড়ি যেথা
এক রাতে চানু করল চুরি সেই নৌকাখানা
কাঠবেড়ালি হলো বটে মানুষ চোদ্দখানা
নৌকাখানা উড়ছে এখন মস্ত ঘুড়ির পিঠে
সাত চোরে তার ধরছে লাটাই জলে ডাঙায় ছুটে” – খটকা লাগছিল ররঙ্গার। সাতভাইকে নাকি রাজা ধরেছিল! তাহলে তারা ঘুড়ির পিঠে নৌকা কী করে ওড়াচ্ছে? আবার নৌকার চোদ্দজনই যদি কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে তাহলে চানুর সাথে ধরা-পড়া সাতটা ভাই কারা? টুনটুনি মিথ্যে বলছে কী?
তক্কে তক্কে থেকে একদিন টুনটুনির গলাটা থাবা দিয়ে চেপে ধরেছিল ররঙ্গা একটা গাছের গুঁড়িতে। সে চিল চীৎকার করেছিল, “আমাকে যদি আজ মেরে ফেলিস, তোকে বাকিটা কে বলবে?” ররঙ্গা তাতে ঘাবড়ায় নি, সে থাবাও আলগা করে নি, বলেছিল, “বাঁচতে হলে শিগগির বল বাকিটা।” কিন্তু টুনটুনি আর কিছুই বলে নি তখন। একটু কাতরে ছিল, খানিক পরে তার শরীরটা শক্ত হয়ে মাথাটা এলিয়ে পড়েছিল। ররঙ্গা তাতে বেশ হতাশ হয়েছিল। এরপর আর কোনো খবরই পাবে না ভেবে যখন সে দুশ্চিন্তায় ঘেমে উঠছিল য়ার ঝাপসা চোখে বেগুনি রঙের ফুল দেখছিল, তখন থাবাটা যে কী করে আলগা হয়ে গিয়েছিল সে টের পায় নি। তার হুঁশ হয়েছিল,
“ঝড়বাদলে ছিঁড়ল ঘুড়ি নৌকা গেল উড়ে,
তার টুকরো ছড়িয়ে গেল রাজার বাগান জুড়ে” - শুনতে পেয়ে। সে বুঝেছিল যে চতুর পাখিটা মরার অভিনয় করে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর পাখিটা আবার গায়েব হয়েছিল। তারপরে যে অমলতাসের বনে ররঙ্গা ছিল সেখানে সে একদিনও আসেনি।
ঘুম ভেঙে যেদিন ররঙ্গা দেখেছিল যে সে পলাশবনে সেদিন সে ভেবেছিল যে রুরুও যদি কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে তো কাঠবেড়ালির স্বরে, কাঠবেড়ালির ভাষায় তাকে ডাকলে নিশ্চয়ই সে শুনতে পাবে যদি সে আশেপাশে থাকে। উত্তেজনা উদ্দীপণায় ঝটপট করে সে একটা ঝোরা খুঁজে বার করেছিল। তাতে স্নান করে, দাঁত মেজে, চোখমুখ ডলে ডলে ধুয়ে নিজেকে ঝকঝকে করে ফেলেছিল। তারপর পলাশ পাতায় বাদাম সাজিয়ে ডেকেছিল, “রুরু, রুরু” বলে। সেই ডাক পলাশের রক্তিমা, স্বর্ণাভা, শুভ্রতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল বনান্তরে। তারপর সূর্য যখন পাটে বসেছিল, তখন হাঁপাতে হাঁপাতে একটা কাঠবেড়ালি এসে ররঙ্গার নাম ধরে ডেকে ছিল। ররঙ্গার কোনো ভুল হয় নি রুরুকে চিনে নিতে। তারপর তারা উদ্যাপণ করেছিল তাদের বকেয়া বাসর, ফুলশয্যা। আর সকালে জেগে উঠেছিল আবার মানুষের বেশে।
নিজেদের মগ্নতা থেকে অবকাশ পেলে শুনেছিল টুনটুনি গাইছে,
“ছেলে, বউ সব গায়েব হতে মা ছুটেছিল রাজদরবারে
প্রজা নাকাল হচ্ছে শুনে রাজা মেতেছিল সংহারে
মন্ত্রী, সান্ত্রী, যন্ত্রী মিলে ধরেছিল সব চোর ডাকাতকে
সেই সঙ্গে ধরেছিল নিজেদের উটকো যত স্যাঙাতকে
ঠ্যাঙিয়ে স্যাঙাত জেনেছিল তারা চানুর দলের খবর
চালিয়ে হানা চানুর ঠেকে পেয়েছিল প্রমাণ জবর
চানুও কিছু কম নয় বটে, তারও ছিল গুপ্ত সেনা
কিছু ফেরার, কিছু নাচার যারা শুধতে পারেনি দেনা
সবাই মিলে রে রে রে করে তেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল
রাজার বাহিনীও তাদের পিটিয়ে ঠান্ডা করেছিল
নাকের শোকে কাতর রাজাকে ঠুকরে আসতাম আমি নিজে
জাদুবলে পালাতাম ধূলোর ঝড়ে বালি দানার সাজে
তাই তো আমিও ছোট্টো সিপাই ছিলাম চানু চোরের দলে
একলা কী করে লড়ি বলো রাজার সঙ্গে পাঙ্গা নিলে?
তারপর এক রাতে জাদুকর গেল রাজার হাজতে মরে
নাওয়ের টুকরো ঝরল রাজার বাগানে জাদুর ঘুড়ি ছিঁড়ে
সেই টুকরোতে লেগে থাকা সুতো ধরিয়ে দিল সাত চোর
তাদের শপথে পড়ল ভেঙে সেরা চোর চানুর যত জোর
জানি না কী করে আমার প্রাণ বাঁচবে চানুর সাজা হলে
এ আবার কী! কে জড়াল, কী করে এমন রঙিন জালে!” – টুনটুনির গান গেল থেমে। আসলে বিভোর হয়ে টুনটুনি যখন বিলাপ গাইছিল, তখন নিঃসাড়ে জড়ো হয়ে ছিল রুরু আর তার সাত ভাই। রুরুর সাথে ররঙ্গা। সাত ভাইয়ের সাথে ছিল তাদের বউয়েরা। জাদুকর মরে যেতেই সবাই কাঠবেড়ালি থেকে মানুষ হয়ে গিয়েছিল। আর খুঁজে পেয়েছিল বাকিদের। তারপর সাত বউ মিলে খোঁপার জাল জুড়ে জুড়ে একটা জাল বানিয়েছিল। সাত ভাই একে অপরের কাঁধের ওপর চড়ে পৌঁছেছিল সেই পলাশ গাছের মগডালে, আর সন্তর্পণে জাল ছুঁড়ে ঢেকে ফেলেছিল পাশের গাছের মগডালে শোকসঙ্গীত বিভোর টুনটুনিকে।
জালে আটকা পড়ে টুনটুনি সন্ধি প্রস্তাব দিয়েছিল। পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাজদরবারে, যেখানে চানুর বিচারসভা চলছিল। সেখানে সে কবুলও করেছিল, নৌকাসুদ্ধ চোদ্দোজনকে চুরি করে কেমন মায়া কাননে লুকিয়ে রাখা হতো কাঠবেড়ালি করে, নানান দেশের বসন্তের পরিবেশে। টুনটুনি কিন্তু ছাড়া পায় নি শেষে। রুরুরা টুনটুনিকে রাজার লোকের হাতে তুলে দেওয়ার পর টুনটুনির সাথে তাদের সন্ধির কথা নিশ্চয়ই কেউ আমল দেয় নি। তাই বিচার শেষে চানু বা টুনটুনির কী হয়েছিল তাও জানা যায় না।
ঋণঃ ছোটো ভাই, ঝানু চোর চানু, টুনটুনি ও রাজার কথা, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি।
No comments:
Post a Comment