Thursday, October 1, 2015

কিছু ফেলনায় লেখা ইতিহাস

লস এঞ্জেলসের শহরতলি কালভার সিটি। সেখানে ২০১০-১১ সালে ছিল আমাদের বাসা। বাসার থেকে হাঁটা দূরত্বে ছিল ওয়েন্ডে মিউজিয়াম। জার্মান ভাষায় ওয়েন্ডে মানে মোড়। ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের উপজীব্য সোভিয়েত ব্লকের ইতিহাস - ১৯৬১ সালে বার্লিন দেয়াল গাঁথা থেকে ১৯৯০ সালে বার্লিন দেওয়ালের ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত। 
ওঁদের ওয়েবসাইট থেকে জেনেছিলাম যে প্রত্যেক শুক্রবার দুপুর তিনটের সময় গাইডেড ট্যুর পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটেই একটা ই-মেল ঠিকানা ছিল ট্যুরে অংশ নেওয়ার আবেদন জানানোর জন্য। একটাই ই-মেলে আমাদের পছন্দের তারিখে মিউজিয়াম দেখার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছিল; কোনো প্রবেশমূল্য ছিল না। 
পার্থ আর রঙহীন দেওয়াল
ছবি আঁকা উল্টো পিঠ
নির্দিষ্ট দিনে ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলাম যে বাইরের চত্বরে পশ্চিম মুখে দাঁড়িয়ে আছে কংক্রিট দেওয়ালের একটা খন্ড, একপিঠ তার ভীষণ রঙিন, উল্টোপিঠ ধূসর কংক্রিট রঙা। সেটা ফেলে সদর পেরিয়ে পৌঁছলাম দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির মুখে। পাশে একটা ঘরে কয়েকটা মনিটরে ফুটে চলেছে বার্লিন দেওয়ালের পূর্ব জার্মান দিকের পাহারাদারদের জবানবন্দি, জার্মান ভাষায়। আর রয়েছে নানা মাপের স্টিলের আলমারি, যাতে তাকগুলো ঢাকা কাঁচের ঠেলা পাল্লা দিয়ে;  অনেকটা আমাদের অনেকের বাড়িতে বই রাখার বা মেডাল রাখার জন্য যেমনটা ব্যবহার করা হয় তেমন। সেই সব আলমারির কয়েকটা ভর্তি সেকালের বাজেয়াপ্ত পাসপোর্টে। কয়েকটাতে রয়েছে নজরদারির নানা সরঞ্জাম। তাছাড়া চেকপোস্ট চার্লির নানা অবশেষ।
  মিউজিয়ামের দোতলায় উঠে যে হলটায় দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানে অনেকগুলো ডেস্ক আর চেয়ার রাখা ছিল। ছিল একটা কাঠের লেনিন মূর্তিও, যা প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু, - বক্তৃতার বা মিছিলে হাঁটার ভঙ্গিমায়। দেওয়ালে টাঙানো ছিল কয়েকটা বড় বড় ছবি। এই হলের ওপরই ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের ইভেন্ট সঞ্চালক ক্রিস্টিনা কুভাস-উল্‌ফের দপ্তর, দপ্তর মিউজিয়াম ডিরেক্টর ও অন্যান্য আধিকারিকদের।
পাঁচ ফুট উঁচু কাঠের লেনিন মূর্তি, সোভিয়েত ব্লকের ভূমিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মেয়েদের ভূমিকার ছবি, পুর্ব জার্মানির সংসদ ভবন থেকে আনা ডেস্ক
মিউজিয়াম দর্শনের জন্য এই হলেই জড়ো হতে হয়। আমাদের সাথে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস ক্যাম্পাসের ছাত্ররা। গরমের ছুটিতে ছাত্ররা বা গবেষকরা এখানে বেতনভুক ইনটার্ন হিসেবে কাজ করতে পারেন। আমাদের মিউজিয়াম ট্যুরের গাইড ছিলেন ইনটার্ন আলিনা সেরেব্র্যানি। ওয়েন্ডেমিউজিয়ামের ফেসবুক পাতা থেকে জানা যায় আলিনার পূর্ব পুরুষও জড়িয়ে ছিলেন বার্লিন দেওয়ালের ইতিহাসে সঙ্গে।
 মিউজিয়ামের সংগ্রহগুলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে আলিনা জানিয়েছিলেন যে বার্লিন দেওয়াল ভেঙে পড়া মাত্র সাবেক পূর্ব জার্মানি জুড়ে দুদ্দাড় করে ভেঙে পড়ছিল পুরোনো ব্যবস্থায় বানানো আসবাব, ভাস্কর্য কিংবা রাষ্ট্রীয় স্মারক। আস্তাকুড়ে জমা হচ্ছিল নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র। ইতিহাসের সেই মোড়ে, প্রায় লোপ পেতে চলেছিল পূর্ব ইউরোপের অবরুদ্ধ তিনদশকের ইতিহাস। আধুনিক ইতিহাসের স্বার্থে ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার জাস্টিনিয়ান জামপল চেষ্টা করে চলেছেন সেই অধ্যায়কে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের চেষ্টায়, তাঁর নিজের শহর লস এঞ্জেলসে। যেহেতু বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ার সময় পূর্ব জার্মানির মানুষের আবেগ পুরোনো সব কিছুকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল সেহেতু ঐ মিউজিয়াম পূর্ব জার্মানির কোথাও বানাতে ভরসা পাননি জামপল। যে সমস্ত দিনলিপি, নথি, অবশেষ ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে আছে তা দেখেই বোঝা যায় একথা। ধ্বংসাবশেস কুড়োতে কুড়োতে একদশকে ইতিহাসবিদ জামপলের সংগ্রহ যা দাঁড়িয়েছিল তা সংরক্ষণের জন্য গ্যারাজ কিংবা বৈঠকখানা নেহাতই অপ্রতুল ছিল। তাছাড়াও ইতিহাসের সেই মূহুর্তকে তো তিনি আশ্রয় দিয়ে চলেছেন ভাবীকালের জন্যও। তাই সমস্ত সংগ্রহ যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছাত্র, গবেষক, উৎসাহী মনোযোগী সাধরণ পর্যবেক্ষকের নাগালে পৌঁছোয় তাই বানিয়েছেন ওয়েন্ডে মিউজিয়াম।  
পিঙ্ক লেনিন
হল পেরিয়ে যে করিডরে গেলাম সেখানে লেনিনের একটা আবক্ষ মূর্তি রাখা ছিল। কিন্তু সেটার মাথা থেকে নব্বই শতাংশ গোলাপি রঙে ঢাকা। সেটার ডাকনাম পিঙ্ক লেনিন। পাঁচিল ভেঙে পড়ার পর জনতার আক্রোশে মূর্তিটার রং বদলে গেছে!
করিডর পেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় এসে দেখতে পেলাম একতলার সংগ্রহশালা, মোটেও মিউজিয়ামের মতো নয়, ওয়্যার হাউসের মতো। স্টিলের নাটবল্টু আঁটা তাকে আড়াআড়ি আর লম্বালম্বি দড়ির পেছনে সারি সারি কার্ল মাক্স, স্টালিন, লেনিন, ক্রুশ্চেভের ভাঙা কিংবা গোটা, আবক্ষ মূর্তি। আসলে সেগুলো যাতে তাক থেকে পড়ে না যায় তাই আড়াল দেওয়া হয়েছে অমন করে। এই তাকগুলো উচ্চতায় ঘরের ছাদ অবধি আর চওড়ায় দেওয়াল অবধি বাড়ানো যায় এমন। 
দড়ির পেছনে সারি সারি কার্ল মাক্স, স্টালিন, লেনিন, ক্রুশ্চেভের ভাঙা কিংবা গোটা, আবক্ষ মূর্তি

চেক পয়েন্ট চার্লির নামলেখা সাইন বোর্ড
মিউজিয়ামের প্রথম একজিবিট ছিল মিত্র শক্তির চেক পয়েন্ট চার্লির নামলেখা সাইন বোর্ড। তারপর ছিল কিছু অবাক করা চেয়ার। সাদা রঙের প্লাস্টিকে বানানো ডিমাকৃতি গার্ডেন চেয়ারটার গদি নীল ভেলভেট দিয়ে মোড়াতে সেটা অপরূপ দেখাচ্ছিল। বেশ কিছু গদি আঁটা চেয়ারের মাথাটা খুলে দিলেই সেটা একটা সিঁড়ি হয়ে যায়। মনে করা হয় যে বার্লিন প্রাকারের ভিতরে লোহার যোগানের অভাব হয়তো প্লাস্টিকের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর নতুন নতুন উদ্ভাবনীর পথে চালিত করেছিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উৎপাদকদের। তাই অপূর্ব ডিম চেয়ার তৈরি হয়েছিল। তাই হয়তো চাকা লাগানো অটোমান, মানে গদি আঁটা যে চেয়ারের হেলান দেওয়ার পিঠ থাকে না, তার কাঠের খোল দিব্যি ব্যবহার করা যেত জিনিসপত্র রাখার জায়গা হিসেবে।  আসবাবের ধরণ থেকে মনে হয় যে অকুলান বাসস্থাণে সংকুলানের জন্য আসবাব হতো ভাঁজ করে ছোটো করে ফেলে যায় এমন কিংবা একই আসবাবকে অনেক রকম কাজে ব্যবহার করা যাবে এমন। তাই, আলিনার মতে, শুধু চেয়ারের জন্য নয় যে কোনো শিল্পজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রেই অবশ্যম্ভাবী ছিল এই উদ্ভাবনী। এই প্রসঙ্গে পার্থ মনে পড়ে করিয়ে দেয় ডিডিআর বা জিডিআরে বানানো সাইলেন্ট স্টার ছায়াছবির কথা। সেই ছবির বিষয় সারা পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের সম্মিলিত শুক্রগ্রহ অভিযান। সেই বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একজন চিনা বৈজ্ঞানিক অজৈব পদার্থ থেকে খাবার সংশ্লেষের পদ্ধতি জানতেন! সে আরও জানিয়েছিল পূর্ব জার্মান উদ্ভাবনীর আরেক বিস্ময় দুই দরজার ত্রাবান্ত গাড়ির কথা।  
ডিম চেয়ার, সিঁড়ি চেয়ার, অটোমান
প্লাস্টার অব প্যারিসের ভাস্কর্য
ধাতব ভাস্কর্য
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে ইস্টার্ন ব্লকের নানান দেশ থেকে আনা ভাস্কর্যের সংগ্রহটা যদিও আদর্শবাদ জড়ানো তবুও রকমারি। মুষ্টিবদ্ধ মুদ্রায় লাল সেলামরত শ্রমিক কিংবা কমিউনিজমের প্রবক্তা মার্ক্স, এঙ্গেলস ও বিভিন্ন সোভিয়েত ও ইস্টার্ন ব্লকের নেতাদের মূর্তির মাধ্যম ছিল প্লাস্টার অফ প্যারিস। বাচ্চাদের জন্য তৈরি কাঠের খেলনাতেও ছিলেন আধুনিক নেতারা অতিমানবিক মহিমায়। একটা বেশ রঙচঙে কাঠের মূর্তি দেখিয়ে আলিনা বলেছিলেন যে সেই মূর্তিটা সম্ভবতঃ লেনিনের এবং নেদারল্যান্ডসে খোদাই করা। ছাঁচে ঢালা সীসার মূর্তিও পাওয়া গেছে কমিউনিস্ট নেতাদের। তবে  সবথেকে নজরকাড়া মূর্তিটি এক অখ্যাত মহিলাশ্রমিকের। কাঠে বানানো প্রায় দেড় ফুট লম্বা সেই মূর্তির পেশীবহুল হাত, চওড়া কাঁধ ও কপাল, পিছনে টেনে বাধা চুলে এক বলশালীনিকে দেখা যায়। 
আন্দোলনে সামিল কোনো জনের মূর্তি
আলিনার হাতে ফুডিসের রেকর্ড
চমকপ্রদ ছিল গানের দল ফুডিসের রেকর্ডের খাপের ছবি। ফুডিস ছিল পূর্ব জার্মানির প্রথম রকব্যান্ড  যেটা জনসমক্ষে গানের অনুষ্ঠান করার সরকারি অনুমতি পেয়েছিল। শুধু তাই নয় সরকারি রেকর্ডিং সংস্থা আমিগা থেকে বেরোত তাদের লং প্লেয়িং রেকর্ড। সেসব রেকর্ডের খাপের নকশা হতো দারুন রঙিন। 
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে পূর্ব জার্মানির বইপত্রের বেশ বড়ো সংগ্রহ আছে। বইপত্র অবশ্য মূলতঃ কমিউনিস্ট দর্শনের উপরেই লেখা হতো। বইপত্রের মাধ্যম ছিল প্রধানত জার্মান ভাষা।
বই ছাড়াও এই মিউজিয়ামের সংগ্রহে আছে পূর্ব জার্মানির বেশ কিছু রেডিও সেট। রেডিও বেশ শক্তিশালী মাধ্যম ছিল মতাদর্শ প্রচারের। কিন্তু এই যন্ত্রই নাকি তাঁদের অশান্তির কারণও ছিল। কারণ এই যন্ত্রটা সোভিয়েত ব্লকের জনসাধারণেরও বেশ পছন্দ ছিল, সাধারণ ক্রেতার নাগালেও ছিল। ফলে ক্রমাগত রেডিও তরঙ্গ বেয়ে ইস্টার্ন ব্লকের জনসাধারণের বৈঠকখানায় ঢুকে পড়ছিল বার্লিন দেওয়ালের পশ্চিম দিক থেকে প্রচারিত যাবতীয় রাজনৈতিক আলোচনা, জনমত, পুব দিকের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতির সমালোচনা - সবই । যার মধ্যে ইস্টার্ন ব্লকের রাষ্ট্র নেতৃত্বের সব থেকে অপছন্দ ছিল রক সঙ্গীত। আর যুবজনতার প্রথম পছন্দের রেডিও স্টেশন ছিল রক সঙ্গীতের স্টেশন।
ইরিশ হোনেকারের শ্যালমাই
পুর্ব জার্মানির গান বাজনা প্রসঙ্গে আরেকটা খুব জরুরি কথা জানানো দরকার। শ্যালমাই নামে একটা বাজনা ইস্ট জার্মানির ইস্কুল, কারখানা আর নগরে গঞ্জে খুব জনপ্রিয় ছিল। এই বাজনা বেশ সহজে বাজাতে শেখা যায়। পুব জার্মানির বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা ভেব ট্যাকটনের পক্ষ থেকে বার্লিন দেওয়ালের হোতা ইরিশ হোনেকারকে তাঁর পঁচাত্তরতম জন্মদিনে যে শ্যালমাইটা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল সেটা এখন ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের সংগ্রহে আছে। পুর্ব জার্মানির সোশ্যালিস্ট পার্টির শীর্ষনেতা তথা রাষ্ট্রনেতা ইরিশ হোনেকার তাঁর সেই শ্যালমাইটা দিয়েছিলেন পশ্চিম জার্মানির রকস্টার উডো লিন্ডেনবার্গকে, আশির দশকের শেষে পশ্চিম জার্মানিতে; বদলে নিয়েছিলেন লিন্ডেনবার্গের চামড়ার জ্যাকেট। 
ওয়েন্ডে মিউজিয়াম সাবেক পূর্ব জার্মানি আর ইস্টার্ন ব্লকের জীবনের নানা কোণ থেকে সংগ্রহ করেছে যাপণের অবশেষ। তারমধ্যে রয়েছে পোষাক, পর্দা, কার্পেটও। পুর্ব জার্মানির অসংখ্য কার্পেটের নকশায় দেখা যায় নিসর্গ, ফুলতোলা পাতাবাহার আর অবশ্যই বালক নেতার ছবি। সব থেকে বেশি পাওয়া যায় লেনিনের ছ বছর বয়সের একটা ছবি। আমাদের পটচিত্র বা কাঁথায় বালক নিমাই বা বালক গদাধরের মতো। বালক লেনিনের সেই ছবিটা শুধু কার্পেটে নয়, কুশনের ঢাকায়, পর্দাতেও বোনা হোতো। ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের এসব বস্ত্র সংগ্রহের একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে পুলিশ, নাবিক আর সেনার উর্দি। নাবিকের উর্দি ও স্কার্ফের রং হতো ঘননীল। এরকম এক নাবিকের উর্দিতে স্কার্ফের ভিতরের অংশে আঁকা ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরপ্রান্ত ছোঁওয়া কামচটকা উপদ্বীপের মানচিত্র। 
কার্পেটের নকশায় লেনিনের ছ বছর বয়সের ছবি
অ্যটাচিকেস
এইসব সংগ্রহের মধ্যে সব থেকে চমকপ্রদ ছিল অ্যটাচিকেস। অনেকগুলো অ্যাটাচি খুলে খুলে আলিনা দেখিয়েছিলেন। এই অ্যটাচিকেসগুলো সবই পুর্ব জার্মানি থেকে সংগৃহীত। এগুলো স্টাসির মানে পুর্ব জার্মানির নিরাপত্তামন্ত্রকের সম্পত্তি ছিল। এর ভিতরে সাধারণত একটা ডিকোডার থাকত। এই অ্যাটাচিকেসগুলো মূলত খবর দেওয়া-নেওয়ার কাজে লাগত।
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের সংগ্রহে থাকা পূর্ব জার্মানির সিনেমার মধ্য জাপানি ও রাশিয়ান ভাষার বেশ কিছু ছবি আছে। জাপানি ছবির পোস্টারে তার নামের ইংরেজি তর্জমা ছিল। সেটা পড়ে মনে হলো জাপানি ছবিটা সামাজিক ছবি। তবে রাশিয়ান ছবির পোস্টারে মহাকাশ যান আঁকা ছিল।  
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে হাতে আঁকা ছবির সংগ্রহও বিশাল। একটা ছবিতে দেখা যায় মেয়েরা যন্ত্রপাতি, ঝুড়ি কোদাল নিয়ে চাষের কাজে চলেছে। দূরে আকাশে দলা দলা মেঘ। সেই মেঘে নাকি পাঁচটা মহাদেশের রেখার আদল। ছবিটাতে দেখানো হয়েছে যে সোভিয়েত ব্লকের ভূমিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মেয়েরাই ধরে রাখে এবং দূরের মেঘের দিকে মেয়েদের তুলে রাখা আঙুলে সেই ভূমিভিত্তিক সমাজতন্ত্রকে ইস্টার্ন ব্লকের বাইরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার। অন্য কয়েকটা ছবিতে দেখা যায় পশ্চিমী দুনিয়ার কোর্টরুমে চলতে থাকা ডিভোর্সের মামলার শুনানির দৃশ্য; পশ্চিমী হোটেলে ফূর্তির আয়োজনে খোলামেলা পোষাকে নারীদের উপস্থিতি। একটা ছবি রাজনৈতিক সম্মেলনের। এই ছবিতে বক্তা ক্রুশ্চেভ; সমস্ত শ্রোতার ছবি অটুট রেখে নরুন জাতীয় কিছু দিয়ে খুবলে তোলার চেষ্টা হয়েছে ক্রুশ্চেভের প্রতিকৃতি। 
পশ্চিমী দুনিয়ার ছবি
প্যালেস্টাইনের উপহার
অন্যান্য উপহার
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের যাবতীয় সংগ্রহের একটা বড়ো অংশ হলো পুর্ব জার্মানির পাওয়া কুটনৈতিক উপহার। তার মধ্যে প্যালেস্টাইন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, কঙ্গো এবং অবশ্যই রাশিয়া থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপহার আছে। প্যালেস্টাইনের উপহার মুলতঃ পোর্সেলিন প্লেটে একরঙা সনাতন নকশা, ইয়েমেনের উপহার দাবার ঘুটি, কঙ্গোর উপহার আফ্রিকান রমণীর আবক্ষ মুর্তি, রাশিয়ার উপহার লেনিন মূর্তি। দুঃখজনকভাবে এই মূর্তিটাতেও কালো রং লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল। কম্বোডিয়া থেকেও কাঠে খোদাই করা দাবার ঘুটির উপহার ছিল। 
কুটনৈতিক উপহার
পাসপোর্টের সংগ্রহ
আলিনার থেকে জানা গেল যত সিনেমা পাওয়া গেছে পুর্ব জার্মানি থেকে সেগুলোর ইংরেজি তর্জমা ও সাবটাইটেল বানানোর কাজ চলছে। সব দেখাশোনা শেষে দোতলার হলঘরে আবার ফিরে এলাম সবাই। তখন আলিনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে ওঁদের ওখানে কনফারেন্স, মিটিং ইত্যাদি ওই হলঘরে সেইসব কাঠের ডেস্কে বসেই হয় কিনা। আলিনা বলেছিলেন নিশ্চয়ই হয়। তবে কাঠের ডেস্কগুলোও পুর্ব জার্মানির সংসদ ভবন থেকে আনা। বলাবাহুল্য ডেস্কগুলো এমন করে বানানো যে সেগুলো লেখাপড়ার কাজেও ব্যবহার করা যায় আবার একটু এধার ওধার করে সিনেমা দেখার কাজেও ব্যবহার করা যায়। পুর্ব জার্মানির এক-দ্রব্য-বহু-ব্যবহারের উদ্ভাবনীকে কুর্নিশ করে বেরিয়ে এলাম। আসার আগে আলিনা বলেছিলেন, নিচের তলার পাসপোর্টের সংগ্রহ দেখে যেতে, আর দেখে যেতে এক খন্ড বার্লিন দেওয়াল। বার্লিন দেওয়াল খন্ডের পিছনে তখন চরাচরব্যাপি প্রশান্ত মহাসাগর আর অস্তোন্মুখ সূর্য।
লস এঞ্জেলস ডাউনটাউনে লস এঞ্জেলস কাউন্টি মিউজিয়াম অফ আর্ট, লা ব্রি পিট আর কয়েকটা অন্যান্য মিউজিয়াম নিয়ে মাইলটাক রাস্তাটার নাম মিরাক্যল মাইলস। সেই রাস্তার পাশে সারি দিয়ে দাঁড় করানো আছে বার্লিন দেওয়ালের অনেকগুলো খন্ড। তার একদিক ছবিতে ছবিতে রঙিন আর অন্যদিক ধূসর। আলিনার কাছে জেনেছিলাম অবশ্য খুব শিগগির শুরু হতে চলেছে ধূসর দেওয়াল রাঙিয়ে তোলার কাজ।
মিরাক্যল মাইলস-এ বার্লিন ওয়ালের খণ্ডাংশ
        ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে ইস্টার্ণ ব্লকের ইতিহাস চর্চার অংশ হলো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। বার্লিন দেওয়ালের চেক পয়েন্টের পুলিশ থেকে শুরু করে, ইস্টার্ন ব্লকের অধ্যাপক, রাজনীতিক সবাই এই মিউজিয়ামের তথ্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। কখনও এই তথ্য আদানপ্রদানে নিমন্ত্রণ জানানো হয় আপামর উৎসুকদের। যেদিন আজেরবাইজানের রাষ্ট্রদূত এলিন সুলেইমানভ এসেছিলেন, আবার সেদিন আমরা ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে  গিয়েছিলাম তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনতে। যথারীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র ও অধ্যাপকরাও ছিলেন সেখানে। ছিলেন মিউজিয়ামের সাথে যুক্ত নানা মানুষ। আর কৌতুহলীরা।
        একটা ইউটিউব ছবির মাধ্যমে আজেরবাইজানের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তাঁর দেশ কেমন ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সোভিয়েত সেনার হাতে বাকুতে ২০শে জানুয়ারির গণহত্যার কথা যাতে মারা পড়েছিলেন অসামরিক সাধরণ জনতা। যা কিছু তিনি দেখিয়েছিলেন তার মধ্যে সব চেয়ে মজার ছিল পারহ্যাপ্স ব্যাগ। পুরুষ মানুষেরা দিনের বেলা কাজে বেরোনোর সময় সেই ব্যগ সঙ্গে নিয়ে যেতেন, ফেরার পথে দুটো কলা বা একটা আপেল পাওয়া গেলে নিয়ে ঘরে ফিরবেন বলে। কালচে লাল হালকা লাল  উলে বোনা ব্যাগগুলো এমনিতে ধরে যেত মুঠোর মধ্যে বা পকেটে। কিন্তু কলা-আপেলের মাপে বেড়েও যেতো সাইজে। এরকম ব্যাগ কলকাতাতেও দেখেছি বহুবার। 


***** জমা দেওয়ার দু'বছর পর যা ছাপা হয়েছে

##### মূল অ্যালবাম
###### পরের অ্যালবাম

এই গোত্রের অন্য লেখাঃ
বুনো পশ্চিমী মরুপথে এক রাত

স্যান অ্যান্টোনিও – তখন আর এখনের এক অনাস্বাদিতপূর্ব ককটেল

Readers Loved