Tuesday, May 10, 2016

ররঙ্গার অপেক্ষা

একটা বন ছিল অমলতাসের। সেখানেই ঘুমিয়ে ছিল ররঙ্গা। তার গায়ে ছিল অমলতাসের ঝরে পড়া পাপড়ির চাদর। তার বিছানাও ছিল অমলতাসের ঝরে পড়া পাপড়িতে ঢাকা। দিনের বেলা সূর্যের আলো সেখানে আগুন জ্বালাত না, সোনা ঝরাত। সেই সোনার একটা ফোঁটা যখন ররঙ্গার গায়ে এসে পড়ত তখন তার গায়ের অখন্ড সোনার চাদরখানা অসংখ্য টুকরোতে ছড়িয়ে দিয়ে সে জেগে উঠত। 
তারপর অভ্যেস মতো দাগ কাটতে যেত যে গাছে তার বাস তার গুঁড়িতে। তারপর হাত গুটিয়ে নিত। তার স্পষ্ট মনে পড়ে যেত প্রথম যেদিন সে রুরুর নৌকার বাইরে বেড়িয়েছিল সেদিন ছিল পূর্ণিমা। তার চারপাশে ছিল ইলাওয়ারা শিখার রক্তিমা, দিনে রাতে। সে অমলতাসের স্বর্ণালির মতো এমন নরম নয়। তাতে মনে প্রচুর উত্তেজনা, অশান্তি, কৌতুহল তৈরি হয়। 
আবার এও মনে হতো যে সেই সময়টাই তো অমন ছিল। ইলাওয়ারার রক্তিমার আর দোষ কী! তখন সবে সে রুরুকে বিয়ে করেছে। রুরু তাকে লুকিয়ে রেখেছে নৌকার খোলে, মায়ের কাছে ফিরে ভাইদের আর ভাইবউদের চমকে দেবে বলে। তখন ররঙ্গার মনের মধ্যে ছিল ফুলশয্যার আবহ। যখন সে ঠাহর করল যে সে ইলাওয়ারা বনের মধ্যে তখনও ভাবছিল এই বুঝি রুরু আসবে, ইলাওয়ারার রক্তিমাটাই বুঝি রুরুর দারুণ আবেগরাঙা ফুলশয্যার উপহার।
না নাওয়া, না খাওয়া, কেটে গিয়েছিল দুটো রাত আরও। তৃতীয় দিনে তেষ্টায় চোখে অন্ধকার দেখে ররঙ্গা চলতে শুরু করেছিল জমির ঢাল বেয়ে। শেষে পৌছেছিল সমুদ্দুরে। অত জল, কিন্তু তেষ্টা মেটেনি। তখন আবার চোখ মেলে খুঁজে ছিল মোহানা। মোহানা খুঁজতে তাকে চড়তে হয়েছিল এক বালিয়াড়ির মাথায়। সব কিছু সে যেন কেমন অদ্ভুত নিচু থেকে দেখছিল। তার সন্দেহ হচ্ছিল বিয়ে হলে মেয়েরা সত্যিই খাটো হয়ে যায় নাকি!
যা হোক মোহানা থেকে কিছু উপরে গিয়ে সে নদীর পাশে জমা জলের পুকুর পেয়েছিল। সে পুকুরে মুখ চুবিয়ে জল খেয়ে যেই মুখ তুলেছিল, তখনই সে নিজের ছায়াটা খেয়াল করেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে নি। জলটা বার বার ঘুলিয়ে দিয়ে, এ পুকুর সে পুকুর ছুটে যখন সে দেখেছিল যে তার ছায়া কিছুতেই বদলাল না, তখন সে কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল যে সে আর মানুষ নেই, কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে।
তারপর থেকে তিনটে পূর্ণিমা সে গুণতে পেরেছিল। কারণ তিনটে পূর্ণিমা পরে এসে উপস্থিত হয়েছিল একটা টুনটুনি। সে কেবল গান গাইত,
“ও ওরে ও ররঙ্গা,
চারিদিকে মারদাঙ্গা।
চানু নিল কী পাঙ্গা!
রাজা হবে না চাঙ্গা।” - ররঙ্গা কিছুই বোঝে নি। আর পরের পূর্ণিমা আসার আগেই এক ভোরে তার ঘুম ভেঙেছিল সাদা সবুজে প্রাণবন্ত এক গজদন্ত কুণ্ডলি বনে। আর ঘুম ভেঙেছিল সূর্যের আলোর ছোঁয়ায় নয়, টুনটুনির গানে। সেই এক ঘেয়ে একটানা গান, “ও ওরে ও ররঙ্গা, ......” 
টুনটুনিকে এড়িয়েই যেত ররঙ্গা। তাছাড়া তার মাথায় হরেক দুঃশ্চিন্তা ছিল। মূলতঃ সে কী করে তার মানুষী রূপ ফিরে পাবে, কী করেই বা রুরু তাকে চিনবে, তার সাথে রুরুর দেখা হবে কবে। ভেবে ভেবে তার ক্রমাগত ওজন কমে যাচ্ছিল। তারপর তার দিন গোনার ধরতাই খোয়া গিয়েছিল। সে উদ্‌গ্রীব ভাবে অপেক্ষা করছিল পরের পূর্ণিমার। তারপর তার মাথায় এসেছিল যে সে তো সময়ের হিসেব রাখতে পারে তার শারীরবৃত্ত দিয়েও। পূর্ণিমার ব্যবধান সাতাশ দিনের, আর আটাশ দিনান্তর তার নারীত্বের ক্ষরণ। সেই সূত্রেই সে টের পেয়েছিল যে যতগুলো পূর্ণিমাই কাটুক, তার শরীর তাল মেলায় নি।
তার শিরদাঁড়া জুড়ে হিমপ্রবাহ বহে যেত কথাটা মনে পড়লেই। সে মাত্র একবেলার বিবাহিত, না হয়েছিল তার বাসর, না ফুলশয্যা। তার কুমারীত্বও অক্ষত ছিল। তবু তার রজোচক্রে যতি পড়ার কী কারণ সে ঠাহর করতে পারছিল না। তার মনুষ্যত্বের মতো তার নারীত্বও গেছে কিনা তাই নিয়ে সে বিব্রত হচ্ছিল থেকে থেকেই। আবার বিরক্তও হচ্ছিল যে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সে দিনরাত মনোসংযোগও করতে পারছিল না সারাদিন থেকে থেকে তার খিদে পেতে থাকার কারণে।
রান্নার উপায় নেই, উনুন নেই, রান্নাঘর নেই, বাড়িই নেই। কাঠবেড়ালি হয়ে গাছের ওপর থাকা, খাবার খোঁজো, খুঁজে পেলে উদরস্থ করো, পেট ভরুক না ভরুক আবার দৌড়োও। যত পারো দিনের আলো থাকতে থাকতে পেট ভরে নাও ঠেসে। আর রাতে কোনো বিনোদন নেই। কেবল গাছে চড়ে ঘুমিয়ে পড়ো, চেনা তারামণ্ডল বার বার দেখে, চেনা তারা বার বার গুণে, একঘেয়েমির ক্লান্তিতে। এখন ভাবলে তার সন্দেহও হতো যে ক্লান্তি সারাদিন এ গাছে, ও গাছে চড়ে, নেমে, খাবার খুঁজে ছুটে বেড়ানোর জন্য নাকি একঘেয়েমি থেকে।
এরকম সময় টুনটুনিতে গাইতে শুরু করেছিল, 
“ররঙ্গা, ররঙ্গা, ররঙ্গা
রাজা তো এবারে একবগ্‌গা
চানুকে পেলেই ফাঁসির আজ্ঞা
টুনটুনিও ছাড়বে এ জায়গা।” – এ গানেরও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারে নি ররঙ্গা। কিন্তু আবারও এক ভোরে সে আবিষ্কার করে যে সে শুয়ে আছে সাদা সবুজের থোকায় ভরাট একটা শ্বকাষ্ঠকুঞ্জে। এবার আর বিস্ময় নয়, ভয় নয়, সে আক্রান্ত হলো বিরক্তিতে। জমির ঢালে ছুটে গেলে পাওয়া যায় শুকনো নালা। অনেক খুঁজে সে একটা বিশাল হ্রদ আবিষ্কার করল যাতে সাদা চিবুক আর পেট কিন্ত কালো মাথা, গলা আর বাদামী ডানার হাঁসেরা সাঁতার কাটে। যে রাতে ঠান্ডা বাড়ে সে রাতে হাঁসগুলো বিকট ডাকে পাড়া অতিষ্ঠ করে উড়ে যায়। রাতের ঘুম চুরমার হয়ে যায় ররঙ্গার। 
ফলে দিনের বেলা তার আর বিরক্তি কমতেই চায় না। নতুন এলাকায় জলের পর চলে খাবারের খোঁজ। ররঙ্গার বিরক্তি আসে এটা ভাবলেও যে এই নতুন এলাকায়, নতুন আবহাওয়ায় মানিয়ে নেওয়া মাত্রই, গুছিয়ে নেওয়া মাত্রই তার ঘুম ভাঙবে নতুন এলাকায়, নতুন আবহাওয়ায়। আবার তাকে খুঁজতে হবে, জল, খাবার, আর বাসা বানানোর উপযুক্ত গাছ। ঠিক কবে এমনটা হবে সে জানেও না। কেন হবে তাও জানে না। জানলে অন্তত সে এরকম হওয়ার কারণটাকে প্রভাবিত করতে পারত নিজের সুবিধা মতো। নিজের অসামর্থ্য আর অপারগতার ওপর রাগতে রাগতে সে ভয়ানক হতাশ হয়ে পড়ল। 
ররঙ্গার কেবল মনে হতে লাগল যে যদি সে রুরুকে বিয়ে করে রুরুর দেশে যাওয়ার জন্য রুরুর নৌকায় না উঠত তাহলে এমন করে নিজের জীবনের ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণটুকু সে খোয়াত না। সমস্ত যুক্তি দিয়ে বিচার করলেও সিদ্ধান্ত যে আবেগতাড়িতই হয় সে কথা বুঝতে পেরে তার আরও হতাশ লাগতে লাগল, আরও বিরক্তি আসতে লাগল তার মনে। সকাল সন্ধে সে গাল পাড়তে লাগল নিজের বুদ্ধিকে। এর মধ্যে আবার একদিন শুনতে পেল টুনটুনি গাইছে,
“রাজা ধরেছে চানুকে, সঙ্গে সাতটা ভাই
ভাইগুলো সব চোর নাকি তা বোঝার উপায় নাই” – সাত ভাইয়ের কথা শুনে ররঙ্গা চমকে ওঠে। তাছাড়া তার রজঃস্রাব শুরু হওয়ায় সে বিশেষ হুটোপাটি করে খাবার জোগাড় করতেও পারছিল না, খুব খিদেও তার ছিল না। দিনের ব্যস্ততা উপে যাওয়ায় তার আরও একঘেয়ে লাগছিল। রাতে তবু তারা গোনা যায়, দিনের বেলাটা আরও নির্জন লাগে তার। তাই গানের কথাগুলো তার মনে পাক খেতে লাগল। 
“টুনটুনিতে টুনটুনাবে
যবে চানু রাজা হবে
রাজা রাগী আর শক্তিমান 
জমিদারকে ধমক লাগান
জমিদারই চানুর শ্বসুর
চানুকে তাঁর ভরসা প্রচুর
‘নাক কাটা রাজা জব্দ কী?’
পারে নি বলতে রানির ঝি।
তাই রাজাকে শাস্তি দিতে
লাগল চানু দল পাকাতে
মিলল সে সাত চোরের সাথে
বুড়ি গেল রাজবাড়িতে
সেখানে সে দাসী হলো
চানুকে রোজ খবর দিল
রানির ঝি যেই টেরটি পেল
রাজা বুড়ির গর্দান নিল”
এই অব্দি শোনার পর ররঙ্গার দিন গোনা ভেস্তে গেল আবার। নিজের শরীরের খবর রাখতে সে গাছের গুঁড়িতে আঁচড় দিচ্ছিল রোজ। কিন্তু এক ভোরে সে জাগল ম্যাগনোলিয়া বনে। সারা বন বেগুনি, গোলাপি, সাদা বিশাল বিশাল একক ফুলে ছয়লাপ। দীর্ঘশ্বাস পড়লেও ররঙ্গা আর বিরক্ত হয় নি। চমক হলেও শুধুই বসন্ত আর সৌন্দর্য ছিল তার প্রত্যেক স্থানান্তরণে। তাই নতুনে মুগ্ধতা সে মেনে নিয়েছিল। নিজের ভালো লাগাকে নিজে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অনুরাগ প্রেমে পরিণতি পাওয়ার আগেই যে বিরহ পেয়ে শোকে, দুঃখে সে ডুবে গিয়েছিল, তার থেকে যেন একটু ভেসে উঠেছিল, যেন চিৎ সাঁতারে অল্প বিরাম খুঁজেছিল।
এর মধ্যে টুনটুনির থেকে আরও বেশি গান শোনার আশায় সে অনেকবার টুনটুনিকে বাদাম বা দানা খেতে দিয়েছে। টুনটুনি সেসব খায় নি। ভাবও করেনি। ঝগড়াও করে নি। খুব নিঃস্পৃহভাবে নিজের খেয়ালে গান গেয়েছে আর লম্বা বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে ফুলের মধু শুষে নিয়েছে। তাই প্রথমবার ম্যাগনোলিয়া বনে ররঙ্গা টুনটুনির অপেক্ষা করছিল। সে যে অপেক্ষা করছে সে কথা নিজে বুঝতে পারার অনেক আগে থেকেই।
আবার একদিন শুনতে পেল,
“বুড়ির মাথা কাটা যেতে চানু গেল খেপে
চাল সাজাল ভীষণ রকম এদিক ওদিক মেপে
রুরুরা গেল বিয়ে করতে ররঙ্গার দেশে
রূপোসীরা ঠকিয়ে দিল ছয় ভাইকে কষে
রুরু ছাড়া আর কোনো ভাই বোঝে নি সে কথা
নৌকা চড়ে ফিরছিল সব মায়ের বাড়ি যেথা
এক রাতে চানু করল চুরি সেই নৌকাখানা
কাঠবেড়ালি হলো বটে মানুষ চোদ্দখানা
নৌকাখানা উড়ছে এখন মস্ত ঘুড়ির পিঠে
সাত চোরে তার ধরছে লাটাই জলে ডাঙায় ছুটে” – খটকা লাগছিল ররঙ্গার। সাতভাইকে নাকি রাজা ধরেছিল! তাহলে তারা ঘুড়ির পিঠে নৌকা কী করে ওড়াচ্ছে? আবার নৌকার চোদ্দজনই যদি কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে তাহলে চানুর সাথে ধরা-পড়া সাতটা ভাই কারা? টুনটুনি মিথ্যে বলছে কী?
তক্কে তক্কে থেকে একদিন টুনটুনির গলাটা থাবা দিয়ে চেপে ধরেছিল ররঙ্গা একটা গাছের গুঁড়িতে। সে চিল চীৎকার করেছিল, “আমাকে যদি আজ মেরে ফেলিস, তোকে বাকিটা কে বলবে?” ররঙ্গা তাতে ঘাবড়ায় নি, সে থাবাও আলগা করে নি, বলেছিল, “বাঁচতে হলে শিগগির বল বাকিটা।” কিন্তু টুনটুনি আর কিছুই বলে নি তখন। একটু কাতরে ছিল, খানিক পরে তার শরীরটা শক্ত হয়ে মাথাটা এলিয়ে পড়েছিল। ররঙ্গা তাতে বেশ হতাশ হয়েছিল। এরপর আর কোনো খবরই পাবে না ভেবে যখন সে দুশ্চিন্তায় ঘেমে উঠছিল য়ার ঝাপসা চোখে বেগুনি রঙের ফুল দেখছিল, তখন থাবাটা যে কী করে আলগা হয়ে গিয়েছিল সে টের পায় নি। তার হুঁশ হয়েছিল,
“ঝড়বাদলে ছিঁড়ল ঘুড়ি নৌকা গেল উড়ে,
তার টুকরো ছড়িয়ে গেল রাজার বাগান জুড়ে” - শুনতে পেয়ে। সে বুঝেছিল যে চতুর পাখিটা মরার অভিনয় করে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর পাখিটা আবার গায়েব হয়েছিল। তারপরে যে অমলতাসের বনে ররঙ্গা ছিল সেখানে সে একদিনও আসেনি। 
ঘুম ভেঙে যেদিন ররঙ্গা দেখেছিল যে সে পলাশবনে সেদিন সে ভেবেছিল যে রুরুও যদি কাঠবেড়ালি হয়ে গেছে তো কাঠবেড়ালির স্বরে, কাঠবেড়ালির ভাষায় তাকে ডাকলে নিশ্চয়ই সে শুনতে পাবে যদি সে আশেপাশে থাকে। উত্তেজনা উদ্দীপণায় ঝটপট করে সে একটা ঝোরা খুঁজে বার করেছিল। তাতে স্নান করে, দাঁত মেজে, চোখমুখ ডলে ডলে ধুয়ে নিজেকে ঝকঝকে করে ফেলেছিল। তারপর পলাশ পাতায় বাদাম সাজিয়ে ডেকেছিল, “রুরু, রুরু” বলে। সেই ডাক পলাশের রক্তিমা, স্বর্ণাভা, শুভ্রতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল বনান্তরে। তারপর সূর্য যখন পাটে বসেছিল, তখন হাঁপাতে হাঁপাতে একটা কাঠবেড়ালি এসে ররঙ্গার নাম ধরে ডেকে ছিল। ররঙ্গার কোনো ভুল হয় নি রুরুকে চিনে নিতে। তারপর তারা উদ্‌যাপণ করেছিল তাদের বকেয়া বাসর, ফুলশয্যা। আর সকালে জেগে উঠেছিল আবার মানুষের বেশে।
নিজেদের মগ্নতা থেকে অবকাশ পেলে শুনেছিল টুনটুনি গাইছে,
“ছেলে, বউ সব গায়েব হতে মা ছুটেছিল রাজদরবারে
প্রজা নাকাল হচ্ছে শুনে রাজা মেতেছিল সংহারে
মন্ত্রী, সান্ত্রী, যন্ত্রী মিলে ধরেছিল সব চোর ডাকাতকে
সেই সঙ্গে ধরেছিল নিজেদের উটকো যত স্যাঙাতকে
ঠ্যাঙিয়ে স্যাঙাত জেনেছিল তারা চানুর দলের খবর
চালিয়ে হানা চানুর ঠেকে পেয়েছিল প্রমাণ জবর
চানুও কিছু কম নয় বটে, তারও ছিল গুপ্ত সেনা
কিছু ফেরার, কিছু নাচার যারা শুধতে পারেনি দেনা
সবাই মিলে রে রে রে করে তেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল 
রাজার বাহিনীও তাদের পিটিয়ে ঠান্ডা করেছিল
নাকের শোকে কাতর রাজাকে ঠুকরে আসতাম আমি নিজে
জাদুবলে পালাতাম ধূলোর ঝড়ে বালি দানার সাজে
তাই তো আমিও ছোট্টো সিপাই ছিলাম চানু চোরের দলে
একলা কী করে লড়ি বলো রাজার সঙ্গে পাঙ্গা নিলে?
তারপর এক রাতে জাদুকর গেল রাজার হাজতে মরে
নাওয়ের টুকরো ঝরল রাজার বাগানে জাদুর ঘুড়ি ছিঁড়ে
সেই টুকরোতে লেগে থাকা সুতো ধরিয়ে দিল সাত চোর
তাদের শপথে পড়ল ভেঙে সেরা চোর চানুর যত জোর
জানি না কী করে আমার প্রাণ বাঁচবে চানুর সাজা হলে
এ আবার কী! কে জড়াল, কী করে এমন রঙিন জালে!” – টুনটুনির গান গেল থেমে। আসলে বিভোর হয়ে টুনটুনি যখন বিলাপ গাইছিল, তখন নিঃসাড়ে জড়ো হয়ে ছিল রুরু আর তার সাত ভাই। রুরুর সাথে ররঙ্গা। সাত ভাইয়ের সাথে ছিল তাদের বউয়েরা। জাদুকর মরে যেতেই সবাই কাঠবেড়ালি থেকে মানুষ হয়ে গিয়েছিল। আর খুঁজে পেয়েছিল বাকিদের। তারপর সাত বউ মিলে খোঁপার জাল জুড়ে জুড়ে একটা জাল বানিয়েছিল। সাত ভাই একে অপরের কাঁধের ওপর চড়ে পৌঁছেছিল সেই পলাশ গাছের মগডালে, আর সন্তর্পণে জাল ছুঁড়ে ঢেকে ফেলেছিল পাশের গাছের মগডালে শোকসঙ্গীত বিভোর টুনটুনিকে।
জালে আটকা পড়ে টুনটুনি সন্ধি প্রস্তাব দিয়েছিল। পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাজদরবারে, যেখানে চানুর বিচারসভা চলছিল। সেখানে সে কবুলও করেছিল, নৌকাসুদ্ধ চোদ্দোজনকে চুরি করে কেমন মায়া কাননে লুকিয়ে রাখা হতো কাঠবেড়ালি করে, নানান দেশের বসন্তের পরিবেশে। টুনটুনি কিন্তু ছাড়া পায় নি শেষে। রুরুরা টুনটুনিকে রাজার লোকের হাতে তুলে দেওয়ার পর টুনটুনির সাথে তাদের সন্ধির কথা নিশ্চয়ই কেউ আমল দেয় নি। তাই বিচার শেষে চানু বা টুনটুনির কী হয়েছিল তাও জানা যায় না।


ঋণঃ ছোটো ভাই, ঝানু চোর চানু, টুনটুনি ও রাজার কথা, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি।

Sunday, April 3, 2016

সংসদীয় গণতন্ত্র নাকি মনসবদারির রকমফের

প্রতি পাঁচবছরে ভারতীয় ভোটাররা নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে থাকেন সংসদে ও বিধানসভায় যথাক্রমে দেশ ও রাজ্যের পরিচালনভার সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দের প্রতিনিধির উপর ন্যস্ত করার জন্য। কিন্তু এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাজ-সাজ রব কাড়া-নাকাড়া বাদ্যির মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে পরিচালনভারের দায় নয় , শাসনক্ষমতার দম্ভ তাই বোধ হয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে অক্লেশে , সমাজতন্ত্রের নামে ধনতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র কবলিত পড়শী  রাষ্ট্রটি , মানে চীন , সামন্ততান্ত্রিক বলে গালাগাল করে কে গাল পাড়ছে তা উপেক্ষা করে যদি তলিয়ে দেখা যায় যে কেন গাল পাড়ছে , তাহলে হয়তো গোড়ার গলদে পৌঁছোনোও যেতে পারে। তাই পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল স্বাধীন সমাজতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বের নির্বাচন পদ্ধতি , দায়িত্ব ও ক্ষমতা , তাঁদের অপসারণের নীতি যেভাবে ভারতীয় সংবিধানে বিধৃত তা নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখা যাক কোথাকার জল কোন খাতে বয়ে কোথায় দাঁড়িয়েছে  
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের গঠনে নানান দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ছিলেন সংবিধান রচয়িতারা ব্রিটিশ ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রনেতার ক্ষমতা ও দায়িত্ব সেই ব্যবস্থানুসারে রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রনেতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনি নিয়োগ করেন মন্ত্রীসভা এই মন্ত্রীসভা আবার দায়বদ্ধ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংসদে অথচ রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনতার কাছে কিংবা তাঁদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদে দায়বদ্ধ ননকারণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচকদের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত হন না, নির্বাচিত হন প্রতিনিধিনিত্বমূলক মতদানের মাধ্যমে মূলত বিভিন্ন রাজ্যের জনতার দ্বারা নিজের নিজের বিধানসভায় নির্বাচিত বিধায়কদের এবং জনতার দ্বারা নির্বাচিত সাংসদদের দেওয়া ভোটের ভিত্তিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন প্রত্যেক বিধায়কের ভোটের পরিমাণ নির্ধারিত হয় তিনি যে রাজ্যের বিধায়ক সেই রাজ্যের জনসংখ্যাকে সেই রাজ্যের বিধানসভায় নির্বাচিত বিধায়কদের মোট সংখ্যার হাজারগুণ দিয়ে ভাগ করে এতে একটি রাজ্যের প্রত্যেক নির্বাচিত বিধায়কের ভোটের মান সমান হয় অর্থাৎ যেকোনো একটি রাজ্যের প্রত্যেক বিধায়ক সমসংখ্যক রাজ্যবাসীর হয়ে মতদান করে থাকেন নির্বাচিত সাংসদদের ভোটের পরিমাণ নির্ধারিত হয় সমস্ত রাজ্যের সমস্ত বিধায়কের ভোটের সমষ্টিকে নির্বাচিত সাংসদদের সর্বমোট সংখ্যার যোগফল দিয়ে ভাগ করে , যাতে এঁরাও প্রত্যেকে সমপরিমাণ দেশবাসীর হয়ে মতদান করতে পারেন যদিও আইনত প্রত্যেক বিধায়ক বা প্রত্যেক সাংসদ নিজের পছন্দের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর সপক্ষে মত দিতে পারেন , কিন্তু সাধারণত প্রত্যেক বিধায়ক ও সাংসদ তাঁদের নিজেদের দলসমর্থিত প্রার্থীর সপক্ষেই মত দিয়ে থাকেন। ফলে রাষ্ট্রপতি নিতান্তই প্রতীকী রাষ্ট্রনেতা কিংবা কাগুজে বাঘ
এই ব্যবস্থা প্রভূত সমালোচিত এবং সমালোচনার মোকাবিলায় সংবিধানকাররা জোরালো সওয়ালও করেছেন। সংবিধান প্রণেতাদর যুক্তি ছিল যে প্রতীকী রাষ্ট্রনেতার নির্বাচনে পাঁচকোটি দশলক্ষ ( তৎকালীন ) মতদাতার অংশগ্রহণ বিপুল পরিমাণ অর্থ , সময় ও শক্তির অপচয় এছাড়াও তাঁদের যুক্তি ছিল যে , সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত দায়িত্বশীল সরকারের প্রকৃত ক্ষমতা নিহিত থাকবে মন্ত্রীত্বে অথচ পাঁচ বছরের সংবিধান নির্ধারিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের প্রক্রিয়াটি বেশ শক্তপোক্ত ।  রাষ্ট্রপতি স্বহস্তে উপরাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে লেখা পদত্যাগ পত্র উপরাষ্ট্রুতির দপ্তরে জমা দিতে পারেন কিংবা সংবিধান অবমাননার অপরাধে তাঁকে ইমপিচ করা হতে পারে লোকসভা বা রাজ্যসভার যে কোনো একটি কক্ষ রাষ্ট্রপতির সংবিধান অবমাননার অভিযোগটি সংসদের অপর কক্ষে উপস্থাপণ করতে পারে মানে লোকসভা যদি রাষ্ট্রপতির সংবিধান অবমাননার অভিযোগ আনে তবে তা আনা হবে রাজ্যসভার কাছে বা রাজ্যসভা রাষ্ট্রপতির সংবিধান অবমাননার অভিযোগ আনতে পারে লোকসভায় কিন্তু এই অভিযোগ আনার আগে অভিযোগ উত্থাপণকারী কক্ষে মানে হয় লোকসভাতে নয় রাজ্যসভাতে অভিযোগটির সপক্ষে একটি সঙ্কল্প উত্থাপণ করতে হবে সঙ্কল্প উত্থাপণ করার কম করে চোদ্দোদিন আগে সঙ্কল্পটির ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে এবং বিজ্ঞপ্তিটিতে কক্ষের মোট সদস্যদের ন্যূনপক্ষে চারভাগের তিনভাগের সই থাকতে হবে তারপর সেই সঙ্কল্পটি কক্ষের মোট সদস্যের ন্যূনপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে গৃহীত হতে হবে তবে সঙ্কল্পটি সংসদের অপর কক্ষে অভিযোগ হিসেবে পাঠানো যাবে। তদন্তের সময়ে সংসদের যে কক্ষ অনুসন্ধানে নিয়োজিত সেই কক্ষে অভিযুক্ত রাষ্ট্রপতি নিজে অথবা প্রতিনিধি মারফত অভিযোগের মোকাবিলা করতে পারেনএই দ্বিতীয় কক্ষেও যদি মোট সদস্যসংখ্যার ন্যূনপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন করেন অভিযোগ, তবে সেই কক্ষে সঙ্কল্পটি গৃহীত হওয়ার দিনই রাষ্ট্রপতি বরখাস্ত হবেন
অন্যদিকে মন্ত্রীসভার শীর্ষে থাকেন প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রীকে ও মন্ত্রীসভার বাকি সদস্যদের কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমেই বাকি সব মন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন তাই প্রধানমন্ত্রী সমানদের মধ্যে প্রথম বলে বিবেচিত হন অর্থাৎ পুরো মন্ত্রীসভার গঠনটি দাঁড়িয়ে থাকে প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার উপর এইভাবে মন্ত্রীদের অপসারণের সিদ্ধান্তটিও মূলত প্রধানমন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশেই রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার সদস্যদের বরখাস্ত করেন প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদটি রাষ্ট্রপতি দিয়ে থাকেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠদলের নেতাকে কিংবা সেই সাংসদকে যিনি সংসদের আস্থার্জনে সক্ষম শুধুমাত্র লোকসভার আস্থা হারালেই মন্ত্রীসভা পদত্যাগে বাধ্য হয় অথবা লোকসভার পাঁচ বছরের মেয়াদ ফুরোলে মন্ত্রীসভারও মেয়াদ ফুরোয় বা রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভা খারিজ করেও দিতে পারেন পাঁচ বছরের স্বাভাবিক মেয়াদের আগেই আবার রাষ্ট্রব্যাপী জরুরী অবস্থার সময় মন্ত্রীসভার মেয়াদ রাষ্ট্রপতি বাড়িয়েও দিতে পারেন সেক্ষেত্রে লোকসভার মেয়াদও বেড়ে যেতে পারে, কিন্তু সবই সংবিধান নির্ধারিত দেড় বছরের সময়সীমার মধ্য এই সময়সীমার অংশটি কোনো দলই সংশোধনের চেষ্টা করেন নি কারণ এ জাতীয় সংবিধান সংশোধনের সময় বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মানে সংবিধান সংশোধন করার সমর্থনে সংসদের উভয়কক্ষে উপস্থিত নির্বাচিত সদস্যদের ন্যূনপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন ও সমস্ত রাজ্যের অর্ধেকের বেশি বিধানসভায় ( মানে এখনকার ঊনত্রিশটা রাজ্যের মধ্যে নিদেনপক্ষে পনেরটা রাজ্যের বিধানসভায় ) সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন। যদিও রাষ্ট্রব্যাপী জরুরী অবস্থাতে রাজ্যগুলির বিধানসভার বিবেচ্য সমস্ত আইনের ওপর লোকসভার বিবেচনাই প্রাধান্য পায় তবুও সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব যেহেতু আইন নয়, সেহেতু সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে বিধানসভার মতামতের ওপর লোকসভার খবর্দারি চলবে না বলেই এখনও অবধি মানা হয় এইভাবে সংবিধানেই নিহিত আছে যথেচ্ছ সাংবিধানিক রদবদল আটকানোর উপায় তাই অধিকাংশ সময়েই মনে করা হয় ভারতবর্ষে সংবিধানেই সমূহ ক্ষমতা নিহিত আছে
অথচ তবুও টের পাওয়া যায় সংসদীয় গণতন্ত্রের হাত ধরে রাজনীতিকরাই ক্ষমতা ট্যাঁকস্থ করে ফেলেছেন এমনটা হওয়ার কারণ কী সমানদের মধ্যে প্রথম বলে বিবেচিত প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় গুরুত্ব ? কারণ সংসদে তিনিই সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা বলে সংসদের মতামত তাঁরই আঙুলের আগায় ঘোরাফেরা করে তারওপর আছে সংবিধানেরই দশম তপশীল, বাহান্নতম সংবিধান সংশোধনের ফসল, যার বলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তাঁর নির্বাচিত হওয়ার সময়ের সমর্থক রাজনৈতিক দলের বদলে অন্য রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে নির্বাচিত প্রতিনিধির পদাধিকার খারিজ হয়ে যায় চালু সংসদ বা বিধানসভার চলতি মেয়াদে ফলে রাজনীতিকে জীবিকা করে যাঁরা বিধায়কবৃত্তি বা সাংসদবৃত্তি নেন, তাঁদের পক্ষে নীতির বা স্বার্থপ্রশ্নে দলবদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া কল্পনাতীত একই কারণে বৃত্তি রক্ষায় তাঁরা গরিষ্ঠের দলে ভিড়ে থাকার চেষ্টাও করেন তাই হয়ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে বা আস্থা ভোটের সময়ে তাঁরা কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করার দলীয় সিদ্ধান্তকে আদেশের মতো পালন করেন না হলে তাঁরা দল থেকে বহিষ্কৃত হতে পারেন এবং জনপ্রতিনিধিত্বও খোয়াতে পারেন
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীত্ব বা মুখ্যমন্ত্রীত্ব নিতান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের উপর নির্ভর করে সেই হিসেবে প্রধানমন্ত্রীত্ব পেতে হলে লোকসভায় কোনো মতে পাঁচশো তেতাল্লিশ ( ৫৪৩ ) - টা আসনের ( বাকি দুটো আসন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান কমিউনিটির থেকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত প্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত ) অর্ধেকের বেশি মানে নিদেনপক্ষে দুশো একাত্তরটা ( ২৭১ ) টা আসন দখল করা । কোনো মতে আসন দখল করতে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে উপায় হলো মোর্চা গঠন করা কিংবা নিজের দলের লোকেরা মারপিট এবং খুনোখুনি করে হলেও যদি সংখ্যাওগরিষ্ঠতা তৈরি করতে পারে তো তাতে উৎসাহ দেওয়া
তাহলে নির্বাচনে মারকুটে লোক বা অপরাধীদের পরোক্ষ ব্যবহার করা এবং কালক্রমে এই সব লোকেদের প্রত্যক্ষে রাজনৈতিক দলে যোগদান করা এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল কারণ এই অপরাধীদের আনুগত্য স্বীকার করে তাদের সাহায্যে নির্বাচন জেতা যায় এবং সংসদে ও বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করা যায় এদের হাতযশে জিতে আসা প্রার্থীদের গুণতিতে রেখে আবার কালক্রমে এদেরকেই নির্বাচনে জয়ী জনপ্রতিনিধি হিসেবে ব্যবহার করার চলও হয়েছে তাই উচ্চাভিলাষী নেতা বশংবদ মারকুটে অপরাধীদের লালন , পোষণ এবং পালন করে থাকেন , তাদের নির্বাচনে জেতাতে উদ্যোগী হন বা নির্বাচনে জেতার যে প্রক্রিয়াই অপরাধীরা গ্রহণ করুন না কেন সেটাকেই নেতারা সমর্থন করেন অন্যথায় এইসব মারকুটে অপরাধীরা উচ্চাভিলাষী নেতাদের রাজনৈতিক বিরুদ্ধপক্ষে যোগ দিলে প্রধানমন্ত্রীত্ব বা মুখ্যমন্ত্রীত্ব পেতে চাওয়া নেতাদের শক্তিহানি ঘটে অর্থাৎ তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় তাই অপরাধী ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পারস্পরিক তোষণ ও পোষণ চলতে থাকে, কখনও নিজের দলের সদস্যপদ দিয়ে, কখনও সমর্থনভিত্তিক মোর্চা গঠন করে
মধ্যযুগের ভূমিভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় চালু মনসবদারিও কতকটা এমনই ছিল কেউ একটা এলাকার শাসক আর সৈন্যদলের নিয়োজক হলেই অপেক্ষাকৃত বড়ো এলাকার বা বেশি শক্তিশালী শাসক এবং বৃহত্তর সৈন্যবাহিনীর নিয়োজকের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতেনবিনিময়ে  প্রথম শাসক সৈন্যপিছু শস্য বা শস্যের মূল্য পেতেন এবং দ্বিতীয় শাসকের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য থাকতেন প্রথম শাসক নিজের এলাকায় উৎপাদিত ফসল ও অন্যান্য দ্রব্যের নির্দিষ্ট ভাগ কর হিসেবে দ্বিতীয় শাসকের কোষাগারে জমা দিতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতেনবদলে প্রথম শাসকের দখলী এলাকা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে দ্বিতীয় শাসক প্রতিশ্রুতি বদ্ধ থাকতেন প্রথম শাসকের দেওয়া করের ও সৈন্যবাহিনীর মাপ দিয়ে নির্ধারিত হতো তাঁর ক্ষমতার মাপঅর্থাৎ তিনি পাঁচ হাজারী কী দশ হাজারী নাকি বিশ হাজারী মনসবদার শক্তির এই জনসংখ্যাভিত্তিক লেনদেন ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে অটুট আছে বলেই দেখা যাচ্ছে বরং এই লেনদেনের মানাবনয়ন হয়েছে কারণ এই লেনদেনে শস্য ও অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্যের কোনো জায়গাই এখন নেইতার জায়গা নিয়েছে শাসনক্ষমতা আর সুবিধে , যেমন পঞ্চায়েত সদস্যপদ ও হাইওয়ের কন্ট্রাক্টরি , বিধায়ক পদ ও নির্বাচন ক্ষেত্রের সমস্ত প্রাইভেট সম্পত্তি হস্তান্তরের ওপর দুই শতাংশ দালালি ( নিষ্কর ) এবং সমস্ত সরকারি পরিকল্পনা ও নির্মাণের কাজের ওপর দশ শতাংশ দালালি ( নিষ্কর )চৌথ ( কৃষিজ উৎপাদনের একচতুর্থাংশ ) এবং সরদেশমুখী (কৃষিজ উৎপাদনের একদশমাংশ ) সেকালে আইন স্বীকৃত কর ব্যবস্থা ছিল একালের সামন্তরা বেআইনকেই যুগসিদ্ধ করে নিয়েছেন
ভারতে যদি রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি নির্বাচিত করে তাঁকে সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে যাবতীয় সরকারি সিদ্ধান্ত (বা সিদ্ধান্তহীনতা ) এবং কাজাকাজের জন্য দায়বদ্ধ করা হতো বা হয় তাহলে হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠের মনসবদারি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেত। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাথে রাষ্ট্রপতির আঁতাত হতে অসুবিধা থাকত না ফলে প্রাথমিকভাবে বিধ্বস্ত মনসবদারি পুনর্কায়েম হতে বেশি সময় লাগত নাপ্রধানমন্ত্রীর বদলে রাষ্ট্রপতিকে শীর্ষে রেখে রমরমিয়ে চলত মধ্যযুগীয় শক্তিচর্চা, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মোড়কে।
এই ব্যবস্থা থেকে নিস্তার পাওয়া যায় যদি বেআইনিগুলোকে অপরাধ হিসেবে মেনে নেওয়া হয় ও তার নিরসনে উদ্যোগী হওয়া যায়। সাংসদদের অপরাধ দমনের সাংবিধানিক প্রক্রিয়াটি সরলসাংসদদের যে কোনো ফৌজদারি মামলায় যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা যায়।  শর্তাধীন অব্যাহতি তাঁরা পেতে পারেন কেবল সিভিল মামলায়সেক্ষেত্রে সাংসদ অপরাধে লিপ্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করাটা তাঁর নির্বাচকদের এবং তাঁর নির্বাচক নন এমন নাগরিকদেরই অবশ্য কর্ত্তব্যএমনকি সাংসদ/বিধায়ক মন্ত্রী হলেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে কোনো অসুবিধে নেই শুধু খেয়াল রাখতে হবে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টাটা সংসদ বা বিধানসভা ভবনে না করে যেন তাঁর আবাসে বা ব্যক্তিগত কাজের জায়গায় করা হয় ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধে উঠে নাগরিকরা এমন একটা কাজ করে ফেলবেন সেটা ভাবাটা সোনার পাথরবাটিতে দুধ খাবার সামিল কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে অবশ্য
তাছাড়া অপরাধী বা প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ জনপ্রতিনিধিকে পাঁচ বছর সময় দেওয়ার বদলে পাঁচ বছরের মধ্যেই বরখাস্ত করার সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার অর্জন করলেও মনসনবদারি ব্যবস্থাটি প্রকৃত গণতন্ত্র হয়ে উঠতে পারে করছি , করব করে পাঁচ বছর কাটিয়ে ভাগ্য , কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের নামে দোষারোপ করে অনেক প্রতিনিধিই সমবেদনা কুড়িয়ে নির্বাচনের পর নির্বাচন জিততে থাকেনঅনেকে এই কাজটাতেও মনসবদারিমূলক পেশীশক্তিই ব্যবহার করেনএই দুরকম হিসেবেই অযোগ্য জনপ্রতিনিধিদের কবল থেকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হতে পারে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে প্রত্যাহার করার সাংবিধানিক ব্যবস্থা ব্যবস্থা এরকম হতে পারে যে একটি নির্বাচন ক্ষেত্রের ন্যূনপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিক সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনের কাছে কোনো একজন প্রতিনিধিকে প্রত্যাহারের লিখিত আবেদন জানালে  প্রত্যাহারের সপক্ষে মতদান / নির্বাচন আয়োজন করা হবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতটি প্রতিষ্ঠিত হবে
আরেক দফা নির্বাচনকে খরচ সাপেক্ষও মনে হবে না যদি নির্বাচনে কমিশন নিয়ম করে দেন বা সংবিধানের নির্বাচনী ধারাগুলোতেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যে যে কোনো নির্বাচনী ক্ষেত্রের যাবতীয় নির্বাচন হবে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে যেমন, এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় রবিবার কারণ এই সময়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্ভাবনা আসমুদ্র হিমাচলব্যপী ভারতবর্ষে সবচেয়ে কম হিংসাত্মক ঘটনা যাঁরা ঘটান তাঁদের প্রতিহত করার জন্য অবশ্য অনেক অনেক পরিমাণে নিরাপত্তা বাহিনী লেগে যাবে তাতে সেক্ষেত্রে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ রবিবারকে ব্যববহার করা যায় নির্বাচনের দিন হিসেবে এছাড়াও চালু বিধানসভাগুলোর মেয়াদ চার বছর থেকে পাঁচ বছর ছমাসের মধ্যে বেঁধে ঊনত্রিশটা বিধানসভা এবং সাতটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ছত্রিশটা নির্বাচনকে প্রতি বছরে তিনটে করে রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নির্বাচনে সীমিত করে ফেলা যায় আরেকটা বছরে লোকসভা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যায়। পঞ্চম বছরকে রাখা যায় সমস্ত পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচনের জন্য অথবা এই শেষদুটো নির্বাচনকেও সংশ্লিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচন বা লোকসভা নির্বাচনের সাথে একই দিনে ঘটানো যায় তাতে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর প্রয়োজন কিছুটা কমানো যায় কারণ হিংসার লগ্নীকারীদেরও একই দিনই একাধিক প্রতিনিধির নির্বাচনে পর্যাপ্ত হিংসুটে/মারকুটে লোক জোটাতে খানিকটা বেগ পেতে হবে তারওপর এক নির্বাচনী ক্ষেত্রে দায়িত্বপালনে ব্যর্থ কিংবা পরাজিত প্রার্থীকে একাধিক পদে মনোনীত করা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও মুশকিল হবে ও তাদের সমর্থনে পর্যাপ্ত হিংসুটে/মারকুটে লোক জোটাতে আরও বেশি বেগ পেতে হবে তাদের কারণ দেখা যায় যে পঞ্চায়েতসফল নেতাকে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হলে তাঁরা অনেকসময় ব্যর্থ হন ও পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় ফিরে নিজ এলাকায় দখল আর শাসন কায়েম রাখার স্বাচ্ছন্দ্যে ফিরে যানএকই দিনে পঞ্চায়েত / পৌরসভা এবং বিধানসভা বা লোকসভার নির্বাচন হলে কোথায় কোন প্রার্থীকে দেওয়া হবে সেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আভ্যন্তরীণ অশান্তিতেও জেরবার হয়ে যেতে পারে ও, ফলে , তাদের পক্ষে প্রশাসনিক অশান্তি বাঁধানোও দুরূহ হয়ে যেতে পারে মানে আভ্যন্তরীণ মনসবদারি কোন্দলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় যোদ্ধৃ পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠতে পারেতাছাড়াও এক এলাকার গুণ্ডাবাহিনী সেই এলাকার স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন ছেড়ে অপর এলাকায় বিধানসভার  লোকসভার নির্বাচনে গিয়ে অশান্তি পাকাবার সময় ও সুযোগ দুটোই নাও পেতে পারে এতে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর প্রয়োজন কমতে পারেসেক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত পঞ্চম বছরে সমস্ত অন্তর্বর্তী নির্বাচন করে ফেলা যেতে পারে
এটাও সোনার পাথরবাটিতে চাটনি চাটার মতো লাগলে নাগরিক ম্যানিফেস্টো বানানো যায়একেক নির্বাচন ক্ষেত্রের নাগরিকরাই কী কী চাই আর কী কী চাই - নার ফর্দ বানিয়ে পাড়ায় ফেস্টুন/ হোর্ডিং লাগাবেন, স্থানীয় কেবল নেটওয়ার্কে ( নেটওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিঊটরের দাবিও ফর্দে রেখে) জনস্বার্থে ( নিঃখরচায়? ) প্রচার করবেন, তা বাদে সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রচার করা যায় বিভিন্ন দলের নানান প্রার্থীর মধ্যে যাঁরা নাগরিক পছন্দের সঙ্গে একমত হয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যেকার দলগুলির নিজেদের খরচে করা প্রাথমিক নির্বাচনে জিতে সমগ্র নির্বাচন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করবেন নির্বাচন কমিশন পরিচালিত নির্বাচনে তাঁকেই প্রতিনিধিত্বে বরণ এবং প্রয়োজনে বরখাস্ত করা যাবে
যতদিন না এসব করা যাচ্ছে ততদিন প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ জনপ্রতিনিধিকে প্রতারণার ফৌজদারি মামলায় ফাটকে পোরার ব্যবস্থা করাই যায় অর্থাৎ প্রত্যেক জনপ্রতিনিধিকে তাঁদের নির্বাচকসমষ্টির প্রতি, নির্বাচনক্ষেত্রের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলার জন্য ব্যবস্থা নেওয়াই যায় সমষ্টিগতভাবে সেই দুঃসাহসটা করতে হলে বুঝতে হবে যে মিলিটারি ক্যাম্প করার জন্য আমাদের মাঠটা ছেড়ে দিতে হলেও তাত্র দেশ সুরক্ষিত হব, কিংবা আমার বাগান আর ক্ষেতের খানিকটা হাইওয়ের জন্য দিলে কাল আমার বসত ভিটাটা ঢাবা, ঢাবা থেকে হোটেল হতে পারে ভবিষ্যতের লাভের দিকে তাকিয়ে বর্তমানের ক্ষতি স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিলের ব্যবস্থা ছেড়ে যুক্তি দিয়ে হক আদায়ের চেষ্টায় লাগতে হবে জনপ্রতিনিধিকে দায়িত্ব বোঝাবার আগে নিজেদের দায়িত্ববান হতে হবে
অতএব সোনার পাথরবাটিটা যতক্ষণ না কাঁচ / প্লাস্টিক / ইস্টিলের মতো বাস্তব হয়, সে পর্যন্ত না হয় গলা মেলাই আর তাল দিয়ে যাই , তুমিই আমার সিপিএম , তুমিই আমার এটিএম , তুমিই আমার সিরিজ প্রেমের শেষটা , তুমিই আমার তৃণমূল , তুমিই আমার টোপাকুল , তুমিই আমার সিরিজ ভুলের শেষটা কিংবা তুমিই আমার বিজেপি, তুমিই আমার জিলাপি, তুমিই আমার সিরিজ লোভের শেষটা
ঋণঃ
১। Introduction to the Constitution of India, 18th Edition, Acharya Durga Das Basu,
২। http://rajyasabha.nic.in/rsnew/rsat_work/chapter-8.pdf

৩। চন্দ্রবিন্দু।

Sunday, February 14, 2016

আমার ভ্যালেন্টাইন

অয়স্কান্ত চেহারা তাঁর বয়স কম তো নয়
ডাবল চিনে ঢেকে রাখেন নীচের ঠোঁটের ক্ষয়
ভীষণ রাগী মুখের ভেতর ফিচেল হাসির বাণ
চুলের কালো মুছে গিয়ে সাদার দিকেই টান

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

মধ্যভাগে উচ্চ তিনি উচ্চভাগে ভারী
চশমা দিয়ে শুষতে থাকেন যত দেখনদারি
কোলে রাখেন বালিশটা তাঁর সামনে খোলা বই
খুলে রাখা ল্যাপটপে ফের লাগান খোঁচা দুই

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

রাতে তাঁকে জাগিয়ে রাখে সিনেমার বাই
দিনের বেলা ঘুমোন তিনি রাত জেগেছেন তাই
তাইতো তিনি পান না সময় খান না সারা দিন
সারা রাতে খালি করেন বিস্কুটের সব টিন

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

তাঁর কাষ্ঠ কাশিখানা বাঁশির মত লাগে
আওয়াজখানা ফিরতে থাকে তাঁরই আগে-ভাগে
ঠোঁটের আগে ঝুলিয়ে রাখেন যত্নে সিগারেট
এটার সংখ্যা ছাপিয়ে যায় সকল এস্টিমেট

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

ছিলেন তিনি সঞ্জীব কাপুর ব্যাচেলর কালে
বউয়ের হাতে চিকেন খেয়ে রাঁধতে গেছেন ভুলে
ভুলে গেছেন কেমন করে কুটো করতেন দুটো
হাঁকাহাঁকি করেন শুধু বুজিয়ে কানের ফুটো

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

গুণের কথা বলব কত হাঁপিয়ে গেলাম প্রায়
তাঁর পাঁচালী লিখতে গেলে কবজি মোচড় খায়
আসছে বছর লিখব আবার তাঁর নামে এক পুরাণ
ভাল থাকুন তিনি, তাতে জুড়োক আমার পরাণ

তিনি আমার ভ্যালেন্টাইন, আহা, আমার ভ্যালেন্টাইন

Thursday, January 14, 2016

PCH January 10, 2016






Tuesday, January 5, 2016

My presence @ International Kolkata Book Fair 2016 January 27th, 2016 – February 7th, 2016 12 Pm to 8 PM

My Books 


 


are available at 

সৃষ্টিসুখ-এর স্টলে (স্টল নং ৪৯৩, থিম প্যাভিলিয়ন বলিভিয়ার পাশেই)

The year long addresses of my books are the followings:
1. Online Amazon store

2.Parabas Book store

3. Sristisukh outlet: 30A Sitaram Ghosh Street, Kolkata - 9

Besides my poem in Bengali has been included @ Iching-Piching, an album 
of the bengali songs for children  will be available @ Stall no.501, Kolkata book fair 2016








Thursday, December 24, 2015

নদীর মতো

অতল ছোঁবে ভেবে ভেবেই ঝাঁপিয়েছিল
ঠুকরে পাথর চলার পথে
ঠোকর দিয়ে ভাঙল শিলা
অপাড় হলো
অমোঘ টানে বয়েই গেল
মিশে গেল, মিলে গেল
অন্য ধারায়, অন্য বহায়
অন্য আধার পেয়ে
অতল যে কী ভুলেই গেল
তবুও কেবল বয়েই গেল

Thursday, October 1, 2015

কিছু ফেলনায় লেখা ইতিহাস

লস এঞ্জেলসের শহরতলি কালভার সিটি। সেখানে ২০১০-১১ সালে ছিল আমাদের বাসা। বাসার থেকে হাঁটা দূরত্বে ছিল ওয়েন্ডে মিউজিয়াম। জার্মান ভাষায় ওয়েন্ডে মানে মোড়। ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের উপজীব্য সোভিয়েত ব্লকের ইতিহাস - ১৯৬১ সালে বার্লিন দেয়াল গাঁথা থেকে ১৯৯০ সালে বার্লিন দেওয়ালের ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত। 
ওঁদের ওয়েবসাইট থেকে জেনেছিলাম যে প্রত্যেক শুক্রবার দুপুর তিনটের সময় গাইডেড ট্যুর পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটেই একটা ই-মেল ঠিকানা ছিল ট্যুরে অংশ নেওয়ার আবেদন জানানোর জন্য। একটাই ই-মেলে আমাদের পছন্দের তারিখে মিউজিয়াম দেখার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছিল; কোনো প্রবেশমূল্য ছিল না। 
পার্থ আর রঙহীন দেওয়াল
ছবি আঁকা উল্টো পিঠ
নির্দিষ্ট দিনে ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলাম যে বাইরের চত্বরে পশ্চিম মুখে দাঁড়িয়ে আছে কংক্রিট দেওয়ালের একটা খন্ড, একপিঠ তার ভীষণ রঙিন, উল্টোপিঠ ধূসর কংক্রিট রঙা। সেটা ফেলে সদর পেরিয়ে পৌঁছলাম দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির মুখে। পাশে একটা ঘরে কয়েকটা মনিটরে ফুটে চলেছে বার্লিন দেওয়ালের পূর্ব জার্মান দিকের পাহারাদারদের জবানবন্দি, জার্মান ভাষায়। আর রয়েছে নানা মাপের স্টিলের আলমারি, যাতে তাকগুলো ঢাকা কাঁচের ঠেলা পাল্লা দিয়ে;  অনেকটা আমাদের অনেকের বাড়িতে বই রাখার বা মেডাল রাখার জন্য যেমনটা ব্যবহার করা হয় তেমন। সেই সব আলমারির কয়েকটা ভর্তি সেকালের বাজেয়াপ্ত পাসপোর্টে। কয়েকটাতে রয়েছে নজরদারির নানা সরঞ্জাম। তাছাড়া চেকপোস্ট চার্লির নানা অবশেষ।
  মিউজিয়ামের দোতলায় উঠে যে হলটায় দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানে অনেকগুলো ডেস্ক আর চেয়ার রাখা ছিল। ছিল একটা কাঠের লেনিন মূর্তিও, যা প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু, - বক্তৃতার বা মিছিলে হাঁটার ভঙ্গিমায়। দেওয়ালে টাঙানো ছিল কয়েকটা বড় বড় ছবি। এই হলের ওপরই ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের ইভেন্ট সঞ্চালক ক্রিস্টিনা কুভাস-উল্‌ফের দপ্তর, দপ্তর মিউজিয়াম ডিরেক্টর ও অন্যান্য আধিকারিকদের।
পাঁচ ফুট উঁচু কাঠের লেনিন মূর্তি, সোভিয়েত ব্লকের ভূমিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মেয়েদের ভূমিকার ছবি, পুর্ব জার্মানির সংসদ ভবন থেকে আনা ডেস্ক
মিউজিয়াম দর্শনের জন্য এই হলেই জড়ো হতে হয়। আমাদের সাথে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস ক্যাম্পাসের ছাত্ররা। গরমের ছুটিতে ছাত্ররা বা গবেষকরা এখানে বেতনভুক ইনটার্ন হিসেবে কাজ করতে পারেন। আমাদের মিউজিয়াম ট্যুরের গাইড ছিলেন ইনটার্ন আলিনা সেরেব্র্যানি। ওয়েন্ডেমিউজিয়ামের ফেসবুক পাতা থেকে জানা যায় আলিনার পূর্ব পুরুষও জড়িয়ে ছিলেন বার্লিন দেওয়ালের ইতিহাসে সঙ্গে।
 মিউজিয়ামের সংগ্রহগুলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে আলিনা জানিয়েছিলেন যে বার্লিন দেওয়াল ভেঙে পড়া মাত্র সাবেক পূর্ব জার্মানি জুড়ে দুদ্দাড় করে ভেঙে পড়ছিল পুরোনো ব্যবস্থায় বানানো আসবাব, ভাস্কর্য কিংবা রাষ্ট্রীয় স্মারক। আস্তাকুড়ে জমা হচ্ছিল নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র। ইতিহাসের সেই মোড়ে, প্রায় লোপ পেতে চলেছিল পূর্ব ইউরোপের অবরুদ্ধ তিনদশকের ইতিহাস। আধুনিক ইতিহাসের স্বার্থে ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার জাস্টিনিয়ান জামপল চেষ্টা করে চলেছেন সেই অধ্যায়কে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের চেষ্টায়, তাঁর নিজের শহর লস এঞ্জেলসে। যেহেতু বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ার সময় পূর্ব জার্মানির মানুষের আবেগ পুরোনো সব কিছুকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল সেহেতু ঐ মিউজিয়াম পূর্ব জার্মানির কোথাও বানাতে ভরসা পাননি জামপল। যে সমস্ত দিনলিপি, নথি, অবশেষ ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে আছে তা দেখেই বোঝা যায় একথা। ধ্বংসাবশেস কুড়োতে কুড়োতে একদশকে ইতিহাসবিদ জামপলের সংগ্রহ যা দাঁড়িয়েছিল তা সংরক্ষণের জন্য গ্যারাজ কিংবা বৈঠকখানা নেহাতই অপ্রতুল ছিল। তাছাড়াও ইতিহাসের সেই মূহুর্তকে তো তিনি আশ্রয় দিয়ে চলেছেন ভাবীকালের জন্যও। তাই সমস্ত সংগ্রহ যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছাত্র, গবেষক, উৎসাহী মনোযোগী সাধরণ পর্যবেক্ষকের নাগালে পৌঁছোয় তাই বানিয়েছেন ওয়েন্ডে মিউজিয়াম।  
পিঙ্ক লেনিন
হল পেরিয়ে যে করিডরে গেলাম সেখানে লেনিনের একটা আবক্ষ মূর্তি রাখা ছিল। কিন্তু সেটার মাথা থেকে নব্বই শতাংশ গোলাপি রঙে ঢাকা। সেটার ডাকনাম পিঙ্ক লেনিন। পাঁচিল ভেঙে পড়ার পর জনতার আক্রোশে মূর্তিটার রং বদলে গেছে!
করিডর পেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় এসে দেখতে পেলাম একতলার সংগ্রহশালা, মোটেও মিউজিয়ামের মতো নয়, ওয়্যার হাউসের মতো। স্টিলের নাটবল্টু আঁটা তাকে আড়াআড়ি আর লম্বালম্বি দড়ির পেছনে সারি সারি কার্ল মাক্স, স্টালিন, লেনিন, ক্রুশ্চেভের ভাঙা কিংবা গোটা, আবক্ষ মূর্তি। আসলে সেগুলো যাতে তাক থেকে পড়ে না যায় তাই আড়াল দেওয়া হয়েছে অমন করে। এই তাকগুলো উচ্চতায় ঘরের ছাদ অবধি আর চওড়ায় দেওয়াল অবধি বাড়ানো যায় এমন। 
দড়ির পেছনে সারি সারি কার্ল মাক্স, স্টালিন, লেনিন, ক্রুশ্চেভের ভাঙা কিংবা গোটা, আবক্ষ মূর্তি

চেক পয়েন্ট চার্লির নামলেখা সাইন বোর্ড
মিউজিয়ামের প্রথম একজিবিট ছিল মিত্র শক্তির চেক পয়েন্ট চার্লির নামলেখা সাইন বোর্ড। তারপর ছিল কিছু অবাক করা চেয়ার। সাদা রঙের প্লাস্টিকে বানানো ডিমাকৃতি গার্ডেন চেয়ারটার গদি নীল ভেলভেট দিয়ে মোড়াতে সেটা অপরূপ দেখাচ্ছিল। বেশ কিছু গদি আঁটা চেয়ারের মাথাটা খুলে দিলেই সেটা একটা সিঁড়ি হয়ে যায়। মনে করা হয় যে বার্লিন প্রাকারের ভিতরে লোহার যোগানের অভাব হয়তো প্লাস্টিকের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর নতুন নতুন উদ্ভাবনীর পথে চালিত করেছিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উৎপাদকদের। তাই অপূর্ব ডিম চেয়ার তৈরি হয়েছিল। তাই হয়তো চাকা লাগানো অটোমান, মানে গদি আঁটা যে চেয়ারের হেলান দেওয়ার পিঠ থাকে না, তার কাঠের খোল দিব্যি ব্যবহার করা যেত জিনিসপত্র রাখার জায়গা হিসেবে।  আসবাবের ধরণ থেকে মনে হয় যে অকুলান বাসস্থাণে সংকুলানের জন্য আসবাব হতো ভাঁজ করে ছোটো করে ফেলে যায় এমন কিংবা একই আসবাবকে অনেক রকম কাজে ব্যবহার করা যাবে এমন। তাই, আলিনার মতে, শুধু চেয়ারের জন্য নয় যে কোনো শিল্পজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রেই অবশ্যম্ভাবী ছিল এই উদ্ভাবনী। এই প্রসঙ্গে পার্থ মনে পড়ে করিয়ে দেয় ডিডিআর বা জিডিআরে বানানো সাইলেন্ট স্টার ছায়াছবির কথা। সেই ছবির বিষয় সারা পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের সম্মিলিত শুক্রগ্রহ অভিযান। সেই বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একজন চিনা বৈজ্ঞানিক অজৈব পদার্থ থেকে খাবার সংশ্লেষের পদ্ধতি জানতেন! সে আরও জানিয়েছিল পূর্ব জার্মান উদ্ভাবনীর আরেক বিস্ময় দুই দরজার ত্রাবান্ত গাড়ির কথা।  
ডিম চেয়ার, সিঁড়ি চেয়ার, অটোমান
প্লাস্টার অব প্যারিসের ভাস্কর্য
ধাতব ভাস্কর্য
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে ইস্টার্ন ব্লকের নানান দেশ থেকে আনা ভাস্কর্যের সংগ্রহটা যদিও আদর্শবাদ জড়ানো তবুও রকমারি। মুষ্টিবদ্ধ মুদ্রায় লাল সেলামরত শ্রমিক কিংবা কমিউনিজমের প্রবক্তা মার্ক্স, এঙ্গেলস ও বিভিন্ন সোভিয়েত ও ইস্টার্ন ব্লকের নেতাদের মূর্তির মাধ্যম ছিল প্লাস্টার অফ প্যারিস। বাচ্চাদের জন্য তৈরি কাঠের খেলনাতেও ছিলেন আধুনিক নেতারা অতিমানবিক মহিমায়। একটা বেশ রঙচঙে কাঠের মূর্তি দেখিয়ে আলিনা বলেছিলেন যে সেই মূর্তিটা সম্ভবতঃ লেনিনের এবং নেদারল্যান্ডসে খোদাই করা। ছাঁচে ঢালা সীসার মূর্তিও পাওয়া গেছে কমিউনিস্ট নেতাদের। তবে  সবথেকে নজরকাড়া মূর্তিটি এক অখ্যাত মহিলাশ্রমিকের। কাঠে বানানো প্রায় দেড় ফুট লম্বা সেই মূর্তির পেশীবহুল হাত, চওড়া কাঁধ ও কপাল, পিছনে টেনে বাধা চুলে এক বলশালীনিকে দেখা যায়। 
আন্দোলনে সামিল কোনো জনের মূর্তি
আলিনার হাতে ফুডিসের রেকর্ড
চমকপ্রদ ছিল গানের দল ফুডিসের রেকর্ডের খাপের ছবি। ফুডিস ছিল পূর্ব জার্মানির প্রথম রকব্যান্ড  যেটা জনসমক্ষে গানের অনুষ্ঠান করার সরকারি অনুমতি পেয়েছিল। শুধু তাই নয় সরকারি রেকর্ডিং সংস্থা আমিগা থেকে বেরোত তাদের লং প্লেয়িং রেকর্ড। সেসব রেকর্ডের খাপের নকশা হতো দারুন রঙিন। 
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে পূর্ব জার্মানির বইপত্রের বেশ বড়ো সংগ্রহ আছে। বইপত্র অবশ্য মূলতঃ কমিউনিস্ট দর্শনের উপরেই লেখা হতো। বইপত্রের মাধ্যম ছিল প্রধানত জার্মান ভাষা।
বই ছাড়াও এই মিউজিয়ামের সংগ্রহে আছে পূর্ব জার্মানির বেশ কিছু রেডিও সেট। রেডিও বেশ শক্তিশালী মাধ্যম ছিল মতাদর্শ প্রচারের। কিন্তু এই যন্ত্রই নাকি তাঁদের অশান্তির কারণও ছিল। কারণ এই যন্ত্রটা সোভিয়েত ব্লকের জনসাধারণেরও বেশ পছন্দ ছিল, সাধারণ ক্রেতার নাগালেও ছিল। ফলে ক্রমাগত রেডিও তরঙ্গ বেয়ে ইস্টার্ন ব্লকের জনসাধারণের বৈঠকখানায় ঢুকে পড়ছিল বার্লিন দেওয়ালের পশ্চিম দিক থেকে প্রচারিত যাবতীয় রাজনৈতিক আলোচনা, জনমত, পুব দিকের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতির সমালোচনা - সবই । যার মধ্যে ইস্টার্ন ব্লকের রাষ্ট্র নেতৃত্বের সব থেকে অপছন্দ ছিল রক সঙ্গীত। আর যুবজনতার প্রথম পছন্দের রেডিও স্টেশন ছিল রক সঙ্গীতের স্টেশন।
ইরিশ হোনেকারের শ্যালমাই
পুর্ব জার্মানির গান বাজনা প্রসঙ্গে আরেকটা খুব জরুরি কথা জানানো দরকার। শ্যালমাই নামে একটা বাজনা ইস্ট জার্মানির ইস্কুল, কারখানা আর নগরে গঞ্জে খুব জনপ্রিয় ছিল। এই বাজনা বেশ সহজে বাজাতে শেখা যায়। পুব জার্মানির বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা ভেব ট্যাকটনের পক্ষ থেকে বার্লিন দেওয়ালের হোতা ইরিশ হোনেকারকে তাঁর পঁচাত্তরতম জন্মদিনে যে শ্যালমাইটা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল সেটা এখন ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের সংগ্রহে আছে। পুর্ব জার্মানির সোশ্যালিস্ট পার্টির শীর্ষনেতা তথা রাষ্ট্রনেতা ইরিশ হোনেকার তাঁর সেই শ্যালমাইটা দিয়েছিলেন পশ্চিম জার্মানির রকস্টার উডো লিন্ডেনবার্গকে, আশির দশকের শেষে পশ্চিম জার্মানিতে; বদলে নিয়েছিলেন লিন্ডেনবার্গের চামড়ার জ্যাকেট। 
ওয়েন্ডে মিউজিয়াম সাবেক পূর্ব জার্মানি আর ইস্টার্ন ব্লকের জীবনের নানা কোণ থেকে সংগ্রহ করেছে যাপণের অবশেষ। তারমধ্যে রয়েছে পোষাক, পর্দা, কার্পেটও। পুর্ব জার্মানির অসংখ্য কার্পেটের নকশায় দেখা যায় নিসর্গ, ফুলতোলা পাতাবাহার আর অবশ্যই বালক নেতার ছবি। সব থেকে বেশি পাওয়া যায় লেনিনের ছ বছর বয়সের একটা ছবি। আমাদের পটচিত্র বা কাঁথায় বালক নিমাই বা বালক গদাধরের মতো। বালক লেনিনের সেই ছবিটা শুধু কার্পেটে নয়, কুশনের ঢাকায়, পর্দাতেও বোনা হোতো। ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের এসব বস্ত্র সংগ্রহের একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে পুলিশ, নাবিক আর সেনার উর্দি। নাবিকের উর্দি ও স্কার্ফের রং হতো ঘননীল। এরকম এক নাবিকের উর্দিতে স্কার্ফের ভিতরের অংশে আঁকা ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরপ্রান্ত ছোঁওয়া কামচটকা উপদ্বীপের মানচিত্র। 
কার্পেটের নকশায় লেনিনের ছ বছর বয়সের ছবি
অ্যটাচিকেস
এইসব সংগ্রহের মধ্যে সব থেকে চমকপ্রদ ছিল অ্যটাচিকেস। অনেকগুলো অ্যাটাচি খুলে খুলে আলিনা দেখিয়েছিলেন। এই অ্যটাচিকেসগুলো সবই পুর্ব জার্মানি থেকে সংগৃহীত। এগুলো স্টাসির মানে পুর্ব জার্মানির নিরাপত্তামন্ত্রকের সম্পত্তি ছিল। এর ভিতরে সাধারণত একটা ডিকোডার থাকত। এই অ্যাটাচিকেসগুলো মূলত খবর দেওয়া-নেওয়ার কাজে লাগত।
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের সংগ্রহে থাকা পূর্ব জার্মানির সিনেমার মধ্য জাপানি ও রাশিয়ান ভাষার বেশ কিছু ছবি আছে। জাপানি ছবির পোস্টারে তার নামের ইংরেজি তর্জমা ছিল। সেটা পড়ে মনে হলো জাপানি ছবিটা সামাজিক ছবি। তবে রাশিয়ান ছবির পোস্টারে মহাকাশ যান আঁকা ছিল।  
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে হাতে আঁকা ছবির সংগ্রহও বিশাল। একটা ছবিতে দেখা যায় মেয়েরা যন্ত্রপাতি, ঝুড়ি কোদাল নিয়ে চাষের কাজে চলেছে। দূরে আকাশে দলা দলা মেঘ। সেই মেঘে নাকি পাঁচটা মহাদেশের রেখার আদল। ছবিটাতে দেখানো হয়েছে যে সোভিয়েত ব্লকের ভূমিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মেয়েরাই ধরে রাখে এবং দূরের মেঘের দিকে মেয়েদের তুলে রাখা আঙুলে সেই ভূমিভিত্তিক সমাজতন্ত্রকে ইস্টার্ন ব্লকের বাইরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার। অন্য কয়েকটা ছবিতে দেখা যায় পশ্চিমী দুনিয়ার কোর্টরুমে চলতে থাকা ডিভোর্সের মামলার শুনানির দৃশ্য; পশ্চিমী হোটেলে ফূর্তির আয়োজনে খোলামেলা পোষাকে নারীদের উপস্থিতি। একটা ছবি রাজনৈতিক সম্মেলনের। এই ছবিতে বক্তা ক্রুশ্চেভ; সমস্ত শ্রোতার ছবি অটুট রেখে নরুন জাতীয় কিছু দিয়ে খুবলে তোলার চেষ্টা হয়েছে ক্রুশ্চেভের প্রতিকৃতি। 
পশ্চিমী দুনিয়ার ছবি
প্যালেস্টাইনের উপহার
অন্যান্য উপহার
ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের যাবতীয় সংগ্রহের একটা বড়ো অংশ হলো পুর্ব জার্মানির পাওয়া কুটনৈতিক উপহার। তার মধ্যে প্যালেস্টাইন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, কঙ্গো এবং অবশ্যই রাশিয়া থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপহার আছে। প্যালেস্টাইনের উপহার মুলতঃ পোর্সেলিন প্লেটে একরঙা সনাতন নকশা, ইয়েমেনের উপহার দাবার ঘুটি, কঙ্গোর উপহার আফ্রিকান রমণীর আবক্ষ মুর্তি, রাশিয়ার উপহার লেনিন মূর্তি। দুঃখজনকভাবে এই মূর্তিটাতেও কালো রং লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল। কম্বোডিয়া থেকেও কাঠে খোদাই করা দাবার ঘুটির উপহার ছিল। 
কুটনৈতিক উপহার
পাসপোর্টের সংগ্রহ
আলিনার থেকে জানা গেল যত সিনেমা পাওয়া গেছে পুর্ব জার্মানি থেকে সেগুলোর ইংরেজি তর্জমা ও সাবটাইটেল বানানোর কাজ চলছে। সব দেখাশোনা শেষে দোতলার হলঘরে আবার ফিরে এলাম সবাই। তখন আলিনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে ওঁদের ওখানে কনফারেন্স, মিটিং ইত্যাদি ওই হলঘরে সেইসব কাঠের ডেস্কে বসেই হয় কিনা। আলিনা বলেছিলেন নিশ্চয়ই হয়। তবে কাঠের ডেস্কগুলোও পুর্ব জার্মানির সংসদ ভবন থেকে আনা। বলাবাহুল্য ডেস্কগুলো এমন করে বানানো যে সেগুলো লেখাপড়ার কাজেও ব্যবহার করা যায় আবার একটু এধার ওধার করে সিনেমা দেখার কাজেও ব্যবহার করা যায়। পুর্ব জার্মানির এক-দ্রব্য-বহু-ব্যবহারের উদ্ভাবনীকে কুর্নিশ করে বেরিয়ে এলাম। আসার আগে আলিনা বলেছিলেন, নিচের তলার পাসপোর্টের সংগ্রহ দেখে যেতে, আর দেখে যেতে এক খন্ড বার্লিন দেওয়াল। বার্লিন দেওয়াল খন্ডের পিছনে তখন চরাচরব্যাপি প্রশান্ত মহাসাগর আর অস্তোন্মুখ সূর্য।
লস এঞ্জেলস ডাউনটাউনে লস এঞ্জেলস কাউন্টি মিউজিয়াম অফ আর্ট, লা ব্রি পিট আর কয়েকটা অন্যান্য মিউজিয়াম নিয়ে মাইলটাক রাস্তাটার নাম মিরাক্যল মাইলস। সেই রাস্তার পাশে সারি দিয়ে দাঁড় করানো আছে বার্লিন দেওয়ালের অনেকগুলো খন্ড। তার একদিক ছবিতে ছবিতে রঙিন আর অন্যদিক ধূসর। আলিনার কাছে জেনেছিলাম অবশ্য খুব শিগগির শুরু হতে চলেছে ধূসর দেওয়াল রাঙিয়ে তোলার কাজ।
মিরাক্যল মাইলস-এ বার্লিন ওয়ালের খণ্ডাংশ
        ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে ইস্টার্ণ ব্লকের ইতিহাস চর্চার অংশ হলো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। বার্লিন দেওয়ালের চেক পয়েন্টের পুলিশ থেকে শুরু করে, ইস্টার্ন ব্লকের অধ্যাপক, রাজনীতিক সবাই এই মিউজিয়ামের তথ্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। কখনও এই তথ্য আদানপ্রদানে নিমন্ত্রণ জানানো হয় আপামর উৎসুকদের। যেদিন আজেরবাইজানের রাষ্ট্রদূত এলিন সুলেইমানভ এসেছিলেন, আবার সেদিন আমরা ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে  গিয়েছিলাম তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনতে। যথারীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র ও অধ্যাপকরাও ছিলেন সেখানে। ছিলেন মিউজিয়ামের সাথে যুক্ত নানা মানুষ। আর কৌতুহলীরা।
        একটা ইউটিউব ছবির মাধ্যমে আজেরবাইজানের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তাঁর দেশ কেমন ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সোভিয়েত সেনার হাতে বাকুতে ২০শে জানুয়ারির গণহত্যার কথা যাতে মারা পড়েছিলেন অসামরিক সাধরণ জনতা। যা কিছু তিনি দেখিয়েছিলেন তার মধ্যে সব চেয়ে মজার ছিল পারহ্যাপ্স ব্যাগ। পুরুষ মানুষেরা দিনের বেলা কাজে বেরোনোর সময় সেই ব্যগ সঙ্গে নিয়ে যেতেন, ফেরার পথে দুটো কলা বা একটা আপেল পাওয়া গেলে নিয়ে ঘরে ফিরবেন বলে। কালচে লাল হালকা লাল  উলে বোনা ব্যাগগুলো এমনিতে ধরে যেত মুঠোর মধ্যে বা পকেটে। কিন্তু কলা-আপেলের মাপে বেড়েও যেতো সাইজে। এরকম ব্যাগ কলকাতাতেও দেখেছি বহুবার। 


***** জমা দেওয়ার দু'বছর পর যা ছাপা হয়েছে

##### মূল অ্যালবাম
###### পরের অ্যালবাম

এই গোত্রের অন্য লেখাঃ
বুনো পশ্চিমী মরুপথে এক রাত

স্যান অ্যান্টোনিও – তখন আর এখনের এক অনাস্বাদিতপূর্ব ককটেল

Readers Loved