পুব-পশ্চিম বোঝা যায় না। ধু ধু
দিগন্ত আর দিগন্ত। ছেয়ে থাকে শুধু শূণ্যময় ভাসতে থাকা ধূলো। হঠাৎ কোন একদিক থেকে
হু হু করে ধেয়ে এল হাওয়া। ধূলোর কণাগুলো আরও চঞ্চল, আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল; তাদের
নিজেদের মধ্যে লাগল বোধ হয় বেদম ঠোকাঠুকি; কে যে কোথায় কার সাথে জুড়ে গেল, কোনটা
যে কীভাবে ঠিকরে গেল……।
* * * * * * *
কল্পনা মাঠ থেকে
ঘরে ফিরে আজও দেখল শাশুড়ি হেঁসেলে বসে কাঁদছে। হাতের দাটা ছুঁড়ে উঠোনে ফেলে দিল।
কোনো সাড়াই দিল না
শাশুড়ির কান্নার জবাবে। মেয়েদের গায়েও হাত তুলল না রাগ মেটাতে। রোয়াকের কড়ি থেকে
শুকনো কাপড়টা নিয়ে চলে গেল নাইতে।
রাতে মথুরা ঘন হয়ে
এলে কল্পনার মেজাজে চড়ে বসে দাটা। ধড়মড় করে উঠে বসে ঘোষণা করে কালই জমির বাঁটোয়ারা
না হলে তিন ছেলেমেয়েসুদ্ধ সে জলে ডুবে মরবে।
পরের কোজাগরী
পূর্ণিমায়, হারু মাঝির থেকে সদ্য কেনা নৌকায় সংসার পেতে কল্পনা ভেসে পড়ল নতুন
দেশের সন্ধানে। সঙ্গে তিন ছেলেমেয়ে, স্বামী মথুরা, দেওর দেবকী; মথুরার ভাগের দশ
বিঘা জমি বেচে পাওয়া ষাট হাজার টাকা, আর পথ চেনাবার পরিতোষ মিস্ত্রি। চাঁদের আলোয়
ঝিকমিকিয়ে উঠছে কল্পনার হাসি।
দ্বিতীয়রাতে খাঁড়ি
ছেড়ে মোহনায় পৌঁছোল নৌকা। ডাইনে বাঁক নিয়ে নৌকা চলল বীনার ছায়ায় মিশে মিশে।
কালাচের ভয়ে শিউরে ওঠা কল্পনা ডাকতে লাগল মনসা আর বনবিবিকে। মথুরা দু দিন দু রাত
দাঁড় বাওয়ার ক্লান্তিতে প্রায় চুপচাপ যদিও, তবুও মাঝে মাঝে ঠাট্টা করতে ছাড়ল না, “যদি দক্ষিণারায়েও ডাকতি তাইলে ডাঙার
বাঘের থিক্যাও রক্ষা পাওয়া যাইত; তবে এ্যা দ্যাশে মগর থিক্যা বাঁইচবার উপায় নাই কো
কিসুই।”
ভোররাতে নৌকা আবার খাঁড়িতে ঢুকল এবং প্রথমবার নোঙর করা
হল। রোদ চড়ে যখন দূরের সমুদ্র ঝাপসা হয়ে গেল তখন গোলাম আলি এসে উপস্থিত হল। বাটা
দেওয়া নেওয়া সারা হয়ে গেলে পরিতোষ গোলামের আনা নৌকাটা নিয়ে চলে গেল কল্পনার বাপের
দেশের দিকে; সেখান থেকেই কল্পনার যাত্রা শুরু হয়েছিল। কল্পনাদের নৌকার হাল ধরলে
গোলাম আলি। নৌকা গভীর রাতে পৌঁছে গেল ঝড়খালির ঘাটে।
রাত পোয়ালে গোলাম
আসল কথাটা পাড়ল। শুরু করল এই বলে যে সে এবার ছুটি নেবে; তার মজুরী বাবদ এখনই তাকে
তিনহাজার টাকা দিতে হবে, মাথাপিছু এক হাজার করে ধরে, কুচোগুলো বাদ। টাকাটা দিলে
তবেই সে কল্পনাদের পুরো দলটাকে পঞ্চায়েতের হাতে তুলে দেবে।
কল্পনা পড়ল মহা ফাঁপড়ে। পরিতোষ তো
তাদের একথাটা বলে নি। অনেক আশায় ছেলে মানুষ করার জন্য সে এসেছে সর্বস্ব বাজি ধরে।
সব বুঝি গেল ভেস্তে। মথুরাকে ছইয়ের নীচে ডেকে কল্পনা বলল, “অনাকে বুঝাইয়া কও; জ়মি কিনতি পারবা
না অনারে অ্যাখন কিসু দিলে। আমাগো ইহানে রওনের কি হইব অনার লগেই জ়িগাও...”।
গোলামের সাথে কথা বলে মথুরা ঠিক করল
যে কুচোগুলোকে গোলামের বিবির কাছে রেখে তিনজনে গোলামের সাথে যাবে পঞ্চায়েতের কাছে।
পঞ্চায়েত রবি মণ্ডল বিবেচক লোক। কিছু একটা উপায় যা হোক ঠাওরাবেন। রওনা হওয়ার আগেই
কল্পনা দেবকীকে শুনিয়ে রাখল, “দেবু ভাই, জ়মি ইহানে আর জ়ড়্যাইব না ভাবসি। আমরা দশ
বিঘা নিতাসি; তুমি আলদা জ়মিন লও। হিসেব সবই আল্দা আল্দা কইর্যো।”
বেলা বাড়তে কল্পনারা হাজির হল
পঞ্চায়েতের গদিতে। সেখানে অনেক লোকের ভিড়। অনেক শলা চলছে। কল্পনাদের পালা আসতে
পঞ্চায়েত রবিবাবু সব শুনে বললেন, “জমি নিতি চাও বাদাবনের দিকে দু ভাইকে
দশ দশ কুড়ি বিঘা জমি দেওয়া যাবে। এখন আমার থিক্যা নিয়া গোলামের পাওনা মিটায়ে
দ্যাও। জমির টাকাটা অ্যাখন দে দাও। কাগজটা আমার কাছে থাকবে; গোলামের বাবদে ধার
শুধে জমির কাগজ নিয়্যা যেও। তবে জমির কাগজটা ভোটার কার্ড বানাতে লাগবে; তা না হয়
ভোটার কার্ড বানায়েই জমির কাগজ দেব। আর ভোটার কার্ড বাবদ মাথাপিছু হাজার টাকা দে কার্ড ছাড়াইয়্যা নে যাবে”।
পঞ্চায়েতের বিবেচনায় মুগ্ধ
কল্পনা-মথুরা-দেবকী গদগদ হয়ে সব শর্ত মেনে নিল। দেবকীর জমি বাবদ টাকার বাটাও তিনিই
ব্যবস্থা করে দিলেন। দু ভাইয়ের আলাদা আলাদা খাতার ব্যবস্থাও তিনিই করলেন। গোলামের
সাথে কল্পনাদের তিনজনকে পাঠিয়ে দিলেন বাদাবনের দিকে জমিটা দেখে নিতে, যাতে পয়সার
লেনদেন করে কাগজ বানানোর আগেই ওরা বেছে নিতে পারে মনমত দাগগুলো।
কল্পনারা যে বনের পাশে ক ছটাক ঘাসজমি
দেখল তার মাপ মোটেই বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু শিকড় গাড়ার অমোঘ আকর্ষণে চোখের
সামনের জমি মাত্রই নিতে রাজি হয়ে গেল। জমিটা জঙ্গল কেটে বাগাতে যে হবে সেটা বুঝল;
কিন্তু জমির বুক চিড়ে নদীর থেকে আসা নালাটা বেয়ে জমিতে ঢোকা জোয়ারের জল, বেনোজলে
যে মাটি নোনতা করে দেবে, অনেক খরচ করে বাঁধ না দিলে ধান কোন দিন হবেই না – এসব তারা বুঝতেই পারল না ডাঙা দেশের
লোক বলে। উল্টে কল্পনা খুব খুশি হল যে দু ভাইয়ের জমির সীমা চিড়ে বয়ে চলা খালটার
জন্যই কোন দিন জমির সীমা নিয়ে বিবাদ হবে না; মথুরা খুশি হল নালার জলে সহজে সেচ করা
যাবে দেখে, ফসল অনাবৃষ্টিতে মরবে না আশা করে। দেবকী ভাবছিল এবার বিয়ে করবে একটা;
দশ বিঘা জমি তার একার; কেউ নেই মাথা গলাবার !
পঞ্চায়েতের গদিতে ফিরে গিয়ে দেখা গেল
যে তিনি আপিসে গেছেন। কল্পনারা গোলামের সাথে আপিসে গিয়ে জানাল যে জমি তাদের পছন্দ
হয়েছে। সেখান থেকে বেরোবার আগে রবিবাবু বারবার করে বুঝিয়ে দিলেন জমি বাগাবার সময়
কোনো লোক সাকিন বা
ভোটার কার্ডের কথা জানতে চাইলে কি বলতে হবে; জঙ্গল কাটতে মানা করলে কী করতে হবে
এইসব। সবশেষে আশ্বাস দিলেন বিপদ মনে হলেই তাঁর কাছে চলে আসতে; খুব ঝামেলা হলে তিনি
সব সামলে দেবেন, না হলে তিনি পঞ্চায়েত কিসের।
দুপুরের খাওয়া গোলামের ঘরেই সেরে নিল
কল্পনারা। তারপর ফিরে এল তাদের নৌকায়; যদ্দিন না জমির কাগজ হচ্ছে তদ্দিন থাকতে হবে
নৌকাতেই। কুচোগুলো ছইয়ের ভেতর গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে; দু রাতের নৌকা বাওয়ার
ক্লান্তিতে ঘুমোচ্ছে মথুরা-দেবকী দু ভাইও, পড়ন্ত রোদে শুয়েই, মড়ার মত। হালের কাছে
বসে কল্পনা আকাশ-পাতাল ভাবছিল। বেলা আর একটু পড়ে আসতে দু-চারটে করে নৌকা ভিড়তে
লাগল ঘাটে। এর মধ্যে একটা নৌকা নোঙর করল কল্পনাদের নৌকার গা ঘেঁসে।
নৌকা থেকে কল্পনারই বয়সই একটা মেয়ে
হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলল, “দিদির বুঝি আজই আসা হল?” সংক্ষেপে ঘাড় নাড়ল কল্পনা। মেয়েটা
আবার বলল, “আমি জবা। আমাদের ছ মাস হল।”
লজ্জা ভেঙে কল্পনা বলে ফেলল, “জবাদি এহানে কোনো জানা শুনা নাই। আমার নৌকায় কাল
অব্দি খোরাকি আছে; তারপর ব্যবস্থা করতেই হবে; ইদিকে হাতের টাকাও”-
জবা মাঝপথেই জবাব দেয়, “পঞ্চায়েতের বউ বন্ধকী কারবার করে;
কানের দুল দুটো তোমার বোধ হয় রূপোর; হয়ে যাবে হপ্তা খানেকের যোগাড়।”
কল্পনা ককিয়ে উঠল প্রায়, “একটা কাজেরও যোগাড় চাই আমার; মরদ
দুটা ত জমি বাগাতে লাগবে। আমাদের খোরাকির জন্য আমাকেই যেতে হবে কাজে…………। দিদি গো! একটা পথ তুমি ঠিকই
জাইনবা!”
* * * * * * *
দরজায় টোকা পড়ছে। ঘুম ঘুম আবেশটা
কেটে গেল রমিতার। অভ্যেস মত সাড়া দিয়েই দেখে নিল কটা বাজে। চেক-ইন আর কেবিন লাগেজ
নেড়ে চেড়ে নিয়ে, হাত ব্যাগ হাতড়ে টিকিটটা দেখে নিয়ে রমিতা ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
ল্যাণ্ডলেডি দাঁড়িয়ে আছেন ডাইনিং-এ। খেতে বসতে বসতে রমিলা চেকটা দিয়ে দিল ওঁর
হাতে। ঝলমলিয়ে উঠে উনি একটা ফেয়ারওয়েল স্পীচও দিয়ে দিলেন।
দু-প্রস্থ লাগেজ
নিয়ে পিজি থেকে বেরিয়ে এসে রমিতার মনে পড়ল ট্যাক্সি ডাকা হয় নি। ফিরে গেল আবার
গলির মধ্যে। সামনের বাড়িটায় কেউ থাকে না অনেক দিন। বাড়িটার সামনে কোন
ল্যাম্পপোস্টও নেই। বাড়িটাকে ঘিরে জমে ওঠা অন্ধকারে ঢুকে পড়ল রমিতা। চটপট চারপাশে
কেউ দেখার সম্ভাবনা আছে কি না দেখে নিয়ে লাগেজ দুটোকে একে একে মাথার ওপর তুলে পার
করে দিল বাড়িটার পাঁচিলের ভেতর। তারপর চলল অটো স্ট্যান্ডে।
মিনিট পনের লাগল
ট্যাক্সি নিয়ে ফিরতে। ভীষণ টেনশন নিয়ে ট্যাক্সিটা আলোর শেষ প্রান্তে রেখে এসে
রমিতা আবার ঢুকে পড়ল একলা বাড়ির অন্ধকারে। ঠিকঠাক মনে করতে পারল না কোথায় রেখেছে
লাগেজ দুটো। অগত্যা টপকে নিল পাঁচিলটা। তারপর পাঁচিলের একমাথা থেকে আরেক মাথায়
হাতড়ে হাতড়ে পেয়ে গেল লাগেজ দুটো। আবার সেগুলোকে একে একে এবং নিজেকে পগার পার করে
ফিরে গেল ট্যাক্সির কাছে।
সারা রাস্তা যেতে
যেতে রমিতার কেবলই মনে হচ্ছিল রাত দুটোর ফ্লাইট; অফিস পিক আপ দিতে পারত। না দেওয়ায়
পাওয়া থ্রিলটা সাংঘাতিক; কিন্তু এতটারও দরকার ছিল না। এবং ভাবতে ভাবতে কোম্পানীর
বিরুদ্ধে মনে মনে অভিযোগের পাহাড় জমিয়ে তুলল। অথচ, চাকরি-বাকরি করতে হলে এ সব
ঝামেলা পোয়াতেই হবে বোধটাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে সয়ে নিল।
এয়ারপোর্ট পৌঁছে
রমিতা লাগেজদুটো নিয়েই গেল ফোন বুথে। ফোনটা রমিতার মা-ই ধরলেন। অনেক আতঙ্কের মধ্যে
মুখ্য ছিল পড়শী টুকলুর মায়ের ভবিষ্যত বাণী। কয়েকবার এড়িয়ে গেলেও শেষ অবধি রমিতা
বলতে বাধ্য হল, “হ্যাঁ, মা, ডিগ্রী পাওয়ার পর টুকলু আর তোমার মেয়ে রু সমান সমান।
ফার্স্ট-সেকেণ্ড পজিশনগুলো কিংবা পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর ইস্কুল কলেজ টপকাবার পর গৌণ
হয়ে যায়। আর চাকরি পাওয়া না-পাওয়াটা অনেক বেশী বাজার নির্ভর। বাজার ভালো থাকলে
ক্লাসের শেষতম ছাত্রেরও চাকরী জুটে যায়। সুতরাং আমি টুকলুর সাথে কম্পিট করতে গেলে
চারপাশের কম্পিটিশন থেকে পিছিয়ে পড়ব। সুতরাং টুকলুর মায়ের সাথে আর কোন তর্ক নয়
ক্যারিয়ার নিয়ে, বুঝলে?”
ফোঁস করে মায়ের দীর্ঘশ্বাস পড়তে শোনা গেল, “তা হলে মেধার আর কী মূল্য রইল বল; যে
মাথার জোরে পড়ল আর যে বাবার পয়সার জোরে দুজনেরই মান সমান হয়ে যাবে?”
রমিতা হাসি চেপে, ছদ্ম গাম্ভীর্যে বলে, “তুমি আমাকে টুকলুর সাথেও তুলনা করবে?
তোমার চোখে আমিই বেস্ট বাচ্ছা যেমন তেমনি টুকলুও তার মায়ের কাছে; ভদ্রমহিলা তোমার
ওপর না হয় খানিক চালই নিয়েছেন তাই বলে দুনিয়ার হাজার কিসিমের মাপের সামনে আমি আর
টুকলু ছোট বা বড় হয়ে যাই কি? তুমি যার সাথেই তুলনা করবে দেখবে আই’ম দ্য বেস্ট; প্রতিপক্ষ টুকলু,
ইন্দিরা গান্ধী বা আইনস্টাইন যেই হোন না কেন। কিন্তু সত্যি কি মাপা যাবে আমাকে বা
অন্য কাউকে? টুকলুর সাথে তুলনা করে আজ দুঃখ পাচ্ছো। কাল দেখবে জনার্দনের মত ক
অক্ষর গোমাংসও আমার আপিসে কাজ করে। এত অহংকার কোর না।”
মা বললেন, “তা তো বুঝলাম যে আমার মন ছোট, আমি অহঙ্কারী। কিন্তু
টুকলুর মা যে বলল প্রাইভেট চাকরির কোন ভবিষ্যত নেই; বিদেশে যদি তোর চাকরী চলে যায়?”
রমিতা একটু জোরে শব্দ করেই হেসে ফেলল; চারপাশের কেউ কেউ ঘুরেও
তাকাল তার দিকে; দেখে মাউথপিস আর ঠোঁট যথা সম্ভব হাত দিয়ে ঢেকে নিয়ে বলল, “কাম’ন মা, বিদেশে চাকরী গেলে কোম্পানি
দায়িত্ব নিয়ে আমাকে দেশে ফিরিয়ে খাতা থেকে নাম কেটে পাওনা-গণ্ডা বুঝিয়ে মুক্ত হবে;
বিদেশে বেকার হয়ে মোটেও ভিক্ষে, চুরি কিংবা বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য হব না।” বাতুলতার সভ্যসীমা অতিক্রম করায় মা
প্রবল বকা-ঝকা শুরু করলেন। সেই গজগজানির মধ্যেই রমিতা প্রগলভতার জন্য মাফ চেয়ে
নিয়ে বলতে থাকে, “তোমার ভালো মেয়ে ভাও মেয়েতাই থাকবে গো! কাজের কথা শোন ওখান থেকে রোজ ফোন করতে
পারব না; দেখ বাড়ির কাছাকাছি কোন সাইবার কাফে আছে কি না; ছুটির দিনে ভিডিও চ্যাট
করতে পারি। তোমার থেকে আমি তের ঘন্টা পিছিয়ে চলব। না হলে বাবাকে বোলো রোজ অফিস থেকে ই-মেল চেক করে নিতে;
আমার জরুরী কিছু বলার থাকলে তোমাদের, তোমরা জেনে যাবে। না হলে ভাইকে রোজ ফোন কোরো। ওর সাথে আমার রোজ যোগাযোগ থাকবে
আশা করছি।” ………………… ফোনের অন্যপারের আভাস মেলে, রমিতাই
বলতে থাকে, “মা, তুমি কাঁদছ? কেন?” ফোঁপাতে ফোঁপাতে মা জবাব দেন, “কত দূরে চলে যাচ্ছিস! কবে আবার দেখা
হবে তোর সাথে কে জানে; বলিস নি তো রোজ ফোনও করা যাবে না!”……………………জবাব দেয় রমিতা, “জানলে যদি যেতে না দিতে চাও? তাই
বলিনি; এটাই তো চেয়েছিলে যেন তোমার মত বন্দীত্বের জীবন না হয় আমার; যেন রোজগেরে
হই। হয়েছি। হ্যাঁ তুমি ভেবেছিলে নিদেন পক্ষে সরকারী আপিসের স্টেনো টাইপিস্ট যেন
হই। তার বদলে অন্য কিছু হয়েছি। ভাল না মন্দ হয়েছি সে তর্কে যাচ্ছি না; কিন্তু
রোজগার করছি, নিজের খেয়ালে ভাসতেও পারছি; তোমার বাঁচার শর্তের থেকে আমার বাঁচার
শর্তগুলো আলাদা। ঘরে-বাইরের রোজকার লড়াইটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়ত কঠিনতর হয়ে
উঠবে ক্রমশ, কিন্তু আমি তো আমার মেয়ের চোখে তার বাবাকে শত্রুশিবিরের লোক ভাবতে
শেখাব না। ফ্যামিলি হলে মোর ব্যালান্সড হবে। শেষ কথা গুলোয় আবার আমাকে শত্রু বানিও
না। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো। আমি সিকিউরিটি চেক সেরে একটা বই পড়ব। ফ্লাইট রাত
দুটোয়; আমি এরপর আর যোগাযোগ করতে পারব না। আর স্যান ফ্র্যান্সিস্কো পৌঁছে সময় মত
ফোন করব। আজ থেকে ঠিক চার দিন পর সকাল বেলায়। ঠিক আছে ?”
ধরা গলায় মা বললেন “সাবধানে যাস, দুগ্গা, দুগ্গা”।
পাশের সিটের
ছেলেটা বলল, “আপনি বাঙালী?” হাতে ধরা কালকূটের শাম্ব, রমিতা অস্বীকার করার কোন রাস্তাই খুঁজে পেল না।
তারপর নাম কি, কোথায় বাড়ি ক’ ভাইবোন, কোন কোম্পানি, ক্লায়েন্ট কে, ফ্লাইং-এর কারণ
ওয়াই-টু-কে কি না, প্রথমবার ফ্লাইং কি না - ঝালাপালা অবস্থা হল রমিতার; মনে মনে
নিজেকে গাল পাড়তে লাগল, “ট্র্যাভেল টাইমে কালকূট না পড়লেই চলছিল না? বুদ্ধুরাম! এখন ঠেলা সামলাও।”
ছেলেটির নাম সৌরভ। আর্মহার্স্ট
স্ট্রীট সিটিতে কমার্স করেছে; তারপর চাকরির ফিকিরে সি এম সি থেকে পি জি ডি সি এ।
তারপর বছর তিনেক ধানবাদ, রাঁচি, সেকেন্দ্রাবাদ করে এখন স্যান ফ্র্যান্সিস্কো
যাচ্ছে। টিকিট দিয়েছে ওয়াই টু কে।
একফাঁকে বইটা বদলে
নিল রমিতা। তারপর সুযোগ বুঝে সৌরভকে শুনিয়ে দিল, “দেখেছেন, গাইডবুকে লিখেছে উড়ানের সময়
ঘুমোন ভাল?” সৌরভ শাম্বটা রমিতাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে, গাইডটা নিল; জবাবে জিজ্ঞেস করল, “বললেন না তো, কোথা থেকে বি ই করেছেন?” রমিতা বলল, “বলিনি বুঝি? এই অল্প সময়ে এত কথা
বলেছি……; শিবপুর বি ই থেকে কম্পিউটার
সায়েন্স পড়েছি।” আরও একটু জল খেয়ে রমিতা হাই-টাই তুলে, আড়ামোড়া ভেঙে ঘুমিয়ে পড়ল।
ফ্র্যাঙ্কফুর্ট
থেকে স্যান ফ্র্যান্সিস্কো অবধি পথে মেম বুড়ির পাশে বসে দিনের বেলার রোদ ঝলমল আকাশ
দেখে কাটিয়ে দিল রমিতা। প্রথমত, মেম দিম্মা খিটখিটে নন মোটেই; কালো চামড়া
যুবতীটিকে তিনি কোনো বিরক্তি কিংবা কৌতুহল উপহার দেন নি। রমিতার কেবলই আনন্দ হতে
লাগল ছোটোবেলায় নতুন খেলনা পাওয়ার মত; আবার থেকেই থেকেই মনে হচ্ছে , “কত বড় হয়ে গেলাম! দুবছর আগেও মনে হয়
নি মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে আমি আট হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছি একদম একা একা! কিন্তু তবু
মেঘের মধ্যে ভাসছি বুঝতে পারলেই ছোট্টোবেলার থ্রিল!”
স্যান
ফ্র্যান্সিস্কো থেকে মন্টেরি পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। হোটেলে চেক ইন করে বাড়িতে ফোন
করল রমিতা। শুধু বহাল তবিয়তে পৌঁছনোর খবর দিতেই তিরিশ ডলার গলে গেল। সুতরাং
দুধ-পাঁউরুটির ডিনার সেরে ঘুমোতে যেতে হল রমিতাকে।
পরদিন থেকে শুরু
হয়ে গেল নতুন জীবন, নতুন যুদ্ধ ; বসতি বিস্তারের ব্যস্ততা আর অফিসে ক্ষমতা
প্রমাণের আপ্রান চেষ্টা। দিন গুলো কেটে যেতে লাগল হৈ হৈ করে।
* * * * * * *
দিশার কাছে স্পষ্ট
হয়ে গেছে যে সে আর অ্যাস্ট্রনমার হচ্ছে না। স্বপ্ন ভাঙার দুঃখ উদযাপণেরও কোনো
সুযোগ নেই। রোজগার তো করতেই হবে; তাই কাল থেকে সে চাকরি জোটাবার জন্য উঠে পড়ে
লাগবে বলে ঠিক করেছে।
আজ নয়; কারণ আজ প্রিয় বন্ধুদের সাথে
দেখা করার শেষ দিন। তাই উতলা মনে প্রমোদদার ক্যান্টিনে বসে মেয়েটা টিং টিং পা
নাচাচ্ছে; উত্তেজনায় না বিরক্তিতে বোঝার কোনই উপায় নেই; হাতে ধরা বইটা থেকে চোখ
তুলছে না একবারও।
মায়াঙ্ক আর
মিলিন্দ এসে বসল ওর টেবিলে; বেশ তর্ক চলছিল দুজনের। দিশা মুখ তুলে তাকালও না
একবারও। মায়াঙ্ক তর্ক ছেড়ে কেড়ে নিল দিশার বইটা। মিলিন্দ বলল, “চল ডিপ্ থেকে ঘুরে আসি। তারপর কোথাও
বসব।”
ঝাঁই ঝাঁই করে উঠল দিশা, “আমাকে আসতে বলে এক ঘন্টা বসিয়ে রাখার
ফাইন দে; তবে যাব।”
স্বভাবসিদ্ধ মিনমিনে স্বরে মিলিন্দ বলল, “আজও ফাইন নিবি ? তুই একটা বাজে মেয়ে!”
এই সময় মায়াঙ্ক এক টুকরো কাগজ দিল দিশার হাতে; দিশা রাগ রাগ
মুখে দেখল কাগজটায় লেখা আছে “ফাইন।” তারপর দিশার ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে বলল,
“ পা দুটো
ব্যবহার করবি ? না কি -?”
“আর বকিস নি; তোর একমাত্র প্রেমিকার
কানে গেলে আমাকে শূলে দেবে”। বলে খ্যাক খ্যাক হাসতে লাগল দিশা। এবং মিলিন্দ একটা পয়েন্ট পেয়ে বলল, “ওর প্রেমিকা তোকে শূলে দেবে কেন? ওকে
দিয়ে ব্যাগ বওয়ালি বলে?”
“না তো; ওর প্রেমিকা শূলে দেবে একটা
বাজে ছেলের সাথে প্রেম করার জন্য আমি ভদ্রমহিলাকে বার খাইয়ে টং করেছিলাম বলে।”
“ও আমি কিছুই করিনি, সব ক্রেডিট
তোমাদের, না! কিন্তু দিশা, তুই আমাকে বাজে ছেলে বললি কেন?”
এই সব কূট তর্কে
তর্কে কেটে গেল দিনটা। সূর্যাস্তের আলো মেখে তিন তরুণে এগোচ্ছিল শহীদ মিনার থেকে
চাঁদপাল ঘাটের দিকে; মায়াঙ্ক বলল, “তুই তা হলে, পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াই ঠিক
করলি?”
দিশা বলল, “রাতভোর পড়ার পরে যদি দেখি রেজাল্টে পারফরমেন্সের
রিফ্লেকশন আনার জন্য নতুন পরতে শেখা মিনিস্কার্ট কিংবা ট্যাবিউলেটারের দয়াই ভর্সা,
তখন রেজাল্ট ভালো রাখার পড়াশোনা করতে আর সাহস হচ্ছে না। এই নিয়ে কতবার বললাম তোকে?” মিলিন্দ জবাব দেয়, “চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার
মানে আছে? তোকে এখানেই যে পড়তে হবে তাও না; পুনে-তে যাওয়া হলো না, অন্য কোথাও
যেতিস; তুই অ্যাডমিশন টেস্টগুলোই দিলি না। চাকরি খুঁজবি ভাল কথা; কিন্তু এত
পেসিমিস্টিক অ্যাপ্রোচে হবে না; এলিজিবিলিটি শোকেস করতে গেলে পজিটিভ
অ্যাটিচ্যুডটাও লাগবে।”
“এবার আমি ভোট অফ থ্যাঙ্কস্ দিচ্ছি
আমাদের বড়দা মিলিন্দ মহারাজকে।” দিশা বলা মাত্রই তিন জনে হেসে ফেলল। তারপর দিশাই বলল,
“আমি প্রেসির
আই এ এস ট্রেনিং সেন্টারে গিয়েছিলাম। খরচের বহরে সাহসে কুলোল না। শুরুও হয় সন্ধে
সাতটার পর। রাতে কলকাতায় থাকার জায়গা বাগাতে হবে। বাড়িতে সাপোর্ট চাওয়ার সাহস নেই;
ইচ্ছেও নেই; আবার শর্ত পালন না করতে পারলে টেকা দায় হবে। অতএব বন্ধু আমার রেস্ত
পাঁচটা টিউশন রেখে আমাকে ময়দানে নামতে হবে”। জবাব দিল মায়াঙ্ক, “তুই অপদার্থ! তোর মিনিস্কার্ট আর
ট্যাবিউলেটারের ল্যাং খাওয়াই উচিৎ।”
“তুইও অপদার্থ; কেরিয়ারিস্ট! মনে করে
দেখ তিন দশক আগে এই রাস্তায় তোর বাবা ভিয়েতনামের পক্ষে কিসিংগারকে গালি দিতে দিতে
হেঁটেছিলেন আর মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদের গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো করেছিলেন; আর তুই তাঁর
ছেলে হয়ে কেবল ফার্স্ট হওয়ার খোয়াব দেখিস!”
মায়াঙ্ক প্রতিশোধে পেছপা নয়; জবাবে বলল, “সে তো তোর বাবাও হেঁটে ছিল; কিন্তু
আপিসের পর নিজের দুপায়ে; আর তোর ছেলে যে তোর পয়সায় ইন্টারনেট ফোরামে ফোরামে
ব্লগিয়ে পৃথিবীতে যুদ্ধ বন্ধের শ্লোগান তুলবে তখন কি তুই নিজের দোষ দেখবি? বলবি
তোর ছেলেও অপদার্থ।”
এলোমেলো আলোচনাতেই
তিন বন্ধু ভেসে গেল।
পরদিন থেকে নতুন
পরিবেশ। কম্পিউটার ক্লাসের ষোলটা মেয়ের সামনে কৌশিক নামে একটা লোক হাত-পা নেড়ে
সমান তালে চল্লিশ শতাংশ পড়াচ্ছে আর ষাট শতাংশ ফ্লার্ট করছে। দিশা সব দেখে শুনে
আধঘন্টা পর থেকে আর চাপতে পারল না হাসিটা; চশমা পর্যন্ত রুমাল ঢাকা দিয়ে হাসতে
লাগল। কৌশিক দেখে খুশি যে হয় নি তাও বোঝা গেল। এবং প্র্যাকটিক্যাল সেশনে পড়া
বোঝাবার অজুহাতে মাউসের ওপর রাখা দিশার হাতটাকে দিল ভীষণ মুচড়ে, ঘাড়ের ওপর দিল
দীর্ঘ নিশ্বাসের জ্বালা, মুভেবল চেয়ারটা কিছুতেই দিশা নাড়াতে পারল না; ওটার
ব্যাকরেস্টটা কৌশিক ধরে রেখেছিল শক্ত হাতে।
তারপর থেকে মাথা
ঝিম-ঝিম, গা-গোলানো যখন তখন নাস্তা-নাবুদ করে ফেলত দিশাকে; অস্বস্তির আবির্ভাবটা
দিশার নিয়ন্ত্রণে ছিল না; বই-খাতা বাইসাইকেল কখন কোনটা ছুঁলে গা গুলিয়ে উঠবে
বেচারি বুঝত না।
মাস ছয়েক পরে ক্লাসের চেহারা ছোটো
হতে হতে অর্দ্ধেক যখন, তখন সুস্মিতার সাথে দিশার বন্ধুত্ব প্রায় পূর্ণ; একটা
অপ্রত্যাশিত ক্লাস ছুটি হয়ে যাওয়া দুপুরে দুই বন্ধু আলোচনা করছিল কেন কৌশিক দিশার
ওপর খাপ্পা, কেন কৌশিক জোর দেখিয়ে হেনস্থা করতে আসে দিশাকে বারবার। এলোমেলো অনেক
কথার পর দিশা বলে ফেলল সব কথা সুস্মিতাকে। মেয়েটা রেগে গেল; কিন্তু পরদিন থেকে
নিজেই দিশার ঢাল হয়ে দাঁড়াল।
এবং দিশা সাহসে দুর্নিবার হয়ে
কৌশিকের হাতে তার যৌন হেনস্থা হওয়ার কথা জানিয়ে কৌশিকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ
জানাল কর্তৃপক্ষের কাছে । এরপর প্রিপেইড কোর্সের দিনগুলো আরও দুরূহ হয়ে উঠল;
কিন্তু শারিরীক ভাবে ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে পড়তেও দিশার সাহস বেড়ে চলল অগাধ।
মনপ্রাণ জুড়ে টের পেতে লাগল বেদনাতে জেগে ওঠা চেতনা।
এর মধ্যে শনি-রবির ছুটিতে দিশা শিখতে
শুরু করেছে ফরাসি। ওখানেই আলাপ হল আকাশের সাথে। তখন আবার দুজনেই চাকরি খুঁজছে। তাই
বন্ধু হতে বেশী সময় লাগে নি। তারপর সুদীর্ঘ দূরভাষালাপে ভাসতে ভাসতে দুটি প্রাণী
ভয়ানকভাবে সামিল হয়ে গেল পরস্পরের দুঃখে, সুখে। তারপর ক্রমশ দাবী জন্মাল একের ওপর
অন্যের; এসে গেল চাওয়া-না-পাওয়ার খেলা; অভিযোগ অভিঘাতের দিন।
দিশার বাড়িতে যেসব দিন কোন সুপাত্রের
সন্ধান আসে তারপর সাতদিন বাড়িতে সবার সাথে দিশার কথা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা অবধারিত।
অথচ আকাশের সাথে এমন কোনো কথা হয় নি যে দিশা একটা প্রতিবন্ধক দেখাতে পারে
বাবা-মাকে। এরকমই একটা দ্বন্দ জর্জরিত সন্ধেবেলা দিশা আকাশের কাছে বাড়িতে
সুপাত্রজনিত ঝামেলার কথা বলে ফেলল; এবং আকাশের জবাবে ভীষন হতাশ হল; কেবলই ভাবে “কী করে বলল বিয়ে করে ফেলতে অন্য
লোককে? গত এক বছরে যতটা সময় আমরা একে অপরকে দিয়েছি সেটা কি শুধুই পরীক্ষার
প্রিপেরেশনের জন্য; আর কোন আবেগ অনুভূতি ছিল না?”
প্রশ্ন শুনে সুস্মিতা বলল, “ওরে আমার বস্তা-পচা আবেগের সোনা,
জীবনের সার হল ব্যবহার করা, নিজেকে এবং অন্যকেও। নিজেকে ব্যবহার করার নাম ব্যবহৃত
হওয়া বলেই কি এতটা ফিলোসফিক হয়ে যাবি ? দেখ আমাকে, যদি স্ট্রেট না হতাম, তোর মেনি
মুখো আকাশের ঢের আগে আমি তোকে নিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যেতাম।” এবং দুজনে রেল স্টেশনে জুনের শেষ
দুপুরের রোদে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
পরের রোববারে পরীক্ষা শেষে, আকাশ পি
এস সি বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে বলল, “চল, এস্প্ল্যানেড হয়ে যাই, বাড়িতে ফোন করে দে আমার
সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরবি।” আশা নিরাশার
চমকে দিশা বলল, “এস্প্ল্যানেড হয়ে গেলে দেরী কেন হবে? ও তো রাস্তাতেই পড়বে।” আকাশ জানাল “একটা রেস্তরাঁতে বসব, খানিকক্ষণ, তোর
আপত্তি আছে?” ভয় পাওয়া মুখে দিশা ঘোষণা করল, “আমার পকেট ফাঁকা রে আজ।” স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে আকাশ জানাল, “আমি আছি না!” এস্প্ল্যানেডে মেট্রো স্টেশন থেকে
বেরিয়েই আকাশ যাবতীয় হকারকে ডেকে ডেকে জানতে চাইছিল, “মিটিং কি শেষ হয়ে গেছে?” “লোক জন কোন দিক দিয়ে বের হচ্ছে বলুন
তো?” দিশা এত ভোরে
এলাকাটা দিয়ে গেছে যে মিটিং-এর কিছুই টের পায় নি। কিন্তু আকাশের সঙ্গে ঘুরে এত
নতুন কিছু জানতে পেরেছে দিশা যে নতুন ঘটনার আকর্ষণে ও আকাশকে অনুসরণ করতে লাগল।
গান্ধীমূর্তির কাছে এসে দেখল একটি লম্বা কালো বেশ সুন্দর দেখতে মেয়ে অফ হোয়াইট স্লিভলেস
সালোয়ার-কামিজ পরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ জানাল মেয়েটির নাম বন্যা। তিনজনে গিয়ে বসল
মাদ্রাজ ক্যান্টিনে। দিশা বন্যাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কি সক্রিয় রাজনীতি করিস নাকি?” বন্যা বলল, “আমার কাকু অ্যাকটিভ মেম্বার পার্টির;
বাবা-ও পলিটিক্স করেন।” দিশা বলল, “অত দূর থেকে এলি, তুই কি রাতের কোনো
এক্সপ্রেসে ফিরবি?” বন্যার হয়ে আকাশ জবাব দিল, “ও একা ফিরতে পারবে না, আমি ওকে কাল
পৌঁছে দেব।” দিশা বলল, “ও তাহলে তোদের বাড়ি থাকবে আজ রাতে?” হি হি করে হাসতে লাগল বন্যা, আকাশও।
এবার বেশ বোকা লাগছে নিজেকে দিশার। হাসি থামিয়ে আকাশই বলল, “না শরৎ বোস রোডে স্যামিলটন বলে একটা
হোটেল আছে, আমরা আজকে ওখানে থাকব।” দিশা চোখ গোল গোল করে বলল, “ ডেটিং। তবে যে বললি তোরা বিজনেস
পার্টনারস?” বন্যা আকাশের শরীরের আনাচকানাচে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আমার বাড়িতে সবাই জানে; ওর বাড়িতে ও
এখনও জানায় নি; তা ছাড়া জানলে তো বিয়ে অবধি আমাদের যখন-তখন একসাথে থাকার অসুবিধে
হবে। আমি আজ মিটিং-এ এলাম, তারপর বিজনেসের কাজ করলাম, কাল ও আমার সাথে বিষ্ণুপুর
যাবে নতুন অর্ডার দিতে……। এভাবেই
চলছে”। মুচকি
হাসিটা মেয়েটার চোখে চিবুকে ঝলমল করছিল। আকাশ বলল, “ ও বি এ পাশ না করা অবধি বাড়িতে
জানাতে পারব না রে; তা ছাড়া আমি সত্যিই হ্যাণ্ডিক্রাফ্ট এক্সপোর্টের ব্যবসা করি।
ওর সাথে আলাপ যখন তখন কলেজে পড়ি; বিষ্ণুপুর গিয়েছিলাম বেড়াতে; ওর সাথে পেন
ফ্রেণ্ডশিপ ছিল, প্রেমটা মাস চারেকের, হ্যাণ্ডিক্রাফ্ট এক্সপোর্টের কাজটা শুরু
করার পরের; নতুন করে বিষ্ণুপুর যাতায়াতে-।” “আমার পুরোন প্রেমটা রিভাইভড হয়ে যায়”। আকাশকে মাঝ পথে থামিয়ে বলে দেয়
বন্যা। তবে বন্যার মধ্যে ক্রমশঃ আনা কুর্নিকোভাকে এনরিকের অ্যালবামের বাইরেও জেগে উঠতে দেখে উত্থাপামটা
আধখানা রেখেই উঠে পড়ে দিশা; খরচা তো আকাশের এক্সপোর্ট কোম্পানির। তবুও চৌরঙ্গী
স্ট্রীটটা পেরোতে গিয়ে বার তিনেক বাসে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যায় দিশা। একটা মিনি
বাসে চড়ে হাওড়া আসার পথে বাসের শব্দে গলা ছেড়ে গান ধরে দিশা, “আরো আরো প্রভু, আরো আরো”। কেন তা আর বোঝার চেষ্টা করে না।
তারপর পূজোর সময়ে মায়াঙ্ক, মিলিন্দের
সাথে দিশা আলাপ করিয়ে দিল সুস্মিতার। সেদিন খুব জমাটি খাওয়া-দাওয়া হল; মিলিন্দর
থেকে দুবছর আর মায়াঙ্কের থেকে এক বছরের খাওয়া দিশার পাওনা ছিল, দুজনের চাকরি বাবদ;
দিশার চাকরি শুরু হতে মাস দুয়েক বাকী, তাই তিনবন্ধু ওকেও ছাড়ল না। সুস্মিতাও
গুড়্গাঁওতে তখন চাকুরিরতা; সেও তাই নতুন আলাপের উদযাপণে সামিল হল দরাজ মনে।
* * * * * * *
রমিতা ব্যাঙ্গালোর অফিসের লিফটে
মুখোমুখি হয়ে গেল সৌরভের । ছ-সাত বছর পর; ঠিক চিনে উঠতে পারল না দুজনেই। সাধারণ
হাই-হ্যালোর থেকে “কোথায় যেন দেখেছি”-র গবেষণা করতে করতে খুঁজে পাওয়া গেল “ও আপনিও ক্যালিফোর্নিয়ায় ছিলেন, তখন!”
তারপর ফ্লাইটের কথা মনে পড়তে বেশি অপেক্ষা করতে হয় নি। এলিভেটর মাটি ছুঁলে
রমিতা লাউঞ্জে বসে থাকা এক যুবকের দিকে এগিয়ে গেল; আলাপ করিয়ে দিল, “মিট মাই ফিয়ন্সে রামকি।” তারপর রামকির দিকে
ঘুরে বলল, “রামকি, দিস ইস সৌরভ, অ্যান ওল্ড অ্যাকোয়ান্টান্স।” কারুরই তাড়া না থাকায় ওরা গিয়ে বসল
কফি নিয়ে।
কথায় কথায় জানা গেল সৌরভ ২০০১-এই
ফিরে এসেছিল দেশে। ওর এইচ ওয়ান-টা রিনিউয়াল হয় নি। তারপর কয়েক বছর
ধানবাদ-মোরাদাবাদ-কলকাতা করে আজ এসেছিল রমিতাদের ওখানেই ইন্টারভিউ দিতে। তখনই জানা
গেল রমিতাও কোম্পানি ছেড়ে দিল । রামকি যদিও ২০০২ থেকেই আমেরিকান ফার্মে কাজ করছে,
যদিও রমিতা প্রায় দুবছর যাতায়াত করেই চালাল, এবারে ও নিজেও একটা কাজ পেয়েছে রামকির
অফিসের কাছাকাছি এক জায়গায়। এবারে ওরা একটা সংসার পেতে ফেলবে ঠিক করেছে।
* * * * * * *
মিলিন্দর সাথে
দিশার দেখা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। মিলিন্দ খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছে; “বাবার এই অপরেশনের সময়ে সব খরচা তো
কোম্পানীর ইন্সিওরেন্স থেকেই হয়ে গেল; এখন চাকরিটা ছেড়ে ইউ এস গিয়ে রিসার্চ করতে
শুরু করলে-।” বক্তব্য শেষ করল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
দিশা বলল, “বাবার ব্যাপারটা তোর দায়িত্ব আবার
রিসার্চটা তোর অ্যাম্বিশন; দেখ কি ভাবে ব্যালান্স করা যায়। আমার তো রিসার্চ করার
ইচ্ছে নেই; কিন্তু চাকরিতেও এত নিরাপত্তা নেই যে আটকে থাকা যায়; আমি আর তিন বছর
পরে যখন ছাড়ব তখন এত দ্বিধায় বোধ হয় পড়ব না।”
মিলিন্দ কৌতুহলী হয়ে উঠল, “কেন তোদের মেডিক্যাল কভারেজ দেয় না?” এবার দীর্ঘশ্বাস পড়ে দিশার, “মাসে একশ টাকা মেডিক্যাল অ্যালাউন্স,
থ্রু রাঙ্ক অ্যাণ্ড ফাইল; চাকরি যায় না
বলে সিকিওরিটি দেখে সবাই; কিন্তু মেডিকেল এমার্জেন্সীতে নিরাপত্তা নেই।”
প্রসঙ্গ বদলে মিলিন্দ বলে, “ডিভোর্সের পর শুভ্রা বা মায়াঙ্ক কেউ
যোগাযোগ করেছে?” “নাহ্, কি যে হল, মায়াঙ্ক কত ব্যস্ত থাকত যে শুভ্রা অ্যানিভার্সারিতে গিফ্ট
হিসেবে ডিভোর্স দিল! বুঝি না কিছুই……। তুই তো কাছেই থাকতিস, টের পেয়েছিলি কিছু?” জানতে চাইল দিশা।
মিলিন্দ যেটুকু জানত তাই বলল, “দেখা হলেই শুভ্রা গজ গজ করত মায়াঙ্ক
ওকে সময় দিচ্ছে না বলে; সে তো সব মেয়েই বরের নিন্দে করে। এত ভয়ানক রূপ নেবে
অভিযোগগুলো মায়াঙ্কও টের পায় নি।” আবার প্রসঙ্গ বদলাল মিলিন্দই, “তোর আকাশের কী খবর ? তুই কবে সেটল্
করবি ?”
দিশা একটু চোখ গোল গোল করে তাকাল মিলিন্দর দিকে, “সে কী রে তোর মনে আছে? আমি তো নিজেই
সব পাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
মিলিন্দ জিজ্ঞেস করল, “মানে?”
দিশা খুব দায়সারাভাবে জবাব দিল, “বছর খানেক আগে জানিয়েছিল বিয়ে করছে
ক্লাসমেট সম্পূর্ণাকে। আমি বিয়ের পর ফোন করে কন্গ্রাচুলেট করি আর বলে দি ভবিষ্যতে
আমার সাথে সুস্থ বা মাতাল অবস্থায়, সশরীরে বা ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা যেন না করে,
আমি ওকে আর চিনতে চাই না।”
মিলিন্দ অবাক হল, “মেনে নিল?”
দিশা বলল, “হিটলারী খাটিয়েছিলাম; স্টেটমেন্টটা
রেখেই মোবাইলটা স্যুইচড্ অফ করে দিয়েছিলাম।” খানিক হেসে নিয়ে আবার বলল, “আর মনেও পড়ে না; তোর খবর কি? কাউকে
না পেয়ে হ্যাপিলি সিঙ্গল স্টেটাস অব্যাহ ?” মিলিন্দ কোন জবাব দিল না। দিশাই
আবার বলল, “চল, কাল ভোরে আবার আরণ্যক ধরতে হবে।” মিলিন্দ এবার জবাব দিল, “ কাউকে পেতেই হবে এমন তো জরুরী নয়,
না পেলেও জড়িয়ে পড়া যায়, আবার পেলে কি সব সময় জড়ানো যায়? বাদ দে; মেল-টেল করিস।” হতাশ গলায় দিশা বলল, “আগে পাহাড়ে তবু উইক ডে’স-এ আউটিং নিয়ে মিনিট কুড়ি নেট সার্ফ
করা যেত। এখন যেখানে আছি সেখানে আমার অফিস ক্যাম্পাসটাই টেলিফোনিক বা ইলেক্ট্রিক
কানেকশন আইল্যাণ্ড; ছুটির দিনেও ছুটি নেই তো ইউক ডে’স-এ ব্রেক! ইন্টার নেট অনেক দূরের
ব্যাপার। বাড়ি এলে দু-তিন মাস অন্তর মেল করতে পারি, তবে তুই তো পড়বিও না, জবাবের
আশাও করিনা; তবু মায়াঙ্কর থেকে কিছু খবর পেতাম তোদের, তা সে ব্যাটা নিজেই এমন
ঘেঁটে ঘ হয়ে আছে যে…” আরও কিছু একথা সেকথার পর যে যার রাস্তা ধরল।
মাস তিনেক পরে,
দিশা একটা চিঠি লিখল সুস্মিতাকে।
“সু,
তুই খুব চমকে যাবি
এই চিঠিটা পেয়ে। কিন্তু আমি একমাত্র তোর কাছেই নিরাপদ। কারণ তুই এ রাজ্যের বাইরে
থাকিস।
আমি মরে গেলে
হত্যা না মৃত্যু সেই তর্কের অবকাশে মৃত্যুর দলের লোকেরা হয়ত আমার পৈতৃক ভিটাকে
তছনছ করবে, প্রমাণ লোপের তাগিদে। কিন্তু সে দলের লোকেরা ভাবতেও পারে না তোর মত
বন্ধু আছে আমার।
মরে গেলে কী করতে
হবে তুই জানিস; এই চিঠিটার আসলটা রেখে বাকি কপিগুলো যুযুধান মিডিয়াগুলোতে পাঠাতে
হবে। তবে মরব না বলেই এখনও বিশ্বাস রাখি।
আমি ভাবছিলাম
এতদিন বেনিফিসিয়ারিস বা টার্গেট গ্রুপের কথা না শুনেই সমস্যা তৈরী হয়েছে। টার্গেট
গ্রুপের মানুষের সাথে মিশে বুঝতে পারলাম যে ওরা আমাকে বাইরের লোক এবং অবশ্যই ঝাড়ের
বাঁশ বলেই মনে করে; বিশ্বাস করে না এক্কেবারেই। যত মিশলাম তত বিপদ ডাকলাম; প্রথমত,
আমার ঝাড়ে আমি বেয়াড়া হয়ে গেছি; কারো কাজে (পড় স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে) আসছি
না; মানে, ঝাড়ের বাকিদের থেকে আমার অবস্থাণ পৃথক হয়ে যাওয়ায় আমি ধোবি কা কুত্তা,
না ঘাটকা… না ঘরকা। দ্বিতীয়তঃ,
বেনেফিসিয়ারিসদের মধ্যে আবার ওদের লোক – আমাদের লোক আছে। মুণ্ডু বাঁচাবার
তাগিদে এই ভাগের ফাটলটা আমি নিজেও খানিক চওড়া করে ফেলেছি।
ফল সাংঘাতিক কিছু
একটা হতে পারে। যেরকম রাজনৈতিক টাল-মাটাল অবস্থা এখানে, পাঁচ টাকা দিলে, এক ভাঁড়
হাঁড়িয়ার লোভে যে কোন মাতাল আমার মুণ্ডুটা খসিয়ে দিতে পারে; ঘটনাটাকে “দুর্নীতি পরায়ণ মানুষকে বিপ্লবীদের
দেওয়া শাস্তি” বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে; আমার মিনতি দি চেঁচামেচি করে একটা বড়
রাজনৈতিক খেয়োখেয়ি বাধিয়ে দিতে পারে। হতে পারে অনেক কিছু। পাঁচ টাকা খরচা হবে
নিশ্চয়ই সরকারী সিন্দুক থেকে, ওদের লোক বেনেফিসিয়ারীর হাত দিয়ে। ঠিক কে যে কখন
কোনটা করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।
যা হোক আমি চেষ্টা
করছি ছুঁচো সেজে ঘুরতে। যাতে হাতের গন্ধ এড়াতে সবাই আমাকে এড়িয়ে যায়।
চিঠিটার মানে তুইই
বুঝবি তোকে অনেক কিছু ফোনে আর মেলে জানিয়েছিলাম তাই। এটা কাগজে লেখার উদ্দেশ্য
স্পষ্ট করে ঘোষণা করা, “আমি খুন হয়ে যেতে পারি।” কার হাতে জানি না, জানাও যাবে না;
আমার সন্দেহ তালিকার সাপেক্ষে কোন প্রমাণ দাখিল করা মুস্কিল। হয়তো মামলার সাক্ষী
শুরু হতে এত দেরী করবেন পি পি সাহেব যে তার আগেই সবার ন্যাচারাল ডেথ বা
রিটায়ারমেন্ট হয়ে যাবে।
নতুন কিছু শোনাতে
পারলাম না বলে রাগ করিস; কিন্তু তিনমাসে আমি একদম ঘুমোই নি; প্রাণের এবং মানের
ভয়ে। খুব ক্লান্ত হয়ে শুই, পাশ ফিরলেই টের পাই ঘুমোচ্ছিলাম না। একদিন খাতায় দেখলাম
লিখেছি:
‘বনের মাথায় ঝলমলে চাঁদ ফ্যালফ্যালিয়ে
তাকিয়ে থাকে। একসময়ে মনে হত, কোনো এক পূর্ণিমাতে চাঁদ বুঝি নেমে আসবে ছাদে, বসবে
পাশে। এখন চাঁদ বড্ড দূরে; মনে হওয়াটা ক্লিশে হতে হতে মন থেকে মুছে গেছে। এত রং,
এত রস, এত গন্ধ – মহুয়া আর কাজুর – সবে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে চৌর্য বৃত্তি। চোর বনা আর চোর ধরা – এই দুটোই রয়ে গেছে অস্তিত্বের
লড়াইয়ে স্পষ্ট হয়ে। আর সব বর্ণ, গন্ধ হারিয়ে গেছে – লড়াইয়ে চুরমার ধূলোর মত। একা চাঁদ
আর কত জ্যোৎস্না ঢালবে! না কি সব গন্ধ ছাপিয়ে ওঠা পচনের গন্ধে বিরক্ত চাঁদ পণ
করেছে কখনও আসবে না নেমে নিজে থেকে; চোরের সাধ্যে কুলোয় আকাশের বুক থেকে ছিনিয়ে
আনুক চাঁদ’।
ভীষণ ভালো থাকবি।
দিশা।”
* * * * * * *
তখন প্রায় বেলা
দুপুর। কল্পনা মীন ধরে ফিরে এল নৌকায়। মেয়েগুলো এখনও লেগে আছে, যদি আরও কেজিটাক
পাওয়া যায়। ছেলেটা এখনও মাঠে ধূ ধূ রোদে।
এত সাপের উপদ্রব চারদিকে; একরত্তি
ছেলের কোন ভয় নেই। কাকেই বা দোষ দেবে সে? হুঁস তো তার নিজেরই গায়েব হয়েছিল। না হলে
শাশুড়ি-ননদের দুটো খোরাকির জন্য তার ছেলের খোরাকিতে টান পড়ে বলে মনে হয়! এখন তো আর
কেউ নেই; দেবকীও রবি মণ্ডলের ভাইঝি জামাই। কল্পনা নিজে দুবেলা খেটে, গলা অবধি ধারে
ডুবে পারছে কোথায় ছেলের দুবেলার খোরাকি আনতে!
বড় মেয়েটা দিনে দিনে তাল গাছ হয়ে
উঠছে; দেবকীর হিসেব যা হোক গেল তো মেয়ের মাথায় হাজার টাকার খরচা লেগে গেল; সেদিন
রবির বউ ডেকেই বলল যে অনুর তো ভোটার কার্ড করানোর সময় হয়ে গেল। খেতে পায় না, তার
ভোটার কার্ড! রানীটাও পিঠোপিঠি; ছেলেটাকেও ইস্কুলে দেওয়ার দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। এক
এক সময় পাগল হয়ে যাবে বলে মনে হয় কল্পনার। মনে হয় শাশুড়ি-ননদের চোখের জলের শাপ
লেগেছে। হাজারো ভাবনায় ডুবে কল্পনা হাতে হাজার মলম লাগাচ্ছিল; চিন্তার চাপে যত
ডলছিল আঙুলের ফাঁকে তত জ্বালা বাড়ছিল, আঙুলের ত্বকে, বুকে, মাথায়।
হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল,“বলি ও কল্পনাদি আছো নাকি?” চমকে ওঠে কল্পনা, “জবাদি?” সন্দেহ নিয়েই ছই থেকে বেরিয়ে আসে
সে; এবং দেখে যে ঠিকই , জবা-ই বটে। “ওরে বাবা! তা এদ্দিন পরে আমাদের মনি
পড়ল? দাদার শরীল কেমন? একলা আসছ নাকি?” জবা বলল, “এসেছিলাম রবিবাবুর দেনা মিটিয়ে কাগজ-পত্তর
সব নিয়া যেতে।”
“মানে জমির কাগজটাও?” কৌতুহলী হয়ে পড়ে কল্পনা। জবার ঘাড়
নাড়ায় সম্মতি দেখে আশায় চকচক করে ওঠে কল্পনার চোখ; সে জানতে চায়, “কী করে এত পয়সা জোগাড় করলে গো?”
জবা মিষ্টি হেসে বলল, “তোমার দাদার চিকিচ্ছের সময় শহরে গিয়ে
দেখলাম সেখেনে খাটলে অনেক পয়সা। রবিবাবু সেখানে পঞ্চাবাবু বলে একজনার কাছে ভিড়িয়ে
দিয়ে ছেল। তেনার কাছেও কিছু দেনা করিছিলাম। সেটি শুধতে হাসপাতালের সময় বাদে বাকি
সময়ে কাজে লাগিছিলাম। তারপর মেয়ে দুটাকেও খাওয়া-পরাতে দিলাম বাচ্চা আগলাতে,
মেয়েদের পিজিতে। অনেক খরচ কমি গেল; তোমার দাদাও সুস্থ হয়ে কাজে লাগল। পঞ্চাবাবুর
দেনা পেরায় শোধাও হয়ে গেল। ত্যাখন তিনি বুদ্ধি দিলেন সেখানেই থেকে যেতে। রোজগার
করে রবিবাবুর দেনা শুধে দিতে। তাই এসেছিলাম”। কল্পনা যেন চোখের সামনে স্বর্গ
দেখতে পেল। জবাকে ধরে পড়ল, “আমি সেখেনে গেলে আমার কাজ হবে?” জবা বলল, “রবিবাবুর সাথে কথা কও, ভোটার কার্ড
হইয়েছে তোমাদের?” কল্পনা কেঁদে ফেলল প্রায়, “না গো দিদি, খাবার জোটাতেই ধারে
একগলা হয়ে গেছি, যে” – জবা বলল, “দুপুরের খাবার সব গুছিয়ে নাও, দাদা ঘরে এলে কথা কয়ে নিয়ে আমার সাথে এসো;
রবিবাবুর গদিতে যাব।”
শেষ দুপুরে
রবিবাবুর সাথে কল্পনার রফা হয়ে গেল। জমির কাগজ থাকবে রবিবাবুর ঘরে। নৌকাটাও না হয়
সারিয়ে সুরিয়ে রবি বাবু কাজে লাগাবেন। কল্পনার জমিকে বাগান, রোওয়ান সব রবিবাবু
দেখে দেবেন; কল্পনা শুধু লোক লাগাবার খরচা দিয়ে যাবে। ভোটার কার্ড হলেই কার্ডের
ছবি নিয়ে কল্পনারা শহরে চলে যাবে। কার্ডের খরচ এখন রবিবাবুই দেবেন, টাকা শোধ হলেই
কল্পনারা আসল কার্ড পেয়ে যাবে। সব কথা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল কল্পনা, তার
বিশ্বাস হচ্ছিল না। বুঝতে পেরে রবিবাবু বললেন, “জবারেই জিগাও না, সত্যি বলতাসি না সব
বাজে কথা?” ঢক ঢক করে ঘাড় নেড়ে জবা কল্পনাকে বলল, “তুমি ভেতর বাড়িতে খবরটা দিয়ে এসো,
আমি কিছু কাজ সেরে আসছি।” কল্পনা চলে যেতে জবা রবিবাবুর থেকে তার নিজের জমির
কাগজটা চাইল। রবিবাবু বললেন “হিসেবে একটু ভুল ছিল যে! পাঁচ বৎসরে জনের মজুরিটা
বেড়েছে অনেক; ডিস্টি ম্যাজেস্টিকের আপিস থিক্যা খবর করে কবে কত মজুরী ছেল জেনে
তোমায় হিসেবটা দেব দিদি। চিন্তা নাই কিছু, সে সামান্য কটা টাকা হবে। হিসেব হলেই
পঞ্চাকে খবর দিব। কাগজটা ছাড়ায়ে লইয়্যা যেও।”
* * * * * * *
সিটি সেন্টারের সামনে পৌঁছে এদিক
ওদিক তাকাতে তাকাতে দিশা দেখতে পেল কালো জিনস্ আর মস গ্রিন টি-শার্ট পরা একজন
ভদ্রলোক স্মোক করছেন। ভদ্রলোকের দিকে দিশা এগোতে এগোতে তিনিও তাকালেন দিশার দিকে;
ওয়েভ করতে করতে দিশা জিজ্ঞেস করল, “আপনিই তমাল তো?” ভদ্রলোক কর মর্দনের জন্য হাতটা
এগিয়ে দিয়েই জানতে চাইলেন যে দিশা কোনো আইডেন্টিটি প্রুফ দেখতে চায় কি না। দিশা নেতিবাচক ঘাড় নেড়ে
প্রস্তাব দিল হ্যাং আউটে গিয়ে বসার। ভদ্রলোক রাজি হয়ে গেলেন।
প্রথমেই ভদ্রলোক
জিজ্ঞেস করলেন, “আজ যে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন বাড়িতে বলে এসেছেন?” দিশা সোজাসুজি জবাব দিল, “না, কিছু ফাইনালাইস হলে জানাব। আপনি
জানিয়ে এসেছেন বাড়িতে?” তমালও বললেন, “না, বলি নি কিছু; তার মানে এই নয় যে আমি ক্যাসুয়াল; আপনার বাড়িতে জানে যে
ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে অ্যাড দিয়েছেন?” দিশা একটু নড়ে চড়ে বসল, “আমিও ক্যাসুয়াল নই, তবে আমার
ফ্যামিলি স্ট্রাকচার তো প্রোফাইল-এই পড়েছেন; আমি অনর্থক কথা বলে বাড়িতে টেনশন
বাড়াতে চাই না। মা গত হওয়ার পর থেকে বাবা নেহাত সহজ স্বাভাবিক বিষয়েও যথার্থ
পরামর্শের অভাববোধ করতে থাকেন । তাই বিয়ে করব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বন্ধুরা, কাজিন্সরাই
এগিয়ে আসে আমাকে পাত্র পছন্দে সাহায্য করতে।” থেমে একটু জল খেল দিশা। তমাল বলল, “তাহলে বিয়ের সিদ্ধান্ত আপনি হালেই
নিয়েছেন?” দিশা ঘাড় নেড়ে “হ্যাঁ” বলে জানতে চাইল, “আপনার দেরীর কারণ কি? মানে সাধারণতঃ আপনার প্রফেশনে লোকজন সাতাশ-আটাশে
সংসারী হয়ে যায় দেখেছি…। তবে আপনার
প্রোফাইল আই ডি নাম্বার দেখে মনে হল আপনি অনেক দিন প্রোফাইল বানিয়েছেন।” তমাল একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, “চাকরির ব্যস্ততায়……”। তারপর সেদিন ঘন্টা তিনেক, সপ্তাহ
দুয়েক পরে আবার ঘন্টা পাঁচেক, এবং তারপর রোজ রোজ আড্ডা দিতে দিতে তমাল এবং দিশা
ঠিক করল বিয়েটা করেই ফেলবে।
সেই সুবাদে সেক্টর
ফাইভের গায়ে ফ্ল্যাট ভাড়া করল দুজনে। দুদিকে হলেও, দুজনের অফিসই ফ্ল্যাট থেকে আড়াই
কিলোমিটার দূরে। ফ্ল্যাটটা যে ফাঁকা সে খবর পাওয়া গিয়েছিল তমালের কলিগ সৌরভের
থেকে। সৌরভ থাকে ঐ ফ্ল্যাটটার উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে একই ফ্লোরে স্ত্রী স্বাতী আর
ছেলে শৌনককে নিয়ে। সৌরভ ফ্ল্যাটের মালিকের ব্যাপারে আবাসনের কো-অপরেটিভে
জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেই ব্রোকার হরিহর মাইতি যোগাযোগ করে তমালের সাথে। যদিও তমাল বা
সৌরভ কেউই বুঝতে পারে নি যে এমনটা ঘটল কেমন করে। কিন্তু ফ্ল্যাটটা শেষ অবধি পাওয়া
যেতে দুজনেই নিশ্চিন্ত হয়েছিল।
স্বাতীই ব্যবস্থা
করে দিয়েছিল যে তমাল-দিশার জন্য জবা রান্না করবে আর কল্পনা রান্নাঘরের বাইরের সব
কাজ, যেমন করে স্বাতীর বাড়িতে। সব কিছু ঝামেলা ছাড়াই ব্যবস্থা হয়ে যেতে একটা
রবিবারে দিশা আর তমাল ঢুকে পড়ল ফ্ল্যাটে। একদিন সকালের চায়ে সৌরভ হানা দিয়ে
তমালদের দুজনকে নেমন্তন্ন করল পরের শনিবার ওদের নতুন ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়ার জন্য।
সেদিন স্নানের পর
পুজোয় বসে স্বাতী কিছুতেই দেশলাইটা খুঁজে পেল না; সৌরভ কোনো দিনই স্মোকার নয়; তার মানে দেশলাই
ফুরিয়ে গেছে স্বাতীর বেখেয়ালে। স্বাতী ভাবল, “ভাগ্যিস কল্পনা দি থাকে এই সময়!” ঝটপট করে স্বাতী কল্পনাকে পাঠায়
পঞ্চার পানের দোকান থেকে দেশলাই আনতে। পুজো সময় মত সেরে শৌনককে স্কুল থেকে আনতে
হবে।
কল্পনা পঞ্চার
দোকানে আসতে, পঞ্চা কুশল বিনিময়ের পর জানতে চাইল, “কার লাগবে গো দেশলাই, তোমার বউদির না
দিদিভাই-এর ?|” কল্পনা সাবলীল উত্তর দেয়, “বউদির, দিদিভাই-এর ঘরে পুজোর যোগাড়
নেই তো।” পঞ্চার ভ্রূ অল্প কুঁচকে আবার সোজা হয়ে গেল; আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার বউদির তো একবছরের বেশি হয়ে
গেল; যাচ্ছে কবে শুনেছ কিছু?” কল্পনা ফিক করে হেসে বলল, “ঢং, বললে কি আমাকে ভাগা দেবেন না কি?” পঞ্চা খুব অবাক হয়ে থতমত খায়, তারপর
হেসে ওঠে, “মঁমঁমঁহ, ভাগা চাইছে? ধার কত হল হিসেব আছে? ভাগাতে ধারেতে সমান সমান, এখন
বলো দিকি, জান কি না তারা কবে নড়তিছে এই ঘর থিক্যা?” কল্পনা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “দেশলাইটা দ্যান দিকি, বউদির দেরি হয়ে
যাবে, সোনাকে ইস্কুল থিক্যা আনতি যাবে।” দেশলাই দিতে দিতে পঞ্চা বলতে থাকে, “মাসের শেষে ধার নেওয়ার সময় যেন মনে
থাকে তাড়ার কথাটা।” যেতে যেতে কল্পনা বলে যায়, “সে পাড়ে পাকা ঘর নিছে। যাবে
মাস-দুমাসে এক্কে-আরে। ইখানে আর ঠাঁই নাড়া হবে নাকো।”
সকালে রোজই পঞ্চার
দোকানের সামনে লোকাল এম্প্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ বসে। মথুরা আর সতীশ বসে বিড়ি ফুঁকছিল
পাশাপাশি। সতীশ জবার বর। আগের দিনটা ভালই গেছে সতীশের পাঁচটা আলমারি তুলে আই বি
এম-এ হাজার টাকা পেয়েছে। মথুরা অবশ্য গা গতরের ব্যাথায় কাহিল হয়ে পড়েছে; আগের দিন
সারাদিন নতুন বাস টার্মিনাসের ভিতের মাটি কেটেছে। সবারই মোটামুটি হয়ে গেল। মথুরাও
একটা ডাক পেয়ে গেল; রাস্তার মাঝের পাঁচিলে ছবি আঁকিয়েদের রঙের ডাব্বা পুরণের কাজ;
সারাদিন রোদে ঘুরতে হবে, কিন্তু বসে থাকতে হবে রং বওয়া গাড়িতে।
জায়গাটা শুনশান
হয়ে যেতে সতীশ পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো পঞ্চার দোকানে। পঞ্চার বউ তখন দোকানের চার্জ
হ্যাণ্ড ওভার করছে পঞ্চাকে। হিসেব-নিকেশ বোঝা হয়ে গেলে, সতীশকে নজর করল পঞ্চা।
সতীশ গলা খাঁকারি দিয়ে আকর্ণ হেসে বলল, “একটা বিড়িই দ্যান পঞ্চাদা, কাজ যখন
দেতি পারলেন নি আজ……” বিড়ির ডিব্বাটা হাতে ধরে খুলতে গিয়েও খুলল না পঞ্চা। সতীশের বাক্যের
শেষটুকু শুনে, ভ্রূ কুঁচকে উঠল এক মুহূর্ত; তারপরই সৌমভঙ্গীতে হেসে বলল, “তা কাল খুব খেটিছ; আজ না হয় একটু
রেসই নিলে।” একটু থেমে আবার বলল, “ তা নতুন জোড়ার খবর দিছে গো জবাদি?” সতীশ বললে “বোঝলেন আমাদের দে হবে নি। ছেলেরা
ইংরিজি না পড়লে বাবুদের কথাও বোঝা যাবে নি।” পঞ্চা খুব অবাক হল না; “অ, তেনেরা অবাঙালি? তেমনটা তো হরিহরও
বলে নি; সিকিউরি সঞ্জীবও বলে নি” – পঞ্চার কথার মাঝেই বলে ওঠে সতীশ, “তেনেরা অবাঙালি তো নন, তবে কি না কম
কথা কন; জবা থাকতি থাকতি যেটুক কন তাও ইংরিজিতে। জবা শেষ অবধি ছেলের মাষ্টারকে
ধরেছে, মাইনে একশ টাকা বাড়িয়ে দেলি যদি সে জবারে ইংরেজী শেখায়।” এইসময় পঞ্চার মোবাইল বেজে উঠল।
কোমরের গেঁজেল থেকে সেলফোনটা বার করে নিয়ে দু-চারবার “আচ্ছা, দেখছি।” বলে সতীশকে বলল, “সাইকেলটা নিয়ে একবার কর্পোরেশনের
মাঠে যাও; সেখানে ডম্বরু নামে একটা ছেলে থাকবে; তাকে আমার কথা বলবে। ওর সাথে ভ্যাট
থেকে সাদা দুধের প্যাকেট উঠিয়ে আনবে। ওপাড়ে গণেশের দুধের কারখানায় এক্ষুনি পৌঁছে
দিলে কেজিতে পঁচিশটাকা পাবে। কোন মজুরি নেই, কিন্তু ঝামেলাও নেই”।
শনিবারে দুপুর
দুপুর সৌরভ আর তমালরা সবাই মিলে দুটো রিক্সা নিয়ে ডি এল এফ এলো। ওখান থেকে একশ
টাকা দিয়ে একটা অটো রিজার্ভ করে পৌঁছোল সৌরভদের অ্যাপার্টমেন্টে। ওদের রান্নাঘরের কাজ চলছিল।
স্বাতী-সৌরভ কন্ট্রাকটরের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বারান্দায় এসে তমাল জানতে চাইল, “স্বাতী কন্ঠ্দের কথা কী বলছিল?” খুব হতাশ গলায় দিশা বলল, “গত রবিবারে না কি কন্ঠ্দের নীচের
ফ্ল্যাটের দিলীপ সাহা এসে চন্দ্রচূড় বাবুকে বিহারী-টিহারি বলে খারাপ খিস্তি-টিস্তি
করে মারতে গিয়েছিল। রোজ এসে অপমান করে যায় ছেলে কেন লাফায় বলে, সেদিন চন্দ্রচূড়ও মেজাজ রাখতে পারেন
নি। এদিকের চ্যাটার্জীরা দুজনকেই থামাবার চেষ্টা করছিল; ছেলের ভোকাবুলারি
স্ল্যাংসমৃদ্ধ হওয়ার ভয়ে স্বাতী গিয়ে চন্দ্রচূড়দের বাড়ির ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে
দিতে বলে। চন্দ্রচূড় উত্তেজনা এড়াতে না পারার ভুলটা বুঝতে পেরে স্বাতীর কথা শোনে;
ফলে এখন সাহাদের বাড়ি থেকে সবাই স্বাতীর পেছনে লেগেছে। কটা মাত্র দিন পরে চলে
আসবে, তাই বাঁচোয়া”। তমাল বলল, “তাই চন্দ্রচূড় আজকে ফ্ল্যাট বদলাল আবাসনে ! দীলিপ ব্যাটা নিশ্চয়ই
সিকিউরিটির দীনেশের থেকেও কমিশন নিয়েছে। এবার ডিল আবাসনের মধ্যে বলে হরিহর মাইতি
নেই, দীনেশ জানাই ম্যাট। দীলিপের কষ্ট রে; ভাগের পেট্রলপাম্প থেকে বোধ হয় ভাইরা
খেদিয়েছে কিংবা ওর ওখানকার আয়ের থেকে সফো চন্দ্রচূড়ের রোজগার বেশি বলে বোধ হয়
জ্বলে গেছে।” দিশা চোখ বড়ো বড়ো
করে জানতে চায়, “তুই জানলি কি করে দীলিপ অ্যাণ্ড ব্রো’স পেট্রলপাম্প আছে ?” তমাল চালাক চালাক হেসে বলে “পঞ্চা আছে না, আমাদের দাদা!” দিশা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল , এমন
সময় মালিকানায় ঝলমলে স্বাতী এসে খলখল করে বলল, “আজ ভাঁড়েই চা খেতে হবে কিন্তু।” দিশা বলল, “ছেলে বাড়ি থাকলে বারান্দা বন্ধ রাখিস
রে; এখান থেকে পড়লে আমিও সামনের মাঠটায় ঘাসে মিশে যাব, তারপর নরমাংস খেয়ে গরুটা
সোঁদরবনের বাঘ বা গোকুলের ম্লেচ্ছ- কিছু একটা হয়ে যাবে।” চায়ের ভাঁড় আর হাসাহাসি শেষ করে
দরজায় চাবি লাগাতে লাগাতে সৌরভ তমালকে বলল, “উল্টোদিকেরটাও বুক হয়ে হয়ে গেছে ।
আমারই যোগাযোগ।” দিশা যেন ঈষৎ অহঙ্কারী হাসি খেলে যেতে দেখল সৌরভের মুখের আনাচে –কানাচে। “রমিতা বলে একটা মেয়ের সাথে
আটানব্বই-এ প্লেনে আলাপ হয়েছিল। ওর তেলেগু বরের ইচ্ছে এখানে একটা ফ্ল্যাটে ইনভেস্ট
করার। ওরা অবশ্য এখনও আটলান্টাতেই আছে। তোমরা দেখো, পরে বোলো কিছু ভাবলে কিনা”। তমাল জিজ্ঞেস করে, “এখানে এখন দর কি ?”
“চল্লিশ, তবে রমিতার যোগাযোগের জন্য
আমাকে কিছু কমে দিয়েছে।” সংক্ষেপে সারে সৌরভ।
রাস্তায় নেমে ফেরা
এক ঝকমারি। এখানে বাস, সাইকেল রিক্সা অটোরিক্সা কিচ্ছু চলে না। শেষে জাস্ট ডায়ালে
ফোন করে কাছের কারপুল থেকে ভাড়ার গাড়ি ডেকে তাতে চড়ে টেকনোপোলিস পৌঁছে দলটা
নিশ্চিন্ত হল।
টেকনোপোলিস থেকে
রবীন্দ্রসদন ট্যাক্সিতে আসার পথে তমাল দিশাকে বলল, “ভাবছি আমিও একটা বুক করে ফেলি, কি বল?” দিশা তীক্ষ্ণ হুল ফুটিয়ে জবাব দিল, “নুভু রিশদের ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানে
আমি কি ইনপুট দিতে পারি?” তমাল বিরক্ত হল, “থাকার তো একটা ডেরা লাগবে!” দিশা বলল, “যেখানে ডেরা বানাবি সেখানে আগামী
তিরিশ বছরের তিনভাগের বেশী থাকবি তো? ঠিক জানিস?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে তমাল বলল, “নাহ্, প্রজেক্টের পিছনে দৌড়োও,
টেকনোলজি চেঞ্জ কর। আবার দৌড়োও’’। এরপর নৈরাশ্য বেয়ে ট্যাক্সির গহ্বরে ছেয়ে গেল
নৈশঃব্দ।
মাসদুয়েক পরে দিশা
ই-মেল লিখছিল তমালকে।
“কেন রোজ জিজ্ঞেস করিস মন খারাপ কি
না। তোর মন কি ভাল আছে? হয় তো আছে। তোর প্রিয় স্টেস-এ আছিস তো।
মন খারাপ নিয়ে
বেশি কথা বলছি না। বাবা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন; ছাপতে দেওয়া কার্ডগুলো ফিরিয়ে
এনেছি বলে। তুই কি চালাক না কি অলস যে এখনও কার্ডের অর্ডার দিস নি, ড্রাফট রেডি
করিস নি – এ তর্কটাই আজকাল কুরে কুরে খায়।
তোর সই ছাড়াই যাতে
ব্রডব্যাণ্ড ইত্যাদি কানাকশন কেটে যায় তার জন্য একটা লোক ধরেছি। কাজ আধখানা এগিয়েও
গেছে। বাড়িওয়ালা মিত্রমশাই তোর সাথে ফোনে কথা বলতে চান ফ্ল্যাটটা ছাড়ার ব্যাপারে।
বিবেচকের মত কথা বলিস।
আমার জিনিসপত্র
আমি বাবার ওখানে পৌঁছে দিয়েছি। তোরগুলো তোর মায়ের জিম্মায় জমা করে দিয়ে এসেছি।
লোডিং-এর সময়
পঞ্চা এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বলছিল কবে নাকি তুই ওর দোকান থেকে দৈনিক দু প্যাকেট
নেভিকাটের রসদ নিতে গিয়ে বলেছিলিস স্ট্যাণ্ডের সব রিক্সাওয়ালাদের জন্য ইংলিশ শেখার
ব্যবস্থা করতে; এখানে তো এখন অনেক অবাঙালী ইংলিশ স্পিকিং মানুষ, এমনকি লালমুখো,
হলুদমুখো ভিনদেশি সাহেবও; সব নাকি সংখ্যায় বাড়বে। তুই ওকে না বলে চলে যাওয়ায় ও বড়ই
দুঃখ পেয়েছে। আফটার অল তোর মত দরদী কাস্টমার আর একটাও পায় নি যে।
আমি হানিমুনের
ছুটি ক্যান্সেলের দরখাস্ত দিতে গেয়ে দেখলাম ফরেন যাওয়ার নো অবজেকশন লেটার এসে
গেছে। পাটায়া তো যাচ্ছি না আর এখন, ঐ লেটারে অন্য কোথাও যাওয়াও যাবে না, অন্য কোনো ডেটেও যাওয়া যাবে না। আবার পরে
পারমিশনের ঝক্কি, মেলা প্রশ্ন চিহ্ণ সব ভেবে রেসিগনেশন দিয়ে দিলাম। নতুন বছরে আর ঐ
আপিসে যাব না।
মার্চ সেশনে
অলবেরীতে লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির উদুঙ্গা ইন্সটিটিউটে এনভায়রনমেণ্টাল ম্যানেজমেন্ট
এবং ইকোলজি স্কুলে পি এইচ ডির জন্য ভর্তি হব। স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এখন
তো প্রচুর লোক পালিয়ে আসছে। তাই বোধ হয় সোজা হল খানিক ফাণ্ডিং পাওয়া।
অতএব পরের জুনে
আমি আসতে পারছি না। বিয়ের দায়িত্ব বইতে প্রস্তুত থাকলে তুই তার পরের মার্চে আসিস।
আমি দেশে আসব তখন।
অলবেরী
মিনিয়াপোলিসের থেকে ষোল ঘন্টা এগিয়ে চলে। ইচ্ছে হলে মেল করিস।
……………………………………”।
সেদিনই কল্পনার
মেয়ে অনু পালিয়ে গেল বাপ্পার সাথে। বাপ্পার বাবা ছেলেমেয়েদের নিজেদের পছন্দ মেনে
নিয়েছিলেন, কিন্তু কল্পনার কাছে কন্যাপণ হিসেবে চেয়েছিলেন এক বিঘা জমি। কল্পনা
রাজি হয় নি দাবি মেনে মেয়ে দিতে।
*
* * * * * *
ছড়িয়ে ছিটিয়ে
ছুটতে থাকা ধুলোর কণাগুলোর কয়েকটা পরস্পরের সাথে ধাক্কা লেগে জুড়ে যেতে লাগল।
কয়েকটা কখনওই ধাক্কা খেল না; ছুটেই গেল দিকহীন ব্রহ্মাণ্ডে। জোড়া লাগা কণা থেকে
ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠল তারা, গ্রহ, স্থল-জল-ফলের, ডারউইনের পৃথিবী। আবার জোড়ালাগা
কয়েকটা কণা পরের ধাক্কায় ঠিকরে পড়ল সীমাহীন দিগন্তে। মিলিয়ে গেল ব্ল্যাক হোলে
কিংবা সুপারনোভার ঝড়ে। বারবার।