Friday, August 9, 2024

JPDA - Chapter 03

৩. নীল সোনা প্রমোদভবন



জ্যাংঝৌ পৌঁছতে রাত হয়ে গেলো মিন হুয়ের। তখন ল্যান জিন গ্বা-এর অর্থাৎ নীল সোনা প্রমোদভবনের ব্যবসা চলছে পুরো দমে। মালকিন ব্যস্ত কাজ বোঝাতে আর টাকা গুনতে। মিন হুয়েকে বসিয়ে রাখলো ঘন্টা খানেক। তারপর মালকিন দেখা দিলো। বললো, “পুলিশ স্টেশন থেকে আমাকে ফোন করে ছিলো। কী বলি বলো তো? আমি অবশ্য সবটাই বলেছি। উনিশ নম্বর আমাদের সঙ্গে ছিলো এক বছরেরও বেশি -”

মিন হুয়ে বুঝতে পারলো না কিছুই, “উনিশ নম্বর?”

মালকিন ভেঙে বললো, “ওই হলো লি চুন মিয়াও।”

মালকিন কম্পিউটারে টাইপ করে চললো, মাথা না তুলেই। বলেও চললো, “মন দিয়ে কাজ করতো। কাজের হাতও বেশ ভালো ছিলো। আচার আচরণও খুব ভালো ছিলো। এই আর কি। আর বাকি কিছু আমি জানি না।”

মিন হুয়ে জোর করলো, “আমি তার বাসায় যেতে চাই। আমি শুনেছি যে তার জিনিসপত্র সেখানে আছে।”

মালকিন অকপটে জানালো, “বিছানাটা একজনকে দিয়ে দিয়েছি। চাদর, লেপ, সাজগোজের জিনিসপত্র সব ফেলে দিয়েছি। কেবল একটাই বাক্স পড়ে আছে। যদি চাও তো আমি বাইশ নম্বরকে বলে দেবো কাল বাক্সটা এখানে নিয়ে আসার জন্য।”

মিন হুয়ে আবার হোঁচট খেলো, “বাইশ নম্বর? সে কে?”

মালকিন একটু কি যেনো ভাবলো। তার মগজ বেশ খানিক কুস্তি করলো নাম আর নম্বরের মধ্যে মেলানোর জন্য। ফের বললো, “...... ঝাও য়িং মেই। দুজনে একই বাঙ্ক বেডে শুতো।”

মিন হুয়ে ছাড়বে না কিছুতেই সুযোগ, “ঝাও য়িং মেই-এর সাথে দেখা করতে পারি কী?”

মালকিন নিস্পৃহভাবে জানালো, “ঝাও য়িং মেই এখন কাজ করছে। মাঝরাত পেরিয়ে দুটো অবধি ও কাজ করবে।”

তারপর মাথা তুলে মিন হুয়ের দিকে চেয়ে উৎসাহ ভরে পরামর্শ দিলো, “তুমি তোমার পা দুটো এখানে মালিশ করিয়ে নাও না কেনো? একটু বিশ্রামও হবে তোমার আর ঝাও য়িং মেই-এর সাথে কথাও বলে নিতে পারবে।”

মালকিন বেশ ভালো ব্যবসা বোঝে। কোনো সুযোগই সে হাতছাড়া করে না খদ্দের ধরার জন্য।

মিন হুয়ে মেনে নিলো, “ঠিক আছে।”

মালকিন দামের ফর্দ উল্টে পাল্টে বললো, “একটা পাথর গরম জরুরি তেল মালিশ নাও। একঘন্টার জন্য এটার দর ছশো পাঁচ য়ুঁয়াঁ। তবে একদল লোককে যে দরে দি আমি, সেই দরেই দেবো তোমাকে, চারশো য়ুঁয়াঁ। দশ মিনিট পরে তুমি শুরু করতে পারো।”

মিন হুয়ে দরাদরি করতে ছাড়লো না, “আরেকটু সস্তা হতে পারে না?”

বিনচেং-এ, যেখানে মিন হুয়ে থাকে, সেখানে তিরিশ হাজারের বেশি পা পরিস্কারের দোকান আছে। সাধারণত ঘড়ি ধরে একঘন্টার মালিশের খরচা পড়ে দুশো থেকে তিনশো য়ুঁয়াঁ। দোকানের সাজগোজ খুব কেতা দুরস্ত ঝকঝকেও নয়। জিয়াংঝৌ বড়ো শহরও নয় বিনচেং-এর মতো। মিন হুয়ে ভাবতেই পারছে না যে পা ধোওয়ানোর খরচা এতো বেশি হতে পারে জিয়াংঝৌতে। তার সন্দেহ হতে লাগলো যে দামটা মানুষের পকেট জোর করে কাটার ব্যবস্থা।

মালকিন দরাদরিতে আগ্রহ দেখালো না। বরং তর্ক করলো, “আমরা সত্যিকারের জরুরি তেল ব্যবহার করি। সেগুলোর দাম খুব বেশি। বুঝলে? এক বোতল তেলের দামই পড়ে দুশো য়ুঁয়াঁ। নিজের দিকে দেখেছো? এক বোতলে একবারও হবে না তোমার।”

মালকিন ভ্রু উঠিয়ে বললো, “আমি শুনেছি সে তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।”

মিন হুয়ে স্বীকার করে নিলো, “হ্যাঁ।”

মালকিন তর্ক ছেড়ে উপহাসে মাতলো, “তার জন্যই আমি তোমাকে চল্লিশ পারসেন্ট দাম কমিয়ে কাজটা করে দিচ্ছি। আর তুমি তাতেও দরাদরি করছো? বলি তোমার বিবেক বলে কিছু আছে? লাগে বিবেকে?”

লাগে বিবেকে। মিন হুয়ে চুপচাপ টাকাটা দিয়ে দিলো।

ঝাও য়িং মেই বেশ সুন্দরী। বড়ো বড়ো চোখ তার ছোট্টো মুখখানাতে। মুখে হালকা মেক আপ করেছে। চুলটা ঘন আর লম্বা। তাকে দেখে প্রথমেই মনে হয় সে বেশ খাঁটি মানুষ আর বাধ্য। তার পরণে একটা আঁটোসাঁটো ছোটো ঝুলের ছোটো হাতা চেয়ংসাম জামা। পাঁচ সেন্টিমিটার উঁচু হিল জুতো পায়ে। তার পারফিউমের গন্ধটা বেশ কড়া। তার হাতের জোর এতো বেশি যে মিন হুয়ে “ওহ" “ওহ” করে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো।




“বোনটি কী কপি লেখার কাজ করো? তোমার পিঠটা ভয়ানক শক্ত। জোরে জোরে ঘষতে হবে পিঠটা তবে শিরদাঁড়াটা জেগে উঠবে।”

য়িং মেই বেশ কাজের। তার আঙুলগুলো লোহার মতো শক্ত। সে মিন হুয়ের পিঠে ঘষতে লাগলো, খিমচোতে লাগলো, ঠেলতে লাগলো, চাপ দিতে লাগলো। 

মিন হুয়ে তাড়াহুড়ো করে বললো, “আসলে আমি এখানে মালিশ নিতে আসি নি। আমি খুঁজতে এসেছি -” 

য়িং মেই কথা কেড়ে নিলো, “লি চুন মিয়াও-কে তাইতো? ল্বব্যানিয়াঁ বলেছে আমাকে।”

তারপর আস্তে আস্তে ফোঁটা ফোঁটা জরুরি তেল নিজের হাতের তালুতে নিয়ে নিজের আঙুলগুলোতে তেলটা মাখিয়ে সেটা মালিশ করতে লাগলো মিন হুয়ের হাতের তালুতে আর আঙুলে। আর বললো, “কাল সকাল দশটায় এসো আমার কাছে। চুন মিয়াও-এর বাক্স পেয়ে যাবে।”

দ্বিতীয় বার যখন সে মিন হুয়ের পিঠের ওপর চাপ দিলো, তখন মিন হুয়ে সত্যিই বেশ আরাম পেলো। আরামে তার দুচোখ প্রায় বুজে এলো। সে জানতে চাইলো, “তুমি যখন চুন মিয়াও-এর সঙ্গে থাকতে, তখন নিশ্চয়ই তোমরা পরস্পরকে বেশ ভালো চিনতে?”

ঝাও য়িং মেই জবাবে বললো, “এটা সত্যি যে আমরা রোজই একসাথে থাকতাম। আমরা একসাথে খেতাম, একসাথে শুতাম, কিন্তু আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। সে সবার খেয়াল রাখতো, কিন্তু নিজের কথা বলা সে পছন্দ করতো না। তুমি জানো নিশ্চয়ই যে সব পরিবারেরই বলা যায় না এমন কিছু ইতিহাস থাকে। চুন মিয়াও গুয়াঁইশির হেচি শহরের মেয়ে ছিলো। তার লাগোয়া ছিলো উপজাতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বশাসিত এলাকা। কোন উপজাতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সে কথা আমি ভুলে গেছি। সোজা কথা হলো যে সেখানে সবাই খুব গরীব। চুন মিয়াও ষোলো বছর বয়সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ছিলো আর কোনো দিনও ফিরে যায় নি। তার আরো একটা কারণ ছিলো যে সেখানে তার আর কেউ ছিলো না।”

মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “জ্যাংঝৌতে কেনো? কোনো আত্মীয়স্বজন, নিকট বন্ধু, সহকর্মী, প্রেমিকা বা প্রেমিক?”

য়িং মেই বেশ জোর দিয়েই বললো, “না। ল্যান জিন গ-এর ব্যবসার বয়স দু বছরেরও কম। চুন মিয়াও-ই একমাত্র মানুষ যাকে আমি ল্যান জিন গতে সব থেকে কাছ থেকে চিনেছি। আর আমি খুব একটা সময়ও পাই নি তার সাথে কথা বলার। আমরা এখানে বেতন পাই খদ্দের পিছু। মানে যতো কম সময়ে, যতো বেশি খদ্দের ধরা যাবে, রোজগার ততো বেশি। তাই সব্বাই পয়সা রোজগার করতে ব্যস্ত। আমাকে দিনে তের ঘন্টা কাজ করতে হয়। আমি জানি না সূর্যোদয়ই বা কি আর সূর্যাস্তই বা কি। সকালের জলখাবারই বা কি আর রোদ্দুর কাকে বলে। আমি শুধু কাজ করি। কোনো ছুটির দিন নেই। যতো ছুটির দিন সবার, ততো ব্যস্ত কাজের দিন আমার।”

দেশের শহর থেকে শহরে ঘুরে ঘুরে কাজ করে যে মেয়েরা তাদের দুর্দশার কথা বলার সময় য়িং মেই চট করে থামতে পারলো না। মিন হুয়ে শুনে গেলো আর দেখে গেলো দশ বর্গমিটারেরও কম পরিসরের ছোট্টো ঘরখানাকে। ঘরটা বেশ বদ্ধ। কোনো জানলা নেই ঘরে। অবাক হবার কিছু নেই যে যে মেয়েরা পা মালিশের কাজ করে তাদের ত্বক ফ্যাকাসে দেখায় …… সে ভাবার চেষ্টা করলো চুন মিয়াওকে তার কাজের জায়গায় কেমন দেখাতো। পরের পর খদ্দের, বিরামহীন মালিশ, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর। এই রোদ হীন ছোট্টো ঘরে। কেন্নো। কেন্নোর মতো জীবন যেনো।

মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “তার ভবিষ্যতের ভাবনার কথা বলে ছিলো কিছু তোমাকে? তার দেশের বাড়িতে আর যখন কেউ ছিলো না, সে নিশ্চয়ই অনেক টাকা জমিয়ে ফেলে ছিলো। তাই না?”

বলা মাত্র মিন হুয়ের একটু অনুশোচনা হলো। সবাই ভুল বুঝবে নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই সবাই ভাববে যে সে এতোটা পথ এসেছে শুধু একটা খেটে খাওয়া মেয়ের জমানো টাকার লোভে।

ঝাও য়িং মেই সে সবের তোয়াক্কা করলো না, “টাকা নিশ্চয়ই কিছু আছে। কারণ তার জীবন যাপণে কোনো বাহুল্য ছিলো না। তার মা মারা যাবার আগে, চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য সে অনেক টাকা ধার করে ছিলো। সুদ মেটানো হয়ে গিয়ে ছিলো। টাকা সব বোধ হয় ধার মেটাতেই গিয়ে ছিলো। মাস খানেক আগে এক খদ্দের এসে ছিলো। প্রেমে পড়ে ছিলো চুন মিয়াও-এর। দরজির কাজ করতো খদ্দেরটা। পদবী ফেং। তার পরিবার থাকে গুয়াংঝৌতে। আমি জিজ্ঞেস করে ছিলাম চুন মিয়াওকে যে ও লোকটার সাথে যেতে চায় কিনা। লোকটার অবস্থা বেশ ভালো। লোকটা বেশ দয়াবানও বটে। তবে একটু বয়স্ক আর বাড়িতে বৌ আর বাচ্চাও আছে। লোকটা ছেলের বাবা হতে চায়। লোকটা চুন মিয়াওকে একটা আলাদা বাড়ি কিনে দিতে পারতো যেখানে চুন মিয়াও তার নিজের দোকান খুলতে পারতো। চুন মিয়াও কিছুই করলো না। মাথামোটা নাকি? খদ্দেরটা চুন মিয়াও-এর সঙ্গে শুতে আসতো, রোজ রাতে, মাতাল হয়ে। যদি পয়সা না দেয়, তাহলে পয়সার জন্য জোর করতে হতো। পাঁচ মিনিটের ব্যাপার বই তো নয়। আর লোকটা যখন খুব মাতাল হয়ে আসতো, তখন লোকটা বেশি লম্ফঝম্প করতো। চুন মিয়াও একবার লোকটাকে বকাঝকা করে ছিলো। কিন্তু মালকিন সে কথা জানতে পেরে চুন মিয়াও-এর একমাসের মজুরি কেটে নিয়ে ছিলো। তাকে প্রায় তাড়িয়েই দিচ্ছিলো কাজ থেকে ……”

য়িং মেই বলে চললো, “বাসায় ফিরে আমি চুন মিয়াওকে পরামর্শ দিয়ে ছিলাম যে সে তো এতো খাটনি খাটছে শুধু একটু ভালো ভাবে ঘর সংসার করবে বলেই নাকি। তাহলে বাইরে থাকায় আপত্তিটা কী? ছেলে হলে তার মানও বাড়বে। আমরা কি আর শুরুর থেকেই ঘরের বউ হতে পারি? সে সব হতে সময় লাগবে তার খানিক, তাই না? যদ্দিন সে লোকটার খেয়াল রাখবে, তদ্দিন সে যা খুশি তাই পাবে। জীবন তো আর টিভির শো নয়। জিয়েজিয়ে, তোমার কী মনে হয়, এটাই ঠিক নয় কী?”

মিন হুয়ে চুপ করে শুনে গেলো। যতক্ষণ শুনল সারাক্ষণ তার ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগলো য়িং মেই-এর মাথাটা ঠক ঠক করে দেওয়ালে ঠুকে দিতে। সব্বারই নিজের সব ব্যাপারে নিজের নিজের দৃষ্টীভঙ্গি আছে। আর বেশ কিছু লোকের দৃষ্টিভঙ্গী এক্কেবারে উল্টো। মিন হুয়ে অবাক হয় নি। সে তোয়াক্কাও করে না য়িং মেই-এর দৃষ্টীভঙ্গীর। তাই সে জানতে চাইলো, “তাহলে এবারে যে চুন মিয়াও বেরোল ল্যান জিন গ থেকে, সে কী কাজটা একেবারে ছেড়ে দিয়ে গিয়ে ছিলো?”

য়িং মেই জানালো, “আমি তেমন কিছু শুনি নি। ও তো এ মাসের মজুরিও পায় নি। ও এখানে কাজ করেছে দশমাসের বেশি, একদিনও ছুটি না নিয়ে। যদিও বাজে কথা, কিন্তু ও এবারে বলে ছিলো যে ও দেশের বাড়ি ফিরে যেতে চায়। সে যাই হোক, ও ভীষণ কাজের মেয়ে। তাই ল্বব্যানিয়াঁ এক কথায় রাজি হয়ে গেলো।”

মনে মনে একটা মানচিত্র এঁকে ফেললো মিন হুয়ে, “তার দেশের বাড়ি যেতে হলে তাকে হেচি যেতে হতো। সে মুশুইহে কেনো গিয়ে ছিলো?”

 চুন মিয়াও বাসে চড়ে ছিলো ইয়ুখং স্টেশনে। ইয়ুখং আর জিয়াংঝৌ - একটা উত্তরে তো একটা দক্ষিণে। হেচি, বলা যায়, দুটো জায়গার মধ্যিখানে। যদি তার দেশের বাড়ি ফিরে যাবার ছিলো তো তাহলে সে কী ভাবে একবার উত্তরে গেছে, একবার গেছে দক্ষিণে, আর সবই খুব দূর্গম জায়গা।




য়িং মেই বললো, “কে জানে কেনো? কক্ষণও চুন মিয়াও-কে সেই সব মেয়েদের মতো ভেবো না যারা সারা সপ্তাহ ঠাট্টা মশকরা করে, হাসাহাসি করে কাটায়। মেয়েটার অনেক রহস্য ছিলো আর তার উচ্চাশাও ছিলো। তুমি খদ্দের ফেং-এর ব্যাপারটাই দেখো না। আমার মতে, এটা খুব অস্বাভাবিক নয় যে তার মতো মেয়েরা অনেকেই শহরের বাইরে থেকে আসে। যদি তার আত্মীয়স্বজনও কাজের জন্য দেশের বাইরে থাকে? হয়তো আসল পরিকল্পনা ছিলো দেশে ফিরে যাবার। কিন্তু সে যার জন্য বসে ছিলো, সেও হয়তো কাজের খোঁজে ঘর ছাড়া। তাই চুন মিয়াও তার নিজের কাজের জায়গা বদলে চলে ছিলো সমানে।”

য়িং মেই-এর কথায় খানিক যুক্তি টের পেলো মিন হুয়ে। তবুও সে জিজ্ঞেস করলো, “এর মধ্যে কেউ তার খোঁজে এসে ছিলো? তুমি হয়তো তাকে চেনো না। কিন্তু সে হয়তো চুন মিয়াও-এর খুব কাছের জন? যেমন তার একটা ভাই ছিলো যে হারিয়ে যায় যখন চুন মিয়াও নিতান্তই শিশু। আর চুন মিয়াও-এর বাবা-মায়ের মৃত্যুই বা হয় কী করে?”

এ বছরেই চুন মিয়াও-এর বয়স পঁচিশ ছুঁয়েছে। তাহলে তার মা-বাবার বয়স হওয়া উচিৎ পঞ্চাশের আশেপাশে। যদিও তার দেশের অবস্থা খুব খারাপ, কারোরই পয়সাকড়ি তেমন নেই, বসবাসের বন্দোবস্ত অস্বাস্থ্যকর, তবুও তার বাবা, মা দুজনেই মারা যাবেন তাঁদের বয়স পঞ্চাশ হতে না হতে এমনটা সচরাচর ঘটে না।

য়িং মেই অবিশ্বাসে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “চুন মিয়াও-এর ভাই ছিলো নাকি? আমি তাকে কখনো ভাইয়ের কথা বলতে শুনি নি। শুনেছি তার মা-বাবা মারা গেছেন। বাবা গত হয়েছেন যখন ও নিতান্তই শিশু, মা গিয়েছেন যখন, তখন ওর বছর চোদ্দো বয়স। মা রুগ্ন ছিলেন বলেই শুনেছি। শেষ দু বছর বিছানা ছেড়ে উঠতে, হাঁটতেও পারতেন না। মা মারা যাবার পরে চুন মিয়াও-এর যাবার কোনো জায়গা ছিলো না। কদিন এক আত্মীয়বাড়িতে ছিলো, কিন্তু ওকে ওর মাসি বোঝা বলেই মনে করতো। ওকে খুব মারধর করতো, খেতে দিতো না। সহ্য করতে না পেরে ও পালিয়ে এসে ছিলো।”

অবধারিত উত্তরটার জন্য মিন হুয়ে প্রশ্ন করলো, “স্কুলে যায় নি কখনো?”

য়িং মেই নিশ্চিত করলো, “প্রাথমিকের পর আর এগোয় নি।”

মিন হুয়ের কৌতুহলের অন্ত নেই, “শখ কিছু ছিলো?”

য়িং মেই চাঁছা ছোলা উত্তর দিলো, “আমি রোজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠি, কাজে করি রাত ভোর হয়ে আসা অবধি। শখ পোষার মুরোদ নেই আমার। আমাদের বাসায় সব্বার একরকমের শখ - ইন্টারনেটে ভেসে বেড়ানো, মুখে এটা সেটা মেখে ত্বকের যত্ন নেওয়া - এই আর কি। চুন মিয়াও-এর একটা শখ ছিলো বটে, সাঁতারের। তবে আমি ওকে কখনো সাঁতরাতে দেখি নি। আশেপাশের জিমগুলোও বেশ খরচ সাপেক্ষ।”ঝপ করে

একটা ঘন্টা কেটে গেলো। য়িং মেই ফ্রন্ট ডেস্কে পাঠিয়ে দিলো মিন হুয়েকে পয়সা মেটানোর জন্য। তারপর সে নিজে আরেকটা ঘরে চলে গেলো। মিন হুয়ে মালকিনকে দেখে দাবি জানালো চুন মিয়াও-এর শেষ মাসের পাওনাটা মিটিয়ে দেবার। মালকিন কোমরে হাত রেখে খুব হাসলো। বললো, “ছ্যা! মড়া লোকের পাওনা দিয়ে করবে কী? তোমাকে আমি দেবোই বা কেনো?”

মিন হুয়ে যুক্তি সাজালো, “প্রথমত, চুন মিয়াও মৃত কিনা জানা যায় না। সে হারিয়ে গেছে মাত্র। পুলিশ স্টেশন থেকে আমাকে তার জিনিসপত্রের জিম্মা দিয়েছে। মজুরিটা তার আইনি প্রাপ্য, তার পরিশ্রমের দাম। আপনি সেটা দিতে বাধ্য। আমি প্রাপ্তি স্বীকার করে রসিদ দেবো আপনাকে। আমি চুন মিয়াও-এর পরিবারের লোকেদের খুঁজছি। যদি তাদের খুঁজে পাই, তাহলে পুরো টাকাটা আমি তাদের দিয়ে দেবো, যেটা তাদের খানিক কাজে লাগবে।”

মালকিনও ছাড়বার লোক নন, “তাহলে, পরিবারের লোকেদের খুঁজে পেলে তখনই চুন মিয়াও-এর পাওনা বুঝতে এসো।”

মালকিন হাত জোড় করে চাইলো মিন হুয়ের দিকে। সে চাউনিতে খানিক উস্কানিও ছিলো। মিন হুয়ে তর্কটা জারি লাগলো, “এতোবার আসা যাওয়া সম্ভব নয়। আমি পাওনাটা এখনই চাই।”

মুখ নামিয়ে মালকিন বললো, “মামণি, মৃত কর্মচারীর মুখ চেয়ে আমি এখনো তোমার সাথে সহযোগিতা করছি। আমার দিকে চেয়ে থে্কো না। তুমি জানো না তুমি কী বলছ।”

মিন হুয়ে সপাট জবাব দিলো, “তাহলে আর কোনো উপায় নেই আমার। আমি সোজা পুলিশে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, আমি সে কথাও জানাবো পুলিশকে যেখানে আপনার কর্মচারীদের আপনি বাধ্য করেন বেআইনি কাজ করতে।”

মিন হুয়ে মোবাইল ফোনটা বার করলো, “মহিলা ফেডেরেশন আর খবরের কাগজেরও এসব জানা দরকার যাতে ব্যাপারটা সমাজের সব্বার নজর কাড়ে বেশ ব্যাপকভাবে -”

মালকিন বেশ চটেই গেলো। দড়াম করে ড্রয়ার খুলে এক তাড়া নোট বার করে গুণে ছুঁড়ে দিলো মিন হুয়ের মুখের ওপর। বললো, “এই তার গত মাসের মজুরি, ছ হাজার য়ুআঁ, নাও দেখি।”

মিন হুয়েও একটা কাগজের টুকরোয় প্রাপ্তি স্বীকারের রসিদ লিখে কাগজটা ছুঁড়ে দিলো মালকিনের দিকে। বললো, “এই রইলো রসিদ।”

তারপর সে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলো।

ঝাও য়িং মেইকে বোধ হয় মালকিন কিছু বলে রেখে ছিলো। পরের দিন যখন মিন হুয়ে ঝাও য়িং মেই-এর বাসায় গেলো, তখন য়িং মেই তাকে কিছুতেই বাসায় ঢুকতে দিলো না চুন মিয়াও-এর জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে আসার জন্য। বাসাটাতে মালকিনের সব কর্মীরাই থাকে, বাসাটা মালকিনেরই দেওয়া। মিন হুয়েকে ল্যান জিন গের গেটে দেখা করতে হলো য়িং মেই-এর সাথে। ঝাও য়িং মেই তার বাইসাইকেল থেকে টেনে নামালো একটা ভাঙাচোরা সুটকেস। বললো, “এতেই তার সব কিছু আছে। তালা দেওয়া আছে এতে। কেউ কিছু ছোঁয় নি এতে।”

 মিন হুয়ে হাত বাড়িয়ে বাক্সটা নিতে নিতে বললো, “ধন্যবাদ।” 

ঝাও য়িং মেই বাক্সটাকে খুব ঝাঁকাতে লাগলো। খানিক পরে ছেড়ে দিলো আর গম্ভীরমুখে তাকালো মিন হুয়ের দিকে, আর জানালো “ল্বব্যান্নিয়াঁ, আমাকে বলে ছিলো বাক্সের সব জিনিস ফেলে দিয়ে তোমাকে খালি বাক্সটা দিতে। আমি ভাবলাম ‘কী দরকার?’ মহিলার গুণের তো আর সীমা নেই।”

মিন হুয়ে ঝাও য়িং মেই-এর দিকে চেয়ে, মৃদু হেসে বললো, “আমি এটা সাবধানে রাখব।”

য়িং মেই প্রশ্ন করলো, “তোমার কী মনে হয় ……… চুন মিয়াও বেঁচে ফিরবে?”

চোখ নামিয়ে মিন হুয়ে উত্তর দিলো, “জানি না।”

তারপর দুজনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

য়িং মেই বলে উঠলো, “যাই হোক। এই মুক্ত বসানো চুলের কাঁটাটা চুন মিয়াও-এর।”

আঙুল তুলে দেখালো তার নিজের খোঁপার দিকে। আর বলে চললো, “যখন আমরা একসাথে বাজারে যেতাম তখন কিনে ছিলো সে। আমি এটা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাখতে চাই। ঠিক আছে তো?”

মিন হুয়ে সম্মতি দিলো, “হ্যাঁ।”

য়িং মেই কৃতজ্ঞতা জানালো, “শিয়া শিয়া নি।”

তারপর বিদায় জানালো, “ঝেইজিয়া, নিজের যত্ন নিও।”

য়িং মেই পিছন ফিরে চলে যেতে গেলো যেই তখনই মিন হুয়ে বলে উঠলো, “তোমার চুলটা কী ঘন কালো! তুমি কী প্রায়ই হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করো?”

য়িং মেই অবাক গলায় উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। দিই হেয়ার মাস্ক। তুমি জানলে কী করে? এটা একটু দামী। আমি তো চুন মিয়াও-কে এটা ব্যবহার করতে বলে ছিলাম। ও এটা ছাড়তে পারছিলো না। তাওবাও স্টোরে পাওয়া যায়।”

মিন হুয়ে অনুরোধ করলো, “এসো উই চ্যাটে যোগাযোগ করি। তুমি তাহলে আমাকে ওটা পাঠাতে পারবে।”

একটু উদাস ভাবেই য়িং মেই মেনে নিলো প্রস্তাবটা, “ঠিক আছে।”

তার যেনো মনে হচ্ছিলো যে এতোটা বাড়াবাড়ির দরকার নেই। তাও ঝাও য়িং মেই কোডটা স্ক্যান করে নিলো। 



হোটেলে ফিরে মিন হুয়ে বাক্সটা খাটের ওপরে রাখলো। তারপর তালাটা খুঁচিয়ে খুলে ফেললো। খুলে ফেললো বাক্সটা। বাক্সের মধ্যে জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা আছে। স্যুট, সোয়েটার, সিল্কের স্কার্ফগুলো। জিনিসগুলো ভালো। সব কটা যত্ন করে ইস্ত্রি করে রাখা আছে। হয়তো ইন্টারভিউ-এর জন্য। এগুলো সবসময়ে, যেখানে সেখানে পরার ইচ্ছে লি চুন মিয়াও-এর ছিলো না বলেই মনে হয়।

বাক্সের থেকে একটা চড়া কর্পূরের গন্ধ বেরোচ্ছে। একটা মোটা ডাউন জ্যাকেট অনেকটা জায়গা দখল করে ছিলো। খোপের মধ্যে ছিলো একটা নীলরঙা ক্যানভাসের থলি। তার ভেতরে মিন হুয়ে পেলো একটা সাদা রঙের এনামেলের জল খাবার গ্লাস, একটা মোটা ডায়েরি আর একটা হলদেটে ছোপ ধরা সাদা টিশার্ট। টিশার্টের ওপরে একটা বিশাল অর্ধবৃত্তাকার নকশা ছাপানো । 

সাদা এনামেলের গ্লাসটা বেশ পুরোনো। তাতে ছাপানো ছিলো “ইয়াংছেনজেন শিশু কল্যাণ সংস্থা”। খালি জায়গাটুকুতে লাল রং দিয়ে লেখা ছিলো “শিন ছি”। এই কথা দুটো হাতে লেখা ছিলো। ডায়েরির পাতাগুলো খুব মোটা আর হলুদ হয়ে গেছে। সামনের পাতায় লেখা ছিলো “সু তিয়াঁর ডায়েরি" বড়ো বড়ো মোটা মোটা আঁকড়িতে। ভেতরটা একটা দাগটানা ডায়েরি, নানা মাপের অক্ষরে লেখা, যেনো একটা প্রাইমারি ইস্কুলের বাচ্চার খাতা। শুরুর তারিখ ছিলো ঊনিশ শো ছিয়ানব্বই।

মিন হুয়ে মনে মনে হিসেব করে নিলো ঐ বছরে চুন মিয়াও-এর বয়স ছিলো সাত। তাহলে সু তিয়াঁ কে?

পাতা উল্টে মন দিয়ে পড়তে শুরু করলো মিন হুয়ে। হঠাৎ একটা ভাঁজ করা চিঠি লেখার কাগজ পড়লো ডায়েরির ভেতর থেকে। মিন হুয়ে খুলে ফেললো ভাঁজ করা কাগজটা। দেখলো ভেতরে লেখা আছেঃ

“সু তিয়াঁ, 

যেদিন আমি চলে যাবো, সেদিন তোকে স্টেশনে আসতেই হবে। সাঁতার প্রতিযোগিতায় যাচ্ছিস, তুই কী আমাকে আর দেখতে চাস না? সে ঠিক আছে। তুই আর আমি - আমাদের খুব দুঃখ পেতেই হবে এমন নয়।

প্রথমবার প্লেনে চড়ে এতো দূরে একটা জায়গায় যাবো, আমার একটু ভয় ভয় করছে। আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আরো ভয় করছে, বেশ কয়েকদিন ধরে, ঘুমোতে পারছি না।

যখন আমি তোর পাশে থাকবো না, তখন নিজের যত্ন নিবি, খুশি থাকবি। দশ বছর পরে, আজকের দিনে, আমি তোর কাছে ফিরে আসবো, আসবোই। মনে করে সেই জায়গাটায় যাবি যেখানে আমরা প্রথমবার আইসক্রিম খেয়ে ছিলাম। যে জামাটা তোকে দিয়েছি, সেটা পরে যাবি, আর যে কাপটা দিয়েছি তোকে সেটা নিয়ে যাবি। এই দুটোই আমাদের একে অপরকে চিনে নেবার সংকেত।

আমি তোকে বিয়ে করবো। আমি তোকে ভালো বাসবো। আমি তোকে সেই ঘর দেবো যেটা তুই চাস। 

যদি আমি সেদিন না আসি, নিশ্চয়ই ভয়ানক কিছু ঘটে থাকবে। ভয় পাবি না। হয়তো আমি মরে যাবো না। আমাকে আরেকটা সুযোগ দিবি। তোকে আরেকটা সুযোগ দিতেই হবে আমাকে।

আরো তিন বছর পরে একই দিনে তুই আবার যাবি ওখানে। যদি আমি তখনও না আসি, তার মানে আমি নিশ্চয়ই মরে গেছি। আমাকে ভুলে যাস প্লিজ আর নিজের জীবনের পথে এগিয়ে যাস।

তোর নিশ্চয় না আসতে পারার কোনো কারণ থাকবে না। তোকে আসতেই হবে, যে ভাবেই হোক।

আমার সাথে দেখা করার আগে, অন্য কোনো ছেলের সাথে তুই প্রেম করবি না। এমনকি অন্য কোনো ছেলের প্রতি তোর কোনো আকর্ষণও থাকা চলবে না । যদ্দিন আমি বেঁচে থাকবো তোর সাথে প্রেম করার জন্য, তদ্দিন কেউ আমার থেকে বেশি ভালো তোকে বাসবে না।

আমার অপেক্ষায় থাকিস। বাকি জীবন আমাকে তোর যত্ন নিতে দিস। আমি কথা দিলাম।

শিন ছি 

XXXX জুলাই ৭




~~~~~~~~~~~~

সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96

Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/07/jpda-chapter-02.html

Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/07/jpda-chapter-04.html








Readers Loved