Wednesday, August 21, 2024

Some Wariness

 


২০০৮ সবে সবে উর্দি (অসামরিক) ছেড়ে খাঁটি সভ্য/ শিষ্ট/ নাগরিক/ বেসামরিক ধাঁচের একটা সরকারী কাজ করতে শুরু করেছি। বাসে চড়ার সময়ে আর  বাস থকে নামার সময়ে ভিআইপি-কেস্টোপুর মোড়ে বা উল্টোডাঙার মোড়ের পাঁচটা মাথায়, বারাসাত কলোনি মোড়ে উর্দিহীন ডান্ডাবাজদের প্রবল পরাক্রমে বাস আর ট্রাক পেটাতে দেখছি, রিক্সা ঠেলা অমোটরচালিত যানগুলোকে তাড়া করতে দেখেছি। দেখেছি কখনও কখনও উর্দি পরা লোকেরা কাজটা করছে উর্দিহীনদের সাথে একজোটে।

কৌতুহল আটকাতে না পেরে বারাসাত কলোনি মোড়ে এক ডান্ডাবাজকে জিজ্ঞেসই করে ফেলে ছিলাম, “এটা কী আপনার কাজ? নাকি শখ?”

বলে ছিলেন, “কাজ। মিউনিসিপ্যালিটির। সপ্তায় পাঁচদিন দশ ঘন্টা করে ডিউটি করলে হাজার টাকা।”

মিউনিসিপ্যালটির ট্র্যাফিক পুলিশ? হতে পারে কি? সে যাবৎ যা আইন ছিলো তাতে?

আইন যাঁরা বানান আইন সভায়, তাঁরা নির্বাচকদের ইচ্ছে পূরণ করতে চান বলেই নাকি আইন বানান।

আদালত আইন অনুসারে বিচার করে, এমন কি আইনেরও বিচার করে। সরকারী দপ্তর আইন লাগু করে, উর্দি থাক বা না থাক। 

অর্ধদশক ধরে সরকারী দপ্তরের ঝাল খেয়ে, ঝড়ঝাপটা সয়ে ভেবে ছিলাম, “বেআইনি হলেও কদিন পরে আইন বানিয়ে নেওয়াই যায়। আপাতত তো রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজে এদের লাগানো হয়েছে বলে দেখালেই চলবে মিউনিসিপ্যালিটির খরচের খাতায়। অনিয়ম, বেআইনি কিছুই ধরা পড়বে না।”

আপন মনে বাঁকা হাসি নিয়ে নিজের বিশ্লেষণের তারিফ করতে করতে কলকাতা শহরের মোড়ে আবার এক ডান্ডাবাজকে ধরলাম। তিনি বলে ছিলেন তাঁর নিয়োজক পুলিশ, তবে টাকাটা একই পরিমাণ পান। শহর বলে বারাসাতের এক হাজার টাকা বারোশো টাকা হয়ে যায় নি।

আপন মনের বাঁকা হাসি আটকাতে পারি নি। বাহ্‌ রে, উর্বর মস্তিষ্ক রাজনীতিক আর তার গুন্ডাবাহিনী! 

ধর কিনা রোজ সকালে ডান্ডাহাতে সে থানার নির্দেশে বাস ঠেঙালো উল্টোডাঙায়, আর সন্দেশখালির পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগের দিন বলে গেল, “টাকা-ফাকা কাটবেন না বড়োবাবু, কাল যদি জ্যান্ত থাকি, তবে পরশু এসে ডিউটি করবো।”

অন্তত আমি যেখানে কাজ করতাম সেখানে দিনমজুর থেকে চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মী হয়ে যাওয়া মানুষেরা তো আমাকে অমন করেই চমকে দেবার চেষ্টা করতো।

কেবল ভাবতাম জনসুরক্ষা বাহন নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটা কী এতোই সস্তা?

২০১১। কলকাতা পুলিশে কর্মরত এক বন্ধুও কথাটা চায়ের আড্ডাতে বলে ফেললেন। 

২০১৮। হাওড়াতে ক্যারি রোড থেকে যে রাস্তাটা পদ্মপুকুর রেলওয়ে ক্রসিং হয়ে আন্দুল রোডে পড়ছে, তার ক্যারি রোড প্রান্ত ক্যামেরাখচিত, আন্দুল রোড প্রান্তে একটা পুলিশ ব্যারাক আছে কিন্তু কোনো ক্যামেরা নেই। সিভিক ট্র্যাফিক ভলান্টিয়ার ঐখানে মুর্গি বওয়া পিক আপ ট্রাক থেকে তোলা/ঘুষ নগদে নিচ্ছে, দরাদরি চলছে দরাজ। দুপুর বেলা। টাকার পরিমাণ চূড়ান্ত হওয়ার আগে সিভিক ট্র্যাফিক ভলান্টিয়ার সেটা যাচাই করে নিলো শিক্ষকের ভঙ্গীতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রেডিও সেটে কথোপকথনে ব্যস্ত উর্দিপরা সরকারি বেতনভুকের থেকে।

পুরো কলকাতা বিধাননগরে আট হাজার টাকা মাসমাইনের সিভিক ট্র্যাফিক ভলান্টিয়ারের ফ্যাকাসে উর্দি আর চমকিলা মোটরবাইকে নজর আটকে যাচ্ছিল। কারটা সততার বেতনে, ব্যাঙ্কের কাছে ধারে আর কারটা তোলাবাজির পয়সায় বোঝা মুস্কিল। সমাজ ব্যাপারটাই তো অনন্ত ঘোলা জল! অতএব এতো কথা বলার কী দরকার?

২০২৪। উবার ড্রাইভার বললো রফা হলে টাকাটা নবান্নর নিচে ছাতুর সরবত বেচে যে লোকটা তাকে দিয়ে দিতে হয়। রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দার কোণে কোণে পান-বিড়ি সিগারেটের দোকান, বিকাশভবনের সিঁড়ির কোণে ঘুগনি রুটি চায়ের দোকানে ঘুষ/তোলা সংগ্রাহকদের নিজের চোখে দেখেছি। তাই নবান্নর নাকের ডগায় ছাতুর সরবতের কথাটা চোখে না দেখলেও, সয়ে নিলাম।

মানে যদি পুরো বিত্তব্যবস্থা একশোভাগ নগদহীন (ক্যাশলেস বলছি) করে ফেলাও যায়। তাতে সারা দিনে ছাতুওয়ালার পাঁচ গ্লাস শরবত বিক্রি হলে সেটাকে পাঁচ হাজার গ্লাস বিক্রি বলে চালানো যায়, তার দোকানে রাখা কয়েক ডজন কিউআর কোডের একেকটা একেক সরকারী বেতনভুকের, তাদের একেক জনের মায়ের, বউয়ের বা বরের, বোনের, ভাইয়ের, ভাইয়ের বউয়ের, বোনের বরের, মামার, মামার ভায়রাভায়ের, পিসের পিসের পিসতুতো ভাইয়ের - আর যতো লোকের হতে পারে সবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যুক্ত হলে, এতগুলো লোক কে কাকে কতো দরে তোলা বাজির অংশ দেবে সেটা বোঝাপড়া হয়ে গেলে, কতোগুলো প্যান-আধার সম্বলিত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের লেনদেনের ওপর নজরদারি করার সময় বা খরচবহন করার ক্ষমতা কার আছে, তাও যদি প্রত্যকটা লেনদেন খুব কম নয়, দু লাখ টাকার কমে খুব খুচরো পরিমাণে হয়?

এই ব্যবস্থাটা একটা সর্বব্যাপী সুদুরপ্রসারী সরকারী-বেসরকারী যৌথ ব্যবসা (পাব্লিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ [পিপিপি])- এ র উদাহরণ ছাড়া আর কী?

নৈতিক চরিত্রটা যেহেতু ঝামা পাথর সেহেতু মাথাটা খুব ব্যাসল্টের মতো (নোড়ার মতো) নিরেট না হলে গোলোযোগ আর যোগাযোগ দুটোই বোঝা খুবই সোজা।

ভুলি নি তো কাউকেই - নির্ভয়াকে, কামদুনির টুম্পাকে, সুসান রডরিগেজকে, তাপসী মালিককে, তারও আগে খবরের কাগজের পাতা জুড়ে গ্রাম বাংলার মাঠে ময়দানে পড়ে থাকা যে সব অনামী নির্যাতিতা নাবালিকা আর সাবালিকাদের কথা লেখা হতো তাদের, ভাবেরি (ভানওয়ারি) দেবিকে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিপোর্টে ছাপা আফ্রিকার কোণে কোণে কুঁকড়ে থাকা নারীদের আর পুরুষদের, পুঁজিবাদী টিভি কোম্পানির তথ্যচিত্রে দেখা আমাজনের জঙ্গলে আর আন্দিজের খাঁজে থাকা নারীদের,আর হ্যাঁ, পুরুষদের  ……… 

তাতে কী? নির্ভয়ার পরে ভারতীয় দন্ড সংহিতা (ইংরেজি থেকে সংস্কৃত ধোওয়া যেকোনো ভাষাতে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডটা অমনই দাঁড়ায়) -তে ধর্ষণের ধারা বিশদে বদলে ফেলা হয়েছে খুব কম সময়ে, নির্ভয়ার অপরাধীরা সাজাও পেয়েছে, তবুও ধর্ষণের ধারা অব্যাহত।

যদিও দিল্লি পুলিশের কাছে নাকি তথ্য আছে কোন এলাকায় কী হারে কতো পুরুষ ধর্ষিত হয়, তবু ব্যাপারটা মেয়েদের ফুটবলের মতো রয়ে গেছে। হয় নাকি? হয় বুঝি? তবে তেমন বিকোয় না তো - 

ক্ষমতা দেখাতে একটা শরীরকে কষ্ট দিলে, একটা জীবনকে শেষ করে দিলে যদি তুষ্টি মতো সাড়া জাগানো যায়, গণমাধ্যমে নাম ও চেহারা প্রচারিত হয়ে নিমেষে সারা পৃথিবীর সাতশো কোটির ভগ্নাংশেরও মনে জায়গা করে নেওয়া যায়, সেটা ঘেন্না হোক আর প্রীতি হোক, পরিচিতি তো বটে। সেটা ক্ষমতার দৌড়ে একটা মস্ত পিক-আপ, ধাঁ করে অ্যাক্সেলেটরে এক চাপে অনেক দূর -

২০১৬-র পরে, ২০২০-র আগে যে সরকারী হাসপাতাল এসিয়ায় সেরা সরকারী স্বাস্থ্যপরিষেবার জন্য পুরস্কৃত বলে তোরণ বানায়, সেখানে কোণে কোণে সারভেইল্যান্স ক্যামেরা নেই? স্পষ্ট দপ্তর আছে তো যৌননিগ্রহের অভিযোগ জানানোর? আসলে তোরণ বানাতে যে সিমেন্ট লাগে সেটা যদি দু বস্তা হয় তবে দুশো বস্তার রসিদ কেটে তোরণের বানানোর কাজে যারা যুক্ত তারা সবাই মিলে টাকাটা ভাগ করে নিলে কেমন হয়? হলো না খাসা পাব্লিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)? সেই জন্যই উন্নয়নের নামে রাস্তা হয় আর তোরণ হয়, নৈতিক চরিত্র বানানোর জন্য পড়ে থাকে ঝামা পাথর।

ওটা দিয়ে কিচ্ছু পরিষ্কার করা যায় না। 

পরিষ্কার করতে গেলে রাস্তার ওপর থেকে ঠেলা, ছাতার তলার দোকানগুলো তুলে দিতে হবে, সমস্ত দোকান কেবলমাত্র নির্ধারিত বাজারে আবদ্ধ করতে হবে। বড়ো রাস্তার ওপরে যে লোকেরা বাজার বসায়, তাদের বাজার বসানো বন্ধ করতে হবে, সমস্ত নির্মাণ প্রকল্প, যতো খুচরোই হোক না কেন, অনলাইন পাব্লিক বিডিং-এ নিয়োগ করতে হবে। আইন করতে হবে অন্তত সাত বছরের জন্য সমস্ত নির্মাণ প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের দায় নির্মাণের কাজ যে সংস্থা করবে তাদের। আর সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা কিংবা পেটসিটি মেসিন সরকারী হাসপাতালে যে যন্ত্রই কেনা হোক না কেন তার সাময়িক রক্ষণাবেক্ষণের চুক্তি (যেমন অ্যানুয়াল মেইন্ট্যানেন্স কন্ট্রাক্ট)-র ও চুক্তি নবীকরণের ব্যবস্থা বার্ষিক খরচের (বাজেটে) বরাদ্দ করতে হবে। 

না হলে যতোই ডিমনিটাইকজেসন হোক, বা যতোই আধার-প্যান লিঙ্কিং হোক না কেন, যতোই প্রধানমন্ত্রী মেট্রো রেলে চড়ে বোঝানোর চেষ্টা করুন না কেন যে জিনিসটা টেকসই, কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না বিধায়কের বরের পুরসভার পুরপিতা হওয়া আর ঐ পুরসভারই বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের নির্মাতা হওয়া আর সমস্ত প্রয়াস ঝামা পাথর দিয়ে চুঁইয়ে ফুরিয়ে যাওয়া কিংবা একেকটা নিউজ সাইক্লে একেকটা রেপড মেয়ের বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়ে সীমাহীন বিপর্যস্ত হওয়া। 

If you cannot read Bangla, just use the translation app on your device or the translator extension on your internet browser to read it in the language you prefer.

JPDA -Chapter 15

 ১৫. উপত্যকা ফুল মাছ



মিন হুয়ে পুরো দস্তুর ঘরে থাকা মেয়ে। এর আগে কখনোই সে পৃথিবীর এতোখানি এতো অল্প সময়ে ঘুরে বেড়ায় নি। তার জন্মের শহর ছাড়া বেজিং-এর উত্তরে আর সাংহাই-এর দক্ষিণে সে কখনো কোথাও যায় নি। 

শিন ছির সাথে এক যাত্রায় হারবিন থেকে কুঁমিং পৌঁছে গেলো কোথাও না থেমে। প্লেন থেকে নেমে, তিন ঘন্টা বাসে চেপে শিংশুই কাউন্টিতে পৌঁছল। দুজনে একটা হোটেলে একটা ঘর ভাড়া নিলো স্টেশনের কাছে। একরাত সেখানেই ঘুমোলো। পরদিন সকালে হোটেলের ফ্রন্টডেস্কের কর্মীর কাছে জানতে চাইলো আঁয়া গ্রামে কিভাবে যাওয়া যায়। 

কর্মীটি জানালো, “খুব দূরে নয়। বাইসাইকেল চড়ে পঞ্চাশ মিনিট।”

“ট্যাক্সি যেতে পারে না?”

“কাছাকাছি কোনো ট্যাক্সি নেই। আপনারা বাইরে রাস্তায় গিয়ে দেখুন না কে যাচ্ছে আঁয়ার দিকে। তাকে কিছু টাকা দিলে সে নিয়ে যাবে না হয় আঁয়াতে আপনাদেরকে।”

দুজনে রাস্তায় নেমে বেশ খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো। এদিকে ওদিকে কয়েকবার ঘুরপাক খেয়ে শেষে একটা ট্রাইসাইকেল পেলো। ট্রাইসাইকেলের মালিক এক বছর পঞ্চাশের কাকু। উনি আঁয়ার দিকে যাবেন, রাজি হয়ে গেলেন মিন হুয়ে আর শিন ছিকে নিয়ে যেতে। শিন ছি ওঁকে একশো য়ুআঁ দিলো। তারপর দুজনে পিছনের সিটের কাঠের তক্তার ওপরে বসে পড়লো, একজন বামে, একজন ডানে, তরমুজের মধ্যে গাদাগাদি করে।

কুড়ি মিনিট চলার পর, ট্রাই সাইকেল সিমেন্টের রাস্তা ছেড়ে বাঁক নিলো একটা মাটির রাস্তায়। 

বাঁদিকে একটা বড়ো সবুজ ধান ক্ষেত। ডানদিকের বিলে কেবল আনাজ। ধান ক্ষেত পেরিয়ে একের পর এক খামার বাড়ি, কালো টালি আর সাদা দেওয়াল দেওয়া, বিশাল বিশাল কলা গাছের আড়ালে।

কাকু একটা ছোট্টো গান গেয়ে চলে ছিলেন গাড়ি ঠেলার সময়। মাটির রাস্তাটা এবড়ো-খেবড়ো। গাড়ির তরমুজগুলো অনেকক্ষণ ধরে পুবে-পশ্চিমে গড়াগড়ি খেলো। যাত্রীরা ভয় পেতো লাগলো এই বুঝি তরমুজে ঠোকা লাগে, এই বুঝি তরমুজ ফেটে যায়। ব্যাপারটা দেখাচ্ছিলো জাগলিং-এ মতো।

দশ মিনিট মতো চলার পর, কাদার রাস্তা ক্রমশ সরু থেকে সরুতর হয়ে গেলো। রয়ে গেলো একটা মেঠো রাস্তা যাতে একজন চলতে পারে মাত্র। সেটাও পুরো জলকাদা ভরা। 

কাকু ট্রাইসাইকেল রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে যাত্রী দুজনকে বললো নেমে পড়তে, “গাড়ি আর আগে যেতে পারবে না। দেখো, সোজা যাবে এই রাস্তা ধরে। কুড়ি মিনিট পরে একটা ঝোপাল, চুড়োওলা জিশান শু দেখবে। গাছটাকে ডানহাতে রেখে ঘুরে যাবে একান্ন পা। সেটাই আঁয়া গাঁয়ে ঢোকার মুখ।”

জিশান শু Yew Tree

রোদ ঝকঝক করছে। মিন হুয়ে একটা চাঁদোয়া খাটাল। তারপর সোজা সামনের দিকে তাকালো। রাস্তার পাশে অনেক বড়ো গাছ। সে জানেও না কোনটা জিতং শু। তার দ্বিধা দেখে কাকু হেসে বললেন, “ঠিক জায়গায় পৌঁছোলে দেখতে পাবে একটা ভয়ানক লম্বা গাছ যাতে লাল রঙের ছোটো ছোটো গুলির মতো ফল ঝুলছে। ফেরার সময়ে এখান দিয়েই ফিরবে। দেখবে অনেক ট্রাইসাইকেল শহরে ফেরত যাচ্ছে। যেকোনো একটাকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে উঠে পড়বে। পয়সা দিলেই সবাই খুশি হয়ে তোমাদের নিয়ে যাবে।”

“ঠিক আছে। ধন্যবাদ কাকু।”

শিন ছি আর মিন হুয়ে গাড়ি থেকে নামার তোড়জোড় করতে করতে কাকু যেনো খানিক ভাবলেন কিসব। তারপর বললেন, “বাদ দাও, আমি তোমাদের খানিকটা পথ এগিয়ে দি।”

“তাহলে এই তরমুজের কী হবে?”

“ও কেউ নেবে না। এই এলাকায় সবাই জানে যে আমি এই তরমুজ চাষ করি।”

কাকু পায়ের জুতো খুলে ছুঁড়ে দিলেন গাড়িতে। মিন হুয়ে আর শিন ছি দুজনের পায়ে সাদা স্নিকার দেখে বললেন, “সামনে একটা ধানক্ষেত আছে। পুরোটা জলে ডোবা। তোমাদের জুতো খুলে নাও, হাঁটতে শুরু করার আগে। না হলে সাদা জুতো কালো হয়ে যাবে।”

দুজনকেই পায়ের জুতো মোজা খুলে ফেলতে হলো। তারপর ব্যাকপ্যাকে গুঁজে দিলো জুতোমোজা। গুটিয়ে তুলে নিলো প্যন্টের পা। তারপর খালি পায়ে হাঁটতে লাগলো জল কাদা ভেঙে।

শিন ছি জানতে চাইলো, “শুশু, আপনিও কী আঁয়া গাঁয়ে থাকেন?”

“হ।”

“একজনের কথা জানতে চাই। হে শিয়ান গু - চেনেন তাঁকে?”

“হ। তার নাম হে সুইগু। যেহেতু সে ভবিষ্যত বলতে পারে, তাই গাঁয়ের লোকে তার নাম রেখেছে ‘হে শিয়ান গু’। গাঁয়েই থাকে। দংতৌতে দ্বিতীয় বাড়ি।”

মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “উনি কী একলাই থাকেন?”

“না, সঙ্গে তাঁর বর থাকে। আমি তাকে ‘শুশু ইয়াও’ বলে ডাকি। ওঁর বাপের বাড়ির লোকজন আর ওঁর ছেলেও গাঁয়েই থাকে।”

কাকুর যেনো মনে হলো জল কাদায় হাঁটতে ভালো লাগে। তার বড়ো বড়ো পা দিয়ে জলের মধ্যে উবু হয়ে বসে পড়লেন প্রায়, “সবাই সেখানেই থাকে, যেখানে তার পরিবার থাকে।”

শিন ছি হাঁটছিলো কাকুর পাশে পাশে, সারা গায়ে কাদা ছিটিয়ে, “আইয়ে হে শিয়ান গু কী আজকাল বাড়িতেই থাকেন?”

“হ্যাঁ। আমি তো গতকালই ওঁর সঙ্গে কথা বলেছি।”

কাকু আড়চোখে একবার শিন ছির দিকে চেয়ে নিলো, “তুমি কী এখানে কেবল ওঁর খোঁজেই এসেছ নাকি?”

“হ্যাঁ। ওঁর থেকে কিছু জানার আছে।”

“উনি একটা এখানকার খাবারের রেস্টুরেন্ট খুলেছেন, গ্রামে ঢোকার মুখে। কখনো সেখানে থাকেন। কখনো বাড়িতে।”

এই সব কথা চলতে চলতেই এক ঝাঁক হাস দমকা উঠে এলো ধানক্ষেতের ভেতর থেকে। মিন হুয়ের পায়ের পাশ দিয়ে হেলে দুলে চলে গেলো। মিন হুয়ে টাল সামলাতে গিয়ে পা দিলো ধানক্ষেতে। শিন ছি ওকে ধরে নিলো ঝটপট।

“হু…” মিন হুয়ের মনে হলো সে যেনো কিছু একটার ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে যেই সে পায়ের তলার জিনিসটা তুলে আনতে গেলো, অমনি একটা মাছ জল থেকে লাফিয়ে উঠলো। মিন হুয়ে লুফেও নিলো মাছটাকে, “এগুলো এখানে কেনো?”

“এতো গুহুয়া য়ু। এক ধরনের পোনা আরকি।”

কাকু হাসলেন, “তুমি জানো না, ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা যায়? মে মাসে মাছের চারাগুলোকে ধানের চারার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। অগাস্টে ধানের শিষ ওঠে আর মাছগুলো সেই ফুল খেয়ে পেকে যায়। বেশ শাঁসালো হয়ে ওঠে। এটাই এই মাছগুলোকে খাবার উপযুক্ত সময়।”

“আমি কোথায় পাবো এটা?”

মাছের চারাটা অন্য লোকের শুনে মিন হুয়ে চটপট চারাটাকে ধান ক্ষেতে ছেড়ে দিলো।

“হে শিয়ান গুয়ের যে রেস্টুরেন্ট এখানে, সেখানে পাবে। তবে এটা একটা বিশেষ পদ। ওঁর ছেলের বউ নিজে রাঁধে। মাছটাকে ভাপায় ঘরে বানানো মজা মটরশুঁটির, সিম কড়াইয়ের দই দিয়ে। দারুণ সুস্বাদু। মনে করে খেও।”

মিন হুয়ে প্রশংসা না করে পারলো না, “ওয়াও! হে শিয়ান গুয়ের পরিবারের সব্বাই বেশ গুণী তো।”

“না সবাই নয়। ইয়াও শুশু খুব কুঁড়ে। চাষের কাজ মোটেই ভালো করে করতে পারে না। মদের নেশায় চুর হয়ে থাকে। ওদের পরিবারের খরচ হে শিয়ান গু আনে বাইরে কাজ করে। মহিলা খুবই বুদ্ধিমতী, সাহসী, দুঃসাহসীও বটে। মুখও চালায় চাবুকের মতো।”

কথা বলতে বলতেই কাকু ওদের এনে ফেললেন হে শিয়ান গুয়ের বাড়ির দোড়গোড়ায়। তারপর মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন।



মিন হুয়ে টোকা দিলো উঠোনের দোরে। তবে বুঝতে পারলো দরজাটা ফাঁকি দিয়ে বন্ধ করা আছে। দরজাটা আলতো হাতে ঠেলে ঢুকে পড়লো উঠোনে। 

মাঝের কংক্রিটের মেঝে ঢাকা পড়ে আছে চিনে বাদামে। তার পাশে একজন বয়স্ক মহিলা একটা দড়ির চেয়ারে বসে আছেন। মহিলার পরনে একটা নীল রঙা শিলিন কাপড়ের জামা। হাতে কয়েক ছড়া রুপোর কাঁকন। চোখ খুলে জিজ্ঞেস করলেন, “কাকে চাই?”

বয়স্ক মহিলা ম্যান্ডারিন বলছেন দেখে শিন ছি আর মিন হুয়ে দুজনেই অবাক হলো। 

“মাপ করবেন, এখানে কী হে সুইগু থাকেন?”

“সে তো আমিই।”

“নি হাও, আইয়ে ।”

হে শিয়ান গু চোখটা কুঁচকে তাকালো। খুব খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো দুই আগুন্তুককে, “কী হয়েছে? কোনো গন্ডগোল হয়েছে কী?”

“তা খানিকটা হয়েছে বটে।” বললো শিন ছি, “আপনার কথা জানতে পেরেছি তং তিয়াঁ হাইয়ের কাছ থেকে।”

“তং তিয়াঁ হাই?”

হে শিয়ান গু বেশ অবাক হলেন, “সে আবার কে? এমন কাউকে তো আমি চিনি না।”

“আপনার হয়তো মনে নেই সব কথা। তেইশ বছর আগে, তং তিয়াঁ হাই তার মামাতো ভাইকে বলে ছিলো আপনার কাছে একটা বাচ্চা দত্তক নিতে ওঁর জন্য। প্রায় দেড় বছরের একটা বাচ্চা?”

“মোটেই না।” হে শিয়ান গু খুব জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন।

“আপনি একটু ভালো করে মনে করে দেখবেন?”

মিন হুয়ে আশঙ্কা করছিলো যে ও বোধ হয় হে শিয়ান গুকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। তাই শান্ত নরম স্বরে বললো, “তং তিয়াঁ হাই বলেছেন, তখন আপনার কাছে দুটো বাচ্চা ছিলো। দুজনেরই বয়স একবছরের বেশি। একটা বাচ্চা ফর্সা আর গোলগাল, অন্য বাচ্চাটা কালো, রোগাসোগা? তং তিয়াঁ হাই ফর্সা বাচ্চাটাকে নিয়ে ছিলো। অন্য বাচ্চাটার কী হলো? আপনার কী মনে আছে কে তাকে নিয়ে ছিলো?”

“কী করে মনে করবো যদি অমন কিছু ঘটেই না থাকে? যত্তসব হাওয়ায় বানানো মন গড়া কথা!”

হে শিয়ান গু হি হি করে হাসলো, “তাছাড়া এসব ব্যাপারে তোমার কী দরকার?”

“হতে পারে যে অন্য বাচ্চাটা আমার ভাই। আমার ভাইকে যখন ছেলেধরারা চুরি করে ছিলো তখন ওর দেড় বছর বয়স। আপনার কী সেই কালো, রোগা বাচ্চাটাকে মনে আছে? সে কোথায় গেছে?”

“কী রোগা, কালো বাচ্চা? আমি আবার জানতে চাইছি।”

গলার স্বরটা ঠান্ডা হতে হতে হিম হয়ে গেলো হে শিয়েন গুয়ের। ভ্রূ আর চোখের নিচের কালো থলির মতো অংশগুলো থরথর করে কাঁপতে লাগলো, “আমি কক্ষণও তোমার ভাইকে দেখি নি। তুমি ভুল জায়গায় এসেছ।”

“আইয়ে, ছিং, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমরা শুধু আপনার থেকে একটা যোগসূত্র খুঁজছি যাতে আমার ভাইয়ের হদিশ করতে পারি।”

“আমি তং তিয়াঁ হাইকে চিনি না। তার মামাতো ভাইকেও চিনি না। আর কোনো দেড় বছরের বাচ্চার কথাও জানি না।”

হে শিয়ান গু চোখ পাকিয়ে, শরীর ঝুঁকিয়ে তার সামনে রাখা ছোট্টো চায়ের পাত্রে একটা চুমুক লাগালেন, “আমি জানি না তুমি কোথা থেকে আসছো … আমি জানি না কোত্থেকে তুমি খবর পেয়েছো … তবে খবরটা নিঃসন্দেহে ভুল।”

“আইয়ে,” হে শিয়ান গু পুরো ব্যাপারটা নস্যাৎ করে দিচ্ছে দেখে শিন ছি খানিক রাগ দেখালো, “আপনি যখন বলবেন না বলেই ঠিক করেছেন, আমাদের পুলিশের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না। পুলিশই না হয় তদন্ত করবে ব্যাপারটার।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও না, যাও। করো রিপোর্ট। পুলিশের আর কাজ নেই যেনো, তারা কুড়ি বছর আগেকার কাসুন্দি ঘেটেছে আর কী … তাদেরকে নিঙড়ে নিতে চাও?”

হে শিয়ান গু যেনো একটা মরা শুয়োর যার ফুটন্ত জলে ছ্যাঁকা লাগার আর ভয় নেই।

“আমাকে ভয় দেখিও না। আমি ভীতু মানুষ। যদি মরে যাই তো তোমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।”

“আইয়ে -”

“শিগগির বেরো এখান থেকে, ফের কক্ষণো আসবি না বলে দিচ্ছি।”

হে শিয়ান গু মেঝের থেকে বাঁশের আগায় লাগানো একটা ঝাড়ু তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শিন ছি ভাবলো যে হে শিয়ান গু হয় তো এবার মারার ভঙ্গীতে তাড়া করতে শুরু করবে। দেখেই ওর মনে হলো যে বুড়িটাকে একটা ঝানু অপরাধীর মতোই দেখতে বটে। মারপিট হলে সে হয়তো মড়ার ভান করে পড়েই থাকবে শিন ছির আর কিছুই করার ছিলো না। ও মিন হুয়েকে জোর করে উঠোন থেকে বার করে নিয়ে এলো।

তারপর পুরো রাস্তাটা দৌড় লাগালো কোনো কথা না বলে। মিন হুয়ের মোটেই ইচ্ছে ছিলো না। হে শিয়ান গুয়ের বেয়াড়া জেদী আচরণ আর কিচ্ছু না বলার গোঁয়ার্তুমি দেখে ও খুবই রেগে ছিলো, “না, আমি ওকে জিজ্ঞসে করবই। ব্যাপারটা এমন করে ফেলে রাখা যায় না।”

এরপরেই মাটিতে পা ঠুকে দাঁড়িয়ে পড়ে, শিন ছির হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। হে শিয়ান গু সম্ভবত উঠোনের দরজাটা এঁটে দিয়ে ছিলো ভেতর থেকে। 

দুজনে পরস্পরের দিকে তাকালো। কপালে জমে ওঠা ঘাম হাতের পিঠ দিয়ে মুছে জিজ্ঞেস করলো, “কী করি এখন আমি?”

“আরেক ইয়াও শুশু ছিলো না?”

শিন ছি বুদ্ধি দিলো, “চল, তাকে জিজ্ঞেস করি।”

দুজনে উঠোনের বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু কেউই বাইরে বেরিয়ে এলো না। তারা ঠিক করলো যে গ্রামে ঢোকার মুখে যে মেঠো রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে যাবে আর জিজ্ঞাসাবাদ চালাবে। 




রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখলো যে তার দরজা খোলা আর ভেতরে কোনো খদ্দেরও নেই।

তার বদলে দেখা গেলো যে ঢোকার মুখে বাঁশের চেয়ারে বসে একটা লোক রসুন ছাড়াচ্ছে। 

একটা টেকো বুড়ো, পাশে মেঝেতে রেডিও আর একটা জগ রাখা। লোকটা রসুন ছাড়ানোর কাজটা মনে হলো উপভোগই করছিলো, পালাগান শুনতে শুনতে, মদ খেতে খেতে।

মিন হুয়ে আর শিন ছি পরস্পরের দিকে তাকালো আর সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, “শুশু!”

“অ্যাই।” বুড়ো লোকটা সাড়া দিলো। সে ভেবেছে যে এরা দুজন বুঝি খাবার জন্য এসেছে। বুড়ো চটপট নিজের বসার চেয়ারটা ছেড়ে ভেতর থেকে উঠ এলো, “এই খেতে চাও তোমরা?”

“এখানে কী গুহুয়া য়ু পাব?”

শিন ছি সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে দিলো, “সয় সসে ভাপানো?”

“হ্যাঁ-হ্যাঁ।” বুড়ো দেওয়ালে ঝোলানো মেনুর দিকে দেখালো, “এই একটাই পদ?”

দেওয়ালে টাঙানো খাবারের ফর্দ দেখে শিন ছি সব থেকে দামী চারটে পদ চাইলো। এক বোতল আরগৌতৌও চাইলো। 

বুড়ো কান এঁটো করে হাসলো, “আমার বৌকে বলছি বানাতে। বসুন, ছিং।”

বেশ খানিকক্ষণ পরে সব কটা পদই বেড়ে দেওয়া হলো। বুড়ো গ্লাসে মদ ঢেলে দিলেন খদ্দের দুজনের জন্য।

মিন হুই মদ নিলো না। এক বোতল ফলের রস নিলো। শিন ছি বুড়োকে একটা চেয়ারে বসিয়ে তাকেও এক পাত্র মদ দিলো, “শুশু, আমার মনে হয় আপনি বেশ ভালোই পান করতে পারেন। বসুন এখানে, আমার সাথে খানিক পান করুন।”

কথাটা শোনামাত্র বুড়োর চোখ ঝিকমিকিয়ে উঠলো। চটপট বসে পড়ে হাতে পানপাত্র তুলে নিলো। 

মিন হুয়ে বাটি আর খোয়ায়জি তুলে দিলো, “ওহ্‌, সে তো বেশ কাজের কথা। শুশুর তো তোর সঙ্গে পান করার কথা নয়। এদিকে আরগৌতৌটা প্রায় পঞ্চাশ ডিগ্রি গরম, আমার আশঙ্কা যে একলা খেলে তুই মাতাল হয়ে যাবি। ভালোই হয় যদি এটা ভাগ করে নেওয়া যায়।”

মিন হুয়ের কথা শেষ হতে না হতেই, বেশ উদ্ধতভাবেই বুড়ো খোয়ায়জি জোড়া নিয়ে বাটির থেকে একটা মাংসের টুকরো তুলে মুখে পুরে দিলো। চিবোতেও শুরু করলো।

“শুশু, সব্জিও খান।”

মিন হুয়ে একটা আস্ত গুহুয়া মাছ বুড়োর পাতে তুলে দিলো, “এখানে অনেক রকম পদ আছে। আমরা সব খেয়ে শেষ করতে পারবো না। আমরা সঙ্গে করে নিয়েও যেতে পারবো না। আপনি কিছু খান না।”’

“হও দ্য, হও দ্য।”

বুড়ো নিজের গ্লাসে মদে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো, “গুহুয়া য়ুটা কেমন? দৌবানজিয়াং আমাদের ঘরে বানানো টোফু। ওটা দিয়ে মাছ রাঁধলে মাছটা বেশ ঝাল ঝাল নোনতা নোনতা হয়। সেটাই সসটার স্বাদ।”

“আসুন শুশু, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।” শিন ছি গ্লাসটা উঁচু করে ধরে এক ঢোকে সবটা মদ গিলে ফেললো। 

“শিয়া শিয়া নি, শিয়া শিয়া নি। আত্মীয় বাড়িতে এসেছো, নাকি কেবল এদিক দিয়ে যাচ্ছো কোথাও?”

কয়েক পাত্তর পেটে পড়তেই, বুড়োর জিভ মোটা হয়ে গেলো, “তোমাদের দেখে শহুরে বলেই মনে হচ্ছে ……”

“আমরা এখানে একজনকে খুঁজতে এসেছি। শুশু, আপনি কী হে শিয়ান গুকে চেনেন? আইয়ে হে?” খানিক ভান করে বললো মিন হুয়ে।

“হে শিয়ান গু? তাকি চিনি নাকি? আরে সেতো আমার বউ গো। তার সঙ্গে কোনো কাজ আছে নাকি তোমাদের? সে তো বাড়িতে। আমি তোমাদের নিয়ে যেতে পারি তার কাছে।”

“তাড়া নেই কোনো। আসুন, আগে খেয়ে নি।” শিন ছি আরেক পাত্তর মদ ঢেলে দিলো বুড়োকে।

মিন হুয়ে চেষ্টা করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। মাথা নিচু করে ভাত খেয়ে চললো।

“ব্যাপার কী, গুনিয়াঁ? কোনো বিশেষ দরকার আছে নাকি আইয়ে হের কাছে? ওকে বলাও যা, আমাকে বলাও তা। ওর সব কথা আমি জানি, ওও আমার সব কথা জানে।”

তারপর টাকে হাত বুলোতে বুলোতে বললো, “তবে তুমি যদি তার কাছে ভবিষ্যত জানতে এসে থাকো, তবে সে কথা আমি বলতে পারবো না।”

“আমি এসেছি আমার ভাইকে খুঁজতে, আমার থেকে বয়সে ছোটো ছিলো ভাই।” মিন হুয়ে হে শিয়ান গুকে যা বলে ছিলো তার সবটাই আবার বুড়োকে বললো, “ব্যাপারটা তো কুড়ি বছর আগেকার। আমার আশঙ্কা বয়স্ক লোকেরা কেউই সে কথা মনে রাখে নি আর।”

বুড়ো চোখ কুঁচকে কী যেনো ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর হাসলো, “আমার মনে আছে। আমার স্মৃতি তাজা। আমি তখন ওখানে ছিলাম। দুটো বাচ্চা - যাকে তং দত্তক নিয়ে ছিলো এসে ছিলো হারবিন থেকে। অন্যজন এসে ছিলো হুয়াইহুয়া থেকে। আমি তো ওদের কৌপিনও বদলেছি।”

চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো মিন হুয়ে, “হুয়াইহুয়া? হুয়াইহুয়া, হুনান?”

“ভুল হলো?”

“না। এটা ভুল হতেই পারে না।”

বুড়ো লোকটা গভীর দীর্ঘস্বাস ফেললো। নিচু গলায় বললো, “তোমাদের আইয়ে পাঁচ বছরে হাজতে কাটিয়েছে ঐ বাচ্চাটার জন্য।”

চতুর্দিকে হাওয়া স্তব্ধ হয়ে গেলো, “কেনো?”

“কেউ একটা ধরা পড়ে ছিলো। সে স্বীকারোক্তি দিয়ে ছিলো। তখন বাচ্চাটা অসুস্থ, মরো মরো প্রায়, ওর জন্য কোনো বাড়ির পরিবারের ব্যবস্থা করতে পারে নি সে। তোমাদের আইয়ে বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ছিলো চিকিৎসা করানোর জন্য। পায়ে একটা হাতের তালুর মাপের জন্মদাগ ছিলো বাচ্চাটার। বাচ্চাটার বাবা-মা খুব তাড়াতাড়ি বাচ্চাটার খবর পেয়ে গিয়ে ছিলো আর কি।”

মিন হুয়ের মন ভেঙে গেলো। সূত্রগুলো আবার ছিঁড়ে গেলো, “তাহলে শুশু, আপনি আগে নিশ্চয়ই গুয়াঁইশির হেচি থেকে কাউকে দেখে ছিলেন আগে। এরকম কোনো বাচ্চা এসে ছিলো কী?”

“না।” ইয়াও কাকু মাথা নাড়লেন। 

“শুশু, আবার আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।”

মিন হুয়ে দরদর করে ঘামতে দেখে, শিন ছি চটপট মদের গ্লাস ভরে ফেললো।

ইয়াও বুড়ো যতো মাতাল হতে লাগলো, দুজনে ততো পুরোনো প্রশ্ন করে যেতে লাগলো। কিন্তু ইয়াও কাকু কিচ্ছু লুকোলো না। যা যা বলার কথা ওর তার সবটাই ও বলে দিলো। প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করলেও একই প্রশ্নে একই উত্তর পাওয়া গেলো। আর নতুন প্রশ্নে অনেক সময়ই সদুত্তর পাওয়া গেলো না। অনেকটাই ইয়াও বুড়ো জানে না বলে মনে হলো ওদের দুজনের। তবে ওরা ততোক্ষণ প্রশ্ন করে গেলো যতোক্ষণ না ইয়াও বুড়ো মদের নেশার ঘোরে অচৈতন্য হয়ে টেবিলের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।

দুজনে হতাশ হয়ে ফেরার পথ ধরলো।

প্রায় আধবোতল আরগৌতৌ খাবার পরে শিন ছির মাথা টলটল করছে। কাদার ওপর সোজা হাঁটার সময় ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে, বেশ কয়েকবার ক্ষেতে পড়ে যাচ্ছিলো বুঝি। ওকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে রাখতে বাধ্য হচ্ছিলো মিন হুয়ে। কেবল নালিশও করছিলো, “তোকেও বলি হারি! মদের আলমারিতে অতো রকমের মদ থাকতে তুই আরগৌতৌ চাইলি কেনো? বিয়ার খেলে কী হতো?”

মিন হুয়ে কথা শেষ করার আগেই, শিন ছি কয়েক দমক বমি করলো। দৌড়ে রাস্তার পাশের বড়ো গাছের নিচে গিয়ে বমি করলো। ওর পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে মিন হুয়ে ওকে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার বাড়িয়ে দিলো যাতে ও মুখ ধুতে পারে।

ক্ষেতের ধানের গোড়ায় বসে দুজনে জিরিয়ে নিলো খানিক। শিন ছি ঠেস দিয়ে বসে ছিলো মিন হুয়ের গায়ে। ওর ঝিমুনি আসছিলো। শিন ছি ঘুমিয়ে পড়ছে দেখে মিন হুয়ে ওকে ঠেলে দিলো ধড়ফড় করে যাতে ও জেগে ওঠে, “শিন ছি, ঘুমোস না। গ্রামের ভিতরে যাবার উপায় নেই। দোকানের ব্যাপারটা ভালো হয় নি, আমাদের তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া উচিৎ। চল, হোটেলে ফিরে যাই, ঘুমোতে যাবার আগে ভালো করে চান করতে হবে। দ্যাখ নিজেকে, তোর পা দুটো সপসপ করছে জলে কাদায়। জোঁক ধরতে পারে, সাবধান!”

এসব বলার পরে মিন হুয়ে টানতে টানতে সোজা পথে নিয়ে যেতে লাগলো শিন ছিকে। পথে পড়লো একসারি বড়ো গাছ যেগুলোর ছায়া খুব ঘন। সেগুলো পেরোতেই পেছন থেকে মোটর সাইকেলের শব্দ পাওয়া যেতে লাগলো। 

পিছন ফিরে দেখা গেলো কালো হেলমেট পরে দুটো লোক মোটর সাইকেলে ধেয়ে আসছে। 

কি হচ্ছে সেটা বোঝার আগেই মিন হুয়ের ব্যাকপ্যাকটা ছিনিয়ে নিলো মোটর সাইকেলের আরোহীরা। আরেকটা লোক মোটর সাইকেল থেকে লাফ দিয়ে নামলো, হাতে তার একটা গাঁইতি। গাঁইতিটা দিয়ে শিন ছির পিঠে মারলো এক রদ্দা।

শিন ছি হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। কিন্তু চটপট উঠে দাঁড়ালো আর একটা পাথর তুলে নিলো মাটি থেকে। ছুঁড়ে দিলো লোকটার দিকে। লাগলো গিয়ে লোকটার হেলমেটে। লোকটা নড়লো না একচুলও। সে কাঠের গাঁইতিটা তুলে নিয়ে ধেয়ে এলো।

শিন ছি গর্জে উঠলো, “দৌড় দে।”




~~~~~~~~~~~~

সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96

Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-14.html

Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-16.html

Readers Loved