সে অনেক দিন আগের কথা। একটা পাহাড়ঘেরা গ্রাম ছিল। পাহাড়ের বুকে ছিল ঘন কালচে সবুজ রঙা জঙ্গল। সূর্য উঠলে তবেই সে সবুজটাকে সবুজ ঠাওর করা যেত। তা সেও শুধু খুব ভোরের ঘন্টা দুয়েক। তারপর পাহাড় বেয়ে নেমে আসত তুলো তুলো মেঘের দল। মুড়ে দিত তুলোর লেপে পাথুরে রাস্তা, পাথুরে ঘর, গোয়ালের গরু, ছাগল, ভেড়া; নৌকা, মানুষ এমনকি গ্রামের দক্ষিণ দিয়ে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীটাকেও।
সেই গ্রামে লোকেরা মুলত: তাঁত বুনত; গরু, ছাগল, ভেড়া পুষত, দুধ আর মাংস বেচত হাটে হাটে; ভেড়ার লোম ছাড়িয়ে পশম তৈরী করত, সেই পশমের গরম জামা বুনে বেচে আসত বড় বণিকের আছে। বণিকের থেকে তারা বরাতও পেত আরও কাজের জন্য।
আর ছিল এক মাঝি, সে থাকত দক্ষিণের নদীর তীরে। সে নদীটা পাড় করে দিত নৌকা নিয়ে। আরও ছিল এক জেলেনী। সে নদীর মাছ ধরে বেচে আসত হাটে হাটে। জেলেনী থাকত মাঝির বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িটাতে। মাঝির আর তার বউয়ের কোন ছেলেপুলে ছিল না। তারা জেলেনীকেই মেয়ের মত দেখত।
এক ঝড়ের রাতে জেলেনী হাটের থেকে ফিরল না। মাঝি আর মাঝি বউ খুব চিন্তা করল অনেক রাত অবধি। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল সারা দিনের ক্লান্তিতে।
পরদিন ঘুম ভাঙতেও দেরী হয়ে গেল মাঝি আর মাঝিবউয়ের। এদিকে হাটুরেরা সব জড়ো হয়েছে ঘাটে। তাদের কানাকানিতে জায়গাটা সরগরম হয়ে উঠেছে। মাঝি ঝটপট তৈরী হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রথম দলকে নামিয়ে দিয়ে মাঝি একটু ইতস্তত করল। কিন্তু কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না। এদিকে মাঝিবউ এসে দাঁড়িয়ে ছিল ঘাটে। তার চোখে চোখ রেখে মাঝি আস্তে আস্তে ঘাড়টা নাড়িয়ে দিল দুদিকে। মাঝিবউ দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে চোখের জল উপছে ওঠার আগে প্রায় ছুটে ঢুকে পড়ল ঘরে। ততক্ষণে পরের হাটুরে দল জড়ো হয়ে গেছে ঘাটে। নৌকা ভিড়তেই সবাই হৈ হৈ করে উঠে পড়ল নৌকায়। দলের এক গয়লানী মাঝিকে জিজ্ঞেস করল, “কাকা, আজ জেলেনীকে দেখছিনা; সে কি কাল ঘর ফেরে নি”?
মাঝি দাঁড়ের ছপাৎ ছপাৎ শব্দ বাঁচিয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ রে মা; কোন খবর জানিস তার?”
গয়লানী বলল, “সে কাল বেলার প্রথমেই সব মাছ বেচে দিয়েছিল এক সরাইখানা মালিককে। তারপর সে মালিকের বওয়ার লোক না থাকায় জেলেনীকেই যেতে হয়েছিল ঝাঁকা মাথায়। তারপর বাজ পড়ছে দেখে আমরা ফিরে এলাম একে একে। তাকে কেউ ফিরতে দেখে নি”।
মাঝি উত্কন্ঠায় চুপ হয়ে গেল। চুপ হয়ে গেল সব হাটুরে। চুপচাপই সবাই নেমে গেল নদীর দক্ষিণপাড়ে।
- ২ -
প্রথম ঝোঁকে পাড়াপাড়ের ব্যস্ততা কমলে, মাঝি ঘরে ফিরে এল। নেয়ে খেয়ে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য।
ভাতের গরাস ধোঁয়া ওঠা শাকের থেকেও গরম। বাইরের বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায় শাক-ভাতের ওম মিলিয়ে যাচ্ছিল মাঝির মুখে। শুধু গলাতেই যেন শক্ত ঢেলা আটকে গেছে। কিছুই নামতে চাইছে না সেখান দিয়ে।
এমন সময় পাহাড়ে ঘুরতে থাকা হু হু হাওয়ায় যেন ভেসে এল কার ডাক। বড় ক্ষীণ, করুণ সে ডাক।
মাঝি মাঝিবউয়ের দিকে চাইল। মাঝিবউ বলল, “তুমি ভাত কটা খেয়ে উঠবে। বাকি আমি দেখছি”।
মাঝি দেখল এক এক লাফে বউ তার পেরিয়ে গেল এক এক গজ; তারপর শুনতে পেল জলে দাঁড় ফেলার শব্দ। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল দাঁড় বাওয়ার শব্দ। ঘরের মধ্যে মাঝি হাত নেড়ে গেল ভাতে, পাতে; আঙুল জড়ো হয়ে মুখে উঠল কিনা টের পেল না মোটে। কানে শুধু দাঁড়ের ছপাৎ ছপাৎ ; বুকের ভিতরে ঢিপ ঢিপ শব্দ।
ঘোর কেটে গেল মাঝিবউয়ের কলকলানিতে। মাঝি দেখল ক্লান্ত জেলেনীর হাত ধরে মাঝিবউ বাড়ি ঢুকছে। পিছনে রঙীন ঝোলা পিঠে এক শহুরে লোক। তক্ষুণি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ল মাঝি। মাঝিবউও জেলেনিকে দাওয়ায় বসিয়ে মাঝিকে বলল, “বাবুকে একটু দেখ; আমি একটা জলচৌকি আনছি”।
বাবু বলে উঠল, “জেলেনী দাওয়ায় বসতে পারে আর আমি পারি না” ?
মাঝিবউ থতমত খেয়ে চুপ করে হাঁ করে চেয়ে থাকে। বাবু আবার বলতে থাকে, “আমি তোমাদের কেউ নই, তবে থাকতে চাইলে তোমার ঘরে তুমি কি তাড়িয়ে দেবে”?
এবার মাঝি জবাব দেয়, “না, না; তাড়িয়ে কেন দেব ? থাক না হয় যদ্দিন খুশি; তা তোমার ঘর কোথায় বাবু”?
“বাবু বোল না , কাকা। আমার নাম গান্ধর্ব। আমি থাকি উত্তরের এক শহরে। এখানে এসেছি তোমাদের দেশের নাটক দেখতে আর শিখতে”।
এর মধ্যেই রান্নাঘর থেকে ভেসে এল মাছ ভাজার গন্ধ। মাঝি গান্ধর্বকে মাঝপথে থামিয়ে দিল। তারপর মাঝিবউয়ের থেকে তেল আর গামছা নিয়ে গান্ধর্বকে নিয়ে গেল স্নানের ঘাটে।
স্নানের পর গান্ধর্ব ফিরতে জেলেনী হেসে কুটোপাটি হয়ে গেল। শহুরে পোষাকের বদলে তখন তার গায়ে উঠেছে মাঝির ভাল ধুতিখানা আর তার ওপর হলুদ- লালে নকশা কাটা আচকান। মাঝিবউয়ের ধমকে জেলেনীর হাসি থামল বটে; কিন্তু যেই তার চোখ যায় সুদর্শন শহুরে বাবুটির দিকে, অমনি তার পেটের ভিতর থেকে ককিয়ে উঠতে থাকে হাসি।
খাওয়া-দাওয়া মিটতে মাঝিবউ জেলেনীকে নিয়ে চলে গেল তার ঘরে। মাঝি গেল ঘাটে। তার ঘরে রয়ে গেল গান্ধর্ব।
রাতের শেষ খেয়া সেরে মাঝি ঘরে এল। খেতে বসে মঝিবউকে জিজ্ঞেস করল, “মেয়ে কিছু বলল ? কোন বিপদ হয় নি তো কাল”?
“আস্তে কথা বল; ঘরে অতিথি আছে”। মাঝি একবার মুখ তুলে চাইল। একটু থেমে মাঝিবউ আবার বলল, “যা বুঝলাম মেয়ে তোমার সরাইখানাতেই আটকে ছিল; মেয়ের মত আরও কয়েকজন আটকে ছিল সেখানে। সন্ধেবেলাও বৃষ্টি যখন থামল না তখন সবাই মিলে আগুন জ্বেলে বসেছিল তার চারধারে। ওদের মধ্যে এসে বাবুটি জোটে সন্ধে শেষের দিকে। বাবুটি ভালো গল্প বলতে পারে। তার গল্পে গল্পে রাত যখন কাবার প্রায় তখন ফুরোয় বাবুর গল্পের ঝুলি। হাল ধরে বাকিরা। ভোর অব্দি চলে গুলতানি। জেলেমেয়ের গল্পে মজে গিয়ে বাবু এসেছে আমাদের দেশ দেখতে”।
মাঝির বুক চিরে কে জানে কেন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সে উঠে পড়ে হাতের শুকনো এঁটো ধুতে। মাঝিবউও সেদিনের মত সংসারের পাট গুটিয়ে ফেলে প্রায় নিঃশব্দে।
শোবার ঘরে অতিথি; তাই কর্তা আর কর্ত্রী দুজনেই শুয়ে পড়ে নিভন্ত উনুনের পাশে রান্নাঘরে। মরা আঁচে, সারা দিনের পরিশ্রমে, আগের রাতের বাকি থাকা ঘুমে দুজনেই চুপ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি।
-৩-
পরদিন ভোরে উঠে মাঝি রোজকার মত গেল খেয়া ঘাটে; মাঝি বউ ব্যস্ত হয়ে পড়ল কন্নায়; ঘরে অতিথি আছে বলে কথা।
কিছু পরে বাবুটি ঘুম ভেঙে উঠে এসে বসল দাওয়ায়। উল্টাতে লাগল একটা পুঁথি। রান্না ঘরে ব্যস্ত মাঝিবউ হঠাৎ খিলখিলিয়ে হাসি শুনে বুঝল জেলেনী এসেছে। তারপরেই জেলেনী চলে এল রান্না ঘরে। ঘুমিয়ে ঝরঝরে হয়ে গেছে মেয়ের চেহারা। টিয়া-রঙা শাড়িখানা পেঁচিয়ে পরে তাকে দেখাচ্ছে বেশ।
মেঝেতে এক ঝুড়ি মাছ বসিয়ে দিয়ে বলল, “অতিথির জন্য তাজা মাছ এনেছি কাকী; কেটে বেছে দেব”?
মাঝি বউ সম্মতিতে ঘাড় নাড়ে। চার হাতে টুক টুক করে সারা হয়ে যায় দিনের কাজ।
দুপুরে খেতে এসে মাঝি বসে রইল খানিকক্ষণ গান্ধর্বর জন্য। কিন্তু তার কাজের ফাঁকের খাওয়ার বেলা পেরিয়ে যেতেও গান্ধর্ব ফিরল না। অগত্যা মাঝি চটপট খাওয়া সেরে ফিরে গেল কাজে। খেয়ে নিল মাঝি বউও। বসে রইল শুধু জেলেনী।
দিনের আলো প্রায় নিভে যেতে গান্ধর্ব ফিরল মাঝির বাড়ি। তার ফেরাটুকু দেখে জেলেনী ফিরে গেল নিজের ঘরে।
মাঝিবউ কি করবে না বুঝতে পেরে গান্ধর্বকে জিজ্ঞেস করল, “দুপুরে তো কিছু খাওয়া হয় নি; এখনই কি খাবেন ? না কি রাতে খেতে দেব”?
গান্ধর্ব ঠোঁটের হাসিটা সারা মুখে মাখিয়ে বলল, “দুপুরে তো মোড়লের ঘরে খুব খেয়েছি; রাতে খেতে পারব কি না জানি না। এখনও আই-ঢাই করছে পেট”।
মাঝি বউ বলে ফেলল, “এদিকে মেয়ে আমার উপোস দিল যে তার অতিথির খাওয়ার চিন্তায়, বিপদের ভাবনায়……”।
শুনেই গান্ধর্ব দৌড়ল জেলেনীর ঘরের দিকে। মাঝিবউ শুনতে পেল শিকল নেড়ে ডাকার আওয়াজ। একটু পরে একলাই ফিরে এলো গান্ধর্ব। তারপর ঝোলার থেকে একটা বাঁশি বার করে বাজাতে লাগল মিষ্টি সুরে।
রাতে মাঝি ঘরে ফিরতে মাঝি বউ তাকে পাঠালে জেলেনীকে ডাকতে। মাঝির সাথে জেলেনী এলে পর শুরু হল রাতের খাওয়ার পালা। গান্ধর্ব বার বার বলতে লাগল এমন তাজা মাছ সে জন্মে খায় নি। মাঝিবউ বলে ফেলল, “মেয়ে আমার অতিথির জন্যই মাছ ধরেছে আজ; বেছে, কেটে রেঁধেওছে নিজে; আর অতিথির কি না পাত পড়ল মোড়লের বাড়ী”!
গান্ধর্ব জবাব দিল, “আমাদের দেশে এমন অতিথি সেবার চল নেই কি না; তাই বুঝি নি যে; কাল থেকে এমনটা হবে না”।
চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল জেলেনী। মাঝিবউয়ের খাওয়া হলে পর জেলেনী তার সাথে হাত লাগালে দিনের শেষটা গুছিয়ে ফেলায়। তারপর ঘরে যাওয়ার জন্য সে যেই পা বাড়ালে গান্ধর্ব বলল, “কাকা আমি ওকে রেখে আসছি”।
মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলে মাঝি আর মাঝিবউ। অতিথির কথার ওপর তারা বলল না কিছুই। অনেক রাত অবধি নদীর কলকল গান ছাপিয়ে, জ্যোৎস্নায় মিশে গেল গান্ধর্বের বাঁশির সুর।
-৪-
আবারও পরদিন ভোরে মাঝি চলে গেল খেয়া ঘাটে; মাঝিবউ লেগে গেল কন্নায়। সে যখন স্নান সেরে সবে আঁচ দিচ্ছিল উনুনে, তখন দমকা হাওয়ার মত জেলেনী এসে একটা বোয়াল মাছ নামিয়ে দিয়ে বলল, “হাটে চললাম কাকী; দুপুরে আমার খাবার রেখ না। রাতে আসব এক্কেবারে”।
তারপর আবার চলে গেল দমকা হাওয়ার মতই। মাঝিবউ একটু থমকে দৌড়ল তার পিছু পিছু। কিন্তু তার নাগাল পেল না মোটে।
ঘরে ফিরে, বাকি সব কাজ ফেলে বাঁধল এক টুকরি পান্তা । টুকরিটা দিয়ে এলো মাঝির কাছে; যদি কোন হাটুরেকে পায় দিয়ে দেবে জেলেনীকে দেওয়ার জন্য। ফেরার পথে দেখল তাঁতীবউ চলেছে হাটে। তাকে বলে বুঝিয়ে দিল মাঝির থেকে জেলেনীর জন্য পান্তার টুকরি নেওয়ার কথা। ফিরে এসে নিশ্চিন্তে লাগল অতিথি সেবায়।
গান্ধর্ব সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর বেরল ঘর ছেড়ে। ফিরল রাতে, খাওয়ার সময়। চারজনে জমিয়ে আড্ডা দিল রাতে ঘুমোতে যাওয়া অব্দি।
মাস দুয়েক এরকমই কেটে গেল। এক একদিন গান্ধর্ব দুপুরে বেরোত ঝোলা কাঁধে; সন্ধে পার করে ফিরত; কখনও একা; কখনও জেলেনীর সাথে।
এরকমই একদিন জেলেনী ফিরে এলো; কিন্তু গান্ধর্ব ফিরল না। সেদিনও না; পরদিনও না; তারপর দিনও না।
-৫-
এরমধ্যে রোদের বেলা কিছু বেড়েছে। শীতের কামড় কমে এসেছে। প্রকৃতি বদলে চলেছে নিয়ম মাফিক। নিয়মে ফিরে গেছে মাঝি, মাঝিবউ, জেলেনীর জীবন।
কেটে গেল আরও মাস দুয়েক। বসন্ত সবে ছুঁয়েছে পাইন, দেওদার, ওকের শরীর। মাটির বুক ছোঁওয়া লতা-গুল্মে শিরশিরানি ধরেছে ফুল ফোটার অপেক্ষায় । জেলেনীও টের পেল অনিবার্্য প্রাকৃতিক সম্ভাবনাটা।
কখনও তার অহঙ্কারে মাথা ঝিম হয়ে যেতে লাগল; কখনও অকল্পিত আগমনের আনন্দে হতে লাগল শিহরণ; কখনও আগামীর যত্ন আর সুরক্ষার চিন্তায় বিহ্বল হয়ে পড়তে লাগল; কখনও অপরিচিত ভবিষ্যতের ভাবনায় হয়ে উঠল ব্যাকুল ।
এতসব বৈচিত্র্যের কোনটাই মাঝিবউয়ের চোখ এড়াল না।
এক অলস দুপুরে জেলেনী নিজেই খবরটা দিল মাঝিবউকে। সংসারী মাঝিবউয়ের প্রতিক্রিয়ায় শুধুই বাস্তব ধরা পড়ল। কি হবে জেলেনীর পিতৃহীন সন্তানের পরিচয় ? কেই বা সেই জন্মমূহুর্তকে সফল করে তুলবে নিষ্কলঙ্কতায় ?
দিনের পারানীর হিসেব মিলিয়ে মাঝি ঘরে ফেরার পর তাকেও জড়িয়ে ধরল অস্বাভাবিক নৈশঃব্দের অস্বস্তি। অবশেষে, অস্থির দূর্ভাবনায় বাক্হারা দুই নারীকে সিদ্ধান্তের পাড়েও পৌঁছে দিল মাঝি অনায়াসে, অক্লেশে। উনুনের আঁচের রক্তিম আভায় গাভীর্্য ঘনিয়ে ওঠা রাতটুকু উষ্ণতর হয়ে তিন জনকে বাঁধল ঘনতর বিশ্বাসে । সেই রাতই মুখর হয়ে উঠল দুই নারীকে স্বপ্নে আপ্লুত করে।
-৬-
সপ্তাহ খানেক বাদে, এসে পৌঁছল মাঝির ভাগ্নে।
মাঝি তার বউ আর জেলেনীকে নিয়ে রওয়ানা দিল মাঝিবউয়ের বাপেরবাড়ীর দেশে। ভাগ্নে নৌকা বাইবে মাঝি ফেরা অবধি।
ভাগ্নেকে জনে জনে জিজ্ঞেস করতে লাগল মাঝিবউয়ের দেশের খবর সব ভাল তো ? হঠাৎ এত বছর পরে মাঝিবউ কেন গেল বাপের ঘরে ?
ভাগ্নে খানিক লজ্জা পেত প্রথম প্রথম; পরে অভ্যেসে জবাব দিত, “মামীর কি না খোকা হবে; তাকে এমন সময় দেখবে কে ? তাই মামা তাকে বাপের ঘরে রাখতে গেছে”।
“আর জেলে মেয়ে কেন গেল তাদের সাথে”?
“এতখানি পথ! মামা একলা সামলাবে কি করে মামীকে, যদি কোন দরকার পড়ে ? কাছে একটা মেয়েমানুষ থাকা ভাল নয় কি”?
সম্মতিতে কিংবা ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাড় নেড়ে নেড়ে চলে যায় কৌতুহলী জনতা।
আবার দিন পনের পরে, মাঝিকে ঘাটে পেয়ে কেউই সম্বর্ধিত করতে ভোলে না। আরও কৌতুহলে কেউ কেউ জানতে চায়, “জেলেনীকেও কি রেখে এলে নাকি সে দেশে, তার কাকীকে টাটকা মাছের ডবকা খাওয়াবে বলে”?
মাঝিও ঝলমল করে হেসে জবাব দেয়, “সে দেশে তো আমার বুড়ি শাশুড়ি ছাড়া আর কেউই নেই; তা এই অবস্থায় বুড়ো মানুষের অভিজ্ঞতা আর জোয়ান মেয়ের তৎপরতা দুটোই জরুরী কি না”।
আবার শীতের মুখে ভাগ্নে সামলাতে লাগল নৌকা; মাঝি গেল শ্বশুরের দেশ।
মাসখানেক পরে মাঝি ফিরল শুকনো মুখে। তাঁতীবউ, গয়লানী আর চেনা যত মেয়েমানুষ সবাই ঘিরে ধরল মাঝিকে, কৌতুহলে, সমবেদনায়।
শুকনো ভাঙা গলায় মাঝি বলল, “আমার এক মেয়ে এলো; আরেক মেয়েও সাথে সাথেই গেল”।
তারপর হতবাক শ্রোতাদের মৌনীর মূহুর্তটুকুতে নিজের শোকসন্তপ্ত মন সামলে নিয়ে বলল, “জেলে মেয়ে আমার অনেক করেছে; কাকীর যত্ন করতে করতে নিজের কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিল; নতুন ঠাণ্ডাটা সহ্য হল না তার; মেয়ের জন্ম হতেই সে জ্বরে পড়ল; আর উঠল না”।
প্রত্যাশিত ভাল আর অপ্রত্যাশিত খারাপ দুটো খবরের কানাকানিতে কেটে গেল আরও মাস তিনেক।
নতুন কাঁথায় মোড়া শিশুকন্যাকে নিয়ে ঘরে ফিরল মাঝি বউ।
ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়ে বউ আসে মেয়েকে দেখতে; ফেরার সময় কানাকানি চলে, “অমন ফুটফুটে মেয়ের গায়ে কেমন আঁশটে গন্ধ! যেন মানুষের নয়, মাছের বাচ্ছা!
বলে, আর গা ঠেলাঠেলি করে হাসে। মোড়ল মেয়ে দেখতে এসে বলল, “কী নামে ডাকো মেয়েকে, মাঝি”?
মাঝি বলে, “সেই দেশে পণ্ডিত নাম রেখেছেন সত্যবতী”।
হা হা করে হেসে ওঠে মোড়ল, “আমরা ডাকব মৎস্যগন্ধা নামে”।
-৭-
তারপর কেটে গেল অনেক বছর। বদলে গেছে অনেক কিছু। সেদিনের সেই নদীর দক্ষিণপাড়ে পাহাড়ের মাথা সমান করে তৈরী হয়েছে একটা বিশাল ইমারত। সেখানে দেশ বিদেশের মানুষ এসে ভীড় করেছে। বেড়ে গেছে গ্রামের দুধ, সব্জি, মাছ, মাংস, পশমের বিক্রিবাটা।
ইমারতটা একটা গবেষণা, পড়াশুনার জায়গা। সেখানে নিখরচায় পশুর, গাছের, মাছের এবং অবশ্যই মানুষের রোগের ওষুধ পাওয়া যায়। দেশের লোকের সাথে ইমারতের মানুষ জনের পড়শীর সম্পর্ক।
মাঝি ইমারতে মাছের জোগান দেয়। মাছ ধরে তার ভাগ্নে। আজকাল আর নৌকা বাইতে লাগে না। কাঠের একটা পুল হয়েছে। নদীর ওপর। পুলের মাথায় লেখা আছে যমুনার সাঁকো। মাঝির দেশকে ইমারতের লোকেরা ডাকে যমুনাপুর বলে।
মাঝেমধ্যে কাশির ওষুধ নেওয়ার সময় মাঝির চোখ কড়কড়িয়ে ওঠে। কেবলই ভাবে মাঝিবউ বেঁচে থাকতে এতসব হলে বেচারীকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হত না।
বদলায় নি শুধু সত্যবতীর গায়ের গন্ধ।
সে আজকাল বাবার আদেশে ধর্মে মন দিয়েছে। সারাদিন পুলের নীচে নৌকা নিয়ে বসে থাকে। যেখানে যমুনা বাঁদিকে ঘুরে দক্ষিণমুখী হয়েছে , সেখানে একটা চর জেগে উঠেছে। সেই চর থেকে বসন্তের রোদ ঝলমল সকাল-দুপুরে চারপাশের জঙ্গলা পাহাড় ভারি মিষ্টি দেখায়। সত্যবতী পুলের তলা থেকে চরে বেড়াতে যাওয়া লোকেদের পারাপার করে পূণ্যের লোভে।
তার শেষ কৈশোরের বাড়ন্ত শরীরটায় ক্রমশ ফুটে উঠছে সৌন্দর্যের উত্তরাধিকার। তার দিকে চোখ পড়লে মাঝির কিছু আফশোষ হয়; হয় কিছু ভয়। আর মাঝিবউয়ের বাপের দেশের পণ্ডিতের ভবিষ্যবাণী মনে পড়লে খানিক হাসিও পায়। পণ্ডিত বলেছিল এ মেয়ের ছেলে নাকি রাজা হবে। রাজার ছেলেই রাজা হয়; এ দেশে তো কোন রাজাই নেই; দূর দেশ থেকে যদি কেউ আসে, যদি মেয়ের রূপে মুগ্ধও হয়, সে কি সইতে পারবে মেয়ের গায়ের গন্ধ ? বুকের ভেতরটা কিছু উথাল-পাথাল করে ওঠে মাঝির।
- ৮ –
বসন্ত তখন যাই যাই করছে। সত্যবতীর নৌকা তখন ইমারতের ছাত্রদের প্রায় নিত্য ভ্রমণসঙ্গী হয়ে উঠেছে। সত্যবতীর-ও খানিক নেশা হয়ে গেছে নিত্যকার এই নৌকা বাওয়ার। কতটা ধর্মভাবে, কতটা যৌবনের বেড়া ভাঙার তীব্র আকর্ষণে, সেটা নিয়ে মাঝির সন্দেহ হয়। বার বার সাবধান করে দেয় মেয়েকে; কিন্তু মায়ের মত স্পষ্ট করেও বোঝাতে পারে না আশু বিপদটা ঠিক কী। কিছু দ্বন্দ ঘনিয়ে ওঠে বাপ-বেটির মধ্যে।
এই সময়ে একটা মেঘলা দিনে সত্যবতী নৌকা নিয়ে বসেছিল সাঁকোর দক্ষিণ প্রান্তে। ছাত্রদের যাতায়াত সেদিন নেই মোটে। সত্যবতী ভাবছিল চলে যাবে কি না। এমন সময় একটা লম্বা লম্বা গোঁফ- দাড়িওয়ালা লোক এল ঘাটে, চড়ে বসল নৌকায়; চরে যাবে বলে।
বাঁকের কাছাকাছি পৌঁছে লোকটা সত্যবতীকে গাঢ় গলায় ফিসফিসিয়ে ডাকল, “কাছে আয়”।
সত্যবতীর বুকটা ছাঁৎ করে উঠল; ভয় ভয় করতে লাগল মাঝির শাসানির; অন্য দিকে অজানা কিছু একটা ঘটতে চলেছে আঁচ করে মনের মধ্যে কী হয় কী হয় উথাল-পাথাল। দোলাচলে কাঁপা গলায় সে বলে ফেলল, “আমি যেতে পারি, কিন্তু জানতে পারলে বাবা আস্ত রাখবে না আমায়”।
গোঁফ-দাড়ির ফাঁকে ঝিকমিকিয়ে হেসে উঠল লোকটা; বলল, “আমার নাম পরাশর; আমি ওপরের ইউনিভার্সিটিতে পড়াই; তোর বাবা আমাকে চেনে”।
পরাশরের আকর্ষণ আর লোকলজ্জার ভয় – দুয়ের টানাটানিতে পড়ে, সত্যবতী হাতড়ে বেড়ায় একটা বাধ; বলে ওঠে, “আমার গায়ে যে ভীষণ আঁশটে গন্ধ; তোমার ভাল লাগবে না………”- তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয় পরাশর, “সেটা তো আমি নৌকার এই মাথাতে বসেও পাচ্ছি; তুই কি ভাবিস গন্ধ কেবল কাছের লোকে পায়”?
স্রোতের মুখে কুটোর মত ভেসে যেতে থাকে সত্যবতী। দাঁড়ে রাখা হাত অবশ হয়ে পড়ে; ঘোর লাগা চোখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকা পরাশরের দিকে; নৌকা হালকা হালকা দোল খেতে থাকে। দু হাতের তালুর মাঝে সত্যবতীর ঝুঁকে পড়া মুখটা পরাশর তুলে ধরতে অস্ফুটে একবার বলে ওঠে সত্যবতী, “নদীর মাঝে; সবাই দেখতে পাবে যে”!
“ম্ম্ম্ম্হঁ; দেখ না কেমন তোকে ঢেকে দি মেঘের চাদরে”! আশ্বাস দেয় পরাশর।
সত্যবতীর অবশ ঘাড় হেলে পড়ে তার কাঁধ ঘিরে থাকা পরাশরের বলিষ্ঠ হাতের ওপর; পরাশর অন্য হাতে ধরে নেয় দাঁড়; ধীরে ধীরে নৌকা বেয়ে নিয়ে যায় নদীর বুকে নেমে আসা মেঘের গভীরে; একসময়ে দুজনেরই চোখ জুড়ে যায় আবেশে। নৌকাটা মেঘের মধ্যে হালকা দোল খেয়ে খেয়ে পাক খেতে থাকে।
অনেক্ষণ পরে মেঘ সরে গেলে নরম রোদে দুলতে থাকে নৌকা। দুজনে চলে যায় নৌকার দু মাথায়। একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক; চকিত লজ্জায় থেকে থেকেই চোখ সরিয়ে নিতে থাকে সত্যবতী। পরাশর নির্নিমেষে দেখতে থাকে তার হাতে কিশোরী থেকে সদ্য যুবতী হয়ে ওঠা মেয়েটাকে।
ঘাটে পৌঁছে পরাশর পারানী দিতে গেলে নেয় না সত্যবতী। মৃদু স্বরে পরাশর বলে যায়, “আর কয়েক দিন মাত্র, সোনা; তারপরেই তো আঁশটে গন্ধ চলে যাবে”।
চমকে উঠে সত্যবতী ফিরে তাকিয়ে দেখে পরাশর তারই মধ্যে চলে গেছে অনেক দুর।
এবং সত্যবতী একলা হয়ে প্রথম টের পেল শরীরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা নতুন অনুভূতিগুলো।
একটা ভয় চেপে ধরলঃ “যদি সব্বাই টের পেয়ে যায়?”
একটা আকুলতা ছেয়ে গেল মনে ঃ “ কি হবে এরপর?”
একটা পাপবোধ কুরে কুরে খেতে লাগল “ কি মুখে দাঁড়াব বাবার কাছে ? বার বার মানা করেছিল……… বুঝিই নি ভাল করে; শুনলামও না সে নিষেধ;”
একটা অভিযোগ তৈরী হলঃ “বাবাও তো স্পষ্ট করে বলে নি কিছুই……”
একটা প্রত্যয় তৈরী হলঃ “আঁশটে গন্ধটাও কেউ ভালবাসে।”
একটা শিহরণ তৈরী হলঃ “কী যে পেলাম!”
অমনি সারা মন জুড়ে রিনরিনিয়ে উঠল নতুন সুর; খুশিতে মাতাল সুর; চঞ্চল ছন্দে বাধা উত্তাল সুর।
-৯-
পরের দিনটা রোদে ঝলমল করছিল। সাজেগোজে আরো বেশি ঝলমল করছিল সত্যবতী। মনের মধ্যে তিরতিরিয়ে বয়ে চলা আনন্দের স্রোতটা কিছুতেই আটকাতে পারছিল না সে। হতে পারে বাবা কিছু টের পায় নি তাই; হতে পারে কেউ কিচ্ছু টের পায় নি তাই; কতবার সে চেষ্টা করছে গলার কাছে উথলে ওঠা খুশিটা গিলে পেটের মধ্যে পাঠাতে, কিন্তু পারছেই না।
দুপুর ঢলে যাচ্ছে বিকেলে। কত লোক এল গেল। সে এখনও এল না যে! অস্থির হয় সত্যবতী।
সন্ধের তারা ফুটল একে একে আকাশে। তবুও সে এল না যে। এবার খুশির তিরতিরে স্রোতটা যেন একটু থমকে যায়।
মাঝির ডাকে ঘরে ফিরে যায় মেয়েটা।
গলার কাছের ঢল ঢল খুশিটা কখন যেন একতাল দুঃখ হয়ে নেমে আসে নাকের দুপাশে গরম জলের ধারা হয়ে।
তারপর দিন দুপুর নাগাদ খুব খানিক শিলাবৃষ্টি হল। সত্যবতী পুলের নীচে নৌকায় বসে বসে কেবল ভাবছিল একবার যদি সে আসে; ঝিকমিকিয়ে হাসে উশকো-খুশকো গোঁফ-দাড়ির ফাঁকে। ভাবছিল পর দিন বাবার সাথে মাছ নিয়ে উপরে গেলে কেমন হয় ? সে তো বাবা নিয়ে গেলে তবেই না…। যদি কাশির ওষুধ আনার জন্য যায় ? হয় তো বাবা সঙ্গে যাবে; তবে গেলেই যে তাকে পাবে; পেলে যে দুটো কথা বলা যাবে তাতো নয়। আবার ভাবে সে তো নিজেই এসেছিল; ডাকতে তো হয় নি। আবার আসার হলে হয়তো নিজেই আসবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধে নামল; সত্যবতী নিজেই ফিরে গেল ঘরে।
তারপর দিন একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল ভোর ভোর। তারপর ঘন নীল আকাশ আর ঘন সবুজ পাহাড় ঝক ঝক করে উঠল রোদে।
দুপুরের দিকে পরাশর যমুনার সাঁকো পেরিয়ে গ্রামে গেল। যাওয়ার সময় সত্যবতীকে জিজ্ঞেস করল, “সুয্যি ডোবার পর কি থাকতে পারবি ? নিয়ে যেতে পারবি চরে” ?
সত্যবতী এত অবাক হল ঘটনার সহজতায় যে স্পষ্ট করে কিছু বলতেই পারল না। ঘাড়টা কোনমতে একটু নাড়ল; তারপর রাজ্যের লজ্জা এসে নুইয়ে দিল তার মাথা। ঘোর কাটলে সে তাকিয়ে রইল গ্রামের দিকে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে দুলতে লাগল তার মন ঃ পরাশর সত্যিই এসেছিল কি?
শেষ বিকালে একদল ছাত্রকে নিয়ে সত্যবতী গিয়েছিল চরে। মেঘের গায়ের সব রক্তাভা মুছে বিকেল ফুরিয়ে গেল। সন্ধে নামল ছাই রঙা আকাশ বেয়ে। চঞ্চল হয়ে উঠল সত্যবতী ফেরার জন্য।
ফিরতি পথে ছাত্ররা একথা সেকথার পর অভ্যেস মত সত্যবতীকে উত্ত্যক্ত করতে লাগল; যত না তার সুন্দর চেহারার জন্য, তার থেকেও বেশী তার গায়ের গন্ধের জন্য। অন্যদিন সত্যবতী প্রতিবাদ করে; আজ সে বড় শান্ত হয়ে আছে; কিছুটা প্রত্যয়ে; কিছুটা প্রতীক্ষায়।
নৌকা ঘাটে ভিড়তে ছেলেরা নেমে গেল; নামার পর কেউ কেউ সেদিন ঢিলও ছুঁড়ছিল সত্যবতীকে লক্ষ্য করে; সত্যবতী কিছুই নজর করল না। সে কেবলই ভাবছিল সত্যি পরাশর আসবে কি না।
ছেলেদের হল্লা দুরে মিলিয়ে যেতে সত্যবতী বুকভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ঘরে ফেরার তোড়জোড় শুরু করল। ঠিক তখনই নৌকায় এসে বসল পরাশর। প্রাণপণে অভিমান লুকিয়ে সত্যবতী বলার চেষ্টা করল যে সে যেতে পারবে না এই সময়; তার দেরী দেখলে মাঝি চিন্তায় পড়বে। হাসতে হাসতে তাকে আশ্বস্ত করল পরাশর যে মাঝিকে সে আগেই বলে রেখেছে এই যে সন্ধেবেলা তার চরে যেতে লাগবে; সত্যবতী যেন থাকে ঘাটে।
সত্যবতীর কিছু দ্বিধা আর সন্দেহ হতে লাগল এই অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে। বাঁক পেরিয়ে চরের দিকে যেতে যেতে তার সব সন্দেহ দুর করে দিল পরাশর।
তারার আলোয় সত্যবতীর চেনা চর মোহময় অচেনা হয়ে উঠল।
পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। সত্যবতী চরেই রাত কাটানোর বায়না শুরু করল। পরাশর তাকে ভবিষ্যতের কোন এক রাতের প্রতিশ্রুতিতে ভুলিয়ে নিয়ে ফিরে চলল।
সারা পথ তারা মশগুল হয়ে কাটিয়ে দিল কি করে তারা রোজ কাছাকাছি হতে পারে তার জল্পনায়।
এভাবেই কাটিয়ে দিল তারা কয়েকটা পূর্ণিমা রাত, কৃষ্ণা চতুর্দশীর সন্ধে, আর অজস্র মেঘের আড়ালে ঢাকা দুপুর।
- ১০ –
প্রথমে পরাশরের নজরেই এল পরিবর্তনগুলো। একথা সেকথা দিয়ে সে সত্যবতীর কাছ থেকে আদায় করল জরুরী কিছু তথ্য। তারপর খুব আদরে সোহাগে মিশিয়ে রাজি করল মেয়েটাকে তার পরিকল্পনা মত চলতে। তারও পরে সেদিনের মত তারা দুজনে চলে গেল যার যার ঘরে।
কয়েকদিন পর বেলাবেলি পরাশর গেল মাঝির ঘরে। সত্যবতী তখনও নৌকা নিয়ে ধর্মোদ্যাপণে মগ্ন। মাঝিকে সরাসরি বলল পরাশর, “মাঝি, মেয়ে তোমার রাজরানী হবেই”।
মশকরা কি না বুঝতে না পেরে মাঝিও বলল, “বলছ আচায্যি”!
স্বরে আরও একটু গাম্ভীর্য ঢেলে পরাশর বলল, “হ্যাঁ, আমি দেখেছি ওর ভাগ্যরেখা। কিন্তু ওর গায়ের দুর্গন্ধের একটা চিকিৎসা করাতে হবে। তার ওপর মেয়ে তোমার লেখাপড়া কিছুই শেখে নি; রাজকীয়, শহুরে আদব-কায়দাও কিছু জানে না”।
পরাশর আরও কিছু বলার আগেই মাঝি বলে উঠল, “তা হলে আর রাজরানী হবে কি করে ? কিন্তু ভাবালে আচায্যি; গায়ের দুগ্গন্ধ না গেলে ওকে যে দেশে ঘরেও কেউ নেবে না” !
পরাশর আশ্বস্ত করে মাঝিকে, “গায়ের গন্ধের একপ্রস্থ চিকিৎসা করেছি; বাকিটা এখানে হবে না। এখান থেকে শতেক যোজন দুরে এই যমুনা নদীতেই একটা দ্বীপ আছে; সেখানে সন্যাসিনীদের আখড়া আছে। সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থাও আছে। যদি তোমার মত থাকে তবে সত্যকে আমি সেখানে রেখে সারিয়ে তুলতে পারি”।
অবাক মাঝির স্তব্ধতায় পরাশর আরও বলল, “সেখানে মেয়ে তোমার রাজরানী হওয়ার মত পড়াশোনাও শিখে নেবে চিকিৎসার সময়টুকুতে; আর আদব-কায়দাও শিখে নেবে দরকার মত”।
এবার মাঝি একটু চিন্তায় পড়ল, “রাজি হবে মেয়ে আমাকে ছেড়ে এত দূরে যেতে! জম্মে থেকে কোন দিন থাকে নি যে আমাকে ছেড়ে” !
পরাশর বললে, “কথা বল মেয়ের সাথে; হয়তো এই বয়সে বাইরে যাওয়ার নাম শুনলে মূহুর্তে রাজি হয়ে যাবে। যে মেয়ে তোমাকে সব বলত, সে তো এত দিনেও তোমাকে বলে নি আমার হাতে তার চিকিৎসার কথা ; হয়তো অবাক করে দেবে ভেবেই; মেয়ে তোমার বড় হয়ে গেছে; বুঝিয়ে বল। রাজি হয়ে যাবে বলেই আমার মনে হয়”।
আশা নিরাশায় দোলে মাঝির মন।
পুল পেরিয়ে ফেরার পথে পরাশর সত্যবতীকে দিয়ে যায় একটুকরো হাসি। বিশ্বাস গাঢ়তর হয় সত্যবতীর।
সেদিন সন্ধেবেলা মাঝি সত্যবতীকে বোঝাতে বসল। যেহেতু মানসিক প্রস্তুতি ছিলই সত্যবতীর, সেও রাজি হতে বেশী সময় নিল না।
সপ্তাহ খানেক পরে পরাশর নিয়ে চলল সত্যবতীকে যমুনার নির্দিষ্ট দ্বীপে।
- ১১ –
সারা পথেই সত্যবতীর জন্য ছড়ানো ছিল অপার বিস্ময়। একটা জগৎ যেখানে কোন দিন সে উঁকিও দেয় নি, তার প্রত্যেকটা বাঁকে বাঁকে চেনা আকাশের রংটাও নতুন লাগছিল তার। একটা খুশির আবেশে ভেসে যাচ্ছিল সে। ফুল, পাখি, প্রজাপতি আর গন্তব্য দ্বীপ নিয়ে সে অসংখ্য প্রশ্ন করে চলেছিল পরাশরকে।
পরম মমতায়, ধৈর্যে পরাশর উত্তর দিয়ে চলেছিল। কিন্তু সেও শঙ্কিত ছিল অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটার আচম্বিত আগমনের আশঙ্কায়।
অবশেষে তারা পৌঁছে গেল দ্বীপে। ছেলেবেলায় মা হারানো মেয়েটা সন্যাসিনীদের বাৎসল্যে বাক্রহিত হয়ে পড়ল। কখনই তার মনে হল না যে একটা অচেনা পরিবেশে এসে পড়েছে। খুব তাড়াতাড়ি সে মিলে মিশে গেল সন্যাসিনীদের আখড়ায়। তার কুমারী জীবনের আশু সন্তান নিয়ে কোন কটুকথা আলোচনা হল না সেখানে ; এতে সে আবারও অবাক হয়ে গেল তার আকৈশোরের সংস্কার বশে। সে আরও অবাক হতে লাগল এই ভেবে যে তার বাবার কাছ থেকেও তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে তার যে প্রথম সন্তানের অস্তিত্ব, এই আখড়ায় সে সন্তান কী ভীষণ অভিপ্রেত!
সত্যবতী স্বাক্ষর হলে তার হাতে লেখা চিঠি নিয়ে পরাশর চলল যমুনাপুর। সে রওয়ানা হওয়ার মুখে সত্যবতী প্রথম জানতে চাইল যে পরাশর আর আসবে কি না আখড়ায়।
পরাশর খুব তৃপ্ত হল সে প্রশ্নে; যা হোক অজ যমুনাপুরের মাঝির মেয়ে শহুরে হয়ে উঠছে; সন্দেহ করতে শিখছে পারিপার্শ্বিক মানুষের অভিপ্রায়। তারপর সে সত্যবতীকে বার বার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে গেল যমুনাপুর।
শিক্ষায়, সুচারুকলায় দিনে দিনে পারদর্শী হয়ে উঠতে লাগল সত্যবতী। নতুন আচার আচারণেও সে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল ক্রমশ।
খুব মেঘলা দিনে তার মন কেমন করে উঠতো যমুনাপুরের জন্য। তারাভরা আকাশের নীচে শুয়ে আশ্লেষ জমে উঠত তার বুকে ফেলে আসা চরযাপণের। তারপরই আশঙ্কা হত তার যে সে আর কখনও ফিরবে না যমুনাপুরে। সন্তানকে নিয়ে এখানেই থেকে যাবে সন্যাসিনীদের মাঝে। লোকলজ্জা এড়াতে আর দেখা হবে না জীবনের প্রথম প্রিয়জন - বাবার সাথে।
আবার আবেগ ছাড়িয়ে বিষয়ী হয়ে ওঠে ভাবনায়। গ্রামে ফিরলে তার সন্তান শুধু অগৌরবই পাবে; হারিয়ে যাবে হয়তো অমনুষ্যত্বে। এই দ্বীপের আখড়ায় শিক্ষিত হলে আচার্য সন্তান হয়তো বিদ্বান হবে। মা হয়ে নিজের সন্তানের শুভ কামনায় মাঝিকে আর গ্রাম ছেড়ে থাকার কষ্টটুকু মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সত্যবতী।
প্রসব কাল ঘনিয়ে এলে পরাশর উপস্থিত হয় দ্বীপে। ব্যবস্থা করে জটিল কিছু অস্ত্রোপচারের।
সত্যবতী কিছুদিনের মধ্যেই জন্ম দেয় দ্বৈপায়নের। ছেলের এমনটাই নাম রাখে পরাশর।
কয়েক দিন পরে, পরাশর সত্যবতীকে বলে গ্রামে ফেরার কথা। খানিক অবাক হয়েই সত্যবতী জিজ্ঞেস করে পরাশরকে, “কিন্তু আমাকে বিয়ে করলে যে তোমার কাজ চলে যাবে! তুমি জাতিচ্যুত হবে, সমাজচ্যুত হবে”!
পরাশর বুঝিয়ে বলে, “সত্য, সোনা মেয়ে, শোন আমার কথা; আমি আর যমুনাপুর ফিরছি না। তোর রূপ তোকে রাজরানী করবে; আর তোর গন্ধই তোর রাজাকে তোর কাছে নিয়ে আসবে; বদলে দিয়েছি না গন্ধ” ?
কাতরে ওঠে সত্য, “আর আমার ছেলে ? চাই না আমার রাজা” –
থামিয়ে দেয় তাকে পরাশর, “বাবা যে অনেক আশা নিয়ে বসে আছে তোর; তুই বাবাকে হতাশ করবি কি করে” ?
একটু থেমে হতবাক সত্যবতীকে পরাশর আবার বলে, “ছেলেকে তো তুই শিখিয়ে পড়িয়ে আমার মত আচার্্য্য বানাতেও পারবি না। ছেলে থাক আমার কাছে; আমি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি; তোর রাজা কোন দিন-ই টের পাবে না তোর ছেলের কথা বা তোর-আমার মেঘে ঘেরা দুপুরগুলোর কথা। তুই বাবাকে সুখী কর। সুখী করিস তোর রাজাকেও”।
নিরাশ সত্যবতী ভাঙা বিপর্যস্ত স্বরে জানতে চায়, “আমি আর কখনই দ্বৈপায়নকে দেখতে পাব না” ?
“তা কেন ? মনে পড়লেই ছেলের কথা তুই আখড়ায়, এখানে যোগাযোগ করিস। ছেলে হাজির হয়ে যাবে তোর কাছে। যেখানেই তুই থাকিস”। – আশ্বস্ত করে পরাশর।
প্রথম পুরুষ, প্রথম সন্তানকে ছেড়ে নতুন জীবনের দাবিতে বাবার কাছে ফিরে গেল সত্যবতী।
- ১২ –
যমুনাপুর যেন কেমন বদলে গেছে। সেই সাঁকো আছে; ইমারৎ আছে; চরটা আছে; মেঘ রোদের লুকোচুরি আছে; যা কিছু সত্যবতী রেখে গিয়েছিল সবই আছে। কিন্তু তবু বুকের কাছটা সত্যবতীর কেমন যেন খালি খালি লাগে; কেবলই মনে হয় নেই, কী যেন তার নেই; কী যেন ছিল – এখন আর নেই।
একদিন দুপুরে দাওয়ায় আল্পনা আঁকতে আঁকতে আনমনে কিছু ভাবছিল সত্যবতী। সেই সব ভাবনার বুনটেই হঠাৎ মনে হল, গায়ে আঁশটে গন্ধ নেই। তর্ক শুরু হল মনের মধ্যেঃ
- গায়ে আঁশটে গন্ধ নেই তো যমুনাপুরের কী ?
- যমুনাপুরের ছেলে-মেয়েদের অনেক কিছু।
- আচ্ছা, আমার গায়ের আঁশটে গন্ধ বলে সেদিন তো তারা আমার গায়ে পাথর ছুঁড়ত, থুতু ছুঁড়ত –
- কিন্তু অস্বীকার তো করতে পারে না যে তুমিই সে দেশের সেরা রূপসী । তার ওপরে গায়ে এমন যাদু সুগন্ধ ! মেয়েরা পাইনের ছাল ডলে নিজের গায়ের চামড়া তুলে ফেললেও এমন গন্ধের ধারে কাছে আসতে পারবে না যে।
- তাহলে বদল তো আমার, যমুনাপুরের নয়।
তাঁতীবউয়ের ডাকে ছিঁড়ে যায় তর্কজাল।
“হ্যাঁ রে মেয়ে শরীর- টরীর ভাল তো” ?
ঘাড় নেড়ে ইতিবাচক জবাব দেয় সত্যবতী, চোখ সরে না তার আল্পনার নকশা থেকে, চলতে থাকে হাতও কল্কায় কল্কায়, ফুলে ফুলে। তাঁতীবউয়ের আলাপ এগিয়ে চলে,
“চোখ মুখ কেমন ছল্ ছল্ কী না, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম আর কী; তা মেয়ে এমন নকশা কি চিকিচ্ছের সময়েই শিখে এলি” ?
একই রকম উত্তর দেয় সত্যবতী। তাঁতীবউ বাড়াতে চায় আলাপ,
“তা সেখানে থাকতে বাপের জন্যে মন কেমন করে নি তোর”?
“তা তো করতই কাকী”। সংক্ষেপে সারে সত্যবতী। “এই তো মেয়ে কি সুন্দর কথা বলে! কেন যে পাড়ার ছুঁড়িগুলো বলে এমন মেয়ের দেমাকে মাটিতে পা-ই পড়ে না”!
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সত্যবতী; নিজেই চমকে যায় সেই হাসির লহরে; ফিরে থেকে বোধ হয় এই প্রথম এমন হাসতে পারল ! জবাব দেয়, “কী যে বল কাকী ! আমার আবার দেমাক ! আমারই গায়ে গন্ধ বলে কেউ আমার সাথে ……”
“না, না, তা কেন ? তা কেন ? তোর মত রূপ এ দেশে কজনার আছে বল ? তার ওপর তোর এই সুগন্ধ; মেয়েগুলোর তো জানতে ইচ্ছে করে কি মেখে তোর এই গন্ধবদল ……” , ব্যাখ্যা করে তাঁতীবউ। সত্যবতী বলে ফেলে, “তা আমাকে জিজ্ঞেস করলেই পারে তো; তবে কাকী জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না আগে থেকেই বলে দিলাম। “তখন আবার বোল না আমি দেমাক করছি।
তাঁতীবউ কৌতুহলে মরিয়া; বলে, “সে যদি তোর গুরুর মানা থাকে বলবি না ; আর বলবিই বা কেন বল, দেশের ছোঁড়াগুলো, ভিনদেশী ছাত্তরগুলো সব যখন বাকী মেয়েগুলোকে ছেড়ে তোর দোরেই হত্যে দিয়ে পড়ে আছে” !
আক্রমণে কিছুটা থতমত খায় সত্যবতী; ঢোক গিলে জবাব দেয়, “এত খবর আমি রাখি নি কাকী…”
জবাবে ফুঁসে ওঠে তাঁতীবউ, “তা রাখবে কেন ? তোমার বাবা যে রাজার ব্যাটা ছাড়া কাউকে পাত্তাই দেবেন না বলে বেড়াচ্ছেন; তা ছাড়া তোর মত অমন ঘর-বিছানা, দাওয়া-উঠোন সাজানি গুণের মেয়ে নিয়ে দেশের লোকে রাখবে কি করে বল” ?
এবার সত্যবতী বুঝে ফেলে তাঁতীবউয়ের আসার কারণ; তাই বলে, “দেখ কাকী সত্যি হল গায়ের গন্ধ পণ্ডিতে ওষুধ দিয়ে বানিয়েছে; গায়ের গন্ধের ওষুধ দেব তেমন বিদ্যে আমার নেই। তবে দেশের মেয়েরা উঠোন-বাগান সাজাতে চাইলে আসতে বোল আমার কাছে শিখিয়ে দেব”।
এরপর সন্ধে জ্বালার অছিলায় নিজের ঘরের দিকে ফিরে যায় তাঁতীবউ।
কয়েক দিন পর থেকে দুপুরের দিকে মেয়েরা আসতে শুরু করে সত্যবতীর কাছে। সব দেখে শুনে মাঝি ঠোঁট টিপে হাসে; মেয়ের দলে বিদায় হলে বলে, “আমাদের সত্যবতীর আখড়া”।
বাপ-বেটী দুজনেই গড়িয়ে পড়ে হাসতে হাসতে।
হাসির শব্দে ঢাকা পড়ে যায় দুজনের বুক চেরা দীর্ঘশ্বাস।
হাসির শব্দে ঢাকা পড়ে যায় মাঝির বুকের গুরুতে গুরুতে ছেয়ে থাকা দুশ্চিন্তা ঃ মরার আগে কোথা থেকে তার গুণবতী মেয়ের যোগ্য বর আনবে ; কী করে রক্ষা করবে মেয়েকে তার রূপের টানে আসা শ্বাপদের আক্রমন থেকে।
হাসির শব্দে ঢাকা পড়ে যায় মেয়ের বুকে গুমরে ওঠা হাহাকার ঃ আবার কবে বুকে জড়াবে তার পাঁজরের ধন, নাড়ীর বাঁধন ননীর তালকে।
এবং মেয়ে বুঝতে পারে ঃ ঠিকই, যমুনাপুর যমুনাপুরের মতই আছে নিজের ভাল মন্দে ফেঁসে; বদলে গেছে সে নিজে মেয়ে থেকে মা-তে; ঠিকই, দেমাক তারই; তবে সৌন্দর্যের তো নয়ই, সুগন্ধেরও নয়, মাতৃত্বের।
- ১৩ –
যদিও মেয়েরা আসে ঘর সাজানো, উঠোন রাঙানো, বাগান বানানো শিখতে, তবুও তাদের “কি ভালো! কি ভালো !” ছাপিয়ে সত্যবতীর কানে বাজতে থাকে “এমন গন্ধ কোথায় পেলে, বল না ?” আপন মনেই মুচকি হাসে সত্যবতী। তবে এতদিনে সেও শিখে গেছে কৌশল; স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস না করলে সেও বলবে না গন্ধের কথা।
সারা দিনের ঘরের কাজ, দুপুরের মেয়ে-মজলিশ সব ছাপিয়েও হু হু করে ওঠে সত্যবতীর মন। সেই নেই- নেই শূণ্যতা ক্লান্ত করে তোলে যুবতী সত্যবতীকেও। গন্ধ নেই-এর সাথে এত পাওয়া জুড়ে আছে যে, সত্যবতী নিশ্চিত গন্ধ না থাকার হাহাকার তার নেই। গন্ধের সাথে যাওয়া পড়শীর করুণার জন্যও তার মন কাঁদে না। তা হলে নিশ্চয়ই এই হা-হুতাশ ছেলের জন্য; পরাশরের জন্যও।
পরাশরের কথা ভাবলেই প্রেমের আকুতি ছাপিয়ে ওঠে শ্রদ্ধা। মানুষটা নিজের কাজ-পাট-রুজি সব ফেলে গেল সন্তানকে সুস্থ পরিবেশে গড়ে তুলবে বলে। সত্যবতীকেও সত্যি ভালো বেসেছিল সে; তাই তো তার সম্মান, তার লজ্জা, তার পিতৃকর্তব্যের প্রতি এত যত্নশীল পরাশর। ভালো না বাসলে সত্যবতীর সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বার্থে দুজনের প্রেমজ সন্তানকে একলা বড় করার ত্যাগ করতে পারত না সে। সত্যবতী নিশ্চিত জানে যত বড় রাজার সাথেই তার বিয়ে হোক না কেন পরাশরের মত প্রেমিক তার আর কেউ নেই দুনিয়ায়।
সত্যবতীর আরও মনে হয় আরেকটা সন্তান এলেই কি এই হাহাকার মুছে যাবে তার বুক থেকে ? জানে না সে। কেবল ভাবে আর ভাবে; কৌমার্য ফিরে পেলে কি প্রথম প্রেমিকের প্রথম ছোঁওয়ার অনুভব ফিরে আসবে ? কি করে আসবে ? মন যখন সেদিনের থেকে অনেক বদলে গেছে, তখন অনুভব কি করে এক হবে ?
এত সব ভাবনার ঘোরেই হয়ে যায় রোজকার ঘর নিকোনো; রান্না-বান্না, স্নান, এমনকি জঙ্গলে জ্বালানী কাটাও। একদিন জঙ্গলেই জ্বালানী কেটে ফেরার সময় সত্যবতী মুখোমুখি হয়ে গেল এক শহুরে হরিণ শিকারির।
শিকারি পিছু পিছু আসছে। সত্যবতীর উপায় নেই কোনো বিপদ থেকে বাঁচার। তাই সে সরাসরি ঘুরে দাঁড়াল শিকারির দিকে। চোখে চোখ রেখে থামিয়ে দিল শিকারির এগিয়ে আসা।
থতমত শিকারি ঢোক গিলে বলল, “এই জঙ্গলে এমন রূপ দেখতে পাব ভাবিই নি কোনোদিন; তবে দোষ আপনার; কী মেখেছেন আপনিই জানেন, আপনার গন্ধই আমাকে হরিণের থেকে টেনে আনল আপনার খোঁজে। ……”
শিকারির চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই জবাব দিল সত্যবতী, “আমি কিন্তু শিকার নই; আর কিছু বলতে চান ?”
শিকারি প্রগলভ্ হয়ে উঠল, “আপনি তো মনে হয় এদিকে ঘন ঘন আসেন; চলুন কোথাও বসি, তারপর না হয় -’’ ;
শিকারিকে থামিয়ে দিল সত্যবতী, “কথা বলতে হলে আমার বাড়ী আসুন; বাবা আছেন আমার; আপনি কথা বলে আনন্দ পাবেন”।
শিকারি রাজি হয়ে গেল।
সত্যবতী যখন ঘরে পৌঁছল, মাঝি তখন দাওয়ায় বসে সারাদিনের বিক্রিবাটার হিসেব কষছিল। সত্যবতীর দাওয়ায় ঢোকার শব্দ পেল মাঝি। অন্য সব দিন তারপর আওয়াজ পায় কাঠের বোঝা মাটিতে নামানোর। কিন্তু সেই আওয়াজের অপেক্ষায় সময় চলে যেতেও মাঝি আওয়াজ পেল না কোনো। অনুভব করল সময়টা বেতালা চলছে যেন। কিশোরীবেলায় হলে কিসে এই অনিয়ম তাই নিয়ে মেয়ে তার সরব হয়ে উঠতো উত্তেজিতায়; আজকাল মেয়ে তার আর উচ্ছল উদ্বেল হয় না কখনও; আনন্দে কিংবা বিপদে তার চেহারাটা থাকে অবিচল; মনের তার যে কোন তানে বেজে চলে তার টেরটি পাওয়ার জো নেই। মাঝিও অঞ্চল স্বভাবে হিসেব কষে চলেছিল। কিন্তু হঠাৎ-ই টের পেল মেয়ের সাথে তার স্বভাবটা না বদলানো তারই বার্ধক্যজনিত মন্দীভবন। বিরক্ত হল নিজের ওপর; নিয়মিত শব্দটা না হওয়ায় সে যে উতলাও হলনা সেটা তার মনে হল আলস্য। তাই হিসেব আর আলস্য দুই-ই ঝেড়ে ফেলে মাঝি ঘুরে তাকাল সত্যবতীর দিকে। মাঝির জিজ্ঞাসু চোখের উত্তরে সত্যবতী ফিরিয়ে দিল কৌতুক আর স্মিত হাসি মাখা এক দৃষ্টি।
কেউ মুখ খোলার আগেই ঘাটের মুখের শোরগোলটা হট্টগোল হয়ে পৌঁছে গেল দাওয়ার মুখে। মাঝি, সত্যবতী এবং শিকারি তিনজনেই ঘুরে দেখল দাওয়ার মুখ। শিকারিই প্রথম প্রতিক্রিয়া জানাল, “আপনারা পুলের মুখে দাঁড়ান। আমি আসছি এক্ষুনি”।
বাপ-বেটিতে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। আবার ঘনিয়ে আসা নীরবতাকে সত্যবতীই ভাঙল। মাঝিকে বলল কীভাবে কখন শিকারির সাথে দেখা আর কেন শিকারি মাঝির দাওয়ায়। মাঝি শিকারীকে বসতে বলতেই সত্যবতী মাঝিকে ঘরের ভেতর বসার জন্য বলল; কারণ মেয়েদের আসার সময় হয়ে গেছে।
কাঠের বোঝা রান্নাঘরে নামিয়ে রেখে, দু পাত্র সরবত রেখে এল ঘরে। তারপর উঠোন জুড়ে দিতে বসল তুলে আনা রঙীন ফুলের আল্পনা। মেয়েরা একে একে এসে জড়ো হতে লাগল তাদের হাসিতে, কলকলানিতে ছাপিয়ে গেল ঘরের মধ্যে দুই পুরুষের স্বর।
মাঝি শিকারিকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই শিকারি ঝাঁপি খুলেছিল প্রশ্নের। মাঝির ঐ একটিই সন্তান কি না; তার নাম কী; মাঝিবউয়ের কী হয়েছিল, কবে হয়েছিল; মাঝি একাই বুঝি বড় করেছে মেয়েকে; এবং আরও অনেক কিছু শুধু সত্যবতী আর তার যুবতী হয়ে ওঠাকে জানতে, বুঝতে। সরবতের অছিলায় শিকারিকে থামিয়ে প্রথম প্রশ্ন রাখে মাঝি, “মশায়ের নাম ?” ব্যস্ত হয়ে শিকারি উত্তর দিল, “শান্তনু। আমি ইন্দ্রপ্রস্থে থাকি”। মাঝি একটু অবাক হলেও প্রকাশ করল না; বলল, “সেখানে তো আমাদের রাজধানী; রাজাও শান্তনু বলেই জানি। নেহাৎ আমার মেয়ের পিছু পিছু আমার ঘরে না এলে আমিও আপনাকে রাজাই”- মাঝিকে শেষ করতে দেয় না শিকারি, “আমিই সেই অভাগা রাজা; যার সংগঠিত রাজ্য আছে, অনুগত পারিষদ আছে, উত্তরাধিকারে সুযোগ্য পুত্র আছে; কিন্তু রানী নেই”। একটা গাঢ় দীর্ঘশ্বাস ফেলল শান্তনু। খেই ধরল মাঝি, “রাজা, মানে আপনি সত্যিকারের রাজা ?” কোন উত্তর না দিয়ে ডানহাতের মধ্যমা থেকে রাজপ্রতীক খোদাই করা আংটিটা খুলে মাঝির হাতে দিল শান্তনু। মাঝি দেখল করের দলিলের মাথায় দেওয়া ছাপটাই বটে। কিন্তু মাঝির সন্দেহ দূর হয় নি বুঝতে পেরে কোমর থেকে খুলে নিল তলোয়ার। আলোয় ধরে দেখাল তার ফলায় লোকান রাজপ্রতীক। তূণীর থেকে একে একে বার করে আনা বাণগুলো বার করে এনে আলোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাল সেই একই রাজপ্রতীক খোদাই করা আছে।
শান্তনু যে রাজাই সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে মাঝি জিজ্ঞেস করল, “আমার সত্যবতীকে কী প্রয়োজন রাজা?” শান্তনু একটু লজ্জা পেয়ে গেল যেন; তারপর ব্যক্তিত্বে রাজকীয় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বলল, “আজ বনে একটাও শিকার পাই নি; শুধু তোমার মেয়ের গন্ধে উতলা হয়ে ঘুরে বেরিয়েছি তার খোঁজে; যখন খুঁজে পেলাম তখন সে আমাকে দু দণ্ড সময়ও দিতে রাজি ছিল না; তাকে জানতে গেলে তোমার অনুমতি লাগবে বলল সে; তাকে একান্তভাবে জানার চেষ্টায় এসে গেছি তোমার দরজায়…”। শান্তনু থামতে তার আবেগের ঢেউ থামাতেই যেন কিছুক্ষণ কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না মাঝির। রাজার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসতে মাঝি বললে, “তাকে জানতে চান কেন ? সামান্য মাঝির মেয়েকে তো আর আপনি আপনার উত্তরাধিকার বইতে দেবেন না। আপনার ইচ্ছে হলে জানবেন; ইচ্ছে ফুরিয়ে গেলে বা জানার কিছু না থাকলে বা নতুন কৌতুহল তৈরি হলে সত্যবতীকে ফেলে যাবেন…… আপনি রাজা, আপনিই বিচারক…… আপনি পারিষদ নিয়ে শিকারে এসেছেন, আমার মেয়েকেই মৃগয়ার পশু মনে করেছেন… মানুষের মত আর ন্যায় চাইতে যাই কোথায় ?”
এ প্রশ্নের আর্তিতে থমকে গেল রাজকীয় গমক। অনেক সময় কেটে যেতে রাজার যেন হুঁশ ফিরল বাইরে আল্পনায় মশগুল মেয়েদের মিলিত উচ্ছাসের আওয়াজে। প্রশ্ন যেহেতু রাজাকেই করা হয়েছে, উত্তর তাঁরই দেওয়ার কথা। স্বরের স্বাভাবিকতায় বিনয় মিশিয়ে রাজা জবাব দিলেন, “মাঝির মেয়ে হলেও সত্যবতী আত্মমর্যাদাবোধ এবং আত্মসংবরনের যে উদাহরণ রেখেছে তাই আভিজাত্য। সে কোন অংশে আমার যোগ্য অর্ধাঙ্গিনীর চেয়ে কম গুণান্বিতা নয়। আমাকে অনুমতি দিন, আমি সত্যবতীকে আমার রানী করতে চাই”। মাঝিকে দেখে মনে হল রাজার যে এই প্রস্তাবই যেন অভিপ্রেত ছিল তার। বিন্দুমাত্র ইতঃস্তত না করে মাঝি বলল, “প্রস্তাব বড় লোভনীয় রাজা; এই কুঁড়েতে কোলে-পিঠে করে জল-ঝড়ের থেকে আগলে আগলে বড় করলাম যাকে তাকে রাজা নিজে পাটরানী করতে চান…… নিজের কপালকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু একটি শর্ত মঞ্জুর হলে মেয়ে দিতে রাজি আছি আমি”। ব্যাকুল শান্তনুর তর সইল না। তাড়াহুড়ো করে জানতে চাইল, “কী শর্ত?” মাঝি হালকা হেসে বলল, “আপনার তো কিছু বয়স হয়েছে; বলছেন আপনার উত্তরাধিকারও সুযোগ্য পাত্রকে দিয়ে দিয়েছেন; আপনি গত হলে মাঝির মেয়েকে তার বাচ্চা শুদ্ধু যদি রাজপরিবারের রাজনৈতিক মারামারি পথে বার করে দেয়? আমিও তো চিরদিন থাকব না ……। কবে ঘটবে সে ঘটনা জানি না। তাই বলছিলাম সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তানই আপনার উত্তরসূরী হবে এমন আশ্বাস পেলে তবেই আমি অনুমতি দিতে পারব”।
শিউরে উঠল শান্তনু। একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমার ছেলে দেবব্রতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেছি। তাকে বিনা অপরাধে নিজের শখের তাগিদে বঞ্চিত করার অন্যায় করতে পারব না; না রাজা হিসেবে, না বাবা হিসেবে। ……… আমি আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে নিলাম মাঝি”। কালক্ষেপ না করে মাঝির বাড়ি ছেড়ে চলে গেল শান্তনু।
পারিষদদের কলকলানি মিলিয়ে গেল ক্রমে। ততক্ষণে আখড়ার মেয়েরাও যে যার বাড়ি চলে গেছে। প্রাক্ সন্ধের ছাইরঙা ফ্যাকাশে আকাশের নীচে মুখোমুখি হল বাবা আর মেয়ে। বাবা ভাবছে , “ঠিক করলাম ? মেয়ে অখুশি হল না তো ?” মেয়ে অপলকে বাবার চোখের গভীরে ডুবে বলল, “আমি খুব শান্তি পেলাম বাবা; আমার ব্যাটা রাজা না হলে আমার কিসের রানী হওয়া ?”
দুজনেই হেসে হালকা করে নিল সন্ধে।
মেয়ের শুধু মনে হতে লাগল, কেবল রাজার ছেলেই কি রাজা হয় ? অলক্ষ্যে যে বেড়ে উঠছে তিলে তিলে সে কি রাজা হতে পারে না ?
- ১৪ –
এমনি করে রোজকার দিনযাপনকে সত্যবতী যত সহজতায় মেনে নিয়েছে তা মাঝিকে অবাক করে। ভেবে মাঝি কুল পায় না যে কি সেই শিক্ষা যা মেয়েকে জীবন সম্পর্কে এতো নিস্পৃহ করে দিয়েছে। এই যৌবনে তো নিজের ঘর - নিজের বরের কল্পনায়, বাসনায় মেয়ের উতলা হওয়ার কথা; কিন্তু মেয়ের শান্ত সমাহত মুখে না আছে তপস্যার কাঠিন্য না নিশ্চিত কোন সত্যের প্রতীক্ষা।
এতদিনে মনের আকুলতা চেহারায় না ফুটতে দেওয়ার লড়াই করে সত্যবতী নিজের অজান্তেই খানিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শান্তনুর প্রস্তাবে তার নিস্তরঙ্গ জীবনে অন্তত একান্ত অবকাশের কিছু দমকা হাসি জড়ো হয়েছে। নিজের মনের অন্যমনস্ক চিন্তায় উধাও হওয়ার খেলায় একদিন হঠাৎ করেই সত্যবতী আবিষ্কার করল প্রায় আবছা হয়ে আসছে ছোট ছোট চোখ – নাক – মুখ – হাতের এবং পায়ের তালুর ছবিগুলো। তার বদলে একটা আর্তি যেন ফুটে উঠছে হাঁটি হাঁটি পায়ে এগিয়ে এসে আধো স্বরে অস্ফুট কিছু বাণীতে তাকে চমকে দেবে কেউ। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় তার; এ কোন শিশু! একে তো সে চেনে না; তার মানে শিশুও তাকে চেনে না; তার সন্তান কি তাকে কোনদিন চিনবেই না ?
এবং শিশুর ছবি ছাড়াও আরেকটা ছবি সত্যবতীকে সীমাহীন লজ্জায় কাঁপিয়ে দিয়ে যায়, আজকাল। প্রথম প্রথম মানসপটে দেখতে পেলেই গালে গরম আঁচ টের পেত সে; একদিন নদীর ধারে সেই ছবির আক্রমণে সে দেখতে পেল আঁচ গালে ফুটে ওঠে গোধূলির রং হয়ে। মনের এই অজানা পরিবর্তনে তার ডুবে যেতে ইচ্ছে হল নদীতে। কিন্তু জেলেনীর গর্ভজ মাঝির পালনে বেড়ে ওঠা মেয়েটার প্রতিবর্ত বাধা হয়ে দাঁড়াল। আবারও সত্যবতী হেরে গেল মাঝির পিতৃঋণের কাছে। ক্রমশ সে হেরে যেতে লাগল শান্তনুর শিকারীবেশের আকর্ষণের কাছেও। কোনো কো্নো রাতে একলা বিছানায় জেগে উঠে, ঠাণ্ডা ঘাম হাতের তালু থেকে আঁচলে মুছতে মুছতে সে শিউরে ওঠে স্বপ্নের স্খলনে; সাংঘাতিক হতাশায় নিজেকে আহত করে প্রদীপের শিখায় হাতের তালু পেতে দিয়ে; সে দহনও মৃদু হয়ে যায় মনের জ্বালায় ঃ কেন, কেন, কেন স্বপ্নে যে খেলা পরাশর শুরু করে সে সবের শেষ শান্তনুর হাতে হয়!!!! অজস্র দ্বিধা - দ্বন্দ - যন্ত্রণায়- লজ্জায় ঋদ্ধ হতে থাকে স্নেহ – প্রেম – বাৎসল্য – করুণায় জারিত সত্যবতীর অস্তিত্ব।
এই সব অস্থির দিন রাত্রির আপাত স্থৈর্যকে ধূলিসাৎ করে এক বর্ষার সন্ধে এলো; সঙ্গে নিয়ে এলো শান্তনুর উত্তরসূরী দেবব্রতকে। রান্নাঘর থেকে একঝলক দেখে সত্যবতীর ভ্রম হয়েছিল যে প্রেমের উদ্দামতায় বোধহয় প্রৌঢ় শান্তনু তারুণ্যের জ্যোতি ফিরে পেয়েছে। কিন্তু সরবতের অছিলায় ঘরে ঢুকে দেবব্রতর গলার স্বরে তার ভ্রম কেটে গেল। শান্ত গম্ভীর সে স্বরে ভক্তের আর্তি টের পেয়েছিল সত্যবতী যখন দেবব্রত বলেছিল, “মা, আপনার আপত্তি নেই তো হস্তিনাপুরের রানী হওয়ায় ?”
মাঝি অবশ্য উত্তর ছিনিয়ে নিয়ে বলেছিল, “ওঁর আপত্তির থেকেও জরুরী ওঁর ভবিষ্যতের সুরক্ষা। যুবরাজ, আপনার বাবাকে রাজকাজে ফিরিয়ে আনতে আপনি না হয় ছিনিয়ে নিয়ে যাবেন আমার মেয়েকে, আপনার বাবার রানী করবেন তাকে; তারপর রাজা গত হলে আমার মেয়ের এবং তার সন্তানদের কী হাল হবে ?”
বিনীত কিন্তু গম্ভীর স্বরে দেবব্রত জানালেন, “ বাবা যে শুধু রাজকাজে অমনোযোগী তা তো নয়; তিনি পৃথিবীর কোন আনন্দেও অংশ নিতে পারছেন না। যখন শুনলাম আপনার প্রত্যাখ্যানেই তাঁর এই অমনোযোগ এবং মনোপীড়া তখন আমাকে আসতেই হলো … মা সত্যবতীর কেন সায় নেই তা জানতে …… আমি আমার বাবাকে অসুখী দেখতে পারব না”। এই সময় সত্যবতীকে মুখ খুলতেই হল, “ আমিও আমার বাবাকে চূড়ান্ত দুঃশ্চিন্তায় রেখে সংসারে প্রবেশ করতে পারব না”। হাসি মুখে দেবব্রত বললেন, “ তা হলে আমার যৌবরাজ্য ফিরিয়ে দিলেই আপনার সাথে রাজা শান্তনুর বিয়ে হবে তো ?” আবার মাঝি আশঙ্কা প্রকাশ করে, “ আপনার সন্তানেরা যদি না মানেন আজ এই কুঁড়েতে যে কথা দেওয়া – নেওয়া হলো সেই কথা কটা” – মাঝিকে শেষ করতে না দিয়েই দেবব্রত তীব্র কঠিন বজ্রপাতের শব্দ ছাপিয়ে ঘোষণা করলেন , “ আমৃত্যু আমি কৌমার্য পালন করব”। সত্যবতী ককিয়ে উঠল, “ বাবাকে ভালোবেসে এ কী ত্যাগ করলেন ?” আবার শান্ত স্বাভাবিক স্বরে দেবব্রত বললেন, “ ত্যাগ তো কিছুই নয়; আপনি উপলক্ষ্য মাত্র; একদিন এ সিদ্ধান্ত আমাকে ঘোষণা করতেই হতো। এতে কোন তিক্ততা কিংবা অপ্রাপ্তি নেই; বরং আমার মুক্তি আছে। আপনি মাতৃস্থানীয়া, আপনার বাবা গুরুজন; এর থেকে বেশী প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়”।
দেবব্রতের ব্যবস্থাপণায় সত্যবতী সত্যি সত্যিই হস্তিনাপুরের রাজরানী হয়ে উঠলো।
- ১৫ –
যৌবরাজ্য ছেড়ে দেওয়ার এবং আমৃত্যু কৌমার্যের ব্রত নেওয়ার প্রতিজ্ঞায় দেবব্রত সব মানুষেরই শ্রদ্ধার আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন। রাজবাড়ীর মধ্যে বয়সে ও সম্মানে বড় সবাই দেবব্রতর মানসিক শক্তিকে সম্মান জানিয়ে তাঁকে ভীষ্ম নামে ডাকতে শুরু করেন। সেই নামটাই ছড়িয়ে যায় দেশের দূর দূর প্রান্তেও। ক্রমে ভীষ্ম নামটাই কাল পেরিয়ে দেবব্রতর পরিচয় হয়ে যায় ইতিহাসে।
শহুরে এবং অভিজাত আদব-কায়দার পাঠ থাকায় রাজরানী হয়ে উঠতে সত্যবতীর কোনো বড় সমস্যা হলো না যদিও রাজা শান্তনু স্বামী হিসেবে দেওয়ার সময় বেশি পেতেন না। তবে নতুন আবহাওয়ায় কঠিন চৌকাঠগুলো পেরোবার সময় ভীষ্মকে সব সময়ই পাশে পেতো সত্যবতী। মা বলে ডাকলেও পুরো কুরু পরিবারে ভীষ্মই সত্যবতীর একমাত্র বন্ধু ছিলেন। ফলে সহজেই সত্যবতীর রূপমুগ্ধ শান্তনু ক্রমশঃ গুণমুগ্ধও হয়ে উঠলেন। রাজকীয় ব্যস্ততার মধ্যে দাম্পত্য শুরু হলেও প্রথম সন্তান চিত্রাঙ্গদ আসতে খুব দেরি হলো না।
চিত্রাঙ্গদ আসার আগেই, নতুন আবহাওয়া সহ্য করে টিকে থাকার পরীক্ষাটা রোজ দিতে দিতে কখন যে সব আবেগমথিত অনুভুতিরা হারিয়ে গেল সত্যবতী খুব ভালো করে টেরও পেল না। যে স্বপ্নদের নিয়ে সত্যবতীর ভীষণ দুঃশ্চিন্তা ছিল, সে স্বপ্নগুলোও উধাও হয়ে গেল সত্যবতীর অজান্তে। নাওয়া-খাওয়া-রানী সাজার সামাজিক-রাজনৈতিক ঘূর্ণিতে ক্রমশ পাক খেতে খেতে সত্যবতীর অস্তিত্বে যমুনাপুরের জীবন তলিয়ে গেল দূর্মূল্য একাকী অবকাশের খোঁজে। রানি হয়ে বাবাকে খুশি রাখার জন্য বাবার অস্তিত্বও পালা-পার্বণের সুযোগ খুঁজে বেড়াতে লাগল রানির দৈনন্দিন যাপণে। এ সবের মধ্যে অন্তঃসত্বা হওয়াটুকুই একঝলক অন্য হাওয়া এনেছিল। কিন্তু সেই দিনগুলোতে বারবার দ্বৈপায়নের কথা ভাবতে চাওয়ার ইচ্ছেগুলো নির্জানতার জানলা খুঁজে রাজকীয় মনোযোগের নিবাত বেষ্টনীতে মাথা কুটে মরে গেছে। সে ইচ্ছেগুলোর শবদাহনের জ্বালাও সত্যবতীর মন থেকে মুছে গেল চিত্রাঙ্গদ কৈশোরে পৌঁছতে পৌঁছতে। তারপরই চলতি জীবনের অভ্যেসগুলো হঠাৎ কিছুদিনের খেয়ালে বদলে যেতেই এসে গেল বিচিত্রবীর্য।
চিত্রাঙ্গদ সবে কুড়ির কোঠায়; শান্তনু পরলোকগত হলেন। তখন বিচিত্রবীর্য নিতান্ত শিশু। কিন্তু দক্ষ সব গুরুর শিক্ষায় চিত্রাঙ্গদ তখনই রণশৈলীতে এবং রণনীতিতে প্রাজ্ঞ রাজার মতই নিপুণ ও পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। যদিও এই সময়টাই সত্যবতীর আজন্মচর্চিত পরিচিত পরিস্থিতি, তবুও সত্যবতী ভীষ্মের যোগ্যতার দিকে চেয়ে চিত্রাঙ্গদের রাজনৈতিক বোধহীনতার কথা মাথায় রেখে পুরো রাজপরিবারের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না কী করা উচিৎ। ভীষ্ম নিজেই এগিয়ে এলো সমাধান নিয়ে, “কী এতো ভাবছো মা ? আমার তো ইচ্ছামৃত্যুর বর; নাতিদের না দেখে এক্ষুণি মরার ইচ্ছেও আমার নেই; চিত্রাঙ্গদ রাজা হলেও আমি ছায়া হয়ে আগলাব হস্তিনাপুরের সিংহাসন যেমন আগলেছি বাবার সময়; …… প্রতিজ্ঞায় কৌমার্যের কথাটাই সবাই মনে রেখেছে;…… হস্তিনাপুরের সেবার শপথটা কি তুমিও ভুলে গেছ?” এরপরে আর দোলাচলের অবকাশ রইল না সত্যবতীর। হুকুম দিয়ে দিল ভীষ্মের হাতে চিত্রাঙ্গদের অভিষেকের।
হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসেই চিত্রাঙ্গদের প্রথম মনে হলো অনুগত প্রজা আর তাদের গরু চরাবার জমি বাড়ালেই রাজত্ব দীর্ঘায়ু হবে। এই ভাবনার মধ্যে লুকিয়ে ছিল নিজের বীরত্ব সত্যিকারে যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখার ভীষণ লোভ। তার থেকেও বেশি ছিল নিজের বীরত্বের অহঙ্কারের কাছে বাকি সব খ্যাতনামা বীরেদের লুটিয়ে পড়তে দেখার লোভ। ফলটা ভালো হলো না। পোকা-মাকড়ের মতো সামনে যে রাজাই পড়ল সেই রাজাকেই বিনাবাক্যব্যয়ে হত্যা করে তার রাজত্ব দখল করার খেলা বাধা পেল গান্ধর্বের রাজা আরেক চিত্রাঙ্গদের কাছে। নিজের রাজ্য খোয়াবার আশঙ্কায় তিনি এগিয়ে এসেছিলেন কুরুক্ষেত্র অবদি হস্তিনাপুরের চিত্রাঙ্গদকে ঠেকাতে। তিন বছর ভয়ানক রক্তপাতের পর দুই চিত্রাঙ্গদই নিহত হলেন। অমীমাংসিত রয়ে গেল উত্তর-পশ্চিম ভারতের চারণভূমির ওপর একছত্র অধিকারের সমীকরণ।
তারপর কালক্ষেপ না করে শিশু বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসিয়ে হস্তিনাপুরের ভালো-মন্দের ভার সত্যবতী তুলে দিল ভীষ্মের হাতে। তার বুকে বহু বছর জমে থাকা অপরাধবোধ যেন কিছু হালকা হলো।
- ১৬ –
ভীষ্মের ছায়ায় ছায়ায় রাজনীতি, রণনীতি এবং শাস্ত্র শিখতে শিখতে বিচিত্রবীর্য পৌঁছে গেল পূর্ণ যৌবনে। সত্যবতী অনেক খবর নিয়ে জানলো যে কাশীরাজের তিন মেয়েই হলো তার একমাত্র ছেলের উপযুক্ত পাত্রী। কথাটা ভীষ্মকে বলতেই ভীষ্ম কাশীরাজের কাছে প্রস্তাব রাখতে গেল।
কাশীরাজের রাজসভায় পৌঁছে ভীষ্ম খবর পেল যে সেদিনই তিন কন্যের একসাথে স্বয়ম্বর হবে। স্বয়ম্বরে হস্তিনাপুর নেমন্তন্ন না পাওয়ায় ভীষ্ম অপমানিত বোধ করল; খুব বিরক্ত হয়ে ভাবলো যে সে না হয় চিরকুমারব্রতী, তা বলে তামাম ভূ-ভারত কী করে ভুলে যায় যে হস্তিনাপুরের রাজরানী নেই, কিন্তু বিচিত্রবীর্য বিয়ের বয়সে পৌঁছে গেছে। কাশীরাজের এই অবহেলার একটা উচিৎ জবাব দেওয়ার জন্য তিন রাজকন্যাকে প্রায় লুঠ করে নিজের রথে তুলে নিয়ে, সমাগত সমস্ত রাজার সামনে ভীষ্ম কাশীরাজকে খোলাখুলি বলল, “ বিয়ের মধ্যে সেরা হচ্ছে জবরদস্তির বিয়ে; আপনার বা এই যত রাজা আপনার নিমন্ত্রিত তাঁদের কারুর ক্ষমতায় কুলোলে আসুন, আপনার মেয়েদের আমার রথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যান”।
বলা বাহুল্য অনেক রক্তক্ষয় হলো; তারপর তিনকন্যাকে নিজের মেয়ের মতো যত্নে আগলে ভীষ্ম পৌঁছলেন হস্তিনাপুর। সেখানে বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করার প্রস্তুতি পর্বেই তিন রাজকন্যার মধ্যে সব থেকে বড় বোন অম্বা সৌভরাজের কাছে যেতে চাইলেন। বাকি দুজনের সাথে ধুম ধাম করে বিচিত্রবীর্যের বিয়ে হয়ে গেল। এরপর নতুন অশান্তির সৃষ্টি হলো অম্বা হস্তিনাপুরে ফিরে এসে ভীষ্মকে বিয়ে করতে চাইলে। অম্বাকে ভীষ্ম লুঠ করায় সৌভরাজ তাঁকে বিয়ে করতে আপত্তি জানায়। অম্বা হস্তিনাপুর ফিরে এসে ভীষ্মকে বিয়ে করতে চায়; চিরকুমারব্রত যাপণের প্রতিজ্ঞায় অটল ভীষ্মও আপত্তি জানায় অম্বাকে বিয়ে করতে। অম্বা আত্মহত্যা করে।
রাজরানীর জীবনে জড়িয়ে থাকা অনিবার্য রক্তপাতগুলোকে, প্রাণনাশগুলোকে মেনে নেওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে সত্যবতীর। নিজের ছেলে চিত্রাঙ্গদ মারা যাওয়ার সময়ই প্রথমবার নিজের এই মানসিকতা সচেতনভাবে সে টের পেয়েছিল। হয়তো ভীষ্মের নির্মম আত্মবলিই তাকে জীবনের ক্ষয়ে অবিচল হতে শিখিয়েছিল। কিন্তু অম্বার মৃত্যুতে সে খুব বিচলিত হয়ে পড়ল ভীষ্মের বিপদের আশঙ্কায়।
বিয়ের সাত বছর পর টিউবারকুলসিস হয়ে মারা গেল বিচিত্রবীর্য। অম্বিকা অম্বালিকা দুই বোনই নিঃসন্তান তখনও। রাজবংশের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সত্যবতী ধরে পড়ল ভীষ্মকে; যদি কুরু বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় রেখে ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা ভাঙে; কুরু বংশের সেবার আদর্শ আগে না ভীষ্মের সত্য পালনের স্বার্থ আগে এসব নিয়ে অনেক তীক্ষ্ণ এবং কূট তর্ক চালাল সত্যবতী; হয়তো তার রাজকর্তব্য পালনের মধ্যে কোথাও সূক্ষ্মভাবে লুকিয়ে ছিল ভীষ্মের জীবনের হিসেবের খাতায় কামনার অপ্রাপ্তির পাতাগুলো ভরে ডেওয়ার ব্যাকুলতা। কিন্তু ভীষ্মও তাঁর প্রতিজ্ঞা পালন করে যাওয়ার তাড়নায়, সিংহাসন-স্ত্রীসঙ্গ দুই-ই গ্রহণের অপারগতাকে রক্ষা করতে ইতিহাস পেড়ে দেখালেন যে ভৃগুর হাতে সব ক্ষত্রিয় পুরুষ মরে যেতে ক্ষত্রিয় নারীরা সবাই ব্রাহ্মণের সন্তান ধারণ করেছেন ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীকে রক্ষা করতে; আবার বালি রাজার স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন অন্ধ ঋষি দীর্ঘতামস; তিনি অবশ্য সুদেষ্ণার শূদ্রাণী কাজের মেয়ের গর্ভেও জন্ম দিয়েছিলেন এগার জন ব্রাহ্মণের। শেষে ভীষ্ম বললেন, “আমাকে মাপ করতে হবে; সিদ্ধান্ত তোমাকে নিতে হবে; যা ভালো বোঝ তাই কর; যাই করবে তাই কিন্তু ইতিহাস হয়ে যাবে”।
নির্ঘুম কয়েক রাত কাটিয়ে সত্যবতী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এতো বছরের রানির জীবনে দ্বৈপায়নকে মনে করার অবসরও বেশি জোটে নি। শুধু অকারণ প্রাচুর্য আর অপরিসীম জটিলতা ডুবিয়ে রেখেছিল তাকে। বিচিত্রবীর্যও অকালে যাওয়ার পর থেকে মন বড় কু গাইছিল; বড় উতলা হয়েছিল দ্বৈপায়নকে দেখার জন্য। এ কদিনে সে কেবলই ভেবেছে ছুটে একবার যমুনার সেই দ্বীপে চলে যায়! পারে নি; মানসিক যন্ত্রণায় জেরবার হতে হতে কুরু বংশের এই সংকট, দু;খ, শূণ্যতার খাতিরে নিজের একান্ত ব্যাকুলতাকে সে দমিয়ে রেখেছে প্রত্যেক মূহুর্তে। ভীষ্মের সাথে পুরোন কথা আলোচনা করেই এই উপায়টা সে দেখতে পেল। হোক না শূদ্রাণীর গর্ভে, দ্বৈপায়নও তো ব্রাহ্মণ সন্তান; তাকেই ডেকে আনতে হবে; সে এলে তবেই তো সত্যবতীর সন্তানশোক কিছু সান্তনা পাবে; আবার কুরু বংশধারাও অব্যহত থাকবে।
ভীষ্মকে ডেকে বিশদ বলে সত্যবতী একটু হালকা বোধ করল। একে তো বহুদিন আগেকার কথা; তায় নিজের বিয়ের আগেকার ছেলের কথা, তাও বলা সেই সতীনপোকে যার সিংহাসনের যোগ্য দাবি কেড়ে নিয়েছিল সত্যবতী নিজের ভবিষ্যত সন্তানদের কথা ভেবে; নিজের প্রবৃত্তির কাছে, কৌতুহলের কাছে, প্রেম পাওয়ার এবং নারীত্ব উদযাপণের লোভের কাছে হার মানার স্বীকারোক্তি তাও এমন এক ত্যাগীর কাছে; আপাদমস্তক গ্লানিতে লজ্জায় ঢেকে যাচ্ছিল সত্যবতীর অস্তিত্ব। আর কোন কারণে নয় নিজের মাতৃত্বের উৎকন্ঠাকে তুষ্ট করতেই এই আবাহন। সন্তান আর সন্তানবৎ দুই মানুষের সাথে যে স্বার্থপরতা সে করেছিল তার শাস্তিই সে আজ ভোগ করছে দুজনের বঞ্চনাকে স্বীকার করে।
দ্বৈপায়ন আসতে বেশি দেরি হলো না। অবাক হয়ে সত্যবতী দেখল দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ছেলে তার বাপের মতোই অগোছালো কিন্তু মুখ দেখলেই সত্যবতীর ছেলে বলে চেনা যায় তাকে! এও অদ্ভুত ছেলে; কোন অভিযোগ নেই তার সত্যবতীর ওপর! কিন্তু সত্যবতীর কথামত অম্বিকা এবং অম্বালিকাকে গর্ভবতী করতে সে নিমরাজি হলো। তার বক্তব্য ছিল, তার বর্তমান চেহারায় সে রাজবধূদের কাছে গেলে কুরু বংশের ধারা হয়তো রক্ষা পাবে; কিন্তু সুরক্ষিত হবে না; নেমে আসবে অনিবার্য ক্ষয়।
কিন্তু জীবনের দ্রুত পরিবর্তনশীলতাকে মনে করে সত্যবতীই দেরি করতে চাইল না আর। অনেক বুঝিয়ে তবে সে রাজি করাল দুই রাজবধূকে; যথা সময়ে পরপর দুই পুত্রবধূকে নিজের হাতে নতুন কাপড়ে, গয়নায় সাজিয়ে দিল নববধূর সাজে দ্বৈপায়নের সাথে সহবাসের জন্য। প্রথম রাতে অম্বিকা দ্বৈপায়নের ভয়ানক চেহারায় চোখ বন্ধ করে ফেলল; দ্বিতীয় রাতে অম্বালিকা ভয়ে সাদা হয়ে গেল। দ্বৈপায়ন কিছুই লুকোলেন না সত্যবতীর কাছে। ফলাফলও জানালেন অকপটে যে অম্বিকার ছেলে জন্মান্ধ হবে এবং অম্বালিকার ছেলের গায়ের রং ফ্যাকাশে হবে। সবশুনে আবারও অম্বিকাকে ধরে পড়ল সত্যবতী; আরেকবার সুস্থ রাজাকে গর্ভে নেওয়ার জন্য দ্বৈপায়নের সাথে সহবাসে যেতে পীড়াপীড়ি করতে লাগল; নিমরাজি অম্বিকা তার কাজের মেয়েদের মধ্য অপ্সরার মত সুন্দরী একজনকে সাজিয়ে-গুজিয়ে পাঠিয়ে দিল শোবার ঘরে। দ্বৈপায়নের সাথে সহবাসে কর্তব্যে অবিচল সেই মেয়েটিরও একটি কর্তব্যনিষ্ঠ ছেলের হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল।
তারপর দ্বৈপায়ন এবং ভীষ্মকে অবলম্বন করে হস্তিনাপুরের ইতিহাস গড়িয়ে গেল অনেক দূর। সত্যবতী নিতান্ত জঙ্গলচারিণী থেকে বিবর্তিত হল হস্তিনাপুরের রাজমাতায়, তার ত্যাগে-কর্তব্য পরায়ণতায়; সেই সত্যবতীই তার ইচ্ছেপূরণে-স্বপ্নপূরণে-অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণে হস্তিনাপুরকে ঠেলে দিল ক্রমিক বিলোপের দিকে। এইভাবে কেটে গেল তার ইহকাল, আত্মবঞ্চনায় ধূসর রাজনীতিতে রঙীন ভীষণ এক মানুষিক জীবন।
**মূলকাহিনী মহাভারত।