Showing posts with label বাংলা গল্প. Show all posts
Showing posts with label বাংলা গল্প. Show all posts

Monday, August 1, 2016

পরীক্ষা

কবিতা বুল্টুকে নিয়ে খাতাবই কিনতে বেরিয়েছে। সন্তোষ পুস্তকালয় ছাড়া কোথাও বুল্টুর বুকলিস্টের সব বই পাওয়া যাবে না চন্দনগরে। দিলীপ কলেজ স্ট্রীট থেকে এনে দিলে সব বই পাওয়াও যায়, সস্তাও পড়ে। কিন্তু তাতে ছেলেকে এক সপ্তাহ বই ছাড়া স্কুলে যেতে হবে; এদিকে পড়াও এগিয়ে যাবে, ছেলে পিছিয়ে পড়বে। এ তো আর কবিতাদের কাল নয় যে ছেলেমেয়েরা অন্যের বই টুকে নিয়ে পড়বে।
অবশ্য কবিতার বা দিলীপের সময়ের সাথে বুল্টুর শৈশবের অনেক ফারাক। বুল্টুর শৈশবে অনাহার নেই, অর্ধাহার নেই, কেরোসিন তেলের জন্য লাইন দেওয়া নেই, একটা লম্পর চারপাশে গোল হয়ে বসে পাঁচ বা আট ভাইবোনের বা তুতো ভাইবোনেদের সাথে গুনগুনিয়ে পড়া নেই। বাবা স্কুলের মাইনে ভরতে না পারায় ডিফল্টার হয়ে রেজাল্টের দিন হাতে মার্কশিট না পাওয়াও নেই। বরং বুল্টুদের পেছনে খাবার নিয়ে দৌড়তে হয়, আর ভালোমন্দ পাতে জোগাতে না পারলে বায়নায় অস্থির হয়ে যেতে হয় মা-বাবাকে। পাওয়ার কাটের সময় ইনভার্টারের ব্যবস্থা না করে দিলেও, বুল্টুদের মা-বাবারা পাড়ার বেকার ছেলের থেকে জেনারেটরের কানেকশন নিশ্চয়ই নেন। আর ভাইবোন তো থাকেই না, থাকলে একটা বা তুতো।
কবিতা আর দিলীপেরও দুই ছেলেমেয়ে। মামণি আর বুল্টু। সন্তোষ পুস্তকালয়ে লোডশেডিং চলছে। যদিও সন্ধে হয়ে এসেছে, কিন্তু এখনও জেনারেটর চালানোর সময় শুরু হয় নি। মোমবাতি, ব্যাটারিতে জ্বলা টর্চ আর ব্যাটারির হ্যারিকেনের আলোয় বইপত্র খুঁজতে সময় লাগছে। কবিতার দুঃশ্চিন্তা হতে লাগল। কাল থেকে মামণির পার্ট ওয়ান পরীক্ষা শুরু।
রিক্সার মাথায় চোঙা লাগিয়ে কিছু একটা বলতে বলতে আসছে। কে জানে হয়তো নচিকেতার ফাংশন আছে। সন্তোষের বই গোছানো হয়ে গেছে। দুটো বই নিতে কাল আবার আসতে হবে। একটা রিক্সা নিয়ে এবার বাড়ি। কবিতা ভাবছে যে, মেয়েটা হয়তো এতোক্ষণে বাতি জ্বেলেই পড়তে বসে গেছে; বাতি জ্বালাতে গিয়ে যদি হাতে ছ্যাঁকা লেগে যায়? কাল যে পরীক্ষা, কী হবে! ভাবতে ভাবতে তার নাকের ওপর ঘাম জমে উঠেছে বড়ো বড়ো ফোঁটায়। একেক সময় নিজের দুশ্চিন্তার বাতিকে নিজেই বিরক্ত হয়ে ওঠে সে। মামণির বয়সে তো রুগ্ন মায়ের হেঁসেল ঠেলে নিজেরা দুবোন পড়াশোনা করেছে কবিতারা। তারওপর ছিল টিউশন করে পড়ার আর মায়ের সংসারের টুকটাক খরচ চালানো। আর পরীক্ষা? সেসব কথা মনে না করাই ভালো।
কবিতার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায় চোঙাওয়ালা মাইকটা সামনে এসে পড়ায়। কানের পর্দা ফাটিয়ে কতোগুলো কথা যেন কবিতার ঘিলুতে লাভা ঢেলে দিয়ে গেল। যে উৎকন্ঠাকে নিয়ে সে বিব্রত হচ্ছিল সেই উৎকুন্ঠাই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। নাকের ওপরের ঘাম শুকিয়ে গেল। বুকের মধ্যে শুধুই দুরমুশ চলতে লাগল। কাল বার ঘন্টা হুগলী বন্‌ধ!
তারপর দুঃখের বাষ্পও ঝেঁপে আসতে লাগল চোখে। কেন, কেন শুধু তার জন্যই এতো ঝামেলা জড়ো হয়! আপন মনে সে বিড়বিড়িয়ে ওঠে, ঠাকুর, ঠাকুর একটা কিছু করো। বুল্টু বুঝতে পারে না মা কেন এতো অস্থির হয়ে উঠেছে। তার বেশ খারাপই লাগে, দিদির পরীক্ষা বলে তারও এখন ফুচকা কিংবা সিঙারা খাওয়া বন্ধ। বাড়ি ফিরে শুধু চানাচুর দিয়ে মুড়ি খেতে হবে। সে মনে মনে ভেবে নেয় মাকে লুকিয়ে কিভাবে এক পলা সরষের তেল আর এক চামচ গুঁড়ো লঙ্কা মুড়িতে মিশিয়ে নেবে।
বাড়ি ঢোকার মুখেই কারেন্ট চলে এলো। কবিতা একটু যেন নিশ্চিন্ত হলো। দরজার হ্যাজবোল্ড ধরে নাড়তেই মামণি সাড়া দিল। তাড়াতাড়ি দরজাও খুলে দিল। কিভাবে ওকে খবরটা দেবে কবিতা বুঝতে পারছিল না। জিজ্ঞেস করল, খেয়েছিস? মামণি হাতের খাতাটা থেকে চোখ না সরিয়েই ঘাড় নাড়ল। খাবার টেবিলে বসেছিল সে এতোক্ষণ; সব খাতাপত্র হাতড়ে হাতড়ে গুটিয়ে নিচ্ছে এবার দোতলায় নিজের ঘরে উঠে যাবে বলে। বুল্টু বলল, দিদি জানিস কাল বার ঘন্টা হুগলী বন্‌ধ? মামণি চোখ পাকিয়ে বলল, ঠাট্টা করবি না। প্রচুর টেনশন এখন।  কবিতা বলেই ফেলল, বুল্টু ঠাট্টা করছে না। কাল সত্যি- শেষ করতে পারল না কথাটা সে, মামণি ডুকরে উঠল, কেন? এখনই যতো ঝামেলা? কবিতা বুল্টুকে খেতে দিতে দিতে বলল, সেই একই কারণ। যে কারণে গত চার বছরের প্রত্যেক বছরে চল্লিশ দিন করে রেল অবরোধ হয়ছে; সেই আরামবাগ-সিঙ্গুরে সিপিএম-তৃণমূলে মারপিট; যে কারণে তুই হস্টেল নিলি। নিলিই যখন তখন ছাড়লি কেন? মরিয়া গলায় মামণি এবার বলল, মা বিশ্বাস করো, হস্টেলে থাকলে দেবযানী আমাকে পরীক্ষার হলে পৌঁছতে দিত না। অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় সারা রাত ও ঘরে বসে গাঁজা খেয়ে হট্টগোল করেছিল। চারবার আমার গায়ে জল ঢেলে দিয়েছিল। যাতে আপদে বিপদে পরীক্ষার সময় হস্টেলে গিয়ে থাকার উপায়ই না থাকে, তাই আমি সিটটা ছেড়ে দিয়েছি। সম্ভবত দম নিতে থামে মামণি।
বুল্টু খাচ্ছে আর বড়ো বড়ো চোখ করে মামণির কথা শুনছে। নতুন বইপত্র বুল্টুর পড়ার টেবিলে গুছিয়ে দিতে দিতে কবিতা ভাবছিল, চার সিটের ঘরটা যতোটা ছিল মামণির ততোটাই ছিল দেবযানীরও। বেলদা থেকে কলকাতা এসে মেয়েটা নাকি সবার আগে মিনিস্কার্ট পরতে শেখে। এদিকে পড়ে মামণির ডিপার্টমেন্টেই। হাফইয়ার্লি পরীক্ষার পর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার হালহকিকত দেখে মাস্টারমশাইরা চারটে স্টাডিগ্রুপ বানিয়েছিলেন। তাঁরা এই মেয়েদুটোকে এক গ্রুপে রেখেছিলেন। কিন্তু দেবযানীকে ধরে পড়তে বসানোটা মামণির মনে হয় অনধিকার চর্চা। অথচ দেবযানীর মনে হয় নি কখনও যে মামণির পড়াশোনায় বাগড়া দেওয়াটা ওর দিক থেকে অনধিকার চর্চা। দেবযানীর নাকি চাকরি-বাকরি পয়সার দরকার নেই, অতএব কী হবে পড়াশোনা করে এমনটাই তার হাবভাব। কিন্তু তার আবার সমস্যা হলো যে সে যা খুশি তাই করবে আর মামণিকেও তার সঙ্গে তারই মতো করতে হবে; না হলে মামণি ওর সাথে একই ঘরে থেকে ফার্স্ট আর সে লাস্ট হবে ক্লাসে এটা সে মানবে না।  তাই তো সেই মেয়ে অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় এমন লম্ফঝম্প করল যে মামণি সারারাত জেগে পরদিন পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল, রেজাল্ট হাফইয়ায়ার্লির মতো ভালো হয় নি। মামণি ঘর বদলে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ততোদিনে নতুন মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। ফলে থার্ড ইয়ারের আগে ঘর বদল সম্ভব নয় জানিয়ে দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। টেস্ট পরীক্ষার আগে মামণি বাড়ি চলে এসেছিল। তখন অনার্স প্র্যাকটিক্যাল পেপারের পরীক্ষার দিন মাঝপথে ট্রেন অবরোধেও পড়েছিল। কিন্তু দিলীপ রোজ মেয়ের সঙ্গে যেতো। তাই গঙ্গা পার হয়ে, শেয়ালদা লাইনের ট্রেনে চাপিয়ে, সে মামণিকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই কলেজে পৌঁছে দিয়েছিল।
মামণি জিজ্ঞেস করল, কারা বন্‌ধ ডেকেছে? বুল্টু বলল, তৃণমূল। তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে টেলিফোন ডিরেক্টরির পাতা উল্টোতে লাগল মামণি; কবিতা দৌড়ে এসে বলল, কাকে ফোন করছিস তুই? মামণি কোনো জবাব দিল না। তারপর ডায়াল করতে লাগল। সদর দরজায় দিলীপের বাড়ি ফেরার সংকেত। বুল্টু দৌড়ে গেল দরজা খুলতে।
জুতো খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দিলীপ শুনতে পেল মামণি চেঁচাচ্ছে, বাঞ্চ অফ রাস্কালস্‌, কাল হুগলি বন্‌ধ ডেকেছিস, জানিস কাল পাঁচ হাজার ছেলে মেয়ে হুগলি থেকে হাওড়া কলকাতা যাবে পরীক্ষা দিতে? হুগলিতেই তিনটে কলেজে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা? আর কিছু যাবে ব্যারাকপুর, নৈহাটিতে। দিলীপ ধমকে উঠলেন, কার সাথে কথা বলছিস? মামণি শুনেও শুনল না। অন্য পাড়ের জবাব শুনে বলল, তোর মতো অশিক্ষিতরা দেশোদ্ধার করার ভান করলে পরীক্ষা বন্ধ ছাড়া আর কী করবে? দুবার তো পরীক্ষা, হয় তোদের জন্য নয় তোদের মতো অন্য পার্টির জন্য পিছিয়েইছে। আর তোরা নিজেদের ডিগ্রির সংখ্যা বাড়ালেই কী শিক্ষিত হবি? বন্‌ধ না তুললে আমরা কাল পরীক্ষা দেব কী করে?...... ডেকেছিস যেমন করে তেমন করে তুলেনে, রিক্সা চেপে গলা ফাটানোর কাজ তো! আমাদের পাড়ার ছেলেগুলোকেই না হয় ডেকে বলে দে...... দেখ তা হলে... ফোন রেখে মামণি বলল, আমি তৃণমূলের কলকাতা অফিসে ফোন করলাম, বাবা। ওরা কাল সকাল ছটা থেকে বার ঘন্টা বন্‌ধ ডেকেছে। দিলীপ বলল, কেন করলি? ওরা বন্‌ধ কী আর তুলবে? তুলে নেব বললেও বিশ্বাস করবি কী করে? মামণি বলল, বিশ্বাস? পলিটিকোদের? তবে ওদের মধ্যে সব দু ভাগ হয়ে গেল বন্‌ধ করা কাল ঠিক হবে কিনা তাই নিয়ে, সেটা বুঝতে পারলাম।
কবিতা চা দিল সবাইকে। বুল্টু পড়তে বসে গেল, নতুন বইতে মলাটও লাগাতে হবে। মামণি দোতলায় চলে গেল। কবিতা চা খেতে খেতে দিলীপকে বলল, কী শুরু হয়েছে? এখানে না হয় কোনো দিনই কোনো গণ্ডগোল হয় না, হয় নি। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, হাওড়ার গলিতে গলিতে খুন, জখম, রক্তের হোলি খেলা হয় তো এখন আর হয় না, কিন্তু এখন এসবই হচ্ছে আরামবাগে, সিঙ্গুরে, কেশপুরে। তার আঁচ এখানে লাগবে না ভেবেছিলাম। কিন্তু এতো সেই সব দিনের কথাই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। দিলীপ বলল, আজ কোনো স্মৃতিচারণ নয়। কাল রাত তিনটেয় উঠব। চারটে দশের ফার্স্ট লোকালে বেরিয়ে যাব মামণিকে নিয়ে। তারপর দেখা যাবে।  কবিতা ঝটপট রাতের রান্না সেরে নিতে গেল। আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে।
স্নান সেরে দিলীপ দোতলায় গেল। মামণির কাছে গিয়ে বলল, কাল তিনটেয় উঠে চারটেয় বেরোতে হবে। আজ নটা অবধি যা হবে তাই পড়। রাতে ভালো করে ঘুমিয়ে নে। কাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরা অবধি আর তো ঘুমের চান্স নেই। আজ রাত জাগিস না। মামণি বলল, তুমি দুঃখ পেলে ওদের ফোন করলাম বলে? আমি জানি তুমি কারুর থেকে কোনো ফেভার চাইতে মানা করো... আমাদের ভালোর জন্যই। দিলীপ হেসে ফেলল, ফোন করে ঠিক করিস নি। এরা প্রতিবাদ, বিরুদ্ধতা সহ্য করে না। সেখানে এতোটা জ্ঞান দিলি, ওদের ইগোয় ধাক্কা দিলি। ওরা তোর বন্ধু ছিল না, এবার ওরা তোর শত্রু হয়ে গেল। তুই ফেভার চাইলে তো ওদের ইগো আরাম পেত, উল্টে তুই ওদের মেরেছিস, কথার চাবুক। ওরা এটাই চায় মানুষের মধ্যের হিংসেটা, ঘেন্নাটা টেনে বার করে আনতে। হিংসে আর ঘৃণাই রাজনীতির মূলধন, অস্ত্রও বটে। সামনে পেলে তুই ওদের সাথে মারপিটই করে ফেলতিস তাই না? মামণি জবাব দিল না। শুধু তাকিয়ে রইল। দিলীপ বলল, মানে তুইও ওদের যা খারাপ বলে জানিস সেটাই নিজে করে ফেলতিস। আর ওদের রাজনৈতিক শত্রুরা তোকে নিজের দলের বলে প্রমাণ করত। মানে তুইও একটা রাজনৈতিক দলের হয়ে যেতিস। আর অন্য আরেকটা দলের শত্রু হয়ে যেতিস। ......... এদের হারেরেরেতে বুদ্ধি হারাতে নেই। বিচার করতে হয়, কী করে এদের এইসব হল্লা এড়িয়ে নিজের কাজটা সেরে ফেলা যায়। তবে আজকে তো আর একার জন্য কথা বলিস নি। অনেকগুলো পরীক্ষার্থীর হয়রানির কথা ভেবে একটা প্রকৃত কারণের জন্য কথা বলেছিস। চরিত্রবল, সাহস, আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে এই প্রতিবাদ আর বিরুদ্ধতা করার ক্ষমতাটাও জরুরি। সেটা তোর আছে তুই জেনে গেলি। অতএব কাল যাই হোক, একার জীবনে তুই সারভাইভ করতে পারবি। একটু থেমে আবার বলল সে, মনোযোগ হারাস না, ধৈর্য হারাস না, পড়।
রাতে শুয়ে কিছুতেই ঘুম হতে চায় না কবিতার। বুল্টু আর দিলীপের পাল্লা দিয়ে নাক ডাকানো, নাকি মামণির ঘরের জ্বলতে থাকা আলো কিছু একটা কারণ হবে। তারপর একটু ঘুম ধরল কী তছনছ হয়ে গেল সাতাশ বছর আগেকার দুঃস্বপ্নে। তারপর আবার ঘুম একটু গভীর হতে না হতেই তিনটের অ্যালার্ম বেজে উঠল।
মামণিকে সারা দিনের জন্য কিছু খাবার আর জল দিয়ে দিল কবিতা। যন্ত্রের মতো ঝালিয়ে নিল, অ্যাডমিড কার্ড, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট সব নিয়েছিস তো? মাথে নেড়ে সম্মতি জানায় মামণি। দিলীপের পেছন পেছন দৌড় লাগায় প্রায়। এতো ভোরে রিক্সা পাওয়া যাবে না। ওকে আর দিলীপকে অনেকটা সময় এই শেষ বৈশাখের গরমে কাটাতে হবে ঘরের বাইরে। পরীক্ষা তো শুরু সেই দুপুর বারটায়। এসব ভাবনার একরাশ উদ্বেগে অস্থির শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয় কবিতা। ভাবতে থাকে যে সে সব দিনই কী আবার ফিরে এলো? ফিরে আসছে নাকি সেসব দিন? ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা তখন প্রত্যেক বছরই পিছোত অনির্দিষ্টকালের জন্য। কোন বছরের পরীক্ষা কোন বছরে হচ্ছে তার ঠিক ছিল না। পরীক্ষা একরকম হলো তো রেজাল্ট বেরোতে বছর ঘুরে যেত। দুষ্টু ছেলেগুলো বলত, দশ মাসে মানুষ একটা বাচ্চার জন্ম দিয়ে দিতে পারে, আর ইউনিভার্সিটি একটা রেজাল্ট বের করতে পারে না! তারপর পরীক্ষা সেন্টারে পৌঁছে দেখো তোমার নাম-রোল নম্বর সেন্টার কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তখন তুমি ঘুরতে থাকো ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক বিভাগ থেকে সেন্টার আর সেন্টার থেকে ইউনিভার্সিটি।
আলো ফুটল। দিন শুরু হলো। খবরের কাগজ এলো। পুরো পাতা জুড়ে রাজনৈতিক দাঙ্গার খবর। সক্কাল সক্কাল এতো রক্তারক্তির কথা ভালো লাগে না কবিতার। কে জানে এখন চোখের সামনে দাঙ্গা তেমন হতে দেখে না বলেই কী দাঙ্গার ওপর এতো বিতৃষ্ণা? বাড়ির সামনে খুনোখুনি দেখলে হয়তো তার সাথে বসবাসের অভ্যেস হয়ে যেত। যেমন ছিল তিরিশ বছর আগে। তখন মনে হতো যে মাস্টারমশাই শুধু ছাত্রকে শাসন করলেন বলে তাঁকে ছাত্ররা মারল? আজ পরিণত বয়সে কবিতা বোঝে যে মাস্টারমশাই নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্রীমশাই বা ষড়যন্ত্রীমশাইয়ের আখেরে ঘা দিয়েছিলেন বা আখের গুছোনোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আর সুধীরদার পেটের রোগ দাঁড়িয়ে গেল পুলিশের মার খেয়ে খেয়ে, কারণ ওর নকশাল ভাইটাকে পুলিশ কখনও ধরতে পারে নি। অনেক রকম শোনা যেত এ নিয়ে। সুধীরদাকে অমন করে মারা হলো বলেই নাকি ওর ভাইটা পুলিশ খুন করেছিল প্রতিশোধ নিতে, না হলে প্ল্যাম্পফ্লেট বিলি ছাড়া আর কিছু করত না সে ছোকরা। আবার কেউ কেউ বলত, ওর ভাইটাকে পুলিশ আগেই মেরে ফেলেছিল, তার সাঙ্গপাঙ্গদের ভয় দেখাতে সুধীরদাকে বারবার তুলে নিয়ে যেত থানায়। সত্যি মিথ্যের কথা কেউ জানে না। এদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই জমির তুলনায় লোক অনেক বেশি। একটা তানা-নানা করে তাদের শত্রু-মিত্র সাজিয়ে লড়িয়ে দেওয়া সোজা। তাতে ধনে-মানে লাভ হয় গদিয়ালদের।
সময় থেমে থাকে না। বুল্টুও স্কুলে রওয়ানা হয়ে গেল যথা সময়ে। তারওপরে ফোন বাজল। দিলীপ আপিস পৌঁছে খবর দিল, সাড়ে পাঁচটায় হাওড়া স্টেশন পৌঁছে গিয়েছিলাম। সাড়ে ছটার পর বাস ধরে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছই। তারপর হেদোয় বসে ছিলাম। বেথুনের মর্নিং সেকশনে এতোগুলো মেয়েকে ঢুকতে দিতে চাইল না। কবিতা জানতে চাইল, আর কে কে ছিল? দিলীপ বলল, অনিন্দিতা বলে একটি মেয়ে ও তার মা, জয়ালক্ষী বলে একটি মেয়ে ও তার বাবা তো আমাদের সাথে এখান থেকেই গিয়েছিলেন। তারপর প্রায় শখানেক মেয়ে জড়ো হলো সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে। জয়ার বাবা আর অনিন্দিতার মা থাকবেন সারাদিন। আমি ওঁদের সাথে মামণিকে রেখে এসেছি। আবার সাড়ে দশটার দিকে একবার বেরিয়ে যাব, আজ তো প্রথম দিন একঘন্টা আগে গেট খুলে দেবে। অনেক বিল উঠে গেল তাই কবিতা আর কথা বাড়ালো না। বাবা আর মেয়ে ঠিকঠাক খেলো কিনা, মেয়ের কাছে টাকা পয়সা আছে কিনা সেসব নিয়ে চাপা উদ্বেগ রয়ে গেল কবিতার মনে। দুপুরে খবরের কাগজটা নিয়ে বসতেই চোখ জুড়ে এলো তার।
কিন্তু ঘুম হলো না। চোখ বুজলেই দেখে যে, সাতাশ বছর আগের একটা দিনে, কিশোর এসে বলছে, কবিতাদি এই মাত্র হেডমাস্টারটাকে মেরে এলাম গো। সারা গায়ে ভয়ের কাঁটা কবিতার আর তার দিদির। মা রান্নাঘর থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এলেন, যা অনামুখো, বলেছি না আমার বাড়ির চৌহদ্দিতে পা রাখবি না। বাপ-মার মুখে তো চুনকালি দিয়েইছিস, এখন তোর জন্য আমার ছেলেমেয়েগুলোরও বিপদ হোক। কিশোর চোখে অনেক রাগ এনে বলল, মরা বাপ-মায়ের মুখে চুনকালি দেব কী করে? জেঠুর বাড়িতে চাকরের মতো থাকি, শুধু লোকের মুখ বন্ধ করতে স্কুলে পাঠানো। কী হবে এসব বুর্জোয়া শিক্ষায়? কবিতার মা আবার ধমকে উঠলেন, কে শিখিয়েছে এসব তোকে, ডাক্তারের ব্যাটা? জ্যাঠাও কী তোর মতো অনাথের শ্রেণীশত্রু নাকি রে অকৃতজ্ঞ ছেলে? তাদের মতো মানুষ হয় না তোকে তো ডাক্তারের ব্যাটা কালসাপ বানিয়ে তুলেছে দেখছি! কিশোর মুখভঙ্গি করে বলল, ভারি তো দুধকলা খাওয়াচ্ছিল!, সপ্তায় একদিনের বেশি ভাত দিতে পারে নি... কথা না বাড়িয়ে কুড়িটা রুটি দাও তো এখন... কবিতার মা আরও রেগে গিয়ে বললেন, তোদের নেতা নিজের বড়লোক বাপের না খেয়ে পাড়ার হা-ভাতে লোকের দরজায় শৌখিন ভিক্ষে করতে পাঠিয়েছে? কেন? স্যাঙাত জুটিয়েছে বেছে বেছে যতো বাপ-মা মরা কী বাপে খেদানো অভাগাগুলোকে! গুরুজনদের শত্তুর সাজিয়ে! বলে দিস সে হারামজাদাকে আমার মেয়েদের ফুঁসলানোর চেষ্টা করলে চোখ উপড়ে নেব। আর যদি কখনও রুটি চেয়েছিস এদিকে তোর ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব... বলতে বলতে তিনি দরজার শাল কাঠের ভারি খিলটা তুলে তেড়ে গেলেন কিশোরের দিকে। কবিতারা দুবোন মায়ের এই মূর্তি কখনও দেখে নি। কিশোর তো চলে গেল দৌড়ে। মা কবিতাকে খুব বকেছিলেন তারপর, পরদিন পরীক্ষা, পড়ায় মন না দিয়ে অলক্ষুণে ছেলেটার কথা গিলছিল বলে। ইলেকট্রিক কানেকশন ছিল না কবিতাদের বাড়িতে তখনও।  আলো হাওয়ার জন্য দরজা খুলে রেখেই পড়তে বসতে হতো, দিনের বেলা। সন্ধেবেলাও। তাতেই বিপত্তি।
পরদিন ছিল পরীক্ষার শুরু, অনার্স পেপার ওয়ান দিয়ে। অনার্সের হোম সেন্টার আর পাসে বাইরে সেন্টার হতো; সাধারণতঃ কলকাতায়; ফলে দশটার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সাতটা-সাড়ে সাতটায় বেরোতে হতো। কবিতারও পরীক্ষার প্রথম দিনেই বাস বন্ধ ছিল। তখন ওরকম হুটহাট বাস বন্ধ থাকত হামেশাই। নতুন রাস্তা অবধি হেঁটে যাওয়ার পর একটা রিক্সা পেয়েছিল কবিতা আর তার বন্ধু রমা। দালালপুকুরে পৌঁছে দেখেছিল কোনো গাড়িঘোড়া না পেয়ে ওদের আরেক বন্ধু আল্পনা তার বরের সাথে দাঁড়িয়ে। তারপর সেই একটা রিক্সাতেই তিনজনে নরসিংহ দত্ত কলেজে যাচ্ছিল। শ্যামাশ্রীর সামনে পৌঁছে তিনজনের হৃৎকম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সিনেমা হলের বারান্দায় ঝুড়ি করে সাতটা মাথা বসানো। ঝেঁপে বৃষ্টি পড়ছে তখন। রিক্সাওয়ালাও তিনজনকে নিয়ে খুব জোরে রিক্সা টানতে পারছিল না।
তারপর পরীক্ষার হলে সাম্যবাদীরা খাতার লেখা পাতাগুলো নিয়ে টানাটানি করছিল। তাদের দাবি ছিল যে নম্বর বেশি পাওয়ার পুঁজিবাদী স্বার্থপরতা করা চলবে না। আর এক্সটার্নাল ইনভিজিলেটর টহল দিয়ে যাচ্ছে। যাকে সন্দেহ করবে তাকেই রাস্টিকেট করে দেবে।  থেকে থেকেই ডেস্কে ডেস্কে ঘনিয়ে ওঠা তর্কাতর্কি, খাতা-টানাটানিতে কাকে দোষী ধরবে ইনভিজিলেটর? কবিতার বাবা মারা গিয়েছিলেন এই পরীক্ষার দু বছর আগে। দাদার একার রোজগারে পাঁচ ভাইবোন আর মায়ের খরচ চলে। কবিতা, তার দিদি আর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকা তাদের ছোটভাই টিউশন করে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনার চেষ্টা করত। বোনের ক্লাস ফাইভ সবে। কবিতার একটা চাকরি চাই, তক্ষুণি। কিন্তু খাতাটা নিয়ে টুকলিবাজরা ফেরত না দিলে ঠিকঠাক? রাস্টিকেট করে দিলে ইনভিজিলেটর.....
সেসব দিন কেটে গেছে। কিশোরকে একদিন পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেইদিনই জানা গিয়েছিল যে ডাক্তারবাবুর ছেলে নাকি গায়েব। অনেক বছর পরে বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে সে দেশে ফিরেছিল। বাবা কংগ্রেসি কাউন্সিলর ছিলেন কর্পোরেশনে। সে ফেরার পর অনেকদিন কোনো রাজনীতি করে নি। এখন বড়ো নার্সিংহোম করেছে। আগেরবার সিপিএমের টিকিটে লোকসভার ভোটে দাঁড়িয়েছিল। এবার আবার বলেছে ভোট বয়কট করতে।
বুল্টুদের স্কুল হয় নি আজ। দুপুর হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে এসেছে। এবার মাঠে খেলতে যাবে। ফোন বাজল। মামণি বলল, মা পরীক্ষা ভালো হয়েছে। সব খেয়েছি। এইবার বাস ধরব। বাড়ি ফিরেই খবর শুনতে বসল মামণি। কাল ছুটি। পরশু আবার পরীক্ষা। কালকে জবাবি বন্‌ধ ডেকেছে সিপিএম, শুধু আরামবাগ ব্লকে, যেন ওখানকার ছেলেমেয়েরা শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া, রিষড়ায় পরীক্ষা দিতে যাবে না; তবে সমর্থকরা আরামবাগের বন্‌ধকে সর্বাত্মক করে তুললে নেতৃত্বের কোনো দায় নেই বলেও জানানো হয়েছে। আর পরশু এসইউসিআই রেখেছে দুঘন্টা রেল অবরোধের কর্মসূচী, উপলক্ষ আরামবাগে হিংসার অবসান।

মামণি হাতি বাগানে মাসির বাড়ি চলে গেল পেপার টু পরীক্ষার দিন থেকে। ওর জামাকাপড়, বই পত্র দিলীপ পৌঁছে দিলেন সেখানে। জয়া, অনিন্দিতা আর আরও অনেকের কলকাতায় থেকে পরীক্ষা দেওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। ওরা রোজ ভোর চারটের সময় ট্রেন ধরে, সারা সকাল হেদোয় বসে থেকে, দুপুরে পরীক্ষা দিয়ে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরল, বাকি সব অনার্স আর পাস পেপার।

Friday, September 25, 2015

বাংলা মিনিসাগা


অজাতশত্রু


এক রাজপুত্র সিঙ্ঘাসনে বসেছিলেন অজাতশত্রু নামে। সার্থকনামা হতে তিনি তিনটি কাজ আজীবন করেছিলেন। প্রথমত, সবার সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা; দ্বিতীয়ত, যে বন্ধু হয় নি তার বিনাশ, তৃতীয়ত, শত্রুতার সূত্রপাত জানার জন্য চরচর্চা; তার অবশ্যম্ভাবী ফলে শত্রুকে বিনাশ করতে্ন স্থলে, জলে, ছলে বলে, কৌশলে মাতৃজঠরেও। বলাবাহুল্য, তিনি রাজত্ব করেছিলেন জনশূণ্যলোকে।


শঠে ......


লক্ষীরাম আর গঙ্গারাম বুক কাঁপিয়ে হেসে উঠেছিল আইনি বিধান শুনে। সেই বুক ঠুকেই বলেছিল লক্ষীরাম, “আমার নামে উনিশটা আর গঙ্গাদার নামে একুশটা ফৌজদারি রয়েছে।” শুধরে দিয়েছিল গঙ্গারাম, “তেইশটা, ব্যাঁচড়ার চাচা কেটে।”
সেই রাতে সরকারি বনসৃজন প্রকল্পে গরু পড়তে নিরুপায় আধিকারিক সবকটাকে তাড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন লক্ষীরাম গঙ্গারামের ধান খেতে।




শোক ও শিক্ষা


আগে একবার আগুনে পুড়ে গিয়েছিল সনাতনের কেশ, বেশ, বাস, বসত। চুল, চামড়া নতুন গজিয়েছিল। মনের আরাম এসে ছিল সব ভুলে।পরে অন্য আগুনে পুড়তে পুড়তে সে বুঝল যে আগেরবারের দহনশোকের সাথে সে আঁচের অনুভূতি, বিস্ফোরণের কারণ, জ্বালানির চেহারা এসবের লক্ষণ চেনার শিক্ষাটাও ভুলে গিয়েছিল, তাই নিবারণ করতে পারে নি পুনর্দাহ।

শ্রান্ত পান্থের বৃক্ষনিবাস


ধাবায় ঢোকার আগে, লোকটা গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে মাটিতে নামিয়ে রাখল ডালপালা সমেত একটা গাছ। তার ডালে কাঠের একটা বাড়ি টাঙানো, যেন পাখিতে বাসা করবে। স্নান খাওয়া সেরে লোকটা যখন ফিরল তখন গাছটা মহীরুহ। লোকটা এবার ট্রাঙ্ক থেকে ফোল্ডিং মই বাই করে চড়ল ট্রি হাউসে। তারপর ঘুমিয়ে গেল রাতের মতো।

Sunday, August 2, 2015

সুকন্যা বৃত্তান্ত

সুকন্যা সত্যিই ভালো মেয়ে। তার মা বলেন, “ওকে কোনো দিন বলতে হয় নি ‘পড়তে বোস।’ কোনোদিন কোনো বায়না ছিল না ওর। যা খেতে দিয়েছি তাই খেয়েছে। যে জামা পরতে বলেছি তাই পরেছে। ফ্যাশন নিয়ে মোটে মাতামাতি ছিল না ওর...” তার বাবা বলেন, “মেয়েটা বড়ো ঘরকুনো, মুখচোরা ছিল। তাই লাইব্রেরিতে মেম্বার করে দিয়েছিলাম। তাও মেয়েটা অমিশুক, চুপচাপ রয়ে গেল।
সেই সুকন্যা ভালোই আছে। বিগড়েও যায় নি; খারাপও হয় নি; একটুও না। আসলে সুকন্যা খারাপ হতে পারে না। এটাই তার গলদ। সেই যে ভালোতে মন্দতে মিশিয়ে মানুষ বলে নাসুকন্যারও তাই। সে সত্যিই ভালো আর এই যে সে খারাপ হতেই পারে না এইটাই তার মন্দ। একথাটা সুকন্যা টের পেয়েছিল বেশ অল্প বয়সেই; সেই যখন সুকন্যা আর তার ভাই গুপি এক থালায় ভাত খেতো, তখন। গুপির মুখে ভাতের দলা দিলে সে খেলাচ্ছলে ফ্রু ফ্রু করে ভাত ছিটিয়ে দিত। মা অমনি চোখ বড়ো বড়ো তাকাতেন গুপির দিকে আর গলার স্বর গাঢ় করে বলতেন, “ছি গুপি, খাবার নষ্ট করতে নেই। জানো কতো লোকে খেতে পায় না? তুমি খেতে পাচ্ছো বলে মুখের ভাত দালানে ছেটাবে? তুমি না বুদ্ধিমান, কখনও এরকম করবে না আর।” গুপি কিছুক্ষণ পরে ভুলে গিয়ে আবার ফ্রু ফ্রু করে ভাত ছেটাতে শুরু করত। তখন মা মনে করানোর চেষ্টা করতেন যে গুপিকে মা কী শিখিয়েছেন। তারপরের বার গুপি কানমলা খেত। তারপরের বার কিল। তখন কাঁদত। তারপর ঘুমিয়ে পড়ত। তারপর সব ভুলে যেত আবার।
সেই সময় একদিন আঁচাতে গিয়ে সুকন্যা দেখেছিল কলঘরের নর্দমার মুখে বেশ দশ-বারো দানা ভাত পড়ে আছে। সুকন্যার আগে তার দাদু আঁচিয়ে ছিলেন সেখানে। তাঁর হাতের থেকেই সম্ভবতঃ পড়েছিল ভাতের দানাগুলো। সুকন্যা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়েছিল। তারপর মায়ের অনুমতি চেয়েছিল, “মা, এই ভাতগুলো হাঁড়িতে রাখব?”  মা জানতে চেয়েছিলেন, “মানে, কোন ভাত?” উত্তর শুনে বলেছিলেন, “না, রাখবে না।” শুনেই সুকন্যা ভাতের দানাগুলো মুখে দিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ একটা জোরালো কিল তার পিঠে এসে পড়েছিল। সন্ধেবেলা বাবা বাড়ি ফিরতে মা নালিশ করেছিলেন, “তোমার মেয়ের কাণ্ড জানো? সে নর্দমা থেকে ভাত কুড়িয়ে খাচ্ছে! আমি যেন তাকে পেট ভরে খেতে দিই না।” মা একটু শান্ত হতে বাবা সুকন্যাকে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন, “অমন নোংরা থেকে ভাত খুঁটে খেলে কেনো তুমি?” সুকন্যা ঢোক গিলে বলেছিল, “অনেক লোক যে খেতে পায় না, তাই তো ভাত নষ্ট করতে নেই...... মা বলেছিল যে।” মা চেঁচিয়ে উঠে আবার এক ঘা দিয়ে বলেছিলেন, “আমি নর্দমা থেকে ভাত কুড়িয়ে খেতে বলেছি?”
সেদিন সুকন্যা বেশ বুঝেছিল যে সে কিছুই বোঝে নি। “খাবার নষ্ট করতে” নেই মানে “ফেলতে নেই”; কিন্তু ফেলে দেওয়া খাবার তুললে দোষ হয়; কী-করতে-হয় আর কী-সে-যে-কী-হয়-এর দুর্বোধ্যতায় সে শুধু শুনতে শুরু করেছিল। না প্রশ্ন করলে উত্তর দিত না। আর না করতে বললে কোনো কাজ করত না। তাকে একটা কাজ করতে বললে সেই কাজের আওতায় কী কী পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে তবে সে কাজটা করত। আবার প্রত্যেক ধাপে কাজটা ঠিক হলো কিনা জেনে নিত। এভাবে কৈশোর নাগাদ সে বাধ্য, বিনয়ী আর কুশলী হয়ে উঠেছিল সবার বিচারে। কিন্তু সেই সবার মধ্যে কে কে ছিল না সেটাও সুকন্যা জানত। এই জানার একটা বোনাসও ছিল।  বোনাস বোধি হলো যে সাধরণ বিশ্বাস: “যারা বলে কম, তারা শোনেও কম।” সেই কারণেই কেউ কেউ তার সামনেই বলত, “সুকন্যা বিনয়ী না ছাই। কথা বলে না কারুর সাথে এতো অহঙ্কার! নেহাৎ কাজেকম্মে, লেখাপড়ায় ভালো তাই কেউ কিচ্ছু বলে না। না হলে...” আর এভাবেই তিলে তিলে গড়ে উঠছিল জগৎ সংসার সম্বন্ধে তার ধারণার পুঁজি।
কিন্তু সে পুঁজি যে নিতান্ত অকিঞ্চিৎ সেটা সুকন্যা টের পেয়েছিল কলেজে গিয়ে। সেখানে উঁচু ক্লাসের দাদারা বলে, “সে কিরে তুই বাই সাইক্ল থিভস দেখিস নি! তুই কী গাঁওয়ার? তুই কামু পড়িস নি, কাফকা পড়িস নি! তুই তো অমানুষ, জানোয়ার।” উঁচু ক্লাসের দিদিরা বলল, “এমা তুই কাজল পরিস না! কী বিশ্রি বোকা বোকা লাগে। একটা লিপগ্লস তো লাগাবি, কেমন ভিখিরির মতো ফাটা ঠোঁট তোর।” এসব কথার কোনো উত্তর সুকন্যার জানা ছিল না। আর তাছাড়া নিরুত্তরে বোনাস বোধি পাওয়ার লোভও ছিল।
কিন্তু কলেজের বোদ্ধাব্রিগেড চমকে গিয়েছিল যখন সুকন্যা আন্তর্কলেজ তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় চ্যাম্পিয়ন আর বিতর্কে রানার্স আপ হয়েছিল। এক দিদি ব্যাগের ভেতর থেকে ব্যাগ, তার ভেতর থেকে আরেক ব্যাগ বার করে একটা লিপস্টিক দিয়ে বলেছিল, “এটা লাগিয়ে প্রাইজ নিতে উঠিস স্টেজে। ভাঙবি না, এটা টিউশনের পয়সায় কেনা।” আরেক দাদা এসে বলেছিল, “আমি তো দিল্লী চলে যাচ্ছি। আমার তিনটে ছাত্রকে পড়াবি?” সুকন্যা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। বক্তৃতা না হয় সে ইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই করে আসছে নানান দিবসে, নানান জয়ন্তীতে। তাই বলে ছাত্র পড়ানো? সে তো আগে কখনও পড়ায় নি কাউকে। এদিকে পড়ালে যে কাফকা, কামু, লিপস্টিক সব তার সে সম্ভাবনাটাও সে ফেলতে পারছিল না। সমাধান করে দিলেন এক মাস্টারমশাই। তিনি যাচ্ছিলেন কোথাও। যেতে যেতে সুকন্যার সাথে অন্য ছেলেটির কথোপকথন শুনে ফেলেছিলেন। সুকন্যাকে বলেছিলেন, “আমিও তো একদিন প্রথমদিন পড়িয়েছিলাম।”
এরপর সুকন্যার জীবনে অনেক কিছু প্রথমবার ঘটতে লাগল। বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখা, পিকনিকে যাওয়া, কানে ইয়ারফোন গোঁজা আর ওয়াকম্যানে গান শোনা, ইন্টারনেট সার্ফ করা। এই সময়টায় তার নিজেকে মোজার মতো মনে হতো। প্রত্যেকটা প্রথমবারের পর মনে হতো কেউ যেন মোজাটাকে উল্টে দিল একবার। এই সব ওলোটপালোটের মধ্যে সুকন্যার কিছু চ্যালা জুটেছিল। সুকন্যা তখন বেশ “সুকন্যাদি” হয়ে উঠেছিল।
তবু মাঝে মধ্যে পরীক্ষা ঘনিয়ে উঠলেই তার জীবনটা কেমন যেন “দুচ্ছাই, ভাল্লাগে না” হয়ে যেতো। আর পরীক্ষা কাটিয়ে উঠলেই তাকে পেয়ে বসত নতুন কিছু করার উশ্‌খুশুনি। এইসব উশ্‌খুশুনির সময় চ্যালাদের নিয়ে সুকন্যা কিছু একটা করার চেষ্টা করত। যেমন কলেজের সামনের ফুটপাথবাসী ছাত্রদের পড়ানো; পার্ক সাফ করা, সেখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গাছ লাগানো; গ্রামে গিয়ে ছাত্রদের জন্য ক্যুইজ প্রতিযোগিতা করা।
একসময় কলেজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটিতে দুশ জনের ক্লাস। নিজের নিজের দলের বাইরে কেউ কাউকে চিনতে চাইত না। সুকন্যার চালু জীবনটা হঠাৎ যেন অচল হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে ফাঁক পেলেই সে তখন কলেজে চলে যেত। চ্যালাদের সাথে আড্ডা মেরে বা কাজকম্ম করে বাড়ি ফিরে যেত। ছাত্র ধর্মঘটের দিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস হতো না। কিন্তু কলেজে মাস্টারমশাইরা নিজেরা গেটে দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে ইচ্ছুক ছাত্রদের কলেজে ঢুকিয়ে নিতেন। সেদিনগুলোতে সকাল সকাল সুকন্যা গিয়ে কলেজে ঢুকে পড়ত। তারপর কোনো মাস্টারমশাইয়ের ঘরে বসে, পড়ে, পড়া বুঝে বা পড়িয়ে কাটিয়ে দিত সারাদিন।
এরকম একটা ছাত্র ধর্মঘটের দিন কলেজের পাঁচিলে একসার লোক নিজেদের জলমুক্ত করছিল। দেখে সুকন্যার কিছু করার ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেদিন সপারিষদ দরবারে সে ঠিক করেছিল যে মিউয়েরেটিক অ্যাসিড, ফিনাইল আর ঝাড়ু কেনা হবে। তারপর মূত্র মুক্ত করা হবে দেওয়াল। ফের যাকে দেখা যাবে পরিষ্কার দেওয়ালের ধারে নিজেকে জলমুক্ত করতে তার থেকে ফিনাইল, অ্যাসিড আর ঝাড়ুর খরচ তুলে নেওয়া হবে, আর তাকে দিয়েই দেওয়াল পরিষ্কার করানো হবে।
সেদিনই কলেজ ছুটির পরে দেওয়াল পরিষ্কার করা হয়ে গিয়েছিল। সন্ধের সময়টা বয়েজ হস্টেলের ছেলেরা পাহারায় ছিল। যে কজনকে ওরা দাঁড়াতে দেখেছিল দেওয়ালের সামনে তাদেরকে ওরা মানা করেছিল। কোনো কারণে লোকগুলো মানা শুনেছিল। পরের দিন সন্ধে থেকে গভীর রাত অবধি কলেজের দারোয়ান বলরামদা নজর রাখতে লাগল। আর ভোর থেকে কলেজ শুরু হওয়া অবধি বয়েজ হস্টেলের বাহাদুরদা। একদিন সকালে একটা লোক বাহাদুরদাকে বোঝাতে গিয়েছিল, “মানুষের আড়াল লাগে। তাই তো দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ায় লোকে।” সে লোকটাকে বাহাদুরদা একটাকা দিয়ে সুলভ শৌচাগার দেখিয়ে দিয়েছিল। এরকম দয়াতে ছাত্ররা বিরক্ত হয়েছিল। টাকা দিয়ে শৌচাগারে পাঠালে যে দেওয়ালের আড়াল নিত না সেও নেবে। টাকাটা রোজগার হবে আর অন্য কোনো দেওয়ালের আড়ালে কাজটা সেরে নেবে। তাই দফায় দফায় ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপ হতে লাগল। দেওয়াল বাঁচানোর প্রকরণ নিয়ে।
একদিন দুপুরে ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়েকে একটা লোক “কেয়া করে, গরীব হৈ?” বলে ডুকরে উঠেছিল। কিন্তু মেয়েটা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার শারীরিক আবশ্যিকতার সাথে ধনী-গরীবের শ্রেণীবৈষম্যের সম্পর্ক বোঝেনি। তাই সে লোকটাকে দিয়ে দেওয়াল তো সাফ করিয়েই ছিল, আর লোকটা সাফাইয়ের খরচ দিতে পারে নি বলে একটা কাগজে নানা ভাষায় “সাবধান! আমি দেওয়ালে হিসি করি” লিখে কাগজটা লোকটার জামার পিঠে আঠা দিয়ে এঁটে দিয়েছিল। একটা লোক থার্ড ইয়ারের তিনটে ছেলেমেয়েকে, “হুজ্জুতি করছ কেন? ফুচকা খাবে? পয়সা চাই?” বলে তাদের হাতে তিরিশ টাকা গুঁজে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে মুক্ত হতে চেয়েছিল। তারা টাকা তো নিয়েই ছিল। তার ওপর লোকটার জামাতেও কাগজ সেঁটে দিয়েছিল, “আমার টাকা সস্তা তো তাই যেচে ঘুষ দিই।”
কাজটা শুরু করার সপ্তাখানেকের মধ্যে হৈ-হৈ করে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। মাস্টারমশাইরা তো খুশি হয়েই ছিলেন, অধ্যক্ষও মাঝে মাঝে দশ মিনিট করে দেওয়াল পাহারা দিয়ে যেতেন ছুটির পরে। সে বছর কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবসে সুকন্যাকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। খবরের কাগজ আর টিভির লোকেরাও এসেছিল। অধ্যক্ষ তাদের সামনে বক্তৃতা করেছিলেন, “যে যুগে নেতা মানে ঘৃণিত রাজনীতিক, সে যুগে আমরা একজন অরাজনৈতিক নেত্রী পেয়েছি। মহাত্মা গান্ধির মতো। ভারতের ইতিহাসে গান্ধিই কেবল মানুষের জন্য আন্দোলন করেছেন, কোনো দল বা পদ বা চাকরির লোভে বা প্রয়োজনে রাজনীতি করেন নি। বলা ভালো গান্ধি রাজনীতিকে নয়, রাজনীতি গান্ধিকে আশ্রয় করেছিল। সুকন্যা আমাদের ছাত্রী। ভাবলে আনন্দে গর্বে উপচে উঠছে মন। আশা করব রাজনীতি সুকন্যাকে আশ্রয় বা গ্রাস করবে না......।”
এসব শুনে সুকন্যার মনে হয়েছিল যে জীবনে সেই প্রথম সে কোনো আদর্শ খুঁজে পেয়েছিল। যেন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায় একটা টিমটিমে আলোর বিন্দুর মতো, একটা দিশা। তারপর কল্মষারি বলে একটা অলাভজনক সংস্থা শহরের সব দেওয়াল পরিষ্কার রাখার কাজে এগিয়ে এসেছিল। সুকন্যাকে তারা পার্টটাইম মেন্টর রেখেছিল। ইউনিভার্সিটির ক্লাসের পর সে সংস্থাটার শিক্ষানবিশদের ক্লাস করাতো দেওয়াল সাফাইয়ের নীতি নিয়ম নিয়ে। এইসব শিক্ষানবিশরাও অল্পবয়স্ক ছাত্র ছিল। বা পড়াশোনা ছেড়ে কাজে লাগতে শহরে এসেছিল। তাই কেউ পার্টটাইম কাজ করত, তো কেউ ফুল টাইম। প্রথম তিন-চার মাসে কল্মষারির উদ্যোগে শহরের প্রায় সমস্ত দেওয়াল পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। খুব রমরমিয়ে চলছিল দেওয়াল সাফ রাখার পাহারাদারি আর দেওয়াল নোংরা করার জন্য জরিমানা নেওয়ার কাজদুটো।
ইউনিভার্সিটির পাট চুকতে সুকন্যার একটা ব্যক্তিগত সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তাঁর মা চাইছিলেন তখন বিদূষী, বাধ্য, বিনয়ী, কুশলী কন্যাটিকে সুপাত্রস্থ করতে। কিন্তু বাবা চাইছিলেন যে সুকন্যা আরও পড়াশোনা করুক, বিদেশে যাক, গবেষণা করুক। সুকন্যা চাইছিল দেশনেতা হতে। তার ইচ্ছে ছিল সারা দেশে সে ট্রেনে চেপে ঘুরে বেড়াবে, দেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়াটা বুঝে নিতে। কিন্তু বাবা-মায়ের মতানৈক্য দেখা দিতে সুকন্যার নাম থেকে সু খসে যেতে বসেছিল আর কী। মা দুঃখ করে বলতেন যে বাবার ইচ্ছেতেই মা মেয়ের পড়াশোনা, ব্যসন-ভূষণের তদ্বির করেছেন এতকাল। তাঁর নিজের কোনো ইচ্ছেই ছিল না মেয়েকে বিদ্যের জাহাজ করার কেন না তিনি জানতেন যে মেয়েকেও সংসারে তাঁর মতোই সার হতে হবে। এই তর্কে সুকন্যা বোনাস পেয়েছিল যে মায়ের যাবতীয় অনুশাসন হলো বাবার গেঁথে দেওয়া নীতির অনুসরণ মাত্র; তাঁর নিজস্ব কোনো মতই ছিল না।
এই সময়ে টিভির পর্দায় দেখা গিয়েছিল যে কল্মষারির কর্মীরা ঘুষ নিয়ে দেওয়াল নোংরা করতে দিচ্ছে। এক্কেবারে সন্ধেবেলার সরাসরি সম্প্রচারে। প্রচুর বিতর্ক হয়েছিলো। হাঁ হাঁ করে রাজনীতিকরা চেঁচিয়ে ছিল, দাপিয়ে ছিল, “কোন অধিকারে বা আইন বলে কল্মষারি দেওয়াল নোংরা করার জরিমানা ধরে?” “পুলিশ যদি না ধরে তো এই সংস্থা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পুলিশের কাজ করছে কেন?” “এ তো তোলাবাজি আর গুণ্ডামির সামিল?”
একটা ছাত্র সংগঠন আন্দোলনে নামল বিকৃত ছাত্র মনোবৃত্তির সংশোধনের উদ্দেশ্যে। তাদের স্লোগান ছিল, “যাহারা নিত্য দেওয়ালে ঢালিছে উষ্ণ রেচিত দ্রবণ,
   তাহারা পাতক, সুচারু বাক্য করে নি কখনও শ্রবণ।
   তাহারা শাস্তি অবশ্য পাবে আদালতে যথাবিধি।
   আমরা মুক্তি পূজারি, কেন তাদেরকে বাদ সাধি?
এই দলটার বক্তব্য ছিলো যে দেওয়ালে প্রসাব করা নিশ্চয়ই অন্যায়, কিন্তু প্রস্রাবকারীকে বাধা দিলে তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়।
সুকন্যা কল্মষারির কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল ভারত দর্শনে। মা কেঁদে ছিলেন। বাবা গর্জে ছিলেন। গুপির তখন না ছিল পড়াশুনো না প্রেমিকা। তাই সে গিয়েছিল দিদির শাগরেদি করতে; শর্ত একটাই মুখে কুলপ আঁটতে হবে। মাসতিনেকে ওরা ভাইবোনে ছুঁয়েছিল তিরিশটা শহর, গ্রাম, কসবা। শহরের লোকের খাবার জলের অব্যবস্থা আর গ্রামের লোকের গোসলখানার অভাব দূর করার ফিকির ভাইবোনে ভেবেছিল অনেক। সেই সময় শাকিলা বিবি বলে এক গৃহবধু বলেছিল, “আমার পায়খানা ঘরটা পড়েই আছে গো। ওখানে গেলে শান্তি পাই না। মর্চি নদের বালিতে রাংচিতার আড়াল ছাড়া ও কাজটা হয় নাকি? আমার আজন্মের অভ্যেস যে!” অভ্যেসের স্বাস্থ্যাস্বাস্থ্য নিয়ে শাকিলার সাথে তর্কটা সারই হয়েছিল। তারপর এক শহরে তারা দেখে ছিল যে ঝুপড়ির লোকেরা রোজ বিকেলে সাইকেলে নানা রঙের নানা মাপের জ্যারিকেন ঝুলিয়ে কাছাকাছি কসবা থেকে জল নিয়ে আসছে। কেউ বিলোচ্ছে, কেউ বিকোচ্ছে।
এরই মধ্যে সুকন্যা আর গুপি একদিন খবর পেয়েছিল যে কল্মষারি শহরের সমস্ত দেওয়াল সাফ রাখার বরাত পেয়েছে পৌরসভার থেকে এবং জরিমানার টাকাও তারা জমা দিচ্ছে পৌরসভাকেই। ওদের যত কর্মী ঘুষখোর বলে ধরা পড়েছিল, তাদের সবার মাথায় চোর লেখা গাধাটুপি পরিয়ে, তাদেরকে শহর পরিক্রমা করানো হয়েছিল। তারপর তারা আদালতে বিচারকের সামনে প্রতিশ্রুত হয়েছিল যে ফের ঘুষ নিলে তাদের চাকরি যাবে আর শেষ দুমাসের মাইনে জরিমানা বাবদ পৌরসভাকে দিতে তারা বাধ্য হবে; অনাদায়ে দুবছর হাজতবাস। সুকন্যা কল্মষারির কর্ণাধারকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাতে তিনি সুকন্যাকে কাজে সামিল করে নিতে চেয়েছিলেন।
সুকন্যাও চেনা জমিতে ফসল তোলার সহজ লোভে ফিরেছিল। কিন্তু একদিন ওরই সামনে কয়েকটা লোক একসাথে দেওয়াল নোংরা করেছিল আর কল্মষারির কর্মচারী তাদের মানাও করে নি। শুধু রসিদ কেটে জরিমানা নিয়েছিল। পরদিন সেই কর্মচারীকে আপিসে ধরে সুকন্যা জানতে চেয়েছিল যে কর্মচারিটি কেনো এমন করেছিল। উত্তরে শুনেছিল যে, “দুয়েকটা লোককে দেওয়াল নোংরা না করতে দিলে কর্পোরেশনের দেওয়া জরিমানার টার্গেট মেটানো হবে কী করে? কোম্পানি কমিশন পাবে কী করে? আর কোম্পানি কর্পোরেশনের দেওয়া ফিনাইল বাজারে বেচবে কী করে? বা বাড়তি ফিনাইল না কিনে তার ভুয়োবিল জমা দেবে কী করে?”
এরপর সুকন্যা শুধু কল্মষারিই ছাড়ে নি, দেশও ছেড়েছিল বাবার নির্দেশ মেনে। এখন সে কেনিয়ায় কেমিস্ট্রি পড়াচ্ছে। তাই কী এখানে দেওয়ালগুলোতে শেওলা জমেছে? আর টেড টকে শোনা যাচ্ছে পরের নোবেল আফ্রিকার? জানি না। তবে আজও দেওয়ালের দিকে মুখ করে কেউ প্রকৃতির সাথে নিভৃত আলাপ সারলে সুকন্যাকে মনে পড়ে। বেশ বসন্ত বাতাসের মতো মন ফুরফুরে হয়ে যায় এই বিশ্বাসে যে কেউ না কেউ আসবে ঝাড়ু আর ফিনাইল নিয়ে; কে জানে কোথা থেকে, ওয়াগাডুগু না ওট্টাপালাম থেকে; আর আবার সাফ হয়ে যাবে এই নাগরিক জীবন।

**আমার গল্প সংকলন "গুচ্ছ খোরাক" থেকে 

প্রচ্ছদ শিল্পীঃ রোহণ কুদ্দুস
প্রকাশক; সৃষ্টিসুখ

বইটা পাওয়া যাবেঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ঠিকানায়ঃ http://parabaas.com/bookstore/index.html#sanhita
ভারতে ("গুচ্ছ খোরাক") এই ঠিকানায়ঃ http://www.amazon.in/Guccha-Khorak-Sanhita-Mukherjee/dp/1625906366/ref=sr_1_17?m=A11UYLARTG1AFJ&s=merchant-items&ie=UTF8&qid=1393064887&sr=1-17 
> "সৃষ্টিসুখ"-এর আউটলেট, ৩০ এ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, (দেবী সারদা প্রেস লাগোয়া); দুপুর ২টো ৩০ থেকে সন্ধে ৬টা ৩০।
> সুচেতনা প্রকাশন, আদ্যা ভবন , ২০এ বলাই সিংহ লেন,, কলিকাতা ৯, ফোন ৬৫৪০৫৩৯০, ৯৮৩৬০৩৭৬০১,মেইলঃbasab.suchetana@gmail.com

Thursday, July 2, 2015

উদ্বর্তন



দেহলীর পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে এমন আনন্দের রাত সব মিলিয়ে দু-তিনটে। হাতঘড়িতে সময় বলছে মাত্র সাড়ে আটটা। টিভি ঘুরে চলেছে ক্রমান্বয়ে দেড়শটা চ্যানেলে। বেডসাইড টেবিলে রাখা আছে বাকার্ডি হোয়াইট রামের বোতলটা। সঙ্গে একটা ডায়েট কোক। উইকএণ্ড, তায় ভ্যালেন্টাইন্স ইভ। চাপ আছে হোটেলে, বরফের অপেক্ষা চলছে অনির্দিষ্টকাল।
একটা ট্রেন চলে গেল হুহু করে, বদ্ধঘরের টিভির আওয়াজ ছাপিয়ে। দেহলীর হাসি পেল এই ভেবে যে, ট্রেন যখন ছোটে ভাবে গন্তব্য সামনে, আর লাইন্সম্যান হঠাৎ করে তার ট্র্যাক বদলে দেয়, সে তখনও ভাবে গন্তব্য সামনে; কিংবা যখন সে টের পায় রাস্তা বদলে গেছে ততক্ষণে জাড্য তাকে টেনে নিয়ে গেছে অনেক দূরে, যেখান থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে অনিবার্য বাঁকটাও দেখা যায় না। অবধারিতভাবেই তার মনে হলো যে ঠিক এমনটাই ঘটে মানুষের জীবনেও; বার বার।
ভাবনার সুতোটা ছিঁড়ে গেল ডোরবেলের শব্দে। ফ্রেঞ্চফ্রাই আর বরফ এসে গেল। চিন্তার কাছে ফিরতে গিয়ে দেহলী টের পেল মাথাটা খালি হয়ে গেছে। খুব ভ্যাবাচ্যাকা লাগে এরকম সময়। ছেঁড়া চিন্তার প্রান্তটাকে হাতড়াতে হাতড়াতে চিন্তার নাও গিয়ে ঠেকে আরেক ঘাটে, কিংবা আঘাটায়, কিন্তু ঠেকে; জীবনের মতোই; চলে, ভাসতে ভাসতে, গোঁত্তা খেতে খেতে। আসলে চিন্তাও তো জীবনের ঘাড়েই চড়ে থাকে; তাই ডেস্টিনি কিংবা নেমেসিস -কোনোটাতেই সে ব্যাটা ভিন্ন, বিছিন্ন কিছুই হতে পারে না জীবন থেকে।
এখনও জীবনের সাথে জুড়ে আছে বলেই হয়তো ডিসকভারির লক্সোডন্টার থেকে দেহলীর স্মৃতিরা দৃশ্যপটে স্পষ্টতর। কী যে বোকা সে ছিল এই সেদিনও! সে বুঝতই না যে বিধি লিঙান্ত সব ঔচিত্য না মানলে সুখাসুখ, ভালোমন্দে খুব তরবেতর হয় না। সে আরও জানত না যে ভালো-মন্দের বোধটাও একেক লোকের দৃষ্টিকোণের ওপর দাঁড়িয়ে; সেই তফাতেই মানুষ বিচিত্র, বর্ণময়, অশান্তির আকর। যবে থেকে এসব বোধ জেগেছে, তবে থেকে ভালোমন্দের দায় সে অক্লেশে চাপিয়েছে ডেটারমিনিস্টিক ক্যাওসের ঘাড়ে , এতোবার, যে ওটা বিষয় না হয়ে ব্যক্তি হলে নির্ঘাৎ মামলা করত।
নির্বোধবেলায় দেহলী বেশ উদ্যম নিয়ে চেষ্টা করত জটিলতা এড়াতে। বলাবাহুল্য সামাজিক মানবজীবন তাকে সারল্যের স্বর্গে ছেড়ে দেয় নি কখনোই। অবশ্য আর পাঁচটা মানুষের মতোই, দেহলী বেচারিরও কোনো উপায় ছিল না মানবজনম আটকানোর; ফলে একটা সামাজিক জন্তুর জীবনে যতরকম সামাজিক বিনিময় থাকে সেটা সমূলে উৎখাত করা তার অসাধ্য ছিল। তাই জটিলতা এড়ানোর তুমুল চেষ্টা স্বত্তেও হঠাৎ একদিন বেশ খানিকটা গরম, তেতো, ভারি, চটচটে জটিলতা তার অস্তিত্বে আটকে গিয়েছিল। এই দূর্ঘটনার কেন্দ্রে ছিলেন তার পাড়াতুতো প্রাইভেট টিউটর।
টিউটর ভদ্রলোক কিছুই পড়াতে পারতেন না। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে দেহলীকেও খুব বেশি হলে তিনমাস পড়াবেন তিনি, কারণ তার বেশি কোনো টিউশনই টিকত না তাঁর। যেহেতু জমানার ফ্যাশন বাবদ একজন টিউটর রাখার কাজটা পূরণ হয়ে গিয়েছিল, আর দেহলীর বাড়ির লোকের অনীহা ছিল আবার টিউটর নিয়োগের বাড়তি পীড়া নিতে সেহেতু টিউটরমশায় দেহলীর টিউশনে টিকে গিয়েছিলেন তিনবছর; এই অনভিপ্রেত পোষণে টিউটর বেচারা ভবিষ্যত জামাই আদরের পূর্বাভাষ দেখেছিলেন; সে কথা তিনি পাড়ায় রটিয়েও ছিলেন। ফলে দেহলীর জীবনে টিউটরদ্বারা কিছু জ্ঞানবৃদ্ধি হয়েছিল অবশেষে। কিন্তু সে গলা তুলে টিউটরনিয়োজক বনাম টিউটরের দৃষ্টিকোণের ফারাক নিয়ে বক্তৃতা করার সাহস করেনি, তখন এবং পরেও, আরও জটিলতার ভয়ে।
কিন্তু এখন সবাই তাকে সাহসী বলেই জানে! এই রাত সে ধারণাকে চাগিয়ে তুলবে নাকি চুরমার করবে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই তার। ইন্ট্রোস্পেকশনেও কোনো জ্বালা নেই। ফলে দেহলীর ইগো জেগে উঠে তাকে আত্মসন্তুষ্টির উদ্দীপণায় কাজ-কাজ-কাজ চক্রে পিষে মরতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
হয়তো ক্ষিদে, তেষ্টা, প্রেম ইত্যাদি জীবনের অনিবার্য এবং নিতান্ত প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর একটা এই স্মৃতি রোমন্থন। আটকানো যাবে না একে। খেলে মোটা হয়ে যাবে বলে যতটা খিদে আটকানো যায়, প্রেম করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে জেনেও ততটাই প্রেম আটকানো যায়; প্রেম করাটা হয়তো কিছু বেশি আটকানো যায় কিন্তু প্রেমে পড়াটা এক্কেবারেই আটকানো যায় না; বাধ ভেঙে বান আসার মতোই এসে পড়ে, আবার কিছু পলি থিতিয়ে চলে যায় ধীরে ধীরে; শুকিয়েও যায় হঠাৎ একদিন। তখন কেঁদে ভাসাও আর হেঁসেই বাঁচো, কিংবা মাতাল হয়ে গালই খাও, সে আর ফিরবে না। ফেরত চাইলেই টানা-পোড়েন, চ্যুতি-স্খলন, আবেগের চোরাস্রোতে জটিলতার ঘূর্ণাবর্ত। সেই ঘূর্ণির বুকে জটিলতা ক্রমাগত গভীর ক্ষত খুঁড়তে খুঁড়তে তলার দিকে টানতে থাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা সকলকেই। সে টানকে একমাত্র মৃত্যুর অমোঘতাই পারে অগ্রাহ্য করতে। স্বেচ্ছামৃত্যুর আগের স্মৃতিরোমন্থন কী স্বেচ্ছাকৃত? ভাবতে থাকে সে।




স্কুলবেলার ছোট্ট গণ্ডীতে শ্রেষ্ঠত্বের সুখী অহঙ্কারে বালি দিয়েছিলেন মা; বলেছিলেন, .. নেই তাই খাচ্ছ...... বাইরের পৃথিবীটায় কমপিটিশন অনেক বেশি। কী যে চাইতেন তিনি দেহলীর থেকে বুঝতে বুঝতে দেহলীর পঁচিশ পেরিয়ে গিয়েছিল। মা-ই তাকে সারল্য সাধনায় বাধ্য করেছিলেন; তার নির্বুদ্ধিতা আর শ্রীহীনতা নিয়ে সজাগ করে দিতে চেয়েছিলেন; অস্তিত্ব ভরে নারী জন্মের গ্লানি দিতেও চেষ্টা করেছিলেন অনেক, কিন্তু পারেন নি। মায়ের বিনাপণের বিবাহিত জীবনে জা-ননদের কাছে সংকুচিত হয়ে থাকার গ্লানি, বংশের পুত্রসন্তানের আকালে চতুর্থ কন্যা সংযোজনের অপরাধবোধ এবং ইউনিভার্সিটি থেকে যৌথ পরিবারের হেঁসেলে জ্বালানী হয়ে ঢুকে পড়ার হতাশা তাঁকে এক স্নায়বিক খিচুড়ি বানিয়ে ফেলেছিল। দেহলী যখন অয়েলক্লথে শোয়, কিন্তু নিজের হাতে জেঠির ড্রেসিং টেবিল ঘেঁটে দিতে পারে তখন মা এক দুপুরে তার গলায় পা দিয়ে তাকে মেরেও ফেলছিলেন যেহেতু জেঠি হা-ঘরে মায়ের মেয়ের চোর হওয়ার সম্ভাবনায় সোচ্চার হয়েছিলেন; ঠাম্মা দরজা ধাক্কা দিয়ে ছিটকিনি আলগা করে ঘরে ঢুকে পড়ে বাঁচিয়েছিলেন দেহলীকে। হয়তো এসব কারণেই সে মায়ের টিচিং-প্রিচিং কিছুই নিঃসন্দেহে মেনে নেয় নি।
মায়ের অবাধ্য হলেও দেহলী কলেজের বছরগুলোতে কোনো অবোধ্য কারণে প্রেমে পড়ে নি। তবুও কলেজ মানেই তার জীবনে জটিলতার অটোইমিউন সংক্রমণ। শাওন যেমন বলে, আসলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপ জুড়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে ধন-মান-প্রাণ খোয়াতে দেখে, বেঁচে থাকা লোকগুলোর এবং পরের প্রজন্মের মানুষদেরও, মন থেকে সর্বমঙ্গলময় ঈশ্বরের ধারণাটা ভেঙে গিয়েছিল বলেই ইউরোপময় নাস্তিকে ছেয়ে গেছে...... তেমনই কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে মন দিয়ে পড়াশোনা করার সাথে বেশি নম্বর পাওয়ার সরল যোগাযোগের ধারণাটায় বিশ্বাস উপে গিয়েছিল দেহলীর । পরীক্ষা দিয়ে মা ফলেষু কদাচন কিংবা সিদ্ধ্যাসিদ্ধ্যোঃ সমো ভুত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে ভেবেই শান্তি, আরাম পেতে শিখতে হয়েছিল যদিও প্রিপারেশনের মন্ত্র থাকত যোগস্থ কুরু কর্মাণি
দেহলীর অবশ্য ক্রমশঃ ধারণা হয়েছে যে কলেজের চমকটাতে একপক্ষে তার ভালোই হয়েছিল। না হলে পরবর্তী পর্বে চাকরি-বাকরিতে টেকা দায় হতো তার। সে পর্বজুড়ে কেবল ব্যাকবাইটিং-এর রাজনীতি; ক্যারিয়ারের সিঁড়িতে পা পিছলানোর সকাল-সকাল অনিবার্য চমক এবং অবশ্যই দিনের শেষে নো-উইন বা উইন-উইন খেলে নির্লিপ্ত অসন্তুষ্টি নিয়ে বাড়ি ফেরা। চাকরির দিনগুলোতে তারিখ ছাড়া কিছুই তফাৎ করতে পারে না দেহলী। সবকটা দিন দৈর্ঘ্য-প্রস্থে-উচ্চতায় সমান। ছাত্রজীবনে তবু স্পষ্ট সাদা-কালো রঙের পোঁচ ছিল তার জীবনে, কিন্তু চাকরি জীবনে দুই রঙ মিশে একটাই ছাই রঙ।
আজকাল তো মেনে নিতে নিতে প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছে সে যে সিস্টেমের সব্বাইকে লাগবে। এর কারণ নুক এণ্ড ক্র্যানি কোম্পানির সাইট ম্যানেজার নীতিন মিশ্র। সে প্রজেক্টের টাকায় মায়ের নামে ট্রাক কিনে প্রজেক্টেরই মাল বওয়ার কাজে ট্রাকটা লাগিয়েছিল। তার ওপর লেবার কন্ট্রাক্টর থেকে বিভিন্ন সাপ্লায়ার সবাই ছিলেন নীতিনেরই আপনজন। ফলে প্রজেক্ট চলছিল বেশ শান্তিতে। সাইট ম্যানেজারের বিজনেস আকুমেনে তখন কর্তারাও সবাই চোখ বুজে সাধু! সাধু! করছিলেন। কিন্তু নীতিনের সেইসব আপনকল্যাণজনক দক্ষতায় মূল প্রজেক্টের বরাদ্দে ঘাটতি পড়েছিল; গোটা তিনেক ব্রিজ ভেঙে গিয়েছিল প্রজেক্ট শেষ হওয়ার আগেই। মিডিয়া খুব হুল বেচেছিল, কোম্পানির সুনামে বড় দাগ লেগেছিল। কোয়ালিটি অডিটর হিসেবে দেহলীর ক্যারিয়রেও একটা বড় ধাক্কা লাগতে পারত। লাগেনি কারণ দেহলীর আসল কোয়ালিটি রিপোর্ট এবং সে সব নিয়ে দেহলী যে সব যোগাযোগ করেছিল তার উপরওয়ালা, নীতিনের উপরওয়ালা এবং আরও উপরের কোনো ওয়ালার সাথে সে সব নিয়ে হুইস্‌ল্‌টি সে ফুঁকে দিলে কোম্পানির ভিতরে-বাইরে অনেককেই জেলে যেতে হতো। অথচ শোরগোলের সময় দেহলীই বলতে শুরু করে যে স্থাণীয় ঠিকাদার প্রতিশ্রূত মানের কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই দূর্ঘটনাগুলো ঘটেছিল। তার সুরে সুর মিলিয়ে কোম্পানি বলেছিল কন্ট্রাক্টর-পলিটিশিয়ান জোটের ছোটো-ছোটো কারণে লেবার খেপিয়ে থেকে থেকেই কাজ বন্ধ করে দেওয়ার রাজনীতির কথা; যেহেতু কোম্পানি তাদের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ ছিল সময়ে কাজ শেষ করার জন্য সেহেতু ডেডলাইন বাঁচানোর চাপের মুখে পড়ে স্থাণীয় ঠিকাদারের কাজের গূণমান মেনে নিতে কোম্পানি নাকি বাধ্য হয়েছিল। অভিযুক্তদের তালিকা বানিয়ে তাদের নামে আইনি ব্যবস্থার লোকদেখানো তোড়জোড়ও হয়েছিল। ফিরে আসেনি ব্রিজ ভাঙার ফলে আহত লেবারদের সুস্থ শরীর। তাদের জীবন-ধারণের প্রশ্নটাই এখনও তাদের নেতার আরও পয়সা কামাবার উপায় হয়ে গেছে। সে ব্যাটা এখন নুক এণ্ড ক্র্যানি কোম্পানিকে নিঙড়োয়, ঠিকাদারকেও নিঙড়োয়, নিঙড়োয় আহত মানুষগুলোকে আর তাদের পরিবার-পরিজনকেও।
ব্রিজ নিয়ে শোরগোলের মাস ছয়েক পরে মাইনে বাড়ার পরিমাণ এবং প্রোমোশন দুটোতেই তাকে আর নীতিনকে সমান সমান রাখা হয়েছিল। সেই রাগে, যাহোক একটা কারণ দেখিয়ে কোম্পানিটা দেহলী ছেড়ে দিয়েছিল।
এখন দুনিয়াদারির সব হিসেবের বাইরে দাঁড়িয়ে সে। তবু তার মনে হতে লাগল নীতিন মিশ্রদের প্রশ্রয় দিয়ে সিস্টেম অস্বীকার করে যে অসততাও একরকম অদক্ষতা। একটা কাজের মূলধন, অন্যান্য রসদ যদি কাজের সাথে জড়িত কোনো বা কয়েকজন লোক সরিয়ে নিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে দুপয়সা করে আর আসল কাজ সময় মতো খাড়াও করে দেয়, তাতে আসল কাজের পরিমাণে দাগ না লাগলেও মানে তো দাগ লাগেই; তবু সততার ওপর দক্ষতাকে, কিংবা, শান্তিতে, গুছিয়ে কাজ করার দেখনদারির দক্ষতাকে, রেখে বার বার সিস্টেম অস্বীকার করে যে কায়েমী স্বার্থক্লিষ্ট কর্মীদের জন্য সিস্টেমের সার্বিক দক্ষতা কমে যায়। এই ধারণা তার মনে শিকড় গেড়েছে ইউনাইটেড ডেভেলপারসে চাকরি নেওয়ার পর। নুক এণ্ড ক্র্যানিতে যে সব কন্ট্রাক্টর-পলিটিশিয়ানদের সে নীতিনের মামা-কাকা-ভাই বলে চিনত, তাঁদের শালা-জামাই-ভগ্নীপতি-জারজ সন্তান-সবাই তার আপিসেই কাজ করে এখন। আর এদের মুখ দেখতে হবে না ভেবে খুব একটা ফুরফুরে আনন্দ হলো দেহলীর।




এতক্ষণে টম্যাটো সুপ আর স্যুইট বেবিকর্ণ ভাজা শেষ করে ফেলেছে সে। স্নায়ুতে অ্যালকোহলও দুষ্টুমি শুরু করেছে। হাতব্যাগ খুলে বার করে আনল সে লোরাজিনের দশটা পাতা। গতছমাস ধরে বোসকাকুর পুরোনো প্রেসক্রিপশন স্ক্যান করে, গিম্প দিয়ে এডিট করে এই মরণৌষধি ভাণ্ডার জড়ো করেছে দেহলী। প্রত্যেকটা পাতা কেনার পরে প্রেসক্রিপশনগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে সে, বোসকাকু বেশ সজ্জন লোক কিনা তাই। বোতলটা আধাআধি হলে মিশিয়ে দেবে এগুলো। তারপর আশা করা যায় অফিস-শাওন-সঙ্গীতা-বাবা - কোনো ঝঞ্ঝাট থাকবে না তার।
শাওনটা যে এরকম ফেরেববাজ হবে তা কী আর দেহলী বুঝেছিল আগে? না, বুঝেছিল যে বিয়ের পর দেহলীকে ধনে-মানে পর করে দিয়েও বাবা উথলে উঠবেন দেহলীর দুঃখে? হয়তো বুদ্ধিমানেরা বোঝে, সে বোঝে না। তবে বুদ্ধি-মান-ধন-প্রাণ সব প্রতিযোগিতা, সব দৌড়, সব সংগ্রামের বাইরে এসেও এগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাবটা সে যেন কাটিয়ে ওঠে নি।
ওষুধগুলো ঢালতে ঢালতে তার সন্দেহ হতে লাগল, ওগুলো যদি জাল হয়? তারপর নিজেই নিজেকে লেট মি হোপ ফর দ্য বেস্ট বলে হি হি করে হাসল খানিকটা। তাতেও তার সন্দেহ হলো হাসিটা নেশায় না রসবোধে।
চিলিচিকেনটা খেতে খেতে দেহলীর মনে পড়ল প্রথম প্রেম অনির্বাণ আর তার অনেক কমনের মধ্যে চিনে খাদ্য প্রীতিটাও ছিল। তারপর মনে হলো শেষ ডিনারে চিকেন ক্যাসেডিলা থাকলেও ভালো হতো। চিকেন ক্যাসেডিলা কিংবা সালসা মেক্সিকান হলেও অনির্বানেরও যে ভালো লাগতই সে ব্যাপারে দেহলী নিঃসন্দেহ। এবার হাসি পেল তার; সুখাদ্য কারই বা ভালো না লাগে? তবে হিপোক্রিট অনির্বাণ হয়তো তার এ ভালোলাগাটাও অস্বীকার করত দেহলীর কাছে। অনির্বাণ কেবলমাত্র নিজের বিয়ের সাতদিন আগে মাঝরাতে দেহলীর ঘুম ভাঙিয়ে একবার স্বীকারোক্তির চেষ্টা করেছিল; সেবারও মাঝপথে কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিল। এতোটা ভান অসহ্য লেগেছিল দেহলীর। তাই সে পরের দিন থেকেই অনির সাথে যাবতীয় যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল । তারপর কলকাতা শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল নয়ডাতে।
সেখানেই শাওনের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল দেহলীর, বাঙালি খুঁজতে খুঁজতে। সে যদিও মাছ খায় না, কিন্তু নির্বিচারে গরু-শুয়োর-বাইসন যা পায় তাই খায়। প্রচুর পড়ে, প্রচুর বেড়ায়, গুচ্ছ জ্ঞান দেয়, নাটক করে, ছবি আঁকে। একমাসের বেশি লাগে নি দেহলীর সাথে শাওনের প্রেম হতে। কিন্তু শাওনের মতো জ্ঞানী লোকের মাচিসমো দেখেও দেহলীর রাগ হতো। ট্যাক্সিভাড়া থেকে সিনেমার টিকিটের দাম সব কিছুতেই আগবাড়িয়ে শাওন পয়সা দিত। একদিন শাওনের সাথে খুব ঝগড়া করে দেহলী তাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে, শাওনের এই সব শিভ্যালরিতে আখেরে স্বাবলম্বী স্বেচ্ছাধীন দেহলী অপমানিত বোধ করত। সে শাওনকে শর্ত দিয়েছিল যে, এভাবে আমার সাথে বেরিয়ে সব খরচ আপনি করলে আমি আর আপনার সাথে বেরোব না। তারপর কয়েক সপ্তাহ শাওন আর দেহলীর সাথে দেখা করতে চায় নি, ফোনও করে নি। হঠাৎ করে শাওনের সাথে অরুণাংশুর বাড়িতে নিউ ইয়ারস ইভে তার দেখা হয়ে গিয়েছিল আবার। সে রাতে অবশ্য ট্যাক্সি ভাড়া দেহলীই দিয়েছিল। আবার সিগারেট কিনে শাওন দেহলীকেই দাম দিয়ে দিতে বলেছিল। তারপর আবার দুজনের ভাব হয়ে গিয়েছিল।
সে বছর জন্মদিনে বিনা অ্যালকোহলেই বেশ নেশা-নেশা হয়েছিল দেহলীর। তার আগের দিন শাওন তাকে প্রথম উপহারে জয় গোঁসাই দিয়েছিল। তারওপর উপহার পাওয়ার পরমুহূর্ত থেকে সে একলা ছিল, ট্যুরে, দূরে। শাওন জন্মদিনের প্রথম সেকেণ্ডে ফোন করেছিল তাকে। নেশা আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল। সেই নেশার ঝোঁকেই সেরাতে দেহলী শাওনকে বলে বসে, শাওনবাবু, আপনি আমাকে একটি ছানাও দিন, কোনো দায় থাকবে না আপনার। দেবেন? খুব হেসে শাওন বলেছিল, সে তো আপনার একার হবে না, আমারও হবে, অধিকারের জন্তুতে দায় তো থাকবেই। তবে কিনা কাল আপশোশ করবেন না তো আমি যদি ছানা দিতে রাজি হয়ে যাই? আপশোশ দেহলীর এখনও নেই। তবে শাওনের শর্ত ছিল একটাই, আমাকে বিয়ে করতে হবে কিন্তু, পারবেন?। সে রাতের সাড়ে ছমাস পরে শাওনের সাথে দেহলীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
বিয়ের দিন ঠিক হতে দেহলীর বাবা বলেছিলেন, তোমার মা থাকলে আজ আনন্দের চোটে সাংঘাতিক দৌড়োদৌড়ি করতেন। তুমি নিজে বর পছন্দ করেছ বলে কথা, তোমার স্বাধীনতায় তিনি স্বাধীন হতেন আরেকটু। আসলে দেহলী প্রথম চাকরি পাওয়ার পর মা ঢাকঢোল পিটিয়ে সাংঘাতিক কাণ্ড করেছিলেন। তখনও বাবা মাকে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে চাকরিটা তুমিই পেয়েছ! মায়ের কাছে দেহলীর চাকরির মানে ছিল স্বাধীনতা, মুক্তি, স্বেচ্ছাধীনতা মায়ের জীবনে মা যা কখনও পান নি। চাকুরে দেহলীর জীবনধারণের কোনো স্পনসর থাকবে না, দেহলী নিজেই নিজের পোষক, ফলে তাকে কারো জল উঁচুতে জল উঁচু বলতে হবে না এই ভেবেই মা আত্মহারা হয়েছিলেন। এ তাঁর দেখা দিনবদলের স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাওয়া। নিজে বর পছন্দ করে দেহলী সেই স্বেচ্ছাধীনতারই স্বাক্ষর রেখেছিল। মায়ের উচ্ছাসের প্রসঙ্গ তুলে বাবা তাঁর ইচ্ছা খর্ব হয়ে যাওয়ার ক্ষোভটাই জানিয়েছিলেন। সে হুলটা সেদিন বেঁধেনি দেহলীকে। প্রেমে টইটম্বুর সেই সময়ে সহিষ্ণুতার শিখরে ছিল সে।
সে বছর ভ্যালেন্টাইন্স ইভে শাওন এই হোটেলটাতেই নিয়ে এসেছিল দেহলীকে। শহরের বাইরে, নিরিবিলিতে দু-দিন কাটাবে বলে। সে রাতের চুমুটা দেহলীর প্রথম চুমু শুনে শাওনের চেহারা যা হয়েছিল ভেবে এখনও হাসি পাচ্ছে দেহলীর। শাওন অবশ্য চুমুর ব্যালান্সশিট মেলে দিয়েছিল কবে, কাকে ,কতোবার, কোথায়- নেহাতই কৌতুহল মেটাতে কোচিংবেলার এক পরিচিতা থেকে শুরু। তবে সে চুমুর সাথে প্রেমের কোনো নাকি যোগই ছিল না। পূর্ব প্রেমিকা বলতে একজনই - মংপুবাসিনী গুঞ্জা। টুয়েলভে পড়ার সময় এক্সকারশনে গিয়ে গুঞ্জার সাথে আলাপ হয়েছিল শাওনের। তারপর চিঠিপত্রে খুব আড়ষ্ট বন্ধুত্ব ছিল ওদের দুজনের শাওনের কলেজ জীবন অবধি।
কলেজে পড়ার সময় বন্ধুর বন্ধু সঙ্গীতাকে প্রেম নিবেদন করেছিল শাওন। সঙ্গীতা শাওনদের ব্যাচে ডিস্ট্রিক্ট টপার। শাওনের মতো একটা পাতি ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রের নিবেদন সোজাসুজি নাকচ করে দিয়েছিল সঙ্গীতা। সে বলেছিল নাকি, তোর মতো বন্ধু পেয়েই আমি খুশি। তোর আমার জীবনের লক্ষ্য আলাদা। আজ যদি ভালোলাগাটাকে প্রেম বলি, কালকে হয়তো সব তেতো হয়ে বন্ধুত্বটাই কেঁচে যাবে। তখন শাওন থার্ড ইয়ারে; ক্যাম্পাসিং-এ শাওন একটা বহুজাতিকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিও পেয়ে গিয়েছিল; আর সঙ্গীতা ঢুকেছিল লেডি ব্র্যাবোর্নে ফিজিক্স অনার্স পড়তে, তিনবার মেডিক্যাল এন্ট্রাস পাস করতে না পেরে বেছে নিয়েছিল নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিক হওয়ার পথ। শাওনের মতে তার একবছর পর থেকে দেশ-বিদেশ যাতায়াতে সঙ্গীতার ঝোঁক নাকি উপে গিয়েছিল তার। দেহলী প্রেম বলে না, ঝোঁকই বলে। কিন্তু তখন সঙ্গীতা সাক্ষাতে, ইমেলে, সর্বত্র থেকে থেকেই বায়না করে চলেছিল শাওন যদি প্রেমের কথাটা আরেকবার ভেবে দেখে।
শাওন আবার তখন একই সাথে প্রভাতী, শুকতারা আর অপূর্বা বলে জনাতিনেক মেয়ের সাথে মিশছিল মূলত ইমেল এবং চ্যাটে, যদিও এরা সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে তার আগেকার চেনা বান্ধবী। তার মধ্যে শুকতারা ছিল সঙ্গীতার স্কুলের বন্ধু। তো সঙ্গীতাই শুকতারার আগেকার বা সেই সময়ের অন্যান্য সম্পর্কগুলো নিয়ে শাওনকে সচেতন করে দিয়েছিল নাকি। শাওনের মতে শুকতারাকেও একইরকম কিছু বলে সঙ্গীতা শাওন-শুকতারার প্রেমটা পুরোপুরি হতেই দেয় নি। অন্য দুজন অবশ্য বয়সে একটু ছোটো ছিল শাওনদের থেকে। কিন্তু তারা সঙ্গীতার পাড়ার মেয়ে। তাদের প্রসঙ্গেও নানা ভয়ঙ্কর তথ্যের যোগান দিয়ে শাওনকে সঙ্গীতা নাকি মেয়ে দুজন সম্পর্কে বেশ সন্দিহান করে তুলেছিল। শাওনের আর প্রভাতী কিংবা অপূর্বাকে নিয়ে ভেবে দেখতে ইচ্ছে করে নি।
তারপর সঙ্গীতা যখন ইউনিভার্সিটিতে, তখন প্রশান্ত ওকে বলেছিল, তুই আমাকে বিয়ে না করলে আমি স্যুইসাইড করব। এরকম করে কালো, বেঁটে, মোটা দেখতে সঙ্গীতাকে কেউ বলে নি আর কখনোই। উলটে সঙ্গীতা পড়াশোনায় ভালো হলেও বাড়িতে সারাক্ষণ মা-বাবা রূপের খোঁটা দিতেন নাকি, ওর বিয়ে দিতে পারবেন না বলে।
এদিকে তখনও শাওনের জীবনে কোনো প্রেমিকা ছিল না। দেহলীর মনে হয় যে তখন বেচারি সঙ্গীতা বুঝে উঠতে পারছিল না প্রশান্তকে বাঁচাতে গেলে শাওনের প্রতি, সেই সঙ্গে তার নিজের প্রতিও, অবিচার করা হবে কিনা। প্রশান্তর কথা শুনে শাওন অবশ্য সঙ্গীতাকে বলেছিল, আমি আর তোর ব্যাপারে একইরকম ফিল করি না। তাবলে যে যা বলবে তোর সাথে প্রেম করার জন্য তুই সেটাই বিশ্বাস করিস না যেন......। ইতিমধ্যে শাওন কলকাতায় চাকরি নিয়ে চলে আসে। ফলে সঙ্গীতার সাথে যোগাযোগ নিয়মিত হয়ে যায়। কিন্তু শাওন সঙ্গীতাকে যখনই দেখা করতে বা আড্ডা দিতে ডাকত তখনই সঙ্গীতা প্রশান্তকে সঙ্গে নিয়ে যেত শাওনের কাছে। এতে নাকি শাওনের বেশ বিরক্ত লাগত। দেহলীর ধারণা শাওন যদি প্রশান্তকে দেখে হিংসে করেও সঙ্গীতার কাছে ফিরে আসতে চায়, সেই আশাতেই সঙ্গীতা ওরকম ব্যবস্থা নিত।
এইসময় গুঞ্জা কলকাতায় এসেছিল পড়াশোনা করতে। শাওনকে খুঁজে বার করেছিল সে। এবং প্রেম নিবেদন করেছিল। শাওন তো হাতে স্বর্গ পেয়েছিল। তাকে সেই প্রথম কোনো মেয়ে, তাও বহু বছর যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও মনে রেখেছিল, এবং তার প্রেম চেয়েছিল। ফলে শাওন গুঞ্জার সাথে নিয়মিত উইকএণ্ড কাটাতে শুরু করেছিল শরৎ বোস রোডের প্যানাসিয়া হোটেলে। খবর শুনে সঙ্গীতা কেঁদে ভাসিয়েছিল। কিন্তু প্রেমের বয়স মাসছয়েক হতে না হতেই গুঞ্জার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য বায়না শুরু হয়ে গিয়েছিল। নেপালি মাবাঙালি বাবার মেয়ে গুঞ্জাকে নিজের পিউরিটান বাড়িতে জায়গা করে দিতে শাওনকে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হতো। তখনই শাওন পিছিয়ে গিয়েছিল সম্পর্কটা থেকে; চাকরিসূত্রে পালিয়ে গিয়েছিল নয়ডা। যাওয়ার আগে সঙ্গীতার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সঙ্গীতা তখন সিওলে জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক সেমিনারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ওকে একটা স্যুট উপহার দিয়েছিল শাওন। ছলছল চোখে সঙ্গীতা শাওনকে বলেছিল, ফিরে এসে আমাকে আর এভাবে যখন-তখন পাবি না তুই। প্রশান্তর বাড়ি থেকে আমার সিওল যাওয়া নিয়ে অনেক বাধা আছে। খুব শিগগির ওঁরা চাইছেন আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে। শাওন তখন সঙ্গীতার স্তন ছুঁয়ে জিভ দিয়ে মেয়েটার গলা ছোঁওয়া একটা দীর্ঘ চুমু দিয়ে বলেছিল, সিদ্ধান্ত অনেক ভেবে নিতে হয়। আমি আর তোকে বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবি না বলে যেই তোকে বিয়ে করতে চাইবে তাকেই মেনে নিতে হবে এমন তো নয়। সঙ্গীতা সেই শেষবার বলেছিল, শাওন, তুই কি বন্ধু বলেও আমাকে বিয়ে করতে পারিস না? শাওন বলেছিল, না রে, পারি না।
তার পরের বছর সঙ্গীতা প্রশান্তকে বিয়ে করেছিল। তবে সঙ্গীতা প্রশান্তর কাছে শাওনের ব্যাপারে কিছুই লুকোয় নি নাকি। এসব শুনে দেহলী খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাকে এতো কথা বলছেন কেন? আমাকে বিয়ে করতে চাইলেন যে, আমি তো শুধু আপনার জিন চেয়েছি? শাওন বলেছিল, আমার বয়স তিরিশ হয়ে গেছে, আর কবে বিয়ে করব?
সেই প্রথম দেহলীর মনে কাঁটা বেঁধে, তাহলে তার প্রেম নয়, এ সম্পর্কের কারণ শাওনের বয়স। কিন্তু সে সময়টা এমন ছিল যে কোনো কাঁটাই ব্যাথা দিত না। প্রেমের নেশায় চুর দেহলী সুগন্ধী, সুস্বাদু একটা পৃথিবীর আকাশে উড়ে বেড়াত শাওনের সাথে; কখনও একটা ভীষণ অস্থির সমুদ্রে একটা দারুণ রঙিন ভেলায় ভেসে বেড়াত।




দেহলীর সাথে বিয়ের কথা পাকা হওয়ার পরেই শাওন আবার কলকাতায় বদলি হয়ে গিয়েছিল। সাতদিনের ছুটি নিয়ে দেহলীও কলকাতা গিয়েছিল তার পিছু পিছু। বিয়ের বাজার করাটা ছিল ছুতো। কিন্তু ছুতোর ব্যস্ততায় আপাদমস্তক ডুবে গিয়েও বাধা পড়েনি প্রেমে। তখন শাওন সল্টলেকে ঘর ভাড়া নিয়েছিল। ওখানে তখন রাস্তায় রাস্তায় পলাশ, শিমূল, ফুটে থাকত। দেহলীর বহু অপেক্ষিত প্রথম সঙ্গমের রাতে সারাদুপুর সে একটা ঝুড়ি ভর্তি করে পলাশ আর শিমূল জড়ো করেছিল। শাওনের ফ্ল্যাট সাজিয়েছিল সেই ফুলে আর মোমের নরম আলোয়, চৌরাশিয়ার বাগ্রেশ্রীতে মথিত করে দিয়েছিল সে রাত। দুজনে জেগেছিল ভোর অবধি। গল্প করতে করতে সেই রাতে বারবার ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাদের। সব ফ্যান্টাসিকে তারা দুজনে ফ্যাক্ট করে নিয়েছিল অভিনব আঙ্গিকের বিভিন্ন জীবন্ত ভাস্কর্য তৈরি করে। ভাবলে এখনও ভালোলাগায় শিউরে ওঠে দেহলী। শাওন বায়না করেছিল ফুলশয্যায় অমন করেই সাজাতে হবে ঘর। হেসে আকুল হয়েছিল দেহলী; রহস্য করে বলেছিল, তখন অন্য ফুল থাকবে
বাড়ি ফিরেই রণ্টুদাকে ডেকে পাঁচহাজার টাকা দিয়ে বলেছিল, যেখানে যত বকুল গাছ আছে সেখান থেকে ফুল পাড়িয়ে লম্বা মালা গেঁথে দিও ফুলশয্যার খাট সাজানোর জন্য। ব্যবসা জীবনে এমন একটা অভিনব বায়নায় কথা খুইয়েছিল রন্টুদা। সেই সুযোগে দেহলী জুড়ে দিয়েছিল, আর হ্যাঁ, টাটকা চাঁপা ফুলও রেখো কয়েকঝুড়ি। তারপর প্রাণের বন্ধু শুক্লাকে ডেকে বলে দিয়েছিল রণ্টুদার থেকে ফুল নিয়ে ফুলশয্যার দিন দুপুর দুপুর দেহলীর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ঘর সাজিয়ে দেওয়ার জন্য, যাতে শ্বশুরবাড়ির লোক দেহলীর শোবার ঘর সাজানোর সু্যোগই না পায়। চাঁপা-বকুলের গন্ধে-রূপে শাওন সে রাতে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। দেহলী এতো কিছুর পরেও বিশ্বাস করে যে সে সব রাতে কোনো ভান ছিল না।
তারপর দেহলীরা দুজনে দুটো শহরে কয়েকমাস কাটিয়ে দিয়েছিল। শাওন যখন টোকিওতে প্রজেক্ট পেল, তখন দেহলী চাকরি-বাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল শাওনের সাথে। বড় ভালো কেটেছিল সেসব দিন। প্রেমের প্রথম নেশা কেটে গিয়ে তখন ছিল মনোভূমে ইমারত গড়ার সময়। প্রচুর বেড়িয়েছিল তখন দুজনে, অপূর্ব অশরীরী বন্ধুতায়। সে সময় ওখানে সঙ্গীতাও গিয়েছিল বরকে নিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ টোকিওর মেডিসিন স্কুলে কিছুদিন গবেষণা করতে। ওরা দেখা করতে চেয়েছিল দেহলীদের সাথে। দেহলী রাজি ছিল না শাওন আর সঙ্গীতার মধ্যে থেকে একটা জটিল নাটকের চরিত্র হয়ে যেতে। কিন্তু শাওন এড়াতে পারে নি, বলেছিল, ক্রিসমাসে আমরা এখানকার ডিজনিল্যাণ্ড দেখতে যাব। তোরা যদি যেতে চাস তাহলে আসিস
এসেছিল সঙ্গীতারা। খুবই মিষ্টি ব্যবহার করেছিল তারা। ডিজনিল্যাণ্ডে ঘোরার সময় সঙ্গীতা শাওনের গায়ে লেপ্টেছিল; দুজনে বিভোর হয়েছিল ছোটোবেলায় পড়া খেরোর খাতা কিংবা ছোটো আনন্দমেলার গল্পে; আবার কখনও পরস্পরের আঙুল ছুঁয়ে চোখে চোখ রেখে স্পর্শটাকে অনুভব করে কেঁপে উঠছিল। পুরো অ্যালবামে এমন কোনো ছবি নেই যাতে সঙ্গীতা শাওনকে ছাড়া পোজ দিয়েছে; যেটাই দিয়েছে সেটা শাওনের তোলা। একবার প্রশান্তকে শাওন ছবি তুলতে বলে একহাতে দেহলীর কোমড় জড়িয়ে দাঁড়ায়, অমনি সঙ্গীতা এসে শাওনের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল; শাওনও অন্য হাতটা দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছিল। এইসব অনভিপ্রেত ঘটনার সাক্ষী হয়ে দেহলী পড়েছিল ভীষণ অস্বস্তিতে। তার কেবল মনে হতে থাকে যে শাওন কিংবা সঙ্গীতা বিয়েটা বইতে পারে না; বিয়ের কমিটমেন্টের দিকটা হয় বোঝে না, নয় মানে না, কিন্তু মানে না যে সে কথা নিজেরদের কাছে স্বীকার করার সাহসও ওদের নেই। নেই ওপেন রিলেশনশিপের ঝড়ঝাপটা নেওয়ার মতো মনের জোর; লোকভয়ও আছে খুব, দুজনেরই। তাই প্রেম-প্রেম খেলার বয়স পেরোতেই দুজনে বিয়ের আশ্রয়ে ঢুকে পড়েছে, কিন্তু নির্দায় উপরি প্রেমের সু্যোগ ছাড়ে না, কখনোই। সে ভীষণভাবে অনুভব করেছিল তখন যে শাওন আর সঙ্গীতা বিয়ের আশ্রয় নিয়ে ফেলেছে বলেই দুজনেরই পরস্পরের কাছে লুকোচুরি খেলার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। নির্দায় প্রেমের আনন্দে তারা মজে ছিল এতই যে তাদের লীলার মধ্যে দেহলীর উপস্থিতিটা শাওন খেয়ালই করতে পারে নি।
জাপান থেকে ফিরে, দেহলী আবার কাজ নিয়ে চলে আসে নয়ডা। শাওনকে প্রজেক্ট নিয়ে নর্থ ক্যারোলিনা যেতে হয়। দেহলী কিছুতেই ভিসা করাতে যায় নি। ওখানে গিয়ে শাওন কয়েকমাস পর থেকেই পীড়াপিড়ি করতে থাকে দেহলীকে শাওনের কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু দেহলীর একলা একলা বিয়েটা বওয়ার ইচ্ছে মরে গিয়েছিল।
সে সময়ে সঙ্গীতাও পোস্টডক করতে ওরেগন পৌঁছায়। পৌঁছে শাওনের কাছে বায়না করে শাওন যেন ওকে ওখানে সেটল হতে সাহায্য করে কেননা ওদেশে ও একমাত্র শাওনকেই চিনত যার ইউএস ড্রাইভারস লাইসেন্স আছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা খুবই অল্প সে দেশে। নতুন বাড়ি ঘরে জরুরি ঝাড়ুবালতি কিনে আনার জন্যও একটা গাড়ি লাগে। আর লাগে গাড়ি চালিয়ে দোকানে নিয়ে যাওয়ার লোক। দুটো কাজ সারতেই ড্রাইভিং লাইলেন্স, ক্ষেত্রবিশেষে ইউএস ড্রাইভারস লাইসেন্স থাকাটা জরুরি। ওরেগনে সঙ্গীতার কোনো বন্ধু ছিল না। পুরো ইউএস-এতে শুধু শাওনকেই ও চিনত এবং অনেক দিন আগে থেকেই চিনত। তাই শুধু অবলাকে নয়, পুরোন বন্ধুকেও সাহায্য করতে গিয়েছিল শাওন। তারপর কিছুকাল পরে প্রশান্ত হাজির হয় সঙ্গীতার ওখানে। শাওন তখন নর্থ ক্যারলিনা ছেড়ে শিকাগোতে। এই সময় বারকয়েক একা সঙ্গীতা শিকাগো গিয়েছিল, কখনও সেমিনারে, কখনও চাকরি খুঁজতে। প্রত্যেক বারই উঠেছিল শাওনের কাছে। শাওনের মতে, ছাত্ররা খরচ বাঁচাতে ইউএস-এতে প্রথম প্রথম বন্ধুদের কাছে উঠেই থাকে।  কিন্তু দেহলী কখনোই শাওনকে বোঝাতে পারেনি যে সব বন্ধু আর পুরোন প্রেমিকা এক নয়, এবং একটামাত্র চুমুতেই বন্ধুত্ব থেকে প্রেম আলাদা হয়ে যায়।
তার কিছুদিন পরে শাওন ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে দেহলীকে জানিয়েছিল, তুমি না এলে আমি শেষ হয়ে যাব। সঙ্গীতা খুব কম্পলিকেশন তৈরি করেছে। ও প্রেগন্যান্ট। আমাকে বলছে দায়িত্ব না নিলে ও আইনী ব্যবস্থা নেবে। এবং এরকম একটা দাবীর কোনো কারণ নেই। ওকে কদিন থাকতে দিয়েছিলাম বলে...। দেহলী তারপর থেকে শাওনের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে নি আর, যেহেতু সত্যি কী জানে কেবলমাত্র বাদী ও বিবাদী। দুটো অবিমৃষ্যকারির জন্য দেহলীর কোনো সমবেদনাও ছিল না। সেই সঙ্গে উথলে ওঠে তার যত চেপে রাখা অভিমান।
বিবাহিত পাঁচ বছরের তিন বছর দেহলী ছিল শাওনের সাথে। অনুনয়-বিনয়েও শাওন রাজি হয় নি তখন দেহলীকে বাচ্চা দিতে। শাওনের মনে হতো সে নাকি অর্থনৈতিকভাবে পিতৃত্ব নিতে  সক্ষম হলেও সময় নেই তার বাবা হওয়ার। বাচ্চার প্রসঙ্গ উঠলেই তাদের সংসারে সাংঘাতিক অশান্তি হতো। অশান্তি হতো তাদের অযৌন দাম্পত্যে দেহলী যৌনতা চাইলেও। সব মিলিয়ে দেহলীর অনেকবার মনে হয়েছে যে তার নিজের ওপরও শাওনের ঝোঁক কেটে গেছে। তবুও দেহলী সইয়ে নিয়েছিল সে জীবন, ইন্টারনেট আর কেবল টিভির দোহাই পেড়ে। কিন্তু সঙ্গীতার সাথে শাওনের সম্পর্কের জটিলতায় তিক্ত বিরক্ত হতাশ দেহলীর যেন খানিক সত্যদর্শন কিংবা চরম-পাঠ-লাভ হলো। এই দ্বন্দ, অস্থিরতার শেষ বলে সে মৃত্যু খুঁজে পেল।




বাথরুমে বসে সে টের পেল যে নেশাটা কেটে গেছে একদম। বিছানায় বসে দেখল রাত দেড়টা। গ্লাসে ডায়েট কোক নিয়ে তাতে লোরাজিন গোলা রাম ঢেলে দেখল সব বরফ গলে গেছে। খানিকটা বরফ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে নি বলে বেশ আপশোশ হলো। এসির টেম্পেরেচার আরও একটু কমিয়ে দিল। তারপর নিজের শান্তি কামনা করে চুমুক দিল গ্লাসে।
অমনি দেহলীর দরজায় টোকা পড়তে লাগল এলোপাথাড়ি। টোকা না বলে মুষ্ট্যাঘাত বলাই ভালো। প্রথমে হেসে ফেলল এতো শিগগির যমদূত এসে গেছে ভেবে। কিন্তু তারপর উঠে দরজাটা খুলে দেখল পুলিশ। খুব বিরক্ত হলো দেহলী। কেউ জানে না যে সে তার জীবনের শেষ বেআইনি করছে সব আইনের উর্দ্ধে যাবে বলে, সে খবর পুলিশে পেল কী করে? হোটেল ম্যানেজার গদগদ গলায় জানাল, বহুত বার বোলে সাবকো আপ আকেলে ঠেহরে ইহাঁ। লেকিন সাব ফিরভি খুদ দেখনে কী জিদ কী। দেহলী খুব হতাশ ক্লান্ত গলায় বলল, দেখ লিজিয়ে। পুলিশ নাম, ধাম, সব জেনে খুব অবাক হলেন ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে মানাতে ম্যাডাম আকেলী ঠেহরি হৈঁ দেখে। বার বার বিস্মিত হলেন উৎসবের দিনে ম্যাডাম আকেলী দারু পি রহি হৈঁ দেখে। দারুর কথা এতোবার বললেন তিনি যে দেহলীর একটু সন্দেহ হলো। সে জানতে চাইল, আপকো পিনা হৈঁ? হেঁ-হেঁ করে হাসলেন শান্তিরক্ষক।
দেহলী একদম ভাবেনি আজ টাকা পয়সার দরকার হবে। সকালে বেরিয়ে যাওয়ার অজুহাতে সে হোটেলের যাবতীয় বিল রাতেই মিটিয়ে দিয়েছিল। হাত ব্যাগ ঝাঁকিয়ে দুশ টাকা পেল সে। সেটা পকেটে ভরে সান্ত্রীমশাই বিনয়ে অধোবদন হয়ে জানালেন যে ঐ পয়সায় ব্র্যাণ্ডেড দারু হয় না। দেহলী ওর ব্যাগটাই লোকটার হাতে দিতে যাচ্ছিল যাতে সে নিজে ব্যাগ হাতড়ে দেখে নিতে পারে কানাকড়ি কিছুই নেই তাতে। কিন্তু সে সময়ে সান্ত্রী আবার বললেন যে একা একা অত মদ খেলে দেহলীর নাজুক শরীর খারাপ হবে। দেহলীর কাছে একথার সোজা মানে দাঁড়াল যে বাকার্ডির বাকি বোতলটা উনি নিয়ে যেতে চান। তিনি চাইলেন মানে দেহলীর আর কোনো উপায় রইল না না-দিয়ে। বোতলটা হাতে নিয়ে দেহলীর খুব টেনশন হতে লাগল যদি কাল এই লোকটা মরে যায় বা যবে ওর সাথে যারা বসবে এই বোতলটা নিয়ে তাদের সাথে অস্বাভাবিক কিছু হয়? নিজে মরা এক, কিন্তু না মরলে পুলিশে ধরবে। পুলিশে ছোঁবে! ভাবতেই গা-টা গুলিয়ে উঠল তার। খুব কায়দায় ভান করে নেশায় টলে টলে একটা ওয়াক সামলাবার ঝোঁকে যেন বোতলটা পুলিশের হাতে তুলে দিতে গিয়ে মেঝেতে দড়াম করে আছড়ে পড়ে সেটা ভেঙে গেল। বোতলটা এভাবে ভেঙে সে বেশ নিশ্চিন্ত হলো। আর হতাশ পুলিশ ম্যাডামকে বার বার করে সাবধান করে দিয়ে চলে গেল।
ঘুম ভাঙতে দেহলী বুঝল কুয়াশা কেটে গনগনে রোদ উঠেছে। জানলার পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিতেই সূর্যটা তার মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনের মধ্যে তার গুনগুনিয়ে উঠল যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তৎ তে পশ্যামি। / যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি।। তারপর নিজেই হেসে ফেলে বলে উঠল শালা! আমিও পলিটিশিয়ান!

সেলফোনটা অন করতেই শাশুড়ীমার ফোন এলো; বললেন, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে। বাবু কথা বলবে, ধরো। বাবু মানে শাওন বলল, ওদেশটাতে ট্র্যাফিক পুলিশ ঘুষ খায় না। সেটা মানুষের ভগবানে ভক্তি এখনও অটুট বলে নাকি স্ট্যাণ্ডার্ড অফ লিভিং খুব হাই বলে জানি না। নাকি আমাদের মতো দেশিদের ক্ষমতাই নেই ওদেশে ঘুষোবার তাই আমাদের কাছে ওরা সৎ - তাও জানি না। শুধু বুঝি ওদেশে ঘুষের কারবার আমি টের পাই না বলেই আমি সব ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি আসতে পেরেছি। সঙ্গীতা পুলিশ বা কোর্ট কিংবা ডিএনএ কালচার ল্যাব কোথাও ঘুষ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেনি। এ নিয়ে অনেক কথা আছে; সে সবের তোড়ে ভুলে যাওয়ার আগে বলে দি, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে, সোনা

Readers Loved