“এখন কানে শুধু ঘড়ির টিক টিক। হাতেপায়ে দৌড়ের ধকধক। বুকের মধ্যে কী-হয়,
কী-হয় উত্তেজনা। কী কী কাজ ছিল হাতে কিছু মনে নেই। আমি আর নৈঃশব্দ কথা বুনে চলেছি
একে অপরের সাথে অবিরত। মাথার মধ্যে ভীষণ তাড়াহুড়ো। চোখের পাতায় ঘুম। আঙুলের ডগা
ছুঁয়ে ক্লান্তি। ঘাড়ে-পিঠে টনটন। তবু ভীষণ তাড়া। এক্ষুণি শুরু করতে হবে। তক্ষুণি
শেষও করতে হবে। না হলে সামাজিক, সাংসারিক স্রোতে ভেসে যাবে সব। আর করা হবে না।
কিন্তু কী কী করার ছিল মনে পড়ছে না। মনে পড়ে না।”
এক মন ইচ্ছে আর এক শরীর অবজ্ঞা নিয়ে স্বপনে জাগরণে লড়াই চলে মেয়েটির। নামটি
তার মেরুপ্রভা। মনটা তার চঞ্চল। সারাটা দিন তার কেটে যায় কাজে কাজে। তবু দিন শেষে কোনো
কাজেরই শেষ দেখে না সে। উদভ্রান্তের মতো তাড়া করে ফেরে কাজগুলোকে। জড়ো করে। ধরে
বেধে বধ করার মতো করে সেরে ফেলে সব। তবু দিন শেষে জমে যায় কাজের পাহাড়। পাহাড়ের সব
থেকে ভারি পাথরের চাঁই যেন সেই কাজগুলো যেগুলো করতে তার ভালো লাগে না। আর যেগুলো
তার ভালো লাগে সেগুলোতে হাত দেওয়ার সময়ই আসে না। সূর্যোদয় থেকে সূর্যোদয়ে সে
অস্থির থাকে কাজ ধরার আর ধরা কাজ শেষ করার চিন্তায়। আর সূর্যাস্ত দেখে সে দুঃখী
হয়ে পড়ে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বলে। তবু মাঝে মাঝে তার দেখা হয়ে যায় প্রশান্তির সাথে।
ক্ষণজীবি মেরুপ্রভা সেই ‘তখন’টুকুতে যেন জীবন ফিরে পায়। ফিরে যায় নৈমিত্তিক চড়কি পাকে।
“এখন সামনে শুধু খোলা আকাশ। দুধারেও তাই। আদিগন্ত মাঠের বুক চিড়ে চলে গেছে
কালো রাস্তা শরীরময় সাদা আঁচড়ের দাগ নিয়ে। এই যে যাচ্ছি আকাশের দিকে সত্যি কোথাও
পৌঁছোব না জানি। তবু যাই। বিশেষতঃ রাতে। যখন পার্থিব যোগাযোগগুলো শিথিল হয়ে আসে।
বন্ধ হয়ে যায় সব কথোপকথন। আর মনের কথারা খই হয়ে ফুটতে থাকে। কানে নয়, মনে। মনে
মনে। অবাক হয়ে যাই রাতের আকাশেও সেই নির্জনতার ভিড় দেখে। এতো দূর থেকে দেখি বলেই
কী নির্জনতার আধিক্যটা এতো প্রকট লাগে? হ্যাঁও বটে, নাও বটে। হ্যাঁ - কারণ
তারাগুলো সব বিশাল শক্তির বিরাট আখড়া, কিন্তু দূর থেকে দেখতে লাগে আলোর বিন্দুর
মতো; যে কোনো দুটো তারার মধ্যে আঁধারের বিস্তার আলোকবর্ষব্যাপী; এত্তো আলোময় তারা
আর তাদের মধ্য কত্তো অন্ধকারের ব্যবধান! তাই তো তারাগুলো নির্জন; যতো তারা, ততো নির্জনতা; কাছ থেকে একটা তারার আলোয় আলোয় চোখ
ধাঁধানো স্পষ্টতায় অস্পষ্ট থেকে যায় আদত নির্জনতার চরাচরব্যপী অস্তিত্ব। না - কারণ এই নির্জনতা টের পাই আমিও একলা, নির্জন বলে; সঙ্গে কেউ থাকলে
কথায়, অনুভূতিতে বা মননের আলোড়নে, অনুরণনে নির্জনতা লুকিয়ে পড়ে।”
গাড়ির মুখ ঘুরে যায় ফিরতি পথে। রাতদুপুরের অভিযান অশেষ রয়ে যায়। মেরুপ্রভা
বাসায় ফেরে। চটি খুলে রেখে ঢুকে পড়ে লেপের নিচে। সেখানে তখন ঘুমও তাকে জড়িয়ে ধরে।
সেও নিজেকে সঁপে দেয় ঘুমের আলিঙ্গনে। বিছানায় রোদ আসতে অনেক বেলা হয়। পাখিরা
ডাকাডাকি শুরু করে তার আগে। তারও আগে ডাকে এলার্ম ক্লক। ঘুম চলে যায় মেরুপ্রভাকে
ছেড়ে, সজীব দৃষ্টির সামনে পড়লে যেমন এক ঝটকায় দূরে সরে যায় প্রেমিকযুগল, তেমনই।
স্নানঘর সেরে ঢোকে রান্নাঘরে। দুটো ঘরই তার ভাঁড়ার আর গুদাম। তবুও রোজকার কাজের
জিনিসগুলো মেরুপ্রভা যেখান থেকে নেয় সেখানেই রাখে। তাই দাগ, ছোপ, আঁচড় থাকলেও,
মশলার গুঁড়ো, গন্ধ থাকলেও রান্নাঘরটা তার খুব অগোছালো লাগে না। আবার খুব ছুটি পড়া
গোছগাছও নেই সেখানে। স্নানঘরও তাই। তারওপর তার একার সংসার। একার অভ্যাসের অনুশাসনে
বাধা। তাই পান থেকে চুন খসার সুযোগই নেই। জিনিসপত্র খুঁজে না পাওয়া নেই। নৈমিত্তিক
শৃঙ্খলায় সে কাজে চলে যায়।
কাজের জায়গাটা তার ভালোও লাগে। খারাপও লাগে। ভালো লাগে কারণ এখানেই সে অন্য
মানুষের দেখা পায়। এখানে এলেই তার কুকুর পোষার শখটা মাথা চাড়া দেয়। সে বুঝতে পারে
যে সব মায়া, মমতা, বন্ধন, সঙ্গলোভ পেরিয়ে এক্কেবারে অমানুষ হতে বাকি আছে তার। আবার
সারাদিনের দায়িত্ব, কর্তব্য আর বাধ্যতামূলক সামাজিকতায় রোজগারের প্রয়াসটুকুর মধ্য
দিয়ে কিছু তিক্ততা, ক্লান্তি, খারাপ লাগা আর মুক্তির ইচ্ছে জমে ওঠে। মুক্তি মানে
পুষ্যিও যার পায়ে বেড়ি দিতে পারে। তাই কুকুর পোষার শখটা উবে যায়। তারপর একসময় কাজ
থেকে ছুটি মেলে। প্রয়োজন থাকলে বাজার দোকান সেরে, মেরুপ্রভা ঘরে ফেরে। দরকার থাকলে
রান্না করে। তারপর টিভি দেখে, বা বই পড়ে বা সিনেমা দেখে কিছুক্ষণ। না হলে বেড়াতে
যায় ধূ ধূ মাঠ চিরে আকাশের দিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে। কোনো কোনোদিন ইচ্ছে হলে
বাড়ি ফেরার আগেই দোকানে খেয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায় শহর থেকে দূরে। তার প্রিয় মাঠে,
নদীর পাড়ে বা খাদের ধারে।
না, তার কোনো বন্ধু নেই। কিছু পরিচিত জন আছেন; সহকর্মী আছেন, পুরোন সহপাঠী
আছে। সহকর্মীরা কাজের প্রয়োজনে মেরুপ্রভার সাথে যোগাযোগ করেন। সহপাঠীরা তাকে ত্যাগ
করেছে; সে যোগাযোগ রেখে চলতে পারে না তাই। মোদ্দা কথা হলো তার খাপছাড়া, অসামাজিক
ব্যবহার তাকে সামাজিক পরিমণ্ডলে বেশ অপরাধী করে তুলেছে। কেউ কেউ তো তাকে অসামাজিক
না বলে বলেন সমাজবিরোধী। কিন্তু মেরুপ্রভা ঝগরুটে নয়। তার আত্মগত স্বভাবকে
আত্মকেন্দ্রিকতা বলে ভুল হয়। তার নির্বাক অভিব্যক্তিকে উন্নাসিকতা বলে মনে হয়।
কিন্তু সে যে স্বার্থপর নয় সেটা তার পরিচিতরা সবাই মানেন। বরং সে বেশ সংবেদনশীল।
কে, কী, কেন করছে সে বেশ বুঝতে পারে, তার কাছে পরামর্শ চাইলে বোঝাতেও পারে। কিন্তু
এই কারণেই তাকে অপছন্দ করে এবং ভয় পায় এমন লোকও অনেক। যারা মেরুপ্রভাকে ভয় পায়
তাদের ভয় মূলত ধরা পড়ে যাওয়ার, কীর্তিতে না অপকীর্তিতে কে জানে। কিন্তু যারা
অপছন্দ করে তাকে তাদের কারণটা একটু জটিল। যেমন তার সহমর্মী প্রিয়া আর ক্যাথেরিন
দুজনেই মেরুপ্রভাকে অপছন্দ করে দুটো আলাদা কারণে।
প্রিয়ার সাথে একবার ঊর্ধতনের বনিবনার অভাব দেখা দিয়েছিল। তখন প্রিয়া
মেরুপ্রভার সাথে পরামর্শ করতে এসেছিল। কে, কী, কেন বিবেচনায় প্রকট হয়ে পড়ে যে
প্রিয়া নিজের কাজের মান রাখতে গিয়ে, নিজেকে বেশ কাজের মেয়ে বলে প্রমাণ করে
ঊর্ধতনের সুনজরে পড়তে গিয়ে, ঊর্ধতনের কাজে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগগুলো আটকে দিয়েছে।
তাতেই মহিলা ভয়ানক খেপেছেন। তিনি প্রিয়াকে যেসব সুবিধে দিতেন মেয়েটা কাজের বলে,
সেগুলো সব কেড়ে নেন একে একে। তারপর যাদেরকে শুনিয়ে বললে প্রিয়ার অসুবিধে হতে পারে,
তাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে শুরু করেন, “দুদিন কী কাজ করলে, একটু সুনাম করলাম আর অমনি ফাঁকি
দিচ্ছো।” প্রিয়া অবস্থাটা সামলে নিয়েছিল, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে
অবশ্য কর্তব্যগুলো করা বন্ধ করে দিয়ে। মানে তাকে হুকুম করা হলে সে ঝটপট তামিল করত,
কিন্তু বিনা হুকুমে অনিবার্য কোনো কাজ সে আর করত। না। এতে তার লাভই হয়েছিল। কারণ হুকুম দেওয়ার মাধ্যমে
ঊর্ধতন যে তাঁর নিজের কাজটি যথার্থ করছেন তার স্বাক্ষর রাখতে পারছিলেন। তাছাড়া
হুকুম তামিল করে প্রিয়াও নিজের আনুগত্যের স্বাক্ষর রাখতে পারছিল।
কিন্তু প্রিয়া বুঝতে পেরেছিল যে যেসব ঘটনা তার বিশ্লেষণীর অগোচর, তা
মেরুপ্রভার মুঠোয়। অর্থাৎ চুপচাপ মেয়েটা নিশ্চয়ই জানে বা বোঝে তাকে ‘ব্ল্যাকহোল’ বলে ডাকা হয়। আরও বুঝেছিল যে
মেরুপ্রভাকে যতোটা সামাজিক আকাট দেখায়, তার থেকে অনেক বেশি সামাজিক বোধ তার শিরায়
শিরায়। বরং বলা ভালো এসব কথা মনে হলে প্রিয়া একটু শিউরেই ওঠে যে যতগুলো সামাজিকতা
পটু লোককে সে চেনে তাদের সবার থেকে বেশি সামাজিক যাপণকে বোঝে মেরুপ্রভা। মানে এক
চেনা মেরুপ্রভার মধ্যে অন্য এক অচেনা মেরুপ্রভা বাস করে। এই চেহারার সাথে অন্তরের
অমিলটাই প্রিয়ার অপছন্দ। ইমানুয়েল যখন মেরুপ্রভাকে ব্ল্যাকহোল নাম দিয়েছিল তখন
প্রিয়া বোঝেনি সেই নামের এই কারণ। বরং সে ভেবেছিল যে ব্ল্যাকহোলের প্রচন্ড আকর্ষণ
আর আকৃষ্ট সব কিছুকে গিলে ফেলার স্বভাবের সাথে মেরুপ্রভার স্বভাব মেলে বলে
ইমানুয়েল নামটা দিয়েছিল। মেরুপ্রভা চুপচাপ, অমিশুক বলে মিশুকে লোকে তার সাথে কথা
বলার জন্য উতলা হয়ে পড়ে। কিন্তু তার সাথে মিশলে বোঝা যায় যে কোনো পরচর্চার কথা তার
থেকে কানাকানি হবে না। তাই বুঝি সে ব্ল্যাকহোল। কিন্তু মেরুপ্রভার সাথে ফলপ্রসূ
আলোচনাটার পর প্রিয়া বুঝেছিল যে মেরুপ্রভাকে সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। এই রহস্যটাই
প্রিয়ার অপছন্দ। তাই মেরুপ্রভাকেও তার অপছন্দ। অথচ সামাজিক ক্ষেত্রে গলা পর্যন্ত
ডুবিয়ে নানান সম্পর্কের টানাপোড়েনে মেরুপ্রভা নাকানিচোবানি খায় না বলেই হয়ত যে
কোনো সামাজিক আদানপ্রদানকে সে নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে পারে আর বিচার্য যদি হয়
কোনো সমস্যা তাহলে তার সমাধানও বাতলে দিতে পারে এই সহজ সত্যটা প্রিয়া বুঝতে পারল
না।
কানাকানির সম্ভাবনা নেই দেখে ক্যাথেরিন তার হবু পুত্রবধূর কিছু নিন্দে করেছিল
মেরুপ্রভার কাছে। হবু পুত্রবধূ মেয়েটি নাকি বেশ প্রাণবন্ত বলেই শুনেছিল মেরুপ্রভা।
ক্যাথিই বলেছিল যে সে বেশ চট করে মিশে গেছে বাড়ির সবার সাথে। সবাই মানে ক্যাথি,
ক্যাথির মা আর ওদের দুই কুকুর। কিন্তু সে মেয়েটিকে আজকাল ক্যাথির বাচাল এবং অসভ্য
বলে মনে হচ্ছে। সে নাকি ক্যাথিদের সবার সামনেই তার ছেলে মাইককে ‘মিকি মাউস’ আর কী কী সব অর্থহীন শব্দবন্ধে
ডাকছে। চিরন্তন ‘হানি’ বা ‘পাই’ কিংবা ‘সুগার’ ছেড়ে কীসব উদ্ভট নামকরণ! ক্যাথি বেশ অপমানিত বোধ করেছে তার ছেলের নাম-ডাকনাম
সব বিগড়ে যাওয়ায়। সব শুনে মেরুপ্রভা বলেছিল, “সে মেয়ে বেশ সৃজনশীল। তাই সনাতন
ডাকগুলো বাদ দিয়ে নিজের মতো করে নাম দিয়ে ডাকছে তোমার ছেলেকে। আর তোমাদের সাথেও বেশ
চেনাশোনা হয়ে গেছে তো তাই সে দ্বিধা করেনি তোমাদের সামনে তার বিশেষজনকে বিশেষ নামে
ডাকতে।” ক্যাথি গজগজিয়ে বলেছিল, “চিনে গেছে মানে? একটা ছেলে যার সারা পৃথিবীতে মা বই কেউ নেই, তাকে তার মায়ের
সামনেই উল্টোপাল্টা নামে ডাকবে? এটা শুধু মাইক নয় আমাদের জন্যও বেশ অপমানজনক। আর
চেনাশোনা হয়ে গেছে তো কী? এরপর ভালোবাসাবাসিও আমাদের সামনে কিচেন টেবিলে করবে নাকি
হ্যাঁ!” মেরুপ্রভা বলেছিল, “তোমার যুক্তিটা ফেলনা নয়। তুমি তাকে বললেই পারো যে অমন ডাক তোমার পছন্দ নয়।”
তাতে ক্যাথি ঠোঁট উল্টে বলেছিল, “তাতে ছেলের কানে কী উঠবে তা তো-” মেরুপ্রভা মাঝপথেই বলেছিল, “দুজনের সামনেই বলো না হয়।” ক্যাথি ফোঁস করে উঠেছিল, “সেও অসভ্যতা হবে। একজনের সামনে অন্যজনের নিন্দে - তাও হবু দম্পতির সেও তো
অনুচিত।” অতএব কোনো সমাধান পাওয়া যায় নি
ক্যাথির সমস্যার। তাছাড়াও যে মেয়েকে মেরুপ্রভা চেনেই না তার তরফদারি করেছিল বলেও
ক্যাথেরিন বেশ চটেছিল। জনে জনে সে গুজগুজিয়ে ছিল যে একটা অন্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল
থেকে উড়ে এসে কোন সাহসে মেরুপ্রভা তার মতো তিনপুরুষের আমেরিকানকে জ্ঞান দেয়?
মেরুপ্রভা সে গুজগুজানি শুনে নিভৃতে হেসেছিল। কারণ ক্যাথির মতে ‘হানি’ বা ‘পাই’ কিংবা ‘সুগার’ বা তার কত্তার কালের বুড়োদের মতে ‘বেবি’ চিরায়ত সম্বোধন হলেও ক্যাথির
মায়ের কালে সম্বোধনটা ছিল ‘ডিয়ারেস্ট’। সে তত্ত্বকথা পেড়ে আর বেনাবনের শৃগালি মেরুপ্রভা
নিজের শত্রুসংখ্যা বাড়ায় নি।
রজার স্বভাবপ্রেমিক। মেরুপ্রভার নির্বান্ধব নিশ্চুপ স্বভাব তাকে টেনেছিল মেরুপ্রভাদের
ল্যাবে তার প্রথম দিনটাতেই। বেশ কিছুদিন ধরে সে সঙ্গ নিয়েছিল মেরুপ্রভার, মেশার
চেষ্টা করেছিল আপ্রাণ। কিন্তু রজার সরাসরি কিছু বলেও নি মেরুপ্রভাকে। একটা নির্বান্ধব
মেয়ে তার মতো প্রেমপক্ক ছেলের প্রেমকে অস্বীকার করে যদি? অথচ মেরুপ্রভাকে অবজ্ঞা
করে অন্য কোনো মেয়ের দিকে সে মনও দিতে পারছিল না। একদিন সে ল্যাব থেকে পিছু
নিয়েছিল মেরুপ্রভার। সেদিন মেরুপ্রভা ল্যাব থেকে সোজা একটা খাবারের দোকানে গিয়ে
ঢুকেছিল। রজার ড্রাইভ থ্রু থেকে খাবার আর কফি নিয়ে পার্কিং-এই বসেছিল ভিউ ফাইন্ডার
দিয়ে মেরুপ্রভার গাড়ির দিকে নজর রাখতে রাখতে। সেদিন মেরুপ্রভা গিয়েছিল মাঠ, আকাশ
আর খাদের কাছে। ফেরার পথে মেরুপ্রভা গ্যাস স্টেশনে ঢুকেছিল। রজারের অবশ্য না ঢুকে
উপায় ছিল না। তার গাড়ি যে মাঝপথেই জবাব দেয় নি তার অভিযানে তাই তার জন্য তখন
যথেষ্ট। রজারকে দেখে মেরুপ্রভাই হাত নেড়ে “হাই” বলেছিল। তারপর রজারকে গ্যাস স্টেশনের লাগোয়া দোকানে কফিও খাইয়েছিল। কাজের
জায়গা থেকে দূরে মেরুপ্রভাকে অন্যরকম লাগছিল রজারের। কিন্তু মেরুপ্রভাই কথাটা
পেড়েছিল, “তোমার তার মানে বউ-বাচ্ছা নেই?” বিনা মেঘে বাজ পড়ার মতো লেগেছিল রজারের। বলেই মেরুপ্রভা অবশ্য মাপ চেয়েছিল, “ব্যক্তিগত কথা নাও বলতে পারো। আমি
ঠিক উচিৎ-অনুচিৎ তাল রেখে কথা বলতে পারি না।” রজার আস্কারা পেয়ে বলেছিল, “কথা যে বলতে পারো তাই তো জানতাম না।” সে আর কিছু বলার আগেই মেরুপ্রভা
বলেছিল, “জানো না আমাকে ল্যাবে ব্ল্যাকহোল বলে?” রজার ঠোঁট ঝুলিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ছিল। তারপর
মেরুপ্রভাই রজারকে কে, কী, কেন পদ্ধতিতে বুঝিয়ে বলেছিল যে রজার দুজনেরই সময় নষ্ট
করছে। এভাবে রজার “ধরি মাছ না ছুঁই পানি” খেলায় ধরা পড়ে গিয়ে মেরুপ্রভাকে ভয় পেতে শুরু করে। সে মেরুপ্রভাকে ভয় পায়
কারণ কোনো ভাবেই মেরুপ্রভাকে আঘাত করা যায় না বলে। মেয়েটার বর্ম তার নির্লিপ্তিতে
নাকি তার বৌদ্ধিক প্রকাশে সেটা নিয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারে না বলে।
“এখন আবার ঝড়ের সতর্কতা। সে রাতেও
এমনই ছিল। তখনই বেরিয়ে যেতে পারি নি বাড়ির দিকে। আর সাড়ে আট হাজার মাইল দূরেও তখন
ঝড়বৃষ্টিতে বানভাসি ছিল এক শহর। সেখানে আমার বাবা আমার অসুস্থ মাকে নিয়ে যাচ্ছিল
হাসপাতালে। পাঁচদিন পরে আমার সাথে বাবার দেখা হয়েছিল হাসপাতালে। ভেঙে যাওয়া হাইওয়ে
ছাপিয়ে গিয়েছিল বন্যার জলে। তার গ্রাস থেকে বাঁচে নি অ্যাম্বুলেন্স। রুগ্ন মায়ের
জীবনী কেড়ে নিয়েছিল সেই জল। বাবা হাসপাতালে মূমুর্ষু আর শোকসন্তপ্ত। সে অবধি
যাঁদের চিনতাম বাবার নিকটজন বলে তাঁরাই বাবাকে দুষতে লাগলেন পুরো দূর্ঘটনাটার
জন্য। মর্মাহত বাবাও চলে গেলেন আমাকে ছেড়ে। আমিও ছিন্নমূল হলাম। পরিজনদের থেকে
নিজেকে আড়াল করলাম দূরত্ব দিয়ে। মনে হয় বিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতার থেকে মুক্ত আমি
বেশ আছি। তবু ক্যালেন্ডারের পাতার তারিখগুলো উতলা করে যায়। আমি ওয়েদার আপডেট দেখতে
থাকি অনবরত। ঝড়ের সম্ভাবনা গেলে আমি মুখোমুখি হবো তারাদের নির্জনতার। বিশালের
সামনে নিজের ক্ষুদ্রতাকে প্রত্যক্ষ করে নেব বলে। তারপর শান্ত হব উদ্বেগের কোনো শেষ
নেই জেনে।”
ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত সতর্কতার সময়টা কেটে
যাওয়ার পর মেরুপ্রভা সত্যিই রাস্তায় বের হলো সে রাতে। কিন্তু স্টেট হাইওয়ে দিয়ে
পঁচিশ মাইল পশ্চিমে যেতে না যেতেই দেখল যে রাস্তার পাশের মাঠে ছাদের ওপর শুয়ে আছে
একটা গাড়ি, শূণ্যে চারটে চাকা তুলে। এই রাস্তাটা মেরুপ্রভার পছন্দ কারণ কখনোই
এখানে বেশি ভিড় থাকে না। তাছাড়া সে রাতে এদিকে আসার আরও কারণ ছিল যে ওই দিক দিয়েই
ঝড়টা গেছে বলে সে শুনছিল রেডিওতে। ঝড় যেহেতু ওদিক দিয়েই গেছে, তাই ওখানে তখনই আবার
বিপদের সম্ভাবনা কম। কিন্তু ঝড়ের জন্য এদিকে গাড়ির সংখ্যা প্রায় শূণ্য হয়ে গেছে।
তাই বোধ হয় উলটে যাওয়া গাড়িটার কথা কেউ জানতে পারে নি। তাছাড়া প্রশাসন হয়তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড়ের ঠেলা
সামলাতে, তাই এদিকে কোনো টহলদার এখনও এসে পৌঁছয় নি।
নিজের গাড়িটা রাস্তার পাশের ঘড়ঘড়ে শোল্ডারে
নিয়ে গিয়ে ফ্ল্যাশারটা লাগিয়ে নাইন ওয়ান ওয়ান ডায়াল করল মেরপ্রভা। কিন্তু
দূর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়িটাকে ছেড়ে সে যেতে পারল না যতক্ষণ না অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশ
এসে পৌঁছোয়। তারপর নিজের অজান্তেই সে হাসপাতালে গেল। গাড়িটাতে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ
ছিল না। তার পরের দিন কাজ থেকে ফিরে সে খবর নিতে গেল যে ভদ্রলোক কেমন আছেন। গিয়ে শুনে
চমকাল যে এগারশো মাইল দূরে ভদ্রলোকের এক মাসি ছাড়া তিন কূলে আর কারুর খবর পাওয়া
যায় নি। আরও মুশকিল ভদ্রলোক তখনও সংজ্ঞাহীন বলে।
সপ্তাহান্তে আহত ভদ্রলোকের মাসি
জানিয়েছিলেন যে তিনি বয়সের কারণে বোনপোর দুর্দিনে হাজির হতে পারছেন না এবং নিয়মিত
খবর পেলে তিনি বাধিত হবেন। ফলে মেরুপ্রভার ছিমছাম জীবনে ব্যস্ততার ঢল এল।
হাসপাতালে, পুলিশের দপ্তরে দৌড়োদৌড়ি করে সে জানল যে তার শহর থেকে তিরিশ মাইল দূরের
এক শহরে আহত ভদ্রলোক কাজ করতেন একটা নামজাদা ব্যাঙ্কের শাখা আপিসে। তাঁর বাড়িও ওই
এলাকাতেই। কিন্তু বাড়িতে তিনি ছাড়া আর কেউ থাকেন না। বছর খানেক আগে এক গাড়ি
দূর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের তিন বছরের শিশুকন্যা মারা যান।
এরপরে ভদ্রলোকের সংজ্ঞা ফিরতে দেখা গেল যে
তিনি তাঁর নিজের নামটাও ভুলে গেছেন। গাড়ির কাগজপত্র ছিল বলে সব্বাই জানত যে তাঁর
নাম ডেভিড ব্রাউন। কিন্তু তিনি নিজে শুনে অবাক হলেন। তাঁকে তাঁর মাসির বাড়ি বা
নিজের বাড়ি যেতে বলা হলে তিনি খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন। তাঁর মনের চিকিৎসা আর শরীরের
যত্নের প্রয়োজন, মনোবিদের মতে সাহচর্যেরও প্রয়োজন। কিছু দ্বিধার সাথে মেরুপ্রভা রাজি হয়ে গেল। ফলে তার
কাজের থেকে বাড়ি ফেরার তাড়া তৈরি হলো। তার নিশিরাতের অভিযান বন্ধ হয়ে গেল। নিজের
সাথে কথোপকথন বন্ধ হয়ে গেল। নিজের বাড়িটা তার অস্বস্তিকর অচেনা লাগতে শুরু করল।
তার সপ্তাহান্তগুলোও ব্যস্ততায় চুর হয়ে উঠল। ছুটির দিনে দুটো লোকের সারা সপ্তাহের
রান্না, বাজার, কাপড় কাচা আর বাথরুম পরিষ্কার করার পর মেরুপ্রভা কাজের দিনগুলোর
থেকেও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়তে লাগল। তারওপর রান্নায় এত যে ঝক্কি তা কোনোদিন সে
টেরটি পায় নি। বাইরে খেলে সে আন্তর্জাতিক খাদক, কিন্তু ঘরের মধ্যে ডাল, ভাত, ঘন্ট,
চচ্চড়ি, ঝাল ঝোল ছাড়া কিছু রাঁধতে পারত না। এখন সহাবাসিককে স্বস্তি দিতে তাকে তাঁর
স্বাভাবিক রুচির খাবারও রান্না করতে হচ্ছে। তারওপর ভদ্রলোক কিছু বলতে পারেন না যে
বাড়িতে কী খেতেন। সেসব খাবারের নাম কী ছিল। ইন্টারনেটের দয়ায় চিরাচরিত আমেরিকান
খাবারের রাঁধার পদ্ধতি জেনে গেলেও ডেভিডের ঘরের খাবারের স্বাদ ফোটানো সম্ভব কী?
মেরুপ্রভা নিজের জীবনে বহুবার চেষ্টা করেছে
মায়ের রান্না করা খাবারটা রাঁধতে। শুরুতে ফোড়নের গন্ধ থেকে শেষে খাবারের গন্ধ এক
রকম লাগলেও নস্ট্যালজিয়া চুরমার হয়ে গেছে খাবার মুখে নিলে। একই ভাবে মা আর দিদা
পায়েস রাঁধত। কিন্তু দিদার পায়েস খেতে বেশি ভালো লাগত। মা পাশে দাঁড়িয়ে শিখিয়ে
দিলেও, মেরুপ্রভা জানে যে, কিছুতেই হুবহু মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ আসবে না।
সেখানে একটা অপরিচত পরিবারের রান্না হুবহু রাঁধা দুসাধ্য। অথচ মনোবিদ বারবার
অনুরোধ করেছেন যে ডেভিডকে যেন ঘরে রান্না খাবার দেওয়া হয়, যাতে তাঁর স্মৃতিগুলো
আবার জেগে ওঠে। ইচ্ছে করলেও মেরুপ্রভা সন্দেহটা প্রকাশ করে না যে পরিবার ভেঙে
যাওয়া পুরুষটা কী ঘরে খেত আদপেও?
মনোবিদের নির্দেশেই একদিন মেরুপ্রভা ল্যাব
থেকে ছুটি নিয়ে গেল ডেভিডের আপিসে। সেখানে ডেভিডের ম্যানেজার আর সহকর্মীরা সবাই
ডেভিডকে অনেক প্রশ্ন করলেন। কিন্তু ডেভিড কোনো উত্তর দিতে পারল না। তার কী হয়েছিল, কবে হয়েছিল, কিভাবে
হয়েছিল – সব প্রশ্নের একটাই উত্তর, “তোমাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে কিছু হয়েছিল, কিন্তু আমি জানি না যে সত্যিই কিছু
হয়েছিল।” ডেভিডের ম্যানেজার বারবারা মেরুপ্রভার থেকে
আনুপূর্বিক ডেভিডের দূর্ঘটনার কথা জেনে নিলেন। তারপর বললেন, “ডেভ খুবই কাজের ছেলে ছিল। ও যদি
কাজে যোগ দিতে চায় তো যে কোনোদিন যোগ দিতে পারে।” ফেরার পথে
ডেভিড একটাই প্রশ্ন করল, “তুমি যে আমার দেখাশোনা করছ তার খরচ কোথা থেকে আসছে?” মেরুপ্রভা উত্তর দিতে একটু
ঝামেলায় পড়ল। খরচ নিয়ে সে কিছুই ভাবে নি। তার মূল ভাবনা ছিল তার একান্ত যাপণের
চ্যুতি নিয়ে। কিন্তু ডেভিড নিজের ঘরে বই আর টেলিভিশন নিয়েই থাকে বলে মেরুপ্রভার কোনো
অসুবিধে হয় নি এযাবৎ। জবাবে বলল, “আমার রোজগার থেকে।” ডেভিড বলল, “তোমার কাছে আমার কতো ধার?” মেরুপ্রভা বলল, “বাড়ি ফিরে হিসেব করে বলব।” এই প্রথমবার মেরুপ্রভার মনে হলো যে সে বাকপটু হলে
ভালো হতো।
হিসেব ইত্যাদি সারা হলে মেরুপ্রভা বাগানে
গাছের যত্ন করছিল। তার থেকে থেকে মনে হচ্ছিল সেই রাতে বেরাতে না গেলেই ভালো ছিল। এখন উটকো ঝঞ্ঝাট বাড়িতে ডেকে এনে অশান্তি দেখা
দিচ্ছে। হঠাৎ বাইরের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পেল। বাগানটা বাড়ির পিছনে। যে কোণে
মেরুপ্রভা কাজ করছিল সেখান থেকে বাগানের দরজার সামনে এসে দেখল খাঁ খাঁ বসার ঘরটা
পেরিয়ে বাড়ির সামনের দরজাটা বন্ধ। বাড়ির ভেতরে ঢুকে, “ডেভ, ডেভ” করে ডাকাডাকি করে ডেভিডের সাড়া
পেল না, এঘর সেঘর খুঁজে যখন ডেভিডের দেখাও পেল না, তখন সে বাগানের দরজা আর বাড়ির সামনের
দরজায় তালা দিয়ে বেরোল গাড়ি নিয়ে।
পাড়ার রাস্তা পেরিয়ে বড়ো রাস্তার মুখে এসে
মেরুপ্রভা দেখল যে ডেভিড কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে। মেরুপ্রভা ওকে গাড়িতে তুলে
নিল। তারপর দুজনে মলে গেল। মলের দোকানে তেমন ভিড় নেই। সপ্তাহের মধ্যখান, তায় বছরেরও
মাঝখান, তাই সবটাই ফাঁকা ফাঁকা। বেশ কিছু মানুষ হাঁটছে আর ছুটছে। বাইরের গরমে
হাঁটা মুশকিল। তাই এই ব্যবস্থা। মেরুপ্রভাও হাঁটতে লাগল, সঙ্গে ডেভিড। অনেক ঢোক
গিলে মেরুপ্রভা প্রশ্ন করল, “কোথায় যাচ্ছিলে?” ডেভিড বলল, “জানি না। কিন্তু এ বড়ো বাজে ব্যাপার। আমি তোমাকে চিনি না। তোমার কাছে থাকব
কেন?” মেরুপ্রভা বলল, “আজ তো নিয়ে গেলাম তোমার চেনা লোকেদের কাছে। তুমি তো তাদের চিনতেই পারলে না। কী
করে নিশ্চিত হচ্ছ যে তুমি আমাকে চেন না?” ডেভিড একটু চুপ করে থেকে বলল, “এই ধাঁধাটাই ভালো লাগছে না। তুমি
আসলে কে?” মেরুপ্রভার হাসি পেল। তারপর বলল, “আমার নাম মেরুপ্রভা। আমি একজন বৈজ্ঞানিক। এই শহরের
ওষুধের কোম্পানিতে কাজ করি।” ডেভিড ব্যাজার স্বরে বলল, “মনে আছে। আরও মনে আছে আমার গাড়ি
উলটে গিয়েছিল। হয়তো হাইওয়েতে টর্নেডোর ঘায়ে। তুমি আমাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা
করেছিলে। কিন্তু সে সব তো এই জীবনের কথা। আমি জানতে চাইছে আমার দূর্ঘটনার আগে
তোমাকে আমি চিনতাম কিনা?” মেরুপ্রভা বলল, “না, আমি তোমাকে চিনতাম না। তোমার মাসি কিংবা আপিসের লোকেরা, যাঁরা আজ এতো
উচ্ছ্বসিত হলেন তোমাকে দেখে, তাঁরা কেউই হাসপাতালে আসতে পারেন নি। মনোবিদ বলেছিলেন
তোমাকে পারিবারিক যত্নে রাখতে। আমি বরাবর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছিলাম।
তাইতে ওঁদের আমাকে সংবেদনশীল বলে মনে হয়। ওঁরা আমাকে অনুরোধ করেন যে আমার পরিবারে
তোমাকে জায়গা দিতে। আমার ধারণা পুলিশ নির্ঘাৎ জানে যে আমি একলা থাকি। কিন্তু সেসব
কথা আমার আর ওঁদের বলার ইচ্ছে হয় নি। আমার মনে হয়েছিল কটা দিনের ব্যাপার-।” থেমে গেল মেরুপ্রভা আর কথা খুঁজে
পাচ্ছিল না। ডেভিডই কথা বলল আবার, “কিন্তু তুমি আমার খবর রাখছিলে কেন?” মেরুপ্রভা বলল, “স্পষ্ট করে জানি না কেন। কিন্তু
যখনই ভেবেছি তখনই মনে হয়েছে যে তোমার মতো অবস্থা আমারও হতে পারত। সেই অসহায়
অবস্থাটা ভেবেই আমার মনে হয় যে তুমি সুস্থ হওয়া অবধি তোমার সঙ্গে থাকাটা জরুরি।” সেদিন আর কথা
বেশি এগোয় নি।
পরদিন মেরুপ্রভা কাজ থেকে ফিরে দেখল ডেভিড খাবার পরিবেশন করছে। বাড়িটা মাখন আর
মাংসের গন্ধে ম ম করছে। মেরুপ্রভা বুঝতে পারল না উচিৎ কিনা, হয়তো স্বাভাবিক
কথোপকথনের অনভ্যাসেই বলে ফেলল, “তুমি তো রান্না করতে ভোলো নি!” ডেভিড হো হো হেসে উঠে বলল, “তাই তো দেখছি।” খাওয়া শেষে
রান্নাঘর পরিষ্কারে আর বাসন ধুতে গেল ডেভিড। মেরুপ্রভা গেল স্নানে। তারপর ডেভিডকে
নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গিয়ে বসল তার প্রিয় খাদের আলসেতে। ততক্ষণে সূর্য ডুবে অন্ধকার হয়ে
গেছে। একটা একটা করে তারা জাগছে। ডেভিড জিজ্ঞেস করল, “এ জায়গাটা খুঁজে পেলে কী করে?” মেরুপ্রভা বলল, “যখন এ শহরে কাজ করতে এলাম, তখন
একদিন বিকেলে হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ির মুখ ঘোরাবার জন্য এখানে ঢুকেছিলাম।
তারপর আমেরিকায় মেঠো রাস্তা দেখে কৌতুহলে এদ্দুর চলে আসি। তারপর খাদ আর তারা আর
নির্জনতা সব আমাকে এমন গ্রাস করল যে প্রায় দেড় ঘন্টা এখানে বসে ছিলাম। প্রায় হাতড়ে
হাতড়ে হাইওয়েতে ফিরেছিলাম। তারপর মাঝেমধ্যে এ জায়গাটায় আসতে ইচ্ছে করে আর আমি চলে
আসি।” ডেভিড বলল, “তোমাদের বুঝি ধারণা যে আমেরিকা ভর্তি কেবল
আকাশচুম্বী বাড়ি?” মেরুপ্রভা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। ডেভিড বলল, “এদেশের লোকেদেরও অবাক লাগে যে
তোমাদের অভুক্ত লোকেরা কী করে অঙ্ক কষে আর মোবাইলে কথা বলে?” মেরুপ্রভা একটু থতমত খেল। তারপর
বলল, “আমারও অবাক লাগে। কুড়ি বছর আগে দেশ ছেড়েছি। চোদ্দো বছর হয়ে গেল দেশে আর যায়
নি। যারা যায় তাদের মুখে শুনে অবাক হয়ে যাই ওখানে লোকে নাকি ব্র্যান্ডেড জামা ছাড়া
পরেই না। সবার হাতে নাকি মোবাইল ফোন!” এবার বিস্ময় ঝরল ডেভিডের স্বরে, “চোদ্দো-ও বছর! যাও নি কেন?” মেরুপ্রভা চমকে উঠল। অনেক দিন কেটে গেছে। কিন্তু দিনগোনাতে কোনো ভ্রান্তি নেই
তার। ইতস্তত করে বলল, “কেউ নেই আমার ওখানে।” তারপর নিঃস্তব্ধ চরাচরের অস্বস্তি ভেঙে বলেছিল, “আমার মায়ের আর্থ্রিটিস ছিল। বাবা
সুস্থই ছিলেন। ওঁরা দেশে নিজেদের বাড়িতে থাকতেন। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। জমি
কিনে একটা বাড়িও বানিয়েছিলেন। আমার পি এইচ ডি কোর্সের মাঝামাঝি বাবা অবসর নেন কাজ
থেকে। পি এইচ ডি শেষ করে আমি পোস্টডক শুরু করেছিলাম। পরের বসন্তে বাবা-মায়ের আমার
কাছে আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময়ে মায়ের হঠাৎ অসুখ করেছিল। জ্বর হয়েছিল সপ্তাহ খানেক। তারই
চিকিৎসা চলছিল। তারমধ্যেই মা শয্যাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আর সেই সময়েই একটা বন্যা হয়েছিল। বাড়ির থেকে হাসপাতালে
নিয়ে যাওয়ার সময় অ্যাম্বুলেন্স বন্যার জলে ভেসে যায়। সেই জলে ডুবে মা মারা যান।
বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অনেকগুলো আঘাতের চিকিৎসা করাতে। অ্যাম্বুলেন্স
দূর্ঘটনার পাঁচদিন পরে আমি বাবার মুখোমুখি হয়েছিলাম। বাবা ভয়ানক ক্ষমা প্রার্থনার
ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘পারলে মাপ করিস। আমি বুঝতে পারলে গত সপ্তাহেই তোর মাকে হাসপাতালে দিতাম।’ প্রথমটায় আমি
বুঝতে পারি নি যে বাবা অমন কেন বলছিলেন। তারপর শুনলাম যে আমাদের প্রতিবেশীরা,
যাঁদের বাবার বন্ধু বলে চিনতাম তাঁরা, বাবার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা সবাই কানাকানি করছে
যে আমি স্বার্থপর বলে মায়ের অসুখ শুনেও আরও আগে দেশে পৌঁছোনোর চেষ্টা করি নি এবং
আমার বাবা অতি বদমাশ লোক, নিশ্চয়ই কোনো যুবতীর সাথে ঘর বাধার ফিকিরে ছিলেন, তাই
মাকে জোর করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে ছিলেন, চাইলে নাকি বাবা আগেই মাকে হাসপাতালে
নিয়ে যেত পারতেন। আমার মামা আর মাসি কথাগুলো সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছিল। আর বাবার
বাড়ির দিকে আমার একমাত্র জেঠতুতো দিদি বাবার চিকিৎসার সব ঝক্কি সামলাচ্ছিল। তারপর
সাতদিনের মধ্যে বাবাও গত হলেন। পারলৌকিক ক্রিয়া শেষ হতে আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস
করেছিলেন যে আর কতদিন থাকব দেশে। সবাইকেই বলেছিলাম, ‘এখনও ঠিক করি নি কিছু’। হঠাৎ পাড়ার এক মাতব্বর তার জবাবে বলেছিলেন, ‘এরকম বললে তো চলবে না। তোমাকে
তাড়াতাড়ি ঠিক করতে হবে। দেশে থাকতে চাও তো আমরা তোমাকে নাহয় কয়েকদিন আরও থাকতে দেব
বাড়িটাতে, যতদিন না তুমি একটা ব্যবস্থা করতে পারছ নিজের। কিন্তু বিদেশে গেলে তোমার
জিনিস যা রাখার তোমার নিজের কাছে সেসব নিয়ে চলে যেও।’ আমি হকচকিয়ে জিজ্ঞেস
করেছিলাম ‘মানে?’ আরেকজন বুঝিয়ে বলে দিয়েছিলেন আমার বাবা নাকি তাঁর
যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পাড়ার ক্লাবকে লিখে দিয়েছিলেন।” ডেভিডকে এইখানে বোঝাতে হলো ‘পাড়ার ক্লাব’ জিনিসটা কী। ওটা জিনিস নয় ব্যাপার
সেটা বোঝাতে অনেক সময় গেল। আরেকটা কথা বুঝতে পেরে অবাক হলো মেরুপ্রভা, যে সে
এতোক্ষণ নিজের সাথে নয়, আরেকটা মানুষের সাথে কথা বলছিল।
ফেরার পথে ডেভিড গাড়ি চালাচ্ছিল। ও জানতে চাইল, “তুমি মামলা করলে না কেন?” মেরুপ্রভা বলল, “ভেবেছিলাম। প্রথমত, তখন আমি কপর্দক
শূণ্য। দ্বিতীয়ত, দেশে গেলে নিজের খরচ, মামলার খরচ চালানোর মতো কাজ পাওয়ার কোনো
নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু এখানে আমার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা ছিল। তারওপর ভাবলাম
মা-বাবাই রইল না; শুধু বাড়িটা থাকলে আমি ফিরব কার কাছে?” ডেভিড খোঁটা দিল, “তাহলে এখন ভারতের রাস্তায় রাস্তায়
শুধু অঙ্কবিদ আর বৈজ্ঞানিক নয়, আগেকার মতো দার্শনিকও থিকথিক করে!” তারপর আমেরিকানরা যেমন বলে, তেমনই
বলল, “ঠাট্টা করছি।” মেরুপ্রভার এবার একটু অস্বস্তি লাগছিল অচেনা লোকের কাছে এতো কথা বলে ফেলে। লোকটাকে হাসপাতালে রেখে এলেও চলত। কেউ তো তার ঘাড়ে
জোর করে চাপিয়ে দিতে পারত না। যত্তসব! কিন্তু রাতে বিছানায় শুয়ে সে একটা ভালোলাগায়
আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সেই ইস্কুলে প্রথম দিন অনেক নতুন ছেলেমেয়ের সাথে চেনাশোনা হতে
যেমন হয়েছিল, কিংবা গ্র্যাজুয়েট স্কুলে আসার পর যেমন হয়েছিল, তেমনই।
পরদিনও ডেভিড রাতের খাবার বানিয়েছিল। তারপর মেরুপ্রভার বাবা-মায়ের ছবি দেখতে
চেয়েছিল। মেরুপ্রভার অ্যালবাম আশ্চর্যজনক সংক্ষিপ্ত। অবাক হয়ে ডেভিড জানতে
চেয়েছিল, “বাড়ির ছবি রাখো নি কেন?” মেরুপ্রভা বলল, “ইচ্ছে করে নি। বাড়িটা নেই, সেখানে যাওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। ছবি রাখলেও
সেখানে ফেরা যাবে না। আবার ছবি নেই বলে আমার মা-বাবার সাথে ঐ বাড়িতে থাকার আমার যে
স্মৃতি তাও তো এতো বছরে ম্লান হয় নি।” ডেভিড আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার বেড়ানোর ছবি নেই কেন? বন্ধুদের ছবি নেই কেন?” মেরুপ্রভা গলায় অনেক বিরক্তি ভরে
বলল, “ইচ্ছে করে নি ছবি রাখতে।” ডেভিড কৌচ ছেড়ে
চটি পরে বেরোবে বলে দরজা খুলল। প্রাণপণে চীৎকার করে উঠল মেরুপ্রভা, “ডে-এ-ভ, যাচ্ছো কোথায়?” ডেভিড বলল, “তুমি স্মৃতি মুছতে চাইছ। আমি ফিরে
পেতে চাইছি। তুমি কোনোভাবেই আমার উপযুক্ত সঙ্গী নও।” মেরুপ্রভা তর্ক জুড়ল, “তোমাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে যাবে
কে? তুমি তো নিজের অ্যাকাউন্ট নাম্বারও মনে করতে পারছ না। তোমার গাড়িটাও তো সারিয়ে
আনা যাচ্ছে না। তুমি একলা থাকবে কী করে?” ডেভিড উত্তর দিল, “আমার মনে না থাকলেও আমার একটা বাড়ি
আছে, সেখানে থাকব। গাড়ি ভাড়া নিতে একটা ড্রাইভার্স লাইসেন্স লাগে, সেটাও আমার আছে।
গাড়ি চালাতেও আমি ভুলি নি। আর নিজের গাড়ি ফেরত নিতে টাকা লাগবে, ব্যাঙ্ক
অ্যাকাউন্ট নাম্বার লাগবে, সেটা কোর্ট অর্ডার করে হয়তো হস্তগত করতে পারব। আমার
স্মৃতি গেছে, আমি লোকটা বদলে যাই নি।” কিন্তু মেরুপ্রভা এতকথার একটাও শোনে নি। সে ডুবে গিয়েছিল বিস্ময়ের অতলে,
নিজের কথা শুনে, নিজের আচরণ দেখে। চারদিকে সব থমথমে নিশ্চুপ হতে মেরুপ্রভা
মৃদুস্বরে বলল, “কাল সকালে কাজে যাওয়ার পথে তোমাকে কার রেন্টালে নামিয়ে দেব। এখন যেতে ট্যাক্সি
লাগবে। যদি যেতে চাও আমার থেকে কিছু টাকা নিয়ে যাও। পরে দিয়ে যেও না হয়।” ডেভিড পায়ে পায়ে নিজের ঘরে চলে
গেল।
পরদিন সকালে ডেভিড ক্ষমা চাইল প্রথমে। নাম ঠিকানা ভুলে গেলেও অহং খোওয়া যাই নি
বলে রসিকতাও করল। ক্ষমা চাইল মেরুপ্রভাও। ডেভিড বাড়িতে রয়ে গেল, মেরুপ্রভা গেল
কাজে। দুপুরে ডেভিড ফোন করে বলল যে দিনটা শুক্রবার বাইরে খেয়ে সিনেমা দেখতে গেলে
হয়। তার সঙ্গে এটাও জানাতে ভুলল না যে পয়সার ব্যবস্থা হলে সে তার খাবারের আর
সিনেমার টিকিটের দাম দিয়ে দেবে। মেরুপ্রভা ল্যাব থেকে বেরোবার আগেই ডেভিডকে বলে
দিল তৈরি হয়ে সামনের বাগানে দাঁড়াতে। মেরুপ্রভা আর বাড়িতে ঢুকবে না। ডেভিডকে তুলে
নিয়ে গাড়িতে সিধে খেতে চলে যাবে।
খাওয়া এবং সিনেমা দেখা সেরে মেরুপ্রভা গাড়ি ছুটিয়ে দিল সেই নির্জন পথে যেখানে
প্রথম দেখেছিল ডেভিডকে। তারপর রাস্তার যেখানে পড়েছিল ডেভিডের গাড়ি তার কাছে
শোল্ডারে ফ্লাশার দিয়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, “ডেভ, মনে পড়ছে টর্নেডোর দিন কেন
এসেছিলে এখানে? জানতে না ঝড়ে এখানেও টর্নেডো হতে পারে?” ডেভিড খুব আসতে আসতে বলছিল, “টর্নেডো হবে বলেই এসেছিলাম।” মেরুপ্রভাও সমান নিচু স্বরে, ধিমে
তালে জিজ্ঞেস করল, “কেন?” ডেভিড বলল, “আমার কিছু ভালো লাগছিল না আর। বেঁচে থাকার মানে ছিল না কোনো। তাই ঝড়-বাদলার
দিনে বেরিয়ে পড়তাম। আমার গাড়িটা তার মানে সত্যিই টর্নেডোতে উলটে গিয়েছিল!” মেরুপ্রভা বলল, “পুলিশ তো তাই বলছে। আমি না এলে,
ট্রমাতেই মরে যেতে ভোরের দিকে।” ডেভিড বলল, “বাঁচিয়েছ বলে ধন্যবাদ দিয়েছি অনেক। কিন্তু তোমার দয়াতেও হাঁপ লাগছে। আর এখন তো
সব মনে পড়ে গেল। আমি তোমাকে ধন্যবাদও দিতে পারব না।” মেরুপ্রভা বলল, “দরকার নেই তার। বাবা-মা-কে বাঁচাতে
পারি নি সময়ে পৌঁছতে পারি নি বলে। পরের ঘটনা প্রবাহে মানুষের ওপর এমন বীতশ্রদ্ধ
হয়ে পড়েছি যে মামা, মাসিদের সাথে যোগাযোগ তুলে দিয়েছি। যে দিদির কোনো দোষ ছিল না,
আমি তার সাথেও কোনো যোগাযোগ করি নি। এতগুলো বছরে নতুন কোনো সম্পর্ক তৈরি করতে পারি
নি। ভয়ে, ঘেন্নায়, বিরক্তিতে। সেই আমি তোমার গাড়িটা দেখে দ্বিধা করি নি
এমার্জেন্সিতে খবর দিতে। তোমাকে তোমার আপনজনেদের জিম্মাস্থ করে ছুটি নেব
ভেবেছিলাম। এটা আমার প্রায়শ্চিত্ত ছিল বলে মনে করেছিলাম। মা-বাবাকে যে যত্ন দিতে পারি
নি তার প্রায়শ্চিত্ত করে ফেলব বলে ভেবেছিলাম। তারপর তোমার নিজের লোকেদের খোঁজ না পেয়ে বুঝলাম যে আমি
যদি তোমার অবস্থায় পড়তাম তো আমারও নিকটজন খুঁজে পাওয়া যেত না। মনে হলো তোমাকে
বাড়িতে না আনলে আমার প্রায়শ্চিত্ত অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু সেই প্রায়শ্চিত্তের
চেষ্টায় আমি অনেকদিন পরে বেঁচে থাকায় আনন্দ পেয়েছি, তোমাকে অবলম্বন করে। কাল রাতে তুমি যাবার চেষ্টা করতে মূহুর্তে আমাকে
যেন অন্ধকার করে নিরানন্দ ঘিরে ধরেছিল। তাতেই আমি এসব কথা বুঝতে পারলাম। আমি তোমাকে দয়া করেছি নাকি নিজেকে দয়া করেছি সেটা
বোধ হয় বুঝতে পারছ।” তারপর বাড়ি ফিরে নিজের নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল তারা।
পরদিন সকালে মনোবিদের কাছে যাওয়ার ছিল। ডেভিড জানাল যে ব্যক্তিগত অবস্থাটা মনে
পড়লেও কাজ করতে পারবে কিনা বুঝতে পারছে না। মনোবিদই একসপ্তাহ কাজে গিয়ে কাজটা মনে
করার চেষ্টা করতে বললেন। তারপর শেষ দুপুরে দুজনে উপস্থিত হলো ডেভিডের বাড়ি। বাড়ির
ভেতরে পচা আনাজ আর সব্জির গন্ধ। জানলা খুলে দিল ডেভিড। তারপর ফুলদানি থেকে ফুলের
অবশেষ তুলে ট্র্যাশে ফেলে দিল পচা ফুল। মেরুপ্রভাকে নিয়ে গেল মেয়ে জুলিয়ার ঘরে।
ঘরটা এমন সাজান যেন মনে হচ্ছে মেয়েটা একটু আগেও ছিল ঘরে। ডেভিড বলল, “আমার মেয়ে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিল
ঘরটা আমি তেমনই রেখে দিয়েছি, প্রত্যেকবার ধূলো ঝাড়ার পরে।” একই অবস্থা ওদের শোবার ঘরেরও।
তারপর বাগানে বসে বলল, “মেয়ে হওয়ার সময় আমি স্মোকিং ছেড়ে দিয়েছিলাম। মেয়ে মারা যাওয়ার পর যতবার ভেবেছি
একটা সিগারেট জ্বালাব, প্রত্যেকবার মনে হয়েছে আমার সাথে আবার তার দেখা হলে কী বলব।
ধরানো হয় নি সিগারেট। আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম ওদের কাছে যাওয়ার জন্য। দিনের বেলা
কাজে কেটে যেত। কাটতে চাইত না রাত। ছুটির দিন। বেরিয়ে পড়তাম গাড়ি নিয়ে।” মেরুপ্রভা বলল, “মাসির কাছে যেতে?” ডেভিড বলল, “আমার মা মারা যাওয়ার পর থেকে মাসির
সাথে যোগাযোগ কমে এসেছিল। তাছাড়া মাসির কাছে গাড়ি নিয়ে যেতে পনের ঘন্টা লাগত। তাই
সেসব চেষ্টাই করি নি।” মেরুপ্রভা জানতে চাইল, “তোমার বা তোমার স্ত্রীর ভাই-বোন?” ডেভিড হাসল, “আমার বাবা-মায়ের আমি একমাত্র সন্তান। আমি মা-বাবার সাথে থাকতাম, ইউনিভার্সিটি যাওয়ার আগে অব্দি। তারপর কাজ করতাম
শিকাগোতে, সেখান থেকে ডালাসে, তারপর ঘরের কাছে এখানে এসেছিলাম। থাকতাম বাবা-মায়ের
বাড়ির কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্টে। আমাদের বিয়ের পরেও আমি আর আমার স্ত্রী জেনেভিয়েভ
ঐ অ্যাপার্টমেন্টেই থাকতাম। ওঁদের বিয়ের চল্লিশ বছর পূর্তিতে মাসি, মেসো, আমি আর জেন খুব আনন্দ করেছিলাম।
তার কয়েকমাস পরে মা মারা যান। আমার মা গত হতে বাবা বাড়িটায় থাকতে চাইছিলেন না। তাই আমরা বাবার বাড়িতে চলে যাই। কিন্তু বাবা একটা
অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে শুরু করেন। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা বেঁচে ছিলেন মাত্র এক
বছর। তার তিন বছর পরে আমার মেয়ে হয়। তারপর থেকে মাসির কাছে যাতায়াতটা কমে যায়।
নিঃসন্তান মাসি-মেসো এই বয়সে আর আসতে পারে না। টেলিফোন আর স্কাইপেই যোগাযগ ছিল
আমাদের দুর্ঘটনাটা অবধি। তারপর থেকে তো পুরো পৃথিবীর সাথেই আমার বাঁধনটা আলগা হয়ে
গেছে। তার ওপরে বাবার দিকের অধিকাংশ
আত্মীয়স্বজনই থাকেন নরওয়েতে।” মেরুপ্রভা চুপ করেছিল। একটু থেমে ডেভিড আবার বলেছিল, “জেনেভিয়েভ এদেশে ফ্যাশন পড়াতে
এসেছিল। ফ্রান্স থেকে। ওর একমাত্র বোন এডিথ ছিল সাংবাদিক। এডিথ ছিল উড়নচন্ডে, ঘর
সংসারের ধার ধারে নি। জেন বিয়ে করেছিল। সন্তান আর ভরা সংসার চেয়েছিল। ওর স্বামী তা চাননি। বছর তিনেক ঘর করে জেন কাজ নিয়ে
চলে এসেছিল নিউ ইয়র্কে। তারপর কদিনে সব একঘেয়ে হয়ে যেতে সাবেক আমেরিকান ফ্যাশন
খুঁজতে খুঁজতে এসেছিল এখানে, ওকলাহামায়। আমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল ক্যাসিনোতে।
আমার একটু সন্দেহ ছিল যে নিউ ইয়র্কের জাঁকজমক হট্টগোল ছেড়ে ওকলাহামার নিস্তব্ধতায়
কী আর বছরের পর বছর মন টিকবে ফ্যাশনের মাস্টারনির। কিন্তু সে এখানে কমিউনিটি কলেজে
কাজ জুটিয়ে থেকে গেল দু বছর। তার বিয়েটা ততদিনে ভেঙে ফেলেছিল, আমার প্রেমে পড়েছিল
বলে। এডিথ তাই নিয়ে জেনের সাথে খুব ঝগড়া করেছিল। কিন্তু আমাদের বিয়েতে এসেছিল।
আমাদের মেয়ের জন্মের পরে পরেই এডিথ কিডনির অসুখে মারা গিয়েছিল।” হালকা অন্ধকার
ধরেছে এবার আকাশে। বাগান থেকে উঠে দুজনে খেতে গেল। ডেভিড আবার ফিরে গেল তার
স্মৃতিচারণে। “সেদিন জেনের এক সহকর্মীর মেয়ের জন্মদিন ছিল। তাই আমাদের জুলিয়াকে নিয়ে গিয়েছিল
নিমন্ত্রণ রাখতে। ফেরার পথে তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল। একেক সময়ে হয় না যে বৃষ্টির
চোটে হাইওয়েতে কয়েক ফুটের বেশি দেখা যায় না তেমন বৃষ্টি। সেরাতে ওরা ফেরে নি। অথচ
সহকর্মীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে জেন আমাকে জানিয়েছিল যে পনের মিনিটে বাড়ি ঢুকবে। এক
ঘন্টা পরেও যখন এলো না তখন ভাবলাম বৃষ্টিতে আটকে গেছে কি না। আরও ঘণ্টাখানেক পরে
বৃষ্টি থামতে বেরোলাম। যেদিকে ওরা গিয়েছিল সেই রাস্তায়। কোথাও কোনো দূর্ঘটনার
চিহ্ন পাই নি। ফিরতি পথে দেখলাম একটা জায়গায় ভাঙা গাড়ি রাস্তা থেকে সরানোর কাজ
চলছে। ছুটতে ছুটতে গেলাম থানায়। সেখান থেকে হাসপাতালে। জানতে পারলাম ওরা আর নেই। কিন্তু যে দুটো গাড়ি সরানো
হচ্ছিল ওগুলোর একটাও আমাদের গাড়ি ছিল না। ওদের পাওয়া গিয়েছিল ঐ দূর্ঘটনাস্থল থেকে
কিছু দূরে, উপত্যকায়। দুজনেই গাড়িটার সাথে পুড়ে গিয়েছিল।” মেরুপ্রভার
চোখে বিস্ময় দেখে ডেভিড বলল, “পুলিশে যা ব্যাখ্যা করেছিল সেটা ছাড়া আমি কিছু ভাবার চেষ্টা করি নি। জুলিয়া
সঙ্গে থাকায় আর বৃষ্টিতে রাস্তা দেখতে না পাওয়ায় জেন বোধ হয় গাড়ি আস্তে আস্তে
চালাচ্ছিল। ফলে পিছন থেকে বেশি বেগে আসা গাড়ি ওদের ধাক্কা দিয়েছিল। তাতে দুটো
গাড়িই ফ্ল্যাশার দিয়ে শোল্ডারে দাঁড়িয়ে পুলিশ ডেকেছিল। আর আরেকটা মালসমেত মাঝারি
মাপের গাড়ি দেখতে না পেলেও বেশি বেগে এসেছিল দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর পিছনদিক থেকে। সেটা নাকি শোল্ডারের গাড়ি দুটোকে দেখে ওটাই সঠিক লেন
ভেবে শোল্ডারে ওঠে। ফলে গাড়িটার গতি পড়তে থাকে। তৎক্ষণাৎ আবার শোল্ডার থেকে রাস্তায় ওঠার চেষ্টায়
ওই গাড়িটার ড্রাইভার বোধ হয় বেগ বাড়ানোর চেষ্টা করছিল। পেছল শোল্ডারে গাড়ির বেগ হয়তো বেড়ে গিয়েছিল
ড্রাইভারের অনুমানের থেকে বেশি। সে হয়তো সামনের গাড়ির সাথে দূরত্বটুকু ঠিকঠাক
আন্দাজ করতে পারেনি বৃষ্টির ঝাপটায়। কিংবা পেছল রাস্তায় গাড়িকে ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। ফলে হুড়মুড়িয়ে এসে
পড়ে জেনের গাড়িটা আর পিছনে দাঁড়ানো গাড়িটার ওপরে। তাতে জেনের গাড়ি হাইওয়ে থেকে
ছিটকে গিয়ে পড়ে পাশের খাদে। গড়িয়ে যায় উপত্যকা দিয়ে। গাড়িতে আগুন ধরে যায়।”
অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বলে সেরাতে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ঘুমোতে চলে গিয়েছিল
দুজনেই। পরের দিন ডেভিডের বাড়ি পরিষ্কার করে, বাজার করে, ওখানেই রান্না করে রাতের
খাওয়া সেরে মেরুপ্রভা একাই ফিরেছিল নিজের ডেরায়। এবং নির্জনতা ঢাকতে জোরে টিভি
চালিয়ে রেখেছিল ঘুমিয়ে পড়া অবধি। কিন্তু ভোররাতে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ওর।
ওপারে ডেভিড, “মেরু, আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলো এখান থেকে। এখানে একা থাকতে অসহায় নয়, অসহ্য
লাগছে।” কোনো মতে একটা পাজামা গলিয়ে মেরুপ্রভা গাড়ি নিয়ে
পৌঁছল ডেভিডের বাড়ি। ওকে নিয়ে এলো বাড়িতে। তারপর কৌচে জড়োসড়ো হয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে
পড়ল।
পরদিন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল। কিন্তু আলসেমির আঁচ ছেয়ে আছে শরীরে। মেরুপ্রভা জীবনে
প্রথমবার অসুখের অজুহাতে ছুটি নিল। ডেভিড বাক্সভর্তি জামাকাপড় নিয়ে এসেছিল। সঙ্গে জুলিয়া আর জেনেভিয়েভের ছবি। কিন্তু প্রথমেই
ওরা ছুটল ডেভিডের আপিসে। বারবারা রাজি হয়ে গেলেন ডেভিডকে একটা সুযোগ দিতে। ঠিক হয়ে
গেল পরদিন থেকে ডেভিডের এক সহকর্মী মেরুপ্রভার বাড়ি থেকে ডেভিডকে তুলে নেবেন আর
তাকে কাজের শেষে ফিরতি পথে নামিয়েও দেবেন, যতদিন না ডেভিডের নিজের গাড়ির একটা
বন্দোবস্ত হচ্ছে।
বাড়ি ফিরে ডেভিডের বায়নায় মেরুপ্রভা খুঁজে বার করল দিদির পুরোন ফোন নাম্বার।
জুলিয়া আর জেনেভিয়েভের ছবিগুলো টাঙিয়ে ওরা রাতের খাবার খেল। তারপর ফোন করল দিদির
পুরোন নম্বরে। দেখা গেল নম্বর বদলায় নি। এতো দিনের এতো কথা জমা! এ বলে ‘তুই আয়’ ও বলে ‘তুই আয়’। ঠিক হলো যে প্রথমে শীতে মেরুপ্রভা যাবে দিদির কাছে। তারপর গ্রীষ্মে দিদি আসবেন
মেরুপ্রভার কাছে। ডেভিড বলল, “অনেকটা সময়, ভেবে দেখ মেরু, আগামী গ্রীষ্মে আমরা বিয়েও করতে পারি।”
-------