Showing posts with label Bengali Prose.. Show all posts
Showing posts with label Bengali Prose.. Show all posts

Friday, September 25, 2015

বাংলা মিনিসাগা


অজাতশত্রু


এক রাজপুত্র সিঙ্ঘাসনে বসেছিলেন অজাতশত্রু নামে। সার্থকনামা হতে তিনি তিনটি কাজ আজীবন করেছিলেন। প্রথমত, সবার সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা; দ্বিতীয়ত, যে বন্ধু হয় নি তার বিনাশ, তৃতীয়ত, শত্রুতার সূত্রপাত জানার জন্য চরচর্চা; তার অবশ্যম্ভাবী ফলে শত্রুকে বিনাশ করতে্ন স্থলে, জলে, ছলে বলে, কৌশলে মাতৃজঠরেও। বলাবাহুল্য, তিনি রাজত্ব করেছিলেন জনশূণ্যলোকে।


শঠে ......


লক্ষীরাম আর গঙ্গারাম বুক কাঁপিয়ে হেসে উঠেছিল আইনি বিধান শুনে। সেই বুক ঠুকেই বলেছিল লক্ষীরাম, “আমার নামে উনিশটা আর গঙ্গাদার নামে একুশটা ফৌজদারি রয়েছে।” শুধরে দিয়েছিল গঙ্গারাম, “তেইশটা, ব্যাঁচড়ার চাচা কেটে।”
সেই রাতে সরকারি বনসৃজন প্রকল্পে গরু পড়তে নিরুপায় আধিকারিক সবকটাকে তাড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন লক্ষীরাম গঙ্গারামের ধান খেতে।




শোক ও শিক্ষা


আগে একবার আগুনে পুড়ে গিয়েছিল সনাতনের কেশ, বেশ, বাস, বসত। চুল, চামড়া নতুন গজিয়েছিল। মনের আরাম এসে ছিল সব ভুলে।পরে অন্য আগুনে পুড়তে পুড়তে সে বুঝল যে আগেরবারের দহনশোকের সাথে সে আঁচের অনুভূতি, বিস্ফোরণের কারণ, জ্বালানির চেহারা এসবের লক্ষণ চেনার শিক্ষাটাও ভুলে গিয়েছিল, তাই নিবারণ করতে পারে নি পুনর্দাহ।

শ্রান্ত পান্থের বৃক্ষনিবাস


ধাবায় ঢোকার আগে, লোকটা গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে মাটিতে নামিয়ে রাখল ডালপালা সমেত একটা গাছ। তার ডালে কাঠের একটা বাড়ি টাঙানো, যেন পাখিতে বাসা করবে। স্নান খাওয়া সেরে লোকটা যখন ফিরল তখন গাছটা মহীরুহ। লোকটা এবার ট্রাঙ্ক থেকে ফোল্ডিং মই বাই করে চড়ল ট্রি হাউসে। তারপর ঘুমিয়ে গেল রাতের মতো।

Thursday, July 2, 2015

উদ্বর্তন



দেহলীর পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে এমন আনন্দের রাত সব মিলিয়ে দু-তিনটে। হাতঘড়িতে সময় বলছে মাত্র সাড়ে আটটা। টিভি ঘুরে চলেছে ক্রমান্বয়ে দেড়শটা চ্যানেলে। বেডসাইড টেবিলে রাখা আছে বাকার্ডি হোয়াইট রামের বোতলটা। সঙ্গে একটা ডায়েট কোক। উইকএণ্ড, তায় ভ্যালেন্টাইন্স ইভ। চাপ আছে হোটেলে, বরফের অপেক্ষা চলছে অনির্দিষ্টকাল।
একটা ট্রেন চলে গেল হুহু করে, বদ্ধঘরের টিভির আওয়াজ ছাপিয়ে। দেহলীর হাসি পেল এই ভেবে যে, ট্রেন যখন ছোটে ভাবে গন্তব্য সামনে, আর লাইন্সম্যান হঠাৎ করে তার ট্র্যাক বদলে দেয়, সে তখনও ভাবে গন্তব্য সামনে; কিংবা যখন সে টের পায় রাস্তা বদলে গেছে ততক্ষণে জাড্য তাকে টেনে নিয়ে গেছে অনেক দূরে, যেখান থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে অনিবার্য বাঁকটাও দেখা যায় না। অবধারিতভাবেই তার মনে হলো যে ঠিক এমনটাই ঘটে মানুষের জীবনেও; বার বার।
ভাবনার সুতোটা ছিঁড়ে গেল ডোরবেলের শব্দে। ফ্রেঞ্চফ্রাই আর বরফ এসে গেল। চিন্তার কাছে ফিরতে গিয়ে দেহলী টের পেল মাথাটা খালি হয়ে গেছে। খুব ভ্যাবাচ্যাকা লাগে এরকম সময়। ছেঁড়া চিন্তার প্রান্তটাকে হাতড়াতে হাতড়াতে চিন্তার নাও গিয়ে ঠেকে আরেক ঘাটে, কিংবা আঘাটায়, কিন্তু ঠেকে; জীবনের মতোই; চলে, ভাসতে ভাসতে, গোঁত্তা খেতে খেতে। আসলে চিন্তাও তো জীবনের ঘাড়েই চড়ে থাকে; তাই ডেস্টিনি কিংবা নেমেসিস -কোনোটাতেই সে ব্যাটা ভিন্ন, বিছিন্ন কিছুই হতে পারে না জীবন থেকে।
এখনও জীবনের সাথে জুড়ে আছে বলেই হয়তো ডিসকভারির লক্সোডন্টার থেকে দেহলীর স্মৃতিরা দৃশ্যপটে স্পষ্টতর। কী যে বোকা সে ছিল এই সেদিনও! সে বুঝতই না যে বিধি লিঙান্ত সব ঔচিত্য না মানলে সুখাসুখ, ভালোমন্দে খুব তরবেতর হয় না। সে আরও জানত না যে ভালো-মন্দের বোধটাও একেক লোকের দৃষ্টিকোণের ওপর দাঁড়িয়ে; সেই তফাতেই মানুষ বিচিত্র, বর্ণময়, অশান্তির আকর। যবে থেকে এসব বোধ জেগেছে, তবে থেকে ভালোমন্দের দায় সে অক্লেশে চাপিয়েছে ডেটারমিনিস্টিক ক্যাওসের ঘাড়ে , এতোবার, যে ওটা বিষয় না হয়ে ব্যক্তি হলে নির্ঘাৎ মামলা করত।
নির্বোধবেলায় দেহলী বেশ উদ্যম নিয়ে চেষ্টা করত জটিলতা এড়াতে। বলাবাহুল্য সামাজিক মানবজীবন তাকে সারল্যের স্বর্গে ছেড়ে দেয় নি কখনোই। অবশ্য আর পাঁচটা মানুষের মতোই, দেহলী বেচারিরও কোনো উপায় ছিল না মানবজনম আটকানোর; ফলে একটা সামাজিক জন্তুর জীবনে যতরকম সামাজিক বিনিময় থাকে সেটা সমূলে উৎখাত করা তার অসাধ্য ছিল। তাই জটিলতা এড়ানোর তুমুল চেষ্টা স্বত্তেও হঠাৎ একদিন বেশ খানিকটা গরম, তেতো, ভারি, চটচটে জটিলতা তার অস্তিত্বে আটকে গিয়েছিল। এই দূর্ঘটনার কেন্দ্রে ছিলেন তার পাড়াতুতো প্রাইভেট টিউটর।
টিউটর ভদ্রলোক কিছুই পড়াতে পারতেন না। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে দেহলীকেও খুব বেশি হলে তিনমাস পড়াবেন তিনি, কারণ তার বেশি কোনো টিউশনই টিকত না তাঁর। যেহেতু জমানার ফ্যাশন বাবদ একজন টিউটর রাখার কাজটা পূরণ হয়ে গিয়েছিল, আর দেহলীর বাড়ির লোকের অনীহা ছিল আবার টিউটর নিয়োগের বাড়তি পীড়া নিতে সেহেতু টিউটরমশায় দেহলীর টিউশনে টিকে গিয়েছিলেন তিনবছর; এই অনভিপ্রেত পোষণে টিউটর বেচারা ভবিষ্যত জামাই আদরের পূর্বাভাষ দেখেছিলেন; সে কথা তিনি পাড়ায় রটিয়েও ছিলেন। ফলে দেহলীর জীবনে টিউটরদ্বারা কিছু জ্ঞানবৃদ্ধি হয়েছিল অবশেষে। কিন্তু সে গলা তুলে টিউটরনিয়োজক বনাম টিউটরের দৃষ্টিকোণের ফারাক নিয়ে বক্তৃতা করার সাহস করেনি, তখন এবং পরেও, আরও জটিলতার ভয়ে।
কিন্তু এখন সবাই তাকে সাহসী বলেই জানে! এই রাত সে ধারণাকে চাগিয়ে তুলবে নাকি চুরমার করবে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই তার। ইন্ট্রোস্পেকশনেও কোনো জ্বালা নেই। ফলে দেহলীর ইগো জেগে উঠে তাকে আত্মসন্তুষ্টির উদ্দীপণায় কাজ-কাজ-কাজ চক্রে পিষে মরতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
হয়তো ক্ষিদে, তেষ্টা, প্রেম ইত্যাদি জীবনের অনিবার্য এবং নিতান্ত প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর একটা এই স্মৃতি রোমন্থন। আটকানো যাবে না একে। খেলে মোটা হয়ে যাবে বলে যতটা খিদে আটকানো যায়, প্রেম করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে জেনেও ততটাই প্রেম আটকানো যায়; প্রেম করাটা হয়তো কিছু বেশি আটকানো যায় কিন্তু প্রেমে পড়াটা এক্কেবারেই আটকানো যায় না; বাধ ভেঙে বান আসার মতোই এসে পড়ে, আবার কিছু পলি থিতিয়ে চলে যায় ধীরে ধীরে; শুকিয়েও যায় হঠাৎ একদিন। তখন কেঁদে ভাসাও আর হেঁসেই বাঁচো, কিংবা মাতাল হয়ে গালই খাও, সে আর ফিরবে না। ফেরত চাইলেই টানা-পোড়েন, চ্যুতি-স্খলন, আবেগের চোরাস্রোতে জটিলতার ঘূর্ণাবর্ত। সেই ঘূর্ণির বুকে জটিলতা ক্রমাগত গভীর ক্ষত খুঁড়তে খুঁড়তে তলার দিকে টানতে থাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা সকলকেই। সে টানকে একমাত্র মৃত্যুর অমোঘতাই পারে অগ্রাহ্য করতে। স্বেচ্ছামৃত্যুর আগের স্মৃতিরোমন্থন কী স্বেচ্ছাকৃত? ভাবতে থাকে সে।




স্কুলবেলার ছোট্ট গণ্ডীতে শ্রেষ্ঠত্বের সুখী অহঙ্কারে বালি দিয়েছিলেন মা; বলেছিলেন, .. নেই তাই খাচ্ছ...... বাইরের পৃথিবীটায় কমপিটিশন অনেক বেশি। কী যে চাইতেন তিনি দেহলীর থেকে বুঝতে বুঝতে দেহলীর পঁচিশ পেরিয়ে গিয়েছিল। মা-ই তাকে সারল্য সাধনায় বাধ্য করেছিলেন; তার নির্বুদ্ধিতা আর শ্রীহীনতা নিয়ে সজাগ করে দিতে চেয়েছিলেন; অস্তিত্ব ভরে নারী জন্মের গ্লানি দিতেও চেষ্টা করেছিলেন অনেক, কিন্তু পারেন নি। মায়ের বিনাপণের বিবাহিত জীবনে জা-ননদের কাছে সংকুচিত হয়ে থাকার গ্লানি, বংশের পুত্রসন্তানের আকালে চতুর্থ কন্যা সংযোজনের অপরাধবোধ এবং ইউনিভার্সিটি থেকে যৌথ পরিবারের হেঁসেলে জ্বালানী হয়ে ঢুকে পড়ার হতাশা তাঁকে এক স্নায়বিক খিচুড়ি বানিয়ে ফেলেছিল। দেহলী যখন অয়েলক্লথে শোয়, কিন্তু নিজের হাতে জেঠির ড্রেসিং টেবিল ঘেঁটে দিতে পারে তখন মা এক দুপুরে তার গলায় পা দিয়ে তাকে মেরেও ফেলছিলেন যেহেতু জেঠি হা-ঘরে মায়ের মেয়ের চোর হওয়ার সম্ভাবনায় সোচ্চার হয়েছিলেন; ঠাম্মা দরজা ধাক্কা দিয়ে ছিটকিনি আলগা করে ঘরে ঢুকে পড়ে বাঁচিয়েছিলেন দেহলীকে। হয়তো এসব কারণেই সে মায়ের টিচিং-প্রিচিং কিছুই নিঃসন্দেহে মেনে নেয় নি।
মায়ের অবাধ্য হলেও দেহলী কলেজের বছরগুলোতে কোনো অবোধ্য কারণে প্রেমে পড়ে নি। তবুও কলেজ মানেই তার জীবনে জটিলতার অটোইমিউন সংক্রমণ। শাওন যেমন বলে, আসলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপ জুড়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে ধন-মান-প্রাণ খোয়াতে দেখে, বেঁচে থাকা লোকগুলোর এবং পরের প্রজন্মের মানুষদেরও, মন থেকে সর্বমঙ্গলময় ঈশ্বরের ধারণাটা ভেঙে গিয়েছিল বলেই ইউরোপময় নাস্তিকে ছেয়ে গেছে...... তেমনই কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে মন দিয়ে পড়াশোনা করার সাথে বেশি নম্বর পাওয়ার সরল যোগাযোগের ধারণাটায় বিশ্বাস উপে গিয়েছিল দেহলীর । পরীক্ষা দিয়ে মা ফলেষু কদাচন কিংবা সিদ্ধ্যাসিদ্ধ্যোঃ সমো ভুত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে ভেবেই শান্তি, আরাম পেতে শিখতে হয়েছিল যদিও প্রিপারেশনের মন্ত্র থাকত যোগস্থ কুরু কর্মাণি
দেহলীর অবশ্য ক্রমশঃ ধারণা হয়েছে যে কলেজের চমকটাতে একপক্ষে তার ভালোই হয়েছিল। না হলে পরবর্তী পর্বে চাকরি-বাকরিতে টেকা দায় হতো তার। সে পর্বজুড়ে কেবল ব্যাকবাইটিং-এর রাজনীতি; ক্যারিয়ারের সিঁড়িতে পা পিছলানোর সকাল-সকাল অনিবার্য চমক এবং অবশ্যই দিনের শেষে নো-উইন বা উইন-উইন খেলে নির্লিপ্ত অসন্তুষ্টি নিয়ে বাড়ি ফেরা। চাকরির দিনগুলোতে তারিখ ছাড়া কিছুই তফাৎ করতে পারে না দেহলী। সবকটা দিন দৈর্ঘ্য-প্রস্থে-উচ্চতায় সমান। ছাত্রজীবনে তবু স্পষ্ট সাদা-কালো রঙের পোঁচ ছিল তার জীবনে, কিন্তু চাকরি জীবনে দুই রঙ মিশে একটাই ছাই রঙ।
আজকাল তো মেনে নিতে নিতে প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছে সে যে সিস্টেমের সব্বাইকে লাগবে। এর কারণ নুক এণ্ড ক্র্যানি কোম্পানির সাইট ম্যানেজার নীতিন মিশ্র। সে প্রজেক্টের টাকায় মায়ের নামে ট্রাক কিনে প্রজেক্টেরই মাল বওয়ার কাজে ট্রাকটা লাগিয়েছিল। তার ওপর লেবার কন্ট্রাক্টর থেকে বিভিন্ন সাপ্লায়ার সবাই ছিলেন নীতিনেরই আপনজন। ফলে প্রজেক্ট চলছিল বেশ শান্তিতে। সাইট ম্যানেজারের বিজনেস আকুমেনে তখন কর্তারাও সবাই চোখ বুজে সাধু! সাধু! করছিলেন। কিন্তু নীতিনের সেইসব আপনকল্যাণজনক দক্ষতায় মূল প্রজেক্টের বরাদ্দে ঘাটতি পড়েছিল; গোটা তিনেক ব্রিজ ভেঙে গিয়েছিল প্রজেক্ট শেষ হওয়ার আগেই। মিডিয়া খুব হুল বেচেছিল, কোম্পানির সুনামে বড় দাগ লেগেছিল। কোয়ালিটি অডিটর হিসেবে দেহলীর ক্যারিয়রেও একটা বড় ধাক্কা লাগতে পারত। লাগেনি কারণ দেহলীর আসল কোয়ালিটি রিপোর্ট এবং সে সব নিয়ে দেহলী যে সব যোগাযোগ করেছিল তার উপরওয়ালা, নীতিনের উপরওয়ালা এবং আরও উপরের কোনো ওয়ালার সাথে সে সব নিয়ে হুইস্‌ল্‌টি সে ফুঁকে দিলে কোম্পানির ভিতরে-বাইরে অনেককেই জেলে যেতে হতো। অথচ শোরগোলের সময় দেহলীই বলতে শুরু করে যে স্থাণীয় ঠিকাদার প্রতিশ্রূত মানের কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই দূর্ঘটনাগুলো ঘটেছিল। তার সুরে সুর মিলিয়ে কোম্পানি বলেছিল কন্ট্রাক্টর-পলিটিশিয়ান জোটের ছোটো-ছোটো কারণে লেবার খেপিয়ে থেকে থেকেই কাজ বন্ধ করে দেওয়ার রাজনীতির কথা; যেহেতু কোম্পানি তাদের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ ছিল সময়ে কাজ শেষ করার জন্য সেহেতু ডেডলাইন বাঁচানোর চাপের মুখে পড়ে স্থাণীয় ঠিকাদারের কাজের গূণমান মেনে নিতে কোম্পানি নাকি বাধ্য হয়েছিল। অভিযুক্তদের তালিকা বানিয়ে তাদের নামে আইনি ব্যবস্থার লোকদেখানো তোড়জোড়ও হয়েছিল। ফিরে আসেনি ব্রিজ ভাঙার ফলে আহত লেবারদের সুস্থ শরীর। তাদের জীবন-ধারণের প্রশ্নটাই এখনও তাদের নেতার আরও পয়সা কামাবার উপায় হয়ে গেছে। সে ব্যাটা এখন নুক এণ্ড ক্র্যানি কোম্পানিকে নিঙড়োয়, ঠিকাদারকেও নিঙড়োয়, নিঙড়োয় আহত মানুষগুলোকে আর তাদের পরিবার-পরিজনকেও।
ব্রিজ নিয়ে শোরগোলের মাস ছয়েক পরে মাইনে বাড়ার পরিমাণ এবং প্রোমোশন দুটোতেই তাকে আর নীতিনকে সমান সমান রাখা হয়েছিল। সেই রাগে, যাহোক একটা কারণ দেখিয়ে কোম্পানিটা দেহলী ছেড়ে দিয়েছিল।
এখন দুনিয়াদারির সব হিসেবের বাইরে দাঁড়িয়ে সে। তবু তার মনে হতে লাগল নীতিন মিশ্রদের প্রশ্রয় দিয়ে সিস্টেম অস্বীকার করে যে অসততাও একরকম অদক্ষতা। একটা কাজের মূলধন, অন্যান্য রসদ যদি কাজের সাথে জড়িত কোনো বা কয়েকজন লোক সরিয়ে নিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে দুপয়সা করে আর আসল কাজ সময় মতো খাড়াও করে দেয়, তাতে আসল কাজের পরিমাণে দাগ না লাগলেও মানে তো দাগ লাগেই; তবু সততার ওপর দক্ষতাকে, কিংবা, শান্তিতে, গুছিয়ে কাজ করার দেখনদারির দক্ষতাকে, রেখে বার বার সিস্টেম অস্বীকার করে যে কায়েমী স্বার্থক্লিষ্ট কর্মীদের জন্য সিস্টেমের সার্বিক দক্ষতা কমে যায়। এই ধারণা তার মনে শিকড় গেড়েছে ইউনাইটেড ডেভেলপারসে চাকরি নেওয়ার পর। নুক এণ্ড ক্র্যানিতে যে সব কন্ট্রাক্টর-পলিটিশিয়ানদের সে নীতিনের মামা-কাকা-ভাই বলে চিনত, তাঁদের শালা-জামাই-ভগ্নীপতি-জারজ সন্তান-সবাই তার আপিসেই কাজ করে এখন। আর এদের মুখ দেখতে হবে না ভেবে খুব একটা ফুরফুরে আনন্দ হলো দেহলীর।




এতক্ষণে টম্যাটো সুপ আর স্যুইট বেবিকর্ণ ভাজা শেষ করে ফেলেছে সে। স্নায়ুতে অ্যালকোহলও দুষ্টুমি শুরু করেছে। হাতব্যাগ খুলে বার করে আনল সে লোরাজিনের দশটা পাতা। গতছমাস ধরে বোসকাকুর পুরোনো প্রেসক্রিপশন স্ক্যান করে, গিম্প দিয়ে এডিট করে এই মরণৌষধি ভাণ্ডার জড়ো করেছে দেহলী। প্রত্যেকটা পাতা কেনার পরে প্রেসক্রিপশনগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে সে, বোসকাকু বেশ সজ্জন লোক কিনা তাই। বোতলটা আধাআধি হলে মিশিয়ে দেবে এগুলো। তারপর আশা করা যায় অফিস-শাওন-সঙ্গীতা-বাবা - কোনো ঝঞ্ঝাট থাকবে না তার।
শাওনটা যে এরকম ফেরেববাজ হবে তা কী আর দেহলী বুঝেছিল আগে? না, বুঝেছিল যে বিয়ের পর দেহলীকে ধনে-মানে পর করে দিয়েও বাবা উথলে উঠবেন দেহলীর দুঃখে? হয়তো বুদ্ধিমানেরা বোঝে, সে বোঝে না। তবে বুদ্ধি-মান-ধন-প্রাণ সব প্রতিযোগিতা, সব দৌড়, সব সংগ্রামের বাইরে এসেও এগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাবটা সে যেন কাটিয়ে ওঠে নি।
ওষুধগুলো ঢালতে ঢালতে তার সন্দেহ হতে লাগল, ওগুলো যদি জাল হয়? তারপর নিজেই নিজেকে লেট মি হোপ ফর দ্য বেস্ট বলে হি হি করে হাসল খানিকটা। তাতেও তার সন্দেহ হলো হাসিটা নেশায় না রসবোধে।
চিলিচিকেনটা খেতে খেতে দেহলীর মনে পড়ল প্রথম প্রেম অনির্বাণ আর তার অনেক কমনের মধ্যে চিনে খাদ্য প্রীতিটাও ছিল। তারপর মনে হলো শেষ ডিনারে চিকেন ক্যাসেডিলা থাকলেও ভালো হতো। চিকেন ক্যাসেডিলা কিংবা সালসা মেক্সিকান হলেও অনির্বানেরও যে ভালো লাগতই সে ব্যাপারে দেহলী নিঃসন্দেহ। এবার হাসি পেল তার; সুখাদ্য কারই বা ভালো না লাগে? তবে হিপোক্রিট অনির্বাণ হয়তো তার এ ভালোলাগাটাও অস্বীকার করত দেহলীর কাছে। অনির্বাণ কেবলমাত্র নিজের বিয়ের সাতদিন আগে মাঝরাতে দেহলীর ঘুম ভাঙিয়ে একবার স্বীকারোক্তির চেষ্টা করেছিল; সেবারও মাঝপথে কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিল। এতোটা ভান অসহ্য লেগেছিল দেহলীর। তাই সে পরের দিন থেকেই অনির সাথে যাবতীয় যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল । তারপর কলকাতা শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল নয়ডাতে।
সেখানেই শাওনের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল দেহলীর, বাঙালি খুঁজতে খুঁজতে। সে যদিও মাছ খায় না, কিন্তু নির্বিচারে গরু-শুয়োর-বাইসন যা পায় তাই খায়। প্রচুর পড়ে, প্রচুর বেড়ায়, গুচ্ছ জ্ঞান দেয়, নাটক করে, ছবি আঁকে। একমাসের বেশি লাগে নি দেহলীর সাথে শাওনের প্রেম হতে। কিন্তু শাওনের মতো জ্ঞানী লোকের মাচিসমো দেখেও দেহলীর রাগ হতো। ট্যাক্সিভাড়া থেকে সিনেমার টিকিটের দাম সব কিছুতেই আগবাড়িয়ে শাওন পয়সা দিত। একদিন শাওনের সাথে খুব ঝগড়া করে দেহলী তাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে, শাওনের এই সব শিভ্যালরিতে আখেরে স্বাবলম্বী স্বেচ্ছাধীন দেহলী অপমানিত বোধ করত। সে শাওনকে শর্ত দিয়েছিল যে, এভাবে আমার সাথে বেরিয়ে সব খরচ আপনি করলে আমি আর আপনার সাথে বেরোব না। তারপর কয়েক সপ্তাহ শাওন আর দেহলীর সাথে দেখা করতে চায় নি, ফোনও করে নি। হঠাৎ করে শাওনের সাথে অরুণাংশুর বাড়িতে নিউ ইয়ারস ইভে তার দেখা হয়ে গিয়েছিল আবার। সে রাতে অবশ্য ট্যাক্সি ভাড়া দেহলীই দিয়েছিল। আবার সিগারেট কিনে শাওন দেহলীকেই দাম দিয়ে দিতে বলেছিল। তারপর আবার দুজনের ভাব হয়ে গিয়েছিল।
সে বছর জন্মদিনে বিনা অ্যালকোহলেই বেশ নেশা-নেশা হয়েছিল দেহলীর। তার আগের দিন শাওন তাকে প্রথম উপহারে জয় গোঁসাই দিয়েছিল। তারওপর উপহার পাওয়ার পরমুহূর্ত থেকে সে একলা ছিল, ট্যুরে, দূরে। শাওন জন্মদিনের প্রথম সেকেণ্ডে ফোন করেছিল তাকে। নেশা আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল। সেই নেশার ঝোঁকেই সেরাতে দেহলী শাওনকে বলে বসে, শাওনবাবু, আপনি আমাকে একটি ছানাও দিন, কোনো দায় থাকবে না আপনার। দেবেন? খুব হেসে শাওন বলেছিল, সে তো আপনার একার হবে না, আমারও হবে, অধিকারের জন্তুতে দায় তো থাকবেই। তবে কিনা কাল আপশোশ করবেন না তো আমি যদি ছানা দিতে রাজি হয়ে যাই? আপশোশ দেহলীর এখনও নেই। তবে শাওনের শর্ত ছিল একটাই, আমাকে বিয়ে করতে হবে কিন্তু, পারবেন?। সে রাতের সাড়ে ছমাস পরে শাওনের সাথে দেহলীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
বিয়ের দিন ঠিক হতে দেহলীর বাবা বলেছিলেন, তোমার মা থাকলে আজ আনন্দের চোটে সাংঘাতিক দৌড়োদৌড়ি করতেন। তুমি নিজে বর পছন্দ করেছ বলে কথা, তোমার স্বাধীনতায় তিনি স্বাধীন হতেন আরেকটু। আসলে দেহলী প্রথম চাকরি পাওয়ার পর মা ঢাকঢোল পিটিয়ে সাংঘাতিক কাণ্ড করেছিলেন। তখনও বাবা মাকে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে চাকরিটা তুমিই পেয়েছ! মায়ের কাছে দেহলীর চাকরির মানে ছিল স্বাধীনতা, মুক্তি, স্বেচ্ছাধীনতা মায়ের জীবনে মা যা কখনও পান নি। চাকুরে দেহলীর জীবনধারণের কোনো স্পনসর থাকবে না, দেহলী নিজেই নিজের পোষক, ফলে তাকে কারো জল উঁচুতে জল উঁচু বলতে হবে না এই ভেবেই মা আত্মহারা হয়েছিলেন। এ তাঁর দেখা দিনবদলের স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাওয়া। নিজে বর পছন্দ করে দেহলী সেই স্বেচ্ছাধীনতারই স্বাক্ষর রেখেছিল। মায়ের উচ্ছাসের প্রসঙ্গ তুলে বাবা তাঁর ইচ্ছা খর্ব হয়ে যাওয়ার ক্ষোভটাই জানিয়েছিলেন। সে হুলটা সেদিন বেঁধেনি দেহলীকে। প্রেমে টইটম্বুর সেই সময়ে সহিষ্ণুতার শিখরে ছিল সে।
সে বছর ভ্যালেন্টাইন্স ইভে শাওন এই হোটেলটাতেই নিয়ে এসেছিল দেহলীকে। শহরের বাইরে, নিরিবিলিতে দু-দিন কাটাবে বলে। সে রাতের চুমুটা দেহলীর প্রথম চুমু শুনে শাওনের চেহারা যা হয়েছিল ভেবে এখনও হাসি পাচ্ছে দেহলীর। শাওন অবশ্য চুমুর ব্যালান্সশিট মেলে দিয়েছিল কবে, কাকে ,কতোবার, কোথায়- নেহাতই কৌতুহল মেটাতে কোচিংবেলার এক পরিচিতা থেকে শুরু। তবে সে চুমুর সাথে প্রেমের কোনো নাকি যোগই ছিল না। পূর্ব প্রেমিকা বলতে একজনই - মংপুবাসিনী গুঞ্জা। টুয়েলভে পড়ার সময় এক্সকারশনে গিয়ে গুঞ্জার সাথে আলাপ হয়েছিল শাওনের। তারপর চিঠিপত্রে খুব আড়ষ্ট বন্ধুত্ব ছিল ওদের দুজনের শাওনের কলেজ জীবন অবধি।
কলেজে পড়ার সময় বন্ধুর বন্ধু সঙ্গীতাকে প্রেম নিবেদন করেছিল শাওন। সঙ্গীতা শাওনদের ব্যাচে ডিস্ট্রিক্ট টপার। শাওনের মতো একটা পাতি ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রের নিবেদন সোজাসুজি নাকচ করে দিয়েছিল সঙ্গীতা। সে বলেছিল নাকি, তোর মতো বন্ধু পেয়েই আমি খুশি। তোর আমার জীবনের লক্ষ্য আলাদা। আজ যদি ভালোলাগাটাকে প্রেম বলি, কালকে হয়তো সব তেতো হয়ে বন্ধুত্বটাই কেঁচে যাবে। তখন শাওন থার্ড ইয়ারে; ক্যাম্পাসিং-এ শাওন একটা বহুজাতিকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিও পেয়ে গিয়েছিল; আর সঙ্গীতা ঢুকেছিল লেডি ব্র্যাবোর্নে ফিজিক্স অনার্স পড়তে, তিনবার মেডিক্যাল এন্ট্রাস পাস করতে না পেরে বেছে নিয়েছিল নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিক হওয়ার পথ। শাওনের মতে তার একবছর পর থেকে দেশ-বিদেশ যাতায়াতে সঙ্গীতার ঝোঁক নাকি উপে গিয়েছিল তার। দেহলী প্রেম বলে না, ঝোঁকই বলে। কিন্তু তখন সঙ্গীতা সাক্ষাতে, ইমেলে, সর্বত্র থেকে থেকেই বায়না করে চলেছিল শাওন যদি প্রেমের কথাটা আরেকবার ভেবে দেখে।
শাওন আবার তখন একই সাথে প্রভাতী, শুকতারা আর অপূর্বা বলে জনাতিনেক মেয়ের সাথে মিশছিল মূলত ইমেল এবং চ্যাটে, যদিও এরা সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে তার আগেকার চেনা বান্ধবী। তার মধ্যে শুকতারা ছিল সঙ্গীতার স্কুলের বন্ধু। তো সঙ্গীতাই শুকতারার আগেকার বা সেই সময়ের অন্যান্য সম্পর্কগুলো নিয়ে শাওনকে সচেতন করে দিয়েছিল নাকি। শাওনের মতে শুকতারাকেও একইরকম কিছু বলে সঙ্গীতা শাওন-শুকতারার প্রেমটা পুরোপুরি হতেই দেয় নি। অন্য দুজন অবশ্য বয়সে একটু ছোটো ছিল শাওনদের থেকে। কিন্তু তারা সঙ্গীতার পাড়ার মেয়ে। তাদের প্রসঙ্গেও নানা ভয়ঙ্কর তথ্যের যোগান দিয়ে শাওনকে সঙ্গীতা নাকি মেয়ে দুজন সম্পর্কে বেশ সন্দিহান করে তুলেছিল। শাওনের আর প্রভাতী কিংবা অপূর্বাকে নিয়ে ভেবে দেখতে ইচ্ছে করে নি।
তারপর সঙ্গীতা যখন ইউনিভার্সিটিতে, তখন প্রশান্ত ওকে বলেছিল, তুই আমাকে বিয়ে না করলে আমি স্যুইসাইড করব। এরকম করে কালো, বেঁটে, মোটা দেখতে সঙ্গীতাকে কেউ বলে নি আর কখনোই। উলটে সঙ্গীতা পড়াশোনায় ভালো হলেও বাড়িতে সারাক্ষণ মা-বাবা রূপের খোঁটা দিতেন নাকি, ওর বিয়ে দিতে পারবেন না বলে।
এদিকে তখনও শাওনের জীবনে কোনো প্রেমিকা ছিল না। দেহলীর মনে হয় যে তখন বেচারি সঙ্গীতা বুঝে উঠতে পারছিল না প্রশান্তকে বাঁচাতে গেলে শাওনের প্রতি, সেই সঙ্গে তার নিজের প্রতিও, অবিচার করা হবে কিনা। প্রশান্তর কথা শুনে শাওন অবশ্য সঙ্গীতাকে বলেছিল, আমি আর তোর ব্যাপারে একইরকম ফিল করি না। তাবলে যে যা বলবে তোর সাথে প্রেম করার জন্য তুই সেটাই বিশ্বাস করিস না যেন......। ইতিমধ্যে শাওন কলকাতায় চাকরি নিয়ে চলে আসে। ফলে সঙ্গীতার সাথে যোগাযোগ নিয়মিত হয়ে যায়। কিন্তু শাওন সঙ্গীতাকে যখনই দেখা করতে বা আড্ডা দিতে ডাকত তখনই সঙ্গীতা প্রশান্তকে সঙ্গে নিয়ে যেত শাওনের কাছে। এতে নাকি শাওনের বেশ বিরক্ত লাগত। দেহলীর ধারণা শাওন যদি প্রশান্তকে দেখে হিংসে করেও সঙ্গীতার কাছে ফিরে আসতে চায়, সেই আশাতেই সঙ্গীতা ওরকম ব্যবস্থা নিত।
এইসময় গুঞ্জা কলকাতায় এসেছিল পড়াশোনা করতে। শাওনকে খুঁজে বার করেছিল সে। এবং প্রেম নিবেদন করেছিল। শাওন তো হাতে স্বর্গ পেয়েছিল। তাকে সেই প্রথম কোনো মেয়ে, তাও বহু বছর যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও মনে রেখেছিল, এবং তার প্রেম চেয়েছিল। ফলে শাওন গুঞ্জার সাথে নিয়মিত উইকএণ্ড কাটাতে শুরু করেছিল শরৎ বোস রোডের প্যানাসিয়া হোটেলে। খবর শুনে সঙ্গীতা কেঁদে ভাসিয়েছিল। কিন্তু প্রেমের বয়স মাসছয়েক হতে না হতেই গুঞ্জার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য বায়না শুরু হয়ে গিয়েছিল। নেপালি মাবাঙালি বাবার মেয়ে গুঞ্জাকে নিজের পিউরিটান বাড়িতে জায়গা করে দিতে শাওনকে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হতো। তখনই শাওন পিছিয়ে গিয়েছিল সম্পর্কটা থেকে; চাকরিসূত্রে পালিয়ে গিয়েছিল নয়ডা। যাওয়ার আগে সঙ্গীতার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সঙ্গীতা তখন সিওলে জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক সেমিনারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ওকে একটা স্যুট উপহার দিয়েছিল শাওন। ছলছল চোখে সঙ্গীতা শাওনকে বলেছিল, ফিরে এসে আমাকে আর এভাবে যখন-তখন পাবি না তুই। প্রশান্তর বাড়ি থেকে আমার সিওল যাওয়া নিয়ে অনেক বাধা আছে। খুব শিগগির ওঁরা চাইছেন আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে। শাওন তখন সঙ্গীতার স্তন ছুঁয়ে জিভ দিয়ে মেয়েটার গলা ছোঁওয়া একটা দীর্ঘ চুমু দিয়ে বলেছিল, সিদ্ধান্ত অনেক ভেবে নিতে হয়। আমি আর তোকে বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবি না বলে যেই তোকে বিয়ে করতে চাইবে তাকেই মেনে নিতে হবে এমন তো নয়। সঙ্গীতা সেই শেষবার বলেছিল, শাওন, তুই কি বন্ধু বলেও আমাকে বিয়ে করতে পারিস না? শাওন বলেছিল, না রে, পারি না।
তার পরের বছর সঙ্গীতা প্রশান্তকে বিয়ে করেছিল। তবে সঙ্গীতা প্রশান্তর কাছে শাওনের ব্যাপারে কিছুই লুকোয় নি নাকি। এসব শুনে দেহলী খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাকে এতো কথা বলছেন কেন? আমাকে বিয়ে করতে চাইলেন যে, আমি তো শুধু আপনার জিন চেয়েছি? শাওন বলেছিল, আমার বয়স তিরিশ হয়ে গেছে, আর কবে বিয়ে করব?
সেই প্রথম দেহলীর মনে কাঁটা বেঁধে, তাহলে তার প্রেম নয়, এ সম্পর্কের কারণ শাওনের বয়স। কিন্তু সে সময়টা এমন ছিল যে কোনো কাঁটাই ব্যাথা দিত না। প্রেমের নেশায় চুর দেহলী সুগন্ধী, সুস্বাদু একটা পৃথিবীর আকাশে উড়ে বেড়াত শাওনের সাথে; কখনও একটা ভীষণ অস্থির সমুদ্রে একটা দারুণ রঙিন ভেলায় ভেসে বেড়াত।




দেহলীর সাথে বিয়ের কথা পাকা হওয়ার পরেই শাওন আবার কলকাতায় বদলি হয়ে গিয়েছিল। সাতদিনের ছুটি নিয়ে দেহলীও কলকাতা গিয়েছিল তার পিছু পিছু। বিয়ের বাজার করাটা ছিল ছুতো। কিন্তু ছুতোর ব্যস্ততায় আপাদমস্তক ডুবে গিয়েও বাধা পড়েনি প্রেমে। তখন শাওন সল্টলেকে ঘর ভাড়া নিয়েছিল। ওখানে তখন রাস্তায় রাস্তায় পলাশ, শিমূল, ফুটে থাকত। দেহলীর বহু অপেক্ষিত প্রথম সঙ্গমের রাতে সারাদুপুর সে একটা ঝুড়ি ভর্তি করে পলাশ আর শিমূল জড়ো করেছিল। শাওনের ফ্ল্যাট সাজিয়েছিল সেই ফুলে আর মোমের নরম আলোয়, চৌরাশিয়ার বাগ্রেশ্রীতে মথিত করে দিয়েছিল সে রাত। দুজনে জেগেছিল ভোর অবধি। গল্প করতে করতে সেই রাতে বারবার ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাদের। সব ফ্যান্টাসিকে তারা দুজনে ফ্যাক্ট করে নিয়েছিল অভিনব আঙ্গিকের বিভিন্ন জীবন্ত ভাস্কর্য তৈরি করে। ভাবলে এখনও ভালোলাগায় শিউরে ওঠে দেহলী। শাওন বায়না করেছিল ফুলশয্যায় অমন করেই সাজাতে হবে ঘর। হেসে আকুল হয়েছিল দেহলী; রহস্য করে বলেছিল, তখন অন্য ফুল থাকবে
বাড়ি ফিরেই রণ্টুদাকে ডেকে পাঁচহাজার টাকা দিয়ে বলেছিল, যেখানে যত বকুল গাছ আছে সেখান থেকে ফুল পাড়িয়ে লম্বা মালা গেঁথে দিও ফুলশয্যার খাট সাজানোর জন্য। ব্যবসা জীবনে এমন একটা অভিনব বায়নায় কথা খুইয়েছিল রন্টুদা। সেই সুযোগে দেহলী জুড়ে দিয়েছিল, আর হ্যাঁ, টাটকা চাঁপা ফুলও রেখো কয়েকঝুড়ি। তারপর প্রাণের বন্ধু শুক্লাকে ডেকে বলে দিয়েছিল রণ্টুদার থেকে ফুল নিয়ে ফুলশয্যার দিন দুপুর দুপুর দেহলীর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ঘর সাজিয়ে দেওয়ার জন্য, যাতে শ্বশুরবাড়ির লোক দেহলীর শোবার ঘর সাজানোর সু্যোগই না পায়। চাঁপা-বকুলের গন্ধে-রূপে শাওন সে রাতে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। দেহলী এতো কিছুর পরেও বিশ্বাস করে যে সে সব রাতে কোনো ভান ছিল না।
তারপর দেহলীরা দুজনে দুটো শহরে কয়েকমাস কাটিয়ে দিয়েছিল। শাওন যখন টোকিওতে প্রজেক্ট পেল, তখন দেহলী চাকরি-বাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল শাওনের সাথে। বড় ভালো কেটেছিল সেসব দিন। প্রেমের প্রথম নেশা কেটে গিয়ে তখন ছিল মনোভূমে ইমারত গড়ার সময়। প্রচুর বেড়িয়েছিল তখন দুজনে, অপূর্ব অশরীরী বন্ধুতায়। সে সময় ওখানে সঙ্গীতাও গিয়েছিল বরকে নিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ টোকিওর মেডিসিন স্কুলে কিছুদিন গবেষণা করতে। ওরা দেখা করতে চেয়েছিল দেহলীদের সাথে। দেহলী রাজি ছিল না শাওন আর সঙ্গীতার মধ্যে থেকে একটা জটিল নাটকের চরিত্র হয়ে যেতে। কিন্তু শাওন এড়াতে পারে নি, বলেছিল, ক্রিসমাসে আমরা এখানকার ডিজনিল্যাণ্ড দেখতে যাব। তোরা যদি যেতে চাস তাহলে আসিস
এসেছিল সঙ্গীতারা। খুবই মিষ্টি ব্যবহার করেছিল তারা। ডিজনিল্যাণ্ডে ঘোরার সময় সঙ্গীতা শাওনের গায়ে লেপ্টেছিল; দুজনে বিভোর হয়েছিল ছোটোবেলায় পড়া খেরোর খাতা কিংবা ছোটো আনন্দমেলার গল্পে; আবার কখনও পরস্পরের আঙুল ছুঁয়ে চোখে চোখ রেখে স্পর্শটাকে অনুভব করে কেঁপে উঠছিল। পুরো অ্যালবামে এমন কোনো ছবি নেই যাতে সঙ্গীতা শাওনকে ছাড়া পোজ দিয়েছে; যেটাই দিয়েছে সেটা শাওনের তোলা। একবার প্রশান্তকে শাওন ছবি তুলতে বলে একহাতে দেহলীর কোমড় জড়িয়ে দাঁড়ায়, অমনি সঙ্গীতা এসে শাওনের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল; শাওনও অন্য হাতটা দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছিল। এইসব অনভিপ্রেত ঘটনার সাক্ষী হয়ে দেহলী পড়েছিল ভীষণ অস্বস্তিতে। তার কেবল মনে হতে থাকে যে শাওন কিংবা সঙ্গীতা বিয়েটা বইতে পারে না; বিয়ের কমিটমেন্টের দিকটা হয় বোঝে না, নয় মানে না, কিন্তু মানে না যে সে কথা নিজেরদের কাছে স্বীকার করার সাহসও ওদের নেই। নেই ওপেন রিলেশনশিপের ঝড়ঝাপটা নেওয়ার মতো মনের জোর; লোকভয়ও আছে খুব, দুজনেরই। তাই প্রেম-প্রেম খেলার বয়স পেরোতেই দুজনে বিয়ের আশ্রয়ে ঢুকে পড়েছে, কিন্তু নির্দায় উপরি প্রেমের সু্যোগ ছাড়ে না, কখনোই। সে ভীষণভাবে অনুভব করেছিল তখন যে শাওন আর সঙ্গীতা বিয়ের আশ্রয় নিয়ে ফেলেছে বলেই দুজনেরই পরস্পরের কাছে লুকোচুরি খেলার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। নির্দায় প্রেমের আনন্দে তারা মজে ছিল এতই যে তাদের লীলার মধ্যে দেহলীর উপস্থিতিটা শাওন খেয়ালই করতে পারে নি।
জাপান থেকে ফিরে, দেহলী আবার কাজ নিয়ে চলে আসে নয়ডা। শাওনকে প্রজেক্ট নিয়ে নর্থ ক্যারোলিনা যেতে হয়। দেহলী কিছুতেই ভিসা করাতে যায় নি। ওখানে গিয়ে শাওন কয়েকমাস পর থেকেই পীড়াপিড়ি করতে থাকে দেহলীকে শাওনের কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু দেহলীর একলা একলা বিয়েটা বওয়ার ইচ্ছে মরে গিয়েছিল।
সে সময়ে সঙ্গীতাও পোস্টডক করতে ওরেগন পৌঁছায়। পৌঁছে শাওনের কাছে বায়না করে শাওন যেন ওকে ওখানে সেটল হতে সাহায্য করে কেননা ওদেশে ও একমাত্র শাওনকেই চিনত যার ইউএস ড্রাইভারস লাইসেন্স আছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা খুবই অল্প সে দেশে। নতুন বাড়ি ঘরে জরুরি ঝাড়ুবালতি কিনে আনার জন্যও একটা গাড়ি লাগে। আর লাগে গাড়ি চালিয়ে দোকানে নিয়ে যাওয়ার লোক। দুটো কাজ সারতেই ড্রাইভিং লাইলেন্স, ক্ষেত্রবিশেষে ইউএস ড্রাইভারস লাইসেন্স থাকাটা জরুরি। ওরেগনে সঙ্গীতার কোনো বন্ধু ছিল না। পুরো ইউএস-এতে শুধু শাওনকেই ও চিনত এবং অনেক দিন আগে থেকেই চিনত। তাই শুধু অবলাকে নয়, পুরোন বন্ধুকেও সাহায্য করতে গিয়েছিল শাওন। তারপর কিছুকাল পরে প্রশান্ত হাজির হয় সঙ্গীতার ওখানে। শাওন তখন নর্থ ক্যারলিনা ছেড়ে শিকাগোতে। এই সময় বারকয়েক একা সঙ্গীতা শিকাগো গিয়েছিল, কখনও সেমিনারে, কখনও চাকরি খুঁজতে। প্রত্যেক বারই উঠেছিল শাওনের কাছে। শাওনের মতে, ছাত্ররা খরচ বাঁচাতে ইউএস-এতে প্রথম প্রথম বন্ধুদের কাছে উঠেই থাকে।  কিন্তু দেহলী কখনোই শাওনকে বোঝাতে পারেনি যে সব বন্ধু আর পুরোন প্রেমিকা এক নয়, এবং একটামাত্র চুমুতেই বন্ধুত্ব থেকে প্রেম আলাদা হয়ে যায়।
তার কিছুদিন পরে শাওন ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে দেহলীকে জানিয়েছিল, তুমি না এলে আমি শেষ হয়ে যাব। সঙ্গীতা খুব কম্পলিকেশন তৈরি করেছে। ও প্রেগন্যান্ট। আমাকে বলছে দায়িত্ব না নিলে ও আইনী ব্যবস্থা নেবে। এবং এরকম একটা দাবীর কোনো কারণ নেই। ওকে কদিন থাকতে দিয়েছিলাম বলে...। দেহলী তারপর থেকে শাওনের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে নি আর, যেহেতু সত্যি কী জানে কেবলমাত্র বাদী ও বিবাদী। দুটো অবিমৃষ্যকারির জন্য দেহলীর কোনো সমবেদনাও ছিল না। সেই সঙ্গে উথলে ওঠে তার যত চেপে রাখা অভিমান।
বিবাহিত পাঁচ বছরের তিন বছর দেহলী ছিল শাওনের সাথে। অনুনয়-বিনয়েও শাওন রাজি হয় নি তখন দেহলীকে বাচ্চা দিতে। শাওনের মনে হতো সে নাকি অর্থনৈতিকভাবে পিতৃত্ব নিতে  সক্ষম হলেও সময় নেই তার বাবা হওয়ার। বাচ্চার প্রসঙ্গ উঠলেই তাদের সংসারে সাংঘাতিক অশান্তি হতো। অশান্তি হতো তাদের অযৌন দাম্পত্যে দেহলী যৌনতা চাইলেও। সব মিলিয়ে দেহলীর অনেকবার মনে হয়েছে যে তার নিজের ওপরও শাওনের ঝোঁক কেটে গেছে। তবুও দেহলী সইয়ে নিয়েছিল সে জীবন, ইন্টারনেট আর কেবল টিভির দোহাই পেড়ে। কিন্তু সঙ্গীতার সাথে শাওনের সম্পর্কের জটিলতায় তিক্ত বিরক্ত হতাশ দেহলীর যেন খানিক সত্যদর্শন কিংবা চরম-পাঠ-লাভ হলো। এই দ্বন্দ, অস্থিরতার শেষ বলে সে মৃত্যু খুঁজে পেল।




বাথরুমে বসে সে টের পেল যে নেশাটা কেটে গেছে একদম। বিছানায় বসে দেখল রাত দেড়টা। গ্লাসে ডায়েট কোক নিয়ে তাতে লোরাজিন গোলা রাম ঢেলে দেখল সব বরফ গলে গেছে। খানিকটা বরফ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে নি বলে বেশ আপশোশ হলো। এসির টেম্পেরেচার আরও একটু কমিয়ে দিল। তারপর নিজের শান্তি কামনা করে চুমুক দিল গ্লাসে।
অমনি দেহলীর দরজায় টোকা পড়তে লাগল এলোপাথাড়ি। টোকা না বলে মুষ্ট্যাঘাত বলাই ভালো। প্রথমে হেসে ফেলল এতো শিগগির যমদূত এসে গেছে ভেবে। কিন্তু তারপর উঠে দরজাটা খুলে দেখল পুলিশ। খুব বিরক্ত হলো দেহলী। কেউ জানে না যে সে তার জীবনের শেষ বেআইনি করছে সব আইনের উর্দ্ধে যাবে বলে, সে খবর পুলিশে পেল কী করে? হোটেল ম্যানেজার গদগদ গলায় জানাল, বহুত বার বোলে সাবকো আপ আকেলে ঠেহরে ইহাঁ। লেকিন সাব ফিরভি খুদ দেখনে কী জিদ কী। দেহলী খুব হতাশ ক্লান্ত গলায় বলল, দেখ লিজিয়ে। পুলিশ নাম, ধাম, সব জেনে খুব অবাক হলেন ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে মানাতে ম্যাডাম আকেলী ঠেহরি হৈঁ দেখে। বার বার বিস্মিত হলেন উৎসবের দিনে ম্যাডাম আকেলী দারু পি রহি হৈঁ দেখে। দারুর কথা এতোবার বললেন তিনি যে দেহলীর একটু সন্দেহ হলো। সে জানতে চাইল, আপকো পিনা হৈঁ? হেঁ-হেঁ করে হাসলেন শান্তিরক্ষক।
দেহলী একদম ভাবেনি আজ টাকা পয়সার দরকার হবে। সকালে বেরিয়ে যাওয়ার অজুহাতে সে হোটেলের যাবতীয় বিল রাতেই মিটিয়ে দিয়েছিল। হাত ব্যাগ ঝাঁকিয়ে দুশ টাকা পেল সে। সেটা পকেটে ভরে সান্ত্রীমশাই বিনয়ে অধোবদন হয়ে জানালেন যে ঐ পয়সায় ব্র্যাণ্ডেড দারু হয় না। দেহলী ওর ব্যাগটাই লোকটার হাতে দিতে যাচ্ছিল যাতে সে নিজে ব্যাগ হাতড়ে দেখে নিতে পারে কানাকড়ি কিছুই নেই তাতে। কিন্তু সে সময়ে সান্ত্রী আবার বললেন যে একা একা অত মদ খেলে দেহলীর নাজুক শরীর খারাপ হবে। দেহলীর কাছে একথার সোজা মানে দাঁড়াল যে বাকার্ডির বাকি বোতলটা উনি নিয়ে যেতে চান। তিনি চাইলেন মানে দেহলীর আর কোনো উপায় রইল না না-দিয়ে। বোতলটা হাতে নিয়ে দেহলীর খুব টেনশন হতে লাগল যদি কাল এই লোকটা মরে যায় বা যবে ওর সাথে যারা বসবে এই বোতলটা নিয়ে তাদের সাথে অস্বাভাবিক কিছু হয়? নিজে মরা এক, কিন্তু না মরলে পুলিশে ধরবে। পুলিশে ছোঁবে! ভাবতেই গা-টা গুলিয়ে উঠল তার। খুব কায়দায় ভান করে নেশায় টলে টলে একটা ওয়াক সামলাবার ঝোঁকে যেন বোতলটা পুলিশের হাতে তুলে দিতে গিয়ে মেঝেতে দড়াম করে আছড়ে পড়ে সেটা ভেঙে গেল। বোতলটা এভাবে ভেঙে সে বেশ নিশ্চিন্ত হলো। আর হতাশ পুলিশ ম্যাডামকে বার বার করে সাবধান করে দিয়ে চলে গেল।
ঘুম ভাঙতে দেহলী বুঝল কুয়াশা কেটে গনগনে রোদ উঠেছে। জানলার পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিতেই সূর্যটা তার মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনের মধ্যে তার গুনগুনিয়ে উঠল যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তৎ তে পশ্যামি। / যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি।। তারপর নিজেই হেসে ফেলে বলে উঠল শালা! আমিও পলিটিশিয়ান!

সেলফোনটা অন করতেই শাশুড়ীমার ফোন এলো; বললেন, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে। বাবু কথা বলবে, ধরো। বাবু মানে শাওন বলল, ওদেশটাতে ট্র্যাফিক পুলিশ ঘুষ খায় না। সেটা মানুষের ভগবানে ভক্তি এখনও অটুট বলে নাকি স্ট্যাণ্ডার্ড অফ লিভিং খুব হাই বলে জানি না। নাকি আমাদের মতো দেশিদের ক্ষমতাই নেই ওদেশে ঘুষোবার তাই আমাদের কাছে ওরা সৎ - তাও জানি না। শুধু বুঝি ওদেশে ঘুষের কারবার আমি টের পাই না বলেই আমি সব ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি আসতে পেরেছি। সঙ্গীতা পুলিশ বা কোর্ট কিংবা ডিএনএ কালচার ল্যাব কোথাও ঘুষ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেনি। এ নিয়ে অনেক কথা আছে; সে সবের তোড়ে ভুলে যাওয়ার আগে বলে দি, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে, সোনা

Thursday, October 9, 2014

বুনো পশ্চিমী মরুপথে এক রাত

[লস এঞ্জলসে ফিরে এসে থেকে স্মৃতির তাড়া করছে। তাই একটা বছর চারেকের পুরোনো বেড়ানোর কথা বলতে ইচ্ছে হলো। এই লেখাটা প্রায় বছর দুয়েক আগে "হাওয়া বদল"-এ ছাপা হয়েছিল।]
(এখানের লেখাটা সেটাই যা আমি জমা দিয়েছিলাম। যা ছাপা হয়েছিল তার লিঙ্ক নিচে দেওয়া রইল।)

লস এঞ্জেলসে থাকার সময় থ্যাঙ্কস গিভিং ডের ছুটিতে আমরা গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন আর লাস ভেগাসে বেড়াতে গিয়ে ছিলাম। আমরা মানে চারজন - আমাদের বন্ধু রবি আর ওঁর স্ত্রী খুশি, আমার বর পার্থ আর আমি। ইউনাইটেড স্টেটসে নভেম্বরের চতুর্থ বিষ্যুদবারে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদ্‌যাপিত হয়। ছুটি থাকে বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার। বুধবার রাতে রবি আর খুশি পিটসবার্গ থেকে লস এঞ্জেলস এসে পৌঁছে ছিল। অরেঞ্জ কাউন্টি এয়ারপোর্ট থেকে ওদের নিয়ে আমরা রওয়ানা হয়ে ছিলাম অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কের দিকেমোট দূরত্ব পাঁচশ মাইলেরও বেশি, ন-দশ ঘণ্টার পথ।  তাই জিপিএস-এর সেটিংস এমন করে রেখে ছিলাম যাতে সব থেকে কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। এই জিপিএসকে আমরা আদর করে নুভি মাসি বলে ডাকি। আমাদের অস্থাণ-কুস্থাণে হারিয়ে যাওয়ার মদতদাতা হলো মাসি। যেখানেই যাই না কেন, মাসিকে যদি একবার জানাই বাড়ি ফিরে যেতে চাই, মাসি ঠিক বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এই বাৎসল্যের জন্যেই আমরা বোধ হয় খুব সহজে নুভিকে মায়ের আরেক বোন, আমাদের আরেক মাসি বলে ভেবে নিয়েছি।
পথশ্রমে ক্লান্ত ছিল রবি আর খুশিতাই প্রথম রাতটা ওরা পিছনের সিটে ঘুমোচ্ছিল। গাড়ি চালাচ্ছিল পার্থ আর হেল্পারিতে ছিলাম আমি। মনে একটা চাপা টেনশন ছিল। রাতবিরেতে এতোটা পথ যাব বলে, নাকি রোমহর্ষক মোহাবে ডেজার্টের দক্ষিণপ্রান্ত ছুঁয়ে অনেকগুলো মাইল পেরোতে হবে বলে, সে আমি জানি না। লং উইকএন্ডের শুরু বলে হাইওয়েতে গাড়ির ভিড় ছিল। গতিসীমার থেকে অনেক কম বেগে গাড়ি চলছিল। শহর থেকে কিছু দূরে চলে আসার পর প্রতিপদের কাক জ্যোৎস্নায় চারপাশে জেগে উঠে ছিল পাহাড়, ছাইরঙা উপত্যকায় স্থবির উইন্ডমিলের আবছায়া। পাহাড়ের মাথায় চাঁদের আলো, নাকি বরফ পড়ে গেছে তা বুঝতে পারছিলাম না। বরফ পড়তেই পারে, একে নভেম্বরের শেষ, তায় জায়গাটা সমুদ্র থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে আর দূরেও। সামনে টিমটিমানো লাল আলোর স্রোত পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে থাকা গাড়ির মিছিলের নিশান। মাঝে মাঝে ডানদিকের পাহাড় সরে গেলে, দেখা যাচ্ছে আমাদের যাত্রাপথের বিপরীতে চলমান গাড়ির মিছিল। তাদের নিশান তাদের উজ্বল আলোয়। মিউজিক সিস্টেমের গান ছাপিয়ে যাচ্ছিল গাড়ি চলার একঘেয়ে আওয়াজেসে সব ফালাফালা করে একসময় নুভি মাসি হুকুম করেছিল, টার্ন রাইট। তখন এয়ারপোর্ট ছাড়ার পর দেড়ঘন্টা পেরিয়ে গেছিল, অথচ দূরত্ব পেরিয়েছিলাম মাত্র পঁচাশি মাইল! হাইওয়ের গতিসীমায় আমাদের আরো চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল যাওয়ার কথা।
ডানদিকের রাস্তা নিতেই মাসি বলেছিল, ড্রাইভ ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড থার্টি ফাইভ মাইলস্‌।  ভিড় ঠেলে আসার ক্লান্তি কাটাতে পার্থর একটু ফ্রেশ হওয়ার দরকার ছিল তখন। কিন্তু কোনো চায়ের দোকান থুড়ি কফিশপ ছিল না আশেপাশে। অগত্যা একটু জল খেয়ে, একটা সিগারেট টেনে, মুখে বাবল গাম ফেলে ফের গাড়ি চালাচ্ছিল ও
ঘন্টাখানেক পরে টুয়েন্টি নাইন পামস নামে একটা জনপদে পৌঁছে একটা চব্বিশঘন্টা খোলা গ্যাস স্টেশন মানে পেট্রল পাম্প পাওয়া গেছিলসেখানে জল আর বাবল গামের রেশনটাকে বাড়িয়ে নেওয়া গেছিলআবার কতোক্ষণে জল পাওয়া যাবে জানতাম না।
ফ্রেস্কো
এদিকে রাস্তার পাশের বাকি সব দোকানে তখন লোহার গরাদ টানা। তাতে সন্দেহ হচ্ছিল যে সামনে জনপদ থাকলেও দোকান খোলা পাওয়া যাবে কিনা। টুয়েন্টি নাইন পামসের দেওয়ালে দেওয়ালে আলো আবছায়ায় জমজমাট সব ফ্রেস্কো গল্প বলে ছিল
। আর ছিল  দুহাত তুলে নামসংকীর্তনের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে জোশুয়া গাছেদের আবছায়াগুলো। পিঠে বোঝা নিয়ে ধূ ধূ রাস্তা পেরিয়েছিল একজন হোবো। তার হাতে ছিল একটা কাগজের মোড়ক, হয়তো খাবারের, আর কাগজের কাপ, নিশ্চয়ই কফির। 
অন্ধকারে জোশুয়া

কারণ মাঝরাতের মরুভূমি থেকে ছুটে আসা হাওয়ায় নাক-চোখ বেশ জ্বালা করছিল, হাড়েও কনকনানি লাগছিল  হুশ করে ফুরিয়ে গেছিল টুয়েন্টি নাইন পামসের মরুদ্যানটা গাড়ির আলোতে শুধু রাস্তাটুকুই দেখা যাচ্ছিল। সামনের অন্ধকারের ঘনত্বে টের পাওয়া যাচ্ছিল ধারাবাহিক চড়াই-উৎরাই। যখন হেডলাইটের পর অন্ধকারের খাড়া দেওয়াল, তখন চড়াই। আর হেডলাইটের আলো অন্ধকার থেকে গড়িয়ে নিচে নামছে যখন, তখন উৎরাই। এরকম একটা চড়াইয়ের মাথায় উঠতেই মাসি হুকুম করে ছিল, টার্ন লেফ্‌টমাসি না থাকলে  আমরা বাঁদিকের এই বাঁকটা ঠাহরই করতে পারতাম না অন্ধকারে।

আরও ঘন্টাখানেক চড়াই-উৎরাই ভাঙার পর, এক চৌমাথাতে পৌঁছে মাসি বলে ছিল ডাইনে যেতে। সেই ঘণ্টাখানেকে আমাদের আগে পিছে কোনো গাড়ি ছিল না; রাস্তাটা ওয়ান ওয়ে ছিল না, তবুও উল্টোদিক থেকে কোনো গাড়ি আসে নি। এই বিরল জনশূণ্যতায় ঘাবড়ে গিয়ে আমরা তখন মাসির বোধ-বুদ্ধি নিয়ে ট্যারা-ব্যাঁকা মন্তব্য করতে শুরু করে ছিলাম। তারপর মাসির মগজে খুটখাট করে সেটিংস বদলে দিয়েছিলাম যাতে কেবলমাত্র হাইওয়ে দিয়েই যাওয়া যায়তারপর গাড়িটাকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চেষ্টা করেছিলাম যদি মাসি জনবহুল রাজপথের খোঁজ দেয়। আগে এসব কায়দা আমাদের কাজে এসে ছিল, তাই আর-কি। কিন্তু মাসির তখন ঠোঁটে বোধ হয় ছ্যাঁকা লেগে ছিল, ঠাণ্ডায়, ফলে এক দীর্ঘ স্পিকটি নট্‌। দীর্ঘ পথের নিরিখে সময়াভাব আর বিদেশ-বিভুঁই-এ অচেনা অজানার গা ছমছমানো অনুভূতি - এই দুটো কারণই যথেষ্ট ছিল আমাদের সীমিত ধৈর্যকে আরও ছোটো করে দিতেমিনিট দশেক ধরে শঙ্কাকুল চেষ্টা করে হাইওয়ে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে, ডানদিকে আমাদের বাঁকতেই হয়েছিল। আর বাঁকতেই মাসি কটকটিয়ে উঠে ছিল, ড্রাইভ টু হান্ড্রেড মাইলস্‌। দুশ মাইল মানে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার পথ এমনিতে, কিন্তু অন্ধকার আর হাওয়ায় কতো সময় লাগবে তা বেশ অনিশ্চিত ছিল। 
সে পথে ঘণ্টাখানেক কাটার পরেও মনে হচ্ছিল যে যতো জোরেই ছুটুক, গাড়িটা যেন এগোচ্ছে না; হেডলাইটের সীমানার ভেতর একচিলতে রাস্তা; আর বাকি সবটাই নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার, দিগন্ত উধাও, চারপাশে শুধুই  আকাশ। গাড়িটা থেকে থেকে হাওয়ায় দুল ছিল। তাতে আরও মনে হচ্ছিল যেন আমরা আকাশে ভেসে চলেছি। সেই ঘোর কাটিয়ে দিয়ে ছিল ডেজার্ট জ্যাকাল। গাড়ির আলোর শেষ সীমা দিয়ে বুরুশের মতো লেজ দুলিয়ে দৌড়ে গেছিল রাস্তার একদিক থেকে আরেক দিকেঅমনি আকাশটা তারা-টারা সমেত উঁচুতে উঠে গেছিল, তখন গাড়ির চারপাশে পড়ে ছিল আদিগন্ত নির্জলা সমুদ্র, বুকে তার ছড়ানো ছিটোনো বোল্ডার। সেই সমুদ্রের ঢেউ দেখে কখনও মনে হচ্ছিল নুনের ঢিবি, কখনও চলমান বোল্ডারের সারি। পার্থর খুব ইচ্ছে করছিল গাড়ি থামিয়ে একবার পরখ করে যে সে পৃথিবীতে আছে নাকি গ্রহান্তরে। কিন্তু প্রত্যেক মাইলেই সতর্কবার্তা ছিল, সফট শোল্ডার, মানে রাস্তার পাশের ফাঁকা জায়গায় গাড়ি বা পা রাখলে  মাটির নিচে সেঁদিয়ে যেতে পারে! আরও ছিল, উড়ন্ত বোল্ডার থেকে সাবধানকড়াং, ঠনঠন আওয়াজে বোঝা যাচ্ছিল যে প্রচুর মুরাম উড়ে গাড়িতে আছড়ে পড়ছিল। আরও দুএকটা ডেজার্ট জ্যাকাল রাস্তা পেরিয়ে ছিল বলে নাকি আমাদের উল্টোপথে দুটো গাড়ি গেছিল বলে, জানি না, আমাদের সাহস কিছুটা বেড়ে ছিল তারপরতাই একটুক্ষণ ফাঁকা রাস্তার ওপরই গাড়ি থামিয়ে, কাছ থেকে ডেজার্ট জ্যাকাল দেখার চেষ্টা করে ছিল পার্থ। কিন্তু কয়েক মিনিটের অপেক্ষায় ব্যর্থ হয়ে শোল্ডার থেকে এক মুঠো বালিরঙা মুরাম তুলে এনে টিস্যু পেপারে মুড়ে নিয়ে ছিল সে
সেই রুদ্ধশ্বাস যাত্রাপথের শোঁ-শোঁ হাওয়ার শব্দ হঠাৎ ফালাফালা করে দিয়ে ছিল একটা হুইশল। টের পেয়ে ছিলাম রেললাইনের অস্তিত্ব। মনে বেজে ছিল গুড-ব্যাড-আগলির আবহ। সে সময়েই দেখে ছিলাম একটা রেস্ট এরিয়ার পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে গর্জাচ্ছিল একটা ট্রাক। ড্রাইভারের সাড়া ছিল না। হয়তো ড্রাইভার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে রেস্ট এরিয়ার টয়লেটে গেছিলপার্থ রেস্ট এরিয়ার টয়লেট ঘুরে এসে জানিয়ে ছিল যে সেটাও শুনশান। রবি আর খুশি তখন পুরোপুরি জাগন্ত। আমার চারজন আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে নির্জন মরুভূমিতে কৃষ্ণপক্ষের দুপুর রাতে নিখোঁজ ড্রাইভারকে নিয়ে চারটে হাড়-হিম করা গল্প ফাঁদছিলাম মনে মনে। সেই নিশুতিপনা ঘুচিয়ে বরযাত্রীর মতো আলো ঝলমলানো রেলগাড়ি ঝমঝমিয়ে চলে গেছিল আমাদের সামনে দিয়ে। আদিগন্ত বিস্তীর্ণ মরুভূমির সাথে আকাশের মেশামিশিতে তৈরি এক ত্রিমাত্রিক পর্দায় দেখেছিলাম ওয়েস্টার্ন ভিস্যুয়াল আর্ট!
এক চিলতে গাড়ির হেডলাইট দিয়েছিল আর দূরে রেলগাড়ি


তারপরে হাইওয়ে মিলে ছিল। ততোক্ষণে আরও তিনটে গাড়ি আমাদের ফেলে আসা পথের দিকে চলে গেছিলভোর হয়ে ছিল নিডলস্নামের এক জনপদেবার্গার আর হট চকোলেট খেতে খেতে শুনে ছিলাম সামনেও মরুপথ। সে পথের অন্য গল্প।


(এই হলো যা ছাপা হয়েছিল)

Readers Loved