কবিতা বুল্টুকে নিয়ে খাতাবই কিনতে বেরিয়েছে। সন্তোষ পুস্তকালয় ছাড়া কোথাও বুল্টুর বুকলিস্টের সব বই পাওয়া যাবে না চন্দনগরে। দিলীপ কলেজ স্ট্রীট থেকে এনে দিলে সব বই পাওয়াও যায়, সস্তাও পড়ে। কিন্তু তাতে ছেলেকে এক সপ্তাহ বই ছাড়া স্কুলে যেতে হবে; এদিকে পড়াও এগিয়ে যাবে, ছেলে পিছিয়ে পড়বে। এ তো আর কবিতাদের কাল নয় যে ছেলেমেয়েরা অন্যের বই টুকে নিয়ে পড়বে।
অবশ্য কবিতার বা দিলীপের সময়ের সাথে বুল্টুর শৈশবের অনেক ফারাক। বুল্টুর শৈশবে অনাহার নেই, অর্ধাহার নেই, কেরোসিন তেলের জন্য লাইন দেওয়া নেই, একটা লম্পর চারপাশে গোল হয়ে বসে পাঁচ বা আট ভাইবোনের বা তুতো ভাইবোনেদের সাথে গুনগুনিয়ে পড়া নেই। বাবা স্কুলের মাইনে ভরতে না পারায় ডিফল্টার হয়ে রেজাল্টের দিন হাতে মার্কশিট না পাওয়াও নেই। বরং বুল্টুদের পেছনে খাবার নিয়ে দৌড়তে হয়, আর ভালোমন্দ পাতে জোগাতে না পারলে বায়নায় অস্থির হয়ে যেতে হয় মা-বাবাকে। পাওয়ার কাটের সময় ইনভার্টারের ব্যবস্থা না করে দিলেও, বুল্টুদের মা-বাবারা পাড়ার বেকার ছেলের থেকে জেনারেটরের কানেকশন নিশ্চয়ই নেন। আর ভাইবোন তো থাকেই না, থাকলে একটা বা তুতো।
কবিতা আর দিলীপেরও দুই ছেলেমেয়ে। মামণি আর বুল্টু। সন্তোষ পুস্তকালয়ে লোডশেডিং চলছে। যদিও সন্ধে হয়ে এসেছে, কিন্তু এখনও জেনারেটর চালানোর সময় শুরু হয় নি। মোমবাতি, ব্যাটারিতে জ্বলা টর্চ আর ব্যাটারির হ্যারিকেনের আলোয় বইপত্র খুঁজতে সময় লাগছে। কবিতার দুঃশ্চিন্তা হতে লাগল। কাল থেকে মামণির পার্ট ওয়ান পরীক্ষা শুরু।
রিক্সার মাথায় চোঙা লাগিয়ে কিছু একটা বলতে বলতে আসছে। কে জানে হয়তো নচিকেতার ফাংশন আছে। সন্তোষের বই গোছানো হয়ে গেছে। দুটো বই নিতে কাল আবার আসতে হবে। একটা রিক্সা নিয়ে এবার বাড়ি। কবিতা ভাবছে যে, মেয়েটা হয়তো এতোক্ষণে বাতি জ্বেলেই পড়তে বসে গেছে; বাতি জ্বালাতে গিয়ে যদি হাতে ছ্যাঁকা লেগে যায়? কাল যে পরীক্ষা, কী হবে! ভাবতে ভাবতে তার নাকের ওপর ঘাম জমে উঠেছে বড়ো বড়ো ফোঁটায়। একেক সময় নিজের দুশ্চিন্তার বাতিকে নিজেই বিরক্ত হয়ে ওঠে সে। মামণির বয়সে তো রুগ্ন মায়ের হেঁসেল ঠেলে নিজেরা দুবোন পড়াশোনা করেছে কবিতারা। তারওপর ছিল টিউশন করে পড়ার আর মায়ের সংসারের টুকটাক খরচ চালানো। আর পরীক্ষা? সেসব কথা মনে না করাই ভালো।
কবিতার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায় চোঙাওয়ালা মাইকটা সামনে এসে পড়ায়। কানের পর্দা ফাটিয়ে কতোগুলো কথা যেন কবিতার ঘিলুতে লাভা ঢেলে দিয়ে গেল। যে উৎকন্ঠাকে নিয়ে সে বিব্রত হচ্ছিল সেই উৎকুন্ঠাই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। নাকের ওপরের ঘাম শুকিয়ে গেল। বুকের মধ্যে শুধুই দুরমুশ চলতে লাগল। কাল বার ঘন্টা হুগলী বন্ধ!
তারপর দুঃখের বাষ্পও ঝেঁপে আসতে লাগল চোখে। কেন, কেন শুধু তার জন্যই এতো ঝামেলা জড়ো হয়! আপন মনে সে বিড়বিড়িয়ে ওঠে, “ঠাকুর, ঠাকুর একটা কিছু করো।” বুল্টু বুঝতে পারে না মা কেন এতো অস্থির হয়ে উঠেছে। তার বেশ খারাপই লাগে, দিদির পরীক্ষা বলে তারও এখন ফুচকা কিংবা সিঙারা খাওয়া বন্ধ। বাড়ি ফিরে শুধু চানাচুর দিয়ে মুড়ি খেতে হবে। সে মনে মনে ভেবে নেয় মাকে লুকিয়ে কিভাবে এক পলা সরষের তেল আর এক চামচ গুঁড়ো লঙ্কা মুড়িতে মিশিয়ে নেবে।
বাড়ি ঢোকার মুখেই কারেন্ট চলে এলো। কবিতা একটু যেন নিশ্চিন্ত হলো। দরজার হ্যাজবোল্ড ধরে নাড়তেই মামণি সাড়া দিল। তাড়াতাড়ি দরজাও খুলে দিল। কিভাবে ওকে খবরটা দেবে কবিতা বুঝতে পারছিল না। জিজ্ঞেস করল, “খেয়েছিস?” মামণি হাতের খাতাটা থেকে চোখ না সরিয়েই ঘাড় নাড়ল। খাবার টেবিলে বসেছিল সে এতোক্ষণ; সব খাতাপত্র হাতড়ে হাতড়ে গুটিয়ে নিচ্ছে এবার দোতলায় নিজের ঘরে উঠে যাবে বলে। বুল্টু বলল, “দিদি জানিস কাল বার ঘন্টা হুগলী বন্ধ?” মামণি চোখ পাকিয়ে বলল, “ঠাট্টা করবি না। প্রচুর টেনশন এখন।” কবিতা বলেই ফেলল, “বুল্টু ঠাট্টা করছে না। কাল সত্যি-” শেষ করতে পারল না কথাটা সে, মামণি ডুকরে উঠল, “কেন? এখনই যতো ঝামেলা?” কবিতা বুল্টুকে খেতে দিতে দিতে বলল, “সেই একই কারণ। যে কারণে গত চার বছরের প্রত্যেক বছরে চল্লিশ দিন করে রেল অবরোধ হয়ছে; সেই আরামবাগ-সিঙ্গুরে সিপিএম-তৃণমূলে মারপিট; যে কারণে তুই হস্টেল নিলি। নিলিই যখন তখন ছাড়লি কেন?” মরিয়া গলায় মামণি এবার বলল, “মা বিশ্বাস করো, হস্টেলে থাকলে দেবযানী আমাকে পরীক্ষার হলে পৌঁছতে দিত না। অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় সারা রাত ও ঘরে বসে গাঁজা খেয়ে হট্টগোল করেছিল। চারবার আমার গায়ে জল ঢেলে দিয়েছিল। যাতে আপদে বিপদে পরীক্ষার সময় হস্টেলে গিয়ে থাকার উপায়ই না থাকে, তাই আমি সিটটা ছেড়ে দিয়েছি।” সম্ভবত দম নিতে থামে মামণি।
বুল্টু খাচ্ছে আর বড়ো বড়ো চোখ করে মামণির কথা শুনছে। নতুন বইপত্র বুল্টুর পড়ার টেবিলে গুছিয়ে দিতে দিতে কবিতা ভাবছিল, চার সিটের ঘরটা যতোটা ছিল মামণির ততোটাই ছিল দেবযানীরও। বেলদা থেকে কলকাতা এসে মেয়েটা নাকি সবার আগে মিনিস্কার্ট পরতে শেখে। এদিকে পড়ে মামণির ডিপার্টমেন্টেই। হাফইয়ার্লি পরীক্ষার পর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার হালহকিকত দেখে মাস্টারমশাইরা চারটে স্টাডিগ্রুপ বানিয়েছিলেন। তাঁরা এই মেয়েদুটোকে এক গ্রুপে রেখেছিলেন। কিন্তু দেবযানীকে ধরে পড়তে বসানোটা মামণির মনে হয় অনধিকার চর্চা। অথচ দেবযানীর মনে হয় নি কখনও যে মামণির পড়াশোনায় বাগড়া দেওয়াটা ওর দিক থেকে অনধিকার চর্চা। দেবযানীর নাকি চাকরি-বাকরি পয়সার দরকার নেই, অতএব কী হবে পড়াশোনা করে এমনটাই তার হাবভাব। কিন্তু তার আবার সমস্যা হলো যে সে যা খুশি তাই করবে আর মামণিকেও তার সঙ্গে তারই মতো করতে হবে; না হলে মামণি ওর সাথে একই ঘরে থেকে ফার্স্ট আর সে লাস্ট হবে ক্লাসে এটা সে মানবে না। তাই তো সেই মেয়ে অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় এমন লম্ফঝম্প করল যে মামণি সারারাত জেগে পরদিন পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল, রেজাল্ট হাফইয়ায়ার্লির মতো ভালো হয় নি। মামণি ঘর বদলে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ততোদিনে নতুন মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। ফলে থার্ড ইয়ারের আগে ঘর বদল সম্ভব নয় জানিয়ে দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। টেস্ট পরীক্ষার আগে মামণি বাড়ি চলে এসেছিল। তখন অনার্স প্র্যাকটিক্যাল পেপারের পরীক্ষার দিন মাঝপথে ট্রেন অবরোধেও পড়েছিল। কিন্তু দিলীপ রোজ মেয়ের সঙ্গে যেতো। তাই গঙ্গা পার হয়ে, শেয়ালদা লাইনের ট্রেনে চাপিয়ে, সে মামণিকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই কলেজে পৌঁছে দিয়েছিল।
মামণি জিজ্ঞেস করল, “কারা বন্ধ ডেকেছে?” বুল্টু বলল, “তৃণমূল।” তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে টেলিফোন ডিরেক্টরির পাতা উল্টোতে লাগল মামণি; কবিতা দৌড়ে এসে বলল, “কাকে ফোন করছিস তুই?” মামণি কোনো জবাব দিল না। তারপর ডায়াল করতে লাগল। সদর দরজায় দিলীপের বাড়ি ফেরার সংকেত। বুল্টু দৌড়ে গেল দরজা খুলতে।
জুতো খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দিলীপ শুনতে পেল মামণি চেঁচাচ্ছে, “বাঞ্চ অফ রাস্কালস্, কাল হুগলি বন্ধ ডেকেছিস, জানিস কাল পাঁচ হাজার ছেলে মেয়ে হুগলি থেকে হাওড়া কলকাতা যাবে পরীক্ষা দিতে? হুগলিতেই তিনটে কলেজে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা? আর কিছু যাবে ব্যারাকপুর, নৈহাটিতে”। দিলীপ ধমকে উঠলেন, “কার সাথে কথা বলছিস?” মামণি শুনেও শুনল না। অন্য পাড়ের জবাব শুনে বলল, “তোর মতো অশিক্ষিতরা দেশোদ্ধার করার ভান করলে পরীক্ষা বন্ধ ছাড়া আর কী করবে? দুবার তো পরীক্ষা, হয় তোদের জন্য নয় তোদের মতো অন্য পার্টির জন্য পিছিয়েইছে। আর তোরা নিজেদের ডিগ্রির সংখ্যা বাড়ালেই কী শিক্ষিত হবি? বন্ধ না তুললে আমরা কাল পরীক্ষা দেব কী করে?”...... “ডেকেছিস যেমন করে তেমন করে তুলেনে, রিক্সা চেপে গলা ফাটানোর কাজ তো! আমাদের পাড়ার ছেলেগুলোকেই না হয় ডেকে বলে দে”...... “দেখ তা হলে...” ফোন রেখে মামণি বলল, “আমি তৃণমূলের কলকাতা অফিসে ফোন করলাম, বাবা। ওরা কাল সকাল ছটা থেকে বার ঘন্টা বন্ধ ডেকেছে।” দিলীপ বলল, “কেন করলি? ওরা বন্ধ কী আর তুলবে? তুলে নেব বললেও বিশ্বাস করবি কী করে?” মামণি বলল, “বিশ্বাস? পলিটিকোদের? তবে ওদের মধ্যে সব দু ভাগ হয়ে গেল বন্ধ করা কাল ঠিক হবে কিনা তাই নিয়ে, সেটা বুঝতে পারলাম।”
কবিতা চা দিল সবাইকে। বুল্টু পড়তে বসে গেল, নতুন বইতে মলাটও লাগাতে হবে। মামণি দোতলায় চলে গেল। কবিতা চা খেতে খেতে দিলীপকে বলল, “কী শুরু হয়েছে? এখানে না হয় কোনো দিনই কোনো গণ্ডগোল হয় না, হয় নি। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, হাওড়ার গলিতে গলিতে খুন, জখম, রক্তের হোলি খেলা হয় তো এখন আর হয় না, কিন্তু এখন এসবই হচ্ছে আরামবাগে, সিঙ্গুরে, কেশপুরে। তার আঁচ এখানে লাগবে না ভেবেছিলাম। কিন্তু এতো সেই সব দিনের কথাই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে।” দিলীপ বলল, “আজ কোনো স্মৃতিচারণ নয়। কাল রাত তিনটেয় উঠব। চারটে দশের ফার্স্ট লোকালে বেরিয়ে যাব মামণিকে নিয়ে। তারপর দেখা যাবে।” কবিতা ঝটপট রাতের রান্না সেরে নিতে গেল। আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে।
স্নান সেরে দিলীপ দোতলায় গেল। মামণির কাছে গিয়ে বলল, “কাল তিনটেয় উঠে চারটেয় বেরোতে হবে। আজ নটা অবধি যা হবে তাই পড়। রাতে ভালো করে ঘুমিয়ে নে। কাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরা অবধি আর তো ঘুমের চান্স নেই। আজ রাত জাগিস না।” মামণি বলল, “তুমি দুঃখ পেলে ওদের ফোন করলাম বলে? আমি জানি তুমি কারুর থেকে কোনো ফেভার চাইতে মানা করো... আমাদের ভালোর জন্যই।” দিলীপ হেসে ফেলল, “ফোন করে ঠিক করিস নি। এরা প্রতিবাদ, বিরুদ্ধতা সহ্য করে না। সেখানে এতোটা জ্ঞান দিলি, ওদের ইগোয় ধাক্কা দিলি। ওরা তোর বন্ধু ছিল না, এবার ওরা তোর শত্রু হয়ে গেল। তুই ফেভার চাইলে তো ওদের ইগো আরাম পেত, উল্টে তুই ওদের মেরেছিস, কথার চাবুক। ওরা এটাই চায় মানুষের মধ্যের হিংসেটা, ঘেন্নাটা টেনে বার করে আনতে। হিংসে আর ঘৃণাই রাজনীতির মূলধন, অস্ত্রও বটে। সামনে পেলে তুই ওদের সাথে মারপিটই করে ফেলতিস তাই না?” মামণি জবাব দিল না। শুধু তাকিয়ে রইল। দিলীপ বলল, “মানে তুইও ওদের যা খারাপ বলে জানিস সেটাই নিজে করে ফেলতিস। আর ওদের রাজনৈতিক শত্রুরা তোকে নিজের দলের বলে প্রমাণ করত। মানে তুইও একটা রাজনৈতিক দলের হয়ে যেতিস। আর অন্য আরেকটা দলের শত্রু হয়ে যেতিস। ......... এদের হারেরেরেতে বুদ্ধি হারাতে নেই। বিচার করতে হয়, কী করে এদের এইসব হল্লা এড়িয়ে নিজের কাজটা সেরে ফেলা যায়। তবে আজকে তো আর একার জন্য কথা বলিস নি। অনেকগুলো পরীক্ষার্থীর হয়রানির কথা ভেবে একটা প্রকৃত কারণের জন্য কথা বলেছিস। চরিত্রবল, সাহস, আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে এই প্রতিবাদ আর বিরুদ্ধতা করার ক্ষমতাটাও জরুরি। সেটা তোর আছে তুই জেনে গেলি। অতএব কাল যাই হোক, একার জীবনে তুই সারভাইভ করতে পারবি”। একটু থেমে আবার বলল সে, “মনোযোগ হারাস না, ধৈর্য হারাস না, পড়।”
রাতে শুয়ে কিছুতেই ঘুম হতে চায় না কবিতার। বুল্টু আর দিলীপের পাল্লা দিয়ে নাক ডাকানো, নাকি মামণির ঘরের জ্বলতে থাকা আলো কিছু একটা কারণ হবে। তারপর একটু ঘুম ধরল কী তছনছ হয়ে গেল সাতাশ বছর আগেকার দুঃস্বপ্নে। তারপর আবার ঘুম একটু গভীর হতে না হতেই তিনটের অ্যালার্ম বেজে উঠল।
মামণিকে সারা দিনের জন্য কিছু খাবার আর জল দিয়ে দিল কবিতা। যন্ত্রের মতো ঝালিয়ে নিল, “অ্যাডমিড কার্ড, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট সব নিয়েছিস তো?” মাথে নেড়ে সম্মতি জানায় মামণি। দিলীপের পেছন পেছন দৌড় লাগায় প্রায়। এতো ভোরে রিক্সা পাওয়া যাবে না। ওকে আর দিলীপকে অনেকটা সময় এই শেষ বৈশাখের গরমে কাটাতে হবে ঘরের বাইরে। পরীক্ষা তো শুরু সেই দুপুর বারটায়। এসব ভাবনার একরাশ উদ্বেগে অস্থির শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয় কবিতা। ভাবতে থাকে যে সে সব দিনই কী আবার ফিরে এলো? ফিরে আসছে নাকি সেসব দিন? ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা তখন প্রত্যেক বছরই পিছোত অনির্দিষ্টকালের জন্য। কোন বছরের পরীক্ষা কোন বছরে হচ্ছে তার ঠিক ছিল না। পরীক্ষা একরকম হলো তো রেজাল্ট বেরোতে বছর ঘুরে যেত। দুষ্টু ছেলেগুলো বলত, “দশ মাসে মানুষ একটা বাচ্চার জন্ম দিয়ে দিতে পারে, আর ইউনিভার্সিটি একটা রেজাল্ট বের করতে পারে না!” তারপর পরীক্ষা সেন্টারে পৌঁছে দেখো তোমার নাম-রোল নম্বর সেন্টার কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তখন তুমি ঘুরতে থাকো ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক বিভাগ থেকে সেন্টার আর সেন্টার থেকে ইউনিভার্সিটি।
আলো ফুটল। দিন শুরু হলো। খবরের কাগজ এলো। পুরো পাতা জুড়ে রাজনৈতিক দাঙ্গার খবর। সক্কাল সক্কাল এতো রক্তারক্তির কথা ভালো লাগে না কবিতার। কে জানে এখন চোখের সামনে দাঙ্গা তেমন হতে দেখে না বলেই কী দাঙ্গার ওপর এতো বিতৃষ্ণা? বাড়ির সামনে খুনোখুনি দেখলে হয়তো তার সাথে বসবাসের অভ্যেস হয়ে যেত। যেমন ছিল তিরিশ বছর আগে। তখন মনে হতো যে মাস্টারমশাই শুধু ছাত্রকে শাসন করলেন বলে তাঁকে ছাত্ররা মারল? আজ পরিণত বয়সে কবিতা বোঝে যে মাস্টারমশাই নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্রীমশাই বা ষড়যন্ত্রীমশাইয়ের আখেরে ঘা দিয়েছিলেন বা আখের গুছোনোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আর সুধীরদার পেটের রোগ দাঁড়িয়ে গেল পুলিশের মার খেয়ে খেয়ে, কারণ ওর নকশাল ভাইটাকে পুলিশ কখনও ধরতে পারে নি। অনেক রকম শোনা যেত এ নিয়ে। সুধীরদাকে অমন করে মারা হলো বলেই নাকি ওর ভাইটা পুলিশ খুন করেছিল প্রতিশোধ নিতে, না হলে প্ল্যাম্পফ্লেট বিলি ছাড়া আর কিছু করত না সে ছোকরা। আবার কেউ কেউ বলত, ওর ভাইটাকে পুলিশ আগেই মেরে ফেলেছিল, তার সাঙ্গপাঙ্গদের ভয় দেখাতে সুধীরদাকে বারবার তুলে নিয়ে যেত থানায়। সত্যি মিথ্যের কথা কেউ জানে না। এদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই জমির তুলনায় লোক অনেক বেশি। একটা তানা-নানা করে তাদের শত্রু-মিত্র সাজিয়ে লড়িয়ে দেওয়া সোজা। তাতে ধনে-মানে লাভ হয় গদিয়ালদের।
সময় থেমে থাকে না। বুল্টুও স্কুলে রওয়ানা হয়ে গেল যথা সময়ে। তারওপরে ফোন বাজল। দিলীপ আপিস পৌঁছে খবর দিল, “সাড়ে পাঁচটায় হাওড়া স্টেশন পৌঁছে গিয়েছিলাম। সাড়ে ছটার পর বাস ধরে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছই। তারপর হেদোয় বসে ছিলাম। বেথুনের মর্নিং সেকশনে এতোগুলো মেয়েকে ঢুকতে দিতে চাইল না।” কবিতা জানতে চাইল, “আর কে কে ছিল?” দিলীপ বলল, “অনিন্দিতা বলে একটি মেয়ে ও তার মা, জয়ালক্ষী বলে একটি মেয়ে ও তার বাবা তো আমাদের সাথে এখান থেকেই গিয়েছিলেন। তারপর প্রায় শখানেক মেয়ে জড়ো হলো সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে। জয়ার বাবা আর অনিন্দিতার মা থাকবেন সারাদিন। আমি ওঁদের সাথে মামণিকে রেখে এসেছি। আবার সাড়ে দশটার দিকে একবার বেরিয়ে যাব, আজ তো প্রথম দিন একঘন্টা আগে গেট খুলে দেবে।” অনেক বিল উঠে গেল তাই কবিতা আর কথা বাড়ালো না। বাবা আর মেয়ে ঠিকঠাক খেলো কিনা, মেয়ের কাছে টাকা পয়সা আছে কিনা সেসব নিয়ে চাপা উদ্বেগ রয়ে গেল কবিতার মনে। দুপুরে খবরের কাগজটা নিয়ে বসতেই চোখ জুড়ে এলো তার।
কিন্তু ঘুম হলো না। চোখ বুজলেই দেখে যে, সাতাশ বছর আগের একটা দিনে, কিশোর এসে বলছে, “কবিতাদি এই মাত্র হেডমাস্টারটাকে মেরে এলাম গো।” সারা গায়ে ভয়ের কাঁটা কবিতার আর তার দিদির। মা রান্নাঘর থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এলেন, “যা অনামুখো, বলেছি না আমার বাড়ির চৌহদ্দিতে পা রাখবি না। বাপ-মার মুখে তো চুনকালি দিয়েইছিস, এখন তোর জন্য আমার ছেলেমেয়েগুলোরও বিপদ হোক।” কিশোর চোখে অনেক রাগ এনে বলল, “মরা বাপ-মায়ের মুখে চুনকালি দেব কী করে? জেঠুর বাড়িতে চাকরের মতো থাকি, শুধু লোকের মুখ বন্ধ করতে স্কুলে পাঠানো। কী হবে এসব বুর্জোয়া শিক্ষায়?” কবিতার মা আবার ধমকে উঠলেন, “কে শিখিয়েছে এসব তোকে, ডাক্তারের ব্যাটা? জ্যাঠাও কী তোর মতো অনাথের শ্রেণীশত্রু নাকি রে অকৃতজ্ঞ ছেলে? তাদের মতো মানুষ হয় না – তোকে তো ডাক্তারের ব্যাটা কালসাপ বানিয়ে তুলেছে দেখছি!” কিশোর মুখভঙ্গি করে বলল, “ভারি তো দুধকলা খাওয়াচ্ছিল!, সপ্তায় একদিনের বেশি ভাত দিতে পারে নি... কথা না বাড়িয়ে কুড়িটা রুটি দাও তো এখন...” কবিতার মা আরও রেগে গিয়ে বললেন, “তোদের নেতা নিজের বড়লোক বাপের না খেয়ে পাড়ার হা-ভাতে লোকের দরজায় শৌখিন ভিক্ষে করতে পাঠিয়েছে? কেন? স্যাঙাত জুটিয়েছে বেছে বেছে যতো বাপ-মা মরা কী বাপে খেদানো অভাগাগুলোকে! গুরুজনদের শত্তুর সাজিয়ে! বলে দিস সে হারামজাদাকে আমার মেয়েদের ফুঁসলানোর চেষ্টা করলে চোখ উপড়ে নেব। আর যদি কখনও রুটি চেয়েছিস এদিকে তোর ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব...” বলতে বলতে তিনি দরজার শাল কাঠের ভারি খিলটা তুলে তেড়ে গেলেন কিশোরের দিকে। কবিতারা দুবোন মায়ের এই মূর্তি কখনও দেখে নি। কিশোর তো চলে গেল দৌড়ে। মা কবিতাকে খুব বকেছিলেন তারপর, পরদিন পরীক্ষা, পড়ায় মন না দিয়ে অলক্ষুণে ছেলেটার কথা গিলছিল বলে। ইলেকট্রিক কানেকশন ছিল না কবিতাদের বাড়িতে তখনও। আলো হাওয়ার জন্য দরজা খুলে রেখেই পড়তে বসতে হতো, দিনের বেলা। সন্ধেবেলাও। তাতেই বিপত্তি।
পরদিন ছিল পরীক্ষার শুরু, অনার্স পেপার ওয়ান দিয়ে। অনার্সের হোম সেন্টার আর পাসে বাইরে সেন্টার হতো; সাধারণতঃ কলকাতায়; ফলে দশটার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সাতটা-সাড়ে সাতটায় বেরোতে হতো। কবিতারও পরীক্ষার প্রথম দিনেই বাস বন্ধ ছিল। তখন ওরকম হুটহাট বাস বন্ধ থাকত হামেশাই। নতুন রাস্তা অবধি হেঁটে যাওয়ার পর একটা রিক্সা পেয়েছিল কবিতা আর তার বন্ধু রমা। দালালপুকুরে পৌঁছে দেখেছিল কোনো গাড়িঘোড়া না পেয়ে ওদের আরেক বন্ধু আল্পনা তার বরের সাথে দাঁড়িয়ে। তারপর সেই একটা রিক্সাতেই তিনজনে নরসিংহ দত্ত কলেজে যাচ্ছিল। শ্যামাশ্রীর সামনে পৌঁছে তিনজনের হৃৎকম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সিনেমা হলের বারান্দায় ঝুড়ি করে সাতটা মাথা বসানো। ঝেঁপে বৃষ্টি পড়ছে তখন। রিক্সাওয়ালাও তিনজনকে নিয়ে খুব জোরে রিক্সা টানতে পারছিল না।
তারপর পরীক্ষার হলে সাম্যবাদীরা খাতার লেখা পাতাগুলো নিয়ে টানাটানি করছিল। তাদের দাবি ছিল যে নম্বর বেশি পাওয়ার পুঁজিবাদী স্বার্থপরতা করা চলবে না। আর এক্সটার্নাল ইনভিজিলেটর টহল দিয়ে যাচ্ছে। যাকে সন্দেহ করবে তাকেই রাস্টিকেট করে দেবে। থেকে থেকেই ডেস্কে ডেস্কে ঘনিয়ে ওঠা তর্কাতর্কি, খাতা-টানাটানিতে কাকে দোষী ধরবে ইনভিজিলেটর? কবিতার বাবা মারা গিয়েছিলেন এই পরীক্ষার দু বছর আগে। দাদার একার রোজগারে পাঁচ ভাইবোন আর মায়ের খরচ চলে। কবিতা, তার দিদি আর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকা তাদের ছোটভাই টিউশন করে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনার চেষ্টা করত। বোনের ক্লাস ফাইভ সবে। কবিতার একটা চাকরি চাই, তক্ষুণি। কিন্তু খাতাটা নিয়ে টুকলিবাজরা ফেরত না দিলে ঠিকঠাক? রাস্টিকেট করে দিলে ইনভিজিলেটর.....
সেসব দিন কেটে গেছে। কিশোরকে একদিন পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেইদিনই জানা গিয়েছিল যে ডাক্তারবাবুর ছেলে নাকি গায়েব। অনেক বছর পরে বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে সে দেশে ফিরেছিল। বাবা কংগ্রেসি কাউন্সিলর ছিলেন কর্পোরেশনে। সে ফেরার পর অনেকদিন কোনো রাজনীতি করে নি। এখন বড়ো নার্সিংহোম করেছে। আগেরবার সিপিএমের টিকিটে লোকসভার ভোটে দাঁড়িয়েছিল। এবার আবার বলেছে ভোট বয়কট করতে।
বুল্টুদের স্কুল হয় নি আজ। দুপুর হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে এসেছে। এবার মাঠে খেলতে যাবে। ফোন বাজল। মামণি বলল, “মা পরীক্ষা ভালো হয়েছে। সব খেয়েছি। এইবার বাস ধরব।” বাড়ি ফিরেই খবর শুনতে বসল মামণি। কাল ছুটি। পরশু আবার পরীক্ষা। কালকে জবাবি বন্ধ ডেকেছে সিপিএম, শুধু আরামবাগ ব্লকে, যেন ওখানকার ছেলেমেয়েরা শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া, রিষড়ায় পরীক্ষা দিতে যাবে না; তবে সমর্থকরা আরামবাগের বন্ধকে সর্বাত্মক করে তুললে নেতৃত্বের কোনো দায় নেই বলেও জানানো হয়েছে। আর পরশু এসইউসিআই রেখেছে দুঘন্টা রেল অবরোধের কর্মসূচী, উপলক্ষ আরামবাগে হিংসার অবসান।
মামণি হাতি বাগানে মাসির বাড়ি চলে গেল পেপার টু পরীক্ষার দিন থেকে। ওর জামাকাপড়, বই পত্র দিলীপ পৌঁছে দিলেন সেখানে। জয়া, অনিন্দিতা আর আরও অনেকের কলকাতায় থেকে পরীক্ষা দেওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। ওরা রোজ ভোর চারটের সময় ট্রেন ধরে, সারা সকাল হেদোয় বসে থেকে, দুপুরে পরীক্ষা দিয়ে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরল, বাকি সব অনার্স আর পাস পেপার।
No comments:
Post a Comment