Sunday, August 2, 2015

সুকন্যা বৃত্তান্ত

সুকন্যা সত্যিই ভালো মেয়ে। তার মা বলেন, “ওকে কোনো দিন বলতে হয় নি ‘পড়তে বোস।’ কোনোদিন কোনো বায়না ছিল না ওর। যা খেতে দিয়েছি তাই খেয়েছে। যে জামা পরতে বলেছি তাই পরেছে। ফ্যাশন নিয়ে মোটে মাতামাতি ছিল না ওর...” তার বাবা বলেন, “মেয়েটা বড়ো ঘরকুনো, মুখচোরা ছিল। তাই লাইব্রেরিতে মেম্বার করে দিয়েছিলাম। তাও মেয়েটা অমিশুক, চুপচাপ রয়ে গেল।
সেই সুকন্যা ভালোই আছে। বিগড়েও যায় নি; খারাপও হয় নি; একটুও না। আসলে সুকন্যা খারাপ হতে পারে না। এটাই তার গলদ। সেই যে ভালোতে মন্দতে মিশিয়ে মানুষ বলে নাসুকন্যারও তাই। সে সত্যিই ভালো আর এই যে সে খারাপ হতেই পারে না এইটাই তার মন্দ। একথাটা সুকন্যা টের পেয়েছিল বেশ অল্প বয়সেই; সেই যখন সুকন্যা আর তার ভাই গুপি এক থালায় ভাত খেতো, তখন। গুপির মুখে ভাতের দলা দিলে সে খেলাচ্ছলে ফ্রু ফ্রু করে ভাত ছিটিয়ে দিত। মা অমনি চোখ বড়ো বড়ো তাকাতেন গুপির দিকে আর গলার স্বর গাঢ় করে বলতেন, “ছি গুপি, খাবার নষ্ট করতে নেই। জানো কতো লোকে খেতে পায় না? তুমি খেতে পাচ্ছো বলে মুখের ভাত দালানে ছেটাবে? তুমি না বুদ্ধিমান, কখনও এরকম করবে না আর।” গুপি কিছুক্ষণ পরে ভুলে গিয়ে আবার ফ্রু ফ্রু করে ভাত ছেটাতে শুরু করত। তখন মা মনে করানোর চেষ্টা করতেন যে গুপিকে মা কী শিখিয়েছেন। তারপরের বার গুপি কানমলা খেত। তারপরের বার কিল। তখন কাঁদত। তারপর ঘুমিয়ে পড়ত। তারপর সব ভুলে যেত আবার।
সেই সময় একদিন আঁচাতে গিয়ে সুকন্যা দেখেছিল কলঘরের নর্দমার মুখে বেশ দশ-বারো দানা ভাত পড়ে আছে। সুকন্যার আগে তার দাদু আঁচিয়ে ছিলেন সেখানে। তাঁর হাতের থেকেই সম্ভবতঃ পড়েছিল ভাতের দানাগুলো। সুকন্যা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়েছিল। তারপর মায়ের অনুমতি চেয়েছিল, “মা, এই ভাতগুলো হাঁড়িতে রাখব?”  মা জানতে চেয়েছিলেন, “মানে, কোন ভাত?” উত্তর শুনে বলেছিলেন, “না, রাখবে না।” শুনেই সুকন্যা ভাতের দানাগুলো মুখে দিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ একটা জোরালো কিল তার পিঠে এসে পড়েছিল। সন্ধেবেলা বাবা বাড়ি ফিরতে মা নালিশ করেছিলেন, “তোমার মেয়ের কাণ্ড জানো? সে নর্দমা থেকে ভাত কুড়িয়ে খাচ্ছে! আমি যেন তাকে পেট ভরে খেতে দিই না।” মা একটু শান্ত হতে বাবা সুকন্যাকে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন, “অমন নোংরা থেকে ভাত খুঁটে খেলে কেনো তুমি?” সুকন্যা ঢোক গিলে বলেছিল, “অনেক লোক যে খেতে পায় না, তাই তো ভাত নষ্ট করতে নেই...... মা বলেছিল যে।” মা চেঁচিয়ে উঠে আবার এক ঘা দিয়ে বলেছিলেন, “আমি নর্দমা থেকে ভাত কুড়িয়ে খেতে বলেছি?”
সেদিন সুকন্যা বেশ বুঝেছিল যে সে কিছুই বোঝে নি। “খাবার নষ্ট করতে” নেই মানে “ফেলতে নেই”; কিন্তু ফেলে দেওয়া খাবার তুললে দোষ হয়; কী-করতে-হয় আর কী-সে-যে-কী-হয়-এর দুর্বোধ্যতায় সে শুধু শুনতে শুরু করেছিল। না প্রশ্ন করলে উত্তর দিত না। আর না করতে বললে কোনো কাজ করত না। তাকে একটা কাজ করতে বললে সেই কাজের আওতায় কী কী পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে তবে সে কাজটা করত। আবার প্রত্যেক ধাপে কাজটা ঠিক হলো কিনা জেনে নিত। এভাবে কৈশোর নাগাদ সে বাধ্য, বিনয়ী আর কুশলী হয়ে উঠেছিল সবার বিচারে। কিন্তু সেই সবার মধ্যে কে কে ছিল না সেটাও সুকন্যা জানত। এই জানার একটা বোনাসও ছিল।  বোনাস বোধি হলো যে সাধরণ বিশ্বাস: “যারা বলে কম, তারা শোনেও কম।” সেই কারণেই কেউ কেউ তার সামনেই বলত, “সুকন্যা বিনয়ী না ছাই। কথা বলে না কারুর সাথে এতো অহঙ্কার! নেহাৎ কাজেকম্মে, লেখাপড়ায় ভালো তাই কেউ কিচ্ছু বলে না। না হলে...” আর এভাবেই তিলে তিলে গড়ে উঠছিল জগৎ সংসার সম্বন্ধে তার ধারণার পুঁজি।
কিন্তু সে পুঁজি যে নিতান্ত অকিঞ্চিৎ সেটা সুকন্যা টের পেয়েছিল কলেজে গিয়ে। সেখানে উঁচু ক্লাসের দাদারা বলে, “সে কিরে তুই বাই সাইক্ল থিভস দেখিস নি! তুই কী গাঁওয়ার? তুই কামু পড়িস নি, কাফকা পড়িস নি! তুই তো অমানুষ, জানোয়ার।” উঁচু ক্লাসের দিদিরা বলল, “এমা তুই কাজল পরিস না! কী বিশ্রি বোকা বোকা লাগে। একটা লিপগ্লস তো লাগাবি, কেমন ভিখিরির মতো ফাটা ঠোঁট তোর।” এসব কথার কোনো উত্তর সুকন্যার জানা ছিল না। আর তাছাড়া নিরুত্তরে বোনাস বোধি পাওয়ার লোভও ছিল।
কিন্তু কলেজের বোদ্ধাব্রিগেড চমকে গিয়েছিল যখন সুকন্যা আন্তর্কলেজ তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় চ্যাম্পিয়ন আর বিতর্কে রানার্স আপ হয়েছিল। এক দিদি ব্যাগের ভেতর থেকে ব্যাগ, তার ভেতর থেকে আরেক ব্যাগ বার করে একটা লিপস্টিক দিয়ে বলেছিল, “এটা লাগিয়ে প্রাইজ নিতে উঠিস স্টেজে। ভাঙবি না, এটা টিউশনের পয়সায় কেনা।” আরেক দাদা এসে বলেছিল, “আমি তো দিল্লী চলে যাচ্ছি। আমার তিনটে ছাত্রকে পড়াবি?” সুকন্যা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। বক্তৃতা না হয় সে ইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই করে আসছে নানান দিবসে, নানান জয়ন্তীতে। তাই বলে ছাত্র পড়ানো? সে তো আগে কখনও পড়ায় নি কাউকে। এদিকে পড়ালে যে কাফকা, কামু, লিপস্টিক সব তার সে সম্ভাবনাটাও সে ফেলতে পারছিল না। সমাধান করে দিলেন এক মাস্টারমশাই। তিনি যাচ্ছিলেন কোথাও। যেতে যেতে সুকন্যার সাথে অন্য ছেলেটির কথোপকথন শুনে ফেলেছিলেন। সুকন্যাকে বলেছিলেন, “আমিও তো একদিন প্রথমদিন পড়িয়েছিলাম।”
এরপর সুকন্যার জীবনে অনেক কিছু প্রথমবার ঘটতে লাগল। বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখা, পিকনিকে যাওয়া, কানে ইয়ারফোন গোঁজা আর ওয়াকম্যানে গান শোনা, ইন্টারনেট সার্ফ করা। এই সময়টায় তার নিজেকে মোজার মতো মনে হতো। প্রত্যেকটা প্রথমবারের পর মনে হতো কেউ যেন মোজাটাকে উল্টে দিল একবার। এই সব ওলোটপালোটের মধ্যে সুকন্যার কিছু চ্যালা জুটেছিল। সুকন্যা তখন বেশ “সুকন্যাদি” হয়ে উঠেছিল।
তবু মাঝে মধ্যে পরীক্ষা ঘনিয়ে উঠলেই তার জীবনটা কেমন যেন “দুচ্ছাই, ভাল্লাগে না” হয়ে যেতো। আর পরীক্ষা কাটিয়ে উঠলেই তাকে পেয়ে বসত নতুন কিছু করার উশ্‌খুশুনি। এইসব উশ্‌খুশুনির সময় চ্যালাদের নিয়ে সুকন্যা কিছু একটা করার চেষ্টা করত। যেমন কলেজের সামনের ফুটপাথবাসী ছাত্রদের পড়ানো; পার্ক সাফ করা, সেখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গাছ লাগানো; গ্রামে গিয়ে ছাত্রদের জন্য ক্যুইজ প্রতিযোগিতা করা।
একসময় কলেজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটিতে দুশ জনের ক্লাস। নিজের নিজের দলের বাইরে কেউ কাউকে চিনতে চাইত না। সুকন্যার চালু জীবনটা হঠাৎ যেন অচল হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে ফাঁক পেলেই সে তখন কলেজে চলে যেত। চ্যালাদের সাথে আড্ডা মেরে বা কাজকম্ম করে বাড়ি ফিরে যেত। ছাত্র ধর্মঘটের দিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস হতো না। কিন্তু কলেজে মাস্টারমশাইরা নিজেরা গেটে দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে ইচ্ছুক ছাত্রদের কলেজে ঢুকিয়ে নিতেন। সেদিনগুলোতে সকাল সকাল সুকন্যা গিয়ে কলেজে ঢুকে পড়ত। তারপর কোনো মাস্টারমশাইয়ের ঘরে বসে, পড়ে, পড়া বুঝে বা পড়িয়ে কাটিয়ে দিত সারাদিন।
এরকম একটা ছাত্র ধর্মঘটের দিন কলেজের পাঁচিলে একসার লোক নিজেদের জলমুক্ত করছিল। দেখে সুকন্যার কিছু করার ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেদিন সপারিষদ দরবারে সে ঠিক করেছিল যে মিউয়েরেটিক অ্যাসিড, ফিনাইল আর ঝাড়ু কেনা হবে। তারপর মূত্র মুক্ত করা হবে দেওয়াল। ফের যাকে দেখা যাবে পরিষ্কার দেওয়ালের ধারে নিজেকে জলমুক্ত করতে তার থেকে ফিনাইল, অ্যাসিড আর ঝাড়ুর খরচ তুলে নেওয়া হবে, আর তাকে দিয়েই দেওয়াল পরিষ্কার করানো হবে।
সেদিনই কলেজ ছুটির পরে দেওয়াল পরিষ্কার করা হয়ে গিয়েছিল। সন্ধের সময়টা বয়েজ হস্টেলের ছেলেরা পাহারায় ছিল। যে কজনকে ওরা দাঁড়াতে দেখেছিল দেওয়ালের সামনে তাদেরকে ওরা মানা করেছিল। কোনো কারণে লোকগুলো মানা শুনেছিল। পরের দিন সন্ধে থেকে গভীর রাত অবধি কলেজের দারোয়ান বলরামদা নজর রাখতে লাগল। আর ভোর থেকে কলেজ শুরু হওয়া অবধি বয়েজ হস্টেলের বাহাদুরদা। একদিন সকালে একটা লোক বাহাদুরদাকে বোঝাতে গিয়েছিল, “মানুষের আড়াল লাগে। তাই তো দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ায় লোকে।” সে লোকটাকে বাহাদুরদা একটাকা দিয়ে সুলভ শৌচাগার দেখিয়ে দিয়েছিল। এরকম দয়াতে ছাত্ররা বিরক্ত হয়েছিল। টাকা দিয়ে শৌচাগারে পাঠালে যে দেওয়ালের আড়াল নিত না সেও নেবে। টাকাটা রোজগার হবে আর অন্য কোনো দেওয়ালের আড়ালে কাজটা সেরে নেবে। তাই দফায় দফায় ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপ হতে লাগল। দেওয়াল বাঁচানোর প্রকরণ নিয়ে।
একদিন দুপুরে ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়েকে একটা লোক “কেয়া করে, গরীব হৈ?” বলে ডুকরে উঠেছিল। কিন্তু মেয়েটা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার শারীরিক আবশ্যিকতার সাথে ধনী-গরীবের শ্রেণীবৈষম্যের সম্পর্ক বোঝেনি। তাই সে লোকটাকে দিয়ে দেওয়াল তো সাফ করিয়েই ছিল, আর লোকটা সাফাইয়ের খরচ দিতে পারে নি বলে একটা কাগজে নানা ভাষায় “সাবধান! আমি দেওয়ালে হিসি করি” লিখে কাগজটা লোকটার জামার পিঠে আঠা দিয়ে এঁটে দিয়েছিল। একটা লোক থার্ড ইয়ারের তিনটে ছেলেমেয়েকে, “হুজ্জুতি করছ কেন? ফুচকা খাবে? পয়সা চাই?” বলে তাদের হাতে তিরিশ টাকা গুঁজে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে মুক্ত হতে চেয়েছিল। তারা টাকা তো নিয়েই ছিল। তার ওপর লোকটার জামাতেও কাগজ সেঁটে দিয়েছিল, “আমার টাকা সস্তা তো তাই যেচে ঘুষ দিই।”
কাজটা শুরু করার সপ্তাখানেকের মধ্যে হৈ-হৈ করে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। মাস্টারমশাইরা তো খুশি হয়েই ছিলেন, অধ্যক্ষও মাঝে মাঝে দশ মিনিট করে দেওয়াল পাহারা দিয়ে যেতেন ছুটির পরে। সে বছর কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবসে সুকন্যাকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। খবরের কাগজ আর টিভির লোকেরাও এসেছিল। অধ্যক্ষ তাদের সামনে বক্তৃতা করেছিলেন, “যে যুগে নেতা মানে ঘৃণিত রাজনীতিক, সে যুগে আমরা একজন অরাজনৈতিক নেত্রী পেয়েছি। মহাত্মা গান্ধির মতো। ভারতের ইতিহাসে গান্ধিই কেবল মানুষের জন্য আন্দোলন করেছেন, কোনো দল বা পদ বা চাকরির লোভে বা প্রয়োজনে রাজনীতি করেন নি। বলা ভালো গান্ধি রাজনীতিকে নয়, রাজনীতি গান্ধিকে আশ্রয় করেছিল। সুকন্যা আমাদের ছাত্রী। ভাবলে আনন্দে গর্বে উপচে উঠছে মন। আশা করব রাজনীতি সুকন্যাকে আশ্রয় বা গ্রাস করবে না......।”
এসব শুনে সুকন্যার মনে হয়েছিল যে জীবনে সেই প্রথম সে কোনো আদর্শ খুঁজে পেয়েছিল। যেন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায় একটা টিমটিমে আলোর বিন্দুর মতো, একটা দিশা। তারপর কল্মষারি বলে একটা অলাভজনক সংস্থা শহরের সব দেওয়াল পরিষ্কার রাখার কাজে এগিয়ে এসেছিল। সুকন্যাকে তারা পার্টটাইম মেন্টর রেখেছিল। ইউনিভার্সিটির ক্লাসের পর সে সংস্থাটার শিক্ষানবিশদের ক্লাস করাতো দেওয়াল সাফাইয়ের নীতি নিয়ম নিয়ে। এইসব শিক্ষানবিশরাও অল্পবয়স্ক ছাত্র ছিল। বা পড়াশোনা ছেড়ে কাজে লাগতে শহরে এসেছিল। তাই কেউ পার্টটাইম কাজ করত, তো কেউ ফুল টাইম। প্রথম তিন-চার মাসে কল্মষারির উদ্যোগে শহরের প্রায় সমস্ত দেওয়াল পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। খুব রমরমিয়ে চলছিল দেওয়াল সাফ রাখার পাহারাদারি আর দেওয়াল নোংরা করার জন্য জরিমানা নেওয়ার কাজদুটো।
ইউনিভার্সিটির পাট চুকতে সুকন্যার একটা ব্যক্তিগত সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তাঁর মা চাইছিলেন তখন বিদূষী, বাধ্য, বিনয়ী, কুশলী কন্যাটিকে সুপাত্রস্থ করতে। কিন্তু বাবা চাইছিলেন যে সুকন্যা আরও পড়াশোনা করুক, বিদেশে যাক, গবেষণা করুক। সুকন্যা চাইছিল দেশনেতা হতে। তার ইচ্ছে ছিল সারা দেশে সে ট্রেনে চেপে ঘুরে বেড়াবে, দেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়াটা বুঝে নিতে। কিন্তু বাবা-মায়ের মতানৈক্য দেখা দিতে সুকন্যার নাম থেকে সু খসে যেতে বসেছিল আর কী। মা দুঃখ করে বলতেন যে বাবার ইচ্ছেতেই মা মেয়ের পড়াশোনা, ব্যসন-ভূষণের তদ্বির করেছেন এতকাল। তাঁর নিজের কোনো ইচ্ছেই ছিল না মেয়েকে বিদ্যের জাহাজ করার কেন না তিনি জানতেন যে মেয়েকেও সংসারে তাঁর মতোই সার হতে হবে। এই তর্কে সুকন্যা বোনাস পেয়েছিল যে মায়ের যাবতীয় অনুশাসন হলো বাবার গেঁথে দেওয়া নীতির অনুসরণ মাত্র; তাঁর নিজস্ব কোনো মতই ছিল না।
এই সময়ে টিভির পর্দায় দেখা গিয়েছিল যে কল্মষারির কর্মীরা ঘুষ নিয়ে দেওয়াল নোংরা করতে দিচ্ছে। এক্কেবারে সন্ধেবেলার সরাসরি সম্প্রচারে। প্রচুর বিতর্ক হয়েছিলো। হাঁ হাঁ করে রাজনীতিকরা চেঁচিয়ে ছিল, দাপিয়ে ছিল, “কোন অধিকারে বা আইন বলে কল্মষারি দেওয়াল নোংরা করার জরিমানা ধরে?” “পুলিশ যদি না ধরে তো এই সংস্থা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পুলিশের কাজ করছে কেন?” “এ তো তোলাবাজি আর গুণ্ডামির সামিল?”
একটা ছাত্র সংগঠন আন্দোলনে নামল বিকৃত ছাত্র মনোবৃত্তির সংশোধনের উদ্দেশ্যে। তাদের স্লোগান ছিল, “যাহারা নিত্য দেওয়ালে ঢালিছে উষ্ণ রেচিত দ্রবণ,
   তাহারা পাতক, সুচারু বাক্য করে নি কখনও শ্রবণ।
   তাহারা শাস্তি অবশ্য পাবে আদালতে যথাবিধি।
   আমরা মুক্তি পূজারি, কেন তাদেরকে বাদ সাধি?
এই দলটার বক্তব্য ছিলো যে দেওয়ালে প্রসাব করা নিশ্চয়ই অন্যায়, কিন্তু প্রস্রাবকারীকে বাধা দিলে তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়।
সুকন্যা কল্মষারির কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল ভারত দর্শনে। মা কেঁদে ছিলেন। বাবা গর্জে ছিলেন। গুপির তখন না ছিল পড়াশুনো না প্রেমিকা। তাই সে গিয়েছিল দিদির শাগরেদি করতে; শর্ত একটাই মুখে কুলপ আঁটতে হবে। মাসতিনেকে ওরা ভাইবোনে ছুঁয়েছিল তিরিশটা শহর, গ্রাম, কসবা। শহরের লোকের খাবার জলের অব্যবস্থা আর গ্রামের লোকের গোসলখানার অভাব দূর করার ফিকির ভাইবোনে ভেবেছিল অনেক। সেই সময় শাকিলা বিবি বলে এক গৃহবধু বলেছিল, “আমার পায়খানা ঘরটা পড়েই আছে গো। ওখানে গেলে শান্তি পাই না। মর্চি নদের বালিতে রাংচিতার আড়াল ছাড়া ও কাজটা হয় নাকি? আমার আজন্মের অভ্যেস যে!” অভ্যেসের স্বাস্থ্যাস্বাস্থ্য নিয়ে শাকিলার সাথে তর্কটা সারই হয়েছিল। তারপর এক শহরে তারা দেখে ছিল যে ঝুপড়ির লোকেরা রোজ বিকেলে সাইকেলে নানা রঙের নানা মাপের জ্যারিকেন ঝুলিয়ে কাছাকাছি কসবা থেকে জল নিয়ে আসছে। কেউ বিলোচ্ছে, কেউ বিকোচ্ছে।
এরই মধ্যে সুকন্যা আর গুপি একদিন খবর পেয়েছিল যে কল্মষারি শহরের সমস্ত দেওয়াল সাফ রাখার বরাত পেয়েছে পৌরসভার থেকে এবং জরিমানার টাকাও তারা জমা দিচ্ছে পৌরসভাকেই। ওদের যত কর্মী ঘুষখোর বলে ধরা পড়েছিল, তাদের সবার মাথায় চোর লেখা গাধাটুপি পরিয়ে, তাদেরকে শহর পরিক্রমা করানো হয়েছিল। তারপর তারা আদালতে বিচারকের সামনে প্রতিশ্রুত হয়েছিল যে ফের ঘুষ নিলে তাদের চাকরি যাবে আর শেষ দুমাসের মাইনে জরিমানা বাবদ পৌরসভাকে দিতে তারা বাধ্য হবে; অনাদায়ে দুবছর হাজতবাস। সুকন্যা কল্মষারির কর্ণাধারকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাতে তিনি সুকন্যাকে কাজে সামিল করে নিতে চেয়েছিলেন।
সুকন্যাও চেনা জমিতে ফসল তোলার সহজ লোভে ফিরেছিল। কিন্তু একদিন ওরই সামনে কয়েকটা লোক একসাথে দেওয়াল নোংরা করেছিল আর কল্মষারির কর্মচারী তাদের মানাও করে নি। শুধু রসিদ কেটে জরিমানা নিয়েছিল। পরদিন সেই কর্মচারীকে আপিসে ধরে সুকন্যা জানতে চেয়েছিল যে কর্মচারিটি কেনো এমন করেছিল। উত্তরে শুনেছিল যে, “দুয়েকটা লোককে দেওয়াল নোংরা না করতে দিলে কর্পোরেশনের দেওয়া জরিমানার টার্গেট মেটানো হবে কী করে? কোম্পানি কমিশন পাবে কী করে? আর কোম্পানি কর্পোরেশনের দেওয়া ফিনাইল বাজারে বেচবে কী করে? বা বাড়তি ফিনাইল না কিনে তার ভুয়োবিল জমা দেবে কী করে?”
এরপর সুকন্যা শুধু কল্মষারিই ছাড়ে নি, দেশও ছেড়েছিল বাবার নির্দেশ মেনে। এখন সে কেনিয়ায় কেমিস্ট্রি পড়াচ্ছে। তাই কী এখানে দেওয়ালগুলোতে শেওলা জমেছে? আর টেড টকে শোনা যাচ্ছে পরের নোবেল আফ্রিকার? জানি না। তবে আজও দেওয়ালের দিকে মুখ করে কেউ প্রকৃতির সাথে নিভৃত আলাপ সারলে সুকন্যাকে মনে পড়ে। বেশ বসন্ত বাতাসের মতো মন ফুরফুরে হয়ে যায় এই বিশ্বাসে যে কেউ না কেউ আসবে ঝাড়ু আর ফিনাইল নিয়ে; কে জানে কোথা থেকে, ওয়াগাডুগু না ওট্টাপালাম থেকে; আর আবার সাফ হয়ে যাবে এই নাগরিক জীবন।

**আমার গল্প সংকলন "গুচ্ছ খোরাক" থেকে 

প্রচ্ছদ শিল্পীঃ রোহণ কুদ্দুস
প্রকাশক; সৃষ্টিসুখ

বইটা পাওয়া যাবেঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ঠিকানায়ঃ http://parabaas.com/bookstore/index.html#sanhita
ভারতে ("গুচ্ছ খোরাক") এই ঠিকানায়ঃ http://www.amazon.in/Guccha-Khorak-Sanhita-Mukherjee/dp/1625906366/ref=sr_1_17?m=A11UYLARTG1AFJ&s=merchant-items&ie=UTF8&qid=1393064887&sr=1-17 
> "সৃষ্টিসুখ"-এর আউটলেট, ৩০ এ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, (দেবী সারদা প্রেস লাগোয়া); দুপুর ২টো ৩০ থেকে সন্ধে ৬টা ৩০।
> সুচেতনা প্রকাশন, আদ্যা ভবন , ২০এ বলাই সিংহ লেন,, কলিকাতা ৯, ফোন ৬৫৪০৫৩৯০, ৯৮৩৬০৩৭৬০১,মেইলঃbasab.suchetana@gmail.com

No comments:

Post a Comment

Readers Loved