২৪. বেগুনি পুঁতি
ঠেলা দিয়ে দরজাটা খুলতেই নজরে এলো ইয়াও ঝি ঝু খালি পায়ে একটা সোফার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, হাত বাড়িয়ে দেওয়াল থেকে একটা অয়েল পেন্টিং পাড়ছে। হয়তো শরীরের ভারসাম্য রাখার তাগিদে পুরো মানুষটা দেওয়ালের গায়ে লেপ্টে আছে। ঘরের মধ্যে ঢুকেই মিন হুয়ের নজরে পড়লো মানুষটার চেহারাটার এক পাশ। সোজা নাকের হাড়, ছোট্টো নাকের ডগা, নিচু করে বেধে রাখা খোঁপা, কয়েকগোছা উস্কো খুস্কো চুল আলসের মতো ঝুলে আছে ঘাড়ে, রাজহাঁসের মতো সরু, মার্জিত ঘাড়টাকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে।
যে সব পেরেক থেকে পেইন্টিংগুলো ঝুলছিলো, সেগুলো অনেক উঁচুতে। সে অনেকবার চেষ্টা করেও পুরো ছবিটা দেওয়াল থেকে টেনে নামাতে পারলো না। তার কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়ছিলো আর সে সামান্য বেদম হয়ে পড়ে ছিলো।
মিন হুয়ে পাশ থেকে দেখছিলো, একটু যেনো ঘোর লেগে গেলো।
ঝি ঝু এতো সুন্দরী যে মেয়েরাও তার সঙ্গে ভাব করতে চাইবে। প্রত্যেকটা চলন যেনো নাচের মুদ্রা, এমনকি আলসে চেহারাটা জুড়ে ছড়িয়ে আছে যৌন মাদকতা। হঠাৎ মিন হুয়ের মনে পড়ে গেলো ঝৌ রু জির পড়ার ঘরের কাচের আলমারিতে রাখা একটা এসএলআর ক্যামেরা আর কয়েকটা ভীষণ দামী লেন্সের কথা। এরকম বৌ থাকলে বরের ছবি তোলার শখ হওয়াটাই স্বাভাবিক, না হলে বউয়ের সৌন্দর্যের যথেষ্ট কদর করা হবে না।
অনেক সময় লাগলো মিন হুয়ের নজরে আসতে যে একটা লোকের সোফার কোণে উবু হয়ে বসে আছে, দেওয়াল থেকে নামিয়ে আনা অনেকগুলো ফোটোফ্রেমকে গুছিয়ে রাখছে। যখন লোকটা শুনতে পেলো যে ঘরে কেউ ঢুকেছে, তখন মাথা তুলে বললো, “নি হাও!”
লোকটার চেহারা দেখে তাকে মোটেই সুদর্শন বলা চলে না, তবে মোটের ওপর দেখতে ভালো। বিশেষ লম্বা-চওড়া নয়, ফর্সা মুখ, কোঁকড়া চুল, চোখ কোঁচকানো যেনো জেগে উঠতে পারছে না, ঠোঁটের কোণগুলো সামান্য ওঠানো। প্রাণবন্ত। বয়স তিরিশের শুরুতে বলেই মনে হয়। তার হাবভাব শিল্পীসুলভ, ইয়াও ঝি ঝুয়ের মেজাজের সাথে বেশ মানানসই।
চারজনে একে একে নিজেদের পরিচয় দিলো।
“এ হলো শিয়া য়ি হ্যাং, আমার নান ফঙিয়ো।”
ইয়াও ঝি ঝু সোফা থেকে লাফিয়ে নেমে এসে মিন হুয়ের হাত ধরে উদার আন্তরিকতায় ঝাঁকুনি দিলো, “আমি শুনেছি তোমরা বিয়ে করছো। অভিনন্দন।”
মিন হুয়ে এরকম পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত নয়, তার মুখখানা হালকা লাল হয়ে উঠলো। একটা হালকা হাসি দিয়েই উত্তর সেরে ফেললো।
“আজ রেজিস্ট্রেশন।” আনন্দের স্বর ঝৌ রু জির গলায়, “দেখা গেলো যে আমি ভুল রঙের শার্ট পরেছি। মিন হুয়ে আমাকে বললো জামাটা বদলে নিতে।”
“তোমার সাদা পরা উচিৎ। ভুলে গেছো?” ইয়াও ঝি ঝু তাকালো ঝৌ রু জির দিকে, তারপরে মিন হুয়ের দিকে, নরম চোখে, হঠাৎ কী যেনো মনে পড়ে গেলো, ঝুঁকে ব্যাগের থেকে একটা লাল রঙের খাম বার করলো, “বিয়ে সুখের হোক! আমি চাই তোমাদের জীবন প্রেম, প্রীতি আর সৌন্দর্যে ভরে উঠুক।”
“আমরা একটা উপহারও কিনেছি তোমাদেরে দেবো বলে। আশা করি, তোমাদের পছন্দ হবে। আমি কাল দিয়ে যাবো।” বললো শিয়া য়ি হ্যাং।
মিন হুয়ে ফুলে ওঠা লাল খামটার দিকে তাকিয়ে ফিরিয়ে দিলো, “আরে, হংবাও-এর আবার কী দরকার? এতো লৌকিকতার কী আছে!”
“রু জি, আমি কী খুশি হয়েছি। আগের দিন যখন দেখা হলো, তখন তুমি বললে তোমার কোনো সম্পর্কই নেই। আর এক সপ্তাহের মধ্যে তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছো?”
শিয়া য়ি হ্যাং একটা ঠাট্টার ঘুষি মারলেন ঝৌ রু জিকে, বললেন, “মিন শওজিয়ে কী আকাশ থেকে পড়লেন?”
“হ্যাঁ … সঙ্গে বাচ্চাও আছে।” ঝৌ রু জি খুব অহঙ্কার দেখিয়ে জড়িয়ে ধরলো মিন হুয়েকে, “তাড়াতাড়ি করো।”
ঝৌ রু জি যখন এটা বললো, তখন ইয়াও ঝি ঝু একটা লাল খাম গুঁজে দিচ্ছিলো মিন হুয়ের হাতে, মিন হুয়ের শরীর থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো, মিন হুয়ে কিছুতেই আটকাতে পারলো না, “মানুষে মানুষে কতো তফাত, মিন হুয়ে। আমার সঙ্গে যখন ছিলো ঝৌ রু জি, তখন ও কিছুতেই বাচ্চা নিতে রাজি ছিলো না। বলতো চল্লিশের পর ভেবে দেখবে, আর তোমার সঙ্গে এখনই -”
“- - প্ল্যানে ছিলো না এটা।” কাঁধ ঝাড়া দিলো ঝৌ রু জি।
মিন হুয়ে ভেবে পেলো না কী উত্তর দেবে ইয়াও ঝি ঝুয়ের অভিব্যক্তির। কেবল খিলখিল করে হাসলো একটু।
চিনে সমাজজীবনে বেগুনী রঙের তাৎপর্য -১ |
চিনে সমাজজীবনে বেগুনী রঙের তাৎপর্য -২ |
চিনে সমাজজীবনে বেগুনী রঙের তাৎপর্য -৩ |
দুজনকে অস্বস্তিতে দেখে ইয়াও ঝি ঝু আর কথা বাড়ালো না। চটপট প্রসঙ্গ বদলে ফেললো, “বিয়ের উৎসবটা কবে?”
“কয়েকজন বন্ধুকে হুইডং হোটেলে খেতে ডাকবো। আজ বিকেলে সময়টা আর কোথায় সে সব জানাবো। তোমাদের দুজনকেই আসতে হবে কিন্তু।”
“অবশ্যই।” শিয়া য়ি হ্যাং খুব গুরুত্ব দিকে করমর্দন করলো ঝৌ রু জির সাথে, “আমি নিশ্চয়ই আসবো। অভিনন্দন।”
“আচ্ছা, পেইন্টিংগুলো সব বাধা হয়ে গেছে। এই যে চাবিটা। তোমাকে দিয়ে দিলাম।”
ইয়াও ঝি ঝু চাবির রিং থেকে চাবিটা বার করে নিয়ে দিয়ে দিলো মিন হুয়েকে।
“আচ্ছা, আচ্ছা,” মিন হুয়ের বেশ ভালো লেগে গেলো ইয়াও ঝি ঝুকে। ওর মনে হলো যে ঝি ঝু বেশ নরম মনের মানুষ, “আমি শুনেছি যে আপনি সবে একটা বড়ো বাড়ি নিয়েছেন।”
“হ্যাঁ, আপনার প্রতিবেশীই বলতে পারেন।”
“হুহ্!”
“জি আপনাকে বলে নি বোধ হয়, আমরা আমরা তো বত্রিশ তলায় থাকি, আর তিনটে তলা ওপরে।”
ঝৌ রু জি জামা বদলাতে গিয়ে ছিলো। কথাটা কানে যেতে ভারি বিব্রত হয়ে পড়লো।
আইভি গার্ডেনের পেন্টহাউস অ্যাপার্টমেন্ট এলাকাতে সব থেকে দামী অ্যাপার্টমেন্টগুলোর মধ্যে পড়ে। চারটে শোবার ঘর, দুটো বসার ঘর, তিনটে স্নানের ঘর, দুশো স্কোয়ার মিটারের বেশি, দাম প্রায় এক কোটি পঞ্চাশ লাখ য়ুআঁ। মিন হুয়ে জানে কারণ যখন ও প্রথম বিনচেং-এ এসে ছিলো, তখন কোম্পানির একজন মহিলা এক্সেকিউটিভ এই কমিউনিটির সব থেকে ওপরের তলায় থাকতেন। তিনি আসবাব কেনার পরে সবাইকে ছবি পাঠিয়ে ছিলেন, ছবিগুলো মিন হুয়ের ওপরে গভীর প্রভাব ফেলে ছিলো।
“মিন হুয়ে, আমাকে ভুল বুঝো না -”
ইয়াও ঝি ঝু চটপট ব্যাখ্যা দিলো, “আমি বাড়িটা নিতে চেয়ে ছিলাম অনেক দিন আগেই। তখন মালিকের বেচার তাড়া ছিলো, দামটা কুড়ি লাখের মতো কমিয়ে দিয়ে ছিলো। রু জি ডাউন পেমেন্টও করে দিয়ে ছিলো। আমি ভাবি নি যে সারাই-এর কাজ এতো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তারপর আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। কিন্তু বাড়িটা আমার খুব পছন্দ। আমার মোটেই বাড়িটা বিক্রি করার ইচ্ছে ছিলো না। রু জিও খুব ভালো মানুষ। ও বলে ছিলো যে ও অপেক্ষা করবে পাকাপাকিভাবে হাতবদলের জন্য যতোদিন না আমি ডাউনপেমেন্টটা দিতে পারছি। আমি ওখানে কখনো বাস করি নি। এ বছরে য়ি হ্যাং-এর সাথে সম্পর্ক হবার পরে, য়ি হ্যাং আমাকে সাহায্য করলো ডাউনপেমেন্ট-এর ধারটা শোধ করে দিতে। সম্পত্তিটার আইনি অধিকার গত মাসে হাতবদল হয়েছে। আমরা সবে সারাই আর গোছগাছ শুরু করেছি। কিছু মনে কোরো না, রু জি আর আমি - আমরা এখনো ভালো বন্ধু। য়ি হ্যাং আগে থেকেই সহকর্মী ছিলো, আমরা অনেক সময় একসাথে আড্ডা মারি।”
“ঠিক আছে, আমি কিচ্ছু মনে করি নি।” বললো মিন হুয়ে।
“আমাদের রেজিস্টার করতে হবে।” ঘড়ির দিকে তাকালো ঝৌ রু জি, “শনিবারে দেখা হবে।”
“বাড়িটা গুছিয়ে দিয়ে আমরা চলে যাবো। এলোমেলো করে ফেলেছি সব, বড্ডো খারাপ লাগছে।”
একটা ন্যাতা কুড়িয়ে নিয়ে ইয়াও ঝি ঝু সোফাটা মুছতে লাগলো। মুছে দিতে লাগলো ওর পায়ের ছাপ সোফাটার ওপর থেকে।
“তোমাকে গোছাতে হবে না। শুধু ছবিগুলো নিয়ে গেলেই হবে। ভুলে যেও না, শোবার ঘরে আরেকটা ছবি আছে।”
“ঠিক আছে।”
চারজনে পরস্পরকে বিদায় জানালো। ঝৌ রু জি মিন হুয়ের হাত ধরে তড়তড়িয়ে চলে গেলো এলিভেটরে চড়ে।
গাড়িতে মিন হুয়ে ঠাট্টা করলো, “রু জি, তোমরা দুজন বেশ মজার। তোমরা একটা অতো বড়ো বাড়ি কিনলে, তাহলে ছাড়াছাড়ি করলে কেনো?”
“ওর ইচ্ছে, দমকা আবেগে কেনা।”
“আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে … তবুও কেনো ওর সাথে একই বাড়ির নিচের তলায় থাকো? একবার ওপরে উঠে আর আরেকবার নিচে নেমে দেখা করতে অসুবিধে হয় না?”
“ও ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছে। আমি না, আমি নয় … তুমি কী এখনো ফিরে যেতে চাও?”
“...”
“আমি জানতাম না যে বছর ঘুরতে না ঘুরতে ও প্রেমে পড়বে শিয়া য়ি হ্যাং-এর।”
“ও-ও সার্জেন?”
“প্ল্যাস্টিক সার্জেন। ওদের পুরো পরিবারের সবাই একই কাজ করে। ওর বাবা বিনচেং-এ অনেকগুলো ক্লিনিক খুলেছেন। বেইজিং-এও। সাংঘাইতে শাখা আছে। শুনেছো নিশ্চয়ই ‘ফেঙ্গ্যি জিয়ামেই প্লাস্টিক সার্জারি’-র নাম?”
“আমি শুনেছি অনেক মুভিস্টার প্ল্যাস্টিক সার্জারির জন্য ওখানে যায়।”
“হ্যাঁ। সত্যি বলতে কী শিয়া য়ি হ্যাং ভালো ডাক্তার আর খুব মজার মানুষ। ওর বাড়িতে যা টাকা আছে, তাতে ও যদি সারাদিন ঘুমিয়েও কাটায়, তাতেও ওর টাকাই টাকা রোজগার করে আনবে। আমাদের মতো মাসমাইনের লোকেদের মতো নয়, যাদের রোজগার তুলনামূলকভাবে বেশি, কিন্তু আমাদের উত্তরপশ্চিমের হাওয়া খেয়ে কাটাতে হবে যদি আমরা শুয়ে বসে থাকি।”
“তুমি কী শিয়া য়ি হ্যাং-কে খুব ভালো করে চেনো?”
“আগে ও একটা হাসপাতালে কাজ করতো। ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকে ও কাজ ছেড়ে দেয় বাবার ক্লিনিকে বাবাকে সাহায্য করবে বলে। আমিই ঝি ঝুকে ওর সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে ছিলাম। ওর নাচের দলের এক বন্ধু মুখের কিছু সূক্ষ্ম বদল করতে চাই ছিলো, সেই জন্যই আর কি। তারপর যাতায়াত বাড়তে, চেনাশোনাও বাড়লো। সব মিলিয়ে ঘটে গেছে আর কী।”
“ওরা তো সবাইকে জানিয়েও প্রেম করছে। তাহলে একসাথে থাকছে না কেনো, অন্য কোথাও?”
“আমি অন্য জায়গায় চলে যাবো ভেবে ছিলাম। কিন্তু আমি একটাও ঠিকঠাক বাসা খুঁজে পাই নি। প্রথমত, এখানকার পরিবেশটা ভালো। ব্যবস্থাপত্রও ভালো, এটা হাসপাতেলের কাছেও। দ্বিতীয়ত, ও এখানে থাকে না। আরেকটা ব্যাপার হলো যে আমি রোজ ওদের সাথে দেখা করতে চাই যাতে আমাকে দেখলে অন্তত ওরা একটা কথা ভাবে ‘ডাউন পেমেন্টের টাকাটা দেওয়া হয় নি।’ টাকাটা আমার নিজের নয়। আমার মা-বাবার টাকা।”
মিন হুয়ে ‘ফিচ’ করে একটা শব্দ করে হাসলো, “ও তুমি এখানে আছো শুধু টাকার জন্য?”
“হ্যাঁ।” ঝৌ রু জি বললো, “আমরা হাসপাতালে বড়ো বাড়িটা পেলেই এখান থেকে চলে যাবো। তোমার যদি অসুবিধে লাগে, তাহলে তুমি এখনই একটা বাসা দেখো, আস্তে আস্তে সেখানে চলে যাওয়া যাবে।”
“তাহলে এখনই এখান থেকে চলে গিয়ে কাজ নেই। আমি এসব ঝামেলার ব্যাপারে খুব অলস।”
মিন হুয়ে আশা করে নি যে পরের চার বছরেও ওর আলস্য কাটবে না। তার ছেলে সু ছন জন্মানোর পরেও আলস্য কাটে নি, ঝৌ রু জির সঙ্গে বিয়ে ভেঙে ফেলার পরেও আলস্য কাটে নি, মিন হুয়ে হাসপাতালের বড়ো বাড়িতে কোনো দিনই থাকে নি। এমন নয় যে ওর থাকার সুযোগ ঘটে নি, কিন্তু বিনচেং ইউনিভার্সিটি থেকে অনেকটা দূরে তিয়াঁরাঁ কমিউনিটি। ইউনিভার্সিটির হাসপাতাল যেখানে সেখান থেকে সাতটা বাসস্টপ পরে। গাড়িতে গেলে মোটেই দূর নয়। কিন্তু রাস্তার এই অংশটার দুর্নাম শহরের সবথেকে ভিড় এলাকা বলে। সেই জন্য কাজে যাতায়াতের জন্য সুবিধের নয়। তার ওপর সু ছন জন্মেছে জন্মগত মিট্রাল ভালভ ইন্সাফিসিয়েন্সি সেন্ট্রাল কোয়ান্টিটেটিভ রিফ্লাক্স নিয়ে। ওর বয়স খুব কম আর ওর শরীরে কোনো লক্ষণও দেখা যাই নি বলে, ডাক্তার তাড়াতাড়ি করে সার্জারি করতে বারণ করেছেন। বলেছেন, ওর একটু বেড়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে।
বাচ্চা অসুস্থ বলে মিন হুয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকে আর কোনো বয়স্ক মানুষও নেই যে ওকে সাহায্য করতে পারে। সেই জন্য কাজের বেশিরভাগটাই ও বাড়ি থেকে করে। ভাগ্য ভালো যে ঝৌ রু জি ডাক্তার। তাই সু ছনের অবস্থা কোনো সময়ে বিপজ্জনক নাকি সেটা যে কোনো অসুস্থতার শুরুতেই ধরা পড়ে যায়। চট করে স্থির করা যায় যে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে নাকি তার দরকার নেই। তার সঙ্গে, বিনচেং ইউনিভার্সিটির আওতায় যে কিন্ডারগার্টেনটা, সেটা শহরের সেরা কিন্ডারগার্টেনগুলোর একটা। কিন্ডারগার্টেনটা ইউনিভার্সিটির পুবদিকের গেটের গায়ে। সেই জন্য কিন্ডারগার্টেনটা বা’অ্যান টেকনোলজির আপিসের খুব কাছাকাছি। কেবলমাত্র ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও কর্মীদের বাচ্চারাই ঐ কিন্ডারগার্টেনে পড়তে পারে। কাজে যাতায়াতের অসুবিধে আর বাচ্চাকে ইস্কুলে দেবার-নেবার সমস্যার জন্য ঝৌ রু জি যে আবাসন পেয়ে ছিলো সেটা ভাড়া দিয়ে দিয়ে ছিলো। তাতে আইভি গার্ডেনের বাসার যে ভাড়া সেটার খানিকটা পূরণ হয়ে যায়।
প্রথম তিন বছর তিন জনের পরিবারটা ব্যস্ত কিন্তু শান্তিপূর্ণ জীবন যাপণ করলো। ঝৌ রু জি আর মিন হুয়ে দুজনেই তাদের নিজের নিজের কাজের জায়গায় প্রায় মেরুদন্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুজনেই সারাদিন নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রাতে ঘুমোতে যাবার সময় ছাড়া প্রায় কেউ কারুর সাথে কথাই বলে না। বাচ্চাও এতো ছোটো যে বাইরে গিয়ে মুভি দেখার বা কারাওকে গাইতে যাবার বা বেড়াতে যাবার ব্যাপার নেই। ফাঁকা সময়ের অধিকাংশটাই তারা পার্কে যায় বা রেস্টুরেন্টে বা সু ছনের প্রিয় খেলার মাঠে যাতে সে খেলতে পারে।
সু ছন সুন্দর দেখতে আর লাজুক। শান্ত, মনোযোগী, লেগো নিয়ে খেলতে ভালোবাসে, ভালোবাসে “লিটল্ আইনস্টাইন” দেখতে। ও কথা বলতে শুরু করেছে অনেক দেরিতে। ঝৌ রু জি সন্দেহ করছিলো বুঝি ওর অটিসম আছে। অনেক পরীক্ষা করিয়ে দেখা গেছে যে সু ছনের বোধবুদ্ধি একদম স্বাভাবিক। খানিক সময় কেটে যেতে, সু ছন হঠাতই কথা বলতে শুরু করে। শুরু করে একটা আস্ত বাক্য বলে। তারপরে বেশ কিছুদিন খুব বকবক করতো ……মিন হুয়ে কোনো দিন ঝৌ রু জিকে বলে নি যে পৃথিবীতে তার কাছের লোক দুজনঃ একজন মৃত সু তিয়াঁ আর অন্য জন সু ছনের জনক শিন ছি। মিন হুয়ে প্রায়ই ওদের কথা ভাবে। স্বপ্নে দেখে ওদের, এমনকি কখনো কখনো ঘোরের মধ্যে শুনতে পায় যে ওরা দুজনে কথা বলছে।
এসবের থেকে ওর কেবলই মনে পড়ে যায় যে একদম না চাইতেই ওর প্রাপ্তির মূল্য কতোটা আর ও কী ধ্বংস করেছে।
ওর কেবল মনে হয় যে ওর কোনো ঋণ নেই। ও কেবল আরো একটু ভালো করে বেঁচে থাকতে পারে।
সু ছনের কথা ভাবলেই, মনের গভীরে, ওর নিজের দুটো সত্তা যেনো একটা সাদা কুয়াশা দিয়ে আলাদা হয়ে যায়, যাতে দুই সত্তা যেনো পরস্পরকে স্পষ্ট দেখতে না পায়। এই ঠান্ডা স্বভাবের ছেলেটা যেনো সু তিয়াঁর পাঠানো চর, চুপচাপ দেখতে থাকে মিন হুয়েকে। ও মিন হুয়েকে ‘মা’ বলে ডাকে, কিন্তু সেই ডাকে যেনো কেমন একটা ব্যাখ্যাতীত বৈরাগ্য আছে।
সু ছন তো সু তিয়াঁ আর শিন ছির সন্তান, মিন হুয়ে কেবল ধারক, বাহক, বাইরের শরীরি আধার মাত্র। মিন হুয়ের মাঝে মধ্যে অপরাধী লাগে যে ঝৌ রু জিকে এতো জটিলতার মধ্যে জড়ানো উচিৎ হয় নি। মিন হুয়ে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি যে ঝৌ রু জিকে একটা অজানা অভিযোগের আবর্তে এনে ফেলেছে নাকি একটা অভিসম্পাতের ফাঁদে ফেলেছে।
সু ছনকে আপন সন্তানের মতোই দেখে ঝৌ রু জি। প্রথম ডাইপার থেকে সে বাবার ভূমিকা পালন করে চলেছে মনের খুশিতে। মিন হুয়ে আর ঝৌ রু জি - এই দুজনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তানের সম্ভাবনা অনেক দিন হলো লোপ পেয়েছে।
সু তিয়াঁর ডায়েরিটাকে একটা ই-বুক বানিয়ে নিয়েছে মিন হুয়ে, রেখে দিয়েছে নিজের মোবাইল ফোনে, সময় পেলেই খুলে পড়তে থাকে। ডাইরিটার সাথে মিন হুয়ে এতোই সড়গড় হয়ে উঠেছে যে প্রায় প্রত্যেক অনুচ্ছেদ তার মনে খোদাই হয়ে আছে।
“শিন ছি বললো, আমি ওরই। ও যেনো তেনো উপায়ে আমাকে ভোলানোর চেষ্টা করবে না কখনোই, ও যে আমাকে ভালোবাসে সে কথাটা সারা পৃথিবীকে জানানোর কথা তো বাদই থাক। আমরা একে অপরের, আমাদের ঝগড়া করারও দরকার নেই, আমাদের বদলানোরও দরকার নেই, আমাদের কিচ্ছু প্রমাণ করার নেই, আমার যদি ওকে কখনো দরকার পড়ে, তবে একবার একটামাত্র বাক্যে বললেই হবে, ও হাজার হাজার পাহাড় আর নদী পেরিয়ে আমার কাছে চলে আসবে।” - - সু তিয়াঁর ডায়েরি।
***
হেমন্তে যখন সু ছন কিন্ডারগার্টেনে যেতে শুরু করলো, তবে মিন হুয়ে সারা দিনের জন্য কাজে যাওয়া শুরু করতে পারলো। ততো দিনে মিন হুয়ে বা’অ্যান টেকনোলজিতে আর অ্যান্ড ডি -এর ডিরেক্টর হয়ে গেছে। কোম্পানিও তিরিশ জনের একটু বেশি থেকে বেড়ে একশো জনের বেশি কর্মী রেখেছে। সব থেকে সামনের সারিতে থাকা প্রোডাক্ট MIST বাজারে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেছে। স্ব-উদ্ভাবিত স্তনের ক্যান্সারের প্যাথোলজিক্যাল ইমেজ অ্যানালিসিস সিস্টেম আর বুকের এবং ফুসফুসের ইন্টেলিজেন্ট ইমেজ ডায়াগনোসিস সিস্টেম - দুটোই ক্লিনিক্যাল টেস্টিং-এর পর্যায়ে, আর এ দুটোই চিনের কয়েক ডজন শীর্ষস্থানীয় শাখাবহুল হাসপাতালের সাথে সহায়তার সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছে। এ সবের সাথে কোম্পানি একটা ক্লাউড নির্ভর CAD প্রোডাক্টও বানাচ্ছে যার লক্ষ্য হলো যে হাসপাতালগুলোর মধ্যে তথ্যের, কর্মীর এবং যন্ত্রপাতির আদানপ্রদানের একটা সংস্কৃতি তৈরি করা যাতে তৃণমূল স্তরের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো যেগুলো দূর্গম দূরত্বে কাজ করে, সেগুলো তাদের অবস্থান থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত সব সাহায্যই পেতে পারে যে কোনো শহরের যে কোনো বড়ো হাসপাতালের শাখা হাসপাতালের মতোই, ক্লাউডভিত্তিক প্রোডাক্টের মাধ্যমে, যখন কঠিন এবং নানা রকমের রোগের চিকিৎসা করতে হবে, তখন।
মিন হুয়ে আগাপাশতলা ইঞ্জিনিয়ার। যখনই সে কাজে মন দেয় তখনই সে একটা আত্মবিস্মৃত অবস্থায় চলে যায়, চারপাশের মানুষজনের পরিস্থিতি এবং সম্পর্কের কোনো পরিবর্তনের আওয়াজই আর ওর কানে ঢোকে না। একটার পর একটা ডেডলাইনে বেদম হয়ে রাতের পর রাত জেগে কাটানো ওর স্বাভাবিক অভ্যেসের মতো। ঝৌ রু জির কোনো অভিযোগ নেই, কারণ তারও পদোন্নতি ঘটেছে, সেও অনকোলজি বিভাগের ডাইরেক্টর হয়েছে এবং প্রায়ই লাগাতার অপরেসন করে যায়, এতো ব্যস্ত যে কখনো থামার সুযোগ পায় না।
এক দিন অবশেষে, মিন হুয়ে আর ঝৌ রু জি স্বাভাবিক সময়ে কাজের থেকে ছুটি পেলো। দুজনে একসাথে রাতের খাবার খেতে গেলো বেশ দামী রেস্টুরেন্টে। সু ছনের জন্য ছিলো তার প্রিয় ধিমে আঁচে ঝলসানো মুর্গির ডানা।
খেতে খেতে মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “অনেক দিন হলো ঝি ঝু বা য়ি হ্যাং-কে দেখে নি। ওরা কী চলে গেছে?”
“ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।”
মিন হুয়ে চমকে উঠলো, “কবে হলো?”
“তিন চার মাস আগে।”
মিন হুয়ে আর ঝৌ রু জির বিয়ের পরে, সব সময়েই ওপরের তলার অ্যাপার্টমেন্টে ঝি ঝু আর য়ি হ্যাং থাকতো। তিন বছর কেউই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় নি। দুটো পরিবার বেশ আনন্দের সঙ্গেই পড়শীর মতো লেনদেন করতো।
তবে খুব ঘন ঘন যাতায়াত ছিলো না। মিন হুয়ের পরিবারে প্রাপ্ত বয়স্করা ভীষণ ব্যস্ত, আর একটা বাচ্চা ছিলো, ওদের সময়ই ছিলো না অন্য কারুর জন্য। শিয়া য়ি হ্যাং আরো অনেকগুলো ক্লিনিক খুলছিলো। ও সব সময়েই ব্যবসার কাজে বাইরে থাকতো। ঝি ঝুও প্রায়ই বাড়ির বাইরে থাকতো কারণ তার নাচের দল সারা দেশের নানান জায়গায়, এমনকি পৃথিবীর নানান কোণে অনুষ্ঠান করতে যেতো। কিন্তু ছুটির সময়ে দুই পরিবার পস্পরের বাড়িতে যেতো, এলিভেটরে দেখা হলে গল্প জুড়তো, কদাচিৎ মাহ্ঝং-ও খেলতো, মদ খেতো, ফুটবল খেলা দেখতো, এই আরকি। মাসে বার কয়েক দেখা হয়েই যেতো।
ঝি ঝু আর য়ি হ্যাং প্রথা মতো বিয়ে করে নি। মিন হুয়ে শুনে ছিলো যে কারণটা হলো ঝি ঝু তিন বছরের বড়ো য়ি হ্যাং-এর থেকে আর ডিভোর্সি। শিয়া পরিবার অর্থাৎ য়ি হ্যাং-এর বাড়ির লোকেরা ঝি ঝুকে পুত্রবধু হিসেবে মেনে নেয় নি। ঝি ঝুও কিচ্ছুটি মনে করে নি, সারাক্ষণ য়ি হ্যাং-এর সাথে বাস করেছে।
"কেনো? সবই তো ঠিক ছিলো।”
“ঝি ঝু … ওর ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়েছে। বেশ গুরুতর অবস্থা।” বললো ঝৌ রু জি।
“সে কী! কতই বা বয়স ওর?”
অবাক হবার পালা সেরে মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “এখন কী অবস্থা? ও কি হাসপাতালে আছে? ওকে দেখতে যেতে হবে একদিন।”
“আমিই সার্জারি করেছি।”
“ওহ্”
“দুটো স্তনই বাদ দিতে হয়েছে।”
“...”
“ও … ও তো খুবই সুন্দরী।”
“হ্যাঁ” ঝৌ রু জি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
“তাহলে শিয়া য়ি হ্যাং -”
“ও যেই শুনেছে যে ঝি ঝুয়ের স্তন বাদ দিতে হবে, ও হাওয়া হয়ে গেছে … ফিরে কখনো দেখতেও আসে নি।”
দাঁত কিড়মিড় করে উঠলো ঝৌ রু জি, “বেজন্মা!”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-23.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-25.html