চেং ছিরাং-এর সঙ্গে দেখা করার পরের পরের দিন চেং গুয়াং য়ি এসে পৌঁছোলেন যেমন কথা ছিলো। তাঁর মাথার চুল ধূসর, গম্ভীর, অবসরের মুখোমুখি বয়স্ক একজন মানুষ। তাঁর অবদানের কথা ভেবে হাসপাতাল বিশেষভাবে তাঁর জন্য সিঙ্গাপুরে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে, ‘এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড স্টাডি ভিসিট’ নামে, আসলে এটা একটা সবেতন ছুটি ছিলো।
চার ঘন্টার অপরেসন খুব সার্থক হয়েছে। অপরেসনের পর তিন দিন সু ছন আইসিইউ-তে ছিলো। তারপরে ওকে জেনারেল ওয়ার্ডে দেওয়া হলো। বাচ্চাটা ব্যাথা পাবে বলে ভয় পেতো। যখন ছোটো ছিলো তখন ভীষণ কান্নাকাটি করতো যন্ত্রণায়। মিন হুয়ের ভয় ছিলো যে ছেলেটা সুস্থ হবে না ভালো করে তাই ও ছুটি নিয়ে ছিলো রাতদিন ছেলের দেখাশোনা করার জন্য। বুকের গহ্বরের ক্ষতটা খুব গভীর নয়, তবে ক্ষতটা হৃদপিন্ডের আবরনের ঠিক ওপরে। সেই জন্যই নজর রাখতে হবে যাতে ক্ষতটায় কোনো রকম সংক্রমণ না হয়। বিভ্রান্ত চোখে মিন হুয়ে দেখতে লাগলো ছেলেকে, মনের মধ্যে নানান ভয় আর ভয়। ও ভালো করে ঘুমোতেও পারলো না প্রায় এক সপ্তাহ। চেন জিয়া জুন খুব চাইছে সাহায্য করতে। ঝৌ রু জিও থেকে থেকে দেখে যাচ্ছে ওদের। কিন্তু মিন হুয়ে তার ধারণায় অনড় যে মাকেই খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চার। আর জিয়া জুনের বাচ্চা মানুষ করার অভিজ্ঞতা নেই, ও পারবে না সু ছনের খেয়াল রাখতে।
অপরেসনের চার দিন পরে যখন সু ছন জেনারেল ওয়ার্ডে এলো, তখন জিয়া জুন চিকেন স্যুপ বানিয়ে আনলো মিন হুয়ের জন্য।
তখন মিন হুয়ের কিছু মনে পড়ে গেলো, “শাও গ্য কী এর মধ্যে আর উদয় হয়েছে?”
জিয়া জুন দাঁত বার করে হাসলো, মোটেই গম্ভীর হতে পারলো না, “আমি ওকে মেরে ভাগিয়েছি, দিনের বেলা আসতে সাহস করে নি, ও কেবল রাতে আমাদের জানলায় ইঁট ছুড়েছে। কাঁচ ভেঙেছে কিছু।”
বাচ্চার অসুস্থতার জন্য মিন হুয়ে অনেকগুলো কাজ বাদ দিয়ে দিয়েছে। আগে হলে মিন হুয়ে পুলিশে খবর দিতো বা কমিউনিটি সিকিউরিটিকে ডাকতো। কিন্তু ওর শক্তি ছিলো না এতো কিছু একসঙ্গে সামলানোর। সেই জন্য বললো, “চলো, শান্ত হই। আমি দু লাখ য়ুআঁ দিয়ে দেবো ওকে। না হলে, অপেক্ষা করো সু ছন হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হওয়া অবধি। এখন বাড়িতে থাকাটাও খুব শান্তির নয়।”
জিয়া জুন আপত্তি জানিয়ে মাথা নাড়লো, “এইসব গ্যাংস্টারের সাথে রফা করার সময় কখনোই ওদের টাকা দেবে না। একবার যদি ওরা টাকার মিষ্টতা টের পায় তো ওরা মনে করবে যে এই ছুতোটা কাজে দেয়। তারপর রোজ আসবে তোমার কাছে টাকার দাবি নিয়ে।”
“তাহলে? কী করা যায়?”
“আসুক আমার কাছে, আবার মেরে ভাগাবো।”
“তুই কী আবার জেলে যেতে চাস? চেন জিয়া জুন, কতো বার বলব তোকে যে মারপিট করে সমস্যার সমাধান হবে না।”
“জিয়েজিয়ে, যাই হোক, তুমি আজকাল হাসপাতালে। ওরা তোমাকে ছুঁতে পারবে না। এটা তুমি ছাড়ো। আমি বুঝে নিচ্ছি।”
কথা বলা শেষ করে ছেলেটা একটা ভাত খাবার চামচ দিলো মিন হুয়েকে, “নাও, এখন চটপট স্যুপটা খেয়ে ফেলো।”
অল্প বয়সে যখন ওর থাকার জায়গা ছিলো না, রাস্তায় থাকতো, জিয়া জুন অনেক রকম কাজ করেছে, আবর্জনা তোলার কাজও করেছে, খাবার ডেলিভারির কাজ করেছে, ওয়্যারহাউস দেখাশোনার কাজ করেছে আর সিছুয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করেছে, সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করা ছাড়াও।
মিন হুয়ে চোখ দিয়ে ঝলসে দিলো ওকে। তারপর থার্মোস থেকে স্যুপটা ঢেলে নিলো লাঞ্চ বক্সে। এক চুমুক দিয়ে জানালো, “দারুণ স্বাদ!।”
“আরো খাও। আমি কাজে যাচ্ছি। জলদি গেলাম, রাতে আসব।”
মিন হুয়ে দেখলো চেন জিয়া জুনের চলে যাওয়া। আধ বাটি স্যুপ খাবার পর হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেলো কারুর কথা, শিগগির বার করলো ফোনের অ্যাড্রেস বুক। ওর মনে পড়ে গেলো শিন ছির এক বন্ধু আছে যে একটা বডিগার্ড কোম্পানি চালায়, তখন ওকে একটা বিজনেস কার্ড দিয়ে ছিলো। সেই সময়ে ও বিজনেস কার্ডের একটা ছবি তুলে রেখে দিয়ে ছিলো। অনেক ক্ষণ খোঁজার পরে ও ছবিটা খুঁজে পেলো। লোকটার নাম ছিলো দেঁ চেন। কার্ডের ওপরে নাম ছিলো “সিলভার অ্যারো সিকিউরিটি সার্ভিস কো.”। তাতেই লেখা ছিলো যে কোম্পানির মূল ব্যবসা হলো গণ্যমান্য লোকেদের সিকিউরিটি দেওয়া, অল্পদিনের কাজ, স্টারদের গার্ড, কর্পোরেট প্রোটেকসন, ইভেন্ট প্রোটেকসন, ইক্যুইপমেন্ট রেন্টাল ইত্যাদি।
মিন হুয়ে তাড়াহুড়ো করে ফোন করলো। কেউ একটা উত্তর দিলো, “ওয়ে …”
“আমি মিন হুয়ে, চিনতে পারছেন? চার বছর আগে শিন ছি আর আমি শিংশুই কাউন্টিতে ছিলাম? আমাদের পয়সার ব্যাগ হারিয়ে গিয়ে ছিলো, আর শিন ছি আপনাকে ডেকে ছিলো তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করার জন্য? ”
“চিনতে পারছি।” অন্য পাড় থেকে ভেসে এলো দেঁ চেন-এর শান্ত সমাহিত গলা, “মিন শওজিয়ে, আপনি কী বিপদে পড়েছেন?”
মিন হুয়ে একটা “আহ্” বলে শুরু করলো। তারপর শাও গ্যয়ের বৃত্তান্ত বললো আগাগোড়া।
“আপনি এখন কোথায় থাকেন?”
“বিনচেং-এ আছি।”
“আচ্ছা, আমার একটা আপিস আছে বিনচেং-এ। দয়া করে আমাকে আপনার পুরো ঠিকানাটা দিন আর শও গ্যয়ের পুরো নাম। আমি আজই যোগাযোগ করবো আমার বিনচেং আপিসে। কেউ না কেউ ব্যাপারটা সামলে নেবে।”
“খুব ভালো। কতো খরচা পড়বে বলুন। আমি উইচ্যাট দিয়ে টাকাটা পাঠিয়ে দেবো।”
দেঁ চেন প্রশ্নটার উত্তর দিলেন না, প্রসঙ্গ বদলে ফেললেন, “তাহলে সু তিয়াঁর দিদি - হলো গিয়ে চেন জিয়া জুন, আপনি বললেন। খুঁজে পেয়েছেন?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি নিশ্চিত?”
“হ্যাঁ। ডিএনএ তুলনা করে দেখা গেছে, ডিএনএ ডাটাবেসের তুলনার ফলাফল দেখে যোগাযোগ করেছি।”
অন্য পাশে দীর্ঘ নীরবতা ঘনালো। তারপর শোনা গেলো, “আপনি শিন ছিকে জানাচ্ছেন না কেনো? আপনি জানেন নিশ্চয়ই যে ও খুঁজছে একই লোককে।”
“তাহলে, শিন ছি … এখনো বেঁচে আছে?”
কোনো কারণে মিন হুয়ের চোখ লাল হয়ে উঠলো, “সার্জারি - ঠিকঠাক হয়ে ছিলো?”
“না, সার্জারি ভালো হয় নি। ও অনেক দিন ধরে ভুগেছে। বছর খানেক পড়াশোনাও বন্ধ করে দিতে হয় ওকে।”
“ও ছাত্র ছিলো?”
“তুমি জানতে না?”
“ও বলে নি তো।” আবার জিজ্ঞেস না করে পারলো না মিন হুয়ে, “ও এখন কেমন আছে?”
“খুব ভালো।”
“তাহলে তো ভালোই।’
মিন হুয়ে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো আর একটা ঝলমলে মুখশ্রী জেগে উঠলো ওর মনে, “সেই ছাড়াছাড়ি হয়ে ইস্তক আমি শিন ছিকে আর কখনো দেখি নি। আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ও আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না।”
যখন মিন হুয়ে শিংশুই কাউন্টি ছেড়ে যাচ্ছিলো, তখন ও বাসে বসে একটা লম্বা মেসেজ লিখে ছিলো উইচ্যাটে, ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করার চেষ্টায়। কিন্তু তার আগেই শিন ছি ওকে ব্লক করে দিয়ে ছিলো।
ও জানতো শিন ছি রাগলে দূর্বাসা মুনির থেকেও ভয়ানক। কিন্তু শিন ছি এতোটা নির্দয় সেটা ও ভাবে নি। এই কারণে ও অনেক দিন দুঃখও পেয়েছে।
“এটা তোমার আর ওর মধ্যেকার ব্যাপার নয়। এটা ওর আর সু তিয়াঁর ভাইয়ের ব্যাপার। আমার মনে হয় শিন ছিরও জানা উচিৎ।”
“আমি সেটা জিয়া জুনকে জানিয়েছি, জিজ্ঞেস করেছি যে ও শিন ছির সাথে যোগাযোগ করতে চায় কিনা। অনেক দূরত্ব, তাই জিয়া জুন রাজি হয় নি।”
ফোনের উল্টোপারে অনেকক্ষণ কোনো কথা বললেন না কেউ।
“যদি আপনার সাথে শিন ছির যোগাযোগ থাকে এখনো, তাহলে আপনি না হয় ওকে বলে দেবেন চেন জিয়া জুনের কথা। ও যদি আসতে চায় চেন জিয়া জুনের সাথে দেখা করার জন্য, আমি আপত্তি করবো না।”
দেঁ চেন “হ্যাঁ”বললেন, কিন্তু ভরসা বিশেষ দিলেন না, “আমি এখন একটা কাজের মধ্যে আছি। পরে কথা বলব?”
“ঠিক আছে।” মিন হুয়ে ফোন রেখে দিলো, দেখলো সু ছন তখনো জেগে আছে। কম্পিউটারটা চালু করে, মিন হুয়ে কাজ করতে শুরু করলো। সন্ধে সাতটা নাগাদ দেঁ চেন উইচ্যাটে একটা মেসেজ করে জানালেন, “সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। ওরা আর কখনো তোমার কাছে আসবে না।”
কৌতুহলে কামড়ে মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “কী করে সামলালেন?”
দেঁ চেনের উত্তরে মাত্র পাঁচটা শব্দ ছিলো, “তোমার সেকথা জানার দরকার নেই।”
***
যেমন মিন হুয়ে জানতো আগে থেকেই যে শনিবারে এআই শিল্পক্ষেত্র সম্বর্ধনা হবে।
সাও মু খুব অবাক হলো নিমন্ত্রণের উত্তরে সে যাবে এই কথাটা জানানোয় মিন হুয়ের তৎপরতা দেখে, “তুমি নিশ্চিত তো যে তোমার অসুবিধে হবে না? ওখানে চেং ছিরাং থাকবে কিন্তু -”
“আমিও তো কয়েকটা নেমন্তন্ন পাই। ভাবছি এবার এসবের ব্যাপারে অন্য কিছু করবো।”
“তোমার ভালো হোক।" তালি দিয়ে হেসে উঠলো সাও মু, “ব্যাপারটা অনেক আগেই এরকম হওয়া উচিৎ ছিলো। সবাই একই কাজের একই ব্যবসার বৃত্তে, যখন চোখ তুলে চাইবে, তখন আর ওকে দেখতে পাবে না, আর তুমি ওকে ভয়ও পাবে না, কেনো তুমি ওকে এড়িয়ে যাবে?”
“না।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানতে চাইলো মিন হুয়ে, “আর কে যাচ্ছে আমাদের কোম্পানি থেকে?”
“আমি।”
“সাও জিয়ে, তোমার কী না গেলেই নয়?” চটপট মাথা নোয়ালো মিন হুয়ে, “আমি অনুরোধ করছি।”
“ব্যাপার কী?”
“কিছু না, শুধু আমি চাই না যে তুমি যাও।”
“বেশ, বেশ, আমি তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করবো। আমার ছোটোটির সেদিন একটা ব্যালের অনুষ্ঠান আছে। আমি সেটাতে যাবার সুযোগ হারাতে চাই না। কিন্তু শুধু খাবারের দিকে মন দিও না, চারপাশে অনেক গুজগুজ ফুসফুস চলবে এই অনুষ্ঠানে, তাই সে সবের জন্যও কান খোলা রেখো। শুনে নিও তোমার প্রতিযোগীদের পেটে পেটে কী শয়তানি খেলছে।”
“অবশ্যই।”
রিসেপসনটা হবে ঝিজিন ক্লাবে, ঝংউয়াঁ রোডের ওপরে। বিনচেং-এর এআই গোষ্ঠী প্রায়ই এখানে জড়ো হয়। যেহেতু রিসেপসনটা একটু বেশি আনুষ্ঠানিক আয়োজন, সেহেতু পরে রাতে একটা খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও আছে। নেমতন্নর চিঠিতেই বলা ছিলো নেমতন্ন রাখতে হলে নিমন্ত্রিতকে কেমন পোষাকে যেতে হবে। মিন হুয়ে একটা সাদা রঙের এককাঁধ খোলা জামা পরল। সঙ্গে রুপোলি হাই হিল, একটা লম্বা হালকা ধূসর রঙের কোট যাতে কোনো বোতাম নেই। চোখের তলার কালি ঢাকলো অনেক পোঁচ কন্সিলার দিয়ে। তারওপরে খুব জমকালো সন্ধের মেক-আপ মাখলো। বেশ আভা হয়তো বেরোল না ত্বক থেকে, তবে খানিক চমক নিশ্চয় জাগলো। খুব খারাপ হলে মেক-আপটাকে বলা যায়, “চোখে পড়ার মতো ঢঙীর সাজ।”
ও যখন ক্লাবে পৌঁছোলো, ততোক্ষণে রিসেপসন শুরু হয়ে গেছে। ভেতরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সত্তর-আশি জন, সবাই নিচু গলায় কথা বলছে, আর অনেক জন পরিবেশক টাক্সিডো পরে পানীয় আর নানান ধরনের জলখাবার পরিবেশন করে চলেছে, ভিড়ের ভেতরে।
হয়তো গোপনীয়তা তৈরি করার জন্যই ক্লাব ঘরের ভেতরে আলোগুলো যেনো কেমন নিস্তেজ। বাঁদিকে একটা ব্যাঙ্কোয়ে হল। ওখানে আটটা গোল টেবিল পাতা আছে। কিছু লোকে এর মধ্যেই টেবিলে বসে পড়েছে, গালগল্প করছে।
মিন হুয়ে এক ঝলক দেখে নিলো। শতকরা আশিভাগ লোক পরস্পরের চেনা। নানান কোম্পানির সিইও, ভাইসপ্রেসিডেন্ট, সিটিও আর বিনিয়োগকারীরা এসে জড়ো হয়েছে।
যদি হে হাই শিয়াং একটা ব্যবসার কাজে বেজিং-এ না যেতো তাহলে নিশ্চয়ই এই জমায়েত সে ছাড়তো না। আইটি শিল্পক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা বেশ কম। উঁচু পদে কাজ করে এরকম মেয়ে হাতে গোণা। মিন হুয়ে টের পেলো পুরুষের নজর যেই না ও দরজা পেরোলো।
একজন পরিবেশক ওকে থামিয়ে জানতে চাইলো, “দাজিয়ে, আপনি কী পানীয় নেবেন কোনো?”
মিন হুয়ে একগ্লাস হুইস্কি তুলে নিলো আর ঢেলে দিলো গলায়।
পরিবেশক চলে যাচ্ছিলো, মিন হুয়ে বললো, “যাবেন না।”
মিন হুয়ে নিজের হাতের গ্লাসটাতে আরো দু গ্লাস হুইস্কি ঢেলে নিলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো সামনের ভিড়টাতে। সর্বত্র ওর চোখ চষে ফেলতে লাগলো। লক্ষ্য চেং ছিরাং।
হঠাৎ একটা কোঁকড়া চুলো, খাড়া নাকওলা লোক ওকে থামালো, “মিন হুয়ে!”
মিন হুয়ে চিনতে পারলো, শা শি কাই, শেন ল্যান টেকনোলজির সিটিও। শা শি কাই আগে য়ুআঁলাই-তেই কাজ করতো। পরে চাকরি বদল করে। ও-ও কাজ করে এআই মেডিক্যাল কেয়ারে। বা’অ্যানের মতোই শেন ল্যান টেকনোলজিরও অনেকগুলো সহযোগিতাভিত্তিক প্রজেক্ট আছে বিনচেং ইউনিভার্সিটির হাসপাতালের সঙ্গে। ফলে মিন হুয়ের সাথে শা শি কাই-এর প্রায়ই দেখা হয়ে যায় হাসপাতালে। শা শি কাই এর সাথে ঝৌ রু জিরও চেনাশোনা আছে। বলা যেতে পারে দুজনে দুজনের পরিচিত।
“আরে শি কাই যে!" চটপট বললো মিন হুয়ে।
“তুমি তো কখনো এ ধরনের মিটিং-এ আসো না। হঠাৎ আজ এলে যে?” বললো শি কাই।
“ল্বব্যাঁ গেছেন বিজনেস ট্রিপে, তাই আমাকে পাঠিয়েছেন এখানকার খবর নেবার জন্য।”
“তুমি ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছো। তোমার থেকে কিছু জানার আছে আমার।” শা শি কাই টেনে নিয়ে গেলো মিন হুয়েকে এক কোণে, আর ফিসফিস করে বললো, “হালে স্টকের দাম পড়েছে, দুম করে, অনেক উঁচু থেকে। আমি শুনেছি যে একটা অদল-বদল হতে চলেছে ওপর তলায়?”
মিন হুয়ে চমকে উঠলো, ঝটপট মাথা নাড়লো, “আমি জানি স্টকের দাম পড়েছে। কিন্তু অদল-বদল … শুনিনি কিছু এখনো। বদলটা কী হবে?”
“আমি কী ওদিক থেকে অনেক দিন চলে আসি নি? তবুও এখনো কিছু চেনাজানা আছে ওখানে। ওরা শুনেছে যা তাই বললো - কারবার খুব খারাপ। য়ুআঁলাই চেষ্টা করছে কয়েকটা সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বিক্রি করে দিয়ে লোকসান ভরতে। তাতে … তাতে বা’অ্যান নেই, তাই তো?”
“বা’অ্যান? কিছুতেই না।” মিন হুয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো, “যদিও বা’অ্যান এখন, খরচ বেশি করে আর খুব একটা রোজগারও করে না, কিন্তু বা’অ্যানের তো অনেকগুলো প্রোডাক্ট আছে। অনেকগুলো সার্টিফিকেট আর পেটেন্টও আছে। এটাকে শিল্পক্ষেত্রের প্রথম সারির কোম্পানিগুলোর একটা বলে মনে করা হয়। দূর থেকে দেখলেও, বা’অ্যানকে তো আশার আলো বলেই মনে হয়। এটাকে বেচা অসম্ভব।”
“কখনো ভেবেছো কী বা’অ্যান এই জন্য বেচা হবে না যে বা’অ্যান এখনো খুব রোজগার করে না, কিন্তু বা’অ্যান এই জন্য বেচা হবে যে বা’অ্যানকে দেখে মূল্যবান বলে মনে হয়?”
শা শি কাই ঠোঁট কুঁচকোল, “তাছাড়া য়ুআঁলাই শুরুর থেকে একটা হার্ডওয়্যার কোম্পানি। ওদের কখনোই খুব মনোযোগ ছিলো না সফ্টওয়্যারে। এদিকে বাজারে প্রতিযোগিতা ভয়ানক, এদিকে এআই-এর হোমোজিনাইজেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ এতে প্রচুর টাকা খরচা করে, ঠিক তোমাকে নিঙড়ে অন্য কেউ টাকা নিয়ে চলে যাবে। তাহলে কেনো এটা ঝটপট বেচে পয়সা করে নাও না, আর তাই দিয়ে সব গর্ত বোজাও?”
মিন হুয়েরও মনে হলো কথাটার মানে আছে। কিছুতেই না জিজ্ঞের করে পারলো না, “এই হাওয়াটা এলো কোথা থেকে? এর ওপরে কী ভরসা করা যায়??”
“আমি তো তোমার থেকে জানতে চাইছি যে এটা ভরসা করা যায় কিনা।” শা শি কাই মাথা চুলকোল, “আমার কাছে এখনো কিছু স্টক আছে য়ুআঁলাইয়ের। হেডকোয়ার্টার্সের লোকেদের সঙ্গে তুমি অনেক ওঠাবসা করেছো। একটু সাহায্য করো না কেনো আমাকে, এটা সত্যি না মিথ্যে সেটা জানতে?”
“আরে আমাদের মতো একটা সাবসডিয়ারির মিড্ল ম্যানেজমেন্ট কিভাবে জানবে এটা? যদি জানতেও পারে খোলাখুলি, তাহলে সেটা আবার ইনসাইডার ট্রেডিং হয়ে যাবে না তো?”
মিন হুয়ের মনের মধ্যে উথাল পাথাল শুরু হলো। সবে সু ছনের সার্জারি হয়েছে। জিয়া জুন সবে বাড়ি এসেছে, আজকের “কালোকে সাদা করার কারবার” এখনো শুরুই হয় নি, আর ও জানেও না যে ফল কী হবে। এখনই ওর সব থেকে বেশি দরকার ছিলো টাকার আর স্থিতিশীলতার।
“যা হোক, তুমি চেং ছিরাং-কে দেখেছো?” মিন হুয়ে জানতে চাইলো।
“আসে নি এখনো।” শা শি কাই ভ্রূ কোঁচকালো, যেনো গুজবের গন্ধ পাচ্ছে, “তুমি কী ওঁকে খুঁজছো?”
মিন হুয়ে হালকা হাসি নিয়ে বললো, “আসলে আমার কারণ আছে ওঁকে খোঁজার।”
“সিলিকন ভ্যালি থেকে এসেছেন একজন। ওঁর সাথে এখনই কথা বলেছি , তাই আমি এখন ভীষণ উত্তেজিত। যাবে নাকি একবার কথা বলতে ওঁর সাথে?”
“ঠিক আছে।”
শেষে কথাবার্তা দাঁড়ালো আধঘন্টা। শেন ল্যানের ল্বব্যাঁ, ছিয়াঁ জিয়া য়ু-এর বয়স ষাট বছর। উনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। উনি কথা বললেন খুব খোশ মেজাজে। কথা ছেড়ে যেতে মিন হুয়ের বিব্রতই লাগছিলো। যতোক্ষণ না রাতের খাওয়া-দাওয়া শুরু হলো, ততক্ষণ সবাই গল্পগুজব করতে লাগলো। তারপরে সবাই যে যার জায়গা মতো বসতেই, গল্প শেষ।
হলের মধ্যে একটু যেনো গুঞ্জন উঠলো। মিন হুয়ে একটা টেবিলে বসে ছিলো ছিয়াঁ জিয়া য়ু, শা শি কাই আর অন্যদের সাথে। মাথা ঘুরিয়ে বাঁদিকে দেখলো। চেং ছিরাং আর তার স্ত্রী ঝেং য়ি তিং খানিক আগে এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা বাঁদিকের দ্বিতীয় টেবিলে বসে ছিলেন।
ব্যাঙ্কোয়ে শুরু হলো আয়োজকের বক্তৃ্তা দিয়ে আর একটা টোস্ট উৎসর্গ করে। অনেকগুলো পদ পরিবেশন করাও হয়ে গিয়ে ছিলো গড়িয়ে যাওয়া জলের মতো। কিছুক্ষণ খাবার পরে মিন হুয়ের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। একটু আগেই ও অনেকটা মদ খেয়েছে। সেটা খানিকটা ইচ্ছে করেই হয়তো, না হলে পরের কাজটা করতে ওর সাহসে কুলোবে না।
রিসেপসনের নিমন্ত্রিতরা নিজের নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে একে অপরকে টোস্ট দিতে লাগলো। মিন হুয়ে দাঁতে দাঁত চিপে উঠে দাঁড়ালো। সাদা ওয়াইনের একটা গ্লাস তুলে নিলো হাতে। এগিয়ে গেলো চেং ছিরাং-এর টেবিলের দিকে।
মাত্র দশ পা দূরত্ব। কিন্তু মিন হুয়ের মনে হতে লাগলো যেনো ও একটা পাহাড় ডিঙোচ্ছে। আট সেন্টিমিটার হাই হিল ওর কোমরে যেনো ভয়ানক প্যাঁচ কষছে।
এই সময়ে যতো পুরুষ ছিলো চারপাশে, সবাই ওকেই দেখছিলো। হতে পারে থার্টি ফোর সি স্তন, একফুট ছয় ইঞ্চি কোমরের বেড়, লম্বা পা আর সুন্দর মুখের জন্য।
হতে পারে এই জন্যই তাকে সব পুরুষ দেখছে কারণ ও চেং ছিরাং-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। এই মূহুর্তে চেং ছিরাং পিছনে হেলে ছিলো আর একজন পরিবেশকের সাথে কথা বলছিলো, যেনো কোনো খাবারের অর্ডার দিচ্ছে।
ছিনালিপণা কী করে করতে হয় তা যেনো শেখার দরকার নেই। মিন হুয়ে হেঁটে গেলো চেং ছিরাং-এর কাছে অবধি, বসে পড়লো চেং ছিরাং-এর কোলে, জড়িয়ে ধরলো চেং ছিরাং-এর গলা আর হামলে পড়ে চুমু খেলো, তারপর অনুযোগের সুরে বললো, “ছিরাং, তোমার জন্য খুব মন কেমন করে। ও শিয়াং নিয়া।”
হঠাৎ পুরো হলে নৈশব্দ নেমে এলো। এতো চুপচাপ যে মিন হুয়ে শুনতে পাচ্ছিলো পিয়ানিস্ট ফ্রনট ডেস্কে বেঠোভেনের মুনলাইট সোনাটা বাজাচ্ছে।
সবাই হতবাক।
মিন হুয়ে আধা হাসিতে তাকিয়ে দেখলো চেং ছিরাং-এর মুখের ওপরের শানেল রুজ কোকোর দাগটাকে যেটা ও এইমাত্র লেপে দিয়েছে, ওর মুখটা হঠাৎ হিম হয়ে গেলো, আর ওর পাশে বসে ঝেং য়ি তিং ওর মাথায় একগ্লাস ওয়াইন ঢেলে দিলো।
একই সঙ্গে চেং ছিরাং-ও ওর শরীরটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো নিজের কোল থেকে -
মিন হুয়ে প্রায় পড়েই গেলো, কিন্তু ও সময় মতো টেবিলটাকে ধরে নিলো। অসাবধানতাবশত মাথা তুলে সামনে তাকালো আর দেখতে পেলো সামনে শিন ছি।
ও বসে ছিলো টেবিলের উল্টোদিকে, চেং ছিরাং-এর মুখোমুখি।