জানুয়ারি ৮, ২০১৫। নিউ ইয়র্ক
টাইমসে প্রকাশ পেয়েছে কনেক্টোমের কথা। কনেক্টোম মানুষের সমস্ত স্নায়ুকোষকে
মানচিত্রে ধরার প্রয়াস। এর লক্ষ্য হল স্নায়ুর ও সংবেদনের বিচ্ছিন্নতায় যে আচরণগত
বিচ্যুতি আজ অর্নিমেয় রোগ হিসেবে পরিচিত তার নিরাময়ের রাস্তা বাতলানো। এর সম্ভাব্য
উপজাত জ্ঞান হলো মানুষের আচরণের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা জেনে যাওয়া ও কেমন স্নায়ু
মানচিত্রের অধিকারী কিরকম আচরণ করবেন তা আগে ভাগে টের পেয়ে যাওয়া। মানে কোনো
মানুষের স্নায়ু মানচিত্র জানা থাকলে তাঁর ব্যক্তিত্ব কিংবা মেধা নিয়ে কোনো কৌতুহল
আর থাকবে না।
যাহ্, যাচ্চলে, তাহলে ইয়েলো জার্নিলিজমের কী হবে? পেজ থ্রি কলামিস্টের কী
হবে? ...... কী হবে? কী হবে? সব চরিত্ররহস্য, ব্যক্তিরহস্য কী লোপ পাবে? তাহলে
কবতে উপন্যাসের কী হবে? দার্শনিকের কী হবে?
দার্শনিক স্বার্থ সামলাতে না হয় বললেন, “কোনো মানুষের স্নায়ুমানচিত্র নির্ণয় করা অনৈতিক। এর জন্যে রাষ্ট্রকে আইন করতে
হবে যে কেবলমাত্র অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য তাঁর স্নায়ুমানচিত্র করা চলবে। আর
যেসব সুস্থ মানুষ অন্য অসুস্থের রোগ নিরাময়ের স্বার্থে স্বেচ্ছায় স্নায়ুমানচিত্র
নিরূপণে উৎসাহী হবেন তাঁদের স্নায়ুমানচিত্র নির্ণয় করা যাবে।” এর মধ্যে পুঁজিবিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী এসে বলবে, “বহুজাতিক সংস্থা দ্বারা চালিত হাসপাতালে শিশু জন্মালেই তাদের স্নায়ুমানচিত্র
তৈরি হয়ে যাবে কারণ হাসপাতালের পরিষেবা নেওয়ার শর্তই হবে যে নবজাতকের এবং
বাবা-মায়ের স্নায়ুমানচিত্র জানতে দিতে হবে।” সেই গোষ্ঠীর
দার্শনিক একটা পাঁচশ পাতার বই লিখে জলবৎ তরলং করে বোঝাবেন সাব-অলটার্ন জনতাকে যে
জন্ম থেকে মৃত্যু মানুষের দেহে স্নায়ুকোষের সংখ্যা অপরিবর্তনীয়, তাই সদ্যজাতের
স্নায়ুমানচিত্র তার মৃত্যু অবধি একই থাকবে এবং সে বাবদে অপরাধীর সাথে
স্নায়ুমানচিত্রে সাযুজ্য থাকলেই জন্মমাত্র মানুষের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা
মৃত্যুদণ্ড জারি হবে রক্ষণশীল স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায়। এই
নবোন্মোচিত স্নায়ুবোধে উদ্বেল হয়ে জনতা খেয়াল করবে না এই ভয়াবহ আশঙ্কার মূলের তথ্যটা
কৈশোরে পাঠ্যপুস্তকেই ছিল এবং পড়া হয় নি বা পড়লেও মনে রাখা যায় নি এবং সব্বাই দার্শনিক
প্রস্তাবিত স্নায়ুবাদী আন্দোলনে সামিল হবেন। যেমন গত শতকের মাঝামাঝি সিমোন দ্য
বোভোয়ার প্রাণী ও উদ্ভিদে যথাক্রমে পার্থেনোজেনেসিস আর পার্থেনোকার্পি ব্যাখা করেই
জানিয়ে দিয়েছিলেন যে নারীরা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রমাত্র নয়। আর ঘনিয়ে উঠেছিল নারীবাদ।
তাছাড়া পেজ থ্রি কলামিস্ট থেকে ইয়েলো জার্নালিস্ট এবং তাবৎ কবি ঔপন্যাসিকের
রুজি-রুটি এবং প্রতিমা ও মহিমা সংকটের কারণেও এঁরা সব্বাই এজাতীয় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে
পড়বেন। তাই স্নায়ুবাদী আন্দোলন যে ভবিষ্যতের এক মহাগণান্দোলন হতে চলেছে সে বিষয়ে
কোনো সন্দেহই আর রইল না।
স্নায়ুবাদী আন্দোলনের বিষয়টা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু সে প্রসঙ্গে আবার নারীবাদ
ও পার্থেনোকার্পি বা পার্থেনোজেনেসিসের প্রসঙ্গ কেন?
প্রসঙ্গ আছে। পার্থেনোজেনেসিস হলো নিষেক ছাড়াই স্ত্রীজাতীয় প্রাণীর ডিম্বাণু
থেকে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া। পার্থেনোকার্পি বলে ফুলের গর্ভাশয়ে কেবলমাত্র ডিম্বাণু
থেকে অপত্য সৃষ্টির ঘটনাকে। নিষেক ছাড়া মানে শুক্রাণুর সাথে ডিম্বাণুর মিলন ঘটে
না। প্রক্রিয়াটা গর্ভাশয়ে ঘটে মানে শুক্রাণু লাগেই না। এই অবধি হলো তথ্য। তার
উপপাদ্যে মাদাম বোভোয়ার বললেন যে তাহলে জীবজগতের স্ত্রীজাতীয়েরা পুরুষ ছাড়াই
সন্তান উৎপাদনে সক্ষম। কিন্তু পুরুষজাতি স্ত্রীজাতিকে দলন, পেষণ করে তাঁবেতে রাখে
কারণ তারা সন্তান ধারণ করতে পারেনা, স্ত্রীজাতীয়ের ডিম্বাণু ছাড়া অপত্য উৎপাদন
করতে পারেনা এবং সেই কারণে তাদের সন্তান উৎপাদন নিশ্চিত করতে স্ত্রীজাতিকে অবশ্য
প্রয়োজন অর্থাৎ স্ত্রীজাতীয়েরা পুরুষজাতীয়ের বিচারে কেবলমাত্র যৌন বংশবিস্তার
প্রক্রিয়ার যন্ত্র মাত্র।
কিন্তু এই উপপাদ্যে জ্ঞানের গোঁজামিল আছে। আছে রাজনৈতিক অভিসন্ধিও। আছে সত্যের
অপলাপ। জ্ঞানের গোঁজামিল হলো যে যাবতীয় প্রাণীর পার্থেনোজেনেসিস হয় না। সমস্ত
উদ্ভিদেরও পার্থেনোকার্পি হয় না। পেঁপে আর শশাজাতীয় উদ্ভিদে নেহাত প্রাকৃতিক
পদ্ধতিতেই ঘনঘন পার্থেনোজেনেসিস হয়। বেশ কিছু সমাজে মানুষ আনাজ এবং ফলের বীজকে
ঝক্কি মনে করে। সেখানে পেঁপে আর শশাজাতীয় গাছের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে কৃত্রিম
উপায়ে নিত্য ব্যবহার্য আনাজ আর ফলের গাছের শরীরে চালান করে পার্থেনোকার্পি ঘটিয়ে
নির্বীজ আনাজ আর ফল উৎপন্ন করা হয়। পার্থেনোজেনেসিস সাধারণতঃ দেখা যায় আরশোলা এবং
অন্যান্য আর্থোপোডা পর্বের প্রাণীতে আর দেখা যায় কিছু আণুবীক্ষণিক প্রাণীতে। কোনো
কোনো প্রজাতির মাছ, উভচর, সরীসৃপ আর পাখি প্রচুর খাবার, থাকার জায়গা, জল, হাওয়া
মানে বেঁচে থাকার উপযুক্ত অনুকূল পরিবেশ পেলে পার্থেনজেনেসিস ঘটিয়ে ফেলে। তবে
জীবনচক্রের ভিন্ন পর্যায়ে এবং প্রতিকূল পরিবেশে এই সব প্রজাতির জীবেরা যৌন
বংশবিস্তারও করে। যেমন কোনো কোনো সন্ধিপদ প্রাণী লার্ভা দশায় পার্থেনোজেনেসিস ঘটায়
আবার পূর্ণাঙ্গ দশায় যৌন বংশবিস্তার করে। আবার পার্থেনোজেনেসিসজাত স্ত্রীপ্রাণীরা মায়ের,
কিংবা বলা ভাল, পূর্বজের জিনগত বৈশিষ্ট্যের মাত্র অর্ধেক পায়, ফলে এরা বংশগতিতে
সহায়ক হয় না। মৌমাছির চাকে এরা কর্মী হয়েই কাটিয়ে দিতে বাধ্য হয়, রানী হতে পারে
না। কারণ অর্ধেক জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে [মানে জেনেটিক্যালি গরীব বলে ;)] এরা
উত্তরসূরীকে সম্পূর্ণ প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য দিতে পারে না বলে যথার্থ পূর্বসুরী বলে
বিবেচিত হয় না, তাই বংশগতির প্রক্রিয়া থেকে এদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এইখানে
কূটতর্ক করে বলা যায় যে প্রকৃতিই দুর্বল স্ত্রীজাতীয়কে যৌনতার থেকে অব্যাহতি দেয়,
কেউ অবলাকে যৌন ক্রীড়নক বা সন্তানোৎপাদনের যন্ত্র বলে ব্যবহার করে না। সুতরাং যারা
উল্টোটা বলছে তারা হয় মুখ্যু নয় মিথ্যেবাদী।
আর সুস্থ তর্কের স্বার্থে আরেকটু গাম্ভীর্য রেখে বলাই যায় যে যেহেতু জ্ঞান হলো
পার্থেনকার্পি বা পার্থেনোজেনেসিস মানুষে বর্তায়ই না (কোনো স্তন্যপায়ীতেই বর্তায়
না), সেহেতু, পুরুষমানুষের হাতে স্ত্রীমানুষের নিরন্তর যৌন ও অন্যান্য শারীরিক
মানসিক স্তরে নিগৃহীত হওয়া রুখতে সন্তানোৎপাদনে পুরুষের ও তাদের কামনার
অপ্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে পার্থেনকার্পি বা পার্থেনোজেনেসিস অপ্রাসঙ্গিক ও
অপ্রতুল। বরং সূচ-সিরিঞ্জের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির আলোচনা অনেক প্রাসঙ্গিক।
কিন্তু যেহেতু মানুষের অপত্য শুধুমাত্র ডিম্বাণু থেকে জন্মাতে পারে না, বা শুধুমাত্র
শুক্রাণু থেকে জন্মাতে পারে না সেহেতু সন্তানোৎপাদনে স্ত্রীমানুষেরা পুরুষমানুষকে ব্যবহার
করে নাকি উল্টোটা সেটা একটা ভুল প্রশ্ন। মানুষের অপত্য নির্ণীত হয় তার দেহকোষের নিউক্লিয়াসের তেইশ জোড়া ক্রোমোজোমের
উপস্থিতি দিয়ে। জননকোষ মানে
ডিম্বাণু বা শুক্রাণুতে এই ক্রোমোজোম সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায় যাতে নিষেকে দুটো জননকোষ
জোড়া লেগে মানুষের ভ্রূণ কোষে আবার তেইশজোড়া ক্রোমোজোমই দাখিল হয় যার মধ্য মানুষের
সোজা শিরদাঁড়া, মুক্ত অগ্রপদ
বা হাত, বসে যাওয়া কপাল আর গুরু মস্তিস্ক, চোখের রং, চুলের রং, চামড়ার রঙের তথ্য গাঁথা থাকে। যৌনপ্রক্রিয়ায় বংশবিস্তার করে এমন সব জীবের ক্ষেত্রেই
দেহকোষ আর জননকোষের ক্রোমোজোমের অঙ্কটা একই রকম। মানুষ এক্ষেত্রে কিছুমাত্র বিশিষ্ট নয়। এই সত্য আর জ্ঞান স্বীকার করতে পারলে দেখা যাবে পুরুষ
আর নারী দুই-ই প্রকৃতিতে বংশবিস্তারের যন্ত্র
মাত্র। সব গন্ডগোলের শুরু মানুষকে বিশেষ করে দেখার বাতিকে।
তাহলে কী বোভোয়ারিয়ান নারীবাদের শুরু অস্তিত্ববাদী দর্শনের ব্যাপক প্রচারের
মধ্যে আপন অস্তিত্বকে ঐতিহাসিক করে তোলার তীব্রলোভেই? [সেটা সীমান দ্য বোভোয়ারের কানেক্টোমে
হয়ত ধরা যেত। (হায়, প্রযুক্তি আবার আসতে দেরি করলে!)] তাই যা নিতান্ত মনুষ্যেতর
তাকে “সব ভাবনার শুরু মানুষ দিয়ে, মানুষকে বাদ দিয়ে কিচ্ছু ভাবা
যায় না” ফর্মুলাতে ফেলে মানুষের আপন ঘরে অশান্তি বাধিয়ে তোলা গেল।
সেই অশান্তির জোরেই কী তাবৎ পাশ্চাত্য সমাজ মেয়েদের নাগরিক সমানাধিকার যা
ভোটাধিকারে মূর্ত কিংবা সার্থক তা দিতে বাধ্য হয়েছিল? বোধ হয় নয়। কারণ নারীবাদী
আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই পৃথিবীর প্রায় একশোটা স্বাধীন দেশে নারীদের ভোটাধিকার ও
জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকার ছিল। তাছাড়া নারীবাদ যদি বাস্তবিক হতো তাহলে ভারতে
পণপ্রথা আর তার সাথে জড়িত উৎপীড়ন আর মৃত্যুও লোপ পেত। লোপ পেত ধর্ষণ আর যৌন
হেনস্থা (যেগুলোর শিকার পুরুষও, অন্য পুরুষ বা অন্য নারীর দ্বারা)। তাই নারীর রাজনৈতিক
অধিকার প্রাপ্তিতেও নারীবাদের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই, আবার সামাজিক ক্ষেত্রেও নারীবাদ ব্যাপক কোনো বদল আনে নি। কারণ হয়তো এই যে এই মতবাদ কয়েকটা সত্যকে অস্বীকার
করে। প্রথমত, স্ত্রীমানুষ যৌনকামনারহিত কোনো জন্তু নয়, দ্বিতীয়ত, ধর্ষণ আর যৌন
হেনস্থা কেবলমাত্র স্ত্রীজাতীয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এবং তৃতীয়ত অর্থনৈতিক
সক্রিয়তা নয় সচেতনতাই স্বাধিকারের প্রথম ধাপ, যখন অর্থনৈতিক সক্রিয়তা মানে রোজগার
আর অর্থনৈতিক সচেতনতা মানে হিসেব করতে পারা। একটা মানুষের কাজের ঘন্টাগুলোকে
মুদ্রার মূল্যে বদলাতেই গৃহবধুরা সব্বাই গৃহনির্মাতা হয়ে উঠেছেন, কোনো উচ্চকিত
রাষ্ট্র কাঁপানো মিছিল ছাড়াই।
কিন্তু পণপ্রথা আর কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের বঞ্চনা বন্ধ করার রাস্তা কী? পণপ্রথা
একটা দুর্নীতি, ঘুষ নেওয়ার মতো। মানুষের বংশবিস্তারের স্বার্থে একটা স্ত্রীমানুষ
আরেকটা পুরুষমানুষের সাথে জোড় বাধবে। সেই ঘটনাকে বিয়ের মতো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে
বদলে ফেলার নিতান্ত মানবিক বৈশিষ্ট্যে জুড়ে গেছে খরচ করার সামর্থ্য আর খরচ আদায়ের
দূর্নীতি। বৈশিষ্ট্যটা মানবিক, মানুষিক নয় কারণ সমস্ত জন্তুর মধ্যে কেবলমাত্র
মানুষই বিয়ে করে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের বঞ্চনাটা বেশ গোলমেলে বিষয়। যে কয়েকটামাত্র
বাধা মাইনের চাকরি পৃথিবীতে আছে তাতে মেয়েরা আর ছেলেরা সমান সমান মাইনেই পায়।
মেয়েদের রোজগার কম হতে পারে বোনাস জাতীয় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বা দিনমজুরি বা
ঘন্টামজুরির কাজে। কারণটা হয়তো নিছক শারীরবৃত্তীয় নয়। সাধারণত দেখা যায় যে রোজগারে
সন্তানবতী মেয়েরাই পিছিয়ে থাকে। তার কারণ এমন হতে পারে যে মেয়েরা মমতা বা বাৎসল্য বা
প্রেমের সাথে মিশিয়ে দেয় সেবার প্রবণতা। ফলে সন্তান কিংবা পরিবারের কোনো সদস্যের
অসুখ করলে দেখাশোনার ভার মেয়েরাই নেয়। ফলে কাজের জায়গায় তাদের অব্যাহতি নিতে হয়।
ফলে তাদের রোজগার কমে যায়। যে পরিবারে পুরুষমানুষ ঘরের কাজে আর অসুস্থ/আহত সদস্যের
দেখাশোনার কাজ করে সে পরিবারের রোজগেরে স্ত্রীমানুষের রোজগারে বাধা আসে না।
দায়িত্ববোধহীন বা দায়িত্ব নিতে অরাজি পুরুষের সাথে সন্তানোৎপাদনে অংশ নিলে
রোজগারের আর পারিবারিক দেখাশোনার দায় স্ত্রীমানুষটার কাঁধেই এসে পড়ে। হয় তাকে রোজগারে
ফাঁকি দিয়ে দেখাশোনার কাজটা করতে হয় , নয় তো খরচ বাড়িয়ে দেখাশোনার বিকল্প ব্যবস্থা
নিতে হয়। যৌনকামনা আর সন্তানাকাঙ্খার সাথে আপস না করলেই স্ত্রীমানুষের রোজগারে
কোনো বাধা নেই। পছন্দের (সন্তানের উপযুক্ত পিতা হিসাবে যৌন পছন্দের) পুরুষের
যোগ্যতার নির্ধারক বৈশিষ্ট্যগুলো সীমাবদ্ধ না রাখলে, কাজের সাথে (কি কাজ, কোথায়
কাজ, কতক্ষণ কাজ, কি পারিবারিক পরিস্থিতিতে কাজ) বেশি আপস করলেই রোজগারের হ্রাস
ঠেকানো যাবে। মানে পছন্দের পুরুষের সঙ্গ থেকে রোজগারদায়ী কাজকে বেশি গুরুত্ব দিলে,
অপ্রয়োজনীয় পুরুষকে বাতিল করে, নতুন পুরুষ খুঁজে নেওয়ার স্বাভাবিক রাস্তা ধরলে, স্ত্রীমানুষের
রোজগারে টান পড়া বন্ধ হবে। আর কাজের জায়গায় পিঠে ছুরি খাওয়াটা স্ত্রী-পুরুষ সব্বার
জন্য সমান, এমন নয় যে বেছে বেছে স্ত্রী-মানুষেরই রাস্তায় বাধা সৃষ্টি করা হয় বেশি।
তা হলে কানেক্টোম তৈরি হলে মেয়েরা দায়িত্বশীল পুরুষকে বেছে নিতে পারবে? পারবে
কিন্তু সেই পছন্দ আর রোজগার এই দুইয়ের মধ্যে কিসের সাথে আপস করবে তার ওপর নির্ভর
করবে স্ত্রীমানুষের রোজগার আর সম্পত্তির পরিমাণ।
তার মানে নারীবাদ কয়েকজন পুরুষের তৈরি অস্তিত্ববাদের একটা অনুসিদ্ধান্ত মাত্র?
এতে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। মাদাম ক্যুরির পোলোনিয়াম আবিষ্কার প্রসঙ্গে তাঁর
গবেষণার পূর্বসুরী স্ত্রী ছিলেন না পুরুষ তা তো ভাবা হয় না। তা হলে দর্শনের
ক্ষেত্রেও প্রবক্তাদের পূর্বসুরী নিয়ে ভাবাটা যথার্থ নয়। এরকম ভাবনার মুলে হয়ত এই
যে পুরুষ শব্দটার মানে কালক্রমে বদলে গেছে আর জাগতিক বোধ শুধু মাত্র মানুষের
স্বার্থে আটকে গেছে। যদি মনে করা যায় যে পুরুষ বলতে সৃষ্টির আদিমতম এক
অস্তিত্বকে বোঝানো হত আর জগত মানে মানুষের সমাজের চেয়েও বৃহত্তর অস্তিত্ব তাহলে
এতোটা তেতো লাগে না প্রসঙ্গটা। প্রমাণস্বরূপ হাজির ঈশোপনিষাদ। সেখানে আছে,
“পূষন্নেকর্ষে যমঃ, সূর্য, প্রাজাপত্য ব্যুহ রশ্মিন সমূহ
তেজ।
যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তৎ তে
পশ্যামি।
যৌহসাবসৌ পুরুষঃ
সোহমস্মিঃ।।
মানে সূর্যকে খুব ঘটা করে ডেকে বলা
হচ্ছে যে তার কী বা তেজের ছটা যাতে সে নিজেকে মুড়েছে এমন যে আমি তার কল্যাণতম
রূপটাই দেখতেই পাই। সে তুমি যেই ( যে অস্তিত্ব [পুরুষ]-ই) হও, সে আমিই। হয়তো এই শ্লোকে এটাই বলতে চাওয়া
হয়েছে যে সূর্যের মতো তেজবান অস্তিত্ব যে সৃষ্টির অংশ আমিও সেই সৃষ্টিরই ফল। এরকম
বোঝার কারণ হল যে এই উপনিষদ রচয়িতারাই খুব সরল প্রশ্ন রেখেছেন,
"কেনেষিতং
পততি প্রেষিতং মনঃ কেন প্রাণঃ প্রথম প্রৈতি যুক্তঃ।
কেনেষিতা বাচ্চমিমাঁ বদেন্তি চক্ষূঃ শ্রোত্রং ক
উ দেবৌঁ যুনক্তি।।
অর্থাৎ কার ইচ্ছেয় মন পড়ে ধেয়ে যায় (কৌতুহলী হয়, জানতে
চায়), কে প্রথম প্রাণকে (নিরন্তর) আগুয়ান হওয়াতে নিয়োজিত করেছিল, কার ইচ্ছেয়
বাকযন্ত্র বলে, চোখ কান কোন সে দেবনির্দেশে নিজের কাজে নিয়োজিত? কিংবা খুব সহজে
স্বীকার করেছেন,
“যস্যামতং তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ।
অবিজ্ঞাত বিজানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাম্।।
মানে, যে
জানে যে সে জানে আসলে সে কিছুই জানে না, যে এটুকু জানে যে সে জানে না সেই ঠিক
জানে।
হঠাৎ করে
নারীবাদ, অস্তিত্ববাদের পাশ্চাত্য দর্শনে বিচরণ থেকে লাফ দিয়ে প্রাচ্যের উপনিষদে
আসার কারণ সময়। মানুষ যখন খুব কম জানত তখন তার ধারণা আর মনোভাবগুলো, কৌতুহলগুলো
সরলভাবে বলত। তাই প্রাচ্যের উপনিষদের সমকালে পাশ্চাত্যে পিথাগোরাস খুব সহজে বলেছেন
জন্মান্তরের কথা, অমর হওয়া পর্যন্ত পুনর্জন্মের কথা যা কোনোভাবেই বস্তুচিন্তা নয়। আবার অবলীয়ায় পরিমিতি কষে গেছেন, দিয়েছেন
সমকোণী ত্রিভুজের বাহুসন্নিহিত বর্গক্ষেত্র সম্পর্কিত উপপাদ্য, যা নিতান্তই
বস্তভাবনার ফল। হয়ত এইসব অবাস্তবিক মানসিক
চিন্তা আর বস্তুনির্ভর পরিমিতি ভাবনার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব থেকেই ঘনিয়ে উঠেছে মন
আর বস্তুর তর্ক, বিশৃঙ্খলা আর বিন্যাসের তর্ক। দর্শনও প্রকৃতি আর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা বা ভাবা ছেড়ে
একেকটা মানুষের সমাজ যাপণের ভাবনার মধ্যে কেন্দ্রীভুত হয়েছে। তাই দর্শনের যে
ধারণাকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও প্রমাণের উপর নির্ভর করে বিজ্ঞান গ্রহণ বা বর্জন করত,
যাতে বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হতো আর দর্শন ব্যাপৃত হতো আরেক অন্বেষণে, তার থেকে দর্শন
সীমাবদ্ধ হয়ে গেল মানুষ আর তার সমাজের প্রশ্নে। তাই হয়তো উপনিষদ বা পিথাগোরাসের পরবর্তী শতকগুলোতে সক্রেটিস
“ভালো” খুঁজেছেন আবার হেগেল খুঁজেছেন “পরম” বা “চরম”। ব্যাক্তির এইসব খোঁজ আর তার থেকে জন্মানো মতবাদকে আশ্রয় করে
রাজনীতি ব্যক্তিকে চিন্তানায়ক করে তুলেছে, তাকে ভাবনার ইতিহাসে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
কালক্রমে ব্যক্তিই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক মতকে দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য বলে
চালানোর চেষ্টা করেছে। যেমন অস্তিত্ববাদ, নারীবাদ, মার্ক্সবাদ, আধুনিকুতা,
বিনির্মাণ।
এইসব দুরূহ
শব্দ নিয়ে এতো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা কী ভালো? বিশেষত মার্ক্সীয় দর্শনকে বৈজ্ঞানিক বলে না
মানলে যখন প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালি খাবার, চিহ্নিত হওয়ার এবং
প্রাণহানির আশঙ্কা। বৈজ্ঞানিক দর্শন? সোনার পাথরবাটি যেন। বৈজ্ঞানিক
পরীক্ষা হতে পারে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত সত্য হতে পারে। যেমন আগুন
লাগলে দাহ্যের শিখায় আলো পাওয়া যায়, শিখার কাছে গেলে তাপ
পাওয়া যায়, দাহ্য পুড়ে গেলে ছাই পড়ে থাকে। এই সত্য নিছক
প্রাকৃতিক ঘটনা। নানান পদার্থ আগুনে পুড়িয়ে এই আগুনে পোড়ার ঘটনাতে নিহিত সত্যটি
পরীক্ষা করে প্রমাণ করা গেছে। তাই ছাই দেখলেই বলা যায় যে আগুন জ্বলেছিল। এটা “ছাইয়ের মূলে আগুন কী?” এই দার্শনিক প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষালব্ধ
প্রমাণ। কিন্তু কোনো বৈজ্ঞানিক দর্শনের প্রমাণ নয়।
কিন্তু এরকমও শোনা যায় যে একটা সমাজের সব
সদস্য বিভিন্ন প্রজন্মে রাস্তার বাঁদিক দিয়ে চলে চলে এই সত্য নিরূপণ করে যে
রাস্তার বাঁদিক দিয়ে চলাই মানুষের ধর্ম। এই ক্ষেত্রে অভ্যেসকে ধর্ম বলা হলো।
তাছাড়া সত্য নিরূপণ করতে হয় না, জানতে হয়, উপলব্ধি করতে হয়। সন্দেহ হলে পরীক্ষা
করে দেখতে হয় সত্য কি অসত্য। যেমন বাতাসের অক্সিজেন জীবনের জন্য আবশ্যিক এই সত্য
পরীক্ষা করে নিতে হলে লাগে দুটো শিশি, একটা নিরেট কর্কের ছিপি, একটা ফুটোওয়ালা কর্কের
ছিপি আর দুটো আরশোলা (অথবা যে কোনো জ্যান্ত প্রাণী আর তাকে আটকে রাখার একটা বদ্ধ
আধার আরেকটা সছিদ্র আধার, ছিদ্রের মাপ এমন হবে যে জন্তু সেই ছিদ্র দিয়ে আধারের
বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে না)। পরীক্ষা
করতে হলে কর্কের ছিপি দুটোতে আর দুটো শিশির মুখে ভেসলিন লাগিয়ে প্রত্যেক শিশিতে
একটা করে আরশোলা রেখে ছিপি এঁটে দিলেই হলো। তারপর বেশ কিছু সময় পেরিয়ে যদি দেখা
যায় যে ছিপি আঁটা শিশিতে আরশোলা মরে গেছে আর যে শিশির ছিপি ফুটোওয়ালা সেই শিশির
আরশোলা বেঁচে আছে, তাহলে জীবনের জন্য বাতাসের অক্সিজেন যে অপরিহার্য সেই সত্য প্রমাণ
হয়ে যায়। কারণ বদ্ধ শিশির ভেতরের বাতাসের অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ার পরে সেই শিশির
আরশোলা বাতাসের অক্সিজেন পায় নি, আর অন্য শিশির আরশোলা নিরন্তর অক্সিজেনওয়ালা
বাতাসের যোগান পেয়েছে। এর থেকে যদি কারও সন্দেহ হয় যে বাতাসের অক্সিজেনই যে
আরশোলার প্রয়োজন সেটা সত্যি কিনা, তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাও বদ্ধ শিশিতে বাতাসের
উপাদান গ্যাসের একেকটির সাথে আরশোলাকে রেখে দিলেই পাওয়া যাবে। তার মানে নানান
শর্তে (বাতাসের অকিসেজেনের উপস্থিতিতে, অনুপস্থিতিতে, বাতাসের অন্য উপাদানের
উপস্থিতিতে) একটা ঘটনা (আরশোলার বেঁচে থাকা) ঘটে কিনা সেটা যুক্তি দিয়ে যাচাই করে
নেওয়াই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। পরীক্ষার শর্ত ও পর্যবেক্ষণের ফলাফলের মধ্যে
কার্যকারণগত সম্পর্ক স্থাপণ করাই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু শুধুমাত্র তুলনামূলক
পরিসংখ্যান থেকেই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে আসা যায় না। উদাহরণ দেওয়া যায় যে
পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো মফস্বলে মোবাইল ফোনের টাওয়ার আর নর্দমার পাঁকের গভীরতা দুটোই
গত দুদশকে বেড়েছে। বলাবাহুল্য দুজনের কোনোটার বৃদ্ধিই অপরটার বৃদ্ধির কারণ বা ফল
নয়। কারণ যে এলাকায় নর্দমা নেই সেই এলাকায় মোবাইল টাওয়ার সংখ্যায় বাড়লেও নর্দমার
পাঁক বাড়া সম্ভব নয়, কারণ নর্দমাই নেই। সংগৃহীত তথ্যের থেকে বৈজ্ঞানিক বা আবহমান সত্য
প্রমাণ করা যায় না। সংগৃহীত তথ্যের সপক্ষে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা হাজির করলেই ব্যাখ্যাটিকে
চরমসত্য বলে না মানে যে প্রতিক্রিয়াশীল তাকে মেরে ফেলে সাময়িকভাবে আরোপিত তথ্যকে
সত্য বলে গলাবাজি করা যায় মাত্র।
কিন্তু এই বিষয়ের আদি বইগুলো সব এমন দুরূহ তা
পড়ে কী বোঝা সম্ভব নাকি যে পরীক্ষা আদৌ করা হয়েছে না হয় নি। তারওপর অমন দুশো-তিনশ
বছর আগে এমন গূঢ় দর্শনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিয়ে বুঝিয়ে বলার শক্তি আদ্যিকালের
গদ্যের ছিল নাকি? কিন্তু এই গদ্যের থেকে আরও বেশি পুরোনো শেক্সপিয়রের
পদ্য, সেটা অপেক্ষাকৃত সরল। কারণ সেটা শুরুর থেকে শেষ পর্যন্ত গুছিয়ে বলা গল্প। আর
গুছিয়ে কিছু বলার না থাকলে, ইতিহাসের একেকটা অধ্যায়কে নতুন করে ব্যাখ্যা করার নামে
বস্তুপ্রমাণকে অস্বীকার করে ঘটনাপ্রবাহ নির্মাণ করে নানা দেশের নানা কালের
ইতিহাসকে সূত্রাকারে বেঁধে ঘটনাপ্রবাহের পুনরাবৃত্তি দেখানোর চেষ্টা করলে গাছের
সাথে মাছের, খাতার সাথে জাঁতার তুলনা করে উপমান আর উপমেয়ের ওপর সাযুজ্য আরোপ করলে
তা অস্বাভাবিকই দেখায়। আবার সেই অস্বাভাবিক আরোপটাই প্রাণভয়ে স্বাভাবিক বলে মেনে
নিলে মেনে নিতে হয় যে বিষয়টা দুরূহ তাই বোঝা গেল না, সাযুজ্যের কারণ স্পষ্ট করে
বোঝা গেল না। তার ওপর রয়েছে এলোপাথারি শব্দপ্রক্ষেপে গুলিয়ে যাওয়া বিষয়বস্ত। যেমন একমুখে
বলা হয় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুঁজির বিনাশ জরুরি, আরেক মুখে বলা হল
সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের কথা। এই মাতুলের সাথে বাতুলের তুলনায় আসলে কী বলা হচ্ছে,
(সমাজতন্ত্র না একনায়কতন্ত্র?) তা বোঝা গেল না। কোনটা লক্ষ্য আর কোনটা পন্থা তা
গুলিয়ে গেল। গুলিয়ে গুলিয়ে দুর্বোধ্যতা তৈরি করতে জার্মান ভাষার মধ্যবিত্ত শব্দটার
মানে বদলে করে দেওয়া হলো পুঁজিবাদী। ফলে দুদল লোকে কেবল শাস্ত্র কপচে তর্ক করে গেল
বুর্জোয়া মানে আসলে কী, বুর্জোয়া প্রোলাতারিয়েতের শত্রু, কিন্তু তার চেহারা কেমন?
এই দ্বন্দ জারি রইল শ্রেণীহীন সমাজের খোয়াবের তলায়, চর্চিত হলো আদতে এক সাংস্কৃতিক
আভিজাত্য, যার মানে শাসক বলে দেন, “ওসব
শক্ত বই, তোর মতো মুখ্যু সাধারণ মেধার প্রোলাতারিয়েত বুঝবি না কিচ্ছু পড়লে” আর শাসিত মেনে নেয় “আমি
প্রোলাতারিয়েত। কিসসু বুঝি না। বড়দাই ঠিক বলেন। তাই তিনি একনায়ক।” অর্থাৎ তত্ত্বগুলো যা যা প্রচার করল, পালনের সময় তার
কোনোটাই মানল না। কারণ তত্ত্বগুলো শিক্ষিত কেতাবি লোকেদের খেয়ালি পণ্ডিতিমাত্র।
শাসনযন্ত্র হাতে নিলেই কালকের সর্বহারা আজকের ক্ষমতাসীন শাসক হয়ে যায়। সকলের
খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পানীয়ের প্রতিশ্রুত ব্যবস্থা করতে যে বিত্ত
প্রয়োজন তার যোগাড় খোঁজে প্রাকৃতিক সম্পদে; আর প্রাকৃতিক সম্পদকে বিত্তে পরিণত
করতে যে বিত্ত (মূলধন) প্রয়োজন তা খোঁজে মধ্যবিত্তের পকেটে। ফলে মধ্যবিত্ত ক্ষয়
পায় নিম্নবিত্তে, নিম্ন বিত্ত ক্ষয় পেয়ে হয় সর্বহারা। বিত্তের ক্ষয়ে খাদ্য,
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পানীয়ের অভাব তৈরি হয়, ঘনীভূত হয়। একনায়কতন্ত্রে বাস
করেও সর্বহারার শৃঙ্খলমুক্তি হয় না। তাই বিপ্লব জারি থাকে। এটাও দ্বন্দ। ছিল, আছে,
থাকবে। রবিন হুড কিংবা চে গুয়েভারা এতে ফেঁসে যায়, কালনায়ক হয়, কিংবদন্তী হয়। তার
মানে এই দুর্বোধ্যতা তত্ত্বের নামে তত্ত্বের অনুপস্থিতিকে ঢেকে রেখে জোর করে ভুল
বোঝাবার আরেকটা শাসকসুলভ রাজনৈতিক ফিকিরমাত্র? হতে পারে, না হলে ইন্টারনেট
সর্বহারার নাগালে আসতে ১৮৪৮এর কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো-টার ভাষা বদলে https://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/communist-manifesto/ch01.htm -এ যেটা রাখা হলো সেটা সহজবোধ্য না হলেও সহজপাঠ্য করা হয়েছে কেন?
দুর্বোধ্যতার আরোপ মুছতে? কিন্তু দ্বন্দের মধ্যেকার ধাঁধাটাতো যাবে না তত্ত্বটাই
বাতিল না করে দিলে।
তাহলে মানুষের
ভালো হবে কিসে? যদি মানুষের ভালো করার কথা মানুষেই না ভাববে, যদি সবার
সমানাধিকারের কথাই না ভাববে মানুষ তাহলে মানুষ কেন? কেন আলাদা করে মানুষের কথা
ভাবা হবে? সামগ্রিক জীবনের কথা, সৃষ্টি, লয় অস্তিত্বের কথা ভাবার মধ্যেই মানুষের
কথা ভাবা হয়ে যাবে না? এই সব সরল আর দুরূহ তত্ত্ব কী সত্যিই মানুষের ভালো করার কথা
ভেবেছে? ভালো বা খারাপ, ঠিক কিংবা ভুল আসলে তো বিপরীতার্থক বিশেষণ মাত্র। যার
আখেরে একটা জিনিস বা মত বা ঘটনা লাভ আনে তার সেই জিনিস বা মত বা ঘটনাকে ভালো লাগে,
ঠিক বলে মনে হয়। ঐসব জিনিস বা মত বা ঘটনাতে যার ক্ষতি হয় তার ঐসব জিনিস বা মত বা
ঘটনাকে খারাপ লাগে, ভুল বলে মনে হয়।
তাই কানেক্টোম
যে আসছে তাতে মানুষের কী হবে? সেটা যে মানুষ যে বিশেষণে বিশ্বাস করবে তার উপর
নির্ভরশীল। আর যার কোনোটাই বিশ্বাস হবে না তার তর্কে বহু দূর।
No comments:
Post a Comment