সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং ………
কলকাতাকে করোনা গ্রাস করার আগে কলকাতা ছিল কাগ্রস্ত। এই কা কিন্তু রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর কালজয়ী সৃষ্টি জাঙ্গল বুকের অজগর ‘কা’ নয়। এই কা হলো অত্যাধুনিক সংক্ষেপণ প্রক্রিয়ায় উল্লেখিত নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, ২০১৯।
সাবেকি বা কা-এর আগে চলতি নিয়মে যে কোনও আইনকে লিখতে হয় “আইনের (সংশোধন) নাম” “সংশোধনের সাল” [উদাহরণ: Citizenship (Amendment) Act, 2019] এই ছকে। কিংবা “আইনের নাম” “আইনটি প্রথম প্রণয়ণের সাল” (সংশোধিত) [উদাহরণ: Citizenship Act, 1955 (amended)] এই চালে। অথবা, “আইনের নাম” “আইনটি প্রথম প্রণয়ণের সাল” “এযাবৎ সংশোধিত” [উদাহরণ: Citizenship Act, 1955 as amended / as amended upto date] এই বয়ানে। অনেক কিছু বদলে যাওয়ার মতো কা এসে বদলে গেছে আইন উল্লেখের চলতি পদ্ধতিটা।
সারা ভারতবর্ষ কাগ্রস্ত ছিল ২০১৯-এর শেষার্ধে এবং ২০২০-এর মার্চ অবধি। সেই থেকে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রসঙ্গটা গুলিয়েও যাচ্ছে ক্রমশ। এর সাথে জুড়ে গেছে নাগরিকত্বের রাষ্ট্রীয় খাতা (যাকে এনআরসি বললে চেনা সহজ) সংক্রান্ত নানান কথা। রাজনীতিকরা চেঁচামেচিতে জুড়েছেন জনসংখ্যার রাষ্ট্রীয় খাতাকেও। অর্থাৎ এনপিআরকে। এই সেদিন খবরের কাগজের উৎসাহে এনআরসির সঙ্গে জুড়ে গেল ফরেনার্স ট্রাইবুন্যাল। তা বাদে সাম্য ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নও ছিল নাগরিকত্ব আইনের ২০১৯ সালের সংশোধন ঘিরে। আর আছে ভারত থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ভয়।
[ভাবতে অবশ্য ভালো লাগে যে ব্রিটিশরা থাকলে নাকি যে দেশটা এমন উচ্ছন্নে যেত না সেই উচ্ছন্নে যাওয়া দেশের নাগরিকত্ব চলে যেতে পারে বলে এতোগুলো মানুষ ভীষণ বিচলিত।]
নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন এই প্রথম হলো এমন নয়। ১৯৬০, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫, ২০১৫ সালেও নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন হয়েছে। কিন্তু কখনই সেই সব সংশোধন নিয়ে এমন হট্টগোল বাধে নি যেমনটা বেধেছে ২০১৯-এর সংশোধন নিয়ে।
১৯৬০-এর সংশোধনে মুছে দেওয়া হয় মূল আইনের অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের আইনের ধারা ১৯। এই ধারা জড়িত ছিল ধারা ২-এর বিভিন্ন সংজ্ঞা এবং প্রথম তপশিলের সঙ্গে।
প্রথম তপশিল ছিল একটা ফর্দ যাতে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এর এগারটি দেশের নাম ছিল, আর ছিল আয়ারল্যান্ডের প্রজাতন্ত্র। এই এগারটা দেশের মধ্যে পাকিস্তানও ছিল। মূল আইনের ধারা ১১ এবং ১২ অনুযায়ী ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত যে কোনো দেশের নাগরিক ভারতীয় নাগরিক বলে স্বীকৃত হতে পারতেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের নাগরিকও ভারতীয় নাগরিক বলে গণ্য হতে পারতেন।
এদিকে মূল আইন মানে ১৯৫৫-এর নাগরিকত্ব আইনের ধারা ১০ (উপধারা ১, ক্লজ ৩)-এই বলা ছিল যে পাকিস্তান থেকে আসা মানুষদের নাগরিকত্ব খারিজ হয়ে যাবে যদি না তাঁদের পিতা-মাতা কিংবা পিতামহ-পিতামহী/ মাতামহ-মাতামহী কিংবা পিতামাতার পিতামহ-পিতামহী/, মাতামহ-মাতামহীদের অন্তত একজন ভারতে জন্মে থাকেন যে ভারতের সংজ্ঞা দেওয়া আছে ১৯৩৫ সালের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত ভারত সরকার আইনে এবং যদি না তাঁরা পাকিস্তান থেকে ভারতে এসে থাকেন -
- ১৯শে জুলাই ১৯৪৮-এর আগে এবং তারপর ভারতের বাইরে না গিয়ে থাকেন এবং
- ১৯শে জুলাই ১৯৪৮ থেকে ২৬শে জানুয়ারি ১৯৫০-এর মধ্যে এবং ভারত সরকারের নির্দিষ্ট আধিকারিকের কাছে নাগরিকত্বের আবেদন করে থাকেন এবং এই আবেদন করার আগের ছ মাসে ভারতে সাধারণভাবে বসবাস করে থাকেন ।
১৯৫৫ সাল থেকে আজ অবধি ধারা ১০ কখনও সংশোধন করা হয় নি। অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে গৃহীত ধারা ১০ এখনও পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। তাই এই ধারার সাথে ধারা ১১ এবং ১২-এর বিরোধ রয়ে গিয়েছিল ২০০৩ এবং ২০০৪ সালের সংশোধনে ধারা ১১ এবং ১২ এবং প্রথম তপশীল মুছে দেওয়া পর্যন্ত। এই নিয়ে ১৯৬০-এ কিংবা ২০০৩/২০০৪ সালে কোনো বিতর্ক হয় নি।
(চলবে)
লেখা : 2020
প্রকাশ : 2021, 2022
পুরো বই : https://www.amazon.com/dp/B09875SJF8