সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং ………
আবার নাম ধরে ধর্ম নিরূপণ করে নাগরিকত্ব খারিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজে যদি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা হয়, তাহলেও খুব দক্ষ ফলাফল হবে এমন আশা করা যায় না। সারাদিন ভারতীয় ভাষার নানান শব্দ আড়ি পেতে শুনে, যাচাই করে, ফেরাই করার পর ভারতীয় ভাষার কিবোর্ড যা সব শব্দ বানিয়ে দেয়, তাতে রবিউর, মতিউর, আব্দুল, সরকার, সাত্তার হালদার, পাতিদার, মন্ডল, চৌধুরি, বিশ্বাস এসবের তফাত বোঝার মতো মেধা কৃত্রিম বোদ্ধার থাকবে এতোটা আশা করা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
তাছাড়াও অসমের কিছু মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে নাগরিকত্ব আইনের ২০১৯-এর সংশোধনী অসম অ্যাকর্ডকে লঙ্ঘন করছে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব দিয়ে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের ধারায় আছে যে মূল আইনের ধারা ২-এর সংশোধনীতে আরোপিত শর্তের জেরে যাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন তাঁরা অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয় মিজোরামের নির্দিষ্ট উপজাতীয় এলাকাভুক্ত হতে পারবেন না [ধারা ৬খ, নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ (সংশোধিত)]। এর পরেও কোনও আইনি স্খলন হয়েছে কিনা সেটা সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনার বিষয়।
নাগরিকত্ব আইনের ২০১৯-এর সংশোধনী নিয়ে বিতর্কের মূলত দুটো অঙ্গ। প্রথমত, এই সংশোধনী সংবিধান প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষতাকে লঙ্ঘন করেছে কিনা। দ্বিতীয়ত, এই সংশোধনী সংবিধান প্রতিশ্রুত সাম্যের প্রতিশ্রুতিকে ভেঙেছে কিনা। তবে যাঁরা দাবি করেছেন, এই সংশোধনী সংবিধানের মূলগত কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছে, তাঁদের ভুল হচ্ছে যে, সংবিধানের মূলগত কাঠামো ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা আসে সংবিধান সংশোধন থেকে। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী সংবিধানের কাঠামোতে আঁচ লাগাতে পারবে না। খুব বেশি হলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারে অসাংবিধানিক বলে বাতিল হয়ে যেতে পারে।
দূর্গা দাস বসু লিখেছিলেন যে সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটা আইনের, আবেগের নয়। সেকুলার শব্দের বিবর্তনগত অর্থ হলো অধার্মিক। ভারতীয় সংবিধানে নিহিত দর্শন হিসেবে সেকুলার শব্দের মানে দাঁড়ায় যে রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়।
ভারতীয় সংবিধান ১৯৫০-এ সেকুলার ছিল না। ধর্মের প্রতি ভারত রাষ্ট্রের অবস্থান নাগরিকের মূলগত অধিকারগুলির মধ্যে স্বধর্ম উদযাপণের স্বাধীনতায় ও পরধর্ম সহিষ্ণুতার নির্দেশের মধ্যে নিহিত ছিল আর্টিক্ল ১৪, ১৫, ১৬ এবং আর্টিক্ল ২৫ থেকে ২৮-এ। সেকুলার শব্দারোপ ১৯৭৬-এর বিয়াল্লিশতম সংবিধান সংশোধনের ফল।
ভারতীয় সংবিধান শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিক নয়, ভারতের বাসিন্দা সমস্ত মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত করে (আর্টিক্ল ২৫)। একই সঙ্গে সংবিধান জানিয়ে দেয় যে এক ধর্মের স্বাধীনতার উদ্যাপণ অন্য ধর্মের স্বাধীনতা হরণের কারণ হতে পারবে না। ধর্মীয় সংগঠনের, আয়, ব্যয় এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ওপরও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। সংবিধান রাষ্ট্রকে অধিকার দেয় হিন্দু মন্দিরের বিভিন্ন অংশে অহিন্দু শিখ, জৈন, বৌদ্ধদের প্রবেশ অবাধ করে দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ সংবিধানের ধারা ২৫-এই হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন - ভারতে উদ্ভুত চারটি - ধর্মকে এক শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।
সংবিধানের ধারা ২৬ সমস্ত ধর্মীয় সংগঠনকে স্থাবরাস্থাবর সম্পত্তি রাখার এবং বাড়ানোর অধিকার দিয়েছে। ধারা ২৭ রাষ্ট্রকে নিষেধ করেছে এক ধর্মের প্রতিষ্ঠানে করের বোঝা চাপিয়ে সেই করজাত রাজস্ব থেকে অন্য ধর্মের প্রতিষ্ঠানকে পুষ্ট করতে। এই ব্যবস্থা সংবিধানের সূচনায় সেকুলার শব্দ জোড়ার ছাব্বিশ বছর আগে থেকেই ছিল।
ধারা ২৮ রাষ্ট্রকে নিষেধ করেছে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম প্রচার করতে। একই ধারা ধর্মীয় প্রতিষ্টানকে অনুমতি দিয়েছে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মপ্রচার করার। আবার এই ধারা জানায় যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করার আগে যদি তার পরিচালক মণ্ডলী সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মানুচারণের ব্যবস্থা করে থাকেন তাহলে সেই ব্যবস্থা রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করলেও চলতে পারে। এই ধারা আরও জানায় যে, ধর্মীয় সংগঠন পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্ত বয়স্ক ছাত্ররা (বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছাত্ররা তাদের অভিভাবকের সিদ্ধান্ত অনুসারে) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধর্মানুষ্ঠানে নাও অংশ নিতে পারেন। এই ভাবে, প্রতিষ্ঠানের ও ব্যক্তির উভয়ের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা হয়েছে ভারতীয় সংবিধানে।
(চলবে)
লেখা : 2020
প্রকাশ : 2021, 2022
পুরো বই : https://www.amazon.com/dp/B09875SJF8