Showing posts with label Bengali Short Story. Show all posts
Showing posts with label Bengali Short Story. Show all posts

Sunday, August 17, 2025

ললিতা সান্যালের উপলব্ধি

 



প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে     আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
            তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে     আরো আরো আরো দাও স্থান


আমি ললিতা সান্যাল। আজগুবি কিংবা কেউকেটা কোনোটাই নই। বলা ভালো আমি- কে, কী, কেমন – কিছুই বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমিই “সেই” কিনা টের পাই নি, এখনও। এটুকুই জানি যে আমি আমিই। আমি বাঁচতে ভীষণ ভালোবাসি; রোজ ভীষণ বাঁচার পরেও বেঁচে থাকতে আমার একটুও একঘেয়ে লাগে না। বরং প্রত্যেকটা দিনের আলাদা আলাদা বর্ণ, গন্ধ, শব্দ, স্বাদ, ছোঁয়া আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। মনে হয় যে এই অনূভুতিগুলোই আমার দিনটাকে সার্থক করে দিল। এই বোধটুকুই পরেরদিনের অপেক্ষাকে জাগিয়ে তোলে। 

এতসব লিখছি আমার মেয়ের জন্য। ও-ই আমাকে অমরত্ব দেবে, আমি চিরকাল বেঁচে থাকব, ওর মধ্যে দিয়ে, ওর মেয়ের অপত্যের মধ্যে দিয়ে। এটা যেই বুঝলাম অমনি ঠিক করলাম যে ও যেন কখনও বাঁচতে ভুলে না যায়, তাই আমার বেঁচে থাকার কৌশলটুকু, যেটা আমার একান্তই সোপার্জিত, সেটাই ওকে দিয়ে যাব। রোজকার মা-মেয়ের জীবনে আঁতের এই কথাগুলো বলাই হবে না হয়তো; আমাকেও তো আমার মা বলেন নি, নিজে নিজেই বুঝতে হয়েছে; তাই ওর জন্য অন্তত এই লেখাটুকু থাক। আমার এই অভিজ্ঞতাটুকুর জোরেই হয়তো আমার থেকেও সহজে ও কাটিয়ে উঠবে ঝড়ঝাপটা। আমরা বেঁচে থাকব আরও আত্মপ্রত্যয়ে, অনেক প্রজন্মে, পৃথিবীজুড়ে।


           “আরো আলো       আরো আলো
এই        নয়নে প্রভু ঢালো।
            সুরে সুরে বাঁশি পুরে
তুমি      আরো আরো আরো দাও তান

ভাবে বৈষ্ণব আর অহঙ্কারে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ সান্যাল বাড়িতে তিন প্রজন্মে আমিই একমাত্র মেয়ে। ললিতা নামটা ঠাকুর্দা রেখেছিলেন। আমার আগে কদাদা আর খ দাদা; আমার পরে বুবুন আর ঋক (আমি ডাকি, আর সবাই ছোটন বলে)। কদাদা জ্যাজা মানে বড়জেঠুর ছেলে; খদাদা বুবু (মেজজেঠু, আমাকে উনি বুড়ি বলে ডাকতেন, আমি চেষ্টা করতাম ওঁকে বুড়ি বলেই ডাকতে,পারতাম না, তাই বু-বু)-র ছেলে। বুবুন ছোটকু মানে ছোটকাকার ছেলে, ঋক আমার সহোদর।

আমি স্কুলে যেতে শুরু করার আগেই যেহেতু ঠিক হয়ে গিয়েছিল কদাদা ইঞ্জিনিয়ার, খদাদা ডাক্তার হবে, সুতরাং আমাকে ফিজিক্সের অধ্যাপিকাই হতে হবে। কাম্মা খুব রেগে গিয়েছিল, বুবুনের জন্য কিছুই হাই-ফাই পড়ে নেই দেখে। মানে সত্যি করেই বুবুনের জন্য বাড়িতে কোনো জল্পনা ছিল না। বেচারাকে আমরা বড় দাদা-দিদিরা তৃতীয় পুরুষ বলতাম আদর করে, বাড়ির তিন নম্বর পুত্রসন্তান বলে। আবার মেম্মা মানে খদাদার মা-ও আমাকে পছন্দ করত না। তার অনেক কারণ। এক হলো, তাঁর পরে এসে আমার মা তাঁর থেকেও বেশি আদুরে বৌ হয়ে উঠেছিল আমার জন্ম দিয়ে। তারপর জেম্মা, মানে কদাদার মা, আমাকে নিজের মেয়ের মতো আদর দিত, যেটা আমার বা মায়ের মনে না হলেও মেম্মার ঢং বলেই মনে হতো। ফলে বাড়িতে স্পষ্টতই একটা টানাপোড়েন চলত মহিলাকুলে। ঠাম্মা গত হয়েছিলেন আমি জন্মাবার আগেই। তাই এইসব দলবাজি থামার কোনো নামগন্ধ ছিল না। কিন্তু সব মিটে গেল দুম করে ঋকের জন্ম হতে।

ঋক আমার থেকে চোদ্দ বছরের ছোট। মা খুব অপরাধীর মতো আমাকে একদিন জানিয়েছিল যে আমার একটা ভাই কিংবা বোন হতে পারে মায়ের একটা অসুখের চিকিসার সূত্রে, আমি যেন মন খারাপ না করি, আমার আদর কখনও কম হবে না। শুনে খুব থতমত খেয়েছিলাম; পরে খুব আনন্দ হয়েছিল, কেমন আনন্দ? নতুন পুতুল পাওয়ার থেকেও বেশি আনন্দ। বুবুনের সাথে বড়দের কারণেই একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। তারপর দাদাই মানে ঠাকুর্দা মারা যেতে কাম্মা-ছোটকু-বুবুন অন্য বাড়িতে চলে যায়। ততদিনে কদাদা চাকরি নিয়ে ম্যাড্রাস (তখনও চেন্নাই হয় নি) হয়ে সানফ্রান্সিস্কো চলে গেছে। খদাদা বাড়িতে আসে আলে-কালে, হাসপাতালেই থাকে বেশি, শিলিগুড়িতে। তখন আমার খুব একা লাগত। মায়ের কথা শুনে কয়েকরাত ঘুমোই নি; আমি আবার খেলব ছোটবেলার মতো ভেবে, আনন্দে, উত্তেজনায়। 

ঋক ছেলে হয়ে জন্মাতে মা বোধ হয় প্রথম বাস্তবে নেমে এসেছিলেন। ছেলেও তাঁরই; মেয়ের সমান কর্তব্য শুধু নয় সমান ভালোবাসারও সে অধিকারী, আর যেই অবহেলা করুক না কেন মা ঋককে অবহেলা করতে পারবেন না। অবশ্য বাবাও অবহেলা করেন নি কখনও ঋককে। তবে ঋকের ভবিষ্যত নিয়েও কোনো জল্পনা ছিল না বাড়িতে।

আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কদাদা বাড়িতে এসেছিল। আমার আলমারি ভরে গিয়েছিল বার্বি, বানি, টেডিতে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল যে আমার সঙ্গে ওর তবেই দেখা হবে যদি আমি কখনও আমেরিকা যাই। আমি ভেবেছিলাম ঠাট্টা করছে। কিন্তু তারপর থেকে কদাদার ফোন আসা একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। টানা কয়েকমাস ধরে জেম্মার চোখ ফোলা আর হাসিখুশি জ্যাজার গোমড়া মুখ আমাকে বলে দিয়েছিল গণ্ডগোল হয়েছে কিছু একটা।

একদিন কৌতুহল আটকাতে না পেরে মাকে জিজ্ঞেসই করে ফেলেছিলাম যে ব্যাপারটা কী। মা ভারি বুদ্ধিমতী। কিছুই আর ধামাচাপা থাকবে না বুঝতে পেরেছিলেন তিনি; তাই খানিকটা সতর্কতা বাণী জুড়ে নীতিকথার মতো করে ঘটনাটা বলেছিলেন। 

কদাদা তার পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করেছিল। পাত্রীটি অবাঙালি, তামিল; অব্রাহ্মণ; অতএব সান্যাল বাড়ির বনেদিয়ানার পাশে ধূলোবালির মতো, যদিও তাঁদের বাড়িশুদ্ধ সবাই অধ্যাপক-গবেষক এবং ভদ্রমহিলা স্বয়ং বেশ নামজাদা বৈজ্ঞানিক। তিনি যখন এশিয়াটিক সোসাইটির অ্যাওয়ার্ড নিতে এসেছিলেন বাবা-মার সঙ্গে কলকাতায়, তখন কদাদাও বাড়ি এসেছিল; সেটাই শেষবার। সেবার কদাদা পাত্রীর বাড়ির সাথে আমাদের বাড়ির সবার পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিল এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়েই বিয়েটা করতে চেয়েছিল সেই ছুটিতেই। জেম্মা-জ্যাজা কদাদার সিদ্ধান্তটা অবশ্য জানতেন আরও বছর দুয়েক আগে থেকেই; কিন্তু বেচারা কদাদা জন্মেছিল বংশের বড়ছেলে হয়ে। তাই তার হঠকারিতা তার জনক-জননীও মানতে পারেন নি, কিছুতেই; দাদাই থাকলেও নাকি মানতেন না এ বিয়ে, তাই। সেবার কদাদা বিয়েটা সেরেই ফিরেছিল আমেরিকা। সেই থেকে সান্যাল বাড়ির দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে চিরকালের মতো। যাতে বাড়ির বাকি ছেলেমেয়েরা ওর মতো অবাধ্যতা না করে তাই ওকে সবার থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। সে সবার বড় হয়েও নিজের এবং বংশের কল্যাণের পরোয়া তো করেই নি বরং নিজের কামনা-বাসনায় (!) ডুবে এগিয়ে গিয়েছিল অধঃপাতের দিকে;  সেই দৃষ্টান্তে বাড়ির আশু অকল্যাণ প্রতিহত করতে কিংবা বাড়ির বাকি ছেলেপুলেদের বখে যাওয়া আটকাতেই কদাদাকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল পরিবার থেকে।   

এদিকে তখন আমার মনেও রামধনু। আমাদের ব্যাচে আমার মতো অঙ্ক কেউ কষতে পারত না। কিন্তু তনুকা ছিল সব বিষয়েই দড়। টপার ছিল অরিত্র। অরিত্র বসু। অরিত্র আমার আর তনুকার দুজনেরই বন্ধু ছিল। কিন্তু আমার প্রতি ওর বিশেষ নজরটুকু ও কোনোদিনই লুকোবার চেষ্টা করে নি। আমি প্রাণপণে তনুকার থেকে ওকে দূরে রাখার চেষ্টা করতাম। কদাদা সংক্রান্ত নীতিকথা শুনে আমার মনের সব রঙ মুছে গেল। এতোগুলো লোকের চোখের মণি থেকে চক্ষুশূল হয়ে যাব অরিত্রর জন্য ভাবলেই ভয়ে হাতপা ঠান্ডা হয়ে যেত। আমি অরিত্রকে দূরে সরাতে শুরু করেছিলাম। সেটা টের পেয়ে আরও বেশি কাছে আসতে চাইত ও। আমার রাগ হতো বুদ্ধিমান ছেলের জেদ দেখে। মাঝে মাঝে বুদ্ধিমান ছেলের অকপটতায়ও রাগ হতো। ওর কী দরকার ছিল আমার মাকে এসে বারবার বলার যে আমিও যেন ওদের মতো জয়েন্ট এন্ট্রাস দি। বিশেষতঃ এটা যখন আমার প্রতি ওর মনোযোগকে মেলে ধরে। আমাকে কয়েকদিন মা বলেছিলেন যে অরিত্র ভারি জ্যাঠা ছেলে, ব্যাঙ্কের কেরানীর ছেলে হয়ে আমার বাড়িতে আসে কিনা জয়েন্ট এন্ট্রাসের ওকালতি করতে। শেষে একদিন ওকেই অপমান করলেন এই বলে, ললিতার বড়জেঠু যে ডাক্তার সে তো সবাই জানে এখানে; ওর মেজ জেঠু ইঞ্জিনীয়ার; এঁদের ছেলেরা ঠিক উলটো; আমরা তো জানি অরিত্র, রাত-বিরেতে মানুষের  চিকিসার ডাক পেলে একটা মেয়ে তো ছুটে যেতে পারবে না, হয়তো তাতে আরেকটা লোকের প্রাণ সংশয় হবে; ইঞ্জিনীয়ারদের কাজের পরিবেশও খুব ভদ্র নয়, বিশেষতঃ আমাদের মতো বনেদী বাড়ির মেয়ের জন্য একেবারেই চলনসই নয় তাকি আমরা জানি না? ললিতা ওর বাবার মতোই ফিজিক্স পড়াবে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে; ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ারদের জন্য থিওরি বানিয়ে দেবে। না হলে তো কাকার মতো ইংরেজির মাস্টারও হতে পারত। অর্থা আমাদের পুরুষানুক্রমিক ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ারের বাড়িতে অরিত্রর মতো সেদিনের ছেলের কিসে কী হয় বোঝাবার দরকার নেই, আমি অধ্যাপক-গবেষকদের দলে ভিড়ে এইসব ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ারদের থেকে ওপরে থাকব, তাদের জন্য থিয়োরি বানিয়ে(!)। আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। অরিত্রে জন্য তো বটেই; ছোটকুর জন্যও। ছোটকু সাহিত্যের অধ্যাপক, তাঁকে হেনস্থা করতে খুব আনন্দ মায়ের, আবার বাবা যে সান্যাল বাড়িতে সেরা তাঁর অধ্যাপণারগুণে সেটা জাহির করাতেই মায়ের আহ্লাদ বেশি; কিন্তু সান্যাল বাড়িএ মধ্যে পৃথিবী বানিয়ে রেখে কোনোদিনই বুঝতে পারেন নি যে এইসব আচরণে নিজেই নিজেকে কতটা নিচে নামান। এই ঘটানার পর অরিত্র আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করে দিতে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। তারপর ও তনুকার সাথে বেশি মিশলেও আমার কিছু করার ছিল না।

এই অরিত্রই আই আই টি তে যাবে শুনে, মা আর জেম্মা মিলে তাকে ভুরিভোজ খাওয়ালেন। তনুকাও যাদবপুরে যাচ্ছিল; কিন্তু ওকে ডাকা হয় নি। আমি বুঝলাম, বৈষ্ণব এবং বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারটি গুণীর কদর করতে জানে দেখাতে অরিত্রকে ডাকা হয়েছিল, যার ভেতরে ভেতরে ছিল অনুকম্পার অহঙ্কার, কিংবা গুণী ছেলেকে যে অপমান করা হয়েছিল তার প্রায়শ্চিত্ত, অথবা দুটোই। তারপর বছর দুয়েক পরে অরিত্র আর তনুকারও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমি দুজনের জন্যই কষ্ট পাই, অথচ অত অল্প বয়সেও ওরা কেউ কাউকে দোষ দেয় নি; ভবিতব্য নয়, ঘটানাটাকে অনিবার্য বলেই মেনে নিয়েছিল।




            আরো বেদনা    আরো বেদনা
            দাও মোরে আরো চেতনা।
           দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে     করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ।


সেই দুবছরে আমার জীবনে অনেক অনেক পরিবর্তন আসে। আমি যদিও অঙ্কেই সবথেকে বেশি নম্বর পেয়েছিলাম, কিন্তু জন্মের আগে থেকে বানানো ঠিকুজি মেনে পড়তে গেলাম ফিজিক্স। না কোনো ভয় বা মালিন্য নিয়ে নয়; শুরু করেছিলাম খুব উসাহ নিয়েই। বাবা ছিলেন, বাবার বইপত্র ছিল; বাবার সেরা ছাত্রদের টিউশন ছিল; তবু যেন কী একটা ছিল না। বাবার ছাত্র অঙ্কুরদা একদিন মাকে ডেকে বলে দিয়ে গেল, লোলোর বোধ আছে, প্রকাশ নেই, তাই বিকাশও হবে না। মা রেগে গেলেন কিন্তু বাবা মোটেই রাগলেন না। অঙ্কুরদা থার্মোডিনামিক্স পড়াতো; বাবার বিষয় নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। বাবা চেষ্টা শুরু করলেন নিজে; অঙ্কুরদার মতো পারতেন না। আমার কোনো উপায় ছিল না। আসলে বাবা-মা-র মিষ্টি ব্যবহার আর আমাকে পড়ানোর দায়িত্ব পাওয়াকে অঙ্কুর পাল অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যার আশ্বাস ভেবে বসেছিল। যখন আমাকে দেওয়ালের গায়ে ঠেসে ধরে চুমু খেতে চেয়েছিল, আমার কদাদাসংক্রান্ত নীতিকথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, স্যর, আপনি আর আসবেন না। এই প্রত্যাখ্যানটায় অঙ্কুরদা অপমানিত হয়েছিল, তার শোধ তুলতেই মাকে কড়া কথাগুলো বলেছিল। তাছাড়া এই সব সাহায্যের অপেশাদারিত্ব আমাকে ক্লাসে পিছিয়ে দিচ্ছিল। আসলে জ্ঞানের জন্য পড়া আর পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়া এক নয়। একথাটা প্রমাণ হয়ে গেল প্রথম পরীক্ষার পরই। কিন্তু তবুও নিজেদের পদ্ধতি এবং আমার প্রতি বিশ্বাস্ব ও মমত্বে অটল সান্যাল পরিবার বাবার নিত্যনতুন ছাত্র আমদানী করে চলেছিল। তাঁরা ছাত্র ভালো, কিন্তু আনকোরা মাস্টার। মাস্টারমশাইয়ের সংখ্যাধিক্যে আমার নিজের মতো করে পড়ার, পরীক্ষার প্রিপেরেশনের সময়ও কমে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে আমি মনে মনে খুব, খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিএসসি পর্বেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে আমি কোনোদিনও অধ্যাপণা করতে পারব না। 

ক্লাসের সেরা ছাত্ররা সবাই চলে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটি। আমি ছোটকুর লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতাম সারাদিন। বুবুন আইএসসি পাশ করেই স্যাট দিয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিল ততদিনে। যাবার সময় জেম্মাকে বলেছিল যে মেম বউ নিয়ে ফিরবে। ঠাট্টাই; কিন্তু সান্যাল বাড়ির অহঙ্কারে লাগার জন্য যথেষ্ট। মা আর জেম্মা মিলে অমনি কাম্মার নিন্দে শুরু করে দিয়েছিল। আমি মেতেছিলাম আমার কম্পিউটারে। ছোটকুর লাইব্রেরি থেকেই আসক্তি। ইন্টারনেটেও। বাবা আমার বাইশতম জন্মদিনে তাই এগুলোই উপহার দিয়েছিলেন।

খোঁজখবর নিয়ে আমি বাবাকে জানিয়েছিলাম ইগনু-র মাস্টার্স প্রোগ্রামগুলোর কথা। সব নেড়ে ঘেঁটে খুব অনিচ্ছে নিয়েও বাবা এমসিএ-র অনুমতি দিয়েছিলেন। বাবার থেকেও বেশি দুঃখ ছিল এই সময়ে মায়ের। বাবার অধিকাংশ বন্ধুর ছেলেমেয়েরা বিদেশে; কদাদা, খদাদা, বুবুন এমনকি মায়ের তুতো ভাইবোনেদের ছেলেমেয়ারাও কেউ কেউ বিদেশে; তনুকা, অরিত্রও বিদেশে। অথচ মা কখনও ভাবেনই নি যে সান্যাল বাড়ির ঘেরাটোপের বাইরে, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের সাথে মিশে আমি বিদেশে সসম্মানে সুরক্ষিত থাকব; একলা মেয়ের চরিত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না বা চরিত্রে কোনো দাগ লাগবে না। চেনাশোনা অনেকগুলো ছেলেমেয়ে বিদেশ যাওয়াতে মায়ের মনে হতে লাগল আমাকে বিদেশে পাঠালেই সান্যাল বাড়ির টলে যাওয়া সম্মান ফিরে আসবে স্বস্থাণে। তবে কিনা আমাকে তো আর হাভাতের মতো চাকরির ধান্দায় পাঠাবেন না, ছাত্র করে পাঠাবার কথা মনেও আসে নি তাঁর; সেসব কাম্মার মতো জাঁহাবাজদেরই মানায়; তাই প্রতি রবিবার পাত্রী-চাই কলামে কেবল এনআরআই পাত্রের খোঁজ শুরু করেছিলেন। তারপর প্রকৃত সৌন্দর্যে আটকাবে না জেনেও মা হাত কামড়াতে শুরু করেছিলেন আমাকে কেন কনভেন্টে পড়ান নি বলে। কিন্তু সান্যাল বাড়ির অবাক হতে আরও, আরও অনেক বাকি ছিল। যে বনেদী এনআরআই বারেন্দ্র লাহিড়ীরা কনভেন্টের ছাত্রীকে পাত্রী হিসেবে চান নি, তাঁরা বলে গেলেন, আমাদের তাড়া নেই, আমরা আরেকটু ফর্সা, আর পানপাতার মতো মুখের মেয়ে খুঁজছি; এতটা লম্বা মুখের মেয়ে আমাদের চাই না। মায়ের উদ্যম দ্বিগুণ হয়ে গেল; পরের সপ্তাহেই রায় বংশজাত বনেদী বারেন্দ্র এনআরআইয়ের সাথে কথা পাকা করে একমাসের মধ্যে ফাল্গুণের সন্ধ্যেবেলা আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। বিয়ের দশদিনের মাথায় ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল বরের; সে ফিরে গিয়েছিল হ্যুস্টনে, তার দিদি ফিরে গিয়েছিল মুম্বাই, আমি ফিরে গিয়েছিলাম সান্যালবাড়িতে। ঠিক ছিল মাস তিনেক পরে পাসপোর্ট-ভিসা সব হলে আমি বরের কাছে যাব। 

তারপর মাসখানেক রাতে ঘুমোতাম না। রয়বয়ের সঙ্গে চ্যাট করেই কেটে যেত। একপশলা জ্বর কাটিয়ে উঠে একদিন দেখলাম কাঙ্খিত আইডি-র পাশে অফলাইন আইকন। বাজ করে করে, পিং করে করে, মেল করে করে সাড়া নেই। ভিসা দরখাস্ত জমা দেওয়ার জন্য ভদ্রলোকের ঠিকানা চাইছিলেন বাবা; আমি দিতে পারছিলাম না। মা জানতে চেয়েছিলেন ঝগড়া করেছি কিনা। ওঁদের আঘাত দিতে চাই নি; কিন্তু মাসাধিক আমি তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি, সে কথা লুকোবার কোনো উপায়ই ছিল না আর। কোথা থেকে খুঁজবেন তাঁকে বাবা-জ্যাজা-বুবু? তাড়াহুড়োতে ভদ্রলোকের হ্যুস্টনের, তাঁর দিদির মুম্বাইয়ের - কোনো ঠিকানাই নেওয়া হয় নি। যে ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছিলাম বিয়ের পর সেটা নাকি ওঁরা একমাসের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন। আগরপাড়ায় মামারবাড়ি, বর্ধমানে কাকার বাড়ি গিয়ে দেখা গেল সেই সব ঠিকানাই নেই। আত্মীয়স্বজনেরাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মিলিয়ে গেছে পঞ্চাশ ভরি সোনার গয়না, নগদ দশ লাখটাকা বিদেশে ঘর সাজানোর যৌতুক, নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটের খাট, বিছানা, সোফা, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল। 

তখন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত, মার কান্না ভিজে গালের ছোঁয়ায়; মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন আর বলতেন, ভাগ্যিস, আমার মেয়েটাকে নিয়ে যায় নি ডাকাতগুলো! বার চারেক আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম। সফল হতে পারি নি, টেকনিক্যালি, খানিকটা ইমোশনালিও।


            আরো প্রেমে    আরো প্রেমে
মোর      আমি ডুবে যাক নেমে।
            সুধাধারে আপনারে
তুমি      আরো আরো আরো করো দান।


কাম্মা আর ছোটকু আমাকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন মানালি। জেম্মা, জ্যাজা বাবা-মাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন নানা মন্দিরে, দরগাতে। একসময় জেম্মা-জ্যাজা গয়া গিয়েছিলেন, কুসন্তানের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে; কদাদার পাপেই নাকি আমাদের বংশে এরকম বিপদ নেমে এসেছিল; সেবার ওঁদের সাথে বুবু আর মেম্মা গিয়েছিলেন। ফিরে এসে মেম্মা খুব কান্নাকাটি করে জানিয়েছিলেন যে অনেক সাধ্য-সাধনা করে জেম্মা-জ্যাজাকে তিনি রুখেছেন কদাদার শ্রাদ্ধ করার থেকে। তাই শুনে আবার মা বলেছিলেন, নিজের তো আর আঁচ লাগেনি, আটকাবেই তো শ্রাদ্ধ, ক্ষতি যা হবার হলো আমার মেয়েটারই, কোনোদিনই দেখতে পারত না যে ওকে। মেম্মা মায়ের এই গজগজ শুনে একটা কথাই বলেছিলেন, মাথা ঠাণ্ডা করে আমাদের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সময় হয়েছে রে, না হলে আমাদেরই দু-দুটো ছেলেমেয়ে এমন না মরে বেঁচে আছে কেন? অবাক হয়ে ভাবতাম মেম্মাও এতো সহানুভূতিশীল, আগে কখনও বুঝিনি তো!

ঋক কি বুঝত জানি না, তবে থেকে থেকে বলত, দিদিভাই, তোর বর আসবে, এই ডাকাতটা নয়, অন্য বর, দেখিস। আমি ওকে পড়াতে ভুলে যেতাম। বর, বিয়ে, কম্পিউটার চ্যাট সব ভুলে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরল পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড পেয়ে। মেশিনটার ধুলো-টুলো ঝেড়ে বসলাম। বুবুন মেল করেছে। গ্রীটিংস কার্ড পাঠিয়েছে। রিপ্লাই করলাম। একটা অচেনা আইডি থেকে আসা মেলটা স্প্যামে দেবো না মুছে দেবো ঠিক করার জন্য সাবজেক্ট লাইনে চোখ রাখতেই দেখি ফ্রম কদাদা। চোখে সেদিন জল এসে গিয়েছিল। ছোট্ট মেলে লিখেছিল, এবার ললিতা হয়ে ওঠ, সান্যালটা রাখবি না ফেলবি সেটা তোর ব্যাপার, কিন্তু ললিতাকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব একলা তোর,

এরপর পরীক্ষা, রেজাল্ট আর বাবার সাথে ঝগড়া করে প্রফেশনাল টিউটরের কাছে যাওয়ার ফাঁকে অগুণতি কাগজে সই করতে করতে কখন শুনলাম আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। শাঁখাজোড়া হাইড্রেনে ফেলে দিয়েছিলাম তারপর কোনো একসময়। সিঁদুর লাগানো বন্ধ করে দিয়েছিলাম কবে মনে নেই আর। 

পুরোন কারুর সাথেই স্বচ্ছন্দে মিশতে পারতাম না। সবার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে চলতে চাইতাম। সম্ভব ছিল না। ফাইনাল ইয়ার প্রজেক্ট করছিলাম যে কোম্পানিটায় সেটার প্রজেক্ট ম্যানেজার দিব্যেন্দুদা একদিন ডেকে বলেছিলেন, আমাদের কিছু ওপেনিং আছে, এখন প্রজেক্ট বেসড, পরে পার্মানেন্ট হতে পারে। তুমি অ্যাপ্লাই করতে চাইলে আমি রেকমেণ্ড করে দেব। 

আমার দ্বিধার প্রশ্ন ছিল না। সান্যাল বাড়ির থেকে বেরোনোর এটাই প্রথম সু্যোগ ছিল। বছরখানেক পরে ডিগ্রিও পেয়ে গেলাম। বড় কোম্পানিতে পার্মানেন্ট চাকরিও। আসলে দিব্যেন্দুদা তখন ওই কোম্পানিতে চলে গিয়েছিলেন। সময় মতো খবরও দিয়েছিলেন। এবার আর রেকমেণ্ডশনের দরকার হয় নি। এক্সপেরিয়েন্সেই হয়ে গিয়েছিল। 

আস্তে আস্তে আমি সব প্রায় ভুলেই গেছি। সপ্তায় একদিন যেতাম মাদার্স হোমে, ভলিন্টিয়ারিং করতে। অনেককে দেখে আমার মনে হতে লাগল যে অন্তত আমার বাড়িতে সবার কাছে আমি খুব আদর পেয়েছি, শুধু মেয়ে বলেই; আমি তো দুর্লভজনক ভাগ্যবতী; শুধু মেয়ে বলেই কতজনকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গেছে বাবা-মা, বা অন্য আত্মীয়। কিন্তু বাড়িতে ঋক ছাড়া বাকি সবাই আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। কারণ পুরোন বন্ধুদের সাথে সোশাল নেটওয়ারকিং সাইটে মেতে থাকতাম অফিসের পরের সময়টুকু; বাড়ির কারুর সাথে বিশেষ আড্ডা দিতাম না। ছুটির দিনে ঋকের সাথে গেমস নিয়ে মজে থাকতাম। মাঝে মাঝে মেসেও থাকতাম। তখন বড়দের মধ্যে কেবল কদাদাই নিয়মিত যোগাযোগ রাখত, (এখনও রাখে)। খদাদা আর বুবুনও রাখত, তবে কদাদার মতো নয়। সে সময়কার একটা কথা মনে পড়লে এখনও খুব হাসি পায়; তখন  খদাদা থেকে থেকেই হুমকি দিত আমাকে যে বাড়ির বাধ্য মেয়ে হয়ে ওর সাথে ওর বিয়ে নিয়ে কথা বললে ও যোগাযোগই রাখবে না। সান্যাল বাড়িতেও প্রবল গুজব তখন, খদাদা নাকি গে। 

তারপর আমার জীবনে এলো নতুন প্রজেক্ট লিডার কোরক। কোরক দত্ত। তনুকার ক্লাসমেট। বয়স এবং তনুকার সূত্র আমাদের বেশ জলদি বন্ধু করে দিয়েছিল। কোরকের বাড়িতেও যাতায়াত শুরু করেছিলাম আমি। ওর বাবা-মা-র সাথেও বেশ আলাপ হয়ে গেছিল। কোরক আমার প্রথম বন্ধু আমি যার বাড়িতে গিয়েছিলাম। এর আগে কোনোদিন কোনো বন্ধুর বাড়িতে যায় নি সান্যাল বাড়ির একমাত্র মেয়েটি। আমি টের পাচ্ছিলাম যে আমি ললিতা হয়ে উঠেছি। একদিন কদাদাকে সে কথা বলতে ও তো আমার সেলফোনে কলই করে বসল, প্রমাণ নিতে। কদাদার ছেলে, মেয়ে, বৌদি সবার সাথে গল্প শুরু হলো। শনিবার শনিবার রাত জাগা গল্প। মায়ের ভ্রূ কুঁচকে উঠছিল, বলেছিলেন, পাশের বাড়ির টুকুনের মার রাতে ঘুম ভেঙে যায় তোর বন্ধুর ফোন এলে। আমি ভাবছিলাম আমার বন্ধুই বটে; তোমাদের জন্য তো কবেই মরে গেছে সে; কিন্তু সে চোখ মেলে, বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছে; তোমরা মাথা রাখলেই আপন হতে পারবে; সে তোমাদের কখনও পর করে দেয় নি। 

বছর দেড়েক পরে এক সন্ধেবেলা আমার প্রমোশন সেলিব্রেট করতে গিয়েছিলাম কোরকের সাথে। বাড়িতে তো কেউ এসব বেলেল্লাপণা, ধিঙ্গীপণা, বাড়ির মেয়ের আপিসে কাজ করে প্রমোশন পাওয়া সেলিব্রেট করতে যাবে না। তাই আমার বন্ধু বলতে যেহেতু একমাত্র কোরক তাই ওর সাথেই সেলিব্রেট করতে গিয়েছিলাম। সেদিন কোরক প্রোপোজ করেছিল। আমি ভাবছিলাম কবে করবে, এতো ভালো লাগে ওর সাথে সময় কাটাতে, ওকে তো বিয়ে করতেই পারি। আমি উত্তরে বলেছিলাম, কোনটা তোর ভালো লাগবে, এক্ষুণি হ্যাঁ করে দিলে নাকি ভেবে দেখছি বলে দু-তিন দিন কিংবা দু-তিনবার ঘোরালে? কোরক ছদ্মরাগে বলেছিল, আমার পরোয়া আর করলি কই? সবই তো বলে দিলি। তারপর আমরা ওয়াইনের পুরো বোতলটা শেষ করেছিলাম; হাত ধরাধরি করে গঙ্গার ধারে হেঁটেছিলাম; এবং চুমু খেয়েছিলাম। আমার জীবনের প্রথম চুমু। কোরক শুনে বলেছিল, তোর মতো মফস্বলের ভালোমেয়ের থেকে আর কিই বা আশা করা যায়! উত্তরে বলেছিলাম, ভুল করছ, শহুরে চালাকচতুর, তোমার প্রেমিকা কিংবা বাগ্‌দত্তাটি ডিভোর্সি। চালাকচতুর স্বভাবসিদ্ধ বাগ্মিতায় বলেছিল, তুই থুতু ফেলে ডুবে মর, বিয়ে করেছিলি আবার চুমুও খাস নি! কী ভালো মেয়ে রে, নেকুপুশুমুনু! হঠানেশানেশা ঘোরটা কেটে গিয়েছিল, বলেছিলাম, তুই কি আমাকেই দায়ী করছিস? কোরকেরও নেশা কেটে গিয়েছিল; ও জবাবে বলেছিল, লেট বাইগোনস, বি বাইগোনস। লেটস্‌ থিঙ্ক কবে করব বিয়ে, কীভাবে করব, তার আগে বাড়িতে জানাবো কবে, কবে বাড়ির লোকেদের মিট করাব... অনেক কাজ খুকি, বাড়ি যাও, ঘুমোও, কাল থেকে আপিসের পর একঘন্টা করে লিস্টি ধরে বিয়ের যোগাড়ে নামবে বুঝলে। আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম পুরো ব্যাপারটায় কোরকের নিয়ন্ত্রণ দেখে।

সে রাতে ওয়াইনের নেশা গায়েব হয়ে গিয়েইছিল। সারারাত ঘুমোতে পারি নি অন্য আরেক নেশা, নেশা উত্তেজনায়। সে সপ্তাহের পুরোটা মেসেই ছিলাম, কোরকের সাথে রোজ দেখা করব বলে। সে কারণে পাহাড়প্রমাণ কাজ তরতর করে এগিয়েছিল। ওর বাড়িতে আমাদের বিয়ের প্রোপোজাল পাশ হলো স্মুথলি; সান্যাল বাড়িতে ডিভোর্সি মেয়ের বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না; তাও বেনের ছেলের সাথে! অতএব আমার বাড়ির বলতে বিয়েতে যাঁরা সাক্ষী ছিলেন তাঁরা হলেন কদাদা, খদাদা, বুবুন, কাম্মা, ছোটকু। সোনা ছিল না, নগদ ছিল না, ফার্নিচার ছিল না, উলু, শাঁখ, সিঁদুর কিচ্ছু ছিল না। তবু আমার রাগ হয় নি কারুর ওপর। অভিমানকেও বাসা বাধতে দিই নি কদাদার সহনশীলতার কথা ভেবে। 

পাসপোর্টের ললিতা সান্যাল আর আমি একই মানুষ। আর পৃথিবীজোড়া মানুষের ভিড়ে আমার কোনো আলাদা পরিচয় নেই, ভিড়ের একজন। তাও আমি বেঁচে থাকব মেধাতিথি, আমার মেয়ের মধ্যে দিয়ে, তার অপত্যদের মধ্যে দিয়ে। আমিও অমরত্ব পাব, ভিড়ে মিশে থাকা প্রত্যেকের মতোই। কোনো অহঙ্কার আমাকে আলাদা করতে পারবে না এই অস্তিস্বের সমুদ্র থেকে। মেধাতিথি সে কথাটাই জেনে যাবে সোজাসুজি এই লেখাটুকুর মধ্য দিয়ে; অহঙ্কারের চোরাবালির সাথে লড়াইয়ের দরকার হবে না তার। শুরুর থেকেই, ভিড়ের একজন হয়েই সে অমরত্বের সন্ধান পেয়ে যাক, নিজেকে নিয়ে সচেতন না হয়ে, সচেতন হয়ে বেঁচে থাকুক রোজ রোজ, নতুন, নতুন দিনে, মানুষ আর বেঁচে থাকাকে ভালোবেসে।



Sunday, May 18, 2025

Bengali Story - 1 অধরা


কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন   দিয়ে যাও, শেষে  দাও মুছে।
ওহে  চঞ্চল, বেলা   না যেতে খেলা  কেন তব যায় ঘুচে।


ঋক স্কুল থেকে ফেরার পথে অহেতুক দাঁড়িয়ে গেল বারোয়ারিতলার সামনে। নীল আর চিত্রল ছিল ওর সঙ্গে। তিনজনে সমান তালে সাইকেল চালিয়ে আসছিল। ফলে ওরাও প্যাডেল থেকে পা তুলে, মাটিতে কিছুদুর পা ঘষে ঘষে যত শিগগির সম্ভব থেমে গেল। ঋকেদের পাড়ায় একটা ফুটবল ম্যাচ খেলার জন্য ওরা আসছে একসাথে। নাহলে তো অন্যদিনের মতো ইংরেজি কিংবা ভূগোলের প্রাইভেট টিউশন পড়ে ফিরতে হতো যার যার বাড়ি। চিত্রল তড়বড় করে বলল, দাঁড়ালি কেন? মহাশ্বেতার ছুটি হয়ে গেলে ভিড়ে ফেঁসে যাব। মেয়েগুলো গুছিয়ে গরম নেবে শুধু দেরি হতে থাকবে। 

মহাশ্বেতা মানে মহাশ্বেতা বালিকা শিক্ষাভবন। ঋকেদের দ্বিজেন্দ্র স্মৃতি ইংলিস মিডিয়াম স্কুলের ছুটি হয় মহাশ্বেতা স্কুলের থেকে আধঘন্টা আগে। ফলে ঋকের স্কুলের ছেলেরা যারা মহাশ্বেতা স্কুল পেরিয়ে বাড়ি ফেরে তাদের সে কথাটা মাথায় রাখতে হয় নানা কারণে। ঋক বলল, আজ যখন এসে গেছি, তখন ছুটির ঘন্টা শুনে তবে যাব। 

নীল খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, আজ কোন জন বাঁটুলদেবী না বরবটি? 

ঋক বলল, বেঁটেটা বহুত গায়ে পড়া, ওটাকে দেখলে চাঁদি তেতে ওঠে। 

চিত্রল বলল, বরবটি দেখে তেতে ঊঠিস তুই? তোর ভা- -

ঋক খেঁকিয়ে উঠল, কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে শিখিস নি? 

চিত্রল সামলে নিল; বলল, এহ্‌, তুই তো দেখছি খুব সিরিয়াস! 

ঋক মুখটা ব্যাজার করে বলল, জানিস ওর ফোরামেন ওভেল থেকে ফোসা ওভেলিস তৈরি হয় নি ঠিক-ঠাক। 

নীল বলল, তার মানে ডান দিকের অ্যাট্রিয়ামে ইন্টার-অরিকুলার পার্টিসানে ফুটো! মানে মেয়েটার শরীরে তাজা রক্ত নেই!”  

ঋক খানিক উৎসাহিত হয়ে আরও বলল, তাই ওর শরীর খুবই দুর্বল; তাও বেশ গুছিয়ে পড়াশোনা করে। কিন্তু ওর বাড়িতে ওকে লস্ট কেস ধরে নিয়েছে; ওর বোনকেই নজর দেওয়া হয় বেশি

ছুটির পর বাকি মেয়েদের গুঁতোগুঁতি বাঁচিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছিল ইন্দ্রাণী। ও জোরে জোরে চলতে পারে না। রাস্তা পেরোবার জন্য যেই দাঁড়াল অমনি প্রায় ওকে ঠেলে দিয়ে দ্বিজেন্দ্রর ইউনিফর্ম পরা একটা ছেলে চলে গেল। চমকটা সামলাতে সামলাতে ওর কোমরে একটা সাইকেলের হ্যাণ্ডেল মারল এক ধাক্কা। দুর্বল মেয়েটা টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে যেতে শুনল ঠনাৎ ঠনাৎ করে ওকে ধাক্কা দেওয়া সাইকেলটা পড়ে যাচ্ছে। তারপরেই দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরল একটা ছেলে, দ্বিজেন্দ্ররই ইউনিফর্ম পরা। ততক্ষণে তিলোত্তমাদির রিক্সাটা এসে গিয়েছিল। ছেলেটা সেই রিক্সাতেই তুলে দিল ইন্দ্রাণীকে।

পরদিন স্কুল ছুটির পর নীল, চিত্রল, আর ঋক বসেছিল গঙ্গার ঘাটে। ঋকের খুব মন খারাপ। ফুটবল ম্যাচটা জেতার জন্য একবার ইন্দ্রাণীকে দেখতে পাওয়া খুব জরুরি ছিল ওর কাছে। কিন্তু যা ঘটল তারপর ম্যাচে জেতার আনন্দটা ছুঁতেই পারেনি ওকে। যদি অসুস্থ মেয়েটার সাংঘাতিক কিছু হয় ভেবে ভেবে সারারাত জেগে কেটেছে ওর। ইন্দ্রাণী তো ভাববে বেপরোয়াভাবে ঋকই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আসলে নীল মেয়েগুলোর মাঝখান দিয়ে রাস্তা করে নিয়ে কায়দা করে যেভাবে এগোচ্ছিল তাতে রাস্তা পেরোতে গিয়ে ইন্দ্রাণী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঋকও দাঁড়িয়েই পড়েছিল, কিন্তু চিত্রল পিছন থেকে ওর সাইকেলে ধাক্কা দিল বলেই না কাণ্ডটা হল। চিত্রল বলেই চলেছে, সরি, আসলে পিছনে এক গাদা রিক্সার হর্ন, মেয়েদের সাইকেলের ঘন্টি শুনে আমি তাড়া খাওয়া কুত্তার মত কনফিউজড ছিলাম রে। আমি কি তোকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছি, বল? 

সন্ধের অন্ধকার নামার মুখে উঠে পড়ল তিনজনে। ভূগোলের ক্লাস কামাই করেও ওদের মনে শান্তি এলো না। বাড়ি ফেরার পথে চিত্রল একটা গোলাপ ফুল কিনে দিল ঋককে, বলল, ইন্দুকে দিস, সব ঠিক হয়ে যাবে। 

ঋকের খুব রাগ হলো। ওর মনে হলো চিত্রলও ইন্দ্রাণীর জন্য কিছু একটা অনুভব করে, ঋকের মতোই। ও চিত্রলকে বলল, তোর যখন ওথলাচ্ছে তুইই দেখাস ওকে। তবে গোলাপটা আমি নিলাম। আজ অবধি আমাকে কোনো মেয়ে গোলাপ দেয় নি। তুই দিলি- -

পরের শনিবার ইংলিশ মিসের বাড়ি পড়তে গিয়ে মহশ্বেতার তুহিনার মুখে শুনল, ইন্দ্রাণী নাকি শয্যাশায়ী, অতএব হাফ ইয়ার্লিতে ওর ফার্স্ট হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না, বাড়ি থেকে বেরোবে না একদম মানে সারাদিন শুধু পড়বে। ও নাকি ওর সব ভাগ্য বিপর্যয়ের শোধ তোলে পরীক্ষায় নম্বর তুলে। সেদিনই বিকালে একটা গেট-ওয়েল-সুন কার্ড নিয়ে ঋক গেল ইন্দ্রাণীর বাড়ি। ইন্দ্রাণীর মা তো অবাক। এই ছেলেটা যে ইন্দ্রাণীর বন্ধু তিনি কখনও জানতেন না। ইন্দ্রাণীর ঘরে ঋককে পৌঁছে দিয়ে, খানিকক্ষণ ওদের সাথে কথা বলে উনি চলে গেলেন ঘরের কাজ সারতে। ঋকের সততায় উনি খুব অবাক হয়েছেন। ছেলেটা ঈন্দ্রাণীর চোটের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে। আজকাল এতো দৃঢ়চেতা ছেলে দেখা যায় নাকি!

মা চলে যেতে ইন্দ্রাণী বলল, কেন এসেছিস? তুই ভাবছিস তুই একটা গল্প দিলেই আমি খেয়ে নেব? 

ঋক কিছু বলল না। ইন্দ্রাণীর হাতদুটো নিজের দুই হাতের মধ্যে নিল, চুমু দিল। ঋকের চোখের জলে ভিজে গেল ইন্দ্রাণীর হাত। টিশার্টে হাত মুছে, ভারি গলায় ইন্দ্রাণী বলল, চলে যা। আর কক্ষণো আমার চারপাশে ঘুরঘুর করবি না। 

ঋক উঠে পড়ল, যেতে যেতে বলে গেল, আজ যাচ্ছি। কিন্তু আর কখনও তোর কাছে আসব না এমন কথা দিতে পারলাম না। 

ইন্দ্রাণীর রাগও হলো, আনন্দও হলো।

ইন্দ্রাণী হাফ ইয়ার্লিতে ফার্স্ট হলো। যদিও ওর মনে হচ্ছিল সারাদিন বই মুখে নিয়ে ও কেবল ঋকের কথাই ভেবছে, ঋকের পথ চেয়ে থেকেছে। কিন্তু ঋক আসে নি একবারও। যেদিন রেজাল্ট বেরোল সেদিন খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ঋকের সাথে দেখা করার। কিন্তু ঋককে সেদিন কোথাও দেখা গেল না।

হঠাৎ একদিন স্কুল যাওয়ার সময় ঋক পাশ দিয়ে চলে গেল বেশ সেজেগুজে। সেদিন দ্বিজেন্দ্রর ফাউণ্ডেশন ডে; অতএব ঋকের ছুটি। আবার ঘুরে এলো ও একটু পরে। ঠোঁটে একচিলতে হাসি ঝুলছে, চোখে মিটমিটে চাউনি। ইন্দ্রাণীর বুকে তখন ঢেউ ভেঙে চলেছে, একের পর এক; একটু রাগ লাগছে, অধৈর্য লাগছে, ভীষণ ভালো লাগছে। তারপর আবার ঘুরে এলো ঋক। আবারও। এভাবে পাকের পর পাক, রাস্তার মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ইন্দ্রাণী, ওকে গোল করে ঘিরে সাইকেলে চক্কর কেটে চলেছে ঋক। পুরো জগতে যেন কেউ নেই, কিছু নেই, শব্দ নেই, বর্ণ নেই, গন্ধ নেই, অন্ধকার নেই; শুধু এক আলোর বৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্রাণী আর বৃত্তের পরিধিটা ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছে, ক্রমশঃ কাছে আসছে ঋক। একটা পলাশ ফুল ডালপাতা সমেত ঈন্দ্রাণীকে দিয়ে ঋক বলল, যা-আ, দেরি হয়ে যাবে যে স্কুলে পৌঁছতে। 

পলাশ পাতার হালকা রঙা দিকে ঋক লিখে রেখেছিল, আমার তুই। জবাব রাখিস পলাশ পাতায়, পার্কের হাতল ভাঙা বেঞ্চের খাঁজে। তোর আমি

তারপর নিয়মিত ঋক বেঞ্চটায় খোঁজাখুঁজি করে। কিন্তু জবাব পায় না ইন্দ্রাণীর। একদিন সন্ধের মুখে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে যাওয়া বুড়োদের একজনের প্যান্ট থেকে একগোছা হলুদ পোস্ট-ইট ঝুলতে দেখে ছুট্টে গেল ঋক। হলুদ কাগজের গোছাটা টেনে নিয়ে বলল, এটা ফেলে গিয়েছিলাম বেঞ্চে, আপনার প্যাণ্টে আটকে গিয়েছিল। 

সেই কাগজে লেখা ছিল, পরশু ফুটবল মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পাড়ার বখাটে ছেলের দল ঋকেন্দ্রাণী বলে চেঁচাচ্ছিল। তুই এসব ন্যাকামি বন্ধ কর। পড়াশোনা কর। বড়ো হ। তারপর ভেবে দেখা যাবে

নিতান্ত কাগুজে জবাবে ঋকের মন ভেঙে গেল। এদিকে অঙ্ক ইংরেজি তুঙ্গ অবস্থায় থাকলেও, ভূগোল লাইফ সায়েন্সে মাজাঘষা হলেও, ইতিহাস আর ফিজিক্যাল সায়েন্সের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। পরীক্ষারও বেশি দেরি নেই, তায় মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই উচাটন থেকে মরণপণ হয়ে গেল ঋকের। সে কথা ইন্দ্রাণীকে জানাতে দেরিও করল না ঋক। এক লাইন জবাবে ইন্দ্রাণী জানিয়েছিল, "এই-ই তো ভালো, বিশেষতঃ আমার যখন বড়োবেলাটাই অনিশ্চিত

পরীক্ষা মিটতে ঋক বুঝল ইন্দ্রাণীকে আর তেমন লাগে না ওর। তারপর ও কিছুদিন দিল্লী, আগ্রা বেড়িয়ে এলো। ফের পড়াশোনা পরীক্ষার যাঁতাকল চালু হয়ে গেল। নতুন নতুন কোচিং ক্লাসে নতুন নতুন মেয়েদের সাথে আলাপ হলো। কারুর হাসি ভালো লাগল, তো কারুর বাচন ভঙ্গী। কিন্তু তার থেকে উচাটন হওয়া আর হলো না ঋকের। তারওপরে, নীল চলে গেল ব্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনিয়ার হতে, চিত্রল সুরাটে। মায়ের মতে, মানইজ্জত খুইয়ে, ঋক শুরু করল ইংরেজি অনার্স। ক্লাস ভর্তি অনেক মেয়ে, ছেলে ঋককে নিয়ে মাত্র তিনজন। তবে ঋকের ভালো লাগছিল সোসিওলজির দেবারতিকে। দেবারতিও ঋকের প্রেম স্বীকার করে নিয়েছিল।


চকিত চোখের অশ্রুসজল   বেদনায় তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে চল
   কোথা সে পথের শেষ   কোন্‌ সুদূরের দেশ
        সবাই তোমায় তাই পুছে।।

কলেজ পেরিয়ে ঋক এম এ পড়তে ঢুকল। দেবারতি দিল্লী চলে গেল। তারপর সেখান থেকে আমেরিকা। এম এ পড়তে পড়তেই একটা টিভি চ্যানেলে নিউজ সাবএডিট করার কাজ পেয়ে গেল ঋক। এম এ শেষ করে বছরটাক সেই চাকরিটাই করল। তারপর সিঙ্গাপুরের একটা নিউজ চ্যানেলে কাজ করতে চলে গেল।

বিদেশে বাঙালি ঘোঁট যেমন হয়। একজনের পোষা মুরগির ডিম আজ সবাই মিলে কিনে খেলে তো, কাল অন্য কারুর বাগানের সবজি কিনে খাও আর আদিখ্যেতার ঢেকুর তোলো। এর মধ্যে দেশ, কাল, রাজনীতি সবকিছুতে প্রযুক্তির সর্বব্যপি আগ্রাসন ঘটে চলেছে অবিরাম। এইসব মহাযজ্ঞের আগুনে ইচ্ছেয়, অনিচ্ছেয় জ্বলতে জ্বলতে ঋক কলম ধরেছে। কলম ঠেলে প্রবাসের বোরডম-এও জোর ঠেলা দেওয়া যায়। ফলে ঋকের সাথে কলমের প্রায় প্রেম জমে উঠল। প্রবাসী ইন্টেলেকচুয়ালদের মধ্যে তার যাতায়াত বাড়তে লাগল; বাড়তে লাগল ঠোকাঠুকিও; বাড়তে লাগল ভক্ত, অর্পিত ভোগ।

আন্তরিকতা আর একাকীত্বের তীব্র  যুগলবন্দীতে ঋক যা সৃষ্টি করল, তার সুবাদে ওর জীবনে তৈরি হলো এক সামাজিক আবর্ত। নতুন করে জীবন, জীবিকা আবিষ্কার করতে করতে তরতর করে কেটে যাচ্ছে ঋকের। একদিন ভোররাতে একটা ফোন পেল। একটা অপরিচিত, ফ্যাঁসফ্যাঁসে দুর্বল গলায়, ক্ষীণ স্বরে কোনো একটা মেয়ে কিছু বলল। ঘুমের ঘোরে নিজের স্বর স্থির করে কোনো মতে ঋক বলল, কুড ইউ বি লাউডার?। 

কন্ঠস্বর সবটুকু জোর উজাড় করে দিয়ে বলল, ইন্দ্রাণী বলছি। তুই কি ব্যস্ত? 

শব্দকটার আকুলতায় ঘুম ছুটে গেল ঋকের। স্বভাবসিদ্ধ ঠাট্টায় বলল, ব্যস্ত না ঘুমন্ত। 

তারপর অন্যদিকের নিস্তব্ধতায় চকিত হয়ে বলল, হ্যালো? আছিস। 

ক্ষীণস্বরে ইন্দ্রাণী বলল, এখনও আছি। 

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল, সরি রে; আসলে ঘরে লোক থাকলে তোর সাথে কথা বলতে লজ্জা করে, এখনও। 

তারপর হঠাৎ গলায় জোর এনে বলে, সেই লজ্জারই মাথা খেয়ে, পরশু যখন তোর মা-বাবা এসেছিলেন আমার কেবিনে, তখন ওঁদের থেকে তোর কনট্যাক্ট নাম্বারটা নিয়ে ফেলেছি। তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। দেখতে তো আর পাব না তাই তোকে শুনলাম। 

তারপর আবার ইন্দ্রাণী কেমন যেন নিজের ভেতর তলিয়ে যেতে যেতে বলল, জানি আজ বলা অবান্তর; তোর জীবন অন্য সমুদ্রে; সেদিন আনন্দ দিতে চেয়েছিলি; কিন্তু দুজনেই পরে দুঃখ পেতে পারি ভেবে আমি তোর আনন্দও সেদিন মাটি করে দিয়েছিলাম, আমারটাও। কারণ আমি জানতাম আমি শিগগির মরে যাব। দেখ আজ কেমন লোভ হলো, মরে যাব শিগগির, জানি, তবু তোকে বলতে মরিয়া হয়ে উঠেছি তোর আমি; বুঝলি? 

এসব কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে ঋক বলল, তুই কি বলছিস বলতো? আমার এতো ভেগ লাগছে কেন? 

ইন্দ্রাণীর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এলো ঋকের কানে। তারপর ক্ষীণ কিন্তু গাঢ় স্বরে ইন্দ্রাণী বলল, মিথ্যে জানি, তবু একবার বলবি যে তুই আমার? 

ঋক হেসে ফেলল, তারপর জিজ্ঞেস করল, তুই আমার? মানে? 

ইন্দ্রাণী ভাঙা গলায় বলল, তোর কিছু মনে নেই। আসলে আমার তো শুধুই তুই একবার মাত্র প্রেম ---। বাদ দে। ভালো থাকিস

দিন তিনেক পরে অফিস যাওয়ার সময় রোজকার মতো মাকে ফোন করল ঋক। কি খবর? 

প্রশ্নে মা কেমন ডুকরে উঠলেন। 

ঋক বলল, কি হয়েছে? কোনো খারাপ খবর? 

মা বললেন আমি বোসেদের বাড়ি যাব এখন। তুই কাল কথা বলিস।

বাবার সাথে মনোমালিন্য হলেও মা কান্নাকাটি করেন। ঋক বিশেষ মাথা ঘামাল না। পরদিনও মা ফোঁপাচ্ছিলেন ফোনে। শেষে ঋক জিজ্ঞেস করে ফেলল, মা? কোনো খারাপ খবর আছে? 

মা বললেন, বোসেদের বড়ো মেয়েটা মারা গেছে কাল ভোরে। 

মাকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টায় বলল, কী হয়েছিল ওর? 

মা বললেন, ওর একটা কনজেনিটাল সমস্যা ছিলই হার্টে, তারপর চাকরির ধকল আর নিতে পারল না। আপিসে কখনও নাকি ও বলেই নি অসুখের কথা পাছে কেউ কমজোর ভাবে ওকে। 

একটু থেমে, উথলে ওঠা কান্না গিলতে গিলতে আবার বললেন, কোনো দিন কারুর সাথে গল্পগাছা করত না। হাসপাতালে গেছে শুনে একবার দেখতে গিয়েছিলাম। আমার হাত দুটো জড়িয়ে খুব কাঁদল, আর বলল, আমার যে খুব ইচ্ছে ছিল তোমাদের মতো মা হব। আমার কেবল ওর শেষ কথাগুলো মনে পড়ছে। তোর থেকে বছর দুয়েকের ছোটো ছিল। তোর ফোন নম্বর নিয়েছিল......। 

আর কিছু কানে ঢুকল না ঋকের। শুধু মনের চোখে ভেসে উঠল স্কুল ইউনিফর্ম পরে পিঠে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্রাণী, ওকে ঘিরে বেড়ে চলেছে একটা আলোর বৃত্ত; বৃত্ত যতো বাড়ছে ততো ওর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে ঋক; চারপাশে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, শব্দ নেই, বর্ণ নেই, গন্ধ নেই, অন্ধকার নেই, পলাশ ফুল নেই, পলাশ পাতা নেই, পার্ক নেই, বেঞ্চ নেই, হলুদ পোস্ট-ইটের গোছা নেই, ফাইল নেই, স্টোরি নেই, খবর নেই; ঋকের সর্বস্ব জুড়ে কেবল নেই, নেই; আর আলোর বৃত্তে মোড়া ইন্দ্রাণীকে ঘিরে ঘিরে ফুলের মতো থোকায় থোকায় নেমে আসছে, তোর আমি, তোর আমি শব্দগুচ্ছ।




বাঁশরির ডাকে কুঁড়ি ধরে শাখে,  ফুল যবে ফোটে নাই দেখা।
তোমার লগন যায় যে কখন,  মালা গেঁথে আমি রই একা।


আরো অনেকের কথা ভাবতে চেষ্টা করল ঋক, যাতে ইন্দ্রাণীর অসহ্য অনস্তিত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে ও। ঘুরতে গেল পাটায়া। কিন্তু আরাম পেল না। নতুন কাজের খোঁজে গেল লস এঞ্জেলেস। ব্লুমস বার্গে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে শুরু করল। তারপর মত বদলে চলে গেল ফিলাডেলফিয়া। গবেষণা শুরু করল।

বছর দশেক এভাবে কেটে গেল। ক্যাম্পাসে অনেক ছেলেমেয়ে এলো, গেল। মিশল ঋকের সাথে। কিন্তু ঋক মিশতে পারল না। দূর থেকে কলমচির চোখ দিয়ে দেখল, মন দিয়ে বুঝল। কিন্তু মিলে মিশে আত্মহারা হতে পারল না আর। ক্যাম্পাসে কানাকানি চলত, মুখার্জিস লোনার। 

কিন্তু বং-দের পিকনিক, থেকে দূর্গাপুজো, বার্বিকিউ থেকে ক্রিসমাস কিছুতেই ঋকের উপস্থিতির কমতি নেই। কারণ মন্দিরাদি। বয়সে ঋকের মায়ের সমান হলেও বং মহলে মন্দিরাদি সর্ব্বজনীন দিদি। তাঁর সূত্রেই ঋক প্রবাসী বাঙালি মহলে এসে পড়েছে। তার নিষ্প্রাণ সামাজিকতা আশেপাশের সবাই  টের পেলেও তাকে ঠাঁই দিতে কেউ কসুর করে না। তার মূলে ঋকের কলমের খ্যাতি নাকি মন্দিরাদির পক্ষপাত তা ঋক বুঝতে পারে না। প্রত্যেক বছর কলকাতা বইমেলায় মন্দিরাদির বই বেরোয় একটা করে। একটা প্রজন্মের দেশি ও প্রবাসী বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে মন্দিরাদিই সেতু। ঋক লেখক বলেই হয়ত মন্দিরাদির বিশেষ স্নেহের পাত্র সে। কিন্তু স্বভাবে তিনি ঋকের থেকে আলাদা। ভীষণ সামাজিক। কারণ তিনিই ফিলাডেলফিয়ায় বাসন্তী রঙের গাঁদা জড়ো করে সরস্বতী পুজো করেন। আবার দোল, দূর্গোৎসবের হোতাও তিনি। তাই ঋকের সাথে বং মহলের যোগাযোগের সেতুও তিনিই। অবশ্য মন্দিরাদির চারপাশে যে বং মহল তা তাঁরই হাতে গড়া। তাঁর বহুমূখী ব্যক্তিত্বের কারণে বা তাঁর অন্য মানুষের সঙ্গে চট করে মেতে উঠতে পারার গুণেই মানুষকে তিনি অনায়াসে কাছে টেনে নেন। আর প্রবাসে এমন করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাবে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো স্বজন পাওয়া ভার। তাই তিনি সবার কাছের লোক।

আশ্চর্যের বিষয় হলো একাকাঙ্খী ঋকও মন্দিরাদির কাছে স্বছন্দ, ভানহীন, স্বতঃস্ফূর্ত। বলা যায় তিনিই ঋকের নির্জন প্রবাসের একমাত্র স্বজন। সে কথাটা ঋক প্রথম বুঝতে পারলো তখন যখন পড়ানোর কাজ পেয়ে ফিলাডেলফিয়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে কানসাস সিটি যাওয়ার সময় এলো। কিন্তু বেকারত্ব কিংবা ছাত্রদশা দুটোর থেকেই কাজটা তার কাছে বেশি লোভনীয়, জরুরিও। তাই সে চলল আবার নতুন শহরে। 

কানসাস সিটিতে এসে প্রথম একলা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিল ঋক। এবং প্রথম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টের পেল বয়সের ছাপ। কে জানে এর আগে একগাদা বিভিন্ন বয়সী ছাত্রদের সাথে ডর্মে থাকত বলে হয়তো বয়সটা সব সময়ই ছাত্রবয়সে আটকে থাকত। কিংবা বয়সের বাড়কে যতটা জায়গা দিতে লাগে, ততটা জায়গা এতোদিন ঋক নিজেকে দিতে পারে নি। 

চুলের রুপোলির থেকেও বেশি চোখে পড়ে দুবাসি দাড়ির সাদা ছোপ। মন্দিরাদিকেই মনে পড়ে যায় আবার। যেহেতু তিনিও ছাত্রী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি ঋকের হালহদিস জানতেন খুব ভালো করে। ঋকের তিন আর চার নম্বর গার্লফ্রেণ্ডের মাঝের ফাঁকা সময়টায় বলেছিলেন, অমর হবি কী করে? এভাবে ঘাটা-আঘাটায় ভাসলে, নোঙর ফেলার দরকার টের পাবি না, কিন্তু পিতৃত্ব তো প্রাকৃতিক, প্রকৃতি যেদিন চাইবে তোকে বাপ বানাতে, তোকে দিয়ে সন্তান চাওয়াবে, সেদিন কিন্তু তোর ক্ষমতা নাও থাকতে পারে। 

ঋককে সেদিন ছোঁয় নি কথাগুলো। আজ মনে পড়ল। মার্কেজের মত মানলে ঋক এখন সেই বয়সে যে বয়সে সব পুরুষকেই তার বাবার মতো দেখায়।

কিন্তু ঋক তো স্থায়ী সম্পর্ক বা চিরন্তন নারী কিছুই খোঁজে নি। খুঁজেছে উচাটনের উপলক্ষ্য। ইন্দ্রাণীর মতো। যার গোলাপ পাপড়ির মতো ঠোঁটটা পেনসিলে, রঙে, তুলিতে ফুটিয়ে নিয়ে বার বার তর্জনী দিয়ে ছুঁলেই শিহরণ; কিন্তু আসলে ছোঁওয়া যাবে কিনা সেটা অনিশ্চিত। সেই অনিশ্চয়তা আর ফিরে এলো না। 

দেবারতির শাঁখের মতো স্তন মধ্যমা-তর্জনীর আদরে শক্ত হয়ে উঠলে মাছের শরীরের মতো চোখ আঁকার আনন্দ ছিল, দেবারতির নাভিতে ছিল দেশকাল চাদরের মধ্যে দিয়ে মাধ্যাকর্ষণের তীব্রতায় অন্ধকূপে তলিয়ে যাওয়ার বিলাস। 

কিন্তু ইন্দ্রাণীর ভর্ৎসনাতে মগজের কোণে আলো ঝলমল করে ওঠার যন্ত্রণামেদুর তীব্র সুখ যেভাবে শরীর-মনে ছেয়ে যেত, তার প্রত্যাখ্যান জীবনকে যেমন উপলব্ধির উদ্বোধন দিয়েছিল, তেমনটা দেবারতি কেন কারও সঙ্গমই দিতে পারে নি। 

ইন্দ্রাণীর নামটাতেই একটা গম্ভীর অহংকার ছেয়ে থাকে, যেটা মনে পড়লে যন্ত্রণায় মগজ কুঁকড়ে ওঠে, হাহাকারে মন কাতরে ওঠে, অমোঘ আকর্ষণে মন শিউরে ওঠে। তাই সেই শেষ কৈশোরে, যৌবনের তোরণদ্বারে যেমনটা হয়েছিল তেমন নেশা আর হলো না। 

অথচ সেদিন ইন্দ্রাণী একটা সম্পর্ক বানাতে দিলেও সেই নেশা কেটে যেত হয়ত। এতোগুলো বছরে ঋক তো তাই দেখল যে সম্পর্ক - যেকোনো সম্পর্ক - স্থায়ী, চিরন্তন কিছু হয় না; নতুন হয়, পুরোনো হয়; হয় মধুর বা বেদনাবিধুর; তিক্ত কিংবা রিক্ত, মুক্ত হয় না।

আপাতত পেটের চর্বিটায় চোখ টাটাচ্ছে ঋকের। শহর বদলের হিড়িকে মাসদুয়েক জিমে যাওয়া হয় নি। ঝটপট তৈরি হয়ে গেল সাঁতারে। পুল থেকে উঠে রোবটা গায়ে জড়ানো মাত্র রোব পরা একটা মেয়ে এসে বলল, হাই মুখার্জি, আমি ক্যাথেরিন। আমিও এম্পোরিয়াতে সাহিত্য পড়াই। 

ঋক এরকম খেজুরে করতে কোনো আমেরিকানকে দেখে নি। কোনো মতে বলল, হেলো, হাউ আর ইউ ডুয়িং? 

এর একটাই জবাব হয়। ক্যাথিও সে জবাবটাই দিল, ফাইন। 

তারপর বলল, আসলে আমি প্রাচ্যের যত লেখক ইংরেজিতে লেখেন তাঁদের সাহিত্যকাল নিয়ে একটা গবেষণা করছি। তোমার লেখা সবেমাত্র পড়ছি। তুমি এম্পোরিয়া আসছ শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। তবে পুলে তোমায় দেখার চমকটা আরও ভয়ানক। 

এমন একটি আলাপি মেয়ে অবশ্যই এরপর অনেকবার ঋকের সাথে কফি খেতে গেল। ঋক নিজের গাড়ি কেনা অবধি তাকে নিজের গাড়িতে চাপিয়ে ইউনিভার্সিটি নিয়ে গেল এবং সেখান থেকে নিয়ে এলো; ঋকের বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন মুদিখানা, ওষুধ, জামাকাপড়, আসবাব সবকিছুর জোগাড়যন্তরে হাত লাগাল। ফলে দুজনের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে খুব সময় লাগল না।

বছরখানেক ঘুরতেই দুজনে বুঝল যে এতোটা সময় ওরা একসাথে কাটায় যে দুটো আলাদা অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া গোণা, ইউলিটি বিল দেওয়া অনর্থক। দুজনে একটা ডাবল রুম অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতে শুরু করল। ঘরের কাজও ভাগ হয়ে যাওয়ায় দুজনেই খুব খুশি হল। ক্রমে ক্রমে দুজনে জানল সাহিত্যের বাইরে দুজনের জীবনের অনুষঙ্গগুলো। জানতে জানতে একদিন ঋকও জেনে ফেলল যে তাদের সম্পর্ক থেকে ক্যাথি বিয়ে চায়, সন্তান চায়, নিটোল সংসার চায়। ঋক বলে ফেলল, তুমি তো আমার সঙ্গে তাও এক বছরের বেশি কাটালে, প্রায় দুবছর চেনো আমাকে তাই না? 

ক্যাথির উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলল, সব মেয়েই একরকম। ওয়ান-নাইট-স্ট্যাণ্ড না হলে, একবার না একবার তারা কমিন্টমেন্ট চাইবেই; এমনকি যে মুখে বলে, হয়তো বা মনে মানেও, যৌনজীবন তার কাছে খেলা কিংবা নগণ্য প্রয়োজন মাত্র, সেও একদিন শরীরের প্রয়োজন মিটে গেলে পর স্থায়ীত্ব, পরিণতির কথা তোলে। 

ঋক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনেকক্ষণ চুপ থেকে ক্যাথি বলল, আমি ওহায়োর গ্রামে বড়ো হয়েছি, খুব রক্ষণশীল পরিবেশে। আমি প্রেম-বিয়ে-সন্তান শুদ্ধু সংসারে আস্থা রাখি, বিশ্বাস রাখি। তুমি রাখো কিনা না জেনেই ভেবে এসেছি তুমি আমাকে এসব দেবে। 

গলার কাছে পাকিয়ে ওঠা কান্নাটা ক্যাথি গিলতে লাগল। ঋক বলল, আমাদের সম্পর্কটা নিশ্চয়ই প্রেম। কিন্তু বিয়ে-সন্তান এসব তো প্রেম না থাকলেও হয়, তাই না? আমাদের প্রেমের সাথে আর পাঁচজনে প্রেম ভেবে যা যা করে সেসব গোলাচ্ছ -  

ঋককে থামিয়ে শান্ত, দৃঢ় স্বরে প্রশ্ন করল ক্যাথি, আর পাঁচজনে প্রেম বলে যা যা করে সেটা তো তুমি করো নি, তাহলে জানলে কী করে যে সেটা প্রেম নয়? 

চুপ করে গেল ঋক। ক্যাথি আবার বলল, তুমি কিছু সাহিত্য পড়েছ, কিছু দর্শন, কিছু বিজ্ঞান কেউ বলেছে তোমাকে যে কাকে বলে প্রেম?” 

ঋক এতোক্ষণে একটা উত্তর জানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে এমনভাবে বলে উঠল, প্রেমে শরীরি অনুভূতি থাকে অবশ্যই, তবে শারীরিক সম্পর্ক মাত্রই প্রেম নয়। 

ক্যাথি বলল, একথা তুমি কোনো দর্শনে পড়েছ, কিন্তু বিজ্ঞান একেই প্রেম বলে। 

ঋক বলল, প্রেম অনেক ব্যপ্ত বিষয়, তা অবশ্যই মনের চোখ খুলে দেয়। 

ক্যাথি প্রশ্ন ছোঁড়ে, রাতারাতি? 

ঋক বলে, বেশ বিরক্তি নিয়েই, ক্লিশে, এসব নিয়ে অনেক কথা পৃথিবী জুড়ে চলেছে তো চলেছেই। 

ক্যাথি ধীর গলায় যোগ করে, কিন্তু সন্তোষজনক কোনো সংজ্ঞা, সিদ্ধান্ত, তত্ত্ব কেউ এখনো দিতে পারে নি। সমস্ত হয় আর নয় আমরা বুঝি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত দৃষ্টিকোণ দিয়ে। এ সমস্ত কিছুই আপেক্ষিক, আলাদা। তুমি প্রেম বলতে যা বোঝ তা তোমার একার। আমার বোধ একা আমার। তুমি সন্তান চাওনা, বিয়ের দায়িত্বে ভয় পাও এসব কথা আর কোনোদিন উঠবে না

তবুও ক্যাথি কেন রয়ে গেল ঋকের সাথে ঋক বোঝে নি। ঋকের ইচ্ছায় কিংবা ক্যাথির ইচ্ছেয় দুজনে একঘরে শুলেও ক্যাথি বুঝত না কেন ঋক একসাথে শুতে চাইল, অথবা কেন তাকে ঋক প্রত্যাখ্যান করে বারবার, কখনও কখনও প্রত্যাখ্যানের পরেও কেন স্বমেহন সিক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ঋক; আর কেনই বা এসব রাতে ক্যাথির দুঃখ তার ঘুমটুকুকে তাড়িয়ে দেয়। 

কোনো শর্ত নেই বলে ঋক অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক বানাতেই পারে। কিন্তু ক্যাথি চোখ-কান খোলা রাখে, তাই জানে তেমন কিছুই ঘটে নি। আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যে অনেক নতুন বোঝাপড়া তৈরি হয়ে চলে; আর অন্য অনেক পুরোন বোঝাপড়া দূর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু শুরুর দিকের সম্পৃক্ততা ফিরে আসে না। 

দুজনেই বুঝে ফেলে ঋকের কাছে, হয়তো ঋকের মতো আরও অনেক মানুষের কাছে, সম্পর্ক আর বই একরকম। মোড়ক খুলে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে না-পড়া কড়কড়ে পাতা থেকে তথ্য-উপলব্ধি-জ্ঞান একটু একটু করে সেঁচে নেওয়া হয়; তারপর অন্য বই হাতে এলে, বা বইটা একঘেয়ে হয়ে গেলে, বা বইটার মধ্যের সবটুকু উপাদান বোঝা হয়ে গেলে বইটা তাকে পড়ে ধূলো খায়; তারও পরে বইটা থেকে নিয়মিত ধূলো ঝাড়া হয় বা হয় না; বইটার নির্যাস সবটুকু নিতে বাকি থাকলে বইটা হয়তো তাক থেকে নামে, আঙুলে লাগা ধূলো থেকে হয়তো বা কিছু বিরক্তি জমে, অনেকদিন না পড়া কোনো পাতা উল্টে ধূলোর গন্ধ পাওয়া যায়, বইটাকে কোনোভাবেই আর নতুন লাগে না, আকর্ষণীয়ও লাগে না; তবুও প্রয়োজনে যেটুকু দেখতে হয় শুধু সেটুকুই দেখা হয়।

এশিয়ার দক্ষিণপূর্বে একটা সম্মেলন সেরে ফেরার পর ক্যাথি টেক্সাসের অস্টিনে চলে গেল। ঋককে দিয়ে গেল বাকি বছরের বাড়িভাড়ার আধখানা। 


এসো এসো এসো আঁখি কয় কেঁদে।  তৃষিত বক্ষ বলে রাখি বেঁধে
   যেতে যেতে, ওগো প্রিয়,  কিছু ফেলে রেখে দিয়ো
        ধরা দিতে যদি নাই রুচে।


ক্যাথি যে এক্কেবারে চলে গেছে সেটা ঋক টের পেল ফোন-ইন্টারনেট কাটা পড়তে। ক্যাথিই সমস্ত মাসকাবারি লেনদেন খেয়াল রাখত। পরের ইউরোপ ট্যুরে যাওয়ার সময় বাক্স বাঁধতে হিমশিম খেল ঋক। মোজা, টুপি, জ্যাকেট যাও বা আছে, নেই কোনো রুমাল। রুমাল ছাড়াও নতুন স্যুট লাগত। সম্মেলনে বক্তৃতা করার সময় পরতে হবে বলে। কেনার সময় সঙ্গে যাওয়ার কেউ নেই। মাঝে মাঝে মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে। রাগ হচ্ছে ক্যাথির ওপর। কিন্তু দুজনের কেউই তো একে অপরের কাছে দায়বদ্ধ নয়। তাই রাগ দেখাবারও কোনো উপায় রইল না। ধীরে ধীরে ক্যাথিকে ছাড়া দিনযাপণে ঋক অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল।

ইউরোপ থেকে ফিরে খবর পেল, ক্যাথি আসছে এম্পোরিয়াতে, গবেষণাপত্র পড়তে। ঋক ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। বুঝে উঠতে পারল না কী করা উচিৎ। এবং ক্যাথি এসে পৌঁছে গেল। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ক্যাথি থাকল না ঋকের সাথে। উঠল হোটেলে। অনেক অনুনয়ের পর সে রাজি হলো ঋকের সাথে একদিন দুপুরে খেতে যেতে। ঋক শুধু দুজনের ভালোলাগাটুকু মনে রেখে, বন্ধুত্বটুকু রাখতে চেয়ে ডেকেছিল ক্যাথিকে। ক্যাথিও কেবল গবেষণার কথা, ঋকের লেখালিখির কথা এসবই বলছিল। কিন্তু ওঠার মুখে কী যে হলো! ঋক বলে ফেলল, শিখছি কী করে তোমাকে ছাড়াও বাঁচা যায়। 

উত্তরে ক্যাথি বলল, আমিও শিখলাম, পুরুষ ছাড়া সন্তান ধারণ করতে। 

ঋক শিউরে উঠল, তুমি ডোনারকে চেন? 

ক্যাথি প্রতিপ্রশ্ন রাখল, অনেক মিশেও কী সবকটা মানুষকে সম্যক বুঝেছ? 

ঋক বলল, কেবল তর্ক করো। পরে কোনো বিপদ হলে? 

একটু থেমে, আবার বলল, আমাকে একবার জিজ্ঞেসও করলে না এতো বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে? 

ক্যাথির চোখে একটু আগুন এসেই সরে গেল। চোখে, ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে সে বলল, বললে কী তোমার বীজ দিতে না বিয়ে করতে আমাকে? 

তারপর আবার বলল, তোমার পার্সোনাল মেলবক্সটা দেখো, তিন মাস ধরে মেল বাউন্স করায়, অটোমেটিক্যালি ফুল মেসেজ আসায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম তোমার পরামর্শের। একথা নিশ্চয়ই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বলতাম না। 

একটু থেমে আবার বলল, চার বছর তো ছিলাম একসাথে। প্রথম তিন মাসের পর আর কবেই বা আমরা ঘনিষ্ঠ হয়েছি? 

একটু থেমে সে আবার বলল, তাছাড়া কতো অপেক্ষা করব? তোমার মত বদলের আশায় আড়াই বছরের বেশি ছিলাম তোমার কাছে। তুমি যেমন চিরন্তন নারী খোঁজো নি, আমিও তেমন অনন্তকাল অপেক্ষায় কাটানোর কথা ভাবি না। তাছাড়া মনে হয়েছিল, আমি তোমার নতুন সম্পর্ক তৈরির ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি। 

হাঁ-হাঁ করে উঠল ঋক, এসব কী কথা! বন্ধু বলেও কি আমি - 

ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ক্যাথি বলল, মা হওয়াটা আমার বায়োলজিক্যাল অধিকার। তেমনই কে হবে আমার সন্তানের বাবা সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমার বায়োলজিক্যাল স্বাধীনতা। তাও যদি আমি অস্টিন যাওয়ার আগে তোমার বন্ধুত্বের কথা ভাবতে - 

হঠাৎ থেমে যায় ক্যাথি। ঋক জানতে চায়, তাহলে কী? 

ক্যাথির চোখের কোণের চিকচিকে জলটুকু ডানহাতের তর্জনীর আগায় নেয় ঋক। ক্যাথি বলে, আজ আর এসব কথার কোনো মানে নেই। শুধু সময় নষ্ট

পরদিন ক্যাথি চলে গেল ফিলাডেলফিয়ার পথে। অস্টিন ফিরতে ওর কদিন বাকি জানে না ঋক। ইন্দ্রাণীর কথা ভাবলেই দেখতে পায় একটা অন্ধকার চোঙ, যার চওড়া মুখটা মাটিতে আর শীর্ষটা আকাশে, সেটা ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছে, আর চওড়া হচ্ছে। 

অস্টিনে একটা কাজ জুটিয়ে নেয় ঋক, ইউনিভার্সিটিতেই, অনুবাদকের, অধ্যাপনার সু্যোগ নেই বলে। তারপর মন্দিরাদির সাথে কথা বলে জানতে পারে ক্যাথেরিন আরও পনের দিন ফিলাডেলফিয়াতে থাকবে। তিন-চার দিনে পৌঁছনোর ঝুঁকি নিয়ে গাড়িতেই ফিলাডেলফিয়ার দিকে রওয়ানা হয়ে যায় ঋক।




 

Readers Loved