Showing posts with label Gay Rights. Show all posts
Showing posts with label Gay Rights. Show all posts

Tuesday, October 14, 2025

Maternal Might জঠরের জোর

 

২০১০

গ্রাম: ফতেপুর, জেলা: ফরিদপুর, বাংলাদেশ

পাঁচদিনের কন্যা সামার কাঁথাকানি ধুতে পুকুরে গিয়েছিল ফতিমা; শরীর ছিল ভারি দূর্বল, মাথাটা ঘুরছিল, গা গোলাচ্ছিল; হাত-পা সব অবশ হয়ে যাচ্ছিল। তার সন্দেহ হচ্ছিল খুব যে সে বাঁচবে কিনা আর! মাথা কুরে কুরে খাচ্ছিল দুশ্চিন্তাতে; সে না বাঁচলে সামাও বাঁচবে না; পাঁচ বছরের সাবিনার কী হবে? আড়াই বছরের সায়রারই বা কী হবে?

সামার জন্মের সময় মইদুল বাড়ি আসতে পারে নি। সেই সময়টাতেই ঠিকেদারের অনেক লোকের দরকার ছিল। এমন সময় কাজ ছেড়ে বাড়ি এলে, ঠিকেদারকে মুশকিলে ফেললে, যখন ঠিকেদারের তেমন লোকের দরকার থাকবে না তখন ঠিকেদার মইদুলকে কাজ নাও দিতে পারে। তখন তিন মেয়ের সংসার নিয়ে মুশকিলে পড়তে পাড়ে মইদুল।

মইদুল লোক মারফত জানিয়েছিল তার ঘরে না ফিরতে পারার ব্যাপারটা যেন ফতিমা আর মেয়েরা আরও কিছুদিন মানিয়ে নেয়। বোকা মেয়েগুলো জুম্মা থেকে জুম্মায় অপেক্ষায় ছিল যে আব্বা বাড়ি আসবে। আর জুম্মার দিনে তারা ভুলে গিয়েছিল আব্বার ঘরে ফেরার প্রতিশ্রুতি।

দু দিন আগে মইদুলের দিদি আমিনা এসেছিল। যাচ্ছেতাই করে গিয়েছিল ফতিমাকে, দুটো মেয়ের পরেও সংসারে একটা ছেলে দিতে পারে নি বলে। ফতিমার মা অসুস্থ। ভায়েরা তাকে নিয়ে যেতে চায় নি। মাস কয়েক আগে মইদুলের মাও গত হয়েছিলেন। প্রসূতি ফতিমার যত্ন নেবে এমন কেউ ছিল না তার চারপাশে, সাবিনা আর সায়রা ছাড়া। ছোট্টো মেয়েগুলোকেই দেখাশোনার দরকার ছিল তখনও। দুজনের পায়খানায় উঠোনটা নোংরা হয়ে ছিল। মেয়েদুটো তখনও নিজেদের সাফ করতে শেখে নি। দু রাত ফতিমা আঁতুড় ছেড়ে বেরোতে পারে নি। দু রাতই পাড়ার দাই তাকে একটু করে ভাতের ফ্যান খাইয়ে গিয়েছিল।

সামার বয়স তিন দিন হতেই ফতিমা ঠেলেঠুলে উঠেছিল ঘরের কাজ করার তাগিদে। উঠোনটা পরিষ্কার করেছিল। পরিষ্কার করেছিল সাবিনা আর সায়রাকেও। আর থেকে থেকে বেদম হয়ে যাচ্ছিল, উপোসে, বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ধকলে। সে মনেও করতে পারছিল না যে সাবিনা আর সায়রার খিদের কান্না থেমেছিল কিকরে!

সেদিন সন্ধেবেলা যখন মইদুলের বৌদি জুলেখা এসেছিল মেয়েদুটোকে আর ফতিমাকে ভাত খাওয়াতে, তখন ফতিমার মনে হয়েছিল যে তার মেয়েদুটো খিদে হজম করতে শিখে গেছে, শিখে গেছে ধৈর্য ধরতে যে তারা কখনও খেতে পেলেও পেতে পারে। টের পেয়েছিল যে তার একটা কাজের ভীষণ দরকার। 

মইদুলের দাদা সিরাজুল জুয়াড়ি। সিরাজুলের ভরসায় না থেকে জুলেখা কামিনের কাজ নিয়েছিল খেতে, মাছের আড়তে আর যেখানে যেখানে সম্ভব। সে তার ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে দিনের বেলা কাজে যেত।

ফতিমা মরিয়া হয়ে জুলেখাকেই বলেছিল, "একটা কাম দেখে দাও, দিদি।" 

জুলেখা হেসেছিল মৃদু। দুঃখ, অসহায়তায় মাখা ছিল সে হাসি। স্বান্তনা দিয়েছিল, "আগে গায়ে খানিক জোর করি নে।"

সামার পাঁচদিন বয়সে কাচা কাপড়টা উঠোনের দড়িতে মেলার আগেই পড়ে গিয়েছিল ফতিমা। একটা আধলায় মাথাটা ঠুকে ফেটে গিয়েছিল, রক্ত বেরোচ্ছিল গলগল করে।

কিভাবে যেন উঠে দাঁড়িয়ে, পরনের শাড়ি থেকে এক ফালি কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে বেধে ফেলেছিল কপালের ফাটা জায়গাটা।  বাঁ ট্যাঁকে জাপটে নিয়েছিল সামাকে, খামচে ধরেছিল সায়রার হাত আর ডাক দিয়েছিল সাবিনাকে তার পিছু পিছু যাওয়ার জন্য।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছে কাগজ করিয়ে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে ডাকের অপেক্ষা না করে, ভিড় ঠেলে সে গিয়েছিল জরুরি বিভাগে। সেখানে পৌঁছেই তার জ্ঞান হারিয়েছিল।

জ্ঞান ফেরার পরে সে টের পেয়েছিল যে কেউ বা কারা যেন তাকে পরিষ্কার চাদরে শুইয়ে দিয়েছে। খানিকপরে একজন স্বাস্থ্যকর্মী এসে তার নাড়ি, রক্তচাপ, শরীরের তাপমান পরীক্ষা করেছিল। তারপর বলেছিল, "নিজের যত্ন নাও। মেয়েদের কী হবে?" 

ফতিমার চোখ ছাপিয়ে দুগাল বেয়ে গরম জলের ধারা নেমে এসেছিল। সে বিড়বিড়িয়ে বলে ফেলেছিল তার দুরবস্থার কথা স্বাস্থ্যকর্মীটিকেই। 

স্বাস্থ্যকর্মীটি ফতিমা আর তার মেয়েদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেখে দিয়েছিলেন এক সপ্তাহ। তিনি খবরও দিয়েছিলেন জুলেখাকে। যখন জুলেখা ফতিমাকে দেখতে এসেছিল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, তখন তার একটাই রা, "বড়ির কথা কাউকে বলবি না যেন। মাসে একবার যে করেই হোক সুহানাদির থিকে বড়ি নিয়ে যাবি। দাম লাগবে না।"

থতমত খেয়ে ফতিমা জিজ্ঞেস করেছিল, "সাবিনার আব্বারে কী কইব? আমিনাপা তুলকালাম করবে। দুইডা পুলার মা তুমি বড়ি খেতি পারো। আমার পুলা না হলি সাবিনার আব্বা ফের শাদি করবে।"

এমন সময় সুহানা বলে উঠেছিলেন, "তেমন হলি তুমি দিদি শিগ্‌গির কামে লাগি যাও। যখনই আবার বাচ্চার তাগদ পাবে, তখনই বড়ি বন্ধ করে দিয়ে পুলা হওনের চেষ্টা দিও।"

ফতিমা পড়েছিল ভীষণ ভাবনায়। সুহানা কিন্তু থামে নি, "যদ্দুর আমি বুঝি, সাবিনার আব্বা একটু দম নিতি পারবে তোমার বাচ্চা হওনের হিড়িক থামলে। আমিনা বেশি চিল্লালে কইও, 'সব সাবিনার আব্বার দোষ।' জানো তো যে মাইয়্যাতে ক্যাবল মাইয়্যাই বিয়োতি পারে। পুরুষের বীজে ঠিক হয় যে ছানা পুলা হবে না মাইয়্যা।"

ফতিমা আর জুলেখার জোড়া হাঁ দেখেও সুহানা বলে চলেছিল, "ফতিমা তোমার মাসিক বরাবর হলে পর বড়ি নিয়ে যেও। সে অব্দি তুমি ভাবো না হয় বড়ি খাবে কিনা।"

সে প্রস্তাবও রেখেছিল, "ফতিমা কাল থিকা ইখানে কামে লাগতি পারো। ভারি কিছু না। চাদর বদলানো, লোকজন বসার চত্বরটা, বাচ্ছাদের খেলনের জাইগাটা সাফা করা এইসব। মাইয়্যাদের আনতি পারো সঙ্গ্যি, তবে চোখে চোখে রাখবে।"

সে জুলেখাকেও প্রস্তাব দিয়েছিল, "তুমি অনেক মেয়েমানুষকে চেনো। তাদেরকে আমাদের বড়ি দাওনা কেন? মাসে হাজার টাকা দিব। অন্য কামের ফাঁকে করি দিবে এটা।"

জুলেখা আর ফতিমা দুজনেই তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গিয়েছিল সুহানার প্রস্তাবে।

মাসখানেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করার পরে, অনেক মহিলার সাথে যোগাযোগের পরে ফতিমা বড়ি খেতে শুরু করেছিল। মইদুলকে অবশ্য সে কিছুই বলে নি।

পেতাখ তিক্‌ভা, ইস্রায়েল

জসুয়ার আসবাবের কারখানা পেতাখ তিক্‌ভাতে। তার হাইফা চলে যাওয়া মানে পেতাখ তিক্‌ভার কারখানা বেচে হাইফাতে নতুন করে তীব্রতর প্রতিযোগিতার মধ্যে আবার শুরু করা। কিন্তু এব্লের ব্যবসা পৃথিবীর যে কোনও জায়গা থেকেই চালানো যায়। সারা ইস্রায়েলের নানান আসবাব তৈরির কারখানা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন আসবাবের দোকানে আসবাবের যোগান দেওয়ার ব্যবসা তার। গত পাঁচবছর সে হাইফা থেকে ব্যবসা করছিল। সেই সূত্রেই গত পাঁচ বছর ধরে সে ইস্রায়েলের আসবাব ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সম্মেলনে যাতায়াত করছিল। কিন্তু প্রথম দুটো বছরে জসুয়াকে তার আলাদা করে নজরে পড়ে নি। 

তিন বছর আগে জসুয়া এব্লকে তার সাথে ডিনারে যেতে বলেছিল, প্রথমবার। এব্ল ভেবেছিল যে আরেকটা সাধারণ ডেট হতে চলেছে। সেই একটা ডেট থেকে সাপ্তাহিক দূরাভাষালাপ শুরু। তারপর থেকে থেকেই দেখা করা হাইফাতে, যদি জসুয়া সেখানে যায়; নয়তো পেতাখ তিক্‌ভাতে যদি এব্ল যায় তো। তারপর রোজকার কথোপকথন ফোনে, সাপ্তাহিক সাক্ষাৎ, মাসে বা দুমাসে কোনও এক সপ্তাহান্ত জুড়ে একসাথে বেড়াতে যাওয়া। একত্রে বসবাসের ভাবনারও শুরু ক্রমে। তাই এব্ল চেষ্টাচরিত্র করে এসে পড়েছিল পেতাখ তিক্‌ভাতে। 

তাদের মিলিত জীবনের আরম্ভটা উদ্‌যাপনের জন্য বন্ধুদের ডেকেছিল জসুয়া আর এব্ল। উদ্‌যাপণের মধ্যপমণি ছিল নোয়া। সে তখনই মধ্য ইস্রায়েলের অন্যতম প্রজনন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিল।

২০১৪

পেতাখ তিক্‌ভা, ইস্রায়েল

একদিন পাড়ার বাচ্চাদের সাথে খেলছিল জসুয়া। জসুয়ার আনন্দ ঝলমলে চেহারাটা এব্লকেও আনন্দিত করেছিল। পরে সে প্রস্তাব দিয়েছিল, "আমরা সন্তানের জনক হতে পারি না? তার জন্য যা শরীরী পরিবর্তন লাগবে আমি না হয় সে সব করিয়ে নেব। আমাদের সম্পর্কটা সন্তানের মধ্যে দিয়ে জোরালো হতে পারে আরও।"

শুনে জসুয়া যারপরনাই খুশি হয়েছিল। এক মূহুর্ত নষ্ট না করে সে বলেছিল, "চলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নোয়ার ক্লিনিকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নি।"

নোয়া কিন্তু চেয়েছিল ভাড়ার জরায়ুতে কেনা ডিম্বাণু আর জসুয়ার শুক্রাণুজাত সন্তান বেড়ে উঠুক। সে যুক্তি দিয়েছিল, "মা হওয়ার জন্য যেসব অঙ্গ লাগে সে সবই নিজের শরীরে পেতে পারে এব্ল; একজোড়া ডিম্বাশয়, ফ্যালোপিয়ান টিউব, জরায়ু, ভগাঙ্গুর, এমনকি একজোড়া স্তনও শিশুর পোষণের জন্য। এব্লের হর্মোনও না হয় এমন করে দেওয়া হবে যাতে সে গর্ভধারণ করতে পারে, সন্তানের জন্ম দিতে পারে, শিশুকে স্তন্য পানও করাতে পারে। কিন্তু তার পরেও এব্ল পুরুষই থেকে যাবে যেহেতু তার শরীরের সমস্ত পেশীতে, স্নায়ুতে, ত্বকে আর অন্য সব অঙ্গের কোষে এক্সওয়াই ক্রোমোজোম জোড়া থেকে যাবে। অঙ্গ প্রতিস্থাপণ আর হর্মোন বদল তার জন্মগত গঠন, যা কোষস্তরে পুরুষের, তা কিছুতেই বদলাতে পারবে না। তাতে অন্য জটিলতা তৈরি হতে পারে। আয়ুহানি হতে পারে। বাচ্চাদের বড়ো করতে হবে তো! এব্ল যেমন আছে তেমন থাকলে এব্লের সন্তান হওয়ার সম্ভাবনাও রয়ে যাবে।"

সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় নিয়েছিল জসুয়া আর এব্ল। ব্যাপারটা সহজ ছিল না তাদের রক্ষণশীল সমাজের নিরিখে। জসুয়া আর এব্লের একসঙ্গে বসবাসে কিংবা সন্তান পালনে যেমন কোনো ভ্রূ বাঁকত না, কুঁচকোত না, তেমনই এব্লের শরীরী পরিবর্তন ঘটলে অযাচিত কৌতুহলের সৃষ্টি হতো। 

কিছুদিন ভাবার পর জসুয়া আর এব্ল নোয়ার কথাই মেনে নিয়েছিল। তারা তো বিপ্লব করতে চায় নি, চাই নি পেয়ালায় আর সমাজে তুফান তুলতে। তারা চেয়েছিল একটা পরিবার গড়তে, সংসার করতে, সন্তান প্রতিপালন করতে।

একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সব ব্যবস্থা নোয়া করে দিয়েছিল। সংস্থার ব্যবস্থাটা ছিল নেপালের একটা খামার বাড়িতে। সেখানে তারা কৃত্রিম নিষেকের মাধ্যমে মহিলাদের গর্ভ সঞ্চার করত। পুরো গর্ভকাল মহিলাদের সেখানেই রাখা হতো শিশুজন্ম পর্যন্ত।

দুর্ভাগ্যবশতঃ নোয়া সমস্যা দেখেছিল জসুয়ার পিতৃত্বে। সে জসুয়া আর এব্ল দুজনকেই পরীক্ষা করে দেখেছিল। তারপর সে জসুয়ার চিকিৎসা শুরু করেছিল। আর এব্লের শুক্রবীজ পাঠিয়ে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক প্রজনন সংস্থাটির কাছে।

গ্রাম: ফতেপুর, জেলা: ফরিদপুর, বাংলাদেশ

আর সব দিনের মতোই সে দিনটা ছিল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ফতিমা দিবাভাগের ডাক্তারকে যন্ত্রপাতি আর কাগজকলম হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছিল। সুহানা তার কানে কানে বলে গিয়েছিল, "সব মিটলে পরে আমার সাথে দেখা কোরো।"

ঘন্টাদুয়েক পরে ফতিমা দেখা করেছিল সুহানার সাথে। সেখানে জুলেখাও ছিল, ছিল আরও অনেক মহিলা। বরাবরের মতোই সুহানা সোজাসুজি বলেছিল, "দ্যাখেন সবাই, অবস্থা আপনাদের কোনও কালেই ভালো না। যাদের মরদ রোজগেরে, তাদেরও না। এই একটা সুযোগ এসিছে আপনাদের পরিবারকে একটু ভালো রাখবার। ইখান থেকে রওনা হওনের আগেই আপনাদের একলাখ টাকা করে দিবে। ক্যাম্পে আপনাদের গর্ভদশায় খাওয়াদাওয়া আর ওষুধপত্র যা লাগবে তার সব খরচ ক্লায়েন্টের। ফিরবার পর আর তিন থেকে চারলাখ টাকা হাতে পাবেন। এক বছরে। আপনারা কেউই বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকাও রোজগার করে উঠতে পারেন না এখন। ভেবে দ্যাখেন। যত শিগগির সম্ভব জানান আপনাদের সিদ্ধান্ত। প্রথম দল রওয়ানা হবে এক হপ্তার মধ্যে।"

হতভম্ব মহিলাদের মধ্যে থেকে একজন বিদ্রুপ করে উঠে ছিলেন, "হ্যাঁ, বেবুশ্যে হবার জন্যই তো জন্মেছিলাম!"

তাও সুহানা হাসিমুখে ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে ছিলেন, "মোটেই না। বাচ্চা নিবার লগে তো আপনারে আর পুরুষের সাথি শুতি হবে না। কারও প্যাটি তৈরি ছানা দিয়ে দেওয়া হবে সুঁই দিয়া। কারও কারও প্যাট থিক্যা সুঁই দিয়া ডিম নিয়া, তাই দিয়া তৈরি ছানা সুঁই দিয়া ফের প্যাটে ভরে দেওয়া হবে। যারা ডিম দিবে তারা বেশি টাকা পাইবে।"

আরেকজন মহিলা জানতে চেয়েছিলেন, "আমরা কি কাগ? কোকিলের ডিমে তা দিব!"

সুহানা জোরে হেসে বলেছিল, "কাকের মতো। বদলি মা।"

ঘরে ফেরার পথে জুলেখা হেঁকে দিয়েছিল, "আমি যাব না; একটা বছর দেখব, যারা যাচ্ছে তারা ফেরা অব্দি। তারা বাচ্চা দিবার ক্যাম্প থিকা ফিরা কি কয় শুইনব আগে। ইখানে কাম আছে আমার, এত্তো বছরের জানাশুনা। এক বছরের লগে সব ফালায়ে যাব কেন? সেখানকার ব্যাপার কিছুই জানি না যখন?"

ফতিমা চুপ করে ছিল, জুলেখার মতামত শোনার পরেও। বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে ফতিমা জানতে চেয়েছিল,  "দিদি, আমি গেলি তুমি কী আমার মাইয়্যাদের দেখবে? আগাম পয়সার আধখানা তোমায় দিয়া যাব। ফেরার পরে আরও একলাখ দিব।"

জুলেখা হাঁ হয়ে গিয়েছিল শুনে। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলেছিল, "মাইয়্যাদের লগে তুই টাকা দিস বা না দিস, আমি আমাদের মাইয়্যাদের খেয়াল রাখবই।"

ফতিমা প্রথম দলে সামিল হতে চেয়েছিল। মইদুলের ঘরে আসা  পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে নি। সে চলেই গিয়েছিল মইদুলের কাজের জায়গায়। 

ফতিমাকে দেখে মূহুর্তের ব্যবধানে মইদুলের চেহারায় ফুটে উঠেছিল বিস্ময়, আঘাত, ঘনিয়ে ওঠা ভয় তারপর উপছে ওঠা খুশি। যখন মইদুল মুখ খুলেছিল, তখন সে তার শান্ত স্বভাবে ফিরে গিয়েছিল, "আসতে হইল যে? ঘরে সব ভালো তো?"

ফতিমাও শান্ত আবহাওয়া ধরে রেখেছিল, "সব ঠিক। তাড়াহুড়ায় একটা কথা ঠিক করতে হলো আমারে। তা তোমারে কওয়ারও ছিল।"

তারপর সে বলেছিল মইদুলকে, "সুহানাদি একটা অন্য কামের জন্য বলিছে। ঘরছাড়া বিদেশে থাকতি হবে এক বছর। যাওনের আগে কিছু টাকা দিবে, ফিরলে আরও বেশি দিবে। জুলেখাদি মাইয়্যাগুলোকে দেখবে। আমি তোমারে কিছু টাকা দিব যাতে তুমি ঘনঘন ঘরে যাইতে পারো আর মাইয়্যাদের দেখতি পারো।"

মইদুল জানতে চেয়েছিল, "কামটা কী?"

ফতিমা জানিয়েছিল, "ইখানের মতোই। অন্যদের দেখাশোনার। তবে কাম দিবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করবে। উৎরোলে তবে কাম পাব। কাগজপত্র সব তারাই বানাবে।"

মইদুল জানতে চেয়েছিল আরও, "কত টাকা?"

ফতিমা হেসে বলেছিল, "তুমার নিজের মুবাইল রাখতি পারবে। আমি ফেরার আগে একখানা ঘরের দেওয়াল পাকা করতি পারবে। ফেরার পরে পুরা কুঁড়া তুমি পাকা ঘর কইরা নিতি পারবে।"

মইদুল সন্দেহ লুকিয়েছিল, কিন্তু নিজের কৌতুহলে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল, "লাখ?"

ফতিমা সম্মতিতে ঘাড় নেড়ে ছিল। মইদুল দীর্ঘ স্তব্ধতার পরে বলেছিল, "গলা অব্দি ধারের থিকা ভালো তকদির দেখে নেওয়া। তুমি যাও। দেখা যাক কী হয়!"

পরের দিন সকালে কাজ শুরু করার আগে, ফতিমা নাম লিখিয়েছিল সুহানার খাতায়, 'বদলি মা' হওয়ার জন্য।

২০১৫

লেলে, নেপাল

ফতিমাকে সুহানা একটা বইয়ের মতো জিনিস দিয়ে বলেছিল সেটাকে সামলে রাখতে। সুহানা তার নিজের মতো করে  সামনে কুঁচি দিয়ে, লম্বা আঁচল রেখে শাড়ি পড়তেও শিখিয়েছিল ফতিমাকে। ফতিমার বরাবরের জড়িয়ে কোমরে গোঁজা শাড়ি পরায় ঝকমারি অনেক কম। তবুও নতুন কাজের অংশ হিসেবে, তার অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে সে নতুন কায়দায় শাড়ি পরতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। 

তারা প্রথমে পৌঁছেছিল ঢাকাতে। সেখান থেকে বাসে কলকাতা। এতো আরামের বাসে ফতিমা আগে কখনও চড়ে নি। সপ্তাহখানেক তারা কলকাতায় ছিল। তাদের বাজার করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল উলের গরম জামা, কোট, শাল এসব কিনতে। 

কলকাতা থেকে এক বিকেলে ট্রেনে চেপে তারা পরদিন পৌঁছেছিল এক জায়গায়।  সেখানে একরাত কাটিয়ে তারা বাসে চেপে পৌঁছেছিল কাজের জায়গায়।

পরে একটা রেডিও বা টিভির জন্য সাক্ষাৎকার নিতে এসে সুরঞ্জনাদি ফতিমাকে বলেছিল যে সে নেপালে আছে, রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দক্ষিণে লেলে নামে একটা জায়গায়। চমকে কেঁপে উঠেছিল ফতিমা। সে মাত্র এক বছরে দু দুটো ভিনদেশে পা রেখেছে! তার পঁচিশ বছরের জীবনে সে কখনও ফরিদপুরের বাইরে পা রাখে নি।

লেলেতে অবাক হওয়ার আরও অনেক কিছু ছিল। তাকে ক্লান্তিকর যৌনসঙ্গমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নি সন্তানধারণের জন্য। খিদে পেলেই তার সামনে হাজির ছিল যথেষ্ট খাবার। তার নিজের মেয়েদের বেলা সে কেবল পেট ভরতি জল খেয়েছিল খিদের কামড় চাপা দেওয়ার জন্য। আয়নায় ধরা পড়েছিল তার বরাবরের ঠেলে ওঠা চোয়ালের হাড়ের ওপর জমে ওঠে উত্তলতা, উত্তলতা জমেছিল তার সরু কব্জিতেও, বরাবরের  মতো গর্ভদশায় ক্রমাগত রোগা আর দুর্বল হয়ে যাওয়ার বদলে। শিশু জন্মের সপ্তাদুয়েক আগে তার ঘাড়ের পিছনটা কালচে হয়ে উঠেছিল, গায়ের লোমগুলো বেড়ে উঠেছিল বেয়াড়া রকম। তার মনে পড়ে গিয়েছিল যে ছেলে জন্মানোর আগে জুলেখারও অমন হয়েছিল। তার সহকর্মীরা লেলেতে তাকে বলেছিল, "তোর পুলা হইব।"

সত্যিই সে একটা ছেলের জন্ম দিয়েছিল। তার আমিনা আর সুহানা দুজনের কথাই মনে পড়ছিল। তার মনে জোর এসেছিলো, "আমিও পুলার মা। আগের তিনবার মইদুলের ডিম মেয়ে দিছে আমিনার আশায় জল ঢেলে।"

ফতিমা সজাগ হয়েছিল যে তার এই মনোভাব জানলে মইদুল দুঃখ পেতে পারে। মইদুল তার মেয়েদের খুবই ভালোবাসে। কোনওদিনও সে ছেলের কথা বলে নি। দুঃখ এই জন্যও যে সে কোনও দিনও আমিনাকে  এসব বোঝাতে পারবে না ।

আরও অবাক হওয়ার বিষয় ছিল যে তাকে বাচ্চার নাম দিতে হবে না। সে কোনওদিনও তার প্রথম পুত্রকে 'খোকা' বলে ডাকবে না, বা তিন মেয়ের কোলের ছোটো ছেলে বলে 'খোকন' বলেও ডাকবে না। সে কোনও দিনও ছেলেটার 'মা' হবে না। সে বাচ্চাটাকে জন্ম দেওয়ার একটা যন্ত্র যেন। বাচ্চাটা তার নিশ্চিন্ত জীবনের উপায় যেন, তার মেয়েদের একটু ভালো থাকার পাথেয়।

ফতিমা আরও চমকেছিল এই বুঝে যে সে তার পরিবারে এখন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ  আর উপযোগী। আগে তার নিজেরই নিজেকে অকেজো মনে হোতো। লেলে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তার জঠরের জোর।

পেতাখ তিক্‌ভা, ইস্রায়েল

জসুয়া আর এব্ল তাদের প্রথম সন্তানের নাম রেখেছে এজ্রা। ছেলের ঘরের দেওয়াল জুড়ে তারা মেঘ এঁকে রেখেছিল। আর পর্দায় ছাপা ছিল ডলফিন। পুরো ছাদে আঁটা ছিল ঝিকমিকে তারা। একটা কাঠের দোলনা আর একটা কাঠের ছোট্টো খাটও ছিল সে ঘরে। সেসব সাজানো ছিল নানান খেলনা দিয়ে। একটা আলমারি ভর্তি ছিল জামা, জুতো, মোজা আর টুপি। সঙ্গে এক ঝুড়ি কাঁথা আর আরেক ঝুড়ি কৌপিন। 

রান্নাঘরে একটা আলমারির দরজায় লেখা ছিল এজ্রার নাম। সেই আলমারি ভরা ছিল ফিডিং বোতল আর বুকের দুধ বার করার পাম্প।  এব্ল আর জসুয়া এজ্রার জন্য এক স্তন্যদাত্রীর ব্যবস্থা করেছিল পরবর্তী ছমাসের কথা মাথায় রেখে।

এব্ল তার বাড়ির আপিসঘরটাতে বদল করেছিল অনেক। সে ঘরের কোণায় সে একটা ছোট্টো নার্সারি বানিয়ে রেখেছিল যাতে কাজের সময়েও সে নজর রাখতে পারে শিশু এজ্রার ওপর। দুজনেই তৈরি ছিল নবজাতক সন্তানের জন্য রাত জাগতে। নবজাতক যতদিন না মানুষের মতো জাগে আর ঘুমোয়, খায় আর বাহ্যে করে, ততোদিন এব্ল বাড়ির থেকেই কাজ করবে বলে স্থির করেছিল। সেই জন্য সে টেলিফোনে আর ভিডিও কনফারেন্সে ফলপ্রসূ যোগাযোগের বিশেষ প্রশিক্ষণও নিয়েছিল। জসুয়া অভ্যেস করছিল কম সময় কারখানায় থেকে কাজ উদ্ধারের। সেও তার কর্মচারীদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কাজ করতে শুরু করেছিল। 

এজ্রাকে প্রথম দেখতে এসেছিল নোয়া। সে এজ্রার জন্য একটা কাঠের ঘোড়া এনেছিল।

গ্রাম: ফতেপুর, জেলা: ফরিদপুর, বাংলাদেশ

ফতিমা বাড়ি ফিরেছিল। বাচ্চাটা জন্মের পর এক সপ্তাহ তার বুকের দুধ খেয়েছিল। বাচ্চা যখন খাচ্ছিল না, তখনই লেলের প্রসূতিকেন্দ্রের কর্মীরা পাম্প দিয়ে ফতিমার দুধ বার করে নিচ্ছিল। ফতিমা অনুমান করেছিল যে বাড়ি যাওয়ার পথে বাচ্চাটার খেতে লাগবে বলে বোধ হয় পাম্প দিয়ে দুধ নিয়ে জমা করা হচ্ছিল।

সেই দুধের খানিকটা বাচ্চার সঙ্গেই গিয়েছিল বটে, তার যাত্রাপথে এবং বাড়িতে লাগবে বলে। বাকিটা সেইসব বাপ-মাকে বেচে দেওয়া হয়েছিল যাদের বাচ্চার মা বুকের দুধ খাওয়াতে পারে না। ফতিমা এতো কথা জানতে পেরেছিল প্রসূতিসদনের সবজান্তা বাক্যবাগীশ কর্মীদের থেকে। জেনেই সে ভেবে নিয়েছিল যে আবার যদি সে এই কাজে ফিরে আসার সুযোগ পায় তো সে দুধের জন্য আলাদা দর হাঁকবে।

ঘরে ফেরার আগে তাদের পুরো দলকে কাঠমান্ডুতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তারা একটা বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরে গিয়েছিল, গিয়েছিল একটা বৌদ্ধ মন্দিরে যার গম্বুজের চারদিকে বড়ো বড়ো চোখ আঁকা ছিল; আর গিয়েছিল একটা বাজারে যেটার পুরোটাই কাঠের পাটাতনের ওপর বানানো, যেটা নাকি সদ্য ঘটে যাওয়া একটা ভূমিকম্পে ভয়ানক ভেঙেচুরে গেছে।

ফতিমা মেয়েদের জন্য আর জুলেখার জন্য রঙিন কাঁচের চুড়ি কিনেছিল। গরমজামা কিনেছিল সব্বার জন্য; তার মেয়েদের জন্য, জুলেখা আর তার ছেলেদের জন্য, মইদুলের জন্য, সিরাজুলের জন্য, এমনকি আমিনার জন্যও। তার মায়ের জন্য, ভাইয়েদের জন্য, ভাইবউদের জন্য, তাদের বাচ্চাদের জন্য। সে বড়ো আনন্দ পেয়েছিল সবার জন্য উপহার নিতে পেরে, প্রায় বছর পেরিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময়।

যথারীতি, আমিনা মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল, "পাপের তত্ত্ব!"

কিন্তু তার শালটা সে বাড়ি যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল।

মইদুল উপচে ওঠা খুশিতে বলেছিল, "কইতেও পারছি না, 'এতো খচ্চা করার কী দরকার?' এসবই আমাদের দরকার, কিন্তু কোনওদিন কিনে উঠা যায় নাই। তোমার জন্যি গব্ব হচ্ছি গো!"

জুলেখা ফোড়ন কেটেছিল, "আমাকে বাচ্চা দেখনের বখশিস দিচ্ছিস?"

ফতিমাও ভারি সেয়ানা হয়ে উঠেছিল বাড়ির থেকে অনেক দূরে, অনেকগুলো দিন ধরে, অচেনা অজানা মানুষদের মধ্যে বসবাস করে, আধচেনা মেয়েমানুষদের সঙ্গে আধা বিশ্বস্ততায় একে অপরের ব্যবসার কথা গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি লেনদেন  করে। সে জুলেখাকে একটা লাগসই জবাব দিয়েছিল, "জানি গো দিদি, আমার মাইয়্যাদের দেখনের কাজ অত সস্তায় হবে না।"

জবাবের চমকটা জুলেখা পুরোপুরি হজম করে ওঠার আগেই ফতিমা বলে উঠেছিল, "তুমার লগে পয়সার কথা পরে কইব। সাবিনার আব্বা কয়দিন থাকতি পারবে জানি না। ওর লগে আগে কথা কয়ে নি..."

পরে গভীর রাতের নির্জনতায় ফতিমা মইদুলকে বুঝিয়ে বলেছিল, "এই রোজগার অইন্য মিঞাবিবির বাচ্চার জন্ম দিয়া। সে মিঞাবিবির নিজেদের বাচ্চা হতি পারবে না।"

মইদুলের একটা ঝটকা লেগেছিল, তবুও সে তার শান্ত স্বভাব হারায় নি, "ফতিমা রে! এ তুই কী করলি! লোকটা তোরে ভালো রাখছিল তো?"

ফতিমা কিছু বলার আগেই সে বিড়বিড় করে উঠেছিল, "নিশ্চয়ই, অবশ্যই। তাই তো মনি হচ্ছে। তুই তো ঝলমল করতেছিস। তোকে আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে..."

মইদুলের শিরা ওঠা হাতের ওপরে নিজের নরম হাত বুলিয়ে ফতিমা তাকে হঠাৎ থামিয়ে দিয়েছিল। তার হাতের তালুতে সে যখন টের পেয়েছিল যে উদ্বিগ্ন মইদুল ঠান্ডা হয়েছে, সে বুঝিয়েছিল, "কোনও লোক ছিল না। মেয়ে ডাক্তার আর নার্স ছিল অনেক। ছিল আমাদের মতো কাজের মেয়েরা। যেখান দিয়ে বাচ্চা বেরোয় ওরা সেখানে সুঁই দিয়েছিল, কয়েকদিন ছাড়াছাড়ি, দু বার। পরে আমার রক্ত, পেচ্ছাপ পরীক্ষা করে, যেখানে সুঁই দিয়েছিল সেখান দিয়ে একটা পেলাস্টিকের ডান্ডা মতো ঢুকিয়ে আমার প্যাটের ছবি নিয়েছিল তারা। তারপরে আমাকে বলেছিল যে বাচ্চা প্যাটে বসি গেছে। তাই আমাকে দশ মাস থাকতি হলো। এই দশটা মাসে তারা আমাকে ঘড়ি ধরে খাওয়াতো আর ওষুধ খাওয়াতো। বাচ্চাটা হওনের পর হপ্তাটাক ছিল আমার কাছে। তারা পাম্প দিয়া আমার দুধও নিয়ে নেছে। তাই বোধ হয় আমার বুকটা ফুলে নেই!"

মৃদু স্বরে মইদুল কৌতুহল প্রকাশ করেছিল, "লেগেছিল খুব?"

ফতিমা হেসেছিল, "না গো। এটা তো কাজ। কাজ করতি গেলি কী লাগে সবসময়?"

সে তারপর মৃদু কিন্তু সাবধানী স্বরে বলেছিল, "তুমি যদি না চাও, আমি আর ওখানে যাব না। আমি কিন্তু জানি না আমাদের মাথায় একটা পাকা ছাদের খরচা কত।"

বহুদিনের রাজমিস্ত্রি মইদুল আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলেছিল, "একলাখ হলিই হবে। তোমারে দিছে কত?"

ফতিমা অন্যমনস্ক স্বরে বলেছিল, "সব মিলিয়ে পাঁচ লাখ। ফেরার পরে চার লাখ। আমি তোমাকে এই চার লাখের আদ্ধেক দেব।"

তারপর সে একটু কথা ঘুরিয়ে বলেছিল, "যে চল্লিশ হাজার তোমারে দে গেছিলাম তাতে মাইয়্যাগুলার গোসল ঘর করিছো দ্যাখলাম। জুলেখারেও একটা করি দিও। ওর ছাদটাও পাকা করি দিও। আমরা দুজনই কাজে ছেলাম যখন, তখন ও মাইয়্যাদের আইগলেছে বলি কথা।"

মইদুল রাজি হয়েছিল। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে একলাখ টাকা ফতিমা রেখেছিল নিজের কাছে।

পরদিন সকালে ফতিমা জুলেখাকে প্রতিশ্রুতি মতো একলাখ টাকা দিয়ে বলেছিল, "মইদুল তোমার গোসলখানা আর পাকা ছাদ বানাইবে। না করতি পারবে না।"

জুলেখা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল, "আমার বরাত যে এমনি হবে এমনটা আমার বাপ-মা ভাইবোন কেউ ভাবে নাই রে! তুই আমার মায়ের প্যাটের বনির থেকেও বেশি আপন আজ!"

তারপর ফতিমাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে জানতে চেয়েছিল, "লাগে খুব? তুই কী আবার যাবি?"

ফতিমা আশ্বাস দিয়েছিল, " না গো না। এক্কেবারে লাগে না। তবে উরা আমারে সামনের একটা বছর নিবে না, আমার শরীলটাকে বেশ্রাম দিতি। আমি কাল সুহানাদির সাথে দেখা করতি যাব যদি এই একটা বছর আমারে কোনও কাজে লাগাতি পারে।"

ফতিমার উৎসাহ দেখে জুলেখাও সে বছর লেলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে ফতিমাকে বলে গিয়েছিল, "আমার পুলাদুটাকে দেখিস। সায়রা আর সাবিনাকে উদের লগে ভিড়তি দিবি না। নচ্ছারদুটা আমার পরীদুটার ক্ষেতি করতি পারে। আর রাতে মাইয়্যাদের লগে শুইবি। পুলাদের কোনও ভরসা নাই।"

ফতিমা আপ্লুত হয়ে পড়েছিল জুলেখার আন্তরিকতায়। সে যখন জুলেখার ফেরার পথ চেয়ে ছিল তখন সে ছেলেমেয়েগুলোকে কাপড় কাচতে, ঘরদোর পরিষ্কার করতে আর রাঁধতে শিখিয়েছিল।

সে সুহানার জন্যও কাজ করেছিল। সমস্ত ফরিদপুর জেলার মহিলাদের মধ্যে সে তার লেলের অভিজ্ঞতার কথা বলে বেড়াত। পরে সে সারা দেশের মেয়েদেরও সে কথা বলতে যেত, যাতে তারা বুঝতে পারে তাদের গর্ভাশয়ের গুরুত্ব। তার লেলের উপার্জনের টাকার যেটা সে রেখেছিল, যে টাকা তাকে জুলেখা দিয়ে গিয়েছিল, সুহানার সাথে নানান জায়গায় গিয়ে লেলের কথা বলে যে টাকা সে পাচ্ছিল সেসব দিয়ে দিন গুজরান হচ্ছিল, বাড়ি পাকা হওয়া সত্ত্বেও। 

তবু বেশ কয়েকমাস পর থেকেই টানাটানি শুরু হয়েছিল কারণ মইদুল বাইরে কাজে যেতে পারছিল না। সে জুলেখার ঘর আর তাদের ঘর-দালান পাকা করছিল। সিরাজুল কোনওদিনই কোনো খরচা দিচ্ছিল না। ফতিমা টের পেয়েছিল যে তাকে পরের বছর লেলে যেতেই হবে ঘরটা সামলাবার জন্য।

২০১৭

পেতাখ তিক্‌ভা ইস্রায়েল

এজ্রার জন্মদিনে জসুয়া আর এব্ল তাদের বাবামায়েদের আর ভাইবোনেদের নিমন্ত্রণ করেছিল। তাদের বন্ধুরা আর নোয়াও এসেছিল। নোয়াকে অনেক বেশি চনমনে আর খুশি দেখাচ্ছিল। জসুয়া অনেকবার তাকে খুশির কারণ জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু নোয়া কিচ্ছু বলে নি।

নোয়ার স্ত্রী লিয়াহ আর বাচ্চারাও এসেছিল অনুষ্ঠানে। জসুয়া লিয়াহকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। লিয়াহ লাজুক হেসেছিল। তারপর জসুয়া নোয়াকেও শুভেচ্ছা জানিয়েছিল তাদের চতুর্থবার সন্তান সম্ভাবনায়। নোয়া সশব্দে হেসে বলেছিল, "ধন্যবাদ। কিন্তু এটাই আমার খুশির একমাত্র কারণ নয়।"

জসুয়া আর কিছু জানতে চায় নি। জনা পঞ্চাশ অতিথি নিয়ে সেও যারপরনাই ব্যস্ত ছিল সে রাতে।

সেই সন্ধেতেই নোয়া জসুয়ার কিছু পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে জেনে গিয়েছিল যে জসুয়া পিতৃত্বের উপযোগী হয়ে উঠেছে। কিন্তু নোয়া খবরটা তখনই জসুয়াকে জানাতে চায় নি। সে জানত যে এব্ল আর জসুয়া দুজনেই চাইবে তাদের সংসারে জসুয়ার সন্তান শিগ্‌গির আসুক। কিন্তু নোয়া নিজেই বিব্রত ছিল এই ভেবে যে এব্লের পুত্র এজ্রা আর জসুয়ার সন্তানের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে। দুই সন্তানকেই যুগ্ম পিতা হিসেবে এব্ল আর জসুয়া দত্তক নিতে পারে। কিন্তু কোনও ভাবেই ওদের দুই সন্তানের মধ্যে কোনও জৈবিক যোগাযোগ থাকবে না।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ নোয়া ব্যাপারটা ভেবেছিল। তারপর সে যোগাযোগ করেছিল বদলি মা জোগানোর সংস্থাটিকে যারা এজ্রার জন্মের ব্যবস্থা করেছিল। সে এজ্রার মাকে খুঁজে বার করতে চেয়েছিল। যখন সংস্থাটি জানিয়েছিল যে এজ্রার জৈবিক মা তার বিশ্রামের বছরে আছে, তখন নোয়া আগাম ব্যবস্থা করেছিল পরের বছরে সেই মাকে পাওয়ার জন্য। মহিলাকে রাজি করানোর ব্যাপারটা সে সংস্থটির ওপরই ছেড়ে দিয়েছিল। 

গ্রাম: ফতেপুর, জেলা: ফরিদপুর, বাংলাদেশ

ফরিদপুর জেলার এক দূরের গ্রামে সাপ্তাহিক কথা বলে ফেরার পথে সুহানা ফতিমাকে বলেছিল, "মইদুলরে কয়ে ঠিক কাম করছ। সে অন্য কারুর থিকা শুনলি খুব খারাপ হতো। তুমিও নানান জায়গায় বদলি মা হওনের কথা কইবার কামটা নিতি পারতে না।"

ফতিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, "ভালো কাম তো টাকা আনে না। জুলেখা আওনের পর একটা সুযোগ পাইলে আবার যাব লেলে।"

সুহানা জিজ্ঞেস করেছিল, "শুধু কী টাকার জন্যি?"

ফতিমা উত্তর দিয়েছিল, "এখানে গরম, গুমোট। সেখানটা কেমন ঠান্ডা, ঠান্ডা।"

যথাসময়ে জুলেখা ফিরে এসেছিল। টাকা আর কাজ দুইই তার মনে ধরে ছিল। কিন্তু সে চটে ছিল অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে, বিষন্ন আবহাওয়ার ওপর। সে ফতেপুরে গরুর দুধের আর জৈবসারের ব্যবসা করবে ভেবেই ফিরেছিল। কিন্তু সে শুরুটা করেছিল বাড়িতে বিজলি এনে। মোটর দেওয়া লাঙল কিনে, বিজলি চলা ধানঝাড়াই কল লাগিয়ে। তার জমি ছিল না। কিন্তু দুটো যন্ত্রই সে ভাড়ায় খাটাতো ফসল রোয়ার সময় আর ফসল ওঠার পর। 

জুলেখার ব্যবসা বুদ্ধিতে ফতিমার গর্ব হয়েছিল।

পরে সুহানা ফতিমাকে জানিয়েছিল একই দম্পতিকে আরেকটা বাচ্চার জন্ম দিয়ে আরও কিছু রোজগার করার সুযোগ এসেছে। ফতিমা তো তৈরিই ছিল যাওয়ার জন্য।

২০১৮

গ্রাম: ফতেপুর, জেলা: ফরিদপুর, বাংলাদেশ

বাড়ি ফিরে ফতিমা টের পেয়েছিল যে ব্যবসার ওঠাপড়া চলতেই থাকে। জুলেখার ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু ঝুঁকি ছিল সারাক্ষণ টাকার জোগানের। 

ফতিমা টাকার জোগান দিতে দু বছর অন্তর লেলে যেতে মনস্থ করেছিল। মইদুল তাকে সমর্থন করেছিল। পরে আমিনাও তার প্রতি আচরণ বদলেছিল যখন জুলেখা বলেছিল, "ফতিমা আমার বড়ো ঠেকনা।"

ফতিমা টের পেতে শুরু করেছিল তার জীবনের শুরুতে না পাওয়া স্বাধীনতা, সোপার্জন আর সম্মান।

২০১৯

পেতাখ তিক্‌ভা, ইস্রায়েল

এব্ল আর জসুয়া অনেকদিন এই সন্ধেরই অপেক্ষায় ছিল। তাদের পুত্র এজ্রার সহোদরা, এস্থারের প্রথম জন্মদিন উদ্‌যাপণ করছিল। 

নোয়া খুশিতে ঝলমল করছিল এই সন্তুষ্টিতে যে সে বাচ্চাদের মধ্যে সম্পর্কের বিশ্রী জটিলতা কাটাতে পেরেছে। আরও অন্য অনেক কারণে নোয়া খুশি ছিল। তার পানীয়ে চুমুক দিতে দিতে সমাজের দ্বন্দ আর সেসবের সহজতম সমাধানের বিষয়ে তার নিজের অনুভবটা সে উপভোগ করছিল। সে নিশ্চিত যে মানুষের জীবন ধারণের প্রয়োজনজাত প্রযুক্তিগত এবং ব্যবসায়িক উদ্ভাবনী শতকের ধর্মীয় আর রাজনৈতিক ব্যবধান মিটিয়ে দিতে পারে। প্রমাণ ইস্রায়েলি নাগরিক এজ্রা আর এস্থারের জন্মে, রক্ষণশীল ইহুদি পিতার ঘরে, বাংলাদেশি মুসলিম মায়ের গর্ভে, সাংবিধানিক হিন্দু দেশ নেপালে, সমস্ত অভিবাসনের কূটনীতি ও ধর্মীয় রাজনীতিকে নস্যাৎ করে দিয়ে।

~~~

https://www.amazon.com/dp/B09GL3HDGK 

পড়া হয়ে গেছে? তাহলে কেমন লাগলো জানান: https://www.amazon.in/review/create-review/?ie=UTF8&channel=glance-detail&asin=B09875SJF8 





~~~

https://www.amazon.com/dp/B09GL3HDGK 

পড়া হয়ে গেছে? তাহলে কেমন লাগলো জানান:

https://www.amazon.in/review/create-review/?ie=UTF8&channel=glance-detail&asin=B09875SJF8 

Monday, October 4, 2021

More About Maternal Might


  Fatima had three daughters. She used to live in Bangladesh. She was frail and poor. She was unable to take care of herself and her daughters. One day she grabbed the opportunity that appeared before her. It led her to further opportunities. Eventually, her burden of maternity became her power that set her on the path of emancipation from poverty.


    Abel and Joshua used to live in Israel. They wished to have children of their own. There were physical obstacles and social dilemmas. They overcame everything by the actions of their visionary friend, modern technologies and ventures in service sectors.



Fatima became instrumental in the creation of the  family of Abel and Joshua. All of them got what each of them wanted by catering to each other's needs. In this story of personal achievements, some philosophical arguments on national identity reached a resolve.

It is now out on Amazon Kindle and free with Kindle Unlimited. 

https://www.amazon.com/dp/B09GL3HDGK 

Or, check here.

Hope you Enjoy reading it. Please REVERT with REVIEWS. Post your Reviews at: https://www.amazon.in/review/create-review/?ie=UTF8&channel=glance-detail&asin=B09GL3HDGK

Or Click here to write Review

Friday, September 24, 2021

About Maternal Might



Hello there,

Hope you all are good. Hope you all are enjoying yourselves. I am back with a new book. Its name is Maternal Might.

Maternal Might is a short read fiction. It is about a mother’s desperate endeavors in search of livelihood. It is, also, about fathers’ endeavor for family.

Poor, frail Fatima in Bangladesh was desperate to earn bread for her daughters. Her daughters had already learnt to digest hunger. They mustered the patience to see if they would get some food.

Business owners Joshua and Abel, from Israel, set their mind to start their family. One of them relocated his business to the other’s city. One of them was ready to risk a physical makeover to become parents.

Can Fatima and the couple Joshua and Abel, cater to their respective needs?



Maternal Might is rooted in a podcast I heard a few years ago. It speaks about women empowerment and gay rights. It depicts how humanity can reach the pinnacle of harmony by means of modern technologies and visionary initiative.

Short stories by Dr. Manos Chowdhury of Bangladesh helped me build the world of Fatima. Blogs and Vlogs about Israel helped me build the world of Joshua and Abel.

Maternal Might is ultimately an extraordinary tale of human actualization. It is the story of real union which seems impossible from a traditional viewpoint. 

It is now out on Amazon Kindle and free with Kindle Unlimited.

https://www.amazon.com/dp/B09GL3HDGK 

Or, check here.

Hope you Enjoy reading it and please REVERT with REVIEWS.

Post your Reviews at https://www.amazon.in/review/create-review/?ie=UTF8&channel=glance-detail&asin=B09GL3HDGK

Or Click here to write Review 



Readers Loved