৭২. আইভি গার্ডেন
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরে মিন হুয়ে এলো ছ্যুনতাং গার্ডেনের ব্লক এ-তে, যেখানে শিন ছির বিনচেং-এর অ্যাপার্টমেন্ট।
তার আগে, পর পর তিন বার শিন ছি ব্যবসার কাজে বাইরে গিয়ে ছিলো - দুবার বেজিং-এ, একবার সাংহাই-তে - প্লেনের সময় যাই হোক না কেনো, সব সময়েই ও গোধূলিতে ফিরে এসেছে আর মিন হুয়ের সঙ্গে ওয়ার্ডে কাটিয়েছে যতোক্ষণ না মিন হুয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। তারপরে চলে গেছে, যেনো কোনো আচার পালন করছে।
মিন হুয়ের কেবল মনে হচ্ছে যে ওর এসব করার কোনো দরকার নেই। সব কিছুর জন্য নার্স আছে। প্রায়ই ঝৌ রু জিও আসছে যাচ্ছে। ওর দেখাশোনা খুব ভালো হচ্ছে।
মনের গভীর অন্তস্তলে, ও নিশ্চয়ই প্রত্যেক দিন দেখতে চায় শিন ছিকে, কিন্তু ও এটাও জানে যে সেটা খুব বাস্তবসম্মত নয়। ওর মা-বাবার অকাল মৃত্যু ওকে স্বনির্ভর হতে শিখিয়েছে, বিশেষ করে গত কয়েক বছরে একলা মা হয়ে, যতো কঠিনই হোক না কেনো, ওকে সব কিছুই নিজেকে করতে হয়েছে। আর ওর কোন উচ্চাশাও ছিলো না কারুর থেকে কোনো রকম সাহায্য পাবার।
যতো বার ওয়ার্ডে আসে শিন ছি, প্রত্যেক বারই সঙ্গে প্রচুর কাজ নিয়ে আসে। ওয়ার্ডে কোনো ডেস্ক নেই, সেই জন্য ও বিছানাতেই কম্পিউটার আর কগজপত্র গাদা করে রাখে, মিন হুয়ের পাশে বসে টাইপ করতে থাকে।
কখনো কখনো নিচু গলায় ভয়েস মেসেজ করে, খানিক ক্ষণ ইংরেজিতে, খানিক ক্ষণ ফরাসিতে, আমেরিক্যানদের জন্য আমেরিক্যান ইংরেজি, ব্রিটিশদের জন্য অক্সফোর্ডের উচ্চারণ, অনায়াসে নানান চলচল করে অনেকগুলো ভাষা – মিন হুয়ে স্পষ্ট কিছুই শুনতে পায় না ওষুধের ঘোরে, শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে।
“কেনো রোজ আসিস এখানে?" কখনো কখনো জিজ্ঞেস করে ও।
“আসতে পারি না আমি?”
“তুই কী আমাকে পছন্দ করিস?”
শিন ছি মাথা নাড়ে, “না।”
“তাহলে এখানে রোজ কেনো আসিস?”
“আসতে পারি না?”
“তুই নিশ্চয়ই আমাকে পছন্দ করিস?”
“তুই বড্ডো বেশি ভাবিস, মিন হুয়ে।”
কথার লড়াই এভাবে চলতে থাকে একটা অনন্ত চক্রে।
কখনো কখনো মিন হুয়ে জানতে চায় অ্যাকুজিসনের কাজ কতোটা এগোলো, “আজকাল করছিসটা কী? গুয়ান ছাও-এর বেচাকেনা এতোদিন ধরে বন্ধ আছে।”
একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি জেগে ওঠে ওর মুখে, “আমার কাজের ব্যাপারে, আমি তোকে অল্প কথায় ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবো না, কেনো আমি তোকে সবটা বলতে পারি না? বেশ একটা উদাহরণ দিয়ে বলার চেষ্টা করি, একটা পুকুরের ধারে, একটা গাছের ডালে, পাঁচটা ব্যাঙ বসে আছে। তাদের মধ্যে চারটে সিদ্ধান্ত নিলো নিচে ঝাঁপ দেবে। তাহলে কতগুলো ব্যাং বসে রইলো গাছের ডালে?”
“অবশ্যই একটা বসে রইলো।" উত্তর দেয় মিন হুয়ে।
“ভুল।”
“আহ্?”
“পাঁচটা।”
“কেনো?”
“কারণ ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া’ একটা জিনিস, আর ‘করে ফেলা’ আরেকটা।”
শিন ছি হাত ছড়িয়ে দেয়, “আমি রোজ এই দুটো কাজ করি, হয় ব্যস্ত থাকি সিদ্ধান্ত নিতে, না হলে ব্যস্ত থাকি কাজ করতে।”
চোখ পাকিয়ে ছাদের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিন হুয়ে, “অনেক ক্ষণ হয়ে গেলো, আমি একদম কিচ্ছু না বলে থাকি নি।”
“সেই জন্য, জিজ্ঞেস করিস না। এটা এমন একটা জিনিস নয় যেটা নিয়ে তুই মাথাব্যাথা করতে পারিস।”
মিন হুয়ে দেখলো যে শিন ছি আবার মন দিয়েছে হাতের কাগজগুলো পড়াতে। ও একটু নিচু স্বরে, ‘অ্যাই’ বললো।
“যাই হোক, আমি তোকে ফিরিয়ে দিচ্ছি যে দশ লাখ যেটা তুই আমাকে দিয়ে ছিলি। তা ছাড়াও আমার আরো চার লাখ আছে। সব মিলিয়ে চোদ্দো লাখ। আমি সবটা তোকে একসাথে দিয়ে দেবো।”
ও সোফার ওপরে রাখা হাতব্যাগটা দেখালো, “ আমার ভয় যে টাকাটা তোর লাগবে। ক্যাশ করার জন্য চেক লেখা হয়ে গেছে, ওটা ঐ শৌতিবাও-তে আছে।”
ও জানে যে ওর টাকাটা সিন্ধুতে বিন্দু, কিন্তু ওর আর্থিক ক্ষমতায় ও ঐটুকুই করতে পারবে।
শিন ছি সামান্য চমকে উঠলো, তারপরে হাসলো, “বেশ, তুই খুব উদার, কিন্তু আমার দরকার নেই রে।”
ওকে অপ্রস্তুত হতে দেখে, শিন ছি আরো বললো, “দোচি, তোর দয়ার জন্য। হালকা করে নে, এতো জোর দিস না সব ব্যাপারে, সু তিয়াঁর মতো বেপরোয়া হয়ে যাস না।”
মিন হুয়ে তাকালো শিন ছির দিকে, “আমি জানি তুই আমাকে সাহায্য করছিস, কিন্তু আমি কিছুতেই সইতে পারবো না যে তোরা দুজনেই আমার জন্য শেষ হয়ে গেলি।”
“আমি তোকে সাহায্য করছি না, মিন হুয়ে।”
শিন ছি বললো কোনো তাপোত্তাপ ছাড়াই, “আমি কেবল সু তিয়াঁকে দেখেছি তোর মধ্যে।”
এই কথা হওয়ার পরের দিন মিন হুয়ে আসে ছ্যুনতাং গার্ডেনে।
সেদিন সকালে শিন ছিকে বেজিং-এ যেতেই হলো, জরুরী মিটিং আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে। দুপুরে এসে ও মিন হুয়েকে নিয়ে যাবে এমনটাই ভেবে ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে প্লেন জরুরী অবতরণ করলো চ্যাংশাতে, বাজ পড়ার জন্য। শিন ছি হাসপাতালে পৌঁছোলো সন্ধে সাতটার সময়ে।
ওকে ক্লান্ত আর চিন্তাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে।
বিত্ত নিয়ে যতো খবর সে সব বলছে যে ব্লু বার্ড গ্রুপ -বিবিজি আর গুয়ান ছাও-এর মধ্যে অ্যাকুজিসনের লড়াই একটা অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। দু দলই এখন গোপণ প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
শিন ছির দিকে, যেহেতু ও য়ুআঁ মাও-এর সাহায্য আর পাবে না, সেই জন্য ও সর্বত্র পুঁজির খোঁজ করছে, আর দাঁতে দাঁত চেপে আছে।
ব্যবসার ভেতরে থাকা লোকেরা বলছে যে গুয়ান ছাও যে লাগাতার ভালো টাকা রোজগার করে চলেছে সেই জন্যই বিবিজির লাভই হবে যদি ওরা কেবল গুয়ান ছাও-এর অংশীদারী ধরে রাখতে পারে, যদি ওরা গুয়ান ছাও কোম্পানিটা পুরোপুরি নিয়ে নিতে নাও পারে।
গুয়ান ছাও-এর জন্য দিন কাল সহজ নয় আর। কোম্পানির প্রতি বিশ্বাস নাড়া খেয়েছে খুব। নানান দল এসে কর্মীদের কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে প্রায়। বিদেশি পুঁজি আর ব্যাঙ্কের থেকে ধার পাওয়া দুটোই বন্ধ হয়ে গেছে, ওরা অপেক্ষা করছে, অবস্থার দিকে চোখ রেখে চলছে। বেশ কিছু প্রজেক্টের শর্ত বদলে গেছে, সেগুলোর কাজে বাধা পড়েছে, এমনকি কোনো কোনো প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে গেছে সমদর্শিতার অভাব দেখিয়ে।
সাও মু বলেছে যে শিন ছির পুঁজি জোগাড়ের অবস্থা খুব ভালো নয় আর কোনো বড়ো খবরও নেই এই ব্যাপারে।
এদিকে গুয়ান ছাও-এর দিকে শোনা যাচ্ছে যে ওরা একটা উদ্ধারকর্তা খুঁজে পেয়েছে, আর ওদের মধ্যে নাকি কথাবার্তাও হয়ে গেছে।
এরকম একটা সংকটের সময়ে শিন ছি জোর করছে মিন হুয়েকে ওর নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ওর সঙ্গে থাকতে হবে বলে মিন হুয়ের সেরে ওঠার জন্য – ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত।
অবশ্যই ওর অ্যাপার্টমেন্ট অনেক বড়ো, আলো বাতাসও বেশি। সব রকমের ব্যবস্থা আছে। অনেকগুলো ঘর। বড়ো কলঘর, যেটা রুগির জন্য খুবই সুবিধের।
প্রথমে মিন হুয়ের ইচ্ছে ছিলো না শিন ছিকে ঝামেলা দেবার, পরে যখন মনে হলো যে এখানে থাকলে রোজ সু ছনের সঙ্গে দেখা হবে, ও আর আপত্তি করলো না।
কিন্তু মনের গভীরে ওর দ্বিধা, সংশয় কিছুতেই দূর হলো না, কোন অধিকারে ও থাকবে শিন ছির বাড়িতে? ও মিশবেই বা শিন ছির সঙ্গে কোন ভূমিকায়?
বলার অপেক্ষা রাখে না যে ও শিন ছির সন্তানের মা, কিন্তু ওদের কোনো দিন বিয়ে হয় নি।
আর প্রেমিকা, সে তো মেনে নিতে শিন ছি অস্বীকার করেছে।
যদি সু তিয়াঁর জন্য না হোতো, তা হলে হয়তো ওদের কোনো দিন এ জীবনে পরস্পরকে এমন করে জানা হয়ে উঠতো না।
এখনকার সম্পর্কটা একটা সূক্ষ্ম ভারসাম্যে পৌঁছেছে বলা চলে, অবশেষে দু জনের জন্যই কোথাও কোনো অপ্রস্তুত হয়ে পড়া নেই – মিন হুয়ের মনে হচ্ছে এটাই খুব ভালো। এখান থেকে যেদিকে বয়ে যাবার সেদিকে বয়ে যাক এই সম্পর্ক।
বাড়িতে, শিন ছি মূল শোবার ঘরটা ছেড়ে দিলো, মিন হুয়েকে হুইল চেয়ার থেকে বিছানাতে বয়েও নিয়ে গেলো।
মিন হুয়েকে বিছানাতে নামিয়েই ওর খেয়াল হলো যে লেপটা ভাঁজ করা হয় নি, চাদর বদলানো হয় নি, বালিশের মধ্যে একটা গর্ত হয়ে আছে, সব কিছু তেমনই পড়ে আছে ও যখন ঘুম থেকে উঠে ছিলো, তাই ও নিজের মাথায় একটা চাপড় না মেরে পারলো না, “উপস্, আমি ভোরে উঠেছি প্লেন ধরার জন্য, চাদর বদলাতে ভুলে গেছি।”
“ঠিক আছে।”
মিন হুয়ে সোজা শুয়ে আছে। কোমরে একটা বেল্ট বাধা শ্রোণীর সুরক্ষার জন্য, ওর এক পাশে একটা কী যেনো দলা পাকিয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে মিন হুয়ে বার করে আনলো দলাটা – একটা সাদা গেঞ্জি।
শিন ছি চটপট ওটা নিয়ে নিলো। ছুঁড়ে দিলো ঝুড়িটাতে যেখানে বাকি সব কাপড় জড়ো করে রাখা আছে পরে কাচা হবে বলে, “না চাদরটা বদলাতেই হবে। ওটা পাতা আছে এক সপ্তাহের ওপরে।”
শিন ছি পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব যত্নশীল, কিন্তু ব্যাপারটা পরিস্থিতির ওপরেও নির্ভর করে খানিকটা। মূল কথা হলো রোজ বেচে থাকার গুণগত মানটা ধরে রাখার ব্যপারে ও নিখুঁত হতে চায়, তবে অবসর পেলে। ব্যস্ত থাকলে, ও বেনিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নেয়, কাগজপত্র ঢিবি হয়ে পড়ে থাকে, জামাকাপড় ছুঁড়ে ফেলা থাকে, আর বাড়িটা মুর্গির খাঁচা হয়ে ওঠে।
ক্লোজেট খুলে এক প্রস্থ সাদা চাদর বার করে আনলো। পাশে রাখলো। মিন হুয়েকে সাহায্য করলো আস্তে আস্তে পাশ ফিরতে, পুরোনো চাদরটা একদিক থেকে গুটিয়ে নিলো মাঝবরাবর, মিন হুয়েকে গড়িয়ে যেতে দিলো অন্য দিকে, আর তাড়াতাড়ি নতুন চাদরটা পেতে ফেললো। পুরো ব্যাপারটা সারতে দু মিনিটেরও কম সময় লাগলো।
মিন হুয়ে আশা করে নি শিন ছি এতো দক্ষ হতে পারে, “অ্যাই, তুই কোথা থেকে শিখলি এটা?”
“নার্সদের থেকে। আমি তোর থেকে অনেক বেশি সময় এরকম করে শুয়ে থেকেছি।”
সদ্য বদলানো চাদরে লিলির গন্ধ, সুতোগুলো মচমচে, মনে হচ্ছে সিল্কের ওপর শুয়ে আছে। মিন হুয়ে সু ছনের সঙ্গে এই অ্যাপার্টমেন্টে থেকেছে কিছু দিন, জায়গাটা ওর অপরিচিত বলে মনে হয় নি।
যখন ওর মনে পড়লো যে আগামী একমাস রোজ ওরা একসাথে থাকবে, ও কিছুতেই সহজ হয়ে উঠতে পারলো না। ওর হঠাৎ মনে হলো ও যেনো সাবধানী হয়ে উঠছে।
এই সংযম শুরু হয়েছে ও যখন হাসপাতাকে ছিলো তখন থেকে। সমাধান হলো শিয়ামি অ্যাপে গান শোনা, ইয়ারফোনের ভলিউম উঁচু করে রাখা যাতে পাগলাটে চিন্তা কিছু না আসে মাথায়। অথবা ইয়ারফোন খুলে রেখে ওর কথা শোনো, যাই বলুক তাতে বাধা দেবে না, শুধু সম্মতিতে মাথা নেড়ে যাও -
“ও, তাই বুঝি?"
“বু শি!"
“দোয়ে।”
“সে তো খুব ভালো।”
— দুর্ঘটনাবশত ভুল কিছু বলে ফেলার ভয়ে, মিন হুয়ে ব্যাপারটা নিয়ে কিছু একটা বলবে আর তাই নিয়ে দুজনের লড়াই শুরু হয়ে যাক আর কি। তখন তো অসম্ভবও হয়ে যাবে মিন হুয়ের পক্ষে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে চলে যাওয়াটা।
ওকে কোনো কথা না বলে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে শিন ছি দুম করে জানতে চাইলো, “তুই কী কলঘরে যাবি? একটা পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় টয়লেট সবে লাগিয়েছি।”
“না।”
“টিভি দেখবি?”
“না।”
“তাহলে কী করতে চাস তুই?”
“আমি কী করতে চাই। শুয়ে থাকাই ভালো। একটু পরে হয়তো ঘুমিয়েও পড়বো।”
“ঠিক আছে, আমাকে কাজ করতে হবে, কয়েকটা ইমেলের জবাব দিতে হবে, এখানে বসেই করে নেবো, তোর কী অসুবিধে হবে?”
ও এতো বিনম্র যেনো অ্যাপার্টমেন্টটা মিন হুয়ের। তাই মিন হুয়ে কেবল বলতে পারলো, “করে নে কাজ।”
ঘরে যথেষ্ট গরম। ও কোট আর টাই খুলে ফেললো। পায়ে স্লিপার গলিয়ে নিলো, ব্যাগ থেকে কম্পিউটার বার করে নিলো। সোফায় বসলো বিছানার পাশে আর মন দিয়ে টাইপ করতে শুরু করলো।
মিন হুয়ে পাশেই বিছানাতে শুয়ে ছিলো, দু জনে এতো কাছাকাছি যে মিন হুয়ে লেবুর গন্ধ পেতে লাগলো শিন ছির থেকে।
ও টাইপ করে চলেছে, মিন হুয়ে মাথা বাঁকিয়ে চুপচাপ ওকে দেখছে।
শিন ছির মুখটা একটা পাশ থেকেও সুন্দর, সরু গলা, স্পষ্ট চোয়াল, অল্প উঁচু নাক, তাতে ওকে খুবই ধারালো দেখায়।
আরাম করে খাড়া বসে - দু কাঁধ ছড়ানো, পিঠ সোজা – মিন হুয়ের মনে হচ্ছিলো বসার ধরণটা ক্লান্তিকর, কিন্তু মনে হচ্ছে যেনো ওর পুরোপুরি অভ্যেস হয়ে গেছে এভাবে বসাতে।
কুড়ি মিনিট পরে মনে হলো যে ইমেল বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। ও নোটবুকটা বন্ধ করে দিলো, কোমড়টা টান টান করলো, জিজ্ঞেস করলো, “চা, কফি, ফলের বা সব্জির রস কিছু খাবি?”
মাথা নেড়ে মিন হুয়ে না বললো, দেখতে লাগলো ও রান্নাঘরে গেলো এক কাপ কফি বানিয়ে নিতে।
ও ফিরে এসে বসলো ওর আগের জায়গাতেই, ধীরে ধীরে চুমুক লাগালো, কফি খেতে খেতে হাই তুলতে লাগলো।
“সু ছন কোথায়?”
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “এখনো ফেরে নি কেনো?”
শিন ছির মনে পড়ে গেলো যে আজ পিয়ানো শেখার দিন।
“ওর আজ বিকালে পিয়ানো বাজানো আছে। শেষ হবে রাত নটা তিরিশে। আর আমি শেন হানকে বলে দিয়েছি ওকে ওখানে নিয়ে যেতে।”
মিন হুয়ে আরো কতোগুলো প্রশ্ন করতে চাইছে ওকে, কিন্তু পাশের টেবিলে রাখা ওর ফোনটা সমানে কাঁপতে শুরু করলো। ও ফোনটার দিকে এক ঝলক দেখলো কোন নম্বর থেকে ফোন আসছে।
“আমি পাশের ঘরে গিয়ে ফোনে কথা বলবো।”
ও স্টাডিতে রইলো আধঘন্টা। ঘরটা খুব অন্ধকার ছিলো, একঘেয়েমিতে মিন হুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
মিন হুয়ে জানেও না যে ও কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে, কিন্তু ও যখন আধজাগা আধা ঘুমন্ত, ওর মনে হলো হঠাৎ ওর সঙ্গে যেনো কেউ কথা বলছে।
হঠাৎ চোখ খুলে দেখলো শিন ছি হাঁটু মুড়ে বিছানায় বসে আছে, মিন হুয়ের শরীরটা শক্ত করে ঠেলে ধরে আছে।
“অ্যাই, অ্যাই, তুই বিছানার ওপরে এতো নড়াচড়া করতে পারবি না।”
ওর স্বর নরম, প্রায় শোনাই যায় না, “এখনো হাড়গুলো ভালো বাড়ে নি।”
মিন হুয়ে ওর দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে দেখলো, ভাবলো বুঝি বা স্বপ্ন দেখছে, “হুহ্? আমার কী হয়েছে?”
“তুই কী স্বপ্নে সাঁতার কাটছিস?”
ও মিন হুয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, ওর দু চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে একপাশ থেকে অন্যপাশে, যেনো খুঁজছে কিছু, “নখ, দাঁত বার করে?”
“তুই জানলি কী করে?”
“তোর ভঙ্গিমা দেখে।”
মিন হুয়ে হেসে ফেললো, এতোক্ষণে ওর ঘুমটা পুরো ভেঙে গেলো। একটা বড়ো বরফের টুকরো ওর কপালে দেওয়া। খুব ঠান্ডা লাগছে ওটা।
“তোর জ্বর এসেছে।”
শিন ছি বললো, “থার্টি-নাইন ডিগ্রি আর হাফ। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছি। ডাক্তার বলেছে যে একদিনে জ্বর না কমলে তোকে আবার হাসপাতালে যেতে হবে।”
“লেপটা খুব মোটা।”
মিন হুয়ে ঘাম ছিলো, একতাল ভিজে কাপড়ের মতো।
শিন ছি লেপটা বদলে একটা হালকা লেপ দিলো। ঘরের হিটিং বাড়িয়ে দিলো, আর ওকে একটা জ্বর কমাবার ওষুধ দিলো।
মিন হুয়ের নাকে গন্ধ পৌঁছোলো নারকোল দেওয়া রুটির। ওর মনে পড়ে গেলো এটা সু ছনের খুব প্রিয়।
“তুই কী রাতের খাবার বানাচ্ছিস?”
“আমি একটা সেঁকেছি।”
কথাটা শেষ হতেই একটা বাচ্চার খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে এলো। একটা চেহারা দৌড়ে এলো, ডাকলো, “মা”। ওর মাথাটা মিন হুয়ের মুখে গুঁজে দিলো, আর গভীর চুমু দিলো মিন হুয়কে।
“মা, ও মা, তোমার ‘ব্যাং ব্যাং’-এ কী এখনো ব্যাথা আছে?”
– অ্যামেরিকান ইংরেজিতে ‘ব্যাং ব্যাং’ মানে পশ্চাদ্দেশ।
“ব্যাথা নেই, অনেক ক্ষণ আগেই চলে গেছে।” নরম সুরে বললো মিন হুয়ে।
“মা, ও মা, তোমার খিদে পেয়েছে? ড্যাড অনেকগুলো রুটি সেঁকেছে।" সু ছন বলতে লাগলো ওর সামনে লাফাতে লাফাতে, “আমি কী তোমাকে খাইয়ে দেবো?”
“দেবে তুমি?" প্রশ্ন করলো মিন হুয়ে।
“হ্যাঁ। হ্যাঁ। তুমি আমাকে রোজ খাইয়ে দিতে, তাই না?”
সু ছন দৌড়ে রান্নাঘরে গেলো হাসি মুখে, এক টুকড়ো রুটি নিয়ে এলো, কয়েকটা আরো ছোটো টুকড়ো করে নিলো তার থেকে, আর খাইয়ে দিলো মিন হুয়েকে।
*****
রাতে শিন ছি মিন হুয়কে বয়ে নিয়ে গেলো কলঘরে। ওর মুখ কুলকুচি করিয়ে দিলো, মুখ ধুইয়ে দিলো, গা মুছিয়ে দিলো, সব সারা হতে আবার বয়ে নিয়ে এলো বিছানায়।
সু ছন এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
শিন ছি বসে ছিলো বিছানার পাশে সোফাতে হাতে হাত দিয়ে, চার্ট আর ডেটা দেখছে, ক্যালকুলেটরে টাইপ করে চলেছে।
“শিন ছি, তুই কী গুণছিস যে তোর কাছে আর কতো টাকা পড়ে আছে?” প্রশ্ন করলো মিন হুয়ে।
“না।”
“চিন্তা করিস না। তুই যদি দেউলে হয়ে যাস, তাহলে আমার কাছে চলে আসিস।”
বললো মিন হুয়ে, “আমরা একসাথে অ্যাপস্ লিখবো, আর টাকা করবো।”
“আমি অ্যাপস্ লিখতে পারি না।”
“আমি লিখতে পারি। তুই বলবি, আমি লিখবো, আমি তোকে ওটা বানাতে সাহায্য করবো। আমি তো দেখছি তোর প্রচুর ভাবনা আছে।”
“বেশ, তুই যখন অদ্দুরই গেলি, তবে জেনে রাখ, অ্যাপস্ কেনো, আমি তিলের খাজাও বেচতে পারি, হ্যাঁ।”
“এই ওপরে আর নিচে চলতে পারাটা বেশ ভালো।”
শিন ছি ক্যালকুলেটরে টাইপ করে যেতে লাগলো। খানিক পরে মিন হুয়ে আবার জানতে চাইলো, “শিন ছি, আমাকে সত্যিটা বল।”
“শুনছি।”
“তুই কী আবেগে ভেসে এই অ্যাকুইজিসনটা করছিস? তুই যথেষ্ট খোঁজখবর করেছিস কী আগে? তুই কতোটা নিশ্চিত?”
“আমি একজন ইনভেস্টর, জুয়াড়ী নই, স্পেকিউলেটর নই। অবশ্যই একটা লিস্টেড কোম্পানির দখল নিতে গেলে খুঁটিয়ে খোঁজখবর করতে হয়। আমি যদি রোজগারের ব্যাপারে নিশ্চিত না হই, আমি তাহলে শুরুই করতাম না।”
“ওগুলো সবই বাড়ছে, তাই আমিও আশায় আশায় আছি। অবশ্যই আমি হিসেবের খাতায় নজর রেখে চলেছি খুব গুরুত্ব দিয়ে, কোথা থেকে টাকা আসছে, কোথা দিয়ে টাকা যাচ্ছে, আমার পুরো লগ্নি থেকে আমার আয় কী হতে পারে, লাভটা কেমন হবে - ফিরে লগ্নি করা যাবে কিনা, কতোবার করা যেতে পারে।
“তাহলে বলা যায় যে এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, তুই অনেকদিন ধরেই এটার ওপরে নজর রেখে চলেছিস, যাতে আরো টাকা করতে পারিস।”
“আমার তো তাই মনে হয়।”
“আমি কী তাহলে নিজেকে বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছি?”
“দোয়ে।”
“শুনে কেমন জানি কষ্ট হচ্ছে!”
“তুই তো আমাকে সত্যিই বলতে বললি।”
“এমন কিছু বলতে পারিস না, যেটা শুনতে ভালো লাগে?”
“তোর জ্বর হয়েছে, আমার কিছু বলার দরকার নেই, তুই তো স্বপ্ন দেখতে পারিস …”
মিন হুয়ে একটা বালিশ ছুঁড়ে দিলো ওর দিকে, মাথা না তুলেই ও হাত বাড়িয়ে বালিশটা পাশে রেখে দিলো, বার দুয়েক মুচকি হাসলো, তারপরে বালিশটা রেখে দিলো।
মিন হুয়ের কপালের একদিকে আবার বরফের বোঁচকাটা চাপিয়ে দিয়ে, ফের টাইপ করতে লাগলো।
মিন হুয়ের কল্পনায় একটা ভীষণ সুন্দর বাড়ি এরকমই।
মিন হুয়ে খুব চিন্তা মুক্ত হয়ে গেলো, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো।
ভোরের দিকে আবার ওর ঘুম ভেঙে গেলো, জানলার বাইরে আকাশটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
দেখলো যে শিন ছি ঘুমিয়ে আছে ওর পাশে। জামাকাপড় সব আঁটসাঁট করে পরা, একটা কম্বল চাপা দেওয়া পুরো শরীর জুড়ে।
গভীর ঘুমে ডুবে আছে, শ্বাসের গতি সমান ছন্দে চলেছে। হাতে একটা বরফের বোঁচকা ধরা। প্রায় সারা রাত ধরে ওর খেয়াল রেখেছে।
ও প্রথমে শিন ছির হাতটা ছুঁলো, ফের বুকে হাত রাখলো, সমান তালে চলতে থাকা হৃৎপিন্ডের গতিটা অনুভব করলো। পাশ ফিরলো শিন ছি, মুখ ফিরে গেলো ওর দিকে, শিন ছির কপাল ঠেকলো ওর গালে।
মিন হুয়ে আলতো চুমু খেলো, কোনো সাড়া নেই দেখে, ও আবার চুমু খেলো।
এবার একটু বেশি সময় নিয়ে। শিন ছির ঠোঁট নরম, সামান্য শুকনো, প্রাণময় রক্তাভ।
মুখের গভীরে চুমু খাওয়া সেরে, মিন হুয়ে মন দিলো মুখমন্ডলে, নাকের ডগায় চুমু দিলো …
অনেকক্ষণ ধরে চুমু দিয়ে, মিন হুয়ে সরে এলো একটু, আর দেখতে পেলো চোখ মেলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে শিন ছি, অপলক দৃষ্টিতে।
হঠাৎ মিন হুয়ের মুখ রাঙা হয়ে উঠলো —
“মাথা ঘোরা ওদিকে।" শিন ছি বললো নির্বিকার মুখে।
মিন হুয়ে ভাবলো শিন ছি বুঝি ভয়ানক রেগে যাবে এবারে, মিন হুয়ে মাথা ঘোরালো বেশ ভয়ে ভয়ে, বালিশে মুখটা গুঁজে দিলো প্রায়।
শক্ত একটা কী জিনিস ওর কানে ভরে দেওয়া হলো, খানিক পরে সেটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে শব্দ করতে লাগলো।
“সাঁইত্রিশ ডিগ্রি আর এক।”
কানে গোঁজার থার্মোমিটারটা দেখতে দেখতে শান্ত স্বরে শিন ছি বললো, “তোর জ্বর কমছে।”
******
দু সপ্তাহ পরে।
বিনচেং-এর পশ্চিমের মফস্বল এলাকায়, হাইওয়ের ধার ঘেঁষে এক সারি পোড়ো কারখানা থেকে ‘শুকতারা পথের কুকুর উদ্ধার ঘাঁটি’ কাজ করে। সবে মাত্র বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাটিটা কাদায় ভরা, সর্বত্র আগাছা বেড়েছে।
শিন ছি গাড়ি থেকে নেমে পাঁচশো মিটার হেঁটে গেলো ঘাঁটির কাজের জায়গা অবধি।
দরজাটা আধখোলা। এবং একজন মহিলা রোদ চশমা আর জিনস্ পরে নিচু স্বরে বছর তিরিশেক বয়সের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছে।
ওকে দরজায় টোকা দিতে দেখে, মহিলা থেমে পাথর হয়ে গেলো এক মূহুর্তের জন্য, “শিন ছি জঁ, শিন জঁ, কোন হাওয়ার ধাক্কায় এখানে এসে পড়েছেন? এর মধ্যেই?”
“সাওশাং হাও, নুশি।”
এই মহিলা হলো ঝেং য়িতিং, চেং ছিরাং-এর স্ত্রী। এর সঙ্গে শিন ছির সাক্ষাৎ হয়েছে আগে অনেকবার, তাই দু জনেই পরিচিত।
দু জনে করমর্দন করলো। ঝেং য়ি তিং রোদচশমা খুলে ফেললো। শিন ছির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, “আপনি জানলেন কী করে আমি এখানে?”
“সবাই বলে যে আপনি রাস্তার কুকুরদের উদ্ধার করে রাখার জন্য একটা জায়গা করেছেন শহরের পশ্চিমে। আমি এলাম, একবার নিজে চোখে দেখতে।”
ও হেসে বললো, “আমি এক ট্রাক কুকুরের খাবার এনেছি। ড্রাইভার পরে সেগুলো এখানে এনে দেবে।”
“শিয়া শিয়া।" হাসলো ঝেং য়ি তিং।
“আমি ভেতরটা একবার দেখতে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে দেখতে যাবেন?”
“ওকে।”
দু জনে পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগলো। ডানদিকে ঘুরলো। মুখোমুখি রাখা আছে কুকুরের খাঁচা। নানান মাপের, নানান জাতের পথের কুকুর রাখা আছে, দেখতে বিধ্বস্ত আর এলোমেলো।
যেই দেখলো যে কেউ আসছে, অমনি এদিক ওদিক দৌড়োতে লাগলো, চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো, প্রচুর শব্দ করতে লাগলো।
“কখনো কুকুর পুষেছেন?” প্রশ্ন করলো ঝেং য়ি তিং।
“নিউ ইয়র্কের বাড়িতে একটা কোলি আছে। বারো বছর বয়স, আমার মা-বাবার সঙ্গে থাকে।”
কোলি |
“বারো বছর বয়স? সেতো আমার ঠাকুর্দা।”
“হ্যাঁ। এখনো বেশ স্বাস্থ্যবান, খাওয়া-দাওয়া করে ভালো করে। একটু ঢিমে তালা হয়ে গেছে, বেশি নড়াচড়া করতে চায় না।”
তারপর ও মোবাইল ফোন বার করে ছবির অ্যালবামে গিয়ে আঙুল দিয়ে ঠেলে ঠেলে একের পর এক ছবি দেখাতে লাগলো, “এই যে, এই হলেন তিনি, কাঠের গুঁড়ো খেতে ভালো বাসে, তাই আমি ওকে পার্কে নিয়ে যেতে সাহস করি না।”
“এরকম একটা কুকুরের সঙ্গে বেড়ে উঠতে ভালোই লাগে।”
ঝেং য়ি তিং দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ছোট্টোখাট্টো চেহারা, তবে নিজের যত্ন নেয় যে খুব ভালো করে সেটা দেখলেই বোঝা যায়। মুখটা গোল, কোনো রকম চিকিৎসা করিয়েছে, মুখটা এতো ফর্সা আর নরম সব সময়ে ঝকঝক করে।
হার্মেসের কুমীরের চামড়ার একটা লম্বা করে ঝোলানো যায় এমন ঝোলা ওর শরীরের আড়াআড়ি ঝুলছে, শান্ত, সমাহিত আচরণের সঙ্গে।
হার্মেসের কুমীরের চামড়ার লম্বা করে ঝোলানো যায় এমন ঝোলা |
নিশ্চিত করে বলা যায় যে ও ঝেং ল্যানেরই মেয়ে। ছেলেবেলা থেকে ও কোনোদিন কোনো অভাব দেখে নি।
“গুয়ান ছাওতে আমার একটা অফিস আছে, আপনাদের বাড়িটার ঠিক উল্টো দিকে।” বললো ও, “আমার সাথে দেখা করতে এখানে এতো দূরে এলেন যে?”
“নিশ্চয়ই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে গুয়ান ছাওতে যেতে পারি, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে আমাকে ওখানে ঢুকতে দেবে কিনা সন্দেহ আছে।" বললো শিন ছি।
ঝেং য়িতিং থেমে গেলো। নড়লো না এক পাও। শিন ছির দিকে ঠান্ডা চোখে তাকালো, কোনো উত্তর দিলো না।
ঘুরে শিন ছিকে নিয়ে গেলো একটা ছোট্টো ঘরে যেখানে অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা করা হয়। ঘরটাতে একটা টেবিল আর চারটে দড়ির চেয়ার আছে। চেয়ারের দিকে দেখিয়ে বললো, “আসুন, বসুন এখানে। আপনি নিশ্চয়ই এখানে কুকুর দেখতে আসেন নি। তাই না?”
“আমি আপনার কাছে এসেছি কারণ আমি মনে করি যে আপনি একজন খুবই যত্নশীল মানুষ।" শিন ছি হালকা হাসলো, “আমি আপনাকে এটাই জানাতে এসেছি যে বিবিজি এই জন্য নিতে চায় গুয়ান ছাও যে কোম্পানিটার ভবিষ্যত সম্পর্কে তারা উচ্চাশা রাখে। এটা একটা ভালো অর্থকরী লগ্নি।”
“অর্থকরী লগ্নি?”
নাক দিয়ে আওয়াজ করলো ঝেং য়িতিং, “আমার সাথে এইও খেলাটা নাই বা খেললেন শিন জঁ। আপনার লগ্নির ব্যবসা আর আপনি আমাদের গুয়ান ছাওতে ট্রিপল এ ক্রেডিট রেটিংটাই দেখেছেন। যদি বিবিজি নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে গুয়ান ছাও-এর, তাহলে আপনি গুয়ান ছাও-এর পুঁজির গলিঘুঁজি ধরে আপনার অন্য প্রজেক্টে টাকা লাগাতে পারবেন, যাতে আপনার ধারের ওপরে সুদের হার খুব কম হয়, তাতে আপনার লগ্নির খরচ কমে যাবে অনেকটা, লাভ হবে বেশি। আমাকে বলবেন না যা এই সব হিসেব আপনি করেন নি।”
এই কথাগুলো শেষ করে, মুখটা সামান্য তুলে চোখ বুলিয়ে নিলো শিন ছির মুখের ওপরে। চুপ করে বসলো আর দেখতে লাগলো শিন ছির প্রতিক্রিয়া। এক জন কর্মী এসে দুটো কাপে দু জনকে চা ঢেলে দিলো।
“আপনি ভুল বুঝেছেন। বিবিজির ধার শোধার গুণমান খুব উঁচু দরের। আমরা গুয়ান ছাও নিলে গুয়ান ছাও-কে নিজেদের সুবিধের জন্য ব্যবহার করবো না বা গুয়ান ছাও-এর কোনো ক্ষতি করবো না। … বরং গুয়ান ছাও একটা ভালো দিকে উত্তরণের সুযোগ পাবে। আমরা অংশ নিলে গুয়ান ছাও-এর মার্কেটিং আরো ছড়াবে যেখানে আজও ওদের প্রোডাক্ট পৌঁছোয় নি সেখানে পৌঁছোবে, ওদের কর্পোরেট সংস্কৃতির উন্নতি হবে, নিয়ম নীতি বানানো হবে যাতে যাতা রকমের যৌন হেনস্থার ব্যপারটা আর বৈষম্যের অভ্যেসটা আর না থাকে। … কেবল এরকম করে বাইরের অনেকগুলো সংস্থা একসঙ্গে হয়ে গুয়ান ছাও-এর ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করতে পারবে। গুয়ান ছাও-এর স্টকের দাম বাড়ে না কেনো? নুশি, আপনার কী মনে হয় না যে তার সঙ্গে আপনার পতিদেবের জঘন্য আচরণের যোগাযোগ আছে?”
“এতো কথা বলবেন না। এটা তো জনসংযোগের একটা ছক মাত্র।”
ঝেং য়িতিং উপহাস করে উঠলেন, “শিন জঁ, আমার মনে হয় ব্যাপারটা আপনি মেনে নেবেন, যেদিন আপনার নজরে পড়বে, সেদিনই। আমার স্বামী ভীষণ রেগে গেছেন আর প্রতিজ্ঞা করেছেন যে আপনাকে সমূলে বিনাশ করবেন। উনি কিছুতেই থামবেন না, যতোক্ষণ না ওঁর লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে।”
ওর গলার স্বর নিচু, কিন্তু তার মধ্যের মিথ্যাটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
“গুয়ান ছাও আজকে যেখানে পৌঁছেছে তাতে আপনার স্বামীর অবদান তো আমি অস্বীকার করছি না। উনি সত্যিই খুব কাজের ব্যবস্থাপণার দিকেও আবার সুযোগ্য প্রযুক্তিবিদও। কিন্তু উনি কোনো প্রবাদ নন, ওঁর সমস্ত সিদ্ধান্ত সঠিকও নয়। একটা কোম্পানি চালানোর কাজে ওঁর থেকে কোনো অংশে আমি কম যাই না। আপনি আপনার স্বামীকে ভালোই চেনেন, কিন্তু আপনি আমাকে একদমই চেনেন না। আমি খুঁটিয়ে দেখেছি গুয়ান ছাও-কে অনেক দিন ধরে, আর আমি এই দখল নেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি। আপনার স্বামী ছাড়বেন না, আমিও নড়বো না, এক পাও না।" মৃদু হাসলো শিন ছি, “এখন আপনাকে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করবো, গুয়ান ছাও তৈরি করে ছিলেন আপনার বাবা, আর উনি আপনাকে এতো ভালো বেসেছেন ওঁর সারা জীবনে যে কেবল আপনিই গুয়ান ছাওতে সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত অংশের মালিক। আপনি কী দেখতে চান যে আপনার বাবার কঠিন পরিশ্রমের ফসল এক ফালি ঝলসানো পোড়ো জমি হয়ে যাবে?”
“এতো গলা উঁচু করেও বলবেন না।” ঝেং য়িতিং-এর কোনো হেলদোল দেখা গেলো না, “গুজব তো এটাও যে আপনার এই কান্ডটার পেছনে একটাই কারণ, আপনি আপনার মেয়েমানুষটাকে একটু নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলার আরাম দিতে চাইছেন।”
“এটাও আমার একটা উদ্দেশ্য, সেটা আমি অস্বীকার করি না।”
শিন ছি এক চুমুক চা খেলো, “চেং ছিরাং যে অন্যদের উত্যক্ত করে সেটা মোটেও ভালো না। আরো খারাপ হলো কোনো মহিলাকে উত্যক্ত করা। তাছাড়া, ও তো আপনার কুকুরটাকে পর্যন্ত ছাড়ে নি …”
ঝেং য়িতিং হঠাৎ করে বুঝতে পারলো না, ভাবলো ও বোধ হয় কিছু ভুল শুনেছে, “কী বললেন আপনি?”
“আপনার কুকুরটা একটা কালো পিটবুলের হাতে মারা যায়। তাই না? আপনার স্বামী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু কিচ্ছু করেন নি পিটবুলটাকে আটকানোর জন্য। আমার মনে হয় উনি নিশ্চয়ই কুকুরটাকে খুবই ঘেন্না করতেন?”
ঝেং য়িতিং চমকে উঠলো, চুপ করে রইলো অনেক ক্ষণ, বিড়বিড় করলো, “ও বলে ছিলো যে ও সেই সময়ে ওখানে ছিলো না। প্লুটোর মৃত্যুর ব্যাপারে এতো বিশদে তো আমি কাউকে বলি নি। আপনি কী মনে করেন? ওটা একটা পিটবুলই ছিলো? ওটার রং কালো?”
অনেক চেষ্টা স্বত্তেও ওর গলার স্বর কেঁপে উঠলো।
“কারণ ও মিন হুয়েকে ভয় দেখিয়েছে যে মিন হুয়ে যদি ওর কথা না শোনে তবে মিন হুয়ের অবস্থাও ঐ কুকুরটার মতোই হবে।”
ঝেং য়িতিং একটা গভীর প্রশ্বাস নিলো, ক্রমশ ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, অনেক ক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না।
“আপনি ওঁর স্ত্রী। আপনি এটা বিশ্বাস করতে চান ন। সেটা আমি বুঝি।”
আস্তে আস্তে শিন ছি আরেক কাপ চা বাড়িয়ে দিলো ঝেং য়িতিং-কে।
ঝেং য়িতিং একটা চুমুক দিলো, কিন্তু কিছু বললো না, কিছুই বললো না অনেক ক্ষণ।
শিন ছিও কিছু বললো না। ঝুঁকে বসলো চেয়ারটাতে, চুপচাপ নজর করতে লাগলো ঝেং য়িতিং-কে।
বেশ খানিক ক্ষণ পরে ঝেং য়িতিং জানতে চাইলো, “এখন আপনাদের অংশীদারীর অনুপাত কতো?”
“ব্যবস্থাপণা আর উদ্যোগের সমস্ত অংশীদারী মিলিয়ে, অংশীদারীর অনুপাত এখন ঊনত্রিশ দশমিক সাত শতাংশ।”
“আপনি যদি একটা নিয়ন্তার জায়গা নিতে চান, সেক্ষেত্রে আপনার অবস্থা তো বেশ খারাপ।”
“খুব বেশি না, আপনার থেকে মাত্র চার শতাংশ কম।”
“গুয়ান ছাও আমার বাবা তৈরি করেছেন, আমি গুয়ান ছাওয়ের শেয়ার বেচবো না।”
“আমি আপনাকে খুব ভালো দাম দেবো।”
“এটা একদম অসম্ভব।" ঝেং য়ি তিং জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগলো, আর খানিকক্ষণ পরে যোগ করলো, “আমি ভোট দেবার অধিকার আপনাকে দিতে পারি।”
শিন ছির চোখে আলো জ্বলে উঠলো, “শর্ত কী?”
ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। বললো, “আমার বাবা সব সময়ে চেয়েছেন গুয়ান ছাও-এর ব্যবস্থাটা যেনো আমিই দেখি। সেই জন্য উনি আমাকে বিশেষ করে বিদেশে পাঠিয়ে কয়েক বছর ম্যানেজমেন্ট পড়িয়েছেন। কিন্তু আমি এই ব্যবসায় উৎসাহী নই। এটা অসম্ভব যে বাবা আমাকে আরো দেখবেন। … পারিবারিক ব্যবসা পরম্পরায় পেয়ে উনি সবটা চেং ছিরাং-এর হাতে তুলে দিয়ে ছিলেন। এমনকি আমাকে বলে ছিলেন ওকে বিয়ে করতে। কারণ আমার বাবা ব্যবসার ব্যাপারে কেবল মাত্র পরিবারের লোকেদের বিশ্বাস করতেন।”
শিন ছি চুপচাপ শুনে গেলো, কোনো উত্তর দিলো না।
“ব্যাপারটা আমার জন্যেও একই। যদি আমরা এক পরিবারের লোক হই তাহলে আমি আপনাকে গোপণে ভোট দেবার অধিকার দেবো।”
ওঁর ইঙ্গিতটা খুবই স্পষ্ট। শিন ছি তক্ষুণি মাথা নাড়লো যেই শুনলো কথাটা, “না।”
ঝেং য়িতিং ভ্রূ কোঁচকালো, "কেনো?”
“নুশি, আমাকে যদি বিশ্বাস করতে না পারেন, তাহলে আপনি আমাকে বিয়ে করে বাধতে পারবেন না।”
ঝেং য়িতিং তাকিয়ে রইলো শিন ছির দিকে, চুপ করে রইলো অনেক ক্ষণ, শেষে শান্তভাবে বললো, “আমি ভেবে ছিলাম, আপনি অন্তত কথাটা ভেবে দেখবেন।”
“এ কথাটা ভাববোই না। এক্কেবারেই না।" ওর স্বরে জোর ফেটে পড়লো।
ঝেং য়িতিং হাসলো, হাসিতে রহস্য মাখা, “যা বললাম সেটা একটা পরীক্ষা।”
শিন ছি সামান্য হলেও অবাক হলো।
“গংশি নিয়া। আপনি উতরে গেছেন।”
শিন ছি শান্তভাবে ঝেং য়ি তিং-এর দিকে তাকালো, “তাহলে আপনার আসল শর্ত হলো –”
“আপনি কথা দেবেন যে চেং ছিরাং-কে আপনি বলবেন যে আপনি দায়িত্ব নেবার পরে ও যেনো সব ছেড়ে চলে যায়।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-71.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-73.html