স্যান অ্যান্টোনিও এক অপূর্ব শহর। এখানে বর্তমানের
শহর আর অতীতের গ্রাম একসাথে বাস করে, এক বইয়ের লাগোয়া পাতার মতো। গ্রাম - জলজ্যান্ত অতীত যাপণে মগ্ন, আর শহর – সমসাময়িকতায় মত্ত। পলকে যাতায়াত করা যায় দুই জীবনে, তিনশ বছরের ব্যবধানে।
|
গুগল ম্যাপে আলোচ্য এলাকাগুলো এখন যেমন দেখায়
|
১৬৯১ সালে আবিষ্কার হয়েছিল স্যান অ্যান্টোনিও নদী। আবিষ্কারক
স্পেনের ফ্রান্সিকান মিশনের ভিক্ষুরা। এই আবিষ্কারের কথা জানাও যায় তাঁদেরই বিবরণ
থেকে। সব আবিষ্কারের মতো এই নদী আবিষ্কারের মূলেও ছিল প্রয়োজন। স্পেনের সাম্রাজ্য
প্রসার ও রক্ষার প্রয়োজন। যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার শিল্প-বাণিজ্যে বলীয়ান হয়ে ইউরোপ,
এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে পুরো পুরোনো বিশ্বে ছেয়ে গেছে, তখন নতুন বিশ্বের সাথে
চেনাশোনা হয়েছে কেবলমাত্র স্পেনেরই। সেই
চেনাশোনাকে বিশ্বজয়ের শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন স্পেনের রাজন্যরা।
কিন্তু নতুন
বিশ্বে তখন একাধিক যাযাবর ইন্ডিয়ান উপজাতি, যাদের একসাথে বলা হতো কোয়াউইটেকেন তারা
খাবার শিকারি, সংগ্রাহক; চাষ কিংবা পশুপালন করতেও জানে না; গায়ে পরে শিকার করা
পশুর ছাল আর পায়ে ঘাসে বোনা চটি। তখন সেখানে কোয়াউইটেকেনদের সাথে ভাব জমিয়ে, তাদের
জমিতে পুরোনো বিশ্বের সভ্যতার বীজ যে বুনতেই হবে সেই জরুরি প্রয়োজনটা টের
পেয়েছিলেন স্পেনের সম্রাট। সে কাজের ঝুঁকিটা আর দায়টা নেবে কিন্তু সুফলের ভাগ
চাইবে না এমন লোক বলতে ছিলেন ফ্রান্সিকান মিশনারিরা। তাঁরা যে দারিদ্র্য, পবিত্রতা ও বশ্যতার শপথ নিয়েছিলেন। যীশুর নাম প্রচারের
সুযোগ দিলেই তাঁরা সুযোগদাতার যে কোনো কাজের যন্ত্র হতে রাজি ছিলেন। স্পেন সম্রাট
নতুন বিশ্বে তাঁদেরকে রাজতন্ত্রের প্রতিভূ ও কূটনীতিক বানিয়েছিলেন।
|
আলামো |
মেক্সিকো স্পেনের উপনিবেশ ছিল, তখন তাকে বলা হতো নিউ
স্পেন। এদিকে ফরাসীরা কালক্রমে লুইসিয়ানায় নিজেদের আধিপত্য কায়েম করল। তখন নিউ
স্পেনের উত্তর-পূবে, লুইসিয়ানার গা-বরাবর নিজেদের দখলদারি বজায় রাখার জন্য স্পেন
সম্রাট পাঠিয়েছিলেন ফ্রান্সিকান মিশনারিদের। সে অঞ্চলে তখন টেহাস উপজাতির বাস,
যাদের নাম থেকে এই এলাকার নাম রাখা হয় টেক্সাস।
|
সাজগোজ সারা, দৌড়ের জন্য উন্মুখ |
ফ্রান্সিকান ভিক্ষুরা লুইসিয়ানা সীমান্তে কয়েকটা মিশন তৈরি করে
কোয়াউইটেকেনদের দিয়েছিলেন যীশুর আশ্রয়। তাদের সেলাই করা জামা আর চামড়ার চপ্পল
বানিয়ে পরতে শিখিয়েছিলেন। শিকারি-সংগ্রাহক থেকে তাদের পরিণত করেছিলেন চাষি, তাঁতি,
কুমোর, কামার, জেলে, দর্জি, মুদি, রাজমিস্ত্রিতে। পাকাবাড়িতে রাঁধা, খাওয়া ঘুমোনো
আর মাঠে চাষ করার মাপা সময়ের বাঁধা রুটিনের জীবনে তারা সামাজিক হয়ে উঠছিল।
|
খদ্দেরের অপেক্ষায় সারিবদ্ধ ঘোড়ার গাড়ি |
কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ জীবনে সারা বছর নিশ্চিত জলের যোগান জরুরি। তাই স্যান
অ্যান্টোনিও নদীর ধারটা মিশনের জন্য বেছে নেন ফ্রান্সিকান মিশনারিরা। ১৭১৮ সালে
প্রথম গড়ে ওঠে স্যান অ্যান্টোনিও দি ভ্যালেরো। পরে নিউ স্পেনের আলামো নামক জায়গা
থেকে আসা সেনারা এই মিশন বার বছর ধরে অবরুদ্ধ রেখেছিল। সেই কারণে আজও এই মিশন আলামো নামে খ্যাত। তবে মিশনের প্রথম দিককার কুঁড়েগুলো
এক প্রবল ঝড়ে ভেঙে গিয়েছিল। তাই পরে নদীর থেকে খুব দূরে নয় কিন্তু বানভাসি হওয়ার
সম্ভাবনাও নেই এমন জায়গা দেখে মিশনকে পুনর্স্থাপণ করা হয়েছিল। রাবল ম্যাসনরির সেই
দেওয়াল, জানলা, কুলুঙ্গী আর ঘন্টা ঝোলানোর খিলান আজও আছে। কিন্তু আজ সেই চঞ্চলা নদীটার অস্তিত্ব আলামোর পুব দিকের মূল ফটকে
দাঁড়িয়ে টের পাওয়ার জো নেই।
|
দৌড় দৌড় দৌড় |
আলামোকে
ঘিরে আলামো প্লাজা আজকের স্যান অ্যান্টানিও ডাউন টাউনের প্রাণকেন্দ্র। এখানে আছে
সব বড়ো হোটেল, কাপড়ের দোকান আর ফার্মাসি, গা ঘেঁষাঘেষি করে স্যান অ্যান্টানিও নদীর
দুপাড় ধরে। নদীর পাড় ধরে পাঁচ মাইলটাক আলোয়, রঙিন ছাতায় সাজানো। রিভারওয়াক নামেই
এই এলাকাটা জগদ্বিখ্যাত।
|
রিভার ওয়াক |
রিভারওয়াক অবশ্য আলামো প্লাজার একতলা নিচে। সন্ধে থেকে
গভীর রাতে রিভারওয়াকের মাথার ওপরের রাস্তা দিয়ে ছুটে বেড়ায় আলোয় মোড়া ঘোড়ার গাড়ি।
দেখে মনে হয় যেন রূপকথারা সব বেড়াতে এসেছে।
|
আলামো প্লাজা থেকে রিভার ওয়াক |
|
বলাবাহুল্য |
|
ইটের খিলানে ঘন্টা |
আলামো
প্লাজা থেকে নদী পেরিয়ে আরো পুবে গেলে রঙিন বাজার এল মার্কেদো। তার দেওয়ালে
দেওয়ালে ফ্রেস্কো, দোকান ঘরের ছাদের আলসেতে ইটের খিলানে ঘণ্টা দোলে। বাজারে দোকানে
পশরায় কলকাতার নিউ মার্কেটের ছাপ। কিন্তু আয়তনে বেশ ছোট আর চেহারায় বেশ বেশি রকম
চকচকে আর পরিষ্কার। এখানে ফুটপাথে ঝুলন্ত টিশার্ট ধমক লাগায়, ‘লাতিনো নয়, মেক্সিকান বলো।’
|
ফ্রেস্কো |
|
স্যান ওসে এ স্যান মিগুয়েল দ্য আগুআয়ো |
আলামো তৈরি হওয়ার পর ১৭৩১ অবধি লুইসিয়ানা থেকে স্যান
অ্যান্টোনিওতে স্থাণাতরিত হয় আরও চারটে মিশন – স্যান ওসে এ স্যান মিগুয়েল দ্য
আগুআয়ো, নুয়েস্ত্রা সেনিয়রা দে লা পুরিসিমা কনসেপসিয়ন, স্যান উয়ান ক্যাপিস্ত্রানো
এবং স্যান ফ্রান্সিস্কো দে লা এস্পাদা। এদের মধ্যে সেকালের স্থাপত্য সব থেকে বেশি
টিকে আছে স্যান ওসে এ স্যান মিগুয়েল দ্য আগুআয়ো-তে। পাথরের কারুকাজ করা রোসা উইনডো আজও অটুট মিশনের
গির্জার দেওয়ালে। অটুট প্রার্থনাগৃহের তোরণের রোসা উইনডো ও দ্বার ঘিরে থাকা
ঔপনিবেশিক স্পেনীয় ভাস্কর্যের নিদর্শনগুলিও। এই তোরণ দ্বারেই দেখা যায় ক্যাথলিক সন্ত জোসেফ, ফ্রান্সিস, দমিনিক, আনা
জোয়াকিন-এর সাথে কোয়াউইটেকেনদের ফসলের দেবী গুয়াডালিউপকে। ঔপনিবেশিক স্পেনীয় স্থাপত্য অক্ষয় হয়ে আছে
প্রার্থনাগৃহের গম্বুজে, ঘন্টাঘরের মিনারেটে। গির্জা ছাড়াও অটুট আছে কুমোরের ভাটি,
শস্যগোলা, অতীতের বাসিন্দাদের বাসা আর রান্নাঘর।
|
রোসা উইন্ডো |
মিশনের চৌহদ্দির বাইরে আছে টারবাইন
আর আটাকল। এই টারবাইন চলে মিশনের চাষজমিগুলোকে সেচ দেওয়ার জন্য বানানো খালের জলে। খাল আসছে স্যান অ্যান্টোনিও নদী থেকে, ভূমির ঢাল
ধরে উত্তর থেকে দক্ষিণে। একেক মিশনের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য দিনের একেকটা সময়
নির্ধারিত ছিল। নির্দিষ্ট লকগেট খুলে চাষিরা নিজেদের জমিতে জল দিতেন। তাই লকগেট
থেকে শাখাখাল চলে যেত ভূমির ঢাল বেয়ে নদীতে জল ফেরানোর খালে। জলসেচের জন্য
প্রত্যেক মিশনের আলাদা আলাদা জলাধার আর খাল-শাখাখালের নেটওয়ার্ক ছিল। স্যান
ফ্রান্সিস্কো দে লা এস্পাদার জলাধার ও খালের নেটওয়ার্ক এখনও প্রায় অটুট আছে।
পুরোনো নির্মাণ প্রযুক্তিতে কোনো কোনো জায়গায় সারিয়েও দেওয়া হয়েছে একটু আধটু।
|
মিশন স্যান ওসে-র প্রার্থনা কক্ষ |
এই
সমস্ত মিশনগুলি বর্তমানে ইউনাটেড স্টেটস ন্যাশনাল পার্কস সার্ভিসেস-এর
তত্ত্বাবধানে আছে। অতীতের জীবনকে জাগিয়ে রেখেছে মিশনগুলোর দূর্দান্ত ইনফরমেশন
সেন্টার। মিশন স্যান ওসে-তে তো অডিও-ভিসুয়াল শো-ও হয়। তাছাড়া আছে অনেক রকম ইলেক্ট্রো-মেকানিকাল
মডেল, যা সাহায্য করে মিশনের জীবনযাত্রাকে বুঝতে।
|
মিশন কন্সেপসিয়ন |
|
মিশন এস্পাদা |
মিশনের
গির্জাগুলো অবশ্য এখনও সংলগ্ন এলাকার মানুষদের ধর্মজীবনের প্রাণকেন্দ্র। আমরা মিশন
এস্পাদাতে ফিউনারেল রিচুয়ালের সাক্ষী। আবার সঙ্গীতের আধুনিক যন্ত্রায়োজনও দেখেছি
মিশন কনসেপসিয়নের গির্জার প্রার্থনা ঘরে এবং মিশন সান ওসের গির্জার
প্রার্থনাগৃহেও। মিশনের গির্জাগুলোকে ভিত্তি করেই সেদিনের ভূমিভিত্তিক গ্রামীণ
জীবন গড়ে উঠেছিল এবং গির্জাগুলিই সেই জীবনকে ধরে রেখেছিল। তাই হয়তো, যখন স্পেনের
সম্রাট মিশনগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তার বাসিন্দাদের করদ প্রজায় পরিণত করেন, তখন কোয়াউইটেকেনরা
একে একে সব্বাই জঙ্গলে পালায়।
এই
মিশনগুলোর মধ্যে আলামো অতীত ও বর্তমানের সেতু। মাত্র তিনশ বছর আগে এই মিশনগুলোতে
প্রাচীনতম সভ্যতার জীবনযাপণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। আবার উত্তর থেকে আসা অ্যাপাচে
আর কোমান্চে উপজাতির ইন্ডিয়ানদের আক্রমণ ঠেকাতে বন্দুকও ব্যবহার করা হতো। কিন্তু
আলামো আধুনিক জাতীয়তাবাদের পীঠস্থাণ, টেক্সাসের স্বাধীনতার তীর্থ। আলামো-র অবরোধ
আর যুদ্ধই নির্ধারণ করেছিল মেক্সিকো থেকে টেক্সাসের স্বাধীনতা এবং পরে ইউনাইটেড
স্টেট্স থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়াস।
|
স্যান উয়ান ক্যাপিস্ত্রানো |
এখন
আলামোর পাথরের দেওয়ালে প্রাচীনের গাম্ভীর্য আর চারপাশে সমকালের পশরা। এখানে বেড়ালে
মনে হয় যেন এখানে এখনও বর্তমান অতীতকে গ্রাস করে নি।
|
মিশন স্যান ওসের প্রার্থনা ঘরের তোরণ |