৭১. নোনা মাছ
পর পর পনেরো দিন লাগাতার মিন হুয়ে ঘুম থেকে উঠলো তাড়াতাড়ি, বাড়ি ফিরলো দেরি করে। কাজে যাওয়া ছাড়াও ও যাচ্ছে তিয়াঁয়িং পাহাড়ে প্যারাগ্লাইডিং শিখতে।
পুরোক্ষণ হান য়ি ওর সঙ্গে থাকে। হাত ধরে শেখায় সব কিছু, খুব যত্ন করে। মাঝে মধ্যে ও শিন ছির মুখোমুখি হয়ে যাচ্ছে প্যারাগ্লাইডিং বেসে, কখনো একা আসে, কখনো সু ছনকে নিয়ে আসে, তবে খুব বেশি বার নয়।
যতোবার ওদের একে অপরের সঙ্গে দেখা হয়েছে, প্রত্যেকবার হান য়ি ওদের নেমতন্ন করেছে দিনের একটা খাবার একসাথে খাওয়ার জন্য, আর ফেরার পথে শিন ছি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে ফেরে, পৌঁছে দেয় বাড়িতে।
অ্যাকুইজিসনের ব্যাপারে শিন ছি যেহেতু মুখ খোলে না, মিন হুয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না, কয়েকবার দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়ার পরে।
নোনা মাছ প্রবচন |
একের পরে এক খবর আসতে লেগেছে। নানান মত ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবসার ক্ষেত্রে, কিছু ভালো, বেশির ভাগটাই খারাপ। সাধারণ বিশ্বাস এই যে গুয়ান ছাও-এর মাপ ও শক্তির কারণে বিবিজির পক্ষে খুব অল্প সময়ে গুয়ান ছাও গিলে ফেলা সম্ভব হবে না, আর এই যুদ্ধটা ভয়ঙ্কর হবে।
মিন হুয়ে এতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো যে রোজ বিত্তের খবর পড়া ছাড়াও, বকে বকে, প্রশ্ন করে করে অতিষ্ঠ করে তোলে সাও মুকে।
তথ্য বলছে অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া এখনো চলছে।
বিবিজি আর য়ুআঁ মাও গোষ্ঠী এখনো গুয়ান ছাও-এর অংশীদারী কিনে চলেছে আয়ের অদলবদল করে আর অপ্রধান বাজারে।
যৌথ অংশীদারী দশ শতাংশে পৌঁছোতে ওরা আবার একটা হোর্ডিং লাগালো।
গুয়ান ছাও-এর ভেতরে কর্তারা রোজ মিটিং-এ বসে নানান আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু তারাও কোনো বড়ো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফিরে আক্রমণ তো করছেই না।
যেহেতু মিন হুয়ে ইতিমধ্যেই পদত্যাগ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ওর হাতে তুলনামূলকভাবে অনেক খালি সময়। রোজ কাজের জায়গায় ত্রুটি বিচ্যুতি ঠিক করে কাটাচ্ছে, যতোদিন না ও আনুষ্ঠানিকভাবে গুয়ান ছাও ছাড়ছে, আর চেং ছিরাং-ও ওর সঙ্গে আর দেখা করে নি।
ও ভাবছে যে গুয়ান ছাওতে শেষ মাসে অর্ধেকটা ভয়ানক হবে আর চেং ছিরাং নিশ্চয়ই ওকে আচ্ছা করে ঝামেলা দেবে। ও আশাই করে নি যে চেং ছিরাং-ও স্থির হয়ে থাকবে, এমনকি আর অ্যান্ড ডি ডিপার্টমেন্টের মিটিং-এও আসে নি।
“সেটা তোমার ভাই-এর লেখা খবরটার জন্য হতে পারে" বললো সাও মু, “ওকে এখন সমস্ত সন্দেহ কাটিয়ে চলতে হবে। তাছাড়া ও যদি এখন তোমার ওপরে শোধ নিতে যায়, তাহলে তুমি সে কথা চাউর করে দিতে পারো। তা বাদে, ওর এখন খুব ব্যস্ত থাকাটাই স্বাভাবিক, আর তোমাকে সমস্যায় ফেলার পক্ষে এই সময়টাকে বলা যায় অনেক দেরিই হয় গেছে।”
“আমি তো কাজ ছেড়েই দিয়েছি।”
মিন হুয়েকে অবাক করে দিয়ে চেং ছিরাং ওর কাছে আর এলো না, সোজাসুজি গেলো শিন ছির কাছে।
ঠিক যখন অ্যাকুইজিসনটা পুরো দমে চলছে, তখন চেং ছিরাং নেমতন্ন করলো শিন ছিকে বিনচেং-এর পশ্চিমে একটা রিসর্টে গিয়ে একটা উষ্ণ প্রপাতের খানিকটা শুষে নেওয়ার জন্য, সাজিয়ে গুছিয়ে বলেছে, “খোলাখুলি দেখা-সাক্ষাৎ”।
উষ্ণ প্রপাতের জলটা যে ডোবাতে জমে, সেটা একটা বিরাট পাথরের আড়ালে। নুড়ি দিয়ে ঘিরে গোল করে রাখা হয়েছে। চারপাশে ঘন ছায়া দেওয়া গাছেদের সারি।
হেমন্তের ঠান্ডা আবহাওয়ায় উষ্ণ প্রপাতের জল সাদা ধোঁয়া ছাড়ছে। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেনো কোনো দানব মেঘ গিলে খাচ্ছে আর কুয়াশা ঘুমিয়ে আছে বনে।
শুরুতে দুজনে মুখোমুখি বসে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পক্ষেত্রে হালের যতো গল্প আছে সেসব নিয়ে কথা বললো খানিকক্ষণ। চেং ছিরাং হেসে বললো, “ইথান, এতো লজ্জা? তুমি জামাটা কিছুতেই খুললে না, স্নানের পরেও না।”
“ঠান্ডা লেগে যাবার ভয়ে।”
শিন ছি নিজের নাকের দিকে দেখিয়ে বললো, “অ্যালার্জিক রাইনাইটিস।”
“আমি সব সময়েই তোমাকে জিজ্ঞেস করবো ভেবেছি,” বলতে লাগলো চেং ছিরাং, “তুমি চোঙ্গুয়াতে কতো দিন আছো?”
লোকেরা তাদের মধ্যেকার পারস্পরিক বৈরিতা ঢাকতে যে আবহাওয়াটা তৈরি করেঃ একটা শুকনো বিনয় আর ভানে ভরা উদ্দেশ্যহীনতা।
“গুণে বলা সহজ নয়।" হালকা হেসে বললো শিন ছি, “আমি জন্মেছি চোঙ্গুয়াতে।”
চেং ছিরাং ওর দিকে এক ঝলক দেখলেন, কিন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। শিন ছির অভিব্যক্তি পড়ে বলা মুস্কিল। চেং ছিরাং কিছুতেই পড়তে পারছে না শিন ছির মনের গভীরের চিন্তাগুলো।
“আমি খতিয়ে দেখেছি বিবিজি আর তার এসিয়া প্যাসিফিক বিভাগের কাজগুলো।”
চেং ছিরাং নাক টানলো, “তুমি ভালো কাজ করেছো, ভাগ্যও তোমার সহায়। তুমি গত কয়েক বছরে অনেক কামিয়েছো। মনে করা হয় যে তুমি বোঝাপড়ায় বেশ পোড় খাওয়া।”
“শিয়া শিয়া।”
“কিন্তু তোমার গ্যগ্যয়ের কপালটা তোমার কপালের মতো ভালো নয়। যেমন ‘অরকা থ্রি’। ও লগ্নি শুরু করে ছিলো …”
চেং ছিরাং থামলো, কিন্তু শিন ছি কোনো উত্তর দিলো না।
“আমি শুনেছি যে এই ড্রিলিং প্ল্যাটফর্মটা নাকি সেই সময়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো ড্রিলিং রিগ চালাচ্ছিলো? ওদের চূড়ান্ত ড্রিলিং-এর গভীরতা নাকি সাত হাজার মিটারের থেকেও বেশি ছিলো। খুবই দুঃখের কথা যে ওটা একটা ক্যাটেগরি ফিফটিন হ্যারিকেনে পড়ে, কাজ করতে শুরু করার পরে ওটার তখনো দু বছরের বেশি সময়ও হয় নি, ওটা ডুবে যায়। ওটা যে শুধু ডুবে গিয়ে ছিলো তাই নয়, ওটার থেকে একটা বিশাল ক্রুড অয়েল স্পিলও হয়ে ছিলো। ওটা যে দেশের এলাকায় হয়ে ছিলো, সে দেশের সরকার ওটার জন্য জরিমানা চায়, পশুরক্ষা সংস্থাগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি তোলে … তোমার গ্যগ্যয়ের যে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়ে ছিলো সেটা এখনো পূরণ হয় নি না? বিবিজির শেয়ার হোল্ডাররা তোমাকে এরপরে সব দেখেশুনে গুয়ান ছাও কিনতে দেবে এতো খরচা করে?”
শিন ছি অস্বীকারের ভঙ্গিমায় ভ্রূ তুললো, “টাকা করা যেতে পারে, তাহলে করবো না কেনো?”
“তাহলে, এটা একটা অর্থকরী লগ্নি মাত্র? এটা এতো সহজ নয়, তাই না?”
শিন ছি হালকা হাসলো, কিছুই বললো না।
“তোমার কাজের ছক তো ইক্যুইটি হাতিয়ে লিভারেজ মার্জার আর অ্যাকুজিসন করা আর তারপরে ইক্যুইটি মর্টগেজ করে পুঁজি জোগাড় করা।” চেং ছিরাং তাকালো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লিন শি য়ুয়ের দিকে। “তুমি এটা দু-এক বার করেছো তা নয়। তুমি এটা উত্তর আমেরিকায় করেছো, দক্ষিণপূর্ব এসিয়াতে করেছো।”
“হ্যাঁ। আমি একটা মোটামুটি হিসেব করেছি। এই সময়ে তোমার লিভারেজ ফ্যাক্টর প্রায় কুড়ি গুণ। এতো খরচ করে পুঁজি যুগিয়ে তুমি তোমার বাকি ব্যবসার কী করবে? তোমাকে টাকার টার্নওভার দেখাতে হবে না? মাছ তো কেবল চারটা দেখে, বঁড়শিটা নয়। লোকে লাভটা দেখে, ক্ষতিটা দেখতে পায় না – এতো টাকা আসছে গুয়ান ছাও কেনার জন্য, তারপর কী? খাতায় একটা লাভ ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর এদিকে তুমি চাইলেও ওটা বেচতে পারবে না। থামাও।”
“তুমি আমাকে বলছো ব্যবসা কী করে করতে হয়?”
“না। আমি জানি তোমার সাহস নেই। তুমি চোঙ্গুয়াতে ব্যবসা করছো মাত্র কয়েক বছর, তোমার একমাত্র ভরসা সু ঝং হে। কিন্তু এই লোকটা সম্পর্কে তুমি জানো কতোটা? তুমি ওর কাঁধে ভর করে যার বিরদ্ধেই লড়ো না কেনো, লোকটার বদনাম ধূর্ত আর পেছলা বলে। তুমি ওর ওপরে ভরসা করতে পারো না। ও নির্ভরযোগ্য নয়।”
শব্দ কেটে কেটে বললো ও, “আমার সঙ্গে লড়াই? তোমার অস্ত্রের ভাঁড়ার যথেষ্ট তো?”
“নোনা মাছ খেলে লোকের তেষ্টা বাড়ে।”
শিন ছি বললো, “আমার তাড়া নেই। আমি গুয়ান ছাওতে টাকা লাগিয়েছি কারণ আমি গুয়ান ছাও মানে ‘জোয়ারে চোখ রেখে চলা’-তে ভবিষ্যতের আশা আছে বলে মনে করছি।”
“যাহ, ইথান, সত্যিটা বলো। অল্প সময়ের লগ্নি বেচে লাভ করা - এটাই তোমার উদ্দেশ্য?”
“তুমি বললে তা-ই।”
“অথবা তুমি গুয়ান ছাও-এর রোজকার কাজে ব্যবস্থাপণায় অংশ নিতে চাও। কী করে কাজ হয়? কী করে ব্যবস্থাটা চলে? বোঝো তুমি?”
“আমি বুঝি না, অন্য কেউ বোঝে।”
“মনে হচ্ছে, তোমার থামার কোনো ইচ্ছেই নেই?”
“থামবো? তুমি কী ঠাট্টা করছো? তোমার কী মনে হয় আমি খেলা করছি?”
বললো শিন ছি, “তোমার যখন এতোই জানার ইচ্ছে, তখন তোমাকে বলি শোনো গুয়ান ছাওতে আমাদের অংশীদারী প্রায় পনেরো শতাংশ। আগামীকাল, তৃতীয়বার আমরা কার্ড দেখাবো। ততোক্ষণে বিবিজি তোমাদের সবচেয়ে বড়ো অংশীদার হয়ে যাবে।”
চেং ছিরাং-এর চোখ শিন ছির ওপরে থেকে সরছে না, মুখ শুকিয়ে গেছে।
“বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্-এর কাছে আমি একটা আবেদন রাখবো একটা অপ্রত্যাশিত সাধারণ সভা ডাকার জন্য আর একটা প্রস্তাব রাখবো যে এখনকার যতো ব্যবস্থাপক সদস্য আছে সকলকে সরিয়ে দেবার জন্য।”
“হা।”
হাসলো চেং ছিরাং, “শেষে তুমি আমাকে তাড়াতে চাইছো?”
“ঠিক।”
“মিন হুয়ের জন্য?”
“সেটা বোঝা কী কঠিন?”
“আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।”
চেং ছিরাং মাথা নাড়ালো, “একটা মেয়েমানুষ, সেটা একটা তুচ্ছ ব্যাপার, কেনো এতোগুলো লোককে নিয়ে, এতো এতো টাকা নিয়ে তুমি খেলা করছো? যাই হোক, তুমিও তো ব্যবসাদার। এই ঝোঁকটা খুবই হাস্যকর, আর আমি এটার সঙ্গে মোটেই একমত হতে পারছি না।”
“এটা একটা ছোটো ব্যাপার।” শিন ছি ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইলো চেং ছিরাং-এর দিকে, “যখন মিন হুয়ের সঙ্গে তোমার দেখা হয়, তখন ওর জীবন পুরো শুরু হয় নি। কিন্তু তখন তুমি ওকে জোর করে ছিলে যাতে ও বাঁচতে না চায় আর। এবার সমান সমান হবে, এবার তোমার পালা।”
***
পরের দিন তৃতীয় বারের জন্য বিবিজি প্ল্যাকার্ড তুললো। শিন ছি আর ওর দলবল একসাথে দল বেধে তাদের অংশীদারী বাড়িয়ে পনেরো শতাংশ করে দিলো। পেরিয়ে গেলো গুয়ান ছাও-এর সবচেয়ে বড়ো অংশীদার জিং রুই ইন্ডাস্ট্রিসকে। হয়ে গেলো গুয়ান ছাও-এর সবচেয়ে বড়ো অংশের মালিক।
গুয়ান ছাও পাল্টা লড়াই শুরু করলো।
বড়ো অংশীদারেরা নিজেদের অংশের পরিমাণ বাড়াতে লাগলো, জিং রুই ইন্ডাস্ট্রিস আবার তার পুরোনো জায়গা ফিরে পেলো।
এই সময়ে, মিন হুয়ে এড়িয়েই গেলো পাহাড়ের গভীরে গিয়ে বাস্তব পৃথিবীর হিসেব বোঝার চেষ্টাটা, বরং ও মন দিল প্যারাগ্লাইডিং শেখায়। খুব শিগগির এ-লেভেল সার্টিফিকেট পেয়ে গেলো। শুরু করলো একলা উড়তে, কম উচ্চতায় একশো মিটারের নিচে, একটা ছাতা নিয়ে।
এ-সার্টিফিকেট পেয়েই ও তাড়াতাড়ি বি-সার্টিফিকেটের জন্য ট্রেনিং শুরু করলো। এক সময়ে ও একলাই উড়তে শুরু করতে পারলো তিনশো মিটারেরো বেশি উচ্চতায়।
কাজ ছেড়ে দিয়ে নতুন কাজের অপেক্ষা করার সময়ে মিন হুয়ের হাতে অনেক সময় বেড়ে গেলো। তাই ও সু ছনকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখলো।
শিন ছিও আপত্তি করে নি। কারণ গুয়ান ছাওয়ের সঙ্গে অংশীদারীর লড়াইয়ের উত্তাপ সমানে বেড়ে চলেছে। ওর নিজেরও খুব সময় নেই সু ছনের খেয়াল রাখার। এতো ব্যাস্ত ছিলো যে ও সব সময়ে ওর চোখ মাটিতেও পড়তো না।
চেং ছিরাং-এর যৌন হেনস্থার কেচ্ছা নানা মাধ্যমে আবার করে প্রকাশ হলো। সেটা অংশীদারদের মধ্যে একটা আলোড়োন সৃষ্টি করলো।
ও আবার নিজের সমর্থনে দাবি করলো যে সব অভিযোগ মিথ্যে। অংশীদারদের প্রশ্নের আর অনুসন্ধানের চাপে, গুয়ান ছাও-এর এইচআর-এর শীর্ষে নতুন একজনকে বহাল করা হলো।
কর্মীদের অভিযোগের জবাবে, নতুন নিয়োজিত এইচআর ডিরেক্টর বলতে বাধ্য হলো যে “গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করা হবে সমস্ত যৌন হেনস্থার অভিযোগ।”
বাইরের ভাবমূর্তি যাই হয়ে দাঁড়াক না কেনো, কর্মীরা সবাই জানতো যে মূল অংশীদাররা সবাই চেং ছিরাং-এর কেচ্ছার দিকে চোখ বুজে থাকবে। মনে করবে এগুলো সব ‘সামান্য ব্যাপার’, এগুলো বিরোধীরা ব্যবহার করছে ঝামেলা পাকাবার জন্য। সব একসময়ে ঠান্ডা হয়ে যাবে।
যাই হোক, চেং ছিরাং-এর বন্দোবস্তে প্রতিদিন গুয়ান ছাও প্রচুর টাকা করছে আর পুরো তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ক্ষেত্রে আর ব্যবসার ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ হয়ে থাকছে।
একদিন দুপুরে মিন হুয়ে হাসপাতালে গেলো সু ছনকে সঙ্গে নিয়ে ওষুধ আনার জন্য। অনেক দিন ঝৌ রু জির সঙ্গে দেখা হয় নি, ঝৌ রু জি অনেক দিন মোমেন্টস আপডেট করে নি এসব ভাবতে ভাবতে মিন হুয়ের মনে হয় লোকটার খবর কিছুই জানে না মিন হুয়ে, তাই ঝৌ রু জির সঙ্গে দেখা করে যাবে মনে করে ও গেলো ঝৌ রু জির অফিসে। অনকোলজি ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে যখন জানতে চাইলো ঝৌ রু জি অফিসে আছে কিনা, তখন নার্স জানালো যে ঝৌ রু জি সার্জারিতে ব্যস্ত, ব্যস্ত থাকবেনও আরো অনেক ক্ষণ।
মিন হুয়ে ঠিক করলো যে আবার পরে আসবে।
এলিভেটর এলো না অনেক ক্ষণ এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করার পরেও। মিন হুয়ে আপৎকালীন সিঁড়ির দিকে গেলো সু ছনকে নিয়ে। ইনপেশেন্ট ডিপার্টমেন্টের করিডর পেরোনোর সময় ও হঠাৎ টের পেলো যে কেউ একটা ওর পিছু নিয়েছে। মানুষটার পদক্ষেপে বেশ ওজন আছে, চামড়ার জুতোটা যেনো ঘষে ঘষে চলছে মেঝেতে, ওর ঠিক এক মিটার পিছনে একটা করে টক টক আওয়াজ হচ্ছে।
পিছন ফিরে দেখলো মিন হুয়ে, চেনা লাগলো, দুম করে মনে পড়ে গেলো যে লোকটা সেই চাষা যাকে মিন হুয়ে দেখে ছিলো ঝি ঝুর ওয়ার্ডের বাইরে, ঝি ঝু মারা যাবার আগে। লোকটার নাম ছিলো ঝ্যাং ইয়ং গেন। অমনি মিন হুয়ে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “গ্যগ্য, আপনি কী সেই?”
ঝ্যাং ইয়ং গেন সোজাসুজি তাকালো মিন হুয়ের দিকে।
মিন হুয়েকে দেখেই তাকালো সু ছনের দিকে, আবার, মাথা নড়তে লাগলো বোকার মতো, “আপনি ঝৌ রু জির স্ত্রী, তাই তো?”
“প্রাক্তন স্ত্রী।”
“এই আপনার ছেলে?”
“দোয়ে।”
মিন হুয়ে সু ছনের মাথা চাপড়ে বললো, “ছন ছন, শুশুকে ‘নি হাও’ বলো।”
“নি হাও, শুশু।”
ঝ্যাং ইয়ং গেন দেখলো সু ছনকে একবার, তারপর কাঁপা স্বরে জানতে চাইলো, “ওর বয়স কতো?”
“প্রায় চার বছর।”
মিন হুয়ে উত্তর দিলো, “গ্যগ্য, আগের বার আপনি বলে ছিলেন যে আপনার ছেলের সার্জারি হবে, হয়ে গেছে?”
“হয়ে গেছে।”
ঝ্যাং ইয়ং গেনের চোখ লাল হয়ে উঠলো, দাঁত কড়মড় করে ফুঁপিয়ে উঠলো, “ও মারা গেছে অপরেসনের টেবিলেই।”
মিন হুয়ে কেবল একটা ‘ওহ্’ বলত পারলো, ওর মনে পড়ে গেলো যে ওর ছেলে গুরুতর অবস্থায় ছিলো, আর অনেক ডাক্তারই অপেরসন করতে চায় নি। মিন হুয়ে অবাক হলো না, ও লোকটাকে স্বান্তনা দিতে যাচ্ছিলো, এমন সময়ে ঝ্যাং ইয়ং গেন হঠাৎ হাসলো খিল খিল করে, “আমার ছেলে - ওকে মেরে ফেলেছে ঝৌ রু জি!”
ঝ্যাং ইয়ং গেনের হাসির গমক বাড়তে লাগলো, ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বললো, “ও ঠিক ছিলো যখন ওকে অপেরাটিং টেবিলে নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু ও ফিরে এলো না, যাবার পরে! ঝৌ রু জি আমার শিকড় আর আমার পিঠ দুটোই কেটে ফেলেছে – – ও এই জীবনে ব্যাপারটা কেমন ভাবতেও পারবে না! আমি চাই ও-ও বুঝুক কেমন লাগে ছেলে মরে গেলে!”
বলেই ও ছুটে এলো সু ছনের দিকে।
মিন হুয়ে এতো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো যে ও সু ছনকে একটা ধারে ঠেলে দিলো, চেঁচিয়ে বললো, “পালাও।” আর মরিয়া হয়ে এগিয়ে গেলো ঝ্যাং ইয়ং গেনের সাথে লড়াই করতে।
ও সান্ডা করতে জানে, বার কয়েক কোনো মতে আঘাত কাটিয়েও গেলো। ঝ্যাং ইয়ং গেনের গায়ের জোর খুবই বেশি, মিন হুয়ের চুলের মুঠি ধরে ওকে ঠেলে ফেলে দিলো সিঁড়ি দিয়ে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো মিন হুয়ে, তার থেকেও বেশি ভয়ে যে এবার বোধ হয় লোকটা সু ছনকে ধরবে। তাই ও ঝ্যাং ইয়ং গেনের কব্জি চেপে ধরলো, কিছুতেই ছাড়লো না। হ্যাঁচকা টানে দু জনেই সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো … সবটাই খুব দ্রুত ঘটে গেলো, মিন হুয়ের কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হবার আগেই।
যখন থামলো, ততক্ষণে দুজনে ডজন খানেক কংক্রিটের সিঁড়ি পেরিয়ে এসেছে।
মিন হুয়ের কোমরের কাছে একটা কিছু ফোটানোর মতো যন্ত্রণা হচ্ছে, প্রচন্ড যন্ত্রণা। দাঁতে দাঁত চেপে ও উঠে বসার চেষ্টা করতে লাগলো শুধু এইটা দেখতে যে সু ছন পালাতে পেরেছে কিনা।
দুজন সিকিউরিটি গার্ড দৌড়ে এলো, ঠেলে সরিয়ে দিলো ঝ্যাং ইয়ং গেনকে মেঝেতে।
মিন হুয়ে শুনতে পেলো সু ছন চিৎকার করে কাঁদছে, “মা! মা!”
একজন ডাক্তার এসে মিন হুয়ের আঘাত মাপতে লাগলো। ওকে নড়াচড়া করতে বারণ করলো। ডাক্তারের সন্দেহ হচ্ছিলো যে হাড়ে চিড় ধরেছে। মিন হুয়ের এক পাটি জুতো খুলে নিয়ে ওকে জুতো খোলা পায়ের আঙুলগুলো বাঁকাতে বললেন।
আঙুলগুলো নড়লো, ডাক্তার নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁপ ছাড়লেন, তিনজন নার্সকে ডাকলেন, যত্ন করে মিন হুয়েকে একটা স্ট্রেচারে তুললেন, ওকে পাঠিয়ে দিলেন এক্স-রে করাতে।
ফলে দেখা গেলো যে শ্রোণীর হাড়ের ডানদিকটা মাঝমাঝি জায়গায় চিড় খেয়েছে। ভাগ্য ভালো যে ওটা সরে যায় নি। সার্জারির শেষ হতেই ঝৌ রু জি দৌড়ে এলো অপেরেসন শেষ করে।
এক্স-রের ফিল্ম দেখার পরে ডাক্তার জানালেন যে অবস্থাটা গুরুতর কিছুই নয়। সার্জারির দরকার নেই। সাবধানে চিকিৎসা করতে হবে।
“সাবধানে চিকিৎসা করা যায় কিভাবে?”
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জানতে চাইলো মিন হুয়ে।
“চার থেকে ছ সপ্তাহ বিছানায় শুয়ে থাকো, অপেক্ষা করো যাতে হাড় নিজে নিজে জুড়ে যায়।”
ঝৌ রু জি মাথা চাপড়ে দিলো মিন হুয়ের, “এটা তোমার ভাগ্য। যদি তোমার মেরুদন্ডে লাগতো তাহলে তুমি ঝামেলায় পড়তে, এমনকি সারা জীবনের জন্য পক্ষাঘাতও হতে পারতো।”
মিন হুয়ের কোমরে এতো ব্যাথা যে ও হাসতেও পারছে না, কাঁদতেও পারছে না। তবে ডাক্তার তো ডাক্তারই, তাই ঝৌ রু জির কথায় অবাক হবার কিছুই নেই। একটাই মাথা ব্যাথা ওর এখন সেটা হলো টাকা। সবে মাত্র চাকরি ছেড়েছে, ওর কোনো মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স নেই।
ঝৌ রু জি বোঝাতে লাগলো যে ঝ্যাং ইয়ং গেনের ছেলে মৃত্যুর দিকে ঢলে ছিলো, কোনো চিকিৎসাতেই ওর কিছু হবার ছিলো না। তাও লোকটার লাগাতার অনুনয় বিনয়ে থাকতে না পেরে ও ছেলেটার অপেরেসন করে, একটা চেষ্টা করা জন্য।
ঝৌ রু জিকে অপেরেসনে রাজি করানোর জন্য ঝ্যাং ইয়ং গেনও জানতো যে ঝুঁকি কী কী ওর ছেলের অপেরেসনের। ও সেই সব ঝুঁকি স্বীকার করে সম্মতিপত্রে সইও করে ছিলো।
শুরুতে অপেরেসন ভালোই চলছিলো। দশ সেন্টিমিটারের থেকেও বেশি চওড়া টিউমরটা পুরো কেটে ফেলা গিয়ে ছিলো।
সবাই ব্যাপারটা নিয়ে খুশি হওয়ার আগেই, বাচ্চাটার হৃৎপিন্ড হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। যখন ক্ষত সেলাইয়ের কাজ চলছে তখন। অনেক ক্ষণ ধরে ডাক্তার আর নার্সেরা চেষ্টা করে হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার, কিন্তু বাঁচাতে পারে নি বাচ্চাটাকে। ব্যাপারটা মোটেই ঝৌ রু জির দোষ নয়। কিন্তু ঝ্যাং ইয়ং গেন কিছুতেই মানতে রাজি নয় সেটা।
ও রোজ কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে আসে, বলতে থাকে যে ঝৌ রু জি ওর ছেলেকে মেরে ফেলছে।
“এই ঝ্যাং ইয়ং গেন আর আসবে না তোমার খোঁজে, তাই না?”
“না, সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে।”
মিন হুয়ে তাকালো ছন ছনের দিকে। ছন ছন বসে ছিলো মিন হুয়ের পাশে। মুখটা ফ্যাকাসে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে খুব ভয় পেয়েছে।
ওর হাতটা চেপে ধরে মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “ছন ছন, ঠিক আছো তো?”
“মা, আমি ঠিক আছি। আমি তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাচ্ছি।”
“দোয়ে, আমি তো দেখে নিয়েছি এর মধ্যে।” ঝৌ রু জি হাসলো, ছুঁয়ে দিলো ওর মুখটা, “ছন ছন আবার লম্বা হয়েছে।”
“যা হোক, একটু সময় করে শিন ছিকে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে দাও না। বলে দাও যে আমার হাড় ভেঙে গেছে তাই এখন কয়েকদিন আমি ছেলের খেয়াল রাখতে পারবো না। ও যেনো এসে ছেলেকে নিয়ে যায়।”
“পাঠিয়ে দিয়েছি, ও এখনো উত্তর দেয় নি কিছু।”
ঝৌ রু জি বললো, “আপাতত সব কিছু আমার ওপরে ছেড়ে দাও। আমি তোমার খেয়ালও রাখতে পারবো। অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্টে বেডের অবস্থা টায় টায়। তুমি এখানে হয়তো পাঁচ ছ দিন থেকে যেতে পারবে। খানিক ফিজিওথেরাপি করিয়ে নাও। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে বাড়ি যাবে আর বাড়িতেও থাকবে অন্তত একমাস - আমি বলতে চাইছি একদম বিছানায় শুয়ে থাকবে। চব্বিশ ঘন্টায় একবারও উঠবে না।”
মিন হুয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো, “তাহলে … আমার আরাম পাওয়ার দরকার হলে কী করবো?”
“সবই বিছানায় সারা যায়, তাই সারবে।”
“...”
“চিন্তা কোরো না। আমি একজন অভিজ্ঞ নার্সকে দেবো তোমার দেখাশোনার কাজ করার জন্য।”
ঝৌ রু জি হাসি মুখে বললো, “নাহলে, তুমি আমার বাড়িতে থেকে যাও না হয়। আমি না হয় প্রথম দু সপ্তাহ ছুটি নিয়ে তোমার সঙ্গে থাকবো, যতোক্ষণ না তুমি ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছো।”
“না, না, না! ঝৌ রু জি –”
মিন হুয়ে তাড়াতাড়ি বাধা দিলো, “তুমি একজন সার্জন। তোমাকে রোগের চিকিৎসা করতে হবে, জীবন বাঁচাতে হবে রোজ। রোজ তুমি বাড়িতে বসে আমার সেবা করবে কিছুতেই আমি তা ঘটতে দিতে পারবো না।”
“তোমার ভয় কিসের? আমি সু ছনের খেয়াল রাখি নি ও যখন জন্মালো? আমি একটা কাজ শুরু করলে আমি শেষ করেই ছাড়ি। এটাই আমার বিশেষত্ব। তোমার সুস্থ হয়ে ওঠার সময়ে আমি তোমার সঙ্গে থাকলে তুমি নিশ্চয়ই সব থেকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
ঝৌ রু জির কথার সুরে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
“তা সত্যিই তার দরকার পড়বে না।” মিন হুয়ে মাথা নাড়তে লাগলো, “আমি নিজেই পারবো, নার্সও থাকবে। এটা কোনো সমস্যাই নয়।”
ব্যাপারটা ও এর মধ্যেই ভেবে রেখেছে। কাজ ছেড়ে দিলেও ওর কিছু সঞ্চয় আছে এখনো। দু-এক মাস যা লাগবে সুস্থ হতে সেই সময়টায় চালিয়ে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব হবে না, বিশেষত সু ছনের জন্য। সু ছনের ব্যাপারটা পুরোটাই শিন ছিকে দিয়ে দেওয়া যাবে। ও ব্যাপারে চিন্তার কিচ্ছু থাকবে না। বিছানায় শুয়ে থাকতে হলে, ওর সারাদিনের পুরোটার খেয়াল রাখার জন্য একজন নার্স থাকলে তাই যথেষ্ট। যদি জরুরি কিছু লাগে তবে জিয়া জুন তো পাশেই থাকে। ও এসে সাহায্য করতে পারবে।
ঝৌ রু জি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলো, ঝি ঝু সবে মারা গেছে, আর মিন হুয়ে ওর বাড়িতে থাকতে চায় না, হয়তো সন্দেহ এড়াতে, তাছাড়া শিন ছিও এখন বিনচেং-এ, আর ও জানেও না দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা কী, কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে ব্যাপারটা খারাপই হবে। তাই ও আর জোর করলো না, হাসলো, বললো, “ঠিক আছে। তোমার কথাই রইলো। যদি কোনো অসুবিধে হয়, তাহলে ফোন কোরো যতো শিগগির পারবে, ততো শিগগির।”
মিন হুয়ে ব্যথা মারার ওষুধ খেয়ে ছিলো, একটা ঘোরের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো।
যখন ওর আবার ঘুম ভাঙলো ততোক্ষণে রাত হয়ে গেছে, তখনো ঘুমের ঘোর কাটে নি, তেষ্টা লাগছে, বিছানার পাশের টেবিলটার দিকে হাত বাড়ালো, আগে একটা হাত এগিয়ে এলো, আর একটা জলের বোতলে গোঁজা সরু নল ওর মুখে দিলো, নিঃশব্দে একটা চুমুক লাগালো, দেখলো শিন ছি একটা চেয়ারে বসে আছে বিছানার পাশে, পায়ে কাঁচি মেরে, ওর দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে বড়ো বড়ো চোখ করে।
পরণে সাদা টার্টল নেক, কালো জিনস্, আর বসে আছে একটা কালো চেয়ারে, ভুতুড়ে মুখটা না থাকলে ওকে দেওয়ালের অংশ বলেই মনে হোতো।
“শিন ছি?”
ও নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কখন এলি তুই?”
“আধ ঘন্টা আগে। আমি সবে প্লেন থেকে নেমেছি।”
“ছন ছন -”
“ওর ঘুম পেয়ে গিয়ে ছিলো। আমি ইয়ুন লুকে বলেছি যে ওকে বাড়িতে নিয়ে যেতে।”
“আমি ঠিক আছি, একটা সামান্য চিড় লেগেছে হাড়ে। তুই নিশ্চয়ই ব্যস্ত, এখানে বসে থাকিস না।”
ও ঝুঁকে মুখটা মিন হুয়ের সামনে নিয়ে এলো, প্রশ্ন করলো, “মিন হুয়ে, এই ঝ্যাং ইয়ং গেন - এর সঙ্গে কোনো ভাবে চেং ছিরাং-এর যোগাযোগ নেই তো?”
“তুই বলতে চাইছিস -”
“যেমন ধর - ভাড়াটে লাগিয়ে খুন করা?”
“না, না, ওদের মধ্যে কোনো যোগাযোগই নেই।”
মিন হুয়ে তড়বড় করে বলে গেলো যে ও কী করে ঝ্যাং ইয়ং গেনকে চিনে ছিলো আর কী করে ওর ঝৌ রু জির অপেরসনের পরে ওর ছেলে মারা যায় তার সবটা, শুরুর থেকে শেষ পর্যন্ত।
দেখে বোঝা গেলো যে শিন ছির উদ্বেগ বেশ কমে গেছে, “ভালো যে ওদের কোনো সম্পর্ক নেই। না হলে আমি কিছুতেই ব্যাপারটা ছেড়ে দিতাম না।”
মিন হুয়ে দুম করে শিন ছির হাত চেপে ধরে বললো গম্ভীর স্বরে, “শিন ছি, আমাকে কথা দে, তুই নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে যত্ন নিবি, কিছুতেই এই লোকটা যেনো তোকে ধ্বংস করতে না পারে।”
ও একটু অবাক হলো। এক মূহুর্ত চুপ করে থাকলো।
“আমি জানি তুই খুব অহঙ্কারী, চেং ছিরাং এটারই সুযোগ নেবে। সেই সময়ে আমি যদি অতো অহঙ্কারী না হতাম, ব্যাপারটা অতো খারাপ হয়তো হোতো না। কিছু লোকের ব্যাপারে আমি মনোযোগই দিতাম না এক্কেবারে। কিছু ব্যাপার, আমি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করতাম না। আমার তো সাহায্য চাইতে লজ্জা অবধি করতো। ব্যাপারটা থেকে থেকে খারাপ থেকে ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো …”
“চেং ছিরাং নিশ্চয়ই তোকে ভয় দেখিয়েছে, তাই না?” বলে উঠলো শিন ছি।
সেদিন স্টারবাক্সে যা যা হয়ে ছিলো তার সবটা মিন হুয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনে করে বলে গেলো।
“নির্লজ্জ বেয়াদব!”
নিচু স্বরে ধমক দিলো শিন ছি, “দুশ্চিন্তা করিস না, আমি ভুগবো না।”
মিন হুয়ের মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা, কিন্তু শিন ভীষণ শান্ত, মিন হুয়ের চোখ ভর্তি জল।
শিন ছি নজর রাখতে লাগলো মিন হুয়ের ওপরে। একটু পরে জলের বোতলের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুই কী এখনো জল খেতে চাস? একটু আগে কেবল এক চুমুক মাত্র জল খেলি।”
“আমার তেষ্টা নেই … আমার ভয় যে … যেতে হবে, যদি বেশি জল খাই।”
“যেতে চাস?”
“হ্যাঁ। কিন্তু সাহস হচ্ছে না।”
হঠাৎ করে ওর মুখ লাল হয়ে গেলো, “ডাক্তার বলেছে নড়াচড়া করা চলবে না। তুই কী নার্সকে ডেকে দিবি আমার জন্য?”
ও বেরিয়ে গেলো, একটু ঘোরাঘুরি করলো, ফিরে এসে বললো যে নার্স একটা ইনজেকসন দিচ্ছে, হয়ে গেলেই আসবে বলেছে, ওকে অপেক্ষা করতে বলেছে।
অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও নার্স যখন এলো না, মিন হুয়ের মুখ আরো লাল হয়ে উঠলো, এই জন্য নয় যে ওর প্রবল বেগ এসেছে প্রস্রাবের, কিন্তু এই জন্য যে শিন ছি ওর পাশে বসে আছে, ও সত্যিই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে এরকম বিষয় নিয়ে কথা বলতে।
“আমাকে সাহায্য করতে দে।”
মাথা ঝাঁকিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে মিন হুয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো, যাতে কলঘরে যেতে পারে নিজে নিজে। কিন্তু শিন ছি ওকে জোর করে ধরে শুইয়ে দিলো, “নড়িস না। ডাক্তার বলেছে তুই যেনো অবশ্যই বিছানায় থাকিস সারাক্ষণ, অন্তত প্রথম কয়েক দিন।”
ও ব্যবস্থা করে বাইরে বেরিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। অপ্রত্যাশিতভাবে, মিন হুয়ে বিছানায় শুয়ে অনেক চেষ্টা করলো অনেক ক্ষণ ধরে, ও ভীষণ চাইছে প্রস্রাব করতে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে, লজ্জা পাচ্ছে, এবং এতো বিব্রত হয়ে পড়েছে যে প্রায় কেঁদেই ফেললো। পরে নার্স এলো, ম্যাসাজ করলো, কিন্তু তাতেও কিছু হলো না, ওকে বলা হলো ঘাবড়ে না যেতে, আরো বেশি করে জল খেতে, ব্ল্যাডারে জল পড়লে স্বাভাবিক ভাবেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
“ওরে, গান শোন, তাতে কিছু আরাম পেতে পারিস –”
শিন ছি ওর মোবাইল ফোনে একটা অ্যাপে ক্লিক করলো, মিন হুয়ের কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে দিলো, আর কেবল কলকল করে জল বয়ে চলার শব্দ।
মিন হুয়ে দৃষ্টিতেই ঝলসে দিলো ওকে, “এতে কাজ হবে?”
“চেষ্টা কর।”
“তুই বরং ফিরে যা। সু ছনের কাউকে লাগবে তো ওর সঙ্গে থাকার জন্য।”
“বাচ্চার ব্যাপারটা সব গোছানো হয়ে গেছে। আমি এ কদিন এখানেই থাকবো, তোর সঙ্গে।”
“এখানে নার্স আছে।”
“তোর এসবের দরকার নেই এক্কেবারেই, কিন্তু তোর চামড়া খুব পাতলা, তুই কাউকে ঝামেলায় ফেলতে চাস না, তাই তোর হয়ে সেটা আমি করে দেবো।”
খুব সাহস দেখিয়ে বললো শিন ছি।
মিন হুয়ের মনে হঠাৎ খানিক উষ্ণতা ছেয়ে গেলো। শিন ছি এখনো ওর কথা কতো ভাবে, আর যেই শুনেছে যে ওর লেগেছে, অমনি দৌড়ে এসেছে।
“ঝৌ রু জি বলেছে যে তুই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে যাবি ছ দিনে। আর তোকে বিছানাতেই বিশ্রামে থাকতে হবে বাড়িতে ফেরার পরে অন্তত চার সপ্তাহ?” শিন ছি জানতে চাইলো।
“হ্যাঁ। আমি ওকে বলে দিয়েছি বাড়িতে আমার দেখাশোনা করার জন্য একজন নার্সের খবর দিতে যাকে আমি রাখব। এটা তো একটা সাদামাটা চিড় খাওয়া হাড়। আর এটা সেরেও যাবে তাড়াতাড়ি।”
“তুই একলা থাকবি না।" শিন ছি জোর দিয়ে বললো।
“কেনো?”
“কেউ তোকে মারবে বলে হুমকি দিয়েছে।”
“আমি ঠিকই থাকবো।”
“আমি চাই না আমার ছেলের মা মরে যাক।”
“শিন ছি, তুই কী আমাকে নেমতন্ন করছিস তোর বাড়িতে থাকার জন্য?”
“তা ছাড়া বেছে নেওয়ার মতো তোর আর কোনো উপায় নেই।”
পরের দিন সাও মু শুনলো যে মিন হুয়ে হাসপাতালে আছে। দেখা করতে এলো য়িন শুকে সঙ্গে নিয়ে, আর যখন শিন ছি নেই ঘরে, মিন হুয়ে জানতে চাইলো বিবিজি আর গুয়ান ছাও-এর হালের খবর।
“গুয়ান ছাও বাজারে অংশীদারী বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঘোষণা করেছে ওদের সম্পদের একটা বড়োসড়ো রদবদল ঘটাবে।”
“শত্রু সেনার গতিরোধের একটা ছক?”
“অবশ্যই। তোমাকে শিন ছি কিচ্ছু বলে নি?”
মিন হুয়ে মাথা নাড়লো, সাও মুয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। ও জানতো যে পরিস্থিতি গম্ভীর।
“এ মাসে চেং ছিরাং খুব খেটেছে। প্রথমত, কয়েক হাজার কোটি টাকা ও সরিয়ে রেখেছে, কোম্পানির বাছা বাছা শেয়ারগুলোকে আবার কিনে নেবার জন্য। তারপরে আরো কিছু শেয়ার দিয়েছে জিং রুই ইন্ডাস্ট্রিসকে, যারা গুয়ান ছাওয়ের সব চেয়ে বড়ো অংশীদার যাতে ওদের অংশে সম্পদের পরিমাণ বাড়ে। …তা বাদে ও লোক লাগিয়েছে সরকারের কাছে নালিশ করার জন্য যে সু ঝং হে বেনিয়ম করে পুঁজি জড়ো করছে। সু ঝং হে ব্যাপারটার জন্য তৈরি ছিলো না। ও বিবিজিকে মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিসনের জন্য যে অর্ধেক পুঁজির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলো সেটা পুরো জলে গেলো … এখন চেং ছিরাং বেচাকেনা বন্ধ হয়ে থাকার সুবিধে নিচ্ছে যাতে এক মহাবীর এসে ওকে উদ্ধার করে।”
সব শুনে মিন হুয়ে আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। কথাও হারালো। তাকিয়ে রইলো ছাদের দিকে। অনেক ক্ষণ কিচ্ছু বললো না।
“এই পর্যায়ের পরে, চেং ছিরাং-এর হাতেই ক্ষমতা বেশি। এই মূহুর্তে শিন ছি খুবই ঝামেলায় পড়েছে, আর আমি জানিও না ও অবস্থাটা সামাল দিতে পারবে কিনা।" বলে চললো সাও মু।
“মানে তুমি বলছো বিবিজির পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জরুরী অংশীদারী পাওয়া মুস্কিল?”
“আমি শুনেছি যে শিন ছি বেশ কিছু ভালো প্রজেক্ট বাধা দিয়েছে বাজার থেকে পুঁজি জোগাড় করার জন্য। যেমন লজিসটিকস্, ওয়্যারহাউসিং, কেটারিং, এমনকি অনেকগুলো কমার্সিয়াল বিল্ডিং-ও … তবে সু ঝং হের জন্য যে ভরসাটা ছিলো ওর সেটা যেতে আর গুয়ান ছাও বেচাকেনা বন্ধ করে দিতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খরচ বেড়ে যাচ্ছে, মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিসন আরো কঠিন হয়ে উঠছে, শেষে বাঘের পিঠে চড়াটা হয়তো কঠিনই হবে।”
বাঘের পিঠে চড়া প্রবচন |
“তোমার কী মনে হয়, বিবিজি এই যুদ্ধটার পরে টিকে থাকবে?”
“হ্যাঁ।”
সাও মু বললো, “আমি এখনো আশা রাখছি শিন ছির ওপরে। ওর পুঁজি জোগাড় করার একটা ব্যবস্থা রাখা উচিৎ। আর সেটা নির্ভর করছে একটাই জিনিসের ওপরে। সেটা হলো যে ও কী সাহস করবে সর্বস্ব হারিয়ে শেষ পর্যন্ত বাজিটা ধরতে।”
“সব খোয়াবে?”
মিন হুয়ের শরীর বেয়ে নামতে লাগলো ঠান্ডা ঘামের স্রোত।
“সাও মু জিয়ে, তুমি একবার বলে ছিলে যে এসব কোনো অনুভবের ব্যাপার নয়। আর শিন ছি ওর সব পুঁজি এতেই ঢালবে না। ও যদি সব খোয়ায়, তাহলে কী এই ব্যবসা আর করতে পারবে?”
“লগ্নিতে ঝুঁকি আছে। তুমি খুব বেশি চিন্তা কোরো না, শিন ছি নিশ্চয়ই সব কিছু গুরুত্ব দিয়ে হিসেব করে রেখেছে, আর ও যদি একশো ভাগ নিশ্চিত না হোতো তাহলে ও এই বাজিটা ধরতোই না।”
শিন ছি তাড়াহুড়ো করে রাতে এলো মিন হুয়ের বিছানার পাশে ওর সঙ্গে থাকার জন্য। ও চেয়ারে বসা মাত্র মিন হুয়ে জিজ্ঞেস না করে পারলো না, “সাও মু বললো যে গুয়ান ছাও ওদের শেয়ারের বেচাকেনা বন্ধ করে দিয়েছে।”
“হম্ম্”
“বিবিজি ঠিক আছে? আমি তোর জন্য কিছু করতে পারি কী?”
“সব ঠিক আছে। তোকে একদম কিচ্ছু চিন্তা করতে হবে না।" শান্তভাবে বললো শিন ছি।
তাও মিন হুয়ে জানতে চায়, কিন্তু ও হঠাৎ ওর ব্যাগ থেকে একটা ছোটো প্রোজেক্টর বার করলো আর হেসে বললো, “শুয়ে শুয়ে একঘেয়ে লাগছে না তোর? কেমন হয় আমরা যদি একসাথে একটা পুরোনো ছবি দেখি?”
লোকটা মেজাজে আছে। মিন হুয়ে হেসে মাথা নাড়লো সম্মতিতে।
পুরোনো ছবি, ‘টাইটানিক’। মিন হুয়ে খুব বেশিক্ষণ দেখতে পারলো না। ওর কেবল মনে হতে লাগলো বরফ সাদা দেয়ালটা বড্ডো চকচক করছে।
একটু পরে ও বললো, “শিন ছি, ওদিকে বোস।”
ও চেয়ার ঘুরিয়ে সিধে মিন হুয়ের মুখোমুখি বসলো, “এতে তোর দেখায় বাধা পড়ছে না?”
“প্রজেক্টরটা বন্ধ করে দে।”
ও এক মূহুর্তের জন্য চমকে উঠলো। বুঝতে পারছে না যে কী হয়েছে, ও শুধু স্যুইচটা বন্ধ করে দিলো।
“আমি মুভি দেখতে চাই না। আমি কেবল তোকে দেখতে চাই।”
“...”
“আমার জন্য তুইই পৃথিবীর সব চেয়ে সুদর্শন পুরুষ, মুভির থেকে অনেক ভালো।”
ও দৃষ্টি দিয়ে মিন হুয়েকে ঝলসে দিলো। মিন হুয়ে মুচকি হাসলো।
তারপর, লাগাতার ছ দিন, যতোদিন না মিন হুয়ে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলো, শিন ছি ওর সাথে দেখা করতে এলেই, ও ঐ জায়গাতেই বসতে লাগলো।
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-70.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-72.html