এডউইন আর ভেরোনিকা বেরিয়ে গেলেন ব্রেকফাস্টের পরে। টর্টিলার মধ্যে স্যালাড আর টার্কি সালামি রোল করে দুজনেই লাঞ্চপ্যাক নিয়েছেন। তাই রয়েছে অ্যাশলি আর নাটালির জন্য। সকালে দুধ কর্নফ্লেক্স, কলা আপেল, অরেঞ্জ জুস খেয়েছে সবাই। তারপর নাটালি আর অ্যাশলি বসেছে পড়ার বই, ছবির বই এসব নিয়ে।
মাঝে মাঝেই অ্যাশলি শুয়ে পড়ছে। ঝিমুনিতে ঘুমিয়েও পড়ছে। নাটালি সে ফাঁকে নিজের পড়া দেখে নিচ্ছে একটু। হঠাৎ অ্যাশলি “হেলিকপ্টার!” বলে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল।
নাটালিকেও খুব কান পাততে হলো না। বাড়ির খুব কাছে, খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটা হেলিকপ্টার সেটা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে বাজখাঁই আওয়াজে। তারপর সেই আওয়াজের মধ্যে থেকে একটা ঘোষণা ভেসে এলো, “বেঞ্জামিন মাইলস তুমি আত্মসমর্পণ করো।”
দুই বোনে উত্তেজনায় জানলার ধারে ছুট্টে গেল। পর্দা তুলে দেখার চেষ্টা করল যদি হেলিকপ্টারটা দেখা যায়। কিন্তু কিছুতেই সেটা দেখা গেল না। যদিও সেটা ঘুরে ঘুরে আসছে আর ঘোষণা চলছে, “বেঞ্জামিন মাইলস তুমি আত্মসমর্পণ করো। আমদের শিকারী কুকুর তোমাকে খুঁজছে।”
কখনও বা বলছে, “বেঞ্জামিন মাইলস তুমি আত্মসমর্পণ করো। আমাদের অফিসাররা সশস্ত্র। তুমি পালানোর চেষ্টা করলেই তোমাকে দেখা মাত্র গুলি করা হবে।”
তারপর হেলিকপ্টার একসময় ফিরে গেল। দুপুর আবার নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল।
অ্যাশলি গুটিয়ে এসে ঘন হয়ে বসল নাটালির কোলের মধ্যে। নাটালির দুহাতের তালু নিজের দুহাতের তালুতে জড়িয়ে ধরে বলল, “ন্যাট, আমার ভয় করছে।”
নাটালি বলল, “কেন রে? ওরা তো তোকে ধরতে আসে নি।”
অ্যাশলি একটু গুম হয়ে থাকল। তারপর বলল, “বাবা কবে আসবে?”
নাটালি বলল, “ক্রিসমাসে।”
অ্যাশলি বলল, “ক্রিসমাস আসতে আর কত দেরি?”
নাটালি উত্তর দিল, “মাস দুয়েক।”
অ্যাশলি আবার জিজ্ঞেস করল, “মানে ষাট দিন?”
নাটালির হাসি পেল। একটু আগেই ও শিখিয়েছে অ্যাশলিকে এক মাসে কত দিন, কত মাসে এক বছর এইসব। সে ঘাড় নেড়ে “হ্যাঁ” বোঝাতে বোঝাতে বলল, “হঁ-হ্।”
তাতে অ্যাশলি ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু সেও ঠিক কতদিন বুঝলাম না।”
এতে নাটালি হো-হো করে হেসে উঠল। অ্যাশলির এখনও খুব বুদ্ধি হয় নি এমন ভেবে নয়। বরং এই ভেবে যে এই সংখ্যাগুলোর সঙ্গে অপেক্ষা জুড়ে গেলে এগুলো কখনও মনে হয় অনেক অনেক দিন, কখনও মনে হয় কটা মাত্র দিন, আবার কেটে গেলে মনে হয় যেন হুশ করে কেটে গেল।
কিন্তু সেসব অ্যাশলিকে কেউ বলে বোঝাতে পারবে না। এসব সব্বাই শেখে, বোঝে নিজের নিজের মতো করে। তারপর অ্যাশলি আবার বলল, “বাবা কোথায় গেছে বলো তো? এত দেরি তো আগে কখনও হয় নি?”
এক মূহুর্ত ভেবে নিয়ে নাটালি বলল, “মা বলেছে তো, বাবা জেলে গেছে। বলে নি তোমায় যে ওখানে নিজের ইচ্ছেয় যাওয়াও যায় না, ওখান থেকে নিজের ইচ্ছেয় বাড়িও আসা যায় না। জাজ যখনই অনুমতি দেবেন বাবাকে বাড়ি আসার জন্য, তখনই বাবা বাড়ি আসবেন।”
প্রিসিলা, এডউইন, নাটালি, অ্যাশলির বাবা মিগেইল, পেশায় ট্রাক ড্রাইভার। ফ্রেইট নিয়ে প্রায়ই পাড়ি দিতেন ফিনিক্স, সানটা ফে বা তিহুয়ানা। সপ্তাহে তিন-চারদিন বাড়ি থাকতেন না একটানা। কিন্তু একটানা দেড় বছর বাড়ির বাইরে থাকেন নি কখনও। এই ব্যাপারটা অ্যাশলিকে অবাক করে মাঝে মাঝেই।
দু বছর আগে মেক্সিকোর তিহুয়ানা থেকে সবজি নিয়ে ইউনাইটেড স্টেট্সে ঢোকার সময় মিগেইলের ট্রাকে নিষিদ্ধ রাসায়নিক পাওয়া যায়। সে এমন রাসায়নিক যার নেশা মানুষকে শরীরে, মনে, চরিত্রে দূর্বল করতে করতে ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
ধরা পড়ার পর প্রথম ছ’মাস ধরে প্রাথমিক তদন্ত সাক্ষী সাবুদ হয়ে যাওয়ার পরে মিগেইলকে জেলে যেতে হয়, আরউইনডেলে। তাঁর সাজা হয়েছে সাত বছরের জন্য।
তিনি প্রথমবার আইন ভেঙে অপরাধ করেছেন বলে বিচারক তাঁকে প্রথম দুবছরের মাথায় বাড়ি যাওয়ার, কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। জেলে খুব নিয়ম মেনে চলছিলেন মিগেইল। সেই জন্য মিগেইল ক্রিসমাসে বাড়ি আসার বিশেষ অনুমতি পেয়েছেন। অবশ্যই তাঁর হয়ে ভেরোনিকা বিচারকের এজলাসে দরখাস্ত করেছিলেন।
আরউইনডেল কারাগারে মিগেইল জানতে পারেন যে জেল থেকে হাঁটা দূরত্বে অল্প ভাড়ার অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া যায়। ভেরোনিকা ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেই অ্যাপার্টমেন্টেই চলে এসেছেন।
তার আগে ওঁরা থাকতেন পোমোনাতে, যেখানে ভেরোনিকা ও টেরেসার মা থাকেন। ভেরোনিকা কাজ করেন আইনজীবির আপিসে। যদিও তিনি কিছুদিনের জন্য আইন পড়েছিলেন কিন্তু এখনও তাঁর আইনের ডিগ্রি নেই। তাই তিনি পুরোদস্তুর আইনজীবি নন এখনও।
যাতে শিগগির পুরো দস্তুর আইনজীবি হতে পারেন তাই ভেরোনিকা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, ক্লাস করছেন নিয়মিত। বার কাউন্সিলের পরীক্ষা আর বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক্রমের কিছু ধাপ বছর খানেকের মধ্যে উতরে গেলেই তিনি পুরোদস্তুর উকিল হয়ে যাবেন।
মিগেইলের জেল হওয়ার পর থেকেই মিগেইলকে নির্দোষ সাব্যস্ত করার চেষ্টায় সরকারের সাথে মোকদ্দমা চলছে। যদিও ভেরোনিকার আপিসের আইনজ্ঞরাই মিগেইলের মোকদ্দমাটা সামলান তবুও উকিলের, আদালতের আর মোকোদ্দমার অন্যান্য সব খরচ চালানোর জন্য তাঁদের পোমোনার বাড়িটা বেচে দিতে হয়েছে।
তাছাড়া বাড়িটার মর্টগেজ শোধ হতেও কিছু বাকি ছিল। মিগেইলের রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একা ভেরোনিকার রোজগারে চার সন্তানের পড়াশোনা এবং আবশ্যিক আর সব খরচ চালিয়ে বাড়ির মর্টগেজের টাকা চোকানো মুশকিল ছিল। তাই ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভেরোনিকা চলে এসেছিলেন মিগেইলের কারাবাসের কাছাকাছি অ্যাপার্টমেন্টে।
হাইস্কুলের শেষ বছরটার জন্য প্রিসিলা পোমোনাতেই থেকে যায়। নাটালি ভর্তি হয় মিডলস্কুলে আর এডউইন হাইস্কুলে। অ্যাশলি প্রেপস্কুল ছেড়ে ঢুকেছে এলিমেন্টারি স্কুলে।
যে জেলে মিগেইলকে রাখা হয়েছে সেটা আরউইনডেলে হলেও অ্যাপার্টমেন্টটার ঠিকানা অন্য শহরে। আসলে সেই শহরের সীমানা টানা আছে নাটালিরা যে অ্যাপার্টমেন্ট কমিউনিটিতে থাকে তার দুদিক দিয়ে; অ্যাপার্টমেন্ট কমিউনিটির সামনে দিয়ে পুব-পশ্চিমে চলে যাওয়া রাস্তাটা বরাবর; আর অ্যাপার্টমেন্টের গা ঘেঁসে উত্তর-দক্ষিণে চলে যাওয়া রাস্তা বরাবর। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর রাস্তাটা আবার আরউইনডেল আর কোভিনা নামের আরেকটা শহরের সীমাও বটে। ফলে, তিনটে শহরের মিলন স্থলে অ্যাপার্টমেন্টটা।
মাসি টেরেসা থাকেন স্যান ডিমাসে। সেখানে ইস্কুলে পড়ান তিনি। তাঁর বাড়িও জায়গাটা থেকে খুব দূরে নয়। একলা একলা সব সামলাতে গিয়ে ভেরোনিকা যখন হিমসিম খেয়ে যান, তখন টেরেসা এসে দাঁড়াতে পারেন ভেরোনিকার পাশে। ভেরোনিকা বদলি নিয়েছেন আইনজীবির পোমোনা আপিস থেকে কোভিনা আপিসে। বদলি না হলে তাঁর পক্ষে এই অ্যাপার্টমেন্টে আসা সম্ভব হতো না।
মিগেইলের ট্রাকটা এখনও সরকারী হেপাজতে। নাহলে ট্রাকটা বেচে আরও কিছু পয়সার ব্যবস্থা হয়তো করা যেত।
মালিকানার হিসেবে ট্রাকের ইঞ্জিন, ড্রাইভিং-এর যন্ত্রপাতি, বসার জায়গা আর শোওয়ার জায়গা সমেত ছ চাকার ধাতব চৌখুপি যানটার দায়িত্ব ড্রাইভার মিগেইলের। সেই যান মাল ফেরি করার সময় সঙ্গে জুড়ে নেয় মালসমেত কন্টেনার।
যারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় জিনিস পাঠায় কন্টেনারটা তাদের নিজেদের কিংবা অন্য কন্টেনারওয়ালার থেকে ভাড়া নেওয়া। কখনও কখনও মিগেইলের মতো ড্রাইভাররাও কন্টেনার ভাড়া দেন বা ভাড়া করে নেন।
নিজের ট্রাকে কন্টেনার জুড়ে নেওয়ার পরে আইনত ড্রাইভার জানতে বাধ্য থাকেন যে ট্রাকের লাগোয়া কন্টেনারে কি ফেরি করছেন। শুধু তাই নয় কন্টেনারের জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ফেরির সময় ড্রাইভারের।
তিহুয়ায়ানা থেকে সেবার যখন সব্জি নিয়ে আসছিলেন মিগেইল তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না যে সব্জির বস্তার মধ্যে নিষিদ্ধ রাসায়নিক লুকোনো ছিল। সেবার তিনি গিইলেরমো নামের একজনের আড়ত থেকে জিনিস ভরেছিলেন ট্রাকে। তার সাথে লেনদেনের সম্পর্ক প্রায় দশ বছরের।
সেবার ট্রাকের জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল লা এক্সেলেন্তে নামের একটা জনপ্রিয় মুদিখানাতে। তবে একেকটা বাজারে লা এক্সেলেন্তে চালায় একেকটা কোম্পানি। যেমন কোভিনা প্লাজাতে লা এক্সেলেন্তে চালায় উয়ান আর্নেস্তো ই হিহোস আইএনসি। আবার স্যান বার্নার্দিনোতে লা এক্সেলেন্তের মালিক জে এন্ড জে ব্রাদার্স এলএলসি।
মিগেইল দু জায়গাতেই জিনিস ফেরি করেন। যে বার তিনি ধরা পড়লেন নিষিদ্ধ জিনিস ফেরির অপরাধে সেবার ট্রাকের জিনিস পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল কোভিনা প্লাজার লা এক্সেলেন্তে-তে, তাঁর খদ্দের ছিল আর্নেস্তো ই হিহোস আইএনসি। আর্নেস্তো ই হিহোস আইএনসি কোনোদিন কখনও নিষিদ্ধ বস্তুর কারবার করেছে বলে জানা নেই সরকারের। তাই সরকার তাদেরকে সরাসরিভাবে দোষী করছে না।
একমাত্র মিগেইলের সাথেই সরাসরি যোগাযোগ পাওয়া গেছে নিষিদ্ধ বস্তুর। যদিও মিগেইল বারবার পুলিশকে আর কোর্টে জানিয়েছেন যে তিনি জানতেনই না সব্জির ক্রেটে নিষিদ্ধ বস্তু আছে, তবুও আইনের হিসেবে মিগেইল জানতেন যে তিনি কী জিনিস ফেরি করছেন। ফলে ফেরির রাস্তায় চেকপোস্টে যখন ধরা পড়ল যে সব্জির মধ্য নিষিদ্ধ মাদক লুকোনো আছে তখন দায়টা মিগেইলের ঘাড়েই পড়ল। তাই তিনি আইনের চোখে অপরাধী। তাই তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন।