একদিন রাতে হলো কী ...... না ভয়ানক কিছু না। দাদু ফোন করে বলল, “চলে আয় মুম্বাই।” আজ যাই কাল যাই করে একদিন চড়ে পড়লাম গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে।
ভরভরন্ত বর্ষায় নামলাম মুম্বাই স্টেশনে। আঁতিপাতি খুঁজে, ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করেও দাদুর দেখা পেলাম না। বেশ ঘাবড়ে গেলাম। ফোনেই কথা হয়। দাদুর ঠিকানা তো জানি না। অগত্যা আবার টেলিফোনে দাদুকে ধরলাম। দাদু প্রায় কাতরাতে কাতরাতে বলল, “টাকের ব্যাথায় মাথা তুলতে পারছি না।” তারপর ঠিকানা আর কিভাবে পৌঁছব ওর কাছে তার নির্দেশ জেনে নিয়ে রওনা হলাম। শহরটা বানভাসি। আর আমি যাচ্ছি ভাসি। কে জানে, এই ভাসাভাসির চক্করেই বোধ হয় দাদুর এলাকাটা ভাসি!
দাদুর বাড়ি পৌঁছে দরজায় ঘন্টি বাজালাম। ঘোমটায় টাক, মুখ ঢেকে দাদু বেরোল। আমি হেসে ফেললাম। বললাম, “কেন রে? অল্প বয়সে টুপিতে টাক ঢাকতে বললে তো খেঁকিয়ে আসতিস, আর এখন লজ্জায় ঘুমটা দেওয়া হয়েছে! আমি কি তোকে নতুন দেখছি? না তুই আমাকে?” দাদু প্রায় কেঁদে ফেলল; বলল, “ভেতরে আসবি নাকি সব কথা দুয়ার থেকেই বলে চলে যাবি?” ঢুকলাম ভিতরে। দাদু চায়ের ফ্লাস্ক দেখিয়ে দিয়ে, খাটের থেকে মাথা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ল। বালিশ এগিয়ে দিলাম; তাতে খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলল, “টাকের অসুখে বালিশে মাথা রাখা দায়।” অনেক ঝোলাঝুলির পর দাদু টাকের ঘুমটা খুলল। দেখলাম যে দাদুর টাকটা সাংঘাতিক বড়ো হয়েছে, আর তাতে অসংখ্য ব্যাঙের ছাতা গজিয়েছে। অবাক হয়ে দাদুকে বললাম কথাটা। কিন্তু সে কিছুতেই বিশ্বাস করে না, বলে যে, “ঢিবি ঢিবি হয়েছিল, ভাবলাম ফোঁড়া; আমার অসুস্থতা নিয়ে ঠাট্টা করছিস!” আমি ওকে আয়না এনে দেখাতে পারলাম না। ছাতাগুলো সংখ্যায় অনেক কিন্তু ছোটো।
রাত পোহাতেই দাদুকে বলতে গেলাম ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। কিন্তু দাদু রাজি হলো না। এদিকে ছাতাগুলো সারারাত ধরে মোটা আর বড়ো হয়েছে। তাদের ভারে দাদু মাথা তুলতে পারছে না। একবার ওকে ধরাধরি করে আয়না দেখালাম। আয়নায় ওকেও একটা আস্ত ব্যাঙের ছাতার মতো দেখাল। তাতে বুড়ো ছেলে কষ্টে কেঁদে ফেলল। অনেক চেষ্টার পর ওর কষ্টে প্রলেপ লাগালাম। তবে কষ্টটা বেশ গভীর এবং যথেষ্ট যৌক্তিক। তার শহরে চুল কাটাতে নব্বই টাকা খরচ লাগে প্রতিবার। তাও নাপিতের কাছে। নেহাৎ টাক পড়ে খরচটা কমায় ও খুশি ছিল। না জানি এখন ছাতা ওপড়াতে ডাক্তার কতো পয়সা নেবে। ব্যাথায় পাগল দাদু সে রাতে দাপাদাপি শুরু করল।
পরদিন সকালে ওকে ঘুমটায় মুড়ে চললাম হাসপাতালে। কী ঝড়বাদল সেদিন! প্রথমে ঝড়ে অটোর চালটা উড়ে গেল। তারপর দাদুর ঘোমটা। তারপর জল থইথই এক রাস্তায় অটোর প্রপেলারে প্লাস্টিক ব্যাগ আটকে অটো থেমে গেল। ব্যস্ত শহরে বানও জীবন থামাতে পারে না। সব মোটরযানেই প্রপেলার থাকে। এমনকি রিক্সাতেও হাল আর দাঁড় থাকে। সেই ভরসাতেই অমন দূর্যোগেও দাদুকে নিয়ে বেরোনো। কিন্তু অটো থামতেই কোথা থেকে একটা ব্যাঙ এসে চড়ে বসল দাদুর টাকের ছাতায়। আমি তাড়াতে যেতেই চার আঙুলে সামনের পা উঁচিয়ে বলল, “হাই!” চমকে গেলাম। ব্যাঙ বলল, “অ্যালিসের দেশে ব্যাঙের ছাতায় শুঁয়োপোকা বসত, তাই না? তুমিও শুঁয়োপোকাটার দেখা পাবে।” আমি ঠাট্টা ভেবে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কিন্তু ব্যাঙ বাবাজী দাদুর টাকে অচল।
হাসপাতালে ডাক্তার পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর বললেন যে কাজটা তাঁর নয়। তবে এক নাপিতের ঠিকানা দিলেন যে মানুষের টাক থেকে ব্যাঙের ছাতা ওপড়ায়। আবার হুডখোলা অটো চেপে চললাম বিশিষ্ট পারলারে। ব্যাঙ কিন্তু সঙ্গ ছাড়ে নি তখনও।
নাপিতের আয়নার সামনে দাদুকে বসাতেই ব্যাঙের সাথে চোখাচোখি। এদিকে খুর হাতে নাপিত এগিয়ে আসছে। ব্যাঙ বলল, “আমি আর বেশিক্ষণ নয়, কেটে পড়ব। যদি শুঁয়োপাকাটার দেখা পেতে চাও তাহলে এই আয়নাতে ঢুকে পড়ো।” একে ব্যাঙ, তায় ফিচেল। ওটাকে পাত্তাই দিলাম না। নাপিত আসতেই তাকে দেখালাম যে ব্যাঙ বসা ছাতাটাকে আগে কাটতে হবে। নাপিত বলল আয়নায় হাত রেখে দেখাতে কোন ছাতাটা। যেই আমি আঙুল বাড়িয়ে আয়না ছুঁলাম অমনি ব্যাঙ দিল এক লাফ। আর আয়নাটা একটা হ্যাঁচকা টানে আমার আঙুলের ভিতর ঢুকে পড়তে লাগল। নাকি আমি আয়নাটার মধ্যে ঠিক বুঝতে পারলাম না। শুধু ম্যাট্রিক্স সিনেমার নিওর মতো পাক খেতে খেতে হাজির হলাম একটা লালমাটির রাস্তার পাশে; সটান একটা সাদা ঘোড়ার পিঠে। রাঙামাটির পথ গ্রামটাকে ছাড়িয়ে যে দিকে গেছে ঘোড়া ছুটল সেদিকে। হঠাৎ দেখি আমার সামনে রাস্তা ধরে ছুটছে একটা পাঁশুটে শুঁয়োপোকা।
অমনি ঘোড়ার লাগাম ধরলাম। ছুটলাম শুঁয়োপোকার পিছন পিছন। যখন খেত, নালা, জঙ্গল পেরিয়ে সাদা ঘোড়া প্রায় হাঁপিয়ে গেছে, তখন শুঁয়োপোকাটাকে আমরা ধরে ফেললাম। কিন্তু ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ওর রাস্তায় আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে ওর গতিরোধ করার আগেই দেখি ফিনিশিং লাইন এসে গেছে। দুপাশের রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। হৈ হট্টগোলে ঘোড়া আরও জোরে ছুটতে লাগল। জনতা তালি দিয়ে উঠল আর শুঁয়োপোকাটা প্রজাপতি হয়ে উড়ে গেল। বুঝলাম না লোকেরা তালি দিল কেন, দৌড়টা জেতার জন্য নাকি শুঁয়োপোকাটাকে প্রজাপতি হতে দেখে।
এইসব দ্বন্দে সন্দেহে হারিয়ে যাওয়া মনটা ঠাণ্ডা হতেই দেখলাম যে বাড়ির দরজা খুলে বাবা বলছেন, “কখন থেকে চা করে বসে আছি। সাইকেলটা ঢুকিয়ে দে। হাত-পা তাড়াতাড়ি ধো। চাটা গরম করছি।”