টুবলু হাঁ করে রোদ দেখছিল। আমপানের পর, মেঘলা ঝোড়ো সপ্তাখানেক মনটা যেন কেমন ঝিমিয়ে ছিল। এত্তোগুলো দিন ইস্কুল নেই। মাঠে ফুটবল খেলা নেই। এমনকি গরমকালের দারুণ মজা যে সাঁতারে, তাতেও যাওয়া নেই। ইস্কুল যাও বা শুরু হলো মায়ের ফোনে ভিডিও চ্যাটে, তাও নিয়ে গেল ঝড়ে।
আজকাল ঘুম থেকে ওঠার পরে আবার হাই উঠতে থাকে। দাদুন বারান্দার চেয়ারে বসে হাই তোলে। দিদুন তোলে বসার ঘরের সোফায় বসে। টুবলুও তোলে দাদুনের পাশে বসে কিংবা দিদুনের পাশে বসে।
একদিন বাবা দেখে বলেছিল, “টুবলু, রাতে ঘুম হয়নি?”
টুবলু মনে করে দেখার চেষ্টা করেছিল। ঘুমোতে যাওয়া আর ঘুম থেকে ওঠা ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে নি। শুনে বাবা বলেছিল, “তার মানে ঘুম হয়েছে।”
টুবলু ভেবেছিল, “বাবা-মা যেন সব জানে!”
আরেকদিন টুবলুকে সক্কালবেলা হাই তুলতে দেখেছিল মা। সেই থেকে রোজ বাগানে নেমে দড়ি নিয়ে একশোটা লাফ দিতে হয়। তারপর গাছে জল দিতে হয়। আর ফাঁক পেলে ঘাসের ওপর বসে লবঙ্গলতিকার ফুলের ওপরে এসে বসা পোকাদের দেখা যায়।
আমপানের ঝাঁপাঝাঁপিতে কদিন বাগানের বদলে বারান্দায় দড়িলাফ দিতে হয়েছে। টুবলুর কেবল মনে হয়েছে, “জ্বর না হলে, পেট খারাপ না হলে এই বিচ্ছিরি ঘামাঘামির থেকে ছুটি নেই।”
এদ্দিন পরে বাগানে বেরিয়ে টুবলুর ভালোই লাগছিল। যেখানে সেখানে বেয়াড়া রকমের ঘাস গজিয়েছে। শুয়ে পড়া গাছগুলো আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তার মধ্যে আড়ে শুয়ে থাকা রোদটাকে নজরকাড়া লাগছিল টুবলুর। ভাবছিল দুপুরে রোদটাকে আঁকবে; ক্রোম ইয়েলোর সাথে কতোটা লাইম ইয়েলো দেবে সেটা ঠিক করে উঠতে পারছিল না।
এমন সময় একটা সুড়সুড়ি পিঁপড়ে বলল, “অ্যাই, আমাকে একটা জামপাতা করে ঘরে নিয়ে চলো।”
টুবলু নিজের কানকে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। টুবলু কারুর হুকুম নেয় না। নেহাত মা সকালে খেতে দেবে না তাই এইসব লাফালাফি, বাগানবিহার। সেই টুবলুকে একটা পিঁপড়ে কিনা হুকুম করছে!
টুবলু রোদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিল, “তোমার পায়ে কী হয়েছে? নিজে হেঁটে যেতে পারছ না?”
পিঁপড়ে বলল, “পারলে কী আর তোমার মতো তক্কবাজ ছেলেকে বলি আমায় জামপাতা করে ঘরে নিয়ে যেতে...”
টুবলু খেপে উঠল, “এদিকে তোমার আমাকে লাগবে... তাও নির্লজ্জের মতো আমাকেই মুখের ওপর তক্কবাজ বলছ?”
পিঁপড়েও রাগ দেখাল, “ব্যাঙটা তাড়া করেছে। আমাকে খেয়ে ফেলবে। তাই তাড়াহুড়ো করে কাদা মাড়িয়ে আসতে গিয়ে পাগুলো আমার জড়িয়ে জ হয়ে গেছে ......”
টুবলু যেন আপত্তির একটা ঠিকঠাক কারণ খুঁজে পেল, “জড়িয়ে জ হয়ে গেছে আবার কী রকম কথা!”
পিঁপড়ে তর্ক জুড়ল, “কেন, ঘেঁটে ঘ হতে পারে আর জড়িয়ে জ হতে পারে না?”
টুবলু নাক উঁচিয়ে বলল, “পিঁপড়ে বলে ছেড়ে দিলাম। বাংলাটা না হয় জানো না। কিন্তু মানুষ হলে বর্ণপরিচয় ধরাতাম।”
পিঁপড়েও নাছোড়, “ভারি ভাষা বিশেরদ এয়েচেন আমাদের... কথায় বলে ‘ভাষা হলো মহাশয়, যা কওয়াবে তাই কয়’...... নিজে জানে না...”
টুবলু একটু নড়ে চড়ে বসল। আর দেখতে পেল ব্যাঙটাকে। ওটা ওৎ পেতে বসে আছে। পিঁপড়েটাকে ঠাহর করতে পারলেই স্যাট করে জিভ ছুঁড়ে টেনে নেবে বলে। আর কথা না বাড়িয়ে টুবলু একটা পড়ে থাকা জামপাতা কুড়িয়ে নিয়ে, সেটার ওপর পিঁপড়েটাকে তুলে নিয়ে ঘরে চলে গেল।
পড়ার টেবিলের ওপর পিঁপড়েটাকে রেখে বলল, “তুমি আর বেঁচে থেকে কী করবে? মায়ের চিনির কৌটো, ল্যাপটপে ঢুকে পড়বে, আর ওলোট পালোট করবে সব ...”
পিঁপড়ে বলল, “তোমার মায়ের চিনির কৌটোয় ঢোকা যায় না। ল্যাপটপটাও খুব গরম। তার থেকে ভালো তোমার বাবার কাজের টেবিল। উনি কিচ্ছু মনে করেন না ওখান দিয়ে আমরা যাতায়াত করলে। ভারি সহনশীল মানুষ। দাদুন দিদুনের ওষুধের তাকগুলোও ভালো। ওখান থেকে কিছু খেলে ওঁরা কিচ্ছু বলেন না।
টুবলু বিরক্ত হলো, “হ্যাঁ মা একটু কড়া ধাতের লোক। আমাদের সব্বার খেয়াল রাখেন তো। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে চলেন। কোনো কিছু এধার ওধার হলে মুস্কিলে পড়েন।। তাই সব কৌটো শক্ত করে বন্ধ করে রাখেন। তোমরা মায়ের সাথে পেরে ওঠো না বলে এমন বলছ যেন মা সব চেয়ে বাজে লোক...”
এতোটা বলে টুবলু দুম করে থেমে গেলো। তার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। মায়ের হয়ে সে পিঁপড়ের সাথে ঝগড়া করছে! সারা বাড়িতে সব্বাই একদিকে আর মা উলটো দিকে, সারাক্ষণ। এখন বাইরের থেকে পিঁপড়ে এসে টুবলুকে মায়ের দলে করে দিল!
এই সুযোগে পিঁপড়ে বলল, “না বাজে লোক নন, যুদ্ধুবাজ। সেবার অমন মেঘলাতে, গুমোটে, আমরা ডিম মুখে করে বাগান থেকে তোমাদের রান্না ঘরে ঢুকতে বাধ্য হলাম। আর উনি আমাদের পুরো লাইনের ওপর জল ঢেলে দিলেন! এমন হিংসুটে... আমরা তো রাতটুকুই থাকতাম, কলের নিচে, ভাঙা টাইলসের খাঁজে.....”
টুবলু কথা কেড়ে নিল, “তোমরা কী শুধু রান্না ঘরে যাও? তোমরা বাথরুমের মেঝেতেও ঘোরাঘুরি করো... বাথরুম থেকে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় কী পা ধুয়ে যাও? তোমাদের নোংরামির জন্যই তো মা তোমাদের অপছন্দ করেন...”
পিঁপড়ে ফুঁসে উঠল, “কী বললে? নোংরা আবার কী? পা ধোওয়াই বা কী?”
টুবলু বিজয়ীর হাসি হাসল, “দেখলে, যা জানো না তাই নিয়ে তক্ক করছ...”
তারপর বলল, “যা হোক, টিকটিকি আসা অবধি তুমি এখানেই থাকো। তারপর না হয় তোমাকে আবার সরিয়ে দেব।”
পিঁপড়ে বলল, “দিও কিন্তু। সদ্য ডিম ভাঙা পিঁপড়েগুলো লাইনে দাঁড়াতে আর চলতে শিখলেই আমার ছুটি। তখন আমি ব্যাং বা টিকটিকির পেটে গেলেও দলের কোনো ক্ষতি নেই।”
টুবলু বলল, “সে কতো দিন?”
পিঁপড়ে বলল, “বেশি না। আর দিন তিনেক।”
এই কথা শুনে টুবলুর ভারি মন খারাপ করল। তারপর একটা বইকে খুলে বাড়ির চালার মতো করে পিঁপড়েকে ঢেকে রেখে টুবলু খেতে গেল। খেয়ে ফিরে এসে, চার কুঁচো প্যানকেক দিল পিঁপড়েকে। কিন্তু পিঁপড়েটা দেখা গেল বেশ অভদ্র। প্যানকেক খেয়ে বলল, “বড্ড নরম। ল্যাদগ্যাদে। একটু মুচমুচে হলে ভালো লাগত। আর চিনি এতো কম......”
টুবলু বিরক্ত হলো। কিন্তু কথা বাড়াল না। এবার পড়তে না বসলে মা দুপুরে খেতে দেবে না।
দুপুরে খেয়ে ঘরে আসার সময়, টুবলু কয়েক দানা চিনি নিয়ে এলো হাতে করে। বই সরিয়ে দেখল পিঁপড়ে নেই। টুবলুর খারাপ লাগল। তর্কাতর্কি করলেও, টুবলু তো তাকে সাহায্যও করেছিল অনেক। কিন্তু অসভ্য পিঁপড়ে যাওয়ার সময় বলে গেল না।
চিনির দানাগুলো জানলায় রেখে টুবলু ছবি আঁকতে বসল। সন্ধের মুখে দেখল পিঁপড়ে ফিরে এসেছে। চিনির দানা খাচ্ছে। আবার যাওয়ার সময় বলে গেল, “কাল সকালেও একটু চিনি এনে দিও।”
পরের দিন টুবলু জলখাবারের পরোটার মুচমুচে টুকরোগুলো জমিয়ে তুলল। মা খুব খুশি হলো, “ও মা! ছেলে আমার বড়ো হয়ে গেছে। বাড়ি পরিস্কার করে দিচ্ছে।”
টুবলু ভাবল, “মাকে ঘরে আসতে দেওয়া যাবে না। এলেই জানলায় জড়ো হওয়া পরোটার কুঁচো আর চিনি দেখে চেঁচামেচি শুরু করে দেবে।”
এরপর থেকে মা একবার ডাকলেই টুবলু হাজির হতে শুরু করল। চেয়ে খেতে শুরু করল। বাবার ঘরে গিয়ে পড়া বুঝে আসতে লাগল। মায়ের কাছে গিয়ে অঙ্ক দেখে আসতে শুরু করল।
দিন তিনেক পর থেকে জানলায় খাবার জমে থাকতে লাগল। পচে গন্ধ বেরোবার ভয়ে টুবলু জানলার থেকে বাসি খাবার সরিয়ে নিতে লাগল।
একদিন দুপুরে প্যালেটের পাশে হঠাৎ করে দেখল পিঁপড়েটা দুটো পা তুলে যেন নমস্কার করছে। টুবলু জিজ্ঞেস করল, “এদ্দিন কোথায় ছিলে? জানলায় খাবার রাখা আছে, খেয়ে নাও।”
পিঁপড়ে বলল, “ধন্যবাদ। তবে আমার আর খাবারের দরকার নেই।”
টুবলু বলল, “কেন?”
পিঁপড়ে জানাল, “আমি তো আর পিঁপড়ে নই। পিঁপড়ের ভুত। তিনদিন আগে আমাদের লাইনের দুশোটা পিঁপড়েকে হোঁৎকা টিকটিকি খেয়ে ফেলেছে।”
টুবলুর হাত থেকে তুলিটা ঠক করে পড়ে গেল। টুবলু বুঝতে পারছে না ভয় পাবে নাকি তর্ক করবে। ভুত হয়েও পিঁপড়ে ফিরে এসেছে, আবার ‘ধন্যবাদ’ও বলেছে পিঁপড়ে। এতে টুবলু নিশ্চয়ই খুশি হতে পারে। কিন্তু...... টুবলু জিজ্ঞেস করে ফেলল, “টিকিটিকিতে খেয়ে ফেলল তোমাদের, তোমার দুঃখ হচ্ছে না?”
পিঁপড়ে গম্ভীর গলায়, ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে, মাথার পেছনে দু ঠ্যাং বেঁধে, আরামে বসার কায়দায় উত্তর দিল, “নাহ্ ... অমন হয়েই থাকে।”
তারপর উদাস গলায় জানাল, “ভুত হলাম বলেই তো জানতে পারলাম যে তুমি আমাকে অসভ্য, অভদ্র ভাবছিলে, তোমাদের মানে মানুষের আদব-কায়দা জানি না, পারি না, মানি না বলে। তাই ভুতলোকের মানুষ ভুতেদের কাছে গিয়ে একটু শিখে এলাম আর কি। ভুতলোকের যোগাযোগ সহজ কিনা।”
কথা না বাড়িয়ে টুবলু জানতে চাইল, “তাহলে কাল থেকে আর খাবার রাখব না তো?”
পিঁপড়ে বলল, “রাখতেও পারো। এখন বর্ষাকাল তো। অনেকগুলো সদ্য ডিমভাঙা পিঁপড়ে। খাবারের খুব টানাটানির সময়......”
তারপর সে হঠাৎ মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।
টুবলু খাবার রাখতে লাগল জানলায়। ভুত হোক বা পিঁপড়ে; এটুকু করাই যায়।