Saturday, December 7, 2024

Chapter 3 - নতুন পাড়া

 


অ্যাশলির মন ভালো করার জন্য নাটালি বসল আঁকার খাতা আর প্যাস্টেল নিয়ে। বলল, আয়, আমরা হেলিকপ্টারটা আর ওরা কি বলছিল তার ছবি এঁকে ফেলি।

ছবি আঁকা চলল অ্যাশলির খিদে পাওয়া অবধি। খাওয়ার পর অ্যাশলি বসল কার্টুন দেখতে। নাটালি বসল আবার নিজের বই-খাতা নিয়ে। জানলার বাইরে ইতস্তত কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। যাদের ইস্কুল ছুটি হয়ে গেছে তারা কিংবা যাদের ইস্কুল যাওয়া নেই তারা মায়ের সাথে, বন্ধুর সাথে আর বন্ধুর মায়ের সাথে চলেছে স্যুইমিং পুলে।

অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের সুইমিং পুলটা কিন্তু বেশ অপরিস্কার। নিয়মিত পরিস্কার হয়। কিন্তু নামেই। হুল্লোড়বাজ খেলুড়ে ছেলেমেয়েরা অবশ্য শেষ দুপুরে পুলে হল্লা করে। তবে নাটালিরা কেউই যায় না পুলে।

ওদেরকে ভেরোনিকা একটা সুইমিং ক্লাবে নিয়ে যান। সেটা নাটালিদেরও পছন্দের ব্যবস্থা। কারণ তারাও নজর করেছে যে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংগুলোর লাগোয়া ফালি জমির বাগানে কিংবা পায়ে চলা রাস্তাগুলোতে বাসিন্দাদের পুষ্যি কুকুর বেড়ালের পায়খানা পড়ে থাকে। সে সব সাঁতারুদের পায়ে পায়ে গিয়ে পুলে পড়ার সম্ভাবনা নেহাত কম নয়।

পুষ্যির পায়খানা পড়ে থাকে অ্যাপার্টমেন্ট কমিউনিটির চারটে লন্ড্রিতেও। প্রথম সপ্তাহে লন্ড্রির ওয়াশারে কাপড় কেচে ড্রায়ারে শুকোতে গিয়ে ভেরোনিকার গা গুলিয়ে উঠেছিল। তারপর থেকে প্রত্যেক শনিবার ময়লা কাপড়ের বস্তা নিয়ে ভেরোনিকা চলে যান টেরেসার বাড়ি। তাঁকে সাহায্য করতে নাটালি, অ্যাশলি আর এডউইনও যায়। তারপর সবাই মিলে খেতে যান। তারপর সন্ধেবেলা সব্বাই ফিরে আসে অ্যাপার্টমেন্টে।

বলাবাহুল্য এমন হল্লা, এমন যেখানে সেখানে নোংরা বা পুষ্যির পায়খানা পড়ে থাকার ঘটনা নাটালিদের পুরোনো পাড়ায় ছিল না। নতুন পাড়ার এসব ব্যাপার নিয়ে নাটালিদের ভাইবোনেদের চমক নিয়ে তারা নিজেরাই সন্ত্রস্ত ছিল। নিন্দে করলে যদি মা, বাবা দুঃখ পান, যদি তাঁরা মনে করেন যে ছেলেমেয়েরা বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারছে না, এসব ভেবে এডউইন বা নাটালি মুখ বুজে থাকে।

কার্টুন দেখতে দেখতে অ্যাশলি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে কোলে করে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল নাটালি। তারপর আবার দাঁড়াল জানলার ধারে গিয়ে। সে ভাবতে থাকে, বেচারি প্রিসিলাকে হাইস্কুল শেষ করে কাজ নিতে হবে। সে এক্ষুণি সারাক্ষণের পড়াশোনা চালাতে পারবে না।

এডউইন মাঝে মাঝেই রেগে যায় যে মা তাকে কিছুতেই কাজে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন না বলে। আঠার বছর বয়স হয় নি তার এখনও। মা-বাবার লিখিত অনুমতি ছাড়া তাকে কেউ কাজে বহাল করবে না। একই কারণে নাটালিরও কাজ নেই। সব বোঝা একলা মায়ের কাঁধে।

মাসি সাহায্য করেন। দিদিমাও করেন। কিন্তু তবুও মনে হয়...। নাটালি ভাবতে থাকে, বাবাও তো আর জেনে বুঝে কারুর ক্ষতি করতে যান নি। তাঁর অজান্তে কেউ তাঁর ট্রাকে নিষিদ্ধ রাসায়নিক রেখেছিল। কন্টেনার সমেত সব্জির ক্রেট বুঝে নেওয়ার সময় তিনি টের পাননি কিছুই। বাবা তো নিজেই অন্যের ছলের শিকার। সেকথা প্রমাণ করার জন্য মা তো দৌঁড়-ঝাঁপ কিছু কম করল না! মা তিহুয়ানা অবধি গিয়েছিল। গিইলেরমোর সাথে কথা বলতে। কিন্তু সেও বিশেষ কিছু জানাতে পারেনি। আবার আন্তর্জাতিক সীমা পেরিয়ে তাকে প্রথা মতো জেরা করাও সহজ কাজ নয়। অনেক আইনের অনেক বাধা। তবে কয়েকটা খবর পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো বাবার জন্য উপকারী হতেও পারত।

গিলেইরমো ভেরোনিকাকে বলেছেন যে আন্তর্জাতিক সীমা পেরোনোর সময় চেকপোস্টে যখন গাড়ির লম্বা লাইন লেগে যায়, সে লাইন এমন লম্বা হয় যে গাড়িগুলো খুব ধীরে ধীরে গড়ায় আর থেকে থেকে অনেকক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। সেই দাঁড়ানোর জায়গাটা মূল চেকপোস্ট থেকে এত দূরে যে গাড়িগুলো চেকপোস্টের সিকিউরিটি ক্যামেরাতেও ধরা পড়ে না, তখন নাকি ড্রাইভারের অজান্তে গাড়িতে নিষিদ্ধ জিনিস ভরে দেয় নিষিদ্ধ জিনিসের কারবারিরা। যদি  গাড়ি চেকপোস্টে ধরা না পড়ে, তবে তাদের নাকি ব্যবস্থা থাকে জিনিস যথা সময়ে যথাস্থাণে নামিয়ে নেওয়ার।

সেসব কথা কোর্টে আলোচনা করা যায় নি। তাই নাটালির বাবা মিগেইল যে নির্দোষ তাও প্রমাণ করা যায় নি।

নাটালির বিশ্বাস করে, যদিও আমরা সত্যিটা জানি ...... জানি যে বাবা জেনেশুনে কখনও এমন কাজ করেন নি না যাতে তাঁর হাজতবাস হচ্ছে।

সে অবাক এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়, আশ্চর্য! সত্যি কেন সত্যি বলে স্পষ্ট বোঝা যায় না! কেন তা প্রমাণের প্রয়োজন হয়?

নাটালির বিচিত্র ভাবনার স্রোত হয়তো আরও অনেক দিকে আরও অনেক দূরে ভেসে যেত। কিন্তু তার চোখে পড়ল জানলার উল্টো দিকের একতলার অ্যাপার্টমেন্টের নিনাকে। নিনা ইস্কুল থেকে ফিরল, মানে তার সঙ্গে তার ভাই অ্যান্থনিও ফিরেছে।

অ্যান্থনি নাটালির থেকে এক গ্রেড নিচে পড়লেও বয়সে তার থেকে বড়ো। তারওপর সে এপাড়ার খেলার দলের নেতা। নাটালিরা এ পাড়াতে আসার পরে পরেই সে এডউইন আর নাটালির সাথে ভাব করার চেষ্টা করেছে।

যেমন একদিন বিকালে তাদের বারান্দায় বল এসে পড়েছিল। অ্যান্থনি দরজায় বেল বাজিয়ে বল চেয়েছিল। দরজা সেদিন নাটালিই খুলেছিল। বলটাও সে-ই এনে দিয়েছিল। বল ফেরত পেয়ে অ্যান্থনি বলেছিল, ধন্যবাদ। আমাদের সাথে খেলবে?

নাটালি বলেছিল, আজ হোমওয়ার্ক আছে অনেক। পরে কোনোদিন খেলব।

পরে একদিন আবার বল পড়েছিল বারান্দায়। সেদিন এডউইন দরজা খুলেছিল। তাই বলটা সেদিন এডউইন এনে দিয়েছিল। তাকেও অ্যান্থনি বলেছিল, ধন্যবাদ। তুমিও কী হোমওয়ার্ক করবে এখন?

এডউইন বলেছিল, না, তবে আমি আমার ছোটোবোনের দেখাশোনা করছি। পরে কোনোসময় খেলব তোমাদের সাথে।

তারপর যেদিন আবার বল পড়েছিল বারান্দায়, সেদিন ভেরোনিকা দরজা খুলেছিলেন, এক্কেবারে বারান্দা থেকে বল কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে। সেদিন অ্যান্থনি ধন্যবাদ বলেই চলে যাচ্ছিল।

কিন্তু ভেরোনিকা বলেছিলেন, শোনো প্লিজ, এরপর বারান্দায় বল পড়লে আমি কিন্তু পুলিশ ডাকব আর তোমরা পাড়ায় হল্লা করছ বলে নালিশ করব।

তারপর থেকে বারান্দায় আর কক্ষনো বল পড়ে নি। কিন্তু ভেরোনিকা নেই এমন সময় নাটালিকে একলা দেখলে অ্যান্থনি প্রায়ই ভাব করার চেষ্টা করে। তাই নাটালি তাকে এড়িয়ে যায়। কারণ ভেরোনিকা এ বাড়িতে প্রথম রাত কাটানোর আগেই বলে দিয়েছিলেন, এ পাড়ায় কেউ তোমাদের বন্ধু হতে পারে না।

নিনা ঘরে ঢোকা মাত্রই তার ছোটোবোন ইয়ারা চেঁচামেচি জুড়ে দিল, জানো আজ কী হয়েছে?

নিনা জানে অনেক কিছু হয়ছে। কিন্তু ইস্কুলে। সে তো আর ইয়ারার সাথে সারাদিন বাড়িতে ছিল না। তাই সে জানেও না যে বাড়িতে কী হয়েছে। আর যদি জানতও, তাহলেও যা হয়েছে তাই নিয়ে গালগল্প করা থেকে ইয়ারাকে আটকানো যেত না। তাই সে আদুরে গলায় বলল, না তো, জানি না। তুমি আমায় বলবে?

ইয়ারা বলল, জানো আজ একটা ইয়া বড়ো হেলিকপ্টার আমাদের বাড়ির মাথার উপর দিয়ে গোঁ গোঁ করে কতক্ষণ ধরে উড়ছিল!

কথাটা শুনে হাতের খেলা ফেলে লাফিয়ে এলো তাদের ভাই জেকব। জেকব নিনার থেকে ছোটো, কিন্তু ইয়ারার থেকে বড়ো। বলল, একদম খবরে যেমন চেজ দেখায়, সেরকম ব্যাপার। তারপর তার থেকে ভোঁ ভোঁ করে সাবধানও করল একজনকে। বলল যে আত্মসমর্পণ করো। না হলে কুকুররা তোমাকে কামড়াবে, অফিসাররা তোমাকে গুলি করবে। কতবার যে ঘুরে ঘুরে কথাটা-

অ্যান্থনিও শুনছিল জেকবের কথা। ফিক করে হেসে বলল, আবার মাম্মা খবর শোনার সময় তোরা চেজ দেখেছিস বুঝি?

জেকব বলল, হ্যাঁ, তবে রিয়েল চেজ। আমাদের বাড়ির ওপরই।

ইয়ারা বলল, সত্যিই অ্যান্থনি, নিউজে নয়, একদম সত্যি চেজ দেখেছি।

অ্যান্থনি বলল, তাই তো বলছি, সত্যি সত্যিই নিউজে দেখেছো।

ইয়ারা আর জেকব খুব হতাশ হলো। তাদের উত্তেজনাটা তারা কিছুতেই নিনাকে আর অ্যান্থনিকে দিতে পারল না যে। কিন্তু নিনাতে আর অ্যান্থনিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তবে দুজনেরই চোখে অবিশ্বাস ছিল, ছিল খুশিও। ওরা দুজনে যেন এমনটাই হোক তা চেয়েছিল। কিংবা এমনটা হবে বলে আশা করেছিল।

এদিকে বিকেলে এডউইন বাড়ি ফেরা মাত্র অ্যাশলিও খুব উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগল হেলিকপ্টার পর্ব। এডউইন নাটালিকে বলল, নিজে গপ্প দিতে লজ্জা পাচ্ছিস? পুঁচকেটাকে শিখিয়েছিস সব আবোল-তাবোল? হলিউডের পাশে থাকলেই কী সব্বাই জন ওয়েনের মতো হয়? এই রাস্তার নয়ানজুলি কাটছিল আর ওই হেনরি ফন্ডার মতো ওইয়েস্টার্ন মুভি স্টার হয়ে গেল! তুই কবে প্রিসিলার মতো বাস্তবের কথা ভাববি? আর কবছরের মধ্যে নার্সিং বা বিজনেস বা কিছু একটা পড়তে হবে তোকে...... কেবল আজগুবি গল্প বললে হবে?

নাটালি এসব কথার উত্তর দেয় না। খিদে আর ঘুমের মতো তার গল্প পায়। ইস্কুলের লিটেরেচার দিদিমণিরা আর বাড়িতে মা ছাড়া কেউ ওর গল্প শুনতে চায় না। ও বলতেও চায় না। প্রিসিলা আর এডউইন সারাক্ষণ কটাস কটাস কথা শোনায় গল্প লেখা নিয়ে। কিন্তু নাটালির আজকাল আর এসব নিয়ে দুঃখ হয় না।

সে ঠিক করে নিয়েছে যে যত শিগগির সম্ভব রিটেইলে কাজ নেবে, হয়তো হাইস্কুল শেষ করার আগেই। আর তারপর ধীরে ধীরে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে যাতে সময় সুবিধে হলেই সে ইস্কুলের দিদিমণি হতে পারে।

সন্ধেবেলা অ্যাশলি হেলিকপ্টারের গল্পটা আবার বলল ভেরোনিকাকে। ভেরোনিকা খুব উপভোগ করে শুনলেন। তারপর অ্যাশলি ঘুমোলে, এডউইন বাড়ির ময়লা ফেলতে গেলে পর গল্পটা কতটা সত্যি সেটা জানতে চাইলেন নাটালির কাছে।

নাটালি বলল সত্যি সে কী শুনেছে, কারণ হেলিকপ্টারটা তো দেখতে পায় নি জানলা দিয়ে। ভেরোনিকা সব শুনে বললেন, ভালোই করেছ ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় না গিয়ে। গুলি চলবে বলছিল যখন, তখন ঘরের মধ্যে থাকাই নিরাপদ।

কিন্তু নাটালি দেখল যে মায়ের চোখে ভয়ানক দুশ্চিন্তার মেঘ, সেই যেমনটা সে দেখেছিল এই বাসাতে প্রথম রাত্রে। 

প্রথম রাতে ভেরোনিকা তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন পাড়ার মোড়ে বার্গারের দোকানে, রাতের খাওয়া সারতে। সারাদিন ধরে মালপত্র আনা আর গোছানোর কাজ করে সবাই কাহিল হয়ে পড়েছিল। রাতের খাবার রান্না করার আর শক্তি ছিল না।

আসলে কদিন আগেই থেকেই জিনিসপত্র রাখার কাজ করছিলেন ভেরোনিকা, ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়ে। যেমন তিনি কিছু জিনিস রেখেছেন নাটালিদের দিদিমার বাড়িতে, খানিকটা রেখেছেন মাসি টেরেসার বাড়িতে, আরও খানিকটা রাখা হয়েছে একটা স্টোরেজ ভাড়া নিয়ে সেখানে।

তবুও শেষে কিছু জিনিস বারান্দায় রেখে সেখানে বিচ কিংবা গার্ডেনে বার্বিকিউ করার সময় যে ছাতাটা টাঙানো হতো সেটাকে টাঙিয়ে দিতে হয়েছে। রোদ, জল বৃষ্টি থেকে জিনিসগুলোকে বাঁচানোর জন্য। এডউইন আর নাটালির সাইকেল দুটো ঝুলছে বারান্দার আলসে থেকে।

সব্বাই ভয়ানক ক্লান্ত ছিল সে রাতে। যে দোকানটায় নাটালিরা খেতে গিয়েছিল সে রাতে, সেই দোকানটা বেশ বড়ো আর জনপ্রিয়। তার ওপর সেদিন ছিল শনিবার। লোকজনও অনেক ছিল সেখানে। ফলে খেয়ে ফিরতে একটু দেরিই হয়েছিল। রাত প্রায় নটা তখন।

গাড়ি ঢোকার মূল গেট ইলেকট্রনিক চাবি টিপে খুলতে হয়নি ভেরোনিকাকে। লোহার গেটটা হাট হয়ে খোলাই ছিল। গেট দিয়ে ঢুকে বাঁদিকের চত্বরে, লিজিং আপিসের সামনেটায় দেখা মিলেছিল একটা পুলিশ পেট্রল কারের। মাথার সব আলো জ্বালানো ছিল তার।

গুটি গুটি নিজেদের পার্কিং-এর দিকে এগোতে গিয়ে প্রথম বাঁকের মুখে দেখা গিয়েছিল একটা দাড়িওয়ালা বিশাল লম্বা চওড়া লোক দাঁড়িয়ে সেলফোনে কারসাথে যেন কথা বলে চলেছে, মহাচিন্তিত মুখে, প্রায় ফিসফিস করে। লোকটার মাথার লম্বা চুলে অগুণতি বিনুনি বাধা।

তারপর আরেকটু এগোতে দেখা গিয়েছিল যে বাঁদিকের দোতলা বাড়িগুলো আর তাদের লাগোয়া একতলা স্টোরেজগুলোর ছায়ায় ছায়ায় দৌড়ে এসে আরেকটা লোক সড়সড় করে ডাম্পস্টারে ঢুকে পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে গেল পাশের মোবাইল হোমের পাড়ায়।

আরও একটু এগিয়ে দেখা গিয়েছিল দুটো গাড়ির ফাঁকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা একটা লোককে। লোকটার পাশে একটা প্লাস্টিকের বালতি ছিল। বালতিটা প্রায় উপচে উঠেছিল অনেকগুলো রঙিন টিনের ক্যানে, নানান ব্র্যান্ডের ড্রিঙ্কের ক্যানে আরকি। আরও দুটো গাড়ি পেরিয়ে বোঝা গিয়েছিল যে জনাদুয়েক লোক সেই গাড়িগুলোর চারপাশে গা ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

তারপর আরেকটা বাঁক পেরিয়ে দেখা গিয়েছিল আলো নেভানো অবস্থায় রাস্তার দুপ্রান্তে পার্ক করে রাখা দুটো পুলিশ পেট্রল কার। সে দুটোর মাঝখানের জায়গাটা দিয়ে ভেরোনিকা প্রায় থামানো অবস্থায় নিজের গাড়িটাকে পার করেছিলেন। তখন বাঁদিকের লণ্ড্রিখানা আর অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর ফাঁকে দেখা গিয়েছিল যে এক পুলিশকর্মী একটা কুকুরকে খেলাচ্ছেন। 

সব্বাই চুপচাপ অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিল। ভেরোনিকা চুপ করে বসেছিলেন কৌচে। পাশে বসেছিল অ্যাশলি। স্থাণুবৎ সামনে দাঁড়িয়েছিল এডউইন আর নাটালি।

এমন ঘটনা তারা চোখের সামনে কখনও দেখেনি আগে। ভয় করছিল না, কারণ পুলিশ ছিল প্রচুর। কিন্তু একটু গা ছম ছম করছিল। কেমন সব পড়শীদের মধ্যে এসে পড়লাম রে বাবা! এমনটাই ভাবছিল এডউইন আর নাটালি।

ভেরোনিকা ভাবছিলেন, ছেলেমেয়েদের এ কোথায় নিয়ে এলাম!

অ্যাশলি ভাবছিল, মা আমাকে কখন হট চকোলেট দেবে? আমার যে ঘুম পাচ্ছে খুব!

আসলে এঁরা যখন খেতে বেরোচ্ছিলেন, তখন অ্যান্থনির মা পাড়া মাথায় করে দূর্বোধ্য এক ভাষায় ভয়ানক বকাঝকা করছিলেন ছেলেমেয়েদের কাউকে। এমনটাও নাটালিরা আগে দেখে নি। এ পাড়াটা তাদের জানাশোনার সাথে মেলেই না একদম।

তবুও ক্রমশ সামনের আর পাশের অ্যাপার্টমেন্টের লোকেদের সাথে চেনাশনা হয়েছে। নাটালিদের পাশেই থাকে মেলিসা। সঙ্গে থাকে তার সদ্যজাত বোন আর মা। মাঝে মাঝে মামারা আসেন, দিদিমা আসেন তার। বোধহয় যখন মা কাজে যান তখন।

মেলিসারও পাড়ার কারও সাথে মেশা মানা। ইস্কুলের পরে দুপুরে সে বাড়ি চলে আসে। এডউইন বা নাটালিরা যখন ইস্কুল থেকে ফেরে তখন সে সফ্‌টবল খেলতে যায় মায়ের সাথে। আর কোনোদিন যায় ব্যালে শিখতে। এসব নাটালি জানে কারণ সে মেলিসাকে দেখেছে ইস্কুলের কালচারাল গ্রুপে, যেখানে নাটালি পিয়ানো বাজায়। সেই দলে মেলিসা ব্যালে নাচে। নাচে অবশ্য নিনাও। তবে সে বাস্কেটবল দলের চিয়ার লিডার। 

নাটালিদের বাসার ঠিক নিচেই থাকে এক ভারতীয় পরিবার। সেই পরিবারে পাপ্পু নামে একটা খুব ছোট্টো ছেলে আছে। ছেলেটা অ্যাশলির থেকেও ছোট্টো। অ্যাশলি মাঝে মাঝে ওকে কোলে নিতে চায়। কারণ অ্যাশলি দেখেছে যে ইয়ারা পাপ্পুকে কোলে নিয়ে খেলছে। কিন্তু ভেরোনিকা মানা করেছেন বলে নিতে পারে না।

পাপ্পু তো জেকবের পিঠে আর কাঁধেও চাপে। পাপ্পুর বাবা একটা বায়োলজিকাল রিসার্চ কোম্পানিতে কাজ করেন কম্পিউটারের, যেমন হয় ইন্ডিয়ানরা, কম্পিউটার গাই আর কি। নাটালি দেখেছে যে তাঁর সঙ্গে সবসময় একটা ল্যাপটপ ব্যাগ থাকে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো যে তাঁরা এমন পাড়ায় থাকেন। কম্পিউটার গাই-রা সাধারণত নিরিবিলি সাজানো সুন্দর পাড়াতেই থাকেন। তাই নাটালিদের পাড়ায় পাপ্পুদের থাকাটা নাটালির কাছে বেশ বেখাপ্পা ঠেকে।

ল্যাপটপ ব্যাগ থাকে আরও দুজনের সাথেও। একজন নাটালিদের অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক উল্টোদিকের অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, মানে অ্যান্থনিদের ঠিক উপরে। তাঁর সঙ্গিনী মাঝে মাঝে ছবি তোলেন ক্যামেরা নিয়ে। একদিন তো এডউইন বলেই ফেলল, মা, ভদ্রমহিলা আমাদের ঘরের ভেতরের ছবি তুলছেন।

মা বারান্দার দিকে যেই গেলেন অমনি ভদ্রমহিলা ওয়েভ করলেন আর হাই বললেন। তারপর বললেন, কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখো!

ভেরোনিকা চেষ্টা করলেন দেখার কিন্তু খাপরার চালে তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল। তখন সেই ভদ্রমহিলা ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখালেন ভেরোনিকাকে যে সত্যিই ইয়াব্বড় চাঁদ উঠেছে। কিন্তু ভেরোনিকা ব্লাইন্ডসগুলো টানটান করে টেনে বন্ধ করে দিতে তবে এডউইন শান্ত হলো।

ভেরোনিকা একদিন এও শুনেছিলেন যে পাপ্পুর মা ইংরেজিতেই ছবি তোলা ভদ্রমহিলাকে বলছেন, বাব্বা, কী জায়গা এটা! যেন মনে হচ্ছে মেক্সিকোতে পৌঁছে গেছি। টরেন্সে ছিলাম এর আগে, সেটা তো এর পাশে প্যারিস।

ভেরোনিকা কথাটা ছেলেমেয়েদের থেকে চেপে রাখতে পারেন নি। পুরো কথোপকথনের পাত্রপাত্রী আর বিষয়বস্তুতে তাঁর প্রচুর হাসি পেয়েছিল। তিনি ইউনিভার্সিটিতে একটা ছবির প্রদর্শনী দেখেছিলেন। তাতে ভারতের যমুনা নদীর ছবিও ছিল। প্রদর্শনীর বিষয়বস্ত যেহেতু ছিল নাগরিক দূষণ, সেহেতু যমুনার ছবিতে কোনো বহতা নদী দেখা যায় নি, বরং, পাঁকে ভরা, কচুরিপানা ভর্তি একটা জলা দেখা যাচ্ছিল। তাই প্যারিস, টরেন্স, মেক্সিকো ইত্যাদি তুলনায় তিনি মজা পেয়েছিলেন বেশ।

ল্যাপটপ ব্যাগ থাকে ম্যাথিউ-এর সাথেও। ম্যাথিউ থাকে মেলিসাদের অ্যাপার্টমেন্টের নিচের অ্যাপার্টমেন্টে। ম্যাথিউ-এর সঙ্গে থাকে ড্যানিয়েল, ম্যাথিউ-এর স্ত্রী। ড্যানিয়েল নার্স। দুজনেই এসেছে হাউটন, ইলিনয় থেকে।

খুব ধবধবে ফর্সা দুজনেই। ম্যাথিউ রোগা-পাতলা, সাইকেল চেপে আপিস যায়। আর রোজ বিকেলে আর্মব্যান্ডে ফোন লাগিয়ে, কানে হেডফোন গুঁজে দৌড়োতে যায়, যায় ছুটির দিনে সকালেও।

ড্যানিয়েল গোল-গাল। গাড়ি চেপে আপিস যায়। দিনে-রাতে ডিউটির ফাঁকে-ফোকরে ঘুমোয়।

এডউইন প্রিসিলাকে দেখলেই বলে, তোকেও ড্যানিয়েলের মতো দেখতে হয়ে যাবে।

প্রিসিলাও খুব তর্ক করে, মোটেই না। কাজ যতই সময়-অসময়ের হোক না কেনো আমি আমার ডিসিপ্লিন কখনও ভাঙতে দেব না। দেখে নিস।

ভেরোনিকা থামান দুজনকে, দুজনের কেউই কাজ করো না এখন। কাজ করো, তারপর বলবে এসব কথা।


~~~~~~~~~~~~
Read at your own pace. On Browser the whole book FREE OF COST from this link. সম্পূর্ণ বই নিজের গতিতে পড়ার জন্য ইন্টারনেট ব্রাউজারে বিনামূল্যে এই লিঙ্ক থেকে : https://read.bookfunnel.com/read/9cq7a4tl7h
Read at your own pace. On Browser or Download the whole book FREE OF COST from this link. সম্পূর্ণ বই নিজের গতিতে পড়ার জন্য ইন্টারনেট ব্রাউজারে বা ডাউনলোড করে নেওয়া যাবে বিনামূল্যে এই লিঙ্ক থেকে : https://dl.bookfunnel.com/9cq7a4tl7h
~~~~~~~~~~~~~
Link to Previous Post আগের পোস্ট: https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/12/chapter-2.html
Link to Following Post পরের পোস্ট: https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/12/chapter-4.html

No comments:

Post a Comment

Readers Loved