Tuesday, December 10, 2024

Chapter 6 - নতুন দিনকাল

 


গরমের ছুটির পর ইস্কুল শুরু হয়েছে সবে। নতুন ক্লাস, নতুন বই খাতা, নতুন শিক্ষক, নতুন সহপাঠী সবকিছুর মধ্যে নতুন করে শুরু করার আমেজটা আবার আঁকড়ে ধরেছে হেক্টরকে। নতুন সবকিছুর মধ্যে সব থেকে বেশি নাড়া দিচ্ছে তাকে তার নতুন জনপ্রিয়তা। 

সে বরাবরই কম কথা বলত। তার ওপর নতুন দেশে লুকিয়ে আসার ব্যাপারটা তাকে এমন গিলে খেয়েছে, যে সে অনেক সময় নিজের থেকেও লুকিয়ে বেড়ায়। কারোর সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে বাধে তার। লজ্জা, সঙ্কোচ আর ভয়ের ঘেরাটোপে সে যেন আটকা পড়ে থাকে।

শুধু পায়ে বল পেলে সে সব ঘেরাও ভেঙে অন্য মানুষ হয়ে ওঠে। তার খেলা দেখে ইস্কুলের কোচেরা তাকে ইস্কুলের দলে জায়গা দিয়েছিলেন। তাকে বরাবর ভালো খেলায় উৎসাহিত করে চলেছেন। তাকে ইস্কুলের কোচ এবং প্রিন্সিপ্যাল বুঝিয়েছেন যে ভালো খেলার জোরেই সে কলেজে পড়ার স্কলারশিপ পেতে পারে। কারণ এখনও ইউনাইটেড স্টেটস্‌ সকারে ভীষণ দূর্বল। প্রতি বছর কলেজগুলো সকার স্কলারশিপ দিয়ে ইউরোপের নানান দেশ থেকে সকার খেলোয়ার আমদানি করে যাতে কলেজের সকার টিম জবরদস্ত হয়। ক্রমে জাতীয় সকার টিম পোক্ত হয়ে উঠবে এই আশায়।

হেক্টরের এতো কথা মনে থাকে না। সে শুধু টের পায় যে পায়ে বল পড়লে তার সব বাধা খুলে যায়। মাঠটা তার কাছে খোলা আকাশের মতো অনন্ত সম্ভাবনার আশা হয়ে দাঁড়ায়। সে আশা করে না যে অনেক কিছু ঘটবে। কিন্তু পায়ের নিচে মাঠ, গায়ে জার্সি আর বলের ওপর তার দখল তাকে জাদুকর করে তোলে। জাদু সে নিজে টের পায় না। কিন্তু সে টের পায় বলের পিছে আর বল পায়ে নিয়ে দৌড়োনোর আনন্দ। তার সকার দলের সমর্থকদের সাড়া পেলে সে একটা তৃপ্তিও টের পায়।

সকার মাঠের জাদু তাকে ইস্কুলের সকার দলের ক্যাপ্টেন করে দিয়েছে। এখন সারা ইস্কুল তার নাম জানে। তার চেহারা চেনে। প্রায় সব্বাই তার বন্ধু হতে চায়। সে সবাইকে সলজ্জ বিনয়ে সাড়া দেয়। কিন্তু বন্ধু হতে পারে না কারোরই। 

সেকথা তার সহপাঠীরা টের পায় না। বরং তাকে সবাই বেশ সম্মান করে। তাতে তার বিশেষ অহঙ্কার কিছু হয় না। কিন্তু তার জন্মদিনে সবাই মিলে যখন পার্টি দিল তখন সে সত্যিই অভিভুত হয়ে গেল।

সে বন্ধু হওয়ার চেষ্টা শুরু করল। সবাই তাকে বন্ধু করে নিয়েছে বলে কৃতজ্ঞতায়। আর  বন্ধুত্বের টানে। তার ভালো লেগে গেল মিসেলকে, এডউইনকেও।

প্রথমে হেক্টর জানত না যে দুজনেই তাদের অ্যাপার্টমেন্ট পাড়ায় থাকে। সে তো ইস্কুল ফেরতা হয় মাঠে ট্রেনিং-এ যায় নয় তো যায় মামার সাথে, কাজে হাত লাগায়। কখনও কখনও মামা বাড়িতে পৌঁছে কাজ দেন যে জড়ো করে রাখা জঞ্জালগুলো বেছে বস্তায় পুরে তৈরি রাখতে। 

খনির কাজে ছুটির দিনে মামা সেসব বস্তা গাড়িতে বোঝাই করে নিয়ে বিক্রি করে আসবেন রদ্দিওয়ালার কাছে। এমনিতে দুই পরিবারের জল আর কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল মিলিয়েই প্রায় তিরিশ ডলারের মতো প্লাস্টিক জড়ো হয়। তা বাদে আছে কাচের বোতল, ডাকে আসা বিজনেস মেল থেকে জড়ো হওয়া কাগজ আর বেশ কিছু খাবার আর পানীয়ের টিন।

তারওপর খনিতে ছুটির দিনে কার্লোস কনুই ঢাকা গ্লোভস পরে, লোহার আঁকশি দিয়ে খুঁচিয়ে তোলেন পাড়ার সমস্ত ডাম্পস্টারের যত প্লাস্টিক বোতল, টিন, আর কাঁচ। জড়ো করেন ফ্রি খবরের কাগজ, বিজ্ঞাপনের কাগজও। রাস্তার পাশের টিনের বাক্স থেকে তুলে নেন বিনামূল্যের বিজ্ঞাপণের কাগজ অ্যাপার্টমেন্ট ফাইন্ডার আর বিনামূল্যের খবরের কাগজ ফুটহিলস্‌ ক্রনিক্ল। গ্রসারি আর লাইব্রেরি থেকেও জড়ো করা যায় কাগজগুলো।

জড়ো করার কাজে সাধারণত কার্লোস একলা যান বলে কাগজ, প্লাস্টিক, কাঁচ আর টিন মিশে থাকে। হেক্টর আর অ্যান্থনি সেগুলোকে আলাদা করে করে গুছিয়ে রাখে। একটা বস্তায় কাঁচ, আরেকটায় টিন, আরেকটায় কাগজ তো আরেকটায় প্লাস্টিক। কাগজের আর প্লাস্টিকের বস্তা সংখ্যায় একের বেশিই হয়।

তাছাড়াও হেক্টর মারিয়াকে সাহায্য করে ঘরের কাজে, লন্ড্রি করতে। 

নতুন বন্ধুদের সাথে মিশতে মিশতে তার মনের লুকিয়ে থাকা কথাগুলো, সেই কথাগুলোর ভেতরের টনটনে ব্যাথাটা যেন কোথায় লুকিয়ে পড়ল। ভাইবোন আর মাকে দেখলে তার বুক ঠেলে আর দীর্ঘশ্বাস ওঠে না। গলির ফুটবলের মধ্যে তার সোনোরায় কাটানো ফেলে আসা ছেলেবেলাটা মাঝে মাঝে ফিরে আসে। মিসেলের মনোযোগটা তাকে আলাদা ভালো লাগা দেয়।

যদিও তার বাবা আর আসতে পারবেন কিনা তাদের পরিবারে সে কথা হেক্টর জানে না। মা আর ভাইবোনেরা কতোটা বোঝে পরিস্থিতিটা তাও সে জানে না। মেহিকোতে বাবার নিরাপত্তার কথা ভেবে মাঝে মাঝে তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। সামনের দিনগুলোর অতল অনিশ্চয়তার দিকে তাকালে তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।

হেক্টর জানে যে মিসেল তাকে পছন্দ করে তার ফুটবলের জন্য। তার পরিবারের গোপণ সত্যের কথা জানলে মিসেল কী করবে সে কথা হেক্টর জানে না। সে নিশ্চিত নয় যে বাবার অনুপস্থিতে মা আর ভাইবোনেদের প্রতি তার যে দায়িত্ব সেটা মিসেলকে বুঝিয়ে বলা যায় কিনা।

 ইস্কুলের আর মেয়েরা হেক্টরের নাগাল পায় না ইস্কুলের বাইরে ঘন্টাগুলোতে। অথচ একই পাড়ায় থাকার কারণে সন্ধের খানিকটা সময় হেক্টরের কাছাকাছি থেকে মিসেল জেনে ফেলেছে হেক্টরের অনেক কথা যা আর কেউ জানে না। সেসব মিসেল যখন ইস্কুলে গিয়ে বাকি মেয়েদের বলে তখন বাকি মেয়েদের চোখ সত্যি সত্যিই হিংসেতে সবুজ হয়ে যায়।

মেয়েদের চোখের সবুজ রং দেখে হেক্টরের ভীষণ হাসি পায়। সে বুঝতে পারে যে অনেকেই তার সাথে বন্ধুত্ব চায়।  কিন্তু মিসেল ছাড়া আর কেউই হেক্টরের পাড়াতে থাকে না, তাই হেক্টরের সাথে ইস্কুলের পরেও সময় কাটাতে পারে না। সেই জন্য অনেকেই  মিসেলকে হিংসে করে।

সেই হিংসের আঁচটা মিসেল বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। সে কথাও হেক্টর টের পায়। সে আরও বুঝতে পারে মিসেলের এই মেশামেশি লোকদেখানো, গয়নার মতো, নিজের অহঙ্কারকে ফাঁপানোর জন্য। হেক্টরের প্রতি সম্মান, সমীহ তেমন নেই তাতে, ভালোবাসা তো নেই-ই। তবু মিসেল মিষ্টি হেসে কথা বললে হেক্টর এড়িয়ে যেতে পারে না।

মিসেলের উচ্ছসিত স্বভাবটা মুগ্ধ করেছে এডউইনকেও। এডউইনের মনে দুঃখ আছে, বাবার জেলে যাওয়া নিয়ে। এডউইনের দুঃখ আছে তাদের সাজানো সুন্দর বাড়ি ছেড়ে, পাড়া ছেড়ে, এই নোংরা পাড়ার আরশোলা ভর্তি বাসাতে এসে বসবাস করার জন্য। সে দুঃখের কথা কাউকে বলা যায় না। এডউইন আশা করে যে একদিন তার সব দুঃখের কথা হয়তো মিসেলকে বলা যাবে।

যে সময়টা মিসেল এডউইনের সাথে কাটায়, একান্ত ঘনিষ্টতায় তখন এডউইনের দুঃখটা মনের গহীনে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তাই এডউইন আজকাল চুলে স্পাইক বানানোর চেষ্টায় একটা ঝুঁটি বেঁধে রাখে। তাকে যেন ক্লাসের বাকি কুউল ছেলেদের মতোই দেখতে লাগে সেই চেষ্টায়।

মিসেল তার সাথে মেশে কেন সে জানে না। সে আন্দাজ করে যে ক্লাসের বাকি সবাই নার্ডি বলে তাকে এড়িয়ে যায় বলে মিসেল বোধ হয় এডউইনের জন্য কষ্ট পায়। মিসেল হয়তো আর সবার থেকে অনেক বেশি সংবেদনশীল।

শুরুতে এডউইনও ক্লাসের কারোর সাথে বিশেষ মিশত না। পড়াশোনাতে ডুবে থাকত। আর অবসরে লাইব্রেরিতে বসত কিংবা কোনো দিদিমণি বা মাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে পড়া বুঝে নিত।

 মিসেলই নিজের থেকে এগিয়ে এসে ইস্কুল বাসে এডউইনের পাশে বসে। নিজের থেকে এগিয়ে এসে কথা বলে এডউইনের সাথে। এমনকি ইস্কুলের বাইরে, অ্যাপার্টমেন্ট পাড়াতেও মিসেল এডউইনকে এড়িয়ে না গিয়ে তার সাথে কথা বলতে শুরু করে। এসবের থেকেই এডউইন মিসেলের বন্ধুত্বে ভরসা পেতে শুরু করে।

মিসেলের কাছে নিজেকে আরেকটু আর পাঁচজনের মতোই ফান লাভিং দেখাতে টিফিনের পয়সা জমিয়ে এডউইন কিনে ফেলেছে একটা পুরোনো রং চটা স্কেটবোর্ড। সে আবার স্কেটবোর্ড চড়ছে জুনিয়র স্কুলের দিনগুলোর মতো।

তাদের ক্লাসের অন্য অনেক ছেলেমেয়েরা তার সাথে কথা বলতে শুরু করে তারপর থেকে। তারাই জানায় যে ক্লাসের অনেকেই মিসেলের সাথে একান্তে গল্প করতে চায়, মিসেলের ঘনিষ্ঠ হতে চায়, কিন্তু মিসেল শুধু হেক্টরের কথা ভাবে।

এডউইনের কাছে এটা খবর। খবরটাতে এডউইন চমকে যায়। মিসেল তো তাকে বলেছে, হেক্টরের সাথে আমার শুধুই বন্ধুত্ব। সেটাকেই বাকি সব্বাই হিংসে করে। কারণ হেক্টরও খুব সহজে কারুর সাথে মেশে না তো!

মিসেলের সাথে মেশার পরে থেকেই এডউইনেরও বন্ধুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কারণটা সে স্পষ্ট করে জানে না। সে মনে করে যে তার কুউল অভ্‌তারের প্রচুর ভক্ত। নতুন বন্ধুদের মধ্যেই সে কানাকানি শোনে যে তার মতো ইউনাইটেড স্টেটস নাগরিকের ঘনিষ্ঠ হতে কে না চায়!

এতে এডউইন বিরক্ত হয়ে যায়। কথাটা সে মিসেলকে বলায় মিসেল বলে, আমার চাওয়ায় তেমন তরবেতর নেই। আমি তোমাকে আমার বার্থ সার্টিফিকেটও দেখাতে পারি যে আমিও এদেশেরই নাগরিক। কিন্তু ভালোবাসায় এসব খটকা আসছে কেন?

এডউইন টের পেল যে ভালোলাগার মধ্যে এসব জাগতিক হিসেবনিকেশ এসে পড়ায় বেশ রেগে গেছে মিসেল। সে কিছুদিন কথা বলাও বন্ধ করে দিল এডউইনের সাথে। এমনকি এডউইনকে এড়িয়েও যেতে লাগল।

এডউইন এই সমস্তটাক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে ভাবতে লাগল যে কি করে আবার মিসেলকে কাছে পাবে। আর হাসিতে, কথায়, আঙুলের, চুলের হালকা ছোঁয়ায় কেটে যাবে অনেকটা সময় হু-উ-শ করে।

অনেকদিন ধরে মিসেলের সাথে কথা না বলার ব্যাকুলতায় এডউইনের মনে একটা আকুল ব্যাথা তার প্রত্যেক রোমকূপ দিয়ে একটা অস্থির উন্মাদনা হয়ে ফেটে বেরোতে চায় একেকটা সন্ধ্যায়। এইসব সন্ধ্যায় মিসেলকে দেখতে পাওয়ার একটা অদম্য খেপাটে ইচ্ছে নিয়ে এডউইন স্কেটবোর্ডে চেপে ঘুরে বেড়াতে থাকে অ্যাপার্টমেন্ট পাড়ার গলিতে গলিতে, পার্কিং-এ।

এরকমই একটা সন্ধেবেলায় মিসেল কাদের সাথে যেন লুকোচুরি খেলছিল পার্কিং-এ। তাই অবশেষে দুজনে মুখোমুখি হয়ে গেল। আর হাই, হেলো, আঙুলের হালকা ছোঁওয়া, পেরিয়ে ভেসে গেল সব অভিমান।

~~~~~~~~~~~~~

Read at your own pace. On Browser the whole book FREE OF COST from this link. সম্পূর্ণ বই নিজের গতিতে পড়ার জন্য ইন্টারনেট ব্রাউজারে বিনামূল্যে এই লিঙ্ক থেকে : https://read.bookfunnel.com/read/9cq7a4tl7h
Read at your own pace. On Browser or Download the whole book FREE OF COST from this link. সম্পূর্ণ বই নিজের গতিতে পড়ার জন্য ইন্টারনেট ব্রাউজারে বা ডাউনলোড করে নেওয়া যাবে বিনামূল্যে এই লিঙ্ক থেকে : https://dl.bookfunnel.com/9cq7a4tl7h
~~~~~~~~~~~~~
Link to Previous Post আগের পোস্ট: https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/12/chapter-5.html
Link to Following Post পরের পোস্ট: https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/12/chapter-7.html

No comments:

Post a Comment

Readers Loved