৩৪. পিতা
শিন ছিকে দেখে ইস্তক ঝৌ রু জি টের পেয়ে ছিলো যে মিন হুয়ের সাথে শিন ছির কিছু একটা আছে।
শুরুতেই ওর চোখে পড়ে ছিলো বাপ-ব্যাটার চেহারার মিলটা। তাতে মনের মধ্যে উজিয়ে ওঠা বিরক্তিটা কিছুতেই এড়াতে পারে নি ঝৌ রু জি। কথায় বলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিছুই গোপণ থাকে না। বিয়ের চার বছর পরেও মিন হুয়ে কিছুতেই বলে নি ঝৌ রু জিকে ওর ছেলের জনকটি কে। ঝৌ রু জি কথা রেখে ছিলো, কোনো দিন জিজ্ঞেস করে নি সু ছনের বাবার পরিচয়। ঝৌ রু জির পছন্দটাই আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর রহস্যময়ীরা। ইয়াও ঝি ঝুয়ের প্রতি ওর আকর্ষণও ইয়াও ঝি ঝুয়ের আত্মবিশ্বাস আর রহস্যময়তার জন্য। কিন্তু মিন হুয়ের সঙ্গেও ঝৌ রু জি অনেক দিন কাটিয়েছে, সু ছনের প্রতি বাবার কর্তব্য করেছে আন্তরিকতার সাথে, গুরুত্ব দিয়ে। মিন হুয়ে কখনো কিচ্ছু বলে নি। এর থেকে ঝৌ রু জির মনে হয়েছে সু ছনের জন্মদাতার পরিচয়টা একটা টিক টিক করতে থাকা টাইম বোম আর কোনো না কোনো সময়ে সেই জন্মদাতা এসে উপস্থিত হবে আর আত্মীয়তা স্বীকার করবে। এর থেকে একটা কথাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে যদিও দুজনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, তবুও সব কথা দুজনে দুজনকে বলতে পারে সম্পর্কটা এতো অবাধও নয়। যাই হোক, সম্পর্কটা তো আর তীব্র আবেগতাড়িত প্রেমের নয়, দুজনকার মধ্যে একটা কিছু ছিলো যেনো।
অপ্রত্যাশিতভাবে দুজনে বিয়ে ভেঙে ফেলে দুজনের মধ্যেকার এই যোগাযোগের অভাবের সমস্যাটা সমাধান হবার আগেই। ঝৌ রু জি সু ছনকে খুবই ভালোবাসে, ওকে নিজের ছেলেই মনে করে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত, ও চলে যায় আর ছেলেটার সাথে যোগাযোগ ক্রমে ক্রমে কমে আসতে থাকে। আর বাচ্চার তো তেমন স্পষ্ট স্মৃতি কিছু নেই। যদি এই অসুস্থতার ঘটনাটা না ঘটতো, তাহলে ঝৌ রু জি মিন হুয়ের সংসারের শুরুর ইতিহাস থেকে নিজেকে প্রায় সম্পূর্ণ সরিয়েই নিয়েছে।
তাই ঝৌ রু জির মনে হলো বাচ্চাটার জন্মদাতা যখন ফিরে এসেছে, তখন সেই বাবা আর মিন হুয়ে নিশ্চয়ই আবার একসাথে জীবন শুরু করবে। তাই ঝৌ রু জি খানিকটা বাড়তিই এই অবস্থায়। তাই হেসে ও উত্তর দিলো মনে মনে, “এক নম্বর বাবার সাথে।”
যখন মিন হুয়ের কানে গেলো সু ছনের প্রশ্নটা তখন ও মনে মনে ভাবলো যে ঝৌ রু জির বাড়িতে এখনো একজন রুগী আছে। কিছু দিন হলো ইয়াও ঝি ঝুয়ের অবস্থার ওঠা পড়া চলছে বেয়াড়া রকমের।
হঠাতই সব নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। ওয়ার্ডের ভেতরটা এতোই চুপচাপ যে মাথার ওপরের ফ্লুওরোসেন্ট আলোর মধ্যেকার বিদ্যুৎ ক্ষরণের শব্দ যেনো শুনতে পাওয়া যাবে।
সু ছনের প্রশ্নের উত্তর কেউ দিলো না।
মিন হুয়ে ভেবে চলেছে। এখন শিন ছি জানে যে ওর একটা ছেলে আছে। সুতরাং, ও নিশ্চয়ই ছেলের সাথে থাকতে চাইবে। কিন্তু সু ছন নিতান্ত শিশু এখনো। ওকে এখনো ওর মায়ের সাথেই থাকতে হবে। খুব বেশি হলে ও শিন ছিকে ছেলের কাছে আসতে, ছেলের সাথে দেখা করতে দেবে। অথবা, মাঝেমধ্যে সু ছনকে নিয়ে বেড়াতে যেতে দেবে, বা দু-এক দিন কাছে রাখতে দেবে, এমন কি কয়েক দিনের জন্য সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যেতেও দেবে। মিন হুয়ে মোটেও চায় না যে ছেলের প্রতি স্নেহ তার একচেটে হোক। কিন্তু ও তো এখনো জানে না শিন ছির এখনকার পরিস্থিতি কী।
শিন ছি যদি বিয়ে করে থাকে, যদি ওর বাচ্চা হয়ে থাকে, তাহলে শিন ছির সঙ্গে থাকতে খুব বেশি অসুবিধে হবে সু ছনের। সু ছনকে মানিয়ে নিতে হবে শিন ছির বউ আর বাচ্চাদের সাথে। ব্যাপারটা একটা তিন বছরের ছেলের মনের পক্ষে একটু বাড়াবাড়ি রকম চাপের কারণ হয়ে যাবে। ভারী হয়ে যাবে।
শিন ছির দিকে এক ঝলক না তাকিয়ে পারলো না মিন হুয়ে। দেখলো শিন ছি মন দিয় দেখে চলেছে সু ছনকে, যেনো একটা জগদ্বিখ্যাত আঁকা ছবির প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করে চলেছে, সু ছনও ওকে দেখে চলেছে, পর্যবেক্ষণ করে চলেছে কৌতুহল নিয়ে।
মিন হুয়ে না ভেবে পারলো না যে দুজনে দুজনকে এমন করে দেখছে যেনো একটাই মানুষ আয়নাতে নিজের ছায়া দেখছে।
জামার ধরন আর মাথার চুলের কায়দা ছাড়া শিন ছি বিশেষ বদলায় নি। ও প্রায় একই রকম আছে, যেমন ওকে শেষবার মিন হুয়ে দেখে ছিলো। হতে পারে স্যুট আর টাই-এর প্রভাব কিংবা চেহারা আরো মজবুত হয়েছে। কারণ ও যখন মিন হুয়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওর পিঠটাকে মিন হুয়ের মনে হচ্ছে যেনো একটা পাহাড়।
মিন হুয়ের মনে পড়ে যাচ্ছিলো সেই সময়টুকুর কথা, যে সময়টা ওরা একসাথে কাটিয়েছে। কী খুশি, কী মিষ্টি, কী মনের মিল, কি গভীর বোঝাপড়া যে একটাও কথা বলার দরকার হতো না - সু তিয়াঁ না থাকলে, দুজনের জুটি কী মানানসই যে হতো! কী মনে, কী শরীরে।
ও শিন ছির সেরা দিকটাও দেখেছে, ও শিন ছির জঘন্য দিকটাও দেখেছে।
যাই হোক, দোষটা ওরই। যাই হোক, এ সবই ওর নিজের জন্য হয়েছে, ও সু তিয়াঁ হবার ভান করছিলো তাই।
শিন ছির রূপ উপভোগ করার অধিকার ওর নেই।
ওর এতো দিনে মনে হলো যে ও শিন ছির সন্তানকে রেখে ভুল করেছে, বিশেষত শিন ছি যা বললো সেটা শোনার পরে। কেনো ও কখনো কথাটা ভাবে নি? যে মূহুর্তে ও জানতে পেরেছে যে ও অন্তঃস্বত্তা, ওর মন প্রাণ আনন্দে ভরে উঠে ছিলো, এই জন্য নয় যে বাচ্চাটাকে দিয়ে ও শিন ছিকে বেধে ফেলতে পারবে এবারে, বরং এই কথা ভেবে যে শেষ অবধি সু তিয়াঁ, শিন ছি আর ওর মধ্যে একটা রক্তমাংসের যোগাযোগ তৈরি হলো। এই বাচ্চার জন্ম মিন হুয়ে দিয়েছে সু তিয়াঁ আর শিন ছির জন্য। এই বাচ্চা ওদের প্রেমের পরিণতি আর সু তিয়াঁর জীবনের বহমানতা।
“মা, এক নম্বর বাবা, ফিরে এসেছে। ও কী আমাদের সাথে রোজ থাকবে এখন?”
সু ছন আবার জানতে চাইলো। মুখের ভাবখানা দেখে মনে হয় যে ওর আশঙ্কা এক নম্বর বাবা বুঝি আবার পালিয়ে যাবে।
মিন হুয়ে এক মূহুর্তের জন্য অবাক না হয়ে পারলো না। এই বাচ্চা কী একটা বাবার জন্য এতোই মরিয়া যে যে কেউ হলেই চলবে?
ঝৌ রু জি চলে যাবার পরে, খালি বাড়িটা যেনো খাঁ খাঁ করতো। কাজের পরে মিন হুয়ের মোটেই সময় থাকে না সু ছনের সাথে খেলার। কারণ কাজটাই বড্ডো বেশি, সে জন্য ল্যাপটপ নিয়ে মেঝেতে কার্পেটের ওপরে বসে সু ছনের সাথে লেগো নিয়ে খেলতে পারে কোড লেখার ফাঁকে ফাঁকে। মিন হুয়ে একটাও কথা না বলে ছেলেকে ওর অবস্থাটা ভালোই বুঝিয়ে ছিলো। সু ছন জেনে গিয়ে ছিলো যে মিন হুয়ের পুরো মন খেলায় নেই। সেই জন্য ও নিজেই খেলতো, নিজেই টিভি দেখতো, আর ওর স্বভাবটা আরো যেনো চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিলো।
এক দিক দিয়ে মিন হুয়ের মনে হতো যে বাচ্চাটা যেনো বড্ডো বাধ্য আর বয়স অনুপাতে ভীষণ বিবেচক। অন্য দিকে ওর মনে হতো যে ছেলেকে ও যথেষ্ট যত্ন করছে না। যাই হোক, কাজ না করলে কোনো রোজগার থাকবে না। আর মিন হুয়ে হলো সেই ধরনের মানুষ যারা কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখতে শুরু করলেই তুরীয় আনন্দের আবেশে চলে যায়। অনেক সময়েই কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখার সময়ে ও খেতে ভুলে যায়, ওর খাবার কথা মনেই পড়ে না যতক্ষণ না সু ছনের খিদে পায়। পনেরো মিনিট, খাবার অর্ডার করে বাড়িতে দিয়ে যাবার জন্য, মা ছেলের জীবনে কোনো ছন্দ নেই, যেনো ওরা একটা যুদ্ধ লড়ছে।
এটাও আরেকটা কারণ যে জন্য সু ছন তার জীবনে ঝৌ রু জির অভাব বোধ করে। ঝৌ রু জি খাবার ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। ঝৌ রু জি যদি বাড়িতে থাকে, তাহলে দিনের তিনটে খাবার এবং ঝোল হবেই রোজ। তিন দিনের মধ্যে একই মাংস আর একই সব্জি খাওয়া হবে না। একে নাকি বলে “কম্প্রিহেনসিভ নিউট্রিসন”। ঝৌ রু জি সঙ্গে থাকলে জীবন খুব নিয়ম মেনে চলে, কারণ ঝৌ রু জি খুব আলাদা মিন হুয়ের থেকে। ঝৌ রু জি কিছুতেই কাজের কথা ভাববে না একবার অপেরেসন থিয়েটার ছেড়ে বেরিয়ে গেলে। সেই জন্যই যতোক্ষণ বাড়িতে থাকবে, ঝৌ রু জি ততোক্ষণ একটা সত্যিকারের ঘরোয়া পারিবারিক জীবন যাপণ করবে। তাই ও যখন সু ছনের সঙ্গে থাকে তখন ও আসলে সু ছনের সঙ্গে খেলাই করে। মিন হুয়ের মতো নয়। মিন হুয়ে তো চান করতে করতেও কোড লেখার কথা ভাবে।
পুরুষ মানুষের খিদে বেশি। সব্জি কেনার দু-তিনদিনের মধ্যে সব সব্জি খেয়ে শেষ করে দিতে পারে তারা। সেই জন্য তারা বার বার বাজারে যায় আর বার বার সব্জি কেনে।
ঝৌ রু জি চলে যাবার পরে, মিন হুয়ে সব্জি কেনা বন্ধ করে নি। সেগুলো হপ্তা পেরিয়েও খেয়ে শেষ করা যায় নি। সেগুলো ফ্রিজের মধ্যেই পচে গিয়ে ছিলো। ফ্রিজারের মধ্য প্রচুর কাচা মাংস ছিলো। সেগুলো ঠিক সময়ে বার করে গলতে দিতে পারে নি মিন হুয়ে, তাই ওর ইচ্ছে থাকলেও ঐ মাংস ওর আর রান্না করে খাওয়া হয় নি।
মিন হুয়ের ব্যস্ততম দিনগুলোতে মিন হুয়ে ভেবে ছিলো বেবিসিটার রাখবে সু ছনের জন্য। বছর খানেক বয়স হতে সু ছনের, মিন হুয়ে রেখেও ছিলো বেবিসিটার, কিন্তু তারা বেশি দিন টেকে নি। পরে ইন্টারনেট ভর্তি ন্যানির হাতে বাচ্চার নিগ্রহের খবর পড়ে পড়ে ভয় পেয়ে মিন হুয়ে ন্যানি বা বেবিসিটার রাখার কথাটাই চিন্তা থেকে সরিয়ে দিয়ে ছিলো।
যাদের উত্তর পাবার জন্য ভীষণ তাগিদ আছে তারাই এক প্রশ্ন বার বার করে। মিন হুয়ে একটা অস্পষ্ট উত্তর দেবার চেষ্টা করলো, “বাবা থেকে থেকেই কাজের জন্য বাইরে যান তো, তাই তোমার সাথে রোজ হয়তো থাকতে পারবেন না। কিন্তু বাবা আর মা ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চয়ই কথা বলে নেবে। এখন ভালো হও তো। ঘুমোনোর সময় হয়ে গেছে, দাঁত মাজতে হবে, বাথরুমে যেতে হবে।”
মিন হুয়ে উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে খাটের দিকে যাচ্ছে, শিন ছি ওকে থামালো, “আমাকে করতে দে।”
“খেয়াল রাখিস, যেমন -” মিন হুয়ে সতর্ক করে দিতে চাইলো শিন ছিকে।
শিন ছি খানিকটা অবজ্ঞা ঢেলে বলে উঠলো, “আমি জানি থোরাকোটমি কী জিনিস, আমার নিজের দু বার হয়েছে তো।”
কোনো উপায় নেই দেখে মিন হুয়ে মুখ বন্ধ করে রাখলো।
অপেরেসন যেহেতু সফল, সেহেতু অপেরেসনের পরে সু ছনের বিশেষ কোনো অসুবিধে হয় নি। তাই ডাক্তারও ওকে বলেছেন যে বিছানা ছেড়ে নামতে আর হালকা চলা ফেরা করতে।
এতে পাকস্থলীতে খাবার পৌঁছোনোর পেরিস্টোলিসিস প্রক্রিয়াটা সহজ হবে। তাছাড়া এতে শ্বাসপ্রক্রিয়াতে সমস্যা দেখা দেবার সম্ভাবনাও এড়ানো যাবে।
শিন ছি খুব আলতো হাতে সু ছনকে বিছানা ছেড়ে নামতে সাহায্য করলো। সজাগ রইলো যাতে ওর বুকের হাড়ে হাত না লাগে। ওকে এক হাতে নিলো, অন্য হাতে নিলো দাঁত মাজা ব্রাশ আর তোয়ালে। আস্তে আস্তে হেঁটে গেলো বাথরুমে। বাথরুম অবশ্য ওয়ার্ডের দরজা থেকে খুব দূরে নয়।
মিন হুয়ে শুনতে পাচ্ছিলো বাবা আর ছেলের কথাবার্তা চলছে। শুধু দুজনের গলার স্বর। ঠিক কী কথা বলছে ওরা দুজনে তা শোনা যাচ্ছে না যদিও।
মুখ পরিষ্কার করে ধোবার পরে, শিন ছি ধীরে ধীরে সু ছনকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো ওয়ার্ডে। শুইয়ে দিলো বিছানাতে।
হয়তো সু ছনের মনে হচ্ছিলো যে ওর নিজের বাবা যেনো কমিকস্ বইয়ের নায়ক - লম্বা, সুদর্শন, কেতাদুরস্ত - সু ছন হাসি মুখে তাকালো শিন ছির দিকে, তারপর টেবিল থেকে হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন্সের ফেয়ারি টেল বইটা নিয়ে শিন ছির হাতে গুঁজে দিয়ে বললো, “বাবা, পড়ো।”
শিন ছি শান্তভাবে বইটা নিলো, পাতা উল্টোতে শুরু করলো। বললো, “বাবাও এই বইটা খুব পছন্দ করতো ছোটোবেলায়। কোন গল্পটা তোমার সব চেয়ে বেশি প্রিয়?”
“দ্য ডটার অফ দ্য সি।”
“বেশ, তাই তো, ওটা আমারও খুব ভালো লাগে।” শিন ছি নিজের হাতের পাঁচ আঙুল ছড়িয়ে বললো, “হাই ফাইভ।”
সু ছন জানে না মানেটা কী। শিন ছি নিজের হাতের তালুতে সু ছনের পাঁচ আঙুল ছোঁয়ালো আর উঁচু করে ধরে চাপড়ে দিলো।
“হাই ফাইভ!” বলে খিল খিল করে হেসে উঠলো সু ছন।
মিন হুয়ে অবাক হয়ে দুজনকে দেখলো। আশাই করে নি কখনো যে বাবা আর ছেলে এতো স্বাবাভিকভাবে গল্প করতে শুরু করবে।
শিন ছি চেয়ারটা সরিয়ে নিলো, বসলো সু ছনের পাশে। বইটা ধরে পড়তে শুরু করলো, “সমুদ্রের গভীরে জল গাঢ় নীল, সব চেয়ে সুন্দর ঝুমকো ফুলের মতো। আবার জলটা খুব স্বচ্ছ, যেনো কাঁচের তৈরি ঝকঝকে ঝুমকো ফুল। কিন্তু সমুদ্র সেখানে এতো গভীর যে কোনো নোঙর তার নিচে পৌঁছোতে পারে না। সমুদ্রের তলা থেকে জমির ওপরে পৌঁছোনোর জন্য অনেক, অনেক গির্জার চূড়া জুড়তে হবে একটার পরে একটা। সমুদ্রের তলায় যে মানুষেরা বাস করে তারা এখানে -”
ঝুমকো ফুল |
শিন ছির গলার স্বর গাঢ় আর গভীর, চুম্বকীয়। পড়ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু প্রাণবন্ত করে। যেনো চেলো বাজাচ্ছে। শুনতে শুনতে মিন হুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলো। কোনো ধারণা নেই কতক্ষণ পরে, ফোনের কাঁপুনিতে মিন হুয়ের ঘুম ভঙে গেলো। তার মধ্যে শয়ে শয়ে উইচ্যাট মেসেজ।
শুধু কাজের জন্যই আটটা আলাদা উইচ্যাট গ্রুপে আছে মিন হুয়ে। আর ওর সাথে যারা কাজ করে তারা সবাই-ই প্রায় নিশাচর। প্রায়ই কাজের কথা বলে গভীর রাতে।
প্রচুর হাই তুলতে তুলতে দেখলো সু ছন ঘুমিয়ে পড়েছে। শিন ছি বেঁকে বসে আছে চেয়ারে, লম্বা পা ছড়িয়ে আর চুপ করে দেখছে মিন হুয়েকে।
তখনই ওর মনে পড়ে গেলো যে ও সেই জামাটাই পরে আছে যেটাতে রেড ওয়াইন ঢেলে দিয়ে ছিলো। ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “ওহ্” ঘড়ির দিকে তাকালো, “আহ্ বারোটা বাজে!”
ও ঘুমিয়েছে তিন ঘন্টা …
“তুই, তুই এখনো যাস নি কেনো?”
“আমি বেশিক্ষণ থাকতে চাই, তাই।”
“তোর খিদে পেয়েছে?” জানতে চাইলো মিন হুয়ে।
শিন ছি ঘাড় নাড়লো, “নিচে কী রেস্টুরেন্ট আছে?”
“রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কাছে ইন্সট্যান্ট নুডল্ আছে। আর গরম জল আছে বোতলে।”
মিন হুয়ের মনে পড়ে গেলো শিন ছি প্রায় কিছুই খায় নি রাতে, সারাটাক্ষণ ও মিন হুয়ের জন্য চিংড়ির খোসা ছাড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি বললো, “আমি কী তোকে এক বাটি নুডল্ বানিয়ে দেব?”
খাটের তলা থেকে ও এক বাক্স মাস্টার কং বের করে আনলো, “কোন স্বাদটা তোর পছন্দ? অল্প আঁচে রান্না গরুর মাংসের গন্ধ? টক ঝোলের তেলা গরুর মাংস? অল্প আঁচে রাঁধা শুয়োরের মাংস?”
শিন ছি মাথা নেড়ে বললো, “আমি ইন্সট্যান্ট নুডল্ খাই না।”
মিন হুয়ে ফোন বার করলো, “তাহলে আমি তোর জন্য কিছু খাবার অর্ডার করি যেটা দিয়ে যাবে এখানে?”
শিন ছি আবার মাথা নাড়লো, “আমি নালা ছেঁচা তেলও খাই না।”
নালা ছেঁচা তেল |
মিন হুয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো, “আমার বাড়ি কাছেই। রেফ্রিজেরেটরে কিছু সব্জি আছে। তুই আমার সাথে আমার বাড়ি এলে, আমি তোকে সব্জি বানিয়ে দিতে পারি।”
“দরকার নেই। আমি নিজেই একটা সমাধান করে নেবো।”
ও উঠে দাঁড়িয়ে পা দুটো ছাড়ালো টান দিয়ে দিয়ে। তারপর জানতে চাইলো, “তোকে কী রোজ রাতে এখানে থাকতেই হবে ওর সাথে?”
“একবার মাঝরাতে বাচ্চাটা জেগে যায়। ঘুম ভাঙার পরে কাউকে দেখতে না পেলে ভয় পায়।”
শোনা মাত্র শিন ছি বললো, “তাহলে আমি আজ রাতে ওর সাথে এখানে থাকবো। তুই ফিরে যা, ঘুমিয়ে নে।”
মদের টোকো গন্ধ বেরোচ্ছে একটা। খুব শিগগির চান করার দরকার মিন হুয়ের। তাছাড়া হাতে কিছু ওভারটাইম কাজও আছে। ও যদি ওর অংশটা না করে আজ, তাহলে কাল ডেডলাইন পেরিয়ে যাবে।
কিন্তু ও বললো, “তাহলে তুই বিব্রত কেনো? তুই ওকে ভালো করে চিনিস না …”
“ও আমাকে বাবা বলে ডাকলো এই মাত্র, শুনিস নি তুই?”
এটা শোনা মাত্র মিন হুয়ের যাবার সাহস মরে গেলো। ওর মনে হলো যে কতোগুলো কথা আগেই পরিষ্কার করে আলোচনা করে নেওয়া দরকার, “শিন ছি, তুই হাসপাতালে এলে বা আমার ছেলের সাথে দেখা করে গেলে আমি কিছু মনে করবো না। কিন্তু আমি জানতে চাই - সু ছনের ব্যাপারে - তোর পরিকল্পনাটা কী?”
“ঠিক কোন ব্যাপারটা তুই বলতে চাইছিস?”
“তুই বিনচেং-এ থাকিস না, তাই তো? তুই বেড়াতে এসেছিস নাকি কাজে এসেছিস? তুই এরপর থেকে কতো সময় ছাড়া ছাড়া সু ছনকে দেখতে চাস? ঘন ঘন নাকি মাঝে মধ্যে? আমার আগে থেকে জানা দরকার, যাতে আমি বাচ্চাকে একটা বাস্তব সম্মত প্রত্যাশা দিতে পারি।”
“মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা অনুসারে, এক থেকে তিন বছর বয়স বাচ্চাদের সাথে বাবাদের আবেগের সম্পর্ক তৈরি হবার সময়। তোর অসদাচরণের জন্য আমি সেই সুযোগটা হারিয়েছি, সেটা আমার অনুশোচনার কারণও বটে।”
বেশ, শিন ছি আবার অনুযোগ করলো। মিন হুয়ের মর্মস্থলে একটা “ওহ্” ধ্বনি জেগে উঠেই মিলিয়ে গেলো।
“দ্যুইবুচি। আমার দোষ। কোনো রাস্তা আছে যাতে আমি এই দোষ স্খালন করতে পারি?” মিন হুয়ে খুব গুরুত্ব দিয়ে বললো, “আমি সব রকম সহযোগিতা করতে রাজি।”
“খুব সহজ, সাধারণ সমাধান আছে।" শিন ছির দু চোখ ভর্তি চাপ, “চার বছরে আমাকে দিয়ে দে ছেলেটা।”
“আমি বুঝতে পারছি না তুই কী বলছিস।”
“বাচ্চাটা আমাকে দিয়ে দে, ওকে আমার সাথে থাকতে দে।”
মিন হুয়ের গলার স্বর কেঁপে গেলো, “তখন … আমার কী হবে?”
“তুই ঝংজিয়ে, কাজের চাপ অনেক, জীবন অগোছালো, তুই রোজ ইন্সট্যান্ট নুডল্ খাস। তারওপরে তোর ব্যক্তিগত সমস্যা … মনে হচ্ছে সেগুলো এখনো সমাধান হয় নি। আমার মনে হয় তুই বাচ্চার যত্ন করতে পারবি না এখন। কেনো সু ছনকে দিবি না আমার কাছে? তুই যে কোনো সময়ে এসে দেখা করে যেতে পারিস ওর সঙ্গে, আমি তোকে প্লেন ভাড়াও দিয়ে দেবো।”
মিন হুয়ে নিজের দুহাত ঘষে উপহাস করলো, “কাজটা কী করিস তুই?”
“বিনিয়োগ।”
“তুই যদি বিনিয়োগের কাজে ব্যস্ত না থাকিস তবে কী তোর জীবনে কোনো চাপ থাকে না?”
“আমি এটুকুই বলতে পারি যে আমি পরিবারকে যতোটা গুরুত্ব দি তুই পরিবারকে ততোটা গুরুত্ব দিস না। আরো একটু পড়াশোনা কর, সময় করে সব কাজ সামলাতে শেখ।”
“তুই যদি আমার ছেলের জন্য একটা বিরক্তিকর সৎমা আনিস?”
“তুই এর মধ্যেই আমার বাচ্চার জন্য একটা বিরক্তিকর সৎবাবা এনে ফেলেছিস। আর বাচ্চা এখনো এই ধারণাতেই আছে যে সৎবাবাও ওর বাবা।”
“ঝৌ রু জি বিরক্তিকর নয়।”
“আমার মন হয়েছে বিরক্তিকর।”
“না।" মিন হুয়ে পা ঠুকে বললো, “বাচ্চা আমার সঙ্গেই থাকবে।”
“আমাকে ছেলে ফিরিয়ে দে। আমি সু তিয়াঁর কথা তুলবো না।” শিন ছি বললো, “তোর একার পক্ষে ওর খেয়াল রাখা সহজ ছিলো না এই চার বছর। এবার আমার পালা। এটাই সবার জন্য সুখের হবে।”’
“শিন ছি” মিন হুয়ে উদ্বেগে বললো, “আমি তোর অনুভূতি বুঝতে পারছি আর তোর যোগ্যতা নিয়েও আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা বাচ্চার বেড়ে ওঠার সময় তাকে মায়ের থেকে আলাদা করা যায় না। সে কথা তো বলছিই না যে বাচ্চা এতো দিন আমার সঙ্গে থেকেছে আর তোকে মোটেই চেনে না।”
“ও ঠিক করে আমাকে চিনতে পারে নি?”
“না, একেবারেই না।”
মিন হুয়ে গোঁ ধরে মাথা নাড়লো, “বাচ্চা আমার সঙ্গে থাকবে, তুই আসতে পারবি, দেখা করতে পারবি। কতো সময় ছাড়া ছাড়া দেখা করবি সেটা তুই ঠিক করবি। এটাই শেষ কথা। আর কোনো বোঝাপড়ার প্রশ্ন নেই।”
“তাহলে অভিনন্দন, তুই আমাকে আবারও চটিয়েছিস, মিন হুয়ে।” ঠান্ডা স্বরে বললো শিন ছি।
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-33.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-35.html