Wednesday, August 7, 2024

JPDA - Chapter 01

 

১. বাস

মিন হুয়ের ভূমিকায় অভিনেতা ওয়াং ইউয়েন


পুরো বাসটা রি রি করছে মুরগির গুয়ের গন্ধে।

জানলা খোলা যাবে না। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।

মিন হুয়ের দম বন্ধ হয়ে আসছে। জানলায় মুখটা ঠেসিয়ে রেখে ও চেষ্টা করে চলেছে জানলার ফাটল গলে আসার তাজা বাতাসের খানিকটা যদি শুষে নেওয়া যায় । 

এমন সময় গাড়িটা থেমে গেলো, দরজা খুলে গেলো, সামনের থেকে ড্রাইভার চেঁচিয়ে উঠলো, “লুও তাং এসে গেছে। দশ মিনিটের স্টপেজ, খাবার দোকানের পাশে টয়লেট আছে। যেতে চাইলে নেমে পড়ো।”

বাসের ভেতরে হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। 

বাসটা কাদায় তলতলে পাহাড়ি রাস্তায় চলেছে চার ঘন্টারও বেশি। এর মধ্যে একটা গাড়ি লেজ ঘেঁষে বাসটাকে ওভারটেক করেছে, দুবার গাড়ির টায়ার ফেটেছে, একবার একটা কাদার ধসে ধাক্কা লাগাচ্ছিলো আর কি। এখনো যে বাসটা আস্ত আছে সেটা একটা অবাক কান্ড বটে।

যাত্রীরা সবাই খুব ক্লান্ত। অর্ধেকের বেশি লোক উঠে পড়েছে। কেউ কেউ বাস স্টেশনে গেলো। কেউ কেউ শুধু একটু পা ছড়াবার, পা নাড়াবার জন্য গেলো। আর তারা সব্বাই আইল জুড়ে ভিড় করে ফেললো।

টয়লেটটা নামেই আছে। সেটা এতো নোংরা যে সেখানে গেলে পরিষ্কার হবার বদলে আরো নোংরা হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই মিন হুয়ে টয়লেট ব্যবহারের আনন্দ থেকে নিজেকে অব্যহতি দিলো। খোলা দরজা দিয়ে তাজা হাওয়া ঝাঁপিয়ে এলো, বৃষ্টির জলোভাব আর পাহাড়ের ঠান্ডা নিয়ে। মিন হুয়ে তক্ষুণি হেঁচে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে একটু চোখ বন্ধ করে জিরিয়ে নিতে গেলো যেই, অমনি তার পাশে বসা মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো আর মিন হুয়েকে আলতো করে ঠেলা দিয়ে বললো, “হাই, আমি বাথরুমে যেতে চাই। আমাকে একটু সাহায্য করবে আমার ব্যাগগুলোতে চোখ রেখে?”

কথা বলার সময় মেয়েটা আঙুল দিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা কয়েকটা প্লেড ক্যানভাস ব্যাগ দেখালো। 

মিন হুয়ে ঘাড় নাড়লো সম্মতিতে।

“আর এটা।”

মেয়েটা একটা ঠাসা নাইলন ব্যাগ মিন হুয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বললো, “সমস্ত দরকারী জিনিসপত্র এতে আছে।”

তারপর বললো, “ধন্যবাদ।”

মেয়েটা ঝলমলিয়ে হাসলো। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে একটা হলুদ জ্যাকেট গলিয়ে গাড়ির থেকে নেমে ভিড়ে মিশে গেলো।

হতবাক হয়ে মিন হুয়ে মেয়েটার হলুদ পিঠের দিকে তাকিয়েরইলোমেয়েটাকে ও আগে কোনোদিন দেখে নি, যদিও ওরা দুজনে পাশাপাশি বসে ছিলো, মিন হুয়ে পুরো পথে খুব মন দিয়ে কোনো কথা বলে নি মেয়েটার সাথে, তবুও মেয়েটা এতোটা সহজে মিন হুয়ের হাতে সমস্ত জিনিস তার সঁপে দিয়ে চলে গেলো। মেয়েটা বোধহয় নিজের মনের বিশালতায় মজে আছে।

ছোট্টো ব্যাগটা ফুলে আছে। ব্যাগে কি আছে কে জানে। চেনটা কোনো মতে টানা আছে। দেখে মনে হছে যে যে কোনো মুহূর্তে ব্যাগটা ফেটে যাবে। মেয়েটার বয়স কুড়ির ঘরে। জামাকাপড়ে খেটে খাওয়া জীবনের ছায়া। হতে পারে তার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় এই ব্যাগের মধ্যে। মিন হুয়ে অবহেলা করতে পারলো না। ব্যাগটাকে জাপটে ধরে রইলো নিজের দু হাতের মধ্যে।

জানলার বাইরে ঘন অন্ধকার। বাসের চালে ঝেঁপে বৃষ্টি পড়ছে। এতো বৃষ্টিতে ছাতা অকেজো। যে লোকগুলো বাস থেকে নেমে ছিলো তারা নিজেদের মালপত্র নিয়ে দৌড় লাগালো ইঁদুরের মতো। 

যতো বার মিন হুয়ে আঁপিং-এ ফিরেছে, প্রত্যকবার ওকে লুও তাং পেরোতে হয়েছে। দশ বছরে ক্যান্টিনটার চেহারা একটুও বদলায় নি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা একটা টালির ছাউনির তলায় ছোট্টো ঘর। কিন্তু নামটা তার “ওরিয়েন্টাল সুপার মার্কেট”। ঘরের ছাঁচের তলায় এখনো দুটো হলদেটে কুকুর ঘাপটি মেরে ওঁত পেতে বসে আছে। যে কড়াইটা থেকে মশলা মাখানো ডিম বেচা হয়, সেটা ভুসিতে কালো হয়ে আছে। মালকিন তিনিই যিনি সারাক্ষণ দড়ির চেয়ারে বসে টিভি দেখে চলেছেন। আর মালিক সারাক্ষণ খদ্দেরদের অভ্যর্থনা করে চলেছেন। এলোমেলো এবড়ো-খেবড়ো চেহারাটার দিকে তাকিয়ে কাজ নেই, ব্যবসা এখানে মোটেই খারাপ না। তাকের ওপর নানা রঙের ইন্সট্যান্ট নুডল রাখা আছে। হামলে পড়ে খদ্দেররা সে সব খপাখপ তুলে নিচ্ছে। 

একটা বেঁটে লোক, যার হাতে একটা বিশাল বড়ো সবুজ ড্র্যাগনের উল্কি আঁকা, হেঁটে গেলো গাড়ির জানলার পাশ দিয়ে। তার দাঁত নখ সব বেরিয়ে আছে। তার ভাবভঙ্গিমা ভয়ানক। মিন হুয়ের দৃষ্টি সবুজ ড্র্যাগন উল্কির ওপর একটা সেকেন্ড বেশি আটকে রইলো। লোকটা সেটা নজর করে মাথা তুললো, মিন হুয়ের দিকে কড়া চোখে তাকালো তারপর মধ্যমা উঁচিয়ে দেখালো।


জ্যাংঝৌ - বিনচেং 

ওহ! একেক সময় মানুষ কি অসহায়! সে কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারে না অন্যলোকের জীবনের উঠোনে উঁকি দেওয়া থেকে। যদিও এটা একটা সাধারণ চাউনি, তবুও সে কিছুতেই কাউকে আটকাতে পারে না একটা অভ্যস্ত নজরে তাকে দেখার থেকে, যদিও সেটা সত্যি নয়। 

মিন হুয়ে কিছুতেই না ভেবে থাকতে পারলো না যে আজকের পর এই পৃথিবীতে আর কটা লোকই বা ওর কথা ভাববে। কতো লোকের গল্পেই বা ওর অস্তিত্বের উল্লেখ থাকবে? ওকে মনে করে কতোটা অনুতাপই বা জন্মাবে?

মেয়েটা ফিরে এলো বেশ তাড়াতাড়ি আর মিন হুয়েকে এক বোতল বরফ ঠাণ্ডা চা দিলো। 

দরকার নেই কোনো। মিন হুয়ে উত্তরও দিলো না, “আমার লাগবে না।”

মেয়েটা উদাসভাবে বাদামী জিনিসের আরেকটা ব্যাগ বাড়িয়ে ধরে জানতে চাইলো, “সুপুরি, খেতে চাও?”

“না, ধন্যবাদ।”

“নাও বলছি।”

মেয়েটা বরফ ঠাণ্ডা চা এর বোতলটা ঠুসে দিলো মিন হুয়ের হাতে। “যা গরম। এটা কাজে লাগবে। সবে ফ্রিজার থেকে বার করে এনেছি। তুমি এটা তোমার চোখের ওপরে দিতে পারো।”

বাক্যের শেষার্ধটা নিচু স্বরে বলা হলো। সেই সঙ্গে ঘাড়টাও একটু কাৎ করা হলো। 

মিন হুয়ে চট করে কাচের ওপরে নিজের ছায়াটাকে দেখে নিলো। তার চোখগুলো সত্যিই লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।

“দরকার নেই।”

ও বিনয়ের সঙ্গে কিন্তু শক্ত হাতে চায়ের বোতলটা মেয়েটার হাতে গুঁজে দিলো, ব্যাগ থেকে একটা সানগ্লাস বার করে পরে নিলো। 

মেয়েটা হতচকিত হয়ে রইলো তার মুখ ফুটে একটাও শব্দ বেরোল না। সে চুপ করে রইলো পরের আধঘন্টা।

বেশ ভালোই হলো।

মিন হুয়ে যখন বাসে চড়ে ছিলো, তখন তার পাশের সিটটা খালিই ছিলো। মিন হুয়ে মনে করতে পারলো না কখন মেয়েটা এসে বসে ছিলো, হতে পারে মিন হুয়ে বাসে চড়ার ঘন্টা খানেক পরে। তাই ও জানেও না মেয়েটা কোন স্টেশন থেকে চড়েছে বাসে। এর মধ্যে ও নিজের মাথাটাকে গাড়ির জানলায় ঠেকিয়ে রেখেছে। দেখে চলেছে দূরের পাহাড় আর নদী একটা ঘোরের মধ্যে। যখন ও ঘাড় ফিরিয়ে ছিলো, তখন সে দেখে ছিলো যে তার পাশে আরেক জন বসে আছে।

লম্বা পাহাড়ি রাস্তায় ঝিমুনি ধরে। আর গাড়ির মধ্যে একঘেয়েমি আসে। ওর পাশে বসা মেয়েটার উৎসাহ উপছে পড়ছে। অন্তত পাঁচবার সে মিন হুয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মিন হুয়ে কথা বলতে চায় না। তাই ও মেয়েটাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে ছোট্টো উত্তর দিয়ে, ঠান্ডা চোখে তার দিকে তাকিয়ে। শেষে যা হোক হেডফোন লাগিয়ে গান শোনার ভান করে মেয়েটাকে সম্পূর্ণ আটকে দিয়ে ছিলো মিন হুয়ে। 

যদি আর কিছু না করার থাকে, তবে নিশ্চয়ই পিরামিড স্কিম বেচতে চাইছে। এ কিছু একটা বেচতে চাইছে বোধ হয়। হয়তো সুপুরি। 

খুব বেশি সময় কাটতে না কাটতেই, একটা প্রাণবন্ত আড্ডা তার কানে ভেসে এলো। মেয়েটা তার মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে তার অন্য পাশে বসা মাসিমার দিকে। দুজনেই গল্প করে চলেছে তাদের এলাকার ভাষাতে, গলা তুলে, হড়বড় করে। তারা খুব হাসছে ভবিষ্যতের কল্পনা এলেই। শেষে তারা একসাথে তরমুজের বীজ খেলো।

বাসের ভেতরটা সারাক্ষণ সরগরম রয়েছে। একদম পিছনের সারিতে এক ডজনের বেশি জুনিয়র হাইস্কুলের ছাত্র বসে ছিলো খেলার জামা জুতো পরে। তারা সম্ভবত প্রদেশের রাজধানীতে গিয়ে ছিলো কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। হট্টোগোল আর কিছুতেই থামছে না। তুলনায়, মেয়েটার হাসিটা খুব জোর নয়। বরং বলা যায় হাসিটা বেশ মিষ্টি। কিন্তু সে যখনই দুঃখী মিন হুয়ের দিকে ফিরছিলো, তখনই তার হাসিটা একটা ক্যাঁচক্যাঁচে ইলেক্ট্রিক ড্রিলের মতো শোনাচ্ছিলো, যেনো সে একটা ক্র্যানিওটোমি সার্জারি করে খুলির হাড় কাটছে। কপালের শিরা-উপশিরাগুলো সব কুঁকড়ে উঠছে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে, বাচ্চারা নাকি দিনে চারশো বারের বেশি হাসে। আর প্রাপ্ত বয়সে কেউ যদি দিনে কুড়িবারের বেশি হাসে তা হলে সে বেশ সুখেই আছে। মিন হুয়ে হাসে নি অনেকদিন, কয়েক মাসও হতে পারে। হাসছে না ব্যাপারটার থেকেও বেশি হলো যে হাসিতে তার অ্যালার্জি। যারা কাঁদতে চাইছে, তাদের মনমেজাজ তাদেরকে হাসির ভানও করতে দেয় না। ঠোঁটের কোণা তুলতে হলে তাদের ক্লান্তি লাগে।

মিন হুয়ে নিজের কপালের রগ দুটো আচ্ছা করে ঘষছে আর মনে মনে গাল পাড়ছে, “হলুদ জ্যাকেট পরা মেয়েটা কি মুখ বন্ধ করতে পারে না? ওকে কি আমি জ্বালাচ্ছি?” 



গাড়ির বাইরে বৃষ্টির দাপট বেড়ে চলেছে। সাকুল্যে দশ মিটার দূরের জিনিস দেখা যায়, তার পরে সব অস্পষ্ট। বাসটা ষ্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে পাহাড়ী পথের পাকদণ্ডী থেকে পাকদণ্ডীতে ঘুরে ঘুরে চলতে লাগলো। পেরোতে লাগলো গাছের ছায়া আর মেঘের কুয়াশা। যা হোক, ড্রাইভার গাড়িটা চালাচ্ছে পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে। গাড়ির গতিবেগটা কমানোর কথা সে মোটেই ভাবে নি। তার ওপরে সামনে কোনো গাড়ি দেখলে, বা উল্টোমুখে আসা গাড়ি দেখলে সে বেশ জোরে জোরে গাড়ির হর্ন বাজাচ্ছে আর দুমদাম ড্রাইভিং লেন বদলাচ্ছে। রাস্তাটা এবড়ো-খেবড়ো। গাড়ির ভেতর যাত্রীদের খুব ঝাঁকুনি লাগছে। এমনই একটা তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে সামনের সারির কোনো একজন আর সামলাতে না পেরে বমি করতে শুরু করলো। তারপর ছুটলো গালির ফোয়ারা। যাদের বমি হলো, তারা একটু সুস্থ হতেই মনে করতে লাগলো যে তাদের সাথে অন্যায় করা হচ্ছে। তার জেরে গালিগালাজ চললো আর কি খানিক ক্ষণ। দুজনের মধ্যে লেগে গেলো তীব্র ঝগড়া। আরেক জন সে দু জনকে নিরস্ত করলো, না হলে ঝগড়া থেকে হাতাহাতি শুরু হয়ে যেতো খুব শিগগির।

যে লোকটা বমি করেছে তার ঠিক পরের সারিতেই বসে আছে মিন হুয়ে। লোকটার পাকস্থলীর অ্যাসিডের ঝাঁজ, মদের গন্ধ, রাতের খাবারের পচা দুর্গন্ধে মিন হুয়ের গা গুলিয়ে উঠতে লাগলো। তাই বৃষ্টির দাপট সত্ত্বেও ও জানলার কাচের পাল্লা ঠেলে সরিয়ে দিলো একটুখানি। মুখে বৃষ্টির ছাট এসে পড়তে, তার একটু তরতাজা লাগলো।

আরো দুঘন্টা পরে মুশুই হে সিটি এলো। এটাই মিন হুয়ের গন্তব্য। মিন হুয়ে নিজের মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লো বাস থেকে আর গেলো বাস স্টেশনের কাছেই পেংলাই হোটেলে। যতো বার ও বিনচেং-এ ফিরেছে ওর নিজের শহর থেকে, ততো বারই এই হোটেলে রাত কাটিয়েছে, পরের দিন সকালের ট্রেন ধরার জন্য। ও যেই হোটেলের লবিতে পা রাখলো, অমনি ওর সাথে দেখা হয়ে গেলো হলুদ জ্যাকেট পরা মেয়েটার। এই দেখা অবশ্যই অপ্রত্যাশিত।

মেয়েটাই কথা বলার উৎসাহ দেখালো, তখনও আগের মতই হাসি মুখে, “এই, তুমিও এখানেই থাকবে?”

মিন হুয়ে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললো। একটু লজ্জাও পাচ্ছিলো বাসে মেয়েটাকে একদম পাত্তা দেয় নি বলে। যদিও মিন হুয়ে হাসতে পারলো না, তবে মুখের ভঙ্গিতে একটা বন্ধুত্বের আভাস ধরে রাখার চেষ্টা করলো।

মেয়েটা বললো, “আমি জিজ্ঞেস করেছি এইমাত্র, কোনো ঘর নাকি খালি নেই।”

মেয়েটা নিজের ঘড়ি দেখলো। তারপর বাইরের বৃষ্টির দিকে চাইলো। ফের বললো, “ফ্রন্ট ডেস্ক বললো যে কাছেই আরেকটা হোটেল আছে। প্রায় আধঘন্টার হাঁটা পথ। তুমি যাবে?”

মিন হুয়ে বললো, “আমার রিজার্ভেসন আছে। আমার জন্য একটা ঘর আছে নিশ্চয়ই।”

মেয়েটা জবাব দিলো, “ওহ্‌ –”

মিন হুয়ে জানালো, “দোতলায় একটা কফির দোকান আছে। চাইলে তুমি সেখানে অপেক্ষা করতে পারো যতক্ষণ না বৃষ্টি ধরছে।”

মেয়েটার অস্বস্তি, দ্বিধা স্পষ্ট হয়ে উঠলো, “কফি — খুব দামী কী? কিচ্ছু না কিনে বসাটা খারাপ হবে যে।”

মিন হুয়ে পকেটের ভেতর হাত চালিয়ে নিলো, মেয়েটার হাতে কুড়ি য়ুঁয়াঁ দিয়ে মেয়েটাকে তক্ষুণি ভাগিয়ে দেবার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিলো তাই। কিন্তু নিজেকে সংযত করলো। অনেক সময়েই অজানার শুভেচ্ছা আর অচেনার দ্বেষের পার্থক্য করা যায় না। কাউকে উস্কানি না দেওয়াই ভালো।

কথাটা মনে হতেই মিন হুয়ে অনুশোচনায় ঘাড় নাড়লো আর ফ্রন্ট ডেস্কের দিকে পা বাড়াতে গেলো। এমন সময় মেয়েটা খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার সাথে কি আলোচনা করতে পারি?”

মিন হুয়ে খানিক সতর্ক হয়েই মেয়েটার দিকে তাকালো। 

মেয়েটা বলে চললো, “আজ রাতটা কি আমি তোমার সাথে থাকতে পারি? আমি কাল সকালের ট্রেন বুক করেছি। আমার খাট-বিছানায় শোবার দরকার নেই, আমি সোফাতে কিংবা মেঝেতে শুয়ে যাবো। তোমার সাথে ঘরভাড়াটা সমান সমান ভাগ করে নেব?”

মিন হুয়ে একটাও শব্দ উচ্চারণ করলো না। সে অচেনা কারুর সাথে থাকতে চায় না, বিশেষ করে এরকম সময়ে।


মিন হুয়ের দ্বিধা দেখে মেয়েটা ঠোঁট কুঁচকালো আর মাথাটাও অল্প ঝোঁকালো, আর বললো, “ঠিক আছে। আমি এমনি জিজ্ঞেস করলাম। অসুবিধে হলে থাক, দরকার নেই।”

কথা শেষ করে তার সঙ্গের বড়ো ব্যাগটা থেকে মেয়েটা একটা ফোল্ডিং ছাতা বের করলো। তারপর হাত নেড়ে বললো, “গুড বাই। শান্তিতে থেকো এই কামনা করি।”

যখন পিছন ফিরে প্রায় চলেই যাচ্ছে মেয়েটা, তখন মিন হুয়ে হঠাৎ বললো, “ঠিক আছে।”

মেয়েটা খুব অবাক হলো। কি শুনেছে বিশ্বস করতে পারলো না, “হু?”

মিন হুয়ে আবার বললো, “মেঝেতে শোবার দরকার নেই। আমি একটা ডাবল রুম বুক করেছি।”

“তাই?” মেয়েটা ভীষণ খুশিতে মিন হুয়ের হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলো সমানে। তারপর বললো, “ধন্যবাদ, ধন্যবাদ তোমাকে। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। যা হোক, আমার নাম লি চুন মিয়াও। তোমার নাম কি?”

দ্বিধা নিয়েও মিন হুয়ে বললো, “আমার পদবী মিন।”

“আগামী কালের মিং? তাহলে আমি তোমাকে শও মিং বলে ডাকি?”

লি চুন মিয়াও ভুল শুনেছে। মিন হুয়েও ঠিক করে দেবার দরকার বোধ করলো না। ও এলোমেলো ঘাড় নেড়ে চলে গেলো ফ্রন্ট ডেস্কে, নিয়ম মতো চেক-ইন করার জন্য। 

পেংলাই হোটেল একটা সাদামাটা হোটেল, টু-স্টারও নয়। মিন হুয়ে এই হোটেলটা চেনে কারণ হোটেলটা দূর পাল্লার বাস স্টেশনের ইস্ট গেটের থেকে দূরে নয়, হাঁটা পথে পেরোনো যায়, যাতায়াতের পক্ষে সুবিধেজনক। আর হোটেলটা ট্রেন স্টেশন অবধি একটা শাটল বাস দেয়। তাছাড়া ঘরগুলো পরিষ্কার, ভাড়াটা ঠিকঠাক, বাকি সব সুবিধেও ঠিকঠাক, আর ইন্টারনেট ফ্রি। 

লি চুন মিয়াও ঘরভাড়া দেবার জন্য জোরাজুরি করছে। মিন হুয়ে বললো, “বাদ দাও। একটা তো রাতের ব্যাপার।”

কিন্তু মিন হুয়ে বেশি জোরাজুরি পছন্দ করে না। তাই লি চুন মিয়াও টাকা দিতে দিতে ও নিয়ে নিলো।

ঘরটা লবির কাছে, একতলাতেই। কার্ড ব্যবহার করে দু জনে যেই ঘরের দরজা খুলল অমনি একটা ছাতাপড়া দূর্গন্ধ এসে লাগলো নাকে। কার্পেটের গন্ধ হবে। মিন হুয়ের স্পষ্ট মনে আছে যে শেষবার যখন ও এসে ছিলো এখানে, তখন মেঝেটা কাঁচা কাঠ দিয়ে বানানো ছিলো। আসবাবও কাঁচা কাঠের তৈরি ছিলো, তবে তার ওপরে মোটা করে বার্ণিশ লাগানো ছিলো। পুরো ঘরটা তখন বেশ ঝলমলে ছিলো। এখন ঘরের সাজগোজ বদলে গেছে। ঘন সবুজ রঙের আসবাব, ধূসর কার্পেট। আগুনে লাল কম্বল আর আগুনে লাল পর্দা থেকে মিন হুয়ের মনে হচ্ছে যে ও যেনো কোনো মধ্যযুগীও দূর্গে এসে পড়েছে। দামী মানে দামী, কিন্তু এ যেনো ঘোর আঁধার। মিন হুয়ে কার্পেট পছন্দ করে না। ওর কেবল মনে হতে থাকে যে কার্পেটে অনেক ময়লা জমে আছে। তার ওপরে এখন বৃষ্টির সময়। মিন হুয়ে নিজের মালপত্রের ভেতর থেকে একটা চাদর বার করলো। এই চাদরটা ও ব্যবহার করে বাড়ির বাইরে ঘুমোনোর সময়। ট্র্যাভেল শিট। চাদরটা খাটে বিছিয়ে দিলো।

দুটো মেয়েতে তারপর মেতে উঠলো পরস্পরকে স্নানের সুযোগ দেবার তর্কে। চুন মিয়াও প্রস্তাব দিলো, “তুমি আগে যাও। তুমি পরিস্কার থাকতে এতো ভালোবাসো।”

মিন হুয়ে আপত্তি করলো, “তুমি আগে যাও। আমার অনেক সময় লাগবে।”

চুন মিয়াও যুক্তি দিলো, “অনেক সময় আছে। তোমার উচিৎ -”

মিন হুয়ে কথা কেড়ে নিলো, “তোমাকে স্বাগত।”

চুন মিয়াও বললো, “তুমি মোটেই বিনয়ী নও।”

ঠিক এই জন্যই মিন হুয়ে কক্ষণো ঘরে আরেকটা লোক থাকা পছন্দ করে না। স্নানের সময়ে বিনয়ী হতে গিয়ে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেলো। শেষে মিন হুয়ে স্নানে গেলো কুড়ি মিনিটের জন্য। যতক্ষণে চুন মিয়াও স্নান সারলো ততক্ষণে মিন হুয়ে পাজামা পরে ফেলেছে। খাটের পাশে বসে একটা ব্লোয়ার দিয়ে মাথার চুল শুকনো করতে শুরু করেছে। 

লি চুন মিয়াও মিন হুয়ের মুখোমুখি বসলো। তার পরণে একটা তোয়ালে। বললো, “ওয়াও! তোমার তো দারুন ফিগার!। এটা …… থার্টি ফোর সি।”

মিন হুয়ে জোরে শ্বাস নিলো। তারপর উচ্ছাসের স্বরে প্রশ্ন করলো, “তুমি জানলে কি করে?”

চুন মিয়াও-এর প্রতিক্রিয়া, “আমি কাজ করতাম একটা জামাকাপড় বানানোর কারখানায়। বিশেষত ব্রা বানানো হতো যেখানে। আমি মডেলদের থেকে শুনেছি স্তন বাড়ানো সহজ, কিন্তু কমানোটা বেশ যন্ত্রণার …”

সত্যিই নিচু মানের। মিন হুয়ের নরম হওয়া উচিৎ হয় নি। এই মেয়েটাকে না থাকতে দিলেই হতো। মিন হুয়ের পেটের ভেতর অজস্র অনুশোচনা জমে উঠলো। ও কোনো উত্তর দিলো না। গ্লাসের ঢাকা সরিয়ে বেশ অনেকটা জল খেলো এক ঢোকে। তারপর একটা এয়ার কুশন চিরুনি দিয়ে আনমনে চুল আঁচড়াতে লাগলো।

লি চুন মিয়াও সতর্ক করলো চিরুনিতে লেগে থাকা লম্বা চুলগুলো দেখিয়ে, “অতো জোরে জোরে মাথা আঁচড়িও না। সব চুল খসে যাবে …… দেখো, এখন যেমন যেগুলো ছোটো শুধু সেগুলোই আছে।”

তার মুখের ভাবখানা যেনো জগতের অন্তিম লগ্ন ঘনিয়ে এসেছে।




মিন হুয়ে চিরুনি থেকে চুলটা ছিঁড়ে নিলো। দেখলো যে বেশ লম্বা একটা চুল। সে হাতে ধরে রইলো চুলটা, রেশমের মতো আর উষ্ণ, যেনো গ্রীষ্মের পুকুরে ভাষা জোলো আগাছা। একটা ঘোরের মধ্যে ওর যেনো আর চুলটা ফেলে দেবার ইচ্ছে নেই এমনভাবে ও বললো, “আগে এমন ছিলো না।”

চুন মিয়াও তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “আজকাল উঠে যাচ্ছে চুল? কিছু ঘটেছে কী?”

মিন হুয়ে কৌতুক ভরে হেসে মাথা নাড়লো। আর ব্লোয়ার দিয়ে চুল শুকনো করে চললো।

চুন মিয়াও পরামর্শ দিলো, “শও মিং, যদি খারাপ কিছু ঘটে থাকে, তা নিজের মনের মধ্যে চেপে রেখো না। বিশ্বাস করো, যতো খারাপই হোক পরিস্থিতি, তুমি সেটা কাটিয়ে উঠবে।”

বলা সহজ - মিন হুয়ে মুখ তুলে তাকালো চুন মিয়াও-এর দিকে। দেখতে পেলো যে চুন মিয়াও দু চোখ দিয়ে মিন হুয়ের মনের ভেতরটা খুঁড়ে চলেছে। ওর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। মিন হুয়ে ঠাহর করতে পারলো না কারণটা। হতে পারে চুন মিয়াও দুশ্চিন্তায় পড়েছে। অথবা সে সবে স্নান সেরে এসেছে বলে তার মুখ লাল উঠেছে। মিন হুয়ে বেশ টের পাচ্ছে চুন মিয়াও-এর দয়ার্দ্রতা। তারা দুজনে নেহাতই পাকে চক্রে পরস্পরের সামনে এসে পড়েছে। না হলে অপরিচিতের প্রতি এতো দরদ কেই বা দেখায়। এসব মনে হতেই মিন হুয়ে চুন মিয়াওকে আর উপেক্ষা করতে পারলো না, খানিকটা গুরুত্ব দিয়েই দেখলো চুন মিয়াওকে। চুন মিয়াও কুৎসিত নয়, আবার সুন্দরীও বলা যায় না তাকে। তার মুখটা সাধারণ, বিনয়ী, সদাচারী এবং বৈশিষ্ট্যবিহীন। তার গায়ের রং ভীষণ ফ্যাকাসে, যেনো অনেক, অনেকদিন সে রোদে বেরোয় নি। তার মুখটা বেশ পরিস্কার, ভ্রূগুলো উইলো পাতার মতো পাতলা, কাজল দিয়ে চোখের সীমা আঁকা, কোঁকড়া চুল ইলাস্টিকের মতো গুটিয়ে জড়ো হয়ে আছে কাঁধের ওপর, আর স্প্রিং-এর মতো ঝাঁপাচ্ছে যখন সে কথা বলছে। তার হাতের আঙুলে শক্ত কড়া পড়ে গেছে। হাতের নখে ল্যাভেন্ডার নেল পালিশ লাগানো, পরতের পর পরতে। আঙুলগুলো নড়লে নেল পালিশের রঙ ঠিকরে বেরোচ্ছে। চুন মিয়াও বলেছে যে সে একটা জামা তৈরির কারখানায় কাজ করতো। সে হয়তো সব সময়েই সমাজের নিচের তলায় থাকা একজন খেটে খাওয়া মানুষ কিন্তু সমাজের যে সব মানুষ খুব জোট বেধে থাকে চুন মিয়াও সেই সব মানুষের দলেও নেই।


এই পৃথিবীতে পঁচিশ বছর বয়সের যে কোনো মানুষ নানারকম মুখোশ পরতে শিখে যায়। বিরল ঘটনা হলেও, লি চুন মিয়াও-এর কোনো মুখোশ ছিলো না।

গলার স্বর নরম করে মিন হুয়ে বললো, “আমি ঠিক আছি।”

চুন মিয়াও পরামর্শ দিলো, “আসলে একটা হেয়ার মাস্ক আছে যেটা তোমার চুলের জন্য খুব লাগসই। এটা রোজ ব্যবহার করবে। তাতে চুল ঘন আর কালো হবে। আমার বন্ধু ব্যবহার করেছে আর বলেছে যে জিনিসটা বেশ ভালো। তবে জিনিসটা একটু দামী। তুমি যদি কিনতে চাও, তবে আমার কাছে আছে ……।”

এই কি পিরামিড স্কিম বেচা শুরু হলো?

নিজের সমস্ত প্রতিরোধ তড়বড়িয়ে সরিয়ে ফেলার অনুশোচনা হচ্ছে মিন হুয়ের। চুন মিয়াও-কে সবলে আটকাতে বলে উঠলো, “আমি কক্ষণো হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করি না।”

বিব্রত চুন মিয়াও-এর মুখ থেকে শুধু একটা “ওহ্‌” বের হলো। নিজের দিকটা বাঁচানোর জন্য সে মুখ খুললো, কিন্তু শেষে চুপ করেই রইলো। তারপর অস্বস্তি নিয়েই চেয়ে রইলো মেঝের দিকে।

বেশ খানিকক্ষণ পরে হঠাৎই একটা “হাহ্‌” বলে উঠলো চুন মিয়াও। তারপর মেঝের থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে বলে উঠলো, “এখানে একটা ব্রেসলেট পড়ে। তোমার?”

মিন হুয়ে ঘাড় নেড়ে জানালো যে ব্রেসলেটটা ওরই।

চুন মিয়াও ব্রেসলেটটা মিন হুয়েকে দিতে দিতে প্রশংসায় কৌতুহলে বলতে লাগলো, “এটা কী সুন্দর গো! কোথা থেকে কিনেছো এটা?”

মিন হুয়ে সাবধানে চুন মিয়াও-এর কৌতুহল মেটাল, “আমার বাবা আমাকে বানিয়ে দিয়ে ছিলেন।”

চুন মিয়াও-এর কৌতুহল বাধ ভাঙা, “এই চুনো মাছগুলোও উনিই বানিয়ে ছিলেন?”

প্রশ্নটা করার সময়ে সে আঙুল তুলে দেখাচ্ছিলো লালো সুতোয় বাধা দুটো সত্যিকারের চুনো মাছের মাপের নকলের দিকে। মিন হুয়ে জানালো, “উনি তো রুপোর গয়নার কারিগর ছিলেন।”

চুন মিয়াও মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে, “ওয়াও! কি দারুণ হাতের কাজ। সত্যিই সুন্দর।”

মিন হুয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এটা তোমার পছন্দ?”

চুন মিয়াও অকপট, “হ্যাঁ, আমার পছন্দ হয়েছে।”

দুম করে মিন হুয়ে বললো, “এটা তোমার।”

চুন মিয়াও-এর প্রথম উত্তর প্রশ্নবাচক, “আহ্‌?”

তারপর একটা সম্পূর্ণ শব্দ, “সত্যিই?”

মিন হুয়ের আচরণের অস্থিরতয়ায়, অনিশ্চয়তায় সে অবশ্যই বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। মিন হুয়ে উত্তর দিলো, “এটা খুব দামী নয়। আশা করি এটা তোমাকে ভাগ্য এনে দেবে।”

চুন মিয়াও সামান্য প্রতিবাদ করলো, “তা কী করে হয়? এটা তোমার বাবার নিজের হাতে বানানো যে …”

মিন হুয়ে ব্রেসলেটটা চুন মিয়াও-এর হাতে পরিয়ে দিলো অকাতরে বললো, “নাও এটা। আমার অনেক আছে।”

চুন মিয়াও ব্রেসলেটটা ছুঁয়ে দেখলো, সামান্য হেসে জানালো, “স্বাগত। আমারও এখন ভীষণ রকম সৌভাগ্যের দরকার। ”

তারপর মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বললো, “নিতান্ত ভাগ্য। এসো আমরা উইচ্যাটে যোগাযোগ করি।”

মিন হুয়ে ম্লান হেসে বললো, “আমার দরকার নেই উইচ্যাট। আমাকে জানার কোনো দরকার নেই তোমার।”

চুন মিয়াও মেনে নিলো, “ঠিক আছে।”

মিন হুয়ে একটা ওষুধের বোতল বার করে একটা ভ্যালিয়াল মুখে দিলো। তারপর লেপের নিচে ঢুকতে ঢুকতে জানালো, “আমি শিগগির ঘুমিয়ে পড়বো। সারাদিনের বাসের ধকলে আমি ক্লান্ত হয়ে আছি।”

চুন মিয়াও সাড়া দিলো, “শুভ রাত্রি। আমাকে আমার মালপত্র গোছাতে হবে একটু। আমি সকাল ছটার দিকে উঠবো ঘুম থেকে সকাল আটটার ট্রেন ধরার জন্য। তখন হয়তো তোমার ঘুম ভাঙবে না। আমি তোমাকে বলে যেতে পারবো না তখন হয়তো।”

একটু থেমে গম্ভীর চোখে মিন হুয়ের দিকে তাকিয়ে চুন মিয়াও আরো বললো, “ধন্যবাদ। তুমি আমাকে থাকতে দিলে। আবার একটা সুন্দর ব্রেসলেটও দিলে।”

তার গলার স্বরে আন্তুরিকতা ছিলো, ছিলো একটা দীর্ঘ প্যাঁচও। মিন হুয়ে লেপের নিচের থেকে হাতটা বার করতে করতে বললো, “স্বাগত তোমাকে।”

তারপর হাওয়াতে হাত নেড়ে জানালো, “গুড বাই।”

চুন মিয়াও প্রত্যুত্তর দিলো, “গুড বাই।”

একটা বাজের শব্দে মিন হুয়ের ঘুম ভেঙে গেলো। সে মোবাইলে ঘড়ি দেখলো। ভোর তিনটে বারো। 

একবার পাশের বিছানায় দেখে নিলো। বিছানায় চুন মিয়াও গভীর ঘুমে অচেতন। আলতো করে উঠে বসলো মিন হুয়ে। তারপর জামা বদলে নিলো, জুতো পরলো আর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

রাতের আলো সব আবছায়া ঘেরা। লবি জনশূন্য। একজন ওয়েটার বসে ছিলো রাতের ডিউটিতে ফ্রন্ট ডেস্কে। সেও ঘুমিয়ে পড়ে ছিলো কম্পিউটারের সামনে। 

মিন হুয়ে কাচের দরজাটা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো।

সামনে থেকে ধেয়ে আসা বৃষ্টির ছাট তাকে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিলো। কোথায় ঠাণ্ডা লাগবে, তা না মিন হুয়ের তাজা লাগছে। ও বৃষ্টির মধ্যেও দিকভ্রান্ত হলো না। দিব্যি ঠাহর করে চললো পুব দিকে, পার হলো দুটো ছোটো রাস্তা। পৌঁছে গেলো পুবের মুশুই হে ব্রিজে। 

ব্রিজটা নামেই ব্রিজ। এটা আসলে খুব বড়ো নয় আর বড়ো কোনো গাড়ির জন্য এখনো খোলা হয় নি। ব্রিজের ওপর জনমনিষ্যির দেখা নেই। বাজ পড়ার শব্দ, বৃষ্টি পড়ার শব্দ, জ্বলতে নিভতে থাকা আলোর আওয়াজ ছাড়া আর একটাই আওয়াজ টের পাওয়া যাচ্ছে। সেটা হলো হুড়মুড় করে বয়ে চলা জলের শব্দ।

যখনই মিন হুয়ে এখান দিয়ে যাতায়াত করেছে, প্রত্যেকবারই একবার এখানটায় থেমেছে খানিকক্ষণের জন্য, ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখার জন্য। রোদ্দুরের দিনগুলো সবচেয়ে সুন্দর, খাড়া খাড়া সবুজ পাহাড় সব, কুয়াশা ভরা মেঘের ঝাঁক, উড়ন্ত পাখিগুলো। রোদের আভায় মুশুই নদীর জল সোনালি, চলেছে এঁকে বেঁকে, কোন অসীমে ……

 ব্রিজের ওপর উঠে নিচের দিকে চাইলো মিন হুয়ে। ব্রিজের তলা জুড়ে ঘন অন্ধকার। আর জলের শব্দে হুড়োহুড়ির আভাস, ঠিক যেনো তার কানের পাশে, যেনো এক্ষুণি উপছে পড়বে। এই সময়েই ওর মনে পড়ে গেলো বর্ষাকাল চলছে, বন্যার ঋতু চলছে। যদিও প্রতিবার বাড়ি যাবার সময় ও পাশ দিয়ে চলে গেছে, তবুও ও খুব কমই জানে মুশুইহে নদীর কথা। শুধু জানে যে নদীটা উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে চলেছে। সে জানে না যে নদীটা বয়ে কোথায় গেছে।

শূণ্যমনে মিন হুয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ব্রিজের ওপরে। রেলিংটা কাঠের আর মোটেই উঁচু নয়। সে সহজেই টপকে গেলো। কানে শুধু দমকা হাওয়ার হুহু। হাতের পিছনের রেলিংটা আঁকড়ে ধরে ঝুঁকল সামনের দিকে।

সেই মাত্র ও টের পেলো যে পায়ের তলায় নদীটে পাঁচ মিটারেরও কম দূরে, গড়াগড়ি খাওয়া সাদা ঢেউ, সামনের খোলা জায়গা একটা, নদীর দু ধারের পাহাড়ের সারি যেনো ঝাঁপিয়ে পড়ে হামলে খাওয়া লোকের দল। জীবনের কোনো কোনো ব্যাপারটা এমনই। বন্যার সময়ে বন্যা হয়, কেউ জানে না ঠিক কখন বাণ আসে, আর যখন আসে, তখন সবকিছু নিয়ে চলে যায়।

মিন হুয়ে নিজের ভঙ্গিমাটা সামলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে। এমন সময় পিছন থেকে কেউ বাগড়া দিলো, “শও মিং, ঝাঁপিও না -”

মিন হুয়ে সব কথা শুনতেও পেলো না। বৃষ্টির হাহাকারে বাকি সব শব্দ ডুবে গেছে। মিন হুয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো একটা চেহারা দৌড়ে আসছে তার দিকে খুব দ্রুতবেগে। রাস্তার আলোতে হলুদ জ্যাকেটটা খুব স্পষ্ট।

আবার চুন মিয়াও?

মিন হুয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আর ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে।



স্রোত তীব্র। নদীও তেজী খুব। 

মিন হুয়ে সাঁতরাতে পারলো না। যখন ও ডুবে যাচ্ছে তখন ওর শরীরটা গাছের গুঁড়ির মতো দু দিক থেকে গুঁতো খাছে। ও কিছুতেই নদীর স্রোতের সাথে ঘুরে যেতে পারছে না। ও মোটেও ভাবে নি যে ব্যাপারটা এতো যন্ত্রণাদায়ক হবে। চারদিক থেকে জল ঝাঁপিয়ে আসছে। ভরে দিচ্ছে মিন হুয়ের নাক, কান আর মুখ। কয়েক চুমুক জলে বিষম খাবার পর, ও একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলো, ওর মনটা খালি হয়ে গেলো। সব ছাপিয়ে তার বাঁচার ইচ্ছেটাই প্রবল হয়ে উঠলো। ও পা ছুঁড়তে লাগলো জলের ওপরে ভেসে ওঠার চেষ্টায়। কিন্তু ওর জিন্সটা ভিজে আর ভারি। ওর পা দুটোকে ও কোনো ভাবেই ব্যবহার করতে পারছিলো না। ও টের পারছিলো যে ওর চেতনা ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ও ক্রমে ক্রমে ছেড়ে দিলো লড়াইটা। শুধু ওর হাতদুটো জলের মধ্যে এলোমেলো খামচে ধরতে লাগলো যা পাওয়া যায় তাই।

এমন সময় কোথা থেকে একটা হাত বাড়িয়ে কে যেনো ওর মাথাটাকে জলের ওপরে তুলে ধরলো। মিন হুয়ে তক্ষুণি হাঁ করে শ্বাস নিতে গেলো। ওর শরীর জলের মধ্যে ঘুরতে লাগলো, ও জাপ্টে ধরলো হাতের মালিককে। 

মালিক খুব চেষ্টা করলো মিন হুয়ের মুঠি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার। কিন্তু মিন হুয়ে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুপায়ে জড়িয়ে ধরে রাখলো হাতের মালিককে। দুজনেই একসাথে ডুবে যাবে টের পেতেই মিন হুয়ের মাথার ওপরটা টনটন করে উঠলো। মানুষটা ওকে একটা ঘুষি মেরে ওর সামনে কি যেনো একটা বাড়িয়ে দিলো। মিন হুয়ে জিনিসটাকে জড়িয়ে ধরলো অসহায়ভাবে।

একটা লাইফবয়। মানুষটা ওর পাশ দিয়ে সাঁতার কাটছে। লাইফবয়ের দড়ি ধরে টান দিচ্ছে, মিন হুয়েকে পাড়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে।

একটা বিশাল ঢেউ এলো ঝাঁপিয়ে। জলে ঘুরতে লাগলো। মিন হুয়ে খুব জোর দিয়ে জল সরিয়ে দিতে লাগলো আর একটা ঘূর্ণি বানাতে পারলো। কিন্তু একটা ঝটকা স্রোতের ঠেলায় সামনে এগিয়ে গেলো। আতঙ্ক কাটতে মিন হুয়ে টের পেলো চুন মিয়াও ভেসে গেছে। আকাশের বিদ্যুতের ঝলকানিতে ওর চোখে পড়তে লাগলো একটা ঝাপসা চেহারা ওর দিকে সাঁতরে আসতে চেষ্টা করছে আপ্রাণ। 

“চুন মিয়াও! চুন মিয়াও! এই তো আমি।”

মিন হুয়ে ঘুরে সাঁতরাতে লাগলো ঝাপসা চেহারাটার দিকে।

যারা সাঁতার জানে না তারা সহজে জলের মধ্যে দিক ঠাহর করতে পারে না। আর যতো উদ্বিগ্ন হয় তারা, ততো ভুল করতে থাকে তারা। মিন হুয়ে দেখলো চুন মিয়াও ওর থেকে কেবল দূরে আরো দূরে চলে যাচ্ছে, ক্রমশ ভেসে ওঠার সময় কমে যাচ্ছে। কয়েকটা বিদ্যুৎ ঝলকের পরে একেবারে মিলিয়ে গেলো চুন মিয়াও।

চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলো মিন হুয়ে অন্ধকারে। চিৎকার করতে লাগলো সমস্ত জোর দিয়ে। কিন্তু কান খাড়া করে কোনো সাড়া পেলো না। ও কিছুতেই আতঙ্ক এড়াতে পারলো না। আতঙ্ক মৃত্যুর নয়, আতঙ্ক ওর নিজের নির্বুদ্ধিতার। ওর নির্বুদ্ধিতায় এমন একটা মানুষ মুছে গেলো পৃথিবীর বুক থেকে, যার কোনো মতেই মরে যাবার কথা ছিলো না তখন।




~~~~~~~~~~~~

সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96

Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/acknowledgement.html

Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/07/jpda-chapter-02.html


Readers Loved