৫. শিক্ষক হান
যদি শিন ছির সঙ্গে দেখা করাটাই সু তিয়াঁর শেষ ইচ্ছে হতো, তাহলে তার স্বর্গগত আত্মার অনুতাপের কিছুই থাকতো না। বিশেষত যখন তার মৃত্যুযাত্রা ঘটেছে শিন ছির সাথে দেখা করতে যাবার পথেই।
যদি মিন হুয়ের নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য সু তিয়াঁ মরে না যেতো, তাহলে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর দুটো মানুষ ফের পরস্পরকে কাছে পেতো, শিন ছি তার প্রতিশ্রুতি রাখতো, আর সু তিয়াঁর কপাল বদলে যেতো। তার চালচুলোহীন, কষ্টকর, জীবনের দারিদ্র্য ঘুচে যেতো। সবকিছু বেশ ভালো হতো …।
যে খুশির দিন তার অপেক্ষায় ছিলো, সে সবই যেনো উড়ে গেলো।
মিন হুয়ে বার বার ভাবতে লাগলো, কোন যোগাযোগটায় গন্ডগোল?
প্রথমত, তার নিজের মনটাকে এক মূহুর্তের জন্যও নরম করার দরকার ছিলো না। আর তার মোটেই সু তিয়াঁর সাথে একঘরে রাত কাটাতে রাজি হওয়া উচিৎ হয় নি।
দ্বিতীয়ত, সে নিজে যদি মরতেই চেয়ে ছিলো, তবে মিন হুয়ের উচিৎ ছিলো একটা ঠিকঠাক দিন দেখে মরতে যাওয়া। এতো জোরে বাজ পড়ছিলো সেই রাতে যে তার ঘুম ভেঙে গিয়ে ছিলো। স্বাভাবিক ভাবেই সু তিয়াঁরও ঘুম ভেঙে গিয়ে ছিলো। মিন হুয়ে কি আরো কম শব্দ করে ঘর থেকে বেরোতে পারতো না?
তৃতীয়ত, মিন হুয়ে যখন দেখতেই পেয়ে ছিলো যে সু তিয়াঁ তার পিছু পিছু সাঁকোর ওপরে পৌঁছে গেছে, তখন তার নদীতে ঝাঁপ দেবার বদলে ফেরার রাস্তা ধরাই উচিৎ ছিলো।
চতুর্থত, জলে পড়া মাত্র তারা দুজনে আলাদা হয়ে গিয়ে ছিলো। তখনই মহামূল্য লাইফবয়টা ছেড়ে দিয়ে সে নিজে ডুবে মরতে পারতো। কিন্তু মিন হুয়ে স্বার্থপরের মতো লাইফবয়টা আঁকড়ে ধরে রেখে ছিলো নিজের কাছে।
এতদূর ভাবার পরে আরো ভয়ানক একটা সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠলো মিন হুয়ের মনেঃ
সু তিয়াঁ সেদিন মরে গেছে ওর জন্য। সু তিয়াঁর জন্যই সেদিন ও নিজে মরে নি। ও আর মরতেও চায় না এক্কেবারে।
যতো এ কথাটা ভাবতে লাগলো মিন হুয়ে, ততো যেনো অস্থির হয়ে পড়তে লাগলো, ততো সে নিজেকে ক্ষমা করতে অক্ষম হয়ে পড়লো। সে তো শুধুমাত্র একটা নিষ্পাপ জীবন কেড়ে নিয়েছে তা নয়, সে কেড়ে নিয়েছে একটা সুন্দর প্রেম, একটা সুখী জীবন আর আরেকটা মানুষের প্রতীক্ষা।
সময় যে কেটে গেলো সে ব্যাপারে মিন হুয়ের কোনো ধারণা নেই। সে পরের দিন গেলো হাইয়ুআঁ নামের শহরে।
একটা রাস্তার একানে কোণে সে খুঁজে পেলো লংহুই জেলার দু নম্বর শিশুকল্যাণ সংস্থা। একজন সচিব তাকে অভ্যর্থনাও করলো। কম্পিউটারে খুঁজে সে দেখতেও পেলো যে দুটো অনাথাশ্রম সত্যিই জুড়ে দেওয়া হয়ে ছিলো। কিন্তু তাতে একত্র হয়ে ছিলো মূলত অনাথ এবং প্রতিবন্ধী শিশুরা। শিক্ষকরা একত্র হয় নি।
হতাশ হয়ে মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “কেনো?”
সচিবের উত্তরে জানা গেলো, “কারণ এটা একটা খুব ছোটো অনাথাশ্রম। খাতায় কলমে মাত্র তেরোজন কর্মচারী ছিলো। বাকি যারা ছিলো তারা চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করতো বা সাময়িক কাজ করতো। যদিও ইয়াংছেনজেন আর হাইয়ুআঁ গায়ে গায়ে লাগালাগি দুটো শহর, তবুও সে দুটো আলাদা শহর তো বটে। যখন অনাথাশ্রম দুটোকে জুড়ে দেওয়া হয়, তখন অধিকাংশ কর্মচারী অসন্তুষ্ট হয়ে ছিলো। মাত্র তিনজন শিক্ষক শহর ছাড়তে রাজি হয়ে ছিলেন। বাকিরা বদলি হয়ে গিয়েছিলো বা কাজ ছেড়ে দিয়ে ছিলো। যারা বাচ্চাদের সঙ্গে এসে ছিলো তাদের মধ্যে একজনই এখনো কাজ করছেন। তাঁকে আমরা হান লাওশি বলি।”
সু তিয়াঁ তার ডায়েরিতে অনেকজন মাস্টারমশাইয়ের কথা লিখেছে। কিন্তু তাঁদের কারোর পদবী হান নয়। তবুও অনাথাশ্রমে যাওয়াটা একেবারে বৃথা গেলো না। মিন হুয়ে অভ্যর্থানার ঘরে দেখা করলো হান লাওশির সাথে।
শ্রীমতি হানের বয়স পঞ্চাশের ওপরে। ছোটো করে কাটা চুল মাথায়। কালো ফ্রেমের চশমা তাঁর চোখে আর খুব ভদ্র আচরণ তাঁর। মিন হুয়ে তার মনের কথাটা বুঝিয়ে বলা মাত্র, তিনি ঘাড় নাড়তে লাগলেন। আর বললেন, “আমার আবছা হলেও মনে আছে। আবছা, কিন্তু মনে আছে। তখন আমি পুনর্বাসনের ঘরে কাজ করতাম। আমার মূল দায়িত্বটা ছিলো প্রতিবন্ধী শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তুত করা। সু তিয়াঁ বা শিন ছি কাউকেই প্রতিবন্ধী ধরা হতো না। তাদের ইস্কুলে যাবার বয়স হতে, তাদেরকে যথাযথ ক্লাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়ে ছিলো। তারা এক সঙ্গে প্রাথমিক ইস্কুলে যেতো। বেশ কিছুদিন আমার কাজ ছিলো ওদেরকে ইস্কুল থেকে ফেরত আনা। প্রায়ই আমি ওদের ইস্কুলের পড়ার বাইরের অন্যান্য কাজের জন্য মানে খেলার জন্য বা ছবি আঁকার জন্য বা ঐরকম আর পাঁচটা কাজের জন্য নিয়ে যেতাম। আমি ওদের বেশ ভালোই চিনতাম। অনাথাশ্রমটা খুব বড়ো ছিলো না। ওখানে বাচ্চাও ছিলো কয়েকটা মাত্র। আমি রোজই ওদের দেখতাম। ওদের অবস্থা জানতাম।”
মিন হুয়ে একটা সাদামাটা কথা জানতে চাইলো, “হান লাওশি, সু তিয়াঁ অনাথাশ্রমে এসে ছিলো কী করে?”
হান লাওশি বলতে লাগলেন, “ওর তো জন্মদাত্রী মা এসে ওকে ফেরত নিয়ে যায়। বাকিরা ইয়াংছেনজেনের শিশু কল্যাণ সংস্থায় থেকে যায়। যখন সু তিয়াঁ প্রথম এসে ছিলো তখন বছরখানেক ও কোনো কথা বলে নি। আমরা তো ভেবে ছিলাম ও বোধ হয় কানে শুনতে পায় না আর তাই কথাও বলতে পারে না। তাই আমরা ওকে পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে ছিলাম। শুনতে ঠিকই পেত, বোধ হয় আতঙ্কে চুপচাপ হয়ে গিয়ে ছিলো। পরে, আসতে আসতে ও কথা বলতে শুরে করে। তখন ওর মুখ থেকেই আমরা জানতে পারি যে ওকে ছেলেধরায় ধরে ছিলো। ওর সঙ্গে ওর ভাইকেও ধরে ছিলো। পরে দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ও তখন না জানতো ভাইয়ের নাম। না বলতে পারতো মা-বাবার নাম। ও জানতো না …… আমার মনে হয় অনাথাশ্রম থেকে পুলিশে যোগাযোগ করা হয়ে ছিলো। সেই তদন্তকারী পুলিশকর্মীদের সাথেও যোগাযোগ করা হয়ে ছিলো যাঁরা ওর ভাইয়ের খোঁজ করে ছিলেন, যদি ওর ভাই কোথায় আছে সে কথা জানা যায় - এই ভেবে। ঐ পুলিশকর্মীরা জানিয়ে ছিলেন যে ছেলেধরার হাত থেকে উদ্ধার করে আনা বাচ্চাদের মধ্যে কোনো ছেলে ছিলো না, সব মেয়ে। হয়তো ছেলেগুলোকে আগেই বেচে দিয়ে ছিলো ছেলেধরারা। ছেলেধরার দলটা ধরা পড়ে ছিলো। ওদের পালের পান্ডাকে আমি ফোন করে জানতে চেয়ে ছিলাম সু তিয়াঁর ভাইয়ের কথা। কিন্তু সে পুরো বাচ্চা চুরির ব্যাপারটাই অস্বীকার করে।”
মিন হুয়ের পরের প্রশ্ন, “আর শিন ছি? সে কোথা থেকে এসে ছিলো? তাকেও কী ছেলেধরার কবল থেকে উদ্ধার করে আনা হয়?”
হান লাওশি উত্তর দিলেন, “না-না। শিন ছিকে ছেলেধরায় ধরে নি। ওকে ফেলে দিয়ে যায়। জন্মের খুব বেশিদিন পরে নয়, ওকে রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমে একটা কাপড়ের টুকরোয় মুড়ে ফেলে রেখে যায়। একটা কাগজ ছিলো সঙ্গে, তাতে “দয়া করে দত্তক নিন” বা এরকম কিছু লেখা ছিলো।”
মিন হুয়ে জিজ্ঞেস না করে থাকতো পারলো না, “তাহলে ওর নাম শিন ছি দিলো কে?”
হান লাওশি বললেন, “তার নাম শিন ছি। বোধ হয় লাওশি অভিধান থেকে বার করে ছিলেন। আর সু তিয়াঁ কী করে তার নামটা পেয়ে ছিলো? যে পুলিশকর্মী সু তিয়াঁকে উদ্ধার করে ছিলেন তার পদবী ছিলো সু।
হান লাওশি বলে চললেন, “শিন ছিকে যখন প্রথম অনাথাশ্রমে আনা হয়, তখন সবাই খুব অবাক হয়ে ছিলো। ছেলেটা ভারি সুন্দর দেখতে। কোনো সমস্যা কোথাও চোখে পড়ছে না। তার ওপরে ছেলে বলে কথা। তাহলে তাকে ফেলে দিলো কেনো? তারপর যখন ছেলে কাঁদতে শুরু করলো, তখন ওর সারা শরীর নীল হয়ে গেলো, ঠোঁটদুটো হয়ে গেলো বেগুনী। আমি হাসপাতালে দৌড়ে গেলাম শারিরীক পরীক্ষা করানোর জন্য। তখন জানতে পারলাম যে ছেলেটার হার্টের অসুখ আছে, জন্মগত। তখন খুব খারাপ অবস্থা ছেলেটার, তক্ষুণি সার্জারি না করলেই না নয়। তখন চোঙ্গুয়োতে হাতে গোণা কয়েকটা মাত্র হাসপাতালে ওপেন হার্ট সার্জারি হতো। শিন ছিকে বেজিং নিয়ে যাওয়া হয়। এক বিদেশী বিশেষজ্ঞ ছিলেন ওখানে, তিনিই সার্জারিটা করে ছিলেন। আমি শুনেছি ব্যাপারটা বেশ বিপজ্জনক। একটা কয়েক মাসের শিশু - তার বুক কেটে, পাঁজরের হাড়কে করাত দিয়ে কেটে - ডাক্তার জানিয়ে ছিলেন তখনই যে বাচ্চাটার এতো অল্প বয়স যে তাকে একটা সাময়িক ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে মাত্র। পরে বয়স বাড়লে আসল সার্জারিটা করাতে হবে, নাহলে এই বাচ্চা পনেরো বছরের বেশি বাঁচবে না।”
শিন ছির অসুখের ব্যপারে সু তিয়াঁর ডায়েরিতে তেমন কিছুই লেখা নেই। শিন ছি কয়েকবার হাসপাতালে গিয়ে ছিলো এইটুকুই বলা আছে। মনে হয় বাচ্চাটাকে মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা অসুখের ব্যাপারে বিশদে কিছু বলে নি পাছে বাচ্চা দূর্ভাবনায় পড়ে যায়।
মিন হুয়ে ডায়েরির বর্ণনাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনে করতে থাকে আর জিজ্ঞেস করতে থাকে, “সু তিয়াঁ তার ডায়েরিতে লিখেছে যে শিন ছির দৃষ্টিশক্তি ভালো ছিলো না। তাই কি?”
হান লাওশি জানালেন, “দূরের জিনিস দেখতে না পাবার অসুখটাও বংশগত। আমার মনে হয় শিন ছির চোখ ঠিক কতোটা খারাপ ছিলো সেটা বলা মুস্কিল, তবে ওর চশমার কাচগুলো বোতলের নিচের মতো মোটা হতো। ভারি হতো। দামীও হতো বটে। ছেলেটা ভারি দুষ্টু ছিলো। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ওকে সারাক্ষণ টিটকিরি করতো। চশমার কাচগুলো কেবল ভেঙে যেতো। ছেলেটা নিজেই বলত যে ও নারী আর পুরুষের ভেদ করতে পারতো না, তিন মিটার মানে দশ ফুট বা তার বেশি দূর থেকে কাউকে দেখলে। আর দূরত্বটা পাঁচ মিটার বা ষোলো ফুটের বেশি হলে মানুষ আর জানোয়ারে তফাৎ করতে পারতো না শিন ছি।”
একটু হেসে নিয়ে হান লাওশি বললেন, “তবে ছেলেটার ভাগ্য খুলে গিয়ে ছিলো। ওর বয়স যখন বছর তেরো, তখন এক আমেরিকান দম্পতি ওকে দত্তক নিয়ে ছিলেন, ও মেগুওয়াতে চলে যায়। ওখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা বেশ ভালো। এতো দিনে নিশ্চয়ই ওর অসুখ সেরে গেছে। তাই না?”
মিন হুয়ে সম্মতিতে উচ্চারণ করলো, “সম্ভব বটে।”
কিন্তু দুটো বাচ্চার ভাগ্যের এতো তফাৎ হতে দেখে খুব মন খারাপ হয়ে গেলো মিন হুয়ের। ও জানতে চাইলো, “সু তিয়াঁ এখন কোথায়? ও মায়ের কাছে নিজের দেশে ফিরে গিয়ে ছিলো কী করে?”
হান লাওশি এর উত্তরও জানতেন, “সু তিয়াঁর দেশের কোনো আত্মীয় দেশ ছেড়ে বাইরে কাজে বেরিয়ে ছিলো। তারা সবাই খোঁজ করছিলো সু তিয়াঁর। তাছাড়া পুলিশেও নালিশ করে ছিলো সু তিয়াঁর বাড়ির লোকেরা। পুলিশের কাগজপত্রের সঙ্গে আত্মীয়ের বলা নিখোঁজ হবার সময় মিলে যাচ্ছে। তাছাড়াও নিখোঁজ হবার সময়ের ছবিও মিলে গিয়ে ছিলো। সব কিছু দেখে ঠিকই মনে হয়ে ছিলো আমার। তাই যখন তারা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বাচ্চার মাকে আমাদের এখানে নিয়ে এসে ছিলো, তখন মায়ের আনা কাগজপত্র, ছবি সব মিলে গিয়ে ছিলো। শুধু বাচ্চার মুখের আদল নয়, জামাকাপড়ও এক ছিলো। সু তিয়াঁও তখন খুব খুশি হয়ে ছিলো। মেয়েটা ওর মায়ের সাথে ফিরে যায়। চিন্তায় পড়লে -”
মিন হুয়ে সাড়া দিলো, “হুঁ।”
লাওশি বললেন, “সু তিয়াঁর বাড়ির লোক থাকতো একটা দূর্গম পাহাড়ি এলাকায়। অবস্থা সেখানে সবারই বেশ খারাপ ছিলো। বাজার থেকে ওকে আর ওর ভাইকে চুরি করে নিয়ে যায় ছেলেধরারা। মাকে নুডলের সাথে কিছু ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ছেলেধরারা। ওর মা ঘুম থেকে উঠে দেখে যে বাচ্চাদুটোর একটাও নেই। সারা গ্রামের লোক লাগিয়ে বাবা-মা খুঁজতে শুরু করে বাচ্চা দুটোকে, যেখানে সম্ভব, সেখানে। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পায় না। পুলিশে খবর দেবার পরে, পুলিশও অনেক মাস ধরে খুঁজতে থাকে, কিন্তু কোনো খবর পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়, ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিলো সবকিছু। মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকিৎসার খরচ চালানোর পয়সাও ছিলো না। তাই বাচ্চাদের বাবা, তাদের মাকে আত্মীয়পরিজনের জিম্মায় রেখে গ্রাম ছেড়ে বেরোয় কাজ করার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের খোঁজও চালাবে এমনটাই ভেবে ছিলো ওদের বাবা। কিন্তু একবছরের মধ্যে কোনো একটা রাস্তা, সেতু বা বাড়ি তৈরির কাজ করার সময়ে ওদের বাবা মারা যান।”
মিন হুয়ে প্রশ্ন করলো, “তাহলে তার মা যখন সু তিয়াঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসেন তখন তাঁর মনের অবস্থা স্বাভাবিক ছিলো?”
হান লাওশি একটু ভেবে উত্তর দিলেনন, “কেমন করে যে বলি! না, স্বাভাবিক ছিলো না। কিন্তু কথাবার্তা বলতে পারতেন। একটু এলোমেলো বলে ফেলতেন, তবে মেয়েকে দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে ছিলেন। মনের অবস্থাটাও বেশ পরিস্কার হয়ে গিয়ে ছিলো। মা আর মেয়ে - তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদে ছিলো খানিক। তাঁর আত্মীয়রা বলে ছিলো যে তার শরীরও খুব খারাপ। ঘরে তাঁকে দেখাশোনার করার কেউ নেই। সারাদিন আলুথালু হয়ে ভিখিরির মতো পড়ে থাকেন তিনি। একথা জানতে পেরে সু তিয়াঁ খুব উতলা হয়ে পড়ে ছিলো। বাড়ি যাবার জন্য, মায়ের দেখাশোনা করার জন্য আকুল হয়ে উঠে ছিলো। আমরা চেয়ে ছিলাম যে ও এখানে থেকে যাক আরো কিছুদিন। অন্তত সেমিস্টারের পড়াটা করে যাক। হেচিতে তার দেশে বড়ই দূর্দশা যে, সেখানে গেলে ওর আর ইস্কুলে যাওয়া হবে না কিছুতেই। কিন্তু সু তিয়াঁ জেদ ধরে বসে ছিলো। তাছাড়া কয়েকজন আত্মীয়ও ছিলো তার দেশে, যারা ওর দেখাশোনা করতে পারতো। আমি রাজি হয়ে ছিলাম।”
মিন হুয়ে নিশ্চিত হতে চাইলো, “তাহলে শিন ছি অনাথাশ্রম ছেড়ে গিয়ে ছিলো আগে। তার পরে সু তিয়াঁও চলে যায়।”
হান লাওশি নিশ্চিন্ত করলেন, “তিন মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে। এই দুটো বাচ্চার নিজেদের মধ্যে একটা বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। দুজনে সারাক্ষণ একসঙ্গে খেলতো, সারা সপ্তাহ। দুজনকে আলাদা করা যেতো না। যেনো কচি এক ছিংল্যু। দুজনের বয়সের তফাতও এক বছরের কিছু কম ছিলো। শিন ছির বয়সটাই বেশি ছিলো একটু। শারীরিক অসুস্থতার কারণে শিন ছি একটা বছর পরে ইস্কুলে যেতে শুরু করে। তাতেই ও সু তিয়াঁর সাথে এক ক্লাসে পড়তো আরকি। সু তিয়াঁর মনটা বড়ো আর্দ্র, উষ্ণ ছিলো, একদম বাচ্চাবেলা থেকেই। ক্লাসে লাওশি বলে ছিলেন সু তিয়াঁকে শিন ছির খেয়াল রাখার জন্য। শিন ছির চোখের দৃষ্টি দূর্বল ছিলো, ও ব্ল্যাকবোর্ডের লেখাগুলো পরিষ্কার দেখতে পেতো না। সু তিয়াঁকে বলে ছিলেন শিন ছির হয়ে লেখাজোখা করে দিতে। সু তিয়াঁ লাওশির কথাকে রাজাজ্ঞার মতো মনে করে শিন ছির চেলা হয়ে গিয়ে ছিলো, হয়ে গিয়ে ছিলো শিন ছির কাজের লোক।”
মিন হুয়ে বললো, “তার মানে ছেলেবেলা থেকেই ওদের দুজনের খুব ভাব ছিলো?”
হান লাওশি বিশদে বলতে লাগলেন, “ওদের ঝগড়াও হতো। নিশ্চিত বলতে পারবো না কেনো, মনে হয় যে শিন ছির হার্টের অসুখ বলেই হয়তো, ও একটু রগচটা ধরনের ছিলো, অধৈর্য ছিলো। চোখে ভালো দেখতো না বলে প্রায়ই ক্লাসের অন্যান্য ছাত্ররা ওকে খুব টিটকিরি করতো, সেই জন্য ও-ও খুব খিটখিটে মেজাজে থাকতো। মারপিট করতে ওস্তাদ ছিলো। সবাই ওকে ঘাঁটাতে সাহস করতো না। যদি হার্ট অ্যাটাক করে, তবে তো খেতেও পারবে না, হেঁটে চলে বেড়াতেও পারবে না, তাই না? অন্য দিকে সু তিয়াঁ বেশ বাধ্য ছিলো। ওর সঙ্গে থাকার সময় শিন ছি যতই উদ্বিগ্ন থাকুক না কেনো, সু তিয়াঁ পাত্তা দিতো না, খুব বেশি হলে শিন ছিও ওকে অগ্রাহ্য করতো। যদি শিন ছির মাথা গরম হয়ে যেতো, তবে কেবল সু তিয়াঁই ওকে শান্ত করতে পারতো, মাস্টারমশাইরাও পারতেন না।”
মিন হুয়ে মনে মনে ভাবার চেষ্টা করলো যে ছেলেবেলায় শিন ছি নিশ্চয়ই একটা খুদে সর্দার গোছের ছেলে ছিলো। সেই ধারণা থেকেই মিন হুয়ে বললো, “তাহলে ছেলেটা পড়াশোনায় নিশ্চয়ই ভালো ছিলো না?”
হান লাওশি বললেন অন্য কথা, “প্রাথমিক - মাধ্যমিক ইস্কুলের বাচ্চাদের আন্তর্প্রাদেশিক দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য তৈরি করবে শিখিয়ে পড়িয়ে এমন কাউকে আমরা পাই নি। শিন ছি দাবা খেলতে ভালো বাসতো বলে আমরা আন্তর্প্রাদেশিক দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে ওর নাম লিখিয়ে দি। উদ্দেশ্য ছিলো যাতে ও চ্যাম্পিয়নশিপে যায় আর খেলে। আমরা আশা করি নি যে ও একটা আন্তর্প্রাদেশিক চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি নিয়ে ফিরবে। আমরা সবাই চমকে উঠে ছিলাম। আমার মতে ছেলেটা অন্যমনস্ক থাকতো ক্লাসে, পড়া শুনতোই না মন দিয়ে। নাহলে ছেলেটার ভবিষ্যত উজ্জ্বল ছিলো।”
মিন হুয়ে কৌতুহল প্রকাশ করলো, “আর সু তিয়াঁ? তার শখ ছিলো কিসের?”
হান লাওশি জানালেন, “সে খেলাধুলো ভালোবাসত। সাঁতার কাটা, দৌড়োনো, লং জাম্প, এই সবই তার ভালো লাগতো। যখন ওর আর কিছুই করার থাকতো না, তখন ও মাঠে খেলতে ভালো বাসতো। বেশ কিছুদিন ও পিংপং খেলতো খুব উৎসাহ নিয়ে। সব সময়ে কলকল করতো অলিম্পিকে যাবে বলে। শিন ছিকে ওর সাথে খেলতে হতো। কিন্তু শিন ছির চোখ ভালো ছিলো না। একটা খেলার পরে, ও সারা মাঠে সু তিয়াঁকে খুঁজতো আর বলটা খুঁজতো।”
বাল্যপ্রেমিক যুগলের ছেলেবেলার সব মজার মজার ঘটনার কথা কল্পনা করে মিন হুয়ে না হেসে পারলো না, “ফঃ”। তারপর জিজ্ঞেস করলো, “কোনো ভাবে শিন ছির অনাথাশ্রমে যোগাযোগ করার উপায় ছিলো না?”
হান লাওশি মাথা নেড়ে বললেন, “না-না। সে সব দশ বছরেরও বেশি আগেকার কথা। শিন ছি অনাথাশ্রম ছেড়ে যাবার পরে কোনো দিনও আসে নি। ভেবে দেখো, একটা ছেলে, তার হার্টের অসুখ ছিলো, চোখের দৃষ্টি সাংঘাতিক খারাপ যার, একটা অচেনা দেশে, ভাষার বাধা ছিলো, আচার ব্যবহারের ব্যাপক তফাত - ওর জীবন নিশ্চয়ই খুব কঠিন ছিলো, ওর মানিয়ে নিতে নিশ্চয়ই অনেক সময় লেগে ছিলো, তাই না? যখন ও সব কিছুর সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, ততোদিনে এখানকার অনাথাশ্রমটাই উঠে গেছে।”
মিন হুয়ে তর্ক করলো, “কিন্তু যাঁরা শিন ছিকে দত্তক নিয়ে ছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের ঠিকানা, ফোন নম্বর সব লিখে ছিলেন যখন কাগজপত্রের কাজ করছিলেন।”
হান লাওশি সোজাসুজি বললেন, “তখন অনাথাশ্রমে কাজ ছিলো অনেক কিন্তু কাজ করার লোক খুব বেশি ছিলো না, আর পরিচালনার ব্যবস্থাটাও বেশ অগোছালো ছিলো। নথিপত্র গুছিয়ে রাখার কোনো পেশাদারী পদ্ধতি ছিলো না। তারপর এতো বছরে বার বার ঠাঁইনাড়া হতে হতে অনেক কাগজ হারিয়েও গেছে। অনেকেই আগে চেষ্টা করেছে কাগজপত্র খুঁজে দেখতে, কিন্তু অনেকেই কিচ্ছু খুঁজে পায় নি। তাছাড়া কারুর ঠিকানা বা ফোন নম্বর তাদের গোপণীয় তথ্য। সে সব গোপণ রাখাই বাঞ্ছনীয়। তাই তুমি চাইলেই, আমাদের আপিসের লোকেরা তোমাকে সে সব তথ্য দেবে না।”
ক্লাসে যাবার ঘন্টা বেজে উঠলো। হান লাওশি হাতের ঘড়ির দিকে তাকালেন। বললেন, “আর কোনো প্রশ্ন আছে? আমাকে ক্লাসে যেতে হবে এবার -”
মিন হুয়ে বললো, “শেষ প্রশ্ন, শ্রীমতি হান, আপনি কি জানেন কোথায় শিন ছি আর সু তিয়াঁ প্রথমবার আইসক্রিম খেয়ে ছিলো? আমি শুধু জানি যে সেখানে একটা সাঁকো আছে।”
অনাথাশ্রমের বাচ্চারা সাধারণত আইসক্রিম খায় কোথায়? হান লাওশি ভ্রূ কুঁচকে ভাবলেন খানিক। তারপর বললেন, “যদিও এ বাচ্চারা অনাথ, তবুও আইসক্রিম খাবার সুযোগ অনেক আছে। কোনো বড়ো অনুষ্ঠান যেমন সিনেমা দেখা, বসন্তের বেড়ানো, স্মরণসভা, অন্য যে কোনো উৎসব এসবের সবকটাতেই বাচ্চারা আইসক্রিম খেতে পারে।”
মিন হুয়ে যুক্তি দিয়ে উত্তর পাওয়ায়র চেষ্টা করলো, “প্রথমবার আইসক্রিম খেয়ে ছিলো মানে তারা নিশ্চয়ই তখন খুবই ছোটো ছিলো।”
হান লাওশি হতাশ করলেন, “দশ বা কুড়ি বছর আগের কথা। অনেকবার না হলেও বছরে বেশ কয়েকবার আইসক্রিম খাবার সম্ভাবনা থাকে। কেউ জানে সু তিয়াঁ কোথায় প্রথমবার আইসক্রিম খেয়ে ছিলো? কে মনে রাখে বলো দেখি? “
মিন হুয়ে তার নিজের নোটবুক থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে তাতে নিজের মোবাইল নম্বর লিখে সেটা হান লাওশির হাতে দিয়ে বললো, “আমাকে এতো কথা বলার জন্য ধন্যবাদ। যদি আর কিছুর কথা মনে পড়ে, বিশেষ করে, আইসক্রিমের ব্যাপারে, তাহলে আমাকে ফোন করবেন।”
যদিও হাইয়ুআঁ শহরের খোঁজখবরে আসল কথাটাই জানা গেলো না, তবুও আরেকটা দৃষ্টিকোণ থেকে সু তিয়াঁ আর শিন ছির জীবনের ছবি দেখা গেলো। আলাদা আলাদা লোকে আলাদা আলদা চোখে যে যেমনভাবে দেখেছেন তেমনভাবেই বলেছেন, তবুও সব কথাগুলোই একে অপরের পরিপূরক। শিন ছির সাথে সু তিয়াঁর অতীত যেনো কোনো নিপুণ চিত্রকরের হাতে আঁকা কালি কলমের ছবি। কয়েকটা আঁচড়ের পরে, আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মিন হুয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করলো এক বালককে যার চোখে মোটা পুরু কাচের চশমা, রুগ্ন মুখ আর রেগে গেলেই ঠোঁটগুলো যার বেগুনি হয়ে যায়।
অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে তার প্রতিশ্রুতি না রাখতে পারারঃ
সে হয়তো দেখা করার সময় পর্যন্ত বেঁচেই নেই
অন্য প্রেম হয়েছে
সে যদি অসুস্থ থাকে, তবে সে হয়তো নিজেকে অন্যের সামনে আনতে লজ্জা পাচ্ছে
অথবা সবটাই ছেলেবেলার খেয়াল, এখন আর তার কিছু মনেই নেই
মিন হুয়ে ফিরে গেলো ইয়াংছেনজেনে এই আশা করে যে অনাথাশ্রমের আরো কর্মীদের সাথে দেখা হতে পারে, দেখা হলে সু তিয়াঁর আরো খবর পাবে। কয়েকজনকে খুঁজেও পেলো। কিন্তু বিশেষ কিছু জানা গেলো না। হান লাওশির থেকে বেশি কেউই জানে না বলে দেখা গেলো। কারুর মনেই সু তিয়াঁ সম্পর্কে বিশেষ কোনো ছবি গাঁথা নেই। তবে সবাই একটাই কথা কেবল মনে রাখতে পেরেছে যে সু তিয়াঁ সারাক্ষণ শিন ছির সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকতো। সবাই শিন ছির প্রশংসায় পঞ্চমুখ কারণ ছেলেটা দাবার চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ছিলো। খবরটা বেশ সাড়া জাগিয়ে ছিলো অনাথাশ্রমে, এমনকি প্রাইমারি ইস্কুলেও।
এই সমস্ত মানুষ যাঁরা শিন ছি আর সু তিয়াঁর কথা মিন হুয়েকে বলছিলেন তাঁদের অনেকের কথাই বেশ পরস্পরবিরোধী। কেউ বললেন সু তিয়াঁ বেশ হাসিখুশি ছিলো। তো অন্য কেউ বললেন সু তিয়াঁ খুব সাদামাটা ছিলো। একজন বললেন শিন ছি খুব দুষ্টু ছিলো, তো আরেকজন বলেলন, শিন ছি খুব উদ্ধত ছিলো। এক কথায় মেয়েটা ছিলো সাদামাটা, অচেনার ভিড়ে মিশে থাকা একজন, আর ছেলেটা মুখে মুখে কথা কইতো, যাকে সহজে শিক্ষা দেওয়া যেতো না। সবাই জানতো যে তারা দুজনে এক সাথে থাকতো, রোজ, তারা ইস্কুল যেতো এক সাথে, খেতো এক সাথে, খেলতো এক সাথে, তাদের ভাবসাব দেখে মনে হত তারা যেনো প্রেমিক যুগল।
দিন তিনেক ধরে ইয়াংছেনজেনে এক নাগাড়ে সু তিয়াঁর খোঁজখবর করার পরে চতুর্থ দিনে হঠাৎ করে মিন হুয়ে অসুখে পড়লো। সর্দি, জ্বর, কাশি - তার সাথে অনেক দিনের মানসিক অবসাদ - দিন তিনেক মিন হুয়ে বিছানায় পড়ে রইলো। প্রথমে একটা হোমস্টেতে। পরে জ্বর খুব বেড় যাওয়ায়, শরীরে নুনের আর জলের ভারসাম্য পূরণের জন্য মিন হুয়েকে হাসপাতালেও যেতে হয়ে ছিলো। চার দিনের দিন থেকে মিন হুয়ের শরীর একটু ভালোর দিকে গেলো। মিন হুয়ে সেদিন হাসপাতাল থেকে হোমস্টেতে ফিরে গেলো। একদিনের মধ্যে মালপত্র গুছিয়ে ট্রেনে চেপে বেরিয়ে পড়বে এমনটাই ইচ্ছে ছিলো তার।
ঠিক বেরোবার মুখে একটা ভয়েস মেসেজ পেলো, ঝাও য়িং মেই-এর থেকে। য়িং মেই বলছে, “বন্ধু, একটা ফ্যামিলি সার্চ ওয়েবসাইট থেকে একজন ল্যান জিন গতে ফোন করে ছিলো চুন মিয়াও-এর খোঁজে। পাকে চক্রে ফোনটা আমিই ধরে ছিলাম। তারা জানিয়েছে যে তারা একটা সম্ভাবনার খবর পেয়েছে। চুন মিয়াও-এর ভাই-এর বোধ হয় হদিশ পাওয়া গেছে। যে ফোন করে ছিলো সে আমাকে ঠিকানা দিয়েছে একটা আর একটা ফোন নম্বরও দিয়েছে। বলেছে যে এক্ষুণি যেনো চুন মিয়াওকে বলি ওদের সাথে যোগাযোগ করতে।”
মিন হুয়ে তখনই ফোন করে নিলো য়িং মেইকে, “তুমি কি ওদের বলেছো যে চুন মিয়াও হারিয়ে গেছে?”
য়িং মেই বললো, “না। তুমি তো বলে ছিলো যে তুমি চুন মিয়াও-এর আত্মীয়দের খুঁজে বার করতে চাও। তাই না? আমি যদি বলি চুন মিয়া নিজেই হারিয়ে গেছে, তাহলে,আমার আশঙ্কা, ওর ভাইকে খোঁজার চাপটা কেউ নেবে না আর।”
য়িং মেই ফোনে বেশ জোর দিয়েই বললো, “তাছারা আমরাও তো শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত নই যে চুন মিয়াও মারাই গেছে, তাই না?”
মিন হুয়ে যুক্তিটা মেনে নিলো, “সেটা ঠিকই।”
তারপরে বললো, “সে যা হোক, ফ্যামিলি সার্চ ওয়েবসাইটের কর্মীর সাথে আমি যোগাযোগ করবো কি করে? তোমার কাছে ওঁদের ফোন নম্বর আছে?”
য়িং মেই চটপট জানালো, “হ্যাঁ। আমি তোমাকে এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফ্যামিলি সার্চ ওয়েবসাইটে চুন মিয়াও যে নামটা ব্যবহার করতো সেটা হলো সু তিয়াঁ।”
এক মুহূর্তের জন্য মিন হুয়ে থমকে গেলো। আগে যতো কথা হয়েছে, কখনোই য়িং মেই অনাথাশ্রমের কথা বা ফ্যামিলি সার্চ ওয়েবসাইটের কথা বলে নি। এমন মনে হয়ে ছিলো যে চুন মিয়াও কোনো দিন য়িং মেইকে বলেই নি যে ও কিছুদিন অনাথাশ্রমে ছিলো বা ওর ভাই হারিয়ে গেছে যাকে ও খুঁজছে। সেই জন্য মিন হুয়ে প্রশ্ন করলো, “তুমি জানলে কি করে যে চুন মিয়াও-এর ফ্যামিলি সার্চ ওয়েবসাইটে চুন মিয়াও যে নামটা ব্যবহার করতো সেটা হলো সু তিয়াঁ?”
য়িং মেই-এর সাথে কথা শেষ করার তিন মিনিটের মধ্যে মিন হুয়ে-এর ফোন আবার বাজল। এবার শ্রীমতী হান ফোন করেছেন। বললেন, “শও মিন, তুমি আমাকে মনে করতে বলে ছিলে না যে কোথায় সু তিয়াঁ আর শিন ছি প্রথমবার আইসক্রিম খেয়ে ছিলো। আমার মনে পড়ে গেলো একটা কথা। অনেক দিন আগে, ইয়াংছেনজেনে একটা সংস্থা ছিলো ‘লাভ ভলান্টিয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ নামে। তারা হাসপাতালে স্মরণসভা আয়োজন করতো সাধারণত। তারা অনেক সময় অনাথাশ্রমের বাচ্চাদের বেড়াতে নিয়ে যেতো। বাচ্চারা খুব আনন্দও পেত। অনেক বাচ্চাই বার বার গেছে ওদের সাথে। সংস্থাটা চালান যিনি তাঁর পদবী ইয়াং, পুরো নাম ইয়াং ছিয়ঁ। বেশ সুযোগ্য পরিচালক ছিলেন তিনি। তুমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারো। তিনি তোমাকে কোনো সূত্র দিতে পারেন।”
মিন হুয়ে ফোন রেখে দিলো, কম্পিউটার চালু করলো, ইন্টারনেটে এক মিনিটের মধ্যে খুঁজে বার করলো লাভ ভলান্টিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট। ইয়াং ছিয়ঁকে ফোন করলো। তিনি ওখানেই ছিলেন।
ইয়ং ছিয়ঁ বললেন, “...... আইসক্রিম? সে তো বেড়াতে যাবার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যখনই আমরা বাচ্চাদের বাইরে নিয়ে যাই খেলার জন্য, তখনই ওদেরকে আমরা আইসক্রিম কিনে দি। সবাই ভালোবাসে।”
মিন হুয়ে আরো জানতে চায়, “আপনি কি মনে করতে পারবেন যে ঠিক কোথায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন ওদের?”
ইয়ং ছিয়ঁ জানালেন, “নিশ্চয়ই মনে আছে। বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে গেলে তো আর বেখেয়ালে যাওয়া চলে না। আমরা সাধারণত নিরাপদ জায়গা বেছে বেড়াতে যাই। খান তিনেক জায়গা ছাড়া কোথাও আমরা যাই না।”
মিন হুয়ে আরো সরাসরি প্রশ্ন রাখে, “এইসব জায়গার কোনটার কাছে একটা সাঁকো আছে?”
ইয়ং ছিয়ঁ এক নিমেষে উত্তর দিলেন, “সে তো ইয়ে হুয়া হু ফেংজিঙ্গ ছু। সেখানে একটা ইয়ং’আন সাঁকো আছে। সাঁকোর পাশে একটা খেলার মাঠ আছে। ভেতরে একটা আইসক্রিমের দোকান আছে। এই জায়গাটা আশেপাশের প্রাইমারি ইস্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে বসন্তের বেড়ানোর জন্য প্রথম পছন্দ।”
মিন হুয়ে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে জানতে চায়, “সাঁকোটা এখনো আছে?”
ইয়ং ছিয়ঁ অনায়াসে জানালেন, “হ্যাঁ। ওটা মিং রাজাদের সময়ের পাথরের খিলান দেওয়া সাঁকো - একটা জাতীয় মুখ্য সাংস্কৃতিক অবশেষ রক্ষণ বস্তু। কেনো থাকবে না সাঁকোটা? একটা ইয়ো লেয়ুঅ্যানও আছে ওখানে। আইসক্রিমের দোকানও ওখানে আছে। আমি তো গত মাসেই ওখানে গিয়ে ছিলাম।”
ফোনটা রাখার পরে মিন হুয়ে মনের গহনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শিন ছি ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান। ও যদি অনাথাশ্রমে দেখা করার কথা ভাবতো, তাহলে তো হতবাক হয়ে যেতো, তাই না?
মিন হুয়ে যতক্ষণে লি চুন মিয়াও কিংবা সু তিয়াঁর সাদা টিশার্ট পরে এনামেলের কাপ হাতে ইয়ং’আন সাঁকোর দিকে রওয়ানা দিলো ততক্ষণে দুপুর একটা বেজে গেছে। বুনোফুল হ্রদ নিসর্গ এলাকা ইয়াংছেনজেনের উত্তরের পাহাড়ি এলাকায়। দুঘন্টা লাগে ট্যাক্সিতে। অবাক হবার কিছু নেই যে মিন হুয়ে জায়গাটা সেদিন খুঁজে পায় নি। জায়গাটা তো শহরের বাইরে।
শিন ছির সঙ্গে সু তিয়াঁর দেখা করার কথা ছিলো জুলাই মাসের সাত তারিখে। তার পরে আরো নটা দিন কেটে গেছে মিন হুয়ে জায়গাটাতে যেতে যেতে।
মিন হুয়ের হিসেব মতো শিন ছির উদয় হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সে অনেক্ষণ যাবে কি যাবে না ভেবে দ্বিধায় জেরবার হয়ে যাচ্ছে। শেষে চলেই গেলো জায়গাটা কেমন সেটা নিজের চোখে দেখতে, আর একটা আইসক্রিম কিনেও খাবে ভাবলো।
দেরি হলেও জায়গাটা মিন হুয়ে খুঁজে পেলো। জায়গাটা দেখার পর তার মনে আর কোনো অনুতাপ রইলো না।
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়। পাহাড়ের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা, আরামের। যদিও সপ্তাহান্ত নয়, তবুও অনেক লোক বেড়াতে এসেছে। ইয়ং’আন সাঁকোর কাছের পার্কিং লটটা নানান ধরনের ট্যুরিস্ট বাসে ভর্তি। খেলার মাঠটা সাঁকোর পাশেই খোলা জায়গায়। অনেকটা এলাকা নিয়ে ইয়ো লেয়ুঅ্যান, সেখানে স্লিপ আছে, দোলনা আছে, ট্র্যামপোলিন আছে, বাম্পার কার আছে, ক্যারোসৌল আছে … সবই আছে। তার পাশে জলখাবারের দোকানের সারি। তার মধ্যে সাঁকোর সব চেয়ে কাছেরটা আইসক্রিমের দোকান। ক্রিম আর ক্যারামেলের গন্ধে বাতাস ম ম করছে।
অসাবধানে মিন হুয়ে চোখ নামাল আর দেখলো যে ও একটা ম্যানহোলের গোল চাকতি ঢাকার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। কালো ঢালাই লোহার ঢাকাটাতে উদ্ভট মাকড়শার জালের নকশা কাটা আছে। মধ্যখানে লেখা আছে ‘বৃষ্টি’।
ওর মনে হলো যে ও নকশটা কোথায় যেনো দেখেছে। হঠাৎ মনে হলো যে ওর পরণের টিশার্টের নকশাটা যেনো ম্যানহোলের ঢাকার নকশা থেকে তোলা। কেবল নকশার অর্ধেকটা তোলা হয়েছে, তাই নকশাটা পুরো গোল নয়, গোলের অর্ধেক।
বেশ মজার ব্যাপার।
যদি মিন হুয়ে-এর অনুমান ঠিক হয়, তবে বাকি অর্ধেকটা আরেকটা টিশার্টে আছে।
বেশ বুদ্ধিদীপ্ত কায়দা।
সু তিয়াঁ, শিন ছি, তারা কি খেলা যে খেলছে?
মিন হুয়ে আইসক্রিমের দোকানে গেলো। একটা সিঙ্গল স্কুপ সানডি নিলো, কমলালেবুর গন্ধ দেওয়া, ওপরে চকোলেট মাখানো আর কুঁচো বাদাম ছড়ানো। তারপর আবার ফিরে এলো পাথরের সাঁকোতে।
রোদ বেশ চড়া তখন। তিনটে কি পাঁচটা পথচারী তখন সাঁকোর ওপরে। সে সাঁকোতে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখতে লাগলো।
মাত্র দুটো ছেলে ছিলো তাদের কারুরই বয়স উপযুক্ত নয়। হান লাওশির হিসেব অনুযায়ী শিন ছির বয়স এখন ছাব্বিশ। তাছাড়া মিন হুয়ে জানে না যে শিন ছি কেমন ধরনের জামাকাপড় পরে আসবে। তার মতো সাদা টিশার্ট পরে আসবে কিনা, হাতে একটা এনামেলের জলের গ্লাস থাকবে কিনা, সাঁকোর চারপাশে দেখতে থাকবে কিনা, খুঁজতে থাকবে কিনা গুপ্তচরের মতো …।
একমাত্র নিশ্চিত ব্যাপার হলো যে তার চোখে মোটা কাচের চশমা থাকতে পারে। কারণ সে দূরের জিনিস মোটে দেখতে পায় না। মিন হুয়ে তাই মন দিলো যতো জোয়ান ট্যুরিস্ট চোখে চশমা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের দিকে।
দেখার সময়ে তার নিজের অযৌক্তিক আচরণে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। দশ মিনিট কাটতে না কাটতেই ওর ব্যাপারটা বন্ধ করে কেটে পড়তে ইচ্ছে করছে।
পাহাড়ের ওপরের ঠান্ডায় ওর কাঁপুনি ধরে গেলো।
এমন সময় একজোড়া ঠান্ডা হাত ওর পিছন থেকে এসে ঢেকে দিলো মিন হুয়ের চোখ।
চমকে উঠে মিন হুয়ে চেঁচাতে গেলো। এমন সময় একটা আনন্দভরা স্বর তার কানে বলে উঠলো, “তিয়াঁ তিয়াঁ, অবশেষে এবার তোর পালা।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/07/jpda-chapter-04.html
Link to following Post in the Series :