৭০. পাল্টা হাওয়া
নিয়ম অনুসারে কর্মীদের কাজ ছাড়ার তিরিশ দিন আগে এইচআরকে নোটিস দিতে হয়।
বাড়ি ফিরেই, একদম দেরি না করে, মিন হুয়ে কম্পিউটার চালু করে দিলো, একটা আনুষ্ঠানিক পদত্যাগপত্র লিখে ইমেল করে দিলো এইচআর ডিরেক্টরকে। চিঠিটাকে ছেপে নিয়ে সই করলো, সই করা চিঠিটা স্ক্যান করে ইমেলের অ্যাটাচমেন্ট করে পাঠিয়ে দিলো।
জিএস২.০-এর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট হয়েছে অক্লেশে। ওর আর টিমের সবার প্রচুর নতুন ধারণা ছিলো। ওরা আসলে অনেক কাজ করতে চেয়ে ছিলো। কিন্তু এবারে সে সব ওরা ছেড়েই দিয়েছে। ওরা নিজেরাই নিস্পৃহ হয়ে পড়েছে, ছেড়ে দিতে হয়েছে ওদের।
তাড়াহুড়ো করে এক বাটি ইন্সট্যান্ট নুডল্ খেয়ে নিয়ে, মিন হুয়ে কোম্পানির দেওয়া ল্যাপটপটা খুলে নিয়ে চালু করে দিলো। লিখতে শুরু করলো হ্যান্ড ওভার ডকুমেন্টঃ কোডে শেষ কী পরিবর্তন করেছে, নথিপত্র জমা দেওয়া এবং জমা করে রাখার ব্যবস্থা কী, ওর নিজের কাজের সারংশ, বেছে রাখা ফ্লো চার্ট, ফ্রেমওয়ার্কের নকশা, ডিপ্লয়মেন্ট ফাইলস্, আইপিস্, ইউজার নেম, যতো রকম যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সে সবের পাসওয়ার্ড …
শেষে সমস্ত ব্যক্তিগত ইমেল মুছে দিলো, মুছে দিলো সমস্ত চ্যাট, ব্রাউজারের কুকিস ইত্যাদি যা ছিলো কম্পিউটারে।
এইচআর উত্তর দিলেন যে তিনি পদত্যাগ পত্র পেয়েছেন। ওকে বললেন যে সোমবারে কোম্পানিতে গিয়ে আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিটা সেরে নিতে।
******
সকাল নটা বাজার আগেই তিয়াঁয়িং শান পৌঁছোতে হবে বলে পরের দিন সকালে মিন হুয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লো তাড়াতাড়ি।
ও জায়গাটাতে কোনো দিন যায় নি আগে, তাই ও জানেও না জায়গাটা কতোটা দূরে। ও ম্যাপ খুললো আর দেখতে পেলো যে শুধু যেতেই লাগবে দেড় ঘন্টা। বিনচেং-এর উত্তরে অনেক পাহাড় আর জলা আছে, কিন্তু জায়গাটার বিশেষ উন্নতি হয় নি। আশেপাশে মাত্র কয়েকটা গ্রাম আছে। মনে হয় জায়গাটা জনশূণ্য।
চট জলদি স্নান সেরে, হালকা মেকআপ করে নিলো। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা দেখে ও একটা মাথা গলানো ক্যামেল লং সোয়েটার পরে নিলো, তার সঙ্গে মানানসই মোটা জিনস্ পরে নিলো, একটা জ্যাকেট পরে বাইরে এলো।
মাথা গলানো ক্যামেল লং সোয়েটার |
ট্যাক্সি চেপে তিয়াঁয়িং শানের চূড়ার কফির দোকানে পৌঁছোতে সকাল আটটা পঞ্চাশ বেজে গেলো। জায়গাটা মোটেই “জনশূন্য” নয়, বরং অনেক লোক বেড়াতে এসেছে আর বসে আছে ওখানে। জিজ্ঞেস করতে ও জানতে পারলো সকাল নটা থেকে এগারোটা হলো প্যারাগ্লাইডিং-এর জন্য সেরা সময়। এটাই বিনচেং-এর একমাত্র প্যারাগ্লাইডিং বেস। ব্যবসার ব্যাপক রমরমা অবস্থা।
একটা টেবিল খুঁজে নিয়ে বসলো, চারপাশে দেখতে লাগলো, একটা লম্বা লোক সোজা এলো ওর কাছে, “মিন হুয়ে শওজিয়ে, তাই তো?”
“হ্যাঁ। আমিই সে।”
“আমার নাম ছিন রুই, আমি শিন ছির বন্ধু।”
“আপনি জানলেন কী করে? এইটা আমিই?”
“আমি ছবি দেখেছি।”
দুজনে বন্ধুর মতো করমর্দন করলো। ছিন রুই এককাপ কফি আর এক প্লেট জলখাবার বললো মিন হুয়ের জন্য। ওকে একটা ব্যক্তিগত ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো, আর সহজে কথা বলতে লাগলো।
সত্যিই শিন ছির নজর মোটেই খারাপ নয়।
ছিন রুই লম্বা, সুদর্শন, আর শক্তিশালী। ও য়িন শুয়ের মতো। ও-ও একজন পেশাদার খেলোয়াড়। ও একবার ওয়ার্ল্ড ক্লাস সিঙ্গল কায়াকে রানার্স আপ হয়ে ছিলো। সব রকমের ঘরের বাইরের খেলা খেলতে ও পছন্দ করে। এখন ও প্যারাগ্লাইডিং বেসের প্রধান প্রশিক্ষক।
“আপনার সঙ্গে শিন ছির আলাপ হলো কী করে?”
জানতে চাইলো মিন হুয়ে।
“উনি আর আমি এই বেসে টাকা লগ্নি করেছি। আমরা প্রায়ই একসাথে ব্যবসা করি, তবে আমরা খুব ঘনিষ্ঠ নই।”
“হুহ্?”
“আমরা বেশির ভাগ সময়েই ব্যবসার প্রচার নিয়ে কথা বলি, ব্যবসার ব্যবস্থাপণা নিয়ে কথা বলি, আর শিন ছি নিজের সম্পর্কে প্রায় কিছু বলেই না। আপনি ওর বন্ধু, হয়তো আপনি ওর ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন।”
“না, আমিও তেমন কিছু জানি না।”
“তাই ও যখন হঠাৎ করে বললো যে ও কারুর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিতে চায়, তখন আমি খুব অবাক হয়ে ছিলাম। আমার ধারণা, ও এরকম কিছু কখনোই করবে না।”
মিন হুয়ে জানে না কী করা উচিৎ। এসে পড়েছে যখন, এখন গুলিটা দাঁতে চেপে ধরে ওকে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে। আরো আধঘন্টা পরে ছিন রুই সম্পর্কে ওর ধারণা একটু একটু করে ভালোর দিকে গেলো। দুজনের অনেকগুলো শখই একরকম, যেমন ভিডিও গেমস্, ব্রিজ, লেগো, মুভিস্ …মিন হুয়ের মতোই ছিন রুই অভিজ্ঞ ওয়ারক্র্যাফট খেলাতে। দুজনেই মা-বাবার একমাত্র সন্তান, দুজনেই মশলাদার খাবার খেতে ভালো বাসে আর পছন্দ করে দুধ চা …
কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গগুলো বাস্তবে এলো।
“শিন ছি বলেছে যে আপনার একটা ছেলে আছে।”
প্রশ্ন করলো ছিন রুই।
“হ্যাঁ, তিন বছরের বেশি বয়স।”
“সু ছনের সমবয়সী?”
“সু ছন আমার ছেলে।”
ছিন রুই চমকে উঠলো, “শিন ছি তোমার প্রাক্তন বর?”
“ওহ্, না, না, আমরা কোনো দিন বিয়ে করি নি … বিবাহিত নই … কিন্তু দূর্ঘটনাবশত একটা বাচ্চা হয়েছে আমাদের।”
ও অনেক চেষ্টা করলো লুকোতে যে ও ভীষণ অবাক হয়েছে, কিন্তু ওর গলার স্বরে অপ্রস্তুতভাবটা রয়ে গেলো, “বুঝেছি।”
“শিন ছি বলে নি আপনাকে?”
“না, শুধু বলেছে যে আপনি ওর বন্ধু আর আপনি আইটিতে কাজ করেন।”
“ও হয়তো খুব অপ্রস্তুত বোধ করেছে তাই আপনাকে বলতে পারে নি।”
“ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করি নি। আপনার ছেলে ভীষণ সুন্দর, শিন ছি ওকে এখানে নিয়ে এসেছে দু বার। আমরা সবাই ওকে খুব পছন্দ করি।”
মিন হুয়ের এর আগের সমস্ত ব্লাইন্ড ডেটে যেই ও বলেছে যে ওর একটা ছেলে আছে, অমনি সমস্ত সম্ভাবনা মরে গেছে। বেশ বিরল ব্যাপার যে ছিন রুই ছেলের ব্যাপাটা সইতে চাইছে। তাছাড়া ও সু ছনকে পছন্দও করে।
“আমার পরিস্থিতিও একটু আলাদা। আপনাকে সেটা আগে থেকে বলে দেওয়াই ভালো। আমি জানি না আপনি কিছু মনে করবেন কিনা।”
ছিন রুই গলা পরিস্কার করে নিলো।
“আপনারও কী ছেলে আছে?”
“না, আমি অবিবাহিত।”
“কী পরিস্থিতি?”
“যদি আমরা বিয়ে করি, তবে আপনি কী আমার মা-বাবার সঙ্গে থাকতে পছন্দ করবেন?”
মিন হুয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো, “আপনার মা-বাবা … ওঁদের কী শরীর খুব খারাপ তাই আপনার সঙ্গে থাকেন যাতে ওঁদের যত্ন নিতে পারেন?”
“ওঁদের দুজনেরই স্বাস্থ্য ভালো আছে। দুজনেই এখনো খেলাধূলো করেন। বাবা সফ্টবল খেলেন, মা ভলিবল খেলেন। আর আমাদের পরিবারটাই খেলাধূলোর। ছোটোবেলা থেকেই আমার মা-বাবা আমাকে তালিম দিয়েছেন। ওঁরা আমার ব্যাপারে ভীষণ কড়া। আমাকে ওঁরা নিজেদের জীবনের থেকেও বেশি ভালো বাসেন। আমাদের পরিবারটা খেলাধূলোর প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আর আমি কলেজে পড়ার সময়েও ডরমিটরিতে থাকি নি। কলেজ পাশ করার পরে, আমি প্রাদেশিক দলে খেলতাম।আমাদের বাড়িতে চারটে শোবার ঘর আর দুটো দালান আছে। অনেক জায়গা থাকার জন্য।”
“তাহলে আপনি –”
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “কতো দিন মা-বাবার সঙ্গে থাকবেন বলে ঠিক করেছেন?”
“ওঁদের পেনসন ফুরোনো পর্যন্ত।”
এক মূহুর্তের জন্য মিন হুয়ে চমকে উঠলো। মিন হুয়ে কিচ্ছু মনে করে নি বয়স্ক মা-বাবার সঙ্গে বাস করার ব্যাপারটাতে। কিন্তু ওর বিবরণ শুনে মিন হুয়ের ধারণা হলো যে এই লোকটা একেবারেই নিজের যত্ন নিতে পারে না জীবনে। মিন হুয়ে নিজে একজন মা, ফলে ও না হেসে পারলো না।
ও তখনই বুঝতে পারলো আর বললো, “তুমি যদি কিছু মনে না করো, তবে আমরা কেবল বন্ধু হতে পারি। ঠিক আছে। আমি জানি যে অনেক মেয়েই ব্যাপারটা মেনে নেবে না। কিন্তু আমার জন্য আমার মা-বাবার সঙ্গে থাকাটা খুবই জরুরি। আমি ওঁদের ছেড়ে যেতে চাই না।”
“আমি বুঝতে পারছি। ব্যাপারটা এটাই যে আমি চাই একটা স্বাধীন পারিবারিক জীবন। আমরা আমাদের মা-বাবার কাছাকাছি থাকতে পারি। রাস্তার এপাড়-ওপাড়, কিংবা কয়েকটা বাড়ি পরে, আর ওঁদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে পারি। এভাবে আমাদের স্বাধীনতাও থাকবে, আবার মা-বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্য করা থেকেও কোনো চ্যুতি হবে না।”
“না, আমাদের একসঙ্গেই থাকতে হবে।”
ওর মনোভাব বেশ জেদী।
মিন হুয়ে মন খুলে হাসলো, “তাহলে আমরা সাধারণ বন্ধু হতে পারি। আমি কামনা করি যে তুমি একটা ভালো মেয়ের দেখা পাও।”
কথা বলা শেষ করে ও ঘড়িটা দেখলো। সবে দশটা বেজেছে। ভাবছে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে যাবে। ছিন রুই বললো, “আবহাওয়া ভালো আছে আজ। তুমি কী একটা প্যারাগ্লাইডারে বসবে? আমি তোমাকে আকাশে নিয়ে যাবো একটু আনন্দ দিতে?”
“এটা …”
কথা বলার সময়ে মিন হুয়ে দেখেছে যে প্যারাগ্লাইডার উঠছে নামছে জানলার বাইরে পাহাড়ের ধারে।
মিন হুয়ের ইচ্ছে হতে লাগলো প্যারাগ্লাইডারে বসার। কিন্তু সবে মাত্র একটা ব্লাইন্ড ডেট সেরেছে যেটা সফল নয়, সেই জন্য ও অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগলো লোকটার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে। তাই ও লাজুক হেসে বললো, “ওকে, কোথায় টিকেট কেনার জায়গা?”
“হেই, টিকিট কিনবে কী? আমার উপহার।”
“তুমি এতো অপ্রস্তুত কেনো?”
“টিকিট কিনতেই হবে।”
এই মূহুর্তে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। আইডিটা শিন ছির দেখে মিন হুয়ে চট করে বললো, “বু হাইসা,” এক পাশে সরে গেলো ফোনের উত্তর দেবার জন্য।
“তুই কী এখানে?”
শিন ছি জানতে চাইলো, ওর পিছন থেকে জোরে হাওয়া বয়ে যাওয়ার আওয়াজ আসছে, যেনো ও গাড়ি চালাচ্ছে। “দেখা করলি ছিন রুই-এর সাথে?”
“কথা হয়ে গেছে।”
“এতো শিগগির?”
ও জানতে চাইলো, “খেলা এগোবে?”
“কোনো খেলাই নেই।”
ফোনের উল্টো পাশ থেকে অভিযোগ ভেসে এলো, “তুই একটা কী। আমি যে লোকটাকে তোর জন্য খুঁজে বার করলাম সে লোকটার শরীরের গড়নটা ডোয়াইনি জনসনের মতো। ওর পেক্টোরাল মাস্ল দিয়ে আখরোট ভাঙা যায়। তোর তাও পছন্দ হলো না। কেনো?”
ডোয়াইনি জনসন |
“শুধু কিছু মিললো না।” মিন হুয়ে বিশদে ব্যাখ্যা করতে চায় না, “ও তা সত্ত্বেও আমাকে প্যারাগ্লাইডিং-এ নিয়ে যেতে চায়। তুই যাবি?”
“তুই যেতে চাস না?”
“যেতে চাই … কিন্তু ওর সাথে …?”
“সবাই এখানেই আছে। কিন্তু ব্লাইন্ড ডেট বিগড়ে গেছে। তুই যাওয়ার আগে তোকে খানিক ক্ষণ খেলতে হবে, না হলে এতো খাটনির কোনো মানেই নেই, তাই না?" বললো শিন ছি।
“একবার স্কেট করে ছিলাম। অনেক খরচ পড়ে ছিলো। আর এ তো আমাকে টিকিট কিনতে দেবে না বলছে, সেটা অস্বস্তিকর। কেমন হয় এবার না হয় বাদ দিলাম, আমি না হয় আবার পরে আসবো খেলার জন্য?”
“খুব খরচ? আর অ্যন্ড ডি ডিরেক্টর ভাবছে খুব খরচ?”
মিন হুয়ে কল্পনা করলো যে শিন ছি গাড়ি চালাচ্ছে। মিন হুয়ের কথা শুনে ও চোখ পাকালো।
“আমার ওপরে ছেড়ে দে। আমি এক্ষুণি ওখানে পৌঁছে যাবো।”
এতে মিন হুয়ে আবার চমকে গেলো, “তুই কেনো এখানে আসছিস?”
“তোর ছেলেকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি যে তুই একটা ব্লাইন্ড ডেটে গেছিস।”
ও আরো বললো, “তোর ছেলের জন্য তোর কাউকে খুঁজে পাওয়া দরকার, যে তোর ছেলের সৎবাবা হবে। এতে ছেলের নিশ্চয়ই একটা মতামত দেওয়ার জায়গা আছে, দোয়ে বা?”
“আমার মনে হয় তুই এখানে আসছিস পরিস্থিতি আরো বিগড়ে দিতে।”
রেগে গিয়েই ফোন রেখে দিলো মিন হুয়ে।
মনে হলো যেনো ও ফোন রাখা মাত্রই শিন ছি এসে পৌঁছোলো। কারণ ফোন রেখেই ও দেখতে পেলো সু ছনকে নিয়ে শিন ছি ঢুকছে গেট দিয়ে।
মিন হুয়ে তাড়াহুড়ো করে ছিন রুইকে বললো যে ও বাথরুমে যেতে চায়। বলেই ও তাড়াতাড়ি বাথরুমে চলে গেলো।
ও ফিরে এসে দেখলো ছিন রুই চলে গেছে। আর দেখলো যে আরেকটা লোক দাঁড়িয়ে আছে শিন ছির পাশে। লোকটার চেহারা দোহারা, সাধারণ দেখতে, গায়ের রং শ্যামলা, গায়ে উইন্ডব্রেকার জ্যাকেট।
ও যেই এগিয়ে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলবে বলে মনস্থ করেছে অমনি সু ছন দৌড়ে এলো ওকে চেঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে, “মা! মা!”
মিন হুয়ে উবু হয়ে বসে ছেলেটাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলো।
“আয়, আলাপ করিয়ে দি। ইনি হান য়ি, এখানে আরেক জন কোচ। উনি তোকে আজকে ওড়াতে নিয়ে যাবেন।”
মিন হুয়ে একবার শিন ছির দিকে দেখলো, একবার হান য়ির দিকে। ও যখন নিশ্চিত হলো যে ব্যাপারটার মধ্যে কোনো তামাশা নেই, তখন ও ঘাড় নেড়ে সায় দিলো, “মেই ওয়েন্তি।”
“টিকিটের দামের কথা ভাবিস না।”
বললো শিন ছি, “এখনকার মতো আমি দিয়ে দেবো ওটা।”
“শিয়া শিয়া নি। আমি পরে তোকে ফোনে টাকাটা পাঠিয়ে দেবো।”
ওর মুখের অভিব্যক্তিটা শুকিয়ে গেলো।
“বাবা, বাবা, আমিও উড়তে চাই।”
চেঁচিয়ে উঠলো সু ছন।
“বেবি, তুমি যে এখন বড্ডো ছোটো, আমরা উড়বো তুমি বড়ো হলে।”
“বাবা, বাবা, আমরা তো খুব উঁচুতে উড়বো না। আমরা কেবল ঢাল বরাবর উড়বো না হয়? ঘুড়ির মতো? তুমি আমাকে ওটার সঙ্গে বেধে রাখবে আর দড়ি দিয়ে টানবে …”
সু ছন লাফ দিয়ে মিন হুয়ের কোল থেকে নেমে এসে শিন ছির ঊরু জড়িয়ে ধরে নিজের চিবুকটা গুঁজে দিলো বায়না করতে করতে।
প্যারাগ্লাইডিং |
“আমি এখন তোমাকে ওড়াতে পারবো না, বাওবেই। এমন নয় যে আমি তোমাকে উড়তে দিতে চাই না। কিন্তু এখানে অনেক নিয়ম আছে। দশ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের আকাশে যাওয়া বারণ। তুমি যদি আমার কথা বিশ্বাস না করো, তবে কোচকেই জিজ্ঞেস করো।”
সু ছন চোখ বড়ো বড়ো করে চাইলো হান য়ির দিকে, হান য়ি ঘাড় নেড়ে বললেন, “দোয়ে।”
ওর বলার ভঙ্গীতে সন্দেহের কোনো অবকাশ রইলো না।
হয়তো হান য়ির গম্ভীর চেহারায় ভয় পেয়ে তৎক্ষণাৎ সু ছন শান্ত হয়ে গেলো।
হাসি মুখে ওদের দেখছে মিন হুয়ে। শিন ছির পরনে একটা হালকা ধূসর রঙের ট্যুইড স্যুট, কালো জিনস্। মাথার চুলগুলো ছোটো আর খাড়া করে আঁচড়ানো। ওকে সেই প্রথমবার দেখার মতো পরিস্কার আর ঝকঝকে দেখাচ্ছে।
ম্যাগাজিন মলাটের ছবির মতো নয়, শিন ছির রূপ অযত্নের আর অনিয়মের - সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার প্রতি সেটা খানিকটা নিষ্ঠুরতাই, যারা ওর দিকে সোজাসুজি তাকাতে চাইছে নির্লজ্জ চাহনিতে - তারা কিছুতেই পেরে উঠছে না।
ও মেয়েটার দিকে দেখলো অবিচল চোখে, ওর চারপাশে সু ছন দৌড়ে বেড়াতে লাগলো।
কিন্তু যেই ছেলে চোখের আড়ালে চলে গেলো অমনি ছেলের কাছে গিয়ে ছেলেকে জড়িয় ধরে ফিরিয়ে আনলো, যেনো ওর তৃতীয় চোখ দিয়ে ও দেখতে পাচ্ছে ওর ছেলেকে।
“কতোক্ষণ আছিস এখানে?” মিন হুয়ে জানতে চাইলো।
“সারা দিন।”
শিন ছি বললো, “ওদিকে একটা জায়গা আছে বার্বিকিউ করার। আমি ছন ছনকে কথা দিয়েছি যে ওকে এখানে নিয়ে আসবো বার্বিকিউ করতে।”
মিন হুয়ে ভালো করে দেখলো ওকে, “বার্বিকিউ? তুই জানিস কী করে করতে হয়?”
“হ্যাঁ। আমি স্টিইক এনেছি, আর এনেছি ল্যাম্ব রিবস্, কাউবয় বোনস্, সসেজ, চিকেন উইং, ভুট্টা, মিষ্টি আলু আর মাশরুম, আর এনেছি কয়েক ক্যাটিস চারকোল। হান য়ি একটা বার্বিকিউ গ্রিল এনেছে।”
কাউবয় বোনস্ |
ল্যাম্ব রিবস্ |
“এতো খেতে পারবি?”
“আমি ভাবলাম তুই আর ছিন রুই নিশ্চয়ই খুব মজায় আছিস। ভাবলাম, তোর কথা বলা আর ওড়াউড়ি হয়ে গেলে এদিকে আসবি, আমাদের সঙ্গে খাবি, যাতে তোরা দুপুরটাও একসঙ্গে কথা বলে কাটাতে পারিস আর তোদের বোঝাপড়াটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিস, কী ভালো যে হোতো। তুই কী করে জানলি –?”
মিন হুয়ে হাত জোড় করলো, বললো, “সত্যি? আমি এতো আপ্লুত হলাম যে চোখে প্রায় জল চলে এলো।”
“এটা একটা ছোট্টো চেষ্টা।”
শিন ছি চোখ তুলে তাকালো, “আয় না, পরে খাবো, চেখে দ্যাখ আমার হাতের কাজ কেমন?”
“...”
ওকে অনেক ক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে আবার বললো, “একান্তই তুই যদি উপরোধেও না খাস, তো উপরোধটা বাজে খরচ করলাম।”
“সে ঠিক আছে।” বললো মিন হুয়ে।
হান য়ি নিয়ে গেলো মিন হুয়েকে কয়েকটা ফর্ম ভর্তি করার জন্য, তারপর নিরাপত্তার বিষয়টা বুঝিয়ে বলার পরে ওকে নিয়ে গেলো পাহাড়ের উত্তর দিকে আর ছাতাগুলো খাটাতে লাগলো।
সমস্ত সরঞ্জাম মিলিয়ে দেখে, হান য়ি চেনাতে লাগলো মিন হুয়েকে, “এটা অক্সিলিয়ায়রি আমব্রেলা, এটা মেইন হুক, আর এইটা আমব্রেলা। দড়িটা, এইটা প্যারাস্যুটটা …”
“সব খুটিঁয়ে দেখা হয়ে গেলে আমার এসব জিনিস চোখের আড়াল হতে দিই না সাধারণত। আমরা কোনো ভুল হতে দিতে পারি না। আমরা আকাশে পৌঁছোলে আমাদের জীবন নির্ভর করে এই সব জিনিসের ওপরে।”
কথা বলা হয়ে গেলে মিন হুয়েকে পায়ের বাঁধন লাগাতে সাহায্য করলো হান য়ি। বুকের বেল্ট, আর অন্যান্য বেল্ট সব দেখে নেওয়া হয়ে যেতে দুজনে মাথায় হেলমেট পরে নিলো। কৌতুহল নিয়ে সু ছন পাশ থেকে দেখছিলো পুরো ব্যাপারটা। হাত তালি দিয়ে উঠলো, হেসে বললো, “মা, তুমি আকাশে যাচ্ছো!”
মিন হুয়ে জানে বাবা আর ছেলে দুজনেরই হৃৎপিণ্ড অসুস্থ আর এরকম উত্তেজনার খেলা দুজনের খেলতে মানা, তাই ও ছেলের মুখ ছুঁয়ে বললো, “তুমি মায়ের আকাশে ওড়ার ছবি নিও।”
হান য়ি বুঝে নিলো মেঘেদের গতি আর হাওয়া কোন দিক থেকে বইছে। মিন হুয়েকে নিয়ে দৌড়োলো উৎরাই বেয়ে। হাওয়া জোরালো ছিলো। কয়েক পা যেতে না যেতেই ও লাফিয়ে উঠলো আর ধরে নিলো হাওয়া।
শুরুতে মিন হুয়ের একটু ভয় করছিলো। ও চোখ বন্ধ করে ছিলো। ওর হৃদপিন্ড কাঁপছিলো এলোপাথাড়ি। এতো ঘাবড়ে গিয়ে ছিলো যে ও দম নিতেও পারছিলো না। শক্ত করে দড়িটা ধরে ছিলো। শরীরটা হাওয়ায় ঝুলছে, তিরিশ মিটারের ওপরে ওঠা পর্যন্ত কিছুতেই স্নায়ু শান্ত হলো না, তারপরে একটু একটু করে শান্ত হয়ে এলো।
যখন চোখ খুললো, তখন ওর মনে হলো যেনো আকাশ আর মাটির জায়গা ওলোটপালোট হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে এক টুকড়ো সবুজের ছোঁয়া চোখে পড়লো। ওগুলো পাহাড়ের মাথার সবুজ গাছ। আর পাহাড়ের নিচের চাষের জমি।
ধীরে ধীরে মাটি ডুবে গেলো, বন আর ঘাসজমি মিশে এক হয়ে গেলো, ঘুরতে লাগলো থেকে থেকে, যেনো ক্যালাইডোস্কোপ।
চোখের সামনের দৃশ্যের চমকে, ও অনেক ক্ষণ কথাই বললো না কোনো।
“কী ভাবছো?" পিছন থেকে জিজ্ঞেস করলো হান য়ি।
“অনন্ত।”
হাসলো হান য়ি, “কী ধরনের অনন্ত?”
“কোনো কারণ নেই, ফল নেই, শুরু নেই, শেষ নেই, যেমন পাহাড়, নদী, হ্রদ, পাথর, গাছপালা আর আগাছা যেগুলো জানে না যে ওগুলোর সৃষ্টি কেনো হয়েছে কেনো ওগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে – হতে পারে এরকমটাই জীবনের মতো।”
“পুরো বুঝুতে পারছি।”
হান য়ি বললো, “তুমি প্রায়ই আসতে পারো খেলার জন্য। সেটা শরীর আর মন দুয়ের জন্যই ভালো। অনেকে তো এটাকে ব্যবহার করে উদ্বেগে ভোগার চিকিৎসা হিসেবে।”
“কিছুদিন পরে আমি আবার করতে পারি?”
ওর মনে হয় নি যে এই উড়ান যথেষ্ট।
“নিশ্চয়ই।”
বললো হান য়ি, “তোমার যদি ভালো লাগে, তুমি শেখার জন্য ভর্তি হয়ে যাও। প্যারাগ্লাইডিং গাড়ি চালানোর থেকে অনেক সহজ। আসলে, তুমি এটা তিন থেকে পাঁচদিনে শিখে যাবে। শেখা হয়ে গেলে তুমি একটা ‘এ’ সার্টিফিকেট পাবে। তাতে এক বছরের আধখানা অভ্যেস করবে। তুমি একলা উড়তে পারবে একটা ‘বি’ সার্টিফিকেট পাবার পরে। তোমার ওড়ার ক্ষমতা যদি ভালো হয়, তাহলে তুমি ডাবল লাইসেন্সও পেতে পারো। তুমি এসে ব্যবসার জন্য উড়বে আর অনেক পয়সা রোজগার করবে।”
মিন হুয়ের ভীষণ লোভ হতে লাগলো। ও তো কাজটা ছেড়েই দিয়েছে। তাহলে সময়টা কেনো নিজেকে দিচ্ছে না? একটা ছুটি নিক, একটা কাজ শিখুক নতুন, উত্তেজক আর মজার, তার সঙ্গে কিছু পয়সাও রোজগার করুক, আর সঙ্গে সঙ্গে বললো, “তাহলে আমি আগে একটা শেখার ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাই।”
আবার একপিঠের পথ পেরোতে দেড় ঘন্টা লাগবে সে কথা মনে করে বললো, “আজই শুরু করতে পারি কী? তুমি কী আজ শুরু করতে চাও?”
হান য়ি এক মূহুর্তের জন্য চমকে গেলো, ও আশা করে নি যে মিন হুয়ে এতোটা সক্রিয় উৎসাহ দেখাবে, তাই ও বললো, “নিশ্চয়ই।”
তারপর একটু থেমে জানতে চাইলো, “এতো তাড়া কিসের তোমার?”
সামান্য হেসে মিন হুয়ে জানালো, “খুব বেশি দিন হয় নি, আমার খুব উদ্বেগে কেটেছে।”
শিন ছির আচরণের কারণে। চেং ছিরাং-এর ভয় দেখানোর চোটে …
ওর যেনো মনে হচ্ছিলো যে একটা ঘূর্ণাবর্তের নাভির ভেতরে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে যেনো। আর ও পালানোর মরিয়া চেষ্টা করছে। কিন্তু এমন কিছুই নেই যা ও করতে পারে।
সব থেকে বড়ো উদ্বেগের কারণ শিন ছি। ও এমন শান্ত নিরুদ্বিগ্ন আছে, যেনো মনে হচ্ছে খুব ভালো ভাবে ভেবে ও একটা ছক কষে ফেলেছে আর সব কিছু তীব্র নিয়ন্ত্রণে আছে … কিন্তু ও জানেও না ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে কেমন লাগে।
প্রথম উড়ান সারা হয়ে গেলো মাত্র কুড়ি মিনিটে। মিন হুয়ে একটু বিশ্রাম নিলো আর তারপরে চললো হান য়ির পিছু পিছু আবার ওড়ার জন্য।
নেমে এসো ও শিন ছিকে বললো যে ও ভর্তি হতে চায় শেখার জন্য।
শিন ছি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলো, “এটা শেখা খুব ভালো। আমারও প্যারাগ্লাইডিং খুব ভালো লাগে। নর্থ আমেরিকায় থাকার সময়ে, একটা গ্রীষ্মে আমি একটা প্যারাগ্লাইডিং বেসে কাজও করেছি।”
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “একবারও কখনো ওড়ার সুযোগ পাস নি?”
“আমি স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু কেউ আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় না, ভয় পায়, আমি যদি হার্ট অ্যাটাকে মারা যাই।”
মিন হুয়ে থতমত খেলো। ও আশাই করে নি যে শিন ছি কথাটা এতো সোজাসুজি বলবে।
“তুই যদি শিখিস তবে তোর কী সাহস হবে আমাকে ওড়ার জন্য ওপরে নিয়ে যেতে?”
দুম করে বললো কথাটা, দৃষ্টি স্থির মিন হুয়ের মুখের ওপরে।
“হবে সাহস।”
মিন হুয়ে মুখ তুলে তাকালো, রোদের একটা রশ্মি ওর চোখে সোজা এসে পড়লো, সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে বললো, “আমি তোকে ওড়ার জন্য নিয়ে যাবো, সার্টিফিকেট পাওয়ার পরে। আমার ভয় নেই যে তুই আকাশে মরে যাবি। যদি তেমন কিছু হয়, আমি তোর বাচ্চার পুরো দায়িত্ব নেবো।”
শিন ছি চোখ পিট পিট করলো, এক দৃষ্টে মিন হুয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো, “সত্যিই? তোর সাহস হবে?”
মিন হুয়ে হেসে ফেললো, দাঁত বেরিয়ে পড়লো, “কেনো হবে না? আমি তো দেখেছি হান য়ি কেমন করে ছাতাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে কোনো না নেই। আমার যা বুদ্ধি, আমি নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ওস্তাদ হয়ে উঠবো।”
“তোর খিদে পেয়েছে?” হঠাৎ প্রশ্ন করলো শিন ছি।
হাওয়ার দিক পাল্টে গেলো। মিন হুয়ের নাকে ভেসে এলো ঝলসানো মাংসের গন্ধ।
ঘাসের ওপরে একটা ছোটো তাঁবু জেগে উঠেছে, খুব বেশি দূরে নয়, আর তার পাশে উনুনটা এর মধ্যেই জ্বালানো হয়ে গেছে।
ও শিন ছির পিছু পিছু গেলো। দেখতে পেলো যে সু ছন তাঁবুর মধ্যে শুয়ে পুরো মন দিয়ে লেগো নিয়ে খেলছে।
“খুব ভালো গন্ধ ছেড়েছে।”
ও কোটটা খুলে ফেললো, “কী করে ঝলসাতে হয়? আমি তোকে হাতে হাত কাজ এগিয়ে দিই, আয়।”
“না, আমি নিজেই করতে পারবো।”
ও একটা কাগজের থালা দিলো মিন হুয়ের হাতে, “এটা ধর আর অপেক্ষা কর। এটা এক্ষুণি তৈরি হয়ে যাবে।”
মিন হুয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শিন ছির পাশে, নড়তে নারাজ। ও একটা করে ঝলসায়, আর মিন হুয়ে একটা করে খায়, কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চারা যেমন খাবার জন্য অপেক্ষা করে।
ওরা বিশেষ কথাও বললো না, যতোক্ষণ না দুজনে ঝগড়া করছে, মৌনি বড়ো আনন্দের।
আধখানা হতে না হতেই, মিন হুয়ে হঠাৎ বললো, “শিন ছি, তোকে কী চেং ছিরাং-এর সঙ্গে এই টক্করটা চালাতেই হবে?”
“হ্যাঁ।”
“তাতে যদি সব ধ্বংস হয়ে যায়, তাও?”
“হ্যাঁ।”
“আমি কী তোকে অনুরোধ করতে পারি এটা ছেড়ে দেবার জন্য। সত্যি বলতে কী মনকে শান্ত করার অনেক উপায় আছে। তুই ধ্যান করতে শিখতে পারিস, কিংবা যোগা করতে পারিস, বানজি জাম্পিং, প্যারাগ্লাইডিং …”
“ব্যাপারটা এতো ঝামেলার নাও হতে পারে।”
বললো শিন ছি, “সব হিসেব চুকে গেলে আমার মাথা শান্ত হয়ে যাবে।”
“প্রেমে পড়ে তুই খুব দুঃসাহসী।”
মিন হুয়ে বললো চিকেন উইং খেতে খেতে।
শিন ছি ফিরে এক ঝলক দেখলো মিন হুয়েকে।
“আমি সু তিয়াঁর কথা বলছি।" যোগ করলো মিন হুয়ে।
স্টিইক থেকে তেলের ফোঁটা পড়লো গরম কয়লায়, চিড় চিড় করে উঠলো।
এক মুঠো লঙ্কা নিয়ে শিন ছি সমান করে ছড়িয়ে দিলো স্টিইকের ওপরে। বললো, “আমাকে ভালো না বাসাটা আরো বেশি ঝুঁকির।”
মিন হুয়ে কিচ্ছু বুঝতে পারলো না শিন ছির মুখের অভিব্যক্তি দেখে। ওর নিজেকে বিভ্রান্ত মনে হলো।
ও নিজে হাতে যুদ্ধটা শুরু করেছে। বড়ো লড়াইয়ের আগে ও নির্বিকার, যেনো ও একটা ভীষণ নীরস পরিণতি দেখতে পাচ্ছে, তাই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে।
“তোকে এই স্টিইকটা চাখতেই হবে। এটা খেতে দারুণ।”
ও খুব শান্তভাবে এক টুকড়ো মাংস কেটে কাঁটার মাথায় গেঁথে দিলো মিন হুয়েকে।
নরম, তুলতুলে, প্রায় রক্তাক্ত মধ্যিখানটা।
“ব্যাপক খেতে।" মিন হুয়ে প্রশংসা করলো, বোকার মতো হাসতে লাগলো।
খাবার পরে ও ঘাসে বসে বিশ্রাম নিলো, সু ছনের সঙ্গে লেগো নিয়ে খেললো।
হান য়ি এলো। শিন ছির সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বললো। বার্বিকিউ চলতে লাগলো।
এক ঘন্টার বেশি পার করে, হান য়ি এলো তাঁবুতে। বললো যে আবহাওয়া এখন ভালো আছে, মিন হুয়ে চাইলে এখনই শিখতে শুরু করতে পারে।
এক দল লোক গাড়ি নিয়ে চললো শেখার জমিতে, পাহাড়ের নিচে।
“এটা ফার্স্ট ক্লাস আমব্রেলা, ব্যাগিং, অক্সিলিয়ারি আমব্রেলা, হেলমেট, ঠেলে তোলার যন্ত্রপাতি, গো-প্রো …”
হান য়ি চেনাতে থাকলো একে একে। শেষে ওর হাতে দিলো একটা জিনিস যেটা দেখে ওয়াকি-টকি বলে মনে হলো, “এটা KENWOOD TH-F7, ডুয়াল ফ্রেকোয়েন্সি রেডিও। এটা দিয়ে হাওয়ার মধ্যেও যোগাযোগ করা যাবে।”
KENWOOD TH-F7, ডুয়াল ফ্রেকোয়েন্সি রেডিও |
শিন ছি এলো। সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে নিতে সাহায্য করলো মিন হুয়কে। দড়িটা দেখলো, ছাতাও।
কিছু সাবধান থাকার বিষয় বুঝিয়ে বলে দিলো হান য়ি। তারপরে মিন হুয়ে সামনে দৌড়োতে শুরু করলো ছাতাটা ধরে।
“বড়ো বড়ো পা ফেলো, হাত পেছনে করো, মাথা সোজা করো …”
ভেসে এলো হান য়ির গলা রেডিও সেট দিয়ে।
হাওয়া খুব জোরে চলছিলো। কয়েক পা যেতেই কমলা রঙের ছাতাটা ফটাস করে খুলে গেলো।
একই সময়ে মিন হুয়ের পিছনে একটা বিশাল বাধা।
“খুব বেশি জোরে হাওয়া দিচ্ছে দৌড়োনো যাচ্ছে না।” চেঁচিয়ে উঠলো মিন হুয়ে।
“হাওয়াটা একটু জোরালো বটে, এর উল্টো দিকে যেও না। ব্রেক খুলে দাও। সামনে দৌড়োও, হ্যাঁ, ঐ দিকে দৌড়োও।”
শিন ছির গলা ভেসে এলো রেডিওতে, “দিকটা ঠিক করে নে, শরীরটা সামনে ঝোঁকা, তোর শরীর যথেষ্ট ঝুঁকে নেই, বাঁ হাতটা ছেড়ে দে …”
মিন হুয়ে এক দৃষ্টিতে ঝলসে দিতে চাইছে শিন ছিকে, ভাবছে, শিন ছিটা নিজে উড়তে পারে না, কিন্তু অন্য লোককে নির্দেশ দিতে পারে, সমস্ত জোর দিয়ে ও সামনে দৌড়ে গেলো।
“বড়ো বড়ো পা ফেল, আরো বড়ো বড়ো, আরো একটা …”
ওর পিছন থেকে শিন ছির গলা ভেসে এলো, “শরীর নিচু কর, আরো নিচু।”
“ঘুরে আয়, ঘোর, ঘোর, ঘোর, শেষ পর্যন্ত ব্রেকে টান দে, পিছিয়ে আয়, পিছিয়ে আয়।”
“খুব ভালো! গতি বাড়া, ওপরের দিকে হাত ছড়িয়ে দে! যে দিকে যাচ্ছিস, সে দিকেই যেতে থাক, যে গতিতে যাচ্ছিস, দিক ঠিক কর! ঠিক কর! ভালো হয়েছে! ঘুরে পড়, ছেড়ে দে!”
মিন হুয়ে বার বার অভ্যেস করতে লাগলো, শুনতে শুনতে দৌড়োতে লাগলো। বেশ কিছু ক্ষণ পর সু ছনের শিশুসুলভ গলা ভেসে এলো রেডিওতে, “মা, বাবা বলছে যে বাবার গলাটা কড়া, বাবার হয়ে আমি বলছি …”
কী যা তা!
“মা, জোরে দৌড়োও! বড়ো বড়ো পা ফেলো! সামনে দৌড়োও … দৌড়োতে থাকো।”
গোধূলি ফুরোলে শেষ হলো শেখা। শিন ছি নিজে গাড়ি চালিয়ে মিন হুয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দিলো। পথে, কিছুই যেনো হয় নি, এমন ভান করে মিন হুয়ে জানালো, “শিন ছি, আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছি।”
“এটা আবার কখন হলো?” জানতে চাইলো শিন ছি।
“কাল।”
“কেনো?”
“আমি বুঝতে পেরেছি,” হাসি মুখে মিন হুয়ে তাকালো শিন ছির দিকে, “তুই আমাকে বাধ্য হতে বলেছিস, আর আমি বাধ্য হবো।”
“তুই কবে থেকে এতোটা নির্বোধ হয়ে গেলি?”
“তোর হাতে তুলে দিতে সব কিছু কেমন লাগে। — — যদিও সব চুকে গেছে, তবুও এটা মূল্যবান।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-69.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-71.html