Saturday, August 10, 2024

JPDA - Chapter 04

৪. সু তিয়াঁর ডায়েরি



“সেপ্টেম্বর ২, রোদ।

আজকে নতুন সেমিস্টারের প্রথমদিন। ইস্কুল ছুটির পরে শিন ছি আমাকে বললো, ‘চল, ডরমিটরিতে ফিরে গিয়ে চেকারস্‌ খেলি।’ আমি ফিরতে রাজি নই। আমি মাঠে গিয়ে আমার ক্লাসের বন্ধুদের সাথে দড়ি লাফ খেলতে চাইছিলাম। ও আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো। দশ মিনিট হতে না হতেই রেগে গিয়ে হাতের পেন্সিল বাক্সটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আমি ফেরার পর, ওর সাথে কথাও বলিনি, দাবাও খেলি নি। ও-ও ক্ষমা চায় নি। আমার কাছে এসে আমাকে এই ডায়েরিটা দিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করে ছিলাম কেনো আমাকে দিচ্ছে ডায়েরিটা। বলে ছিলো যে যে সমস্ত লোকেদের মন খারাপ থাকে তাদের ডায়েরি লেখার অভ্যেস করা উচিৎ। আমি জানতে চেয়ে ছিলাম যে আমার মন খারাপ হতে যাবে কেনো। তার উত্তরে সে বলে ছিলো যে মন খারাপ হওয়া লোকেরা বড়ো হয়ে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমি কিছুতেই এই ব্যাপারটা ভুলতে পারছি না। আমি কিছুতেই ওকে অবজ্ঞা করতে পারি না। আমি অবশ্য আরো বলে ছিলাম যে আমি ঘড়িটা ঠিক দেখতে পারি না। ওটা দশ মিনিট ছিলো না, পঞ্চাশ মিনিট ছিলো।

“মার্চ ১, রোদ।

শও মেই আজ বললো আমাকে যে ও বাড়ি চলে যাচ্ছে। কারণ মাস্টারমশাই বলেছেন যে ওর মাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। অনেক দূর থেকে ট্রেনে চড়ে ওর পুরো পরিবার আসবে ওকে নিয়ে যাবার জন্য। মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদু, দিদা। মাস্টারমশাই ওকে নতুন জামা আর নতুন ইস্কুলব্যাগ কিনে দিয়েছেন। শও মেই খুব খুশি, লাফিয়ে বেড়াচ্ছে আর বকবক করে চলেছে। রাতে আমি নিঃশব্দে কেঁদেছি। আমি জানি না আমি কবে আবার আমার মাকে দেখতে পাবো। আমি শিন ছিকে জিজ্ঞেস করেছি যে ও ওর মাকে দেখতে চায় কিনা। তাতে ও বলেছে যে ও ওর মাকে ফিরে পেতে চায় না, কারণ ওর মা আর ওকে চায় না। কিন্তু ও বলেছে যে আমরা যখন বড়ো হবো তখন ও আমাকে সাহায্য করবে আমার মাকে খুঁজে বার করার জন্য। আমি বলেছি যে বড়ো হবার পরে আমি নিজেই আমার মাকে খুঁজে বার করবো। তাতে ও বলেছে যে তখন আমি নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত থাকবো আর সাঁতারের অলিম্পিক স্বর্ণপদক থাকবে আমার অপেক্ষায়। আমি হয়তো মাকে খুঁজে বার করার মতো ঝামেলার কাজ ওকেই দিয়ে দেবো।

“মে ১৮, কুয়াশা।

শিন ছিকে মাস্টারমশাই শাস্তি দিয়েছেন সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকার। কারণ ক্লাস সিক্সের সুঁ হাও আর ফ্যাং শও কুই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে ছিলো খেলার মাঠে। ওর চশমাটা পড়ে ভেঙে যায়। শিন ছি ওদের ওপর চেঁচামেচি করছিলো। আমি যতক্ষণে ব্যাপারটা জানতে পেরেছি তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়ে ছিলো। ঝাং হাও আর বাকিরা ততো ক্ষণে পালিয়ে গেছে। যার ওপর শিন ছি চেঁচামেচি করেছে তিনি ছিলেন মাস্টারমশাই চেন। আর শিন ছির ভাষা ছিলো ভয়ানক। মাস্টারমশাই রেগে গিয়ে ছিলেন খুব। হায় হায়, ও যে চোখে একদম দেখতে পায় না। শিন ছি বলে ছিলো যে ও কেবল একটা আবছা মূর্তি দেখেছে। আমি জিজ্ঞেস করে ছিলাম ওকে যে আমাকে দেখলে ও চিনতে পারবে কিনা। ও বলে ছিলো, ‘আমি আজ অবধি তোর মুখটা কখনো স্পষ্ট দেখি নি। চিন্তা করিস না। আমি তোর গলার স্বর চিনি।’

“অক্টোবর ২৭, বৃষ্টি।

  শিন ছি হাসপাতালে। মাস্টারমশাই আমাকে বলেছেন যে খাতায় সব লিখে নিয়ে গিয়ে শিন ছিকে দিতে যাতে ওর পড়াশোনার সুবিধে হয়। আমি একটু ভয় পাচ্ছিলাম। আমি মাস্টারমশাইকে বললাম যে শিন ছির মেজাজ খারাপ কয়েক দিন ধরে আর আমাকে খাতা নিয়ে যেতে দেখলে ও আরো রেগে যাবে, বলবে যে আমি ক্লাসে পড়া বুঝি না, আমার সমস্ত লেখাগুলো ভুলভাল, তাই ওকে নিজে নিজেই পড়া বুঝে নিতে হবে আর পরে ওকেই শেখাতে হয় আমাকে যে কি ভাবে ইস্কুলের দেওয়া বাড়ির কাজ ঠিক করে করতে হয়। এতো সব শুনে মাস্টারমশাই বললেন, ‘ছেড়ে দে।’ শিন ছি ওয়ার্ডে পড়াশোনা করতে চায় না। তাই আমি ওর সাথে চেকার্স খেললাম। তিন ঘন্টা খেলার পর আমি হারলাম। আমি শিন ছিকে জিজ্ঞেস করে ছিলাম যে ওর একঘেয়ে লাগছিলো কিনা। ও জানিয়ে ছিলো যে ওর একঘেয়ে লাগছিলো না। ওর সাথে আমি ছাড়া আর কেউই খেলতে চায় না।

সত্যি কথাটা হলো যে আমার একঘেয়ে লাগছিলো।

. “জানুয়ারি ১২, বরফ।

কেউ আজ ইচ্ছে করে আমার ইস্কুলব্যাগে এঁটো খাবার লাগিয়ে দিয়েছে। আমার বাড়ির কাজের খাতা আর সব বইপত্তর সব নোংরা হয়ে গেছে। আমি জানি যে অপকম্মটা নির্ঘাৎ সুঁ হাও করেছে। ইস্কুল ছুটির পর দেখলাম যে আমার চুলে তিনটে চ্যুইং গাম আঁটা। আমি কিছুতেই ছাড়াতে পারলাম না। শিন ছি কাঁচি দিয়ে আমার চুল কেটে তবে আমাকে মুক্তি দিলো। এই কদিন হলো, সুঁ হাও আমার ওপর সমানে অত্যাচার করে চলেছে। শিন ছি বলেছে যে সুঁ হাও তবেই সাবধান হবে যদি ও ঠ্যাঙানি খায়। দুজনে খেলার মাঠে এমন মারপিট করলো যে ওদের নাক দিয়ে আর হাত দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো। দুজনেরই ডাক পড়লো প্রিন্সিপালের অফিসে। শিন ছিকে বার করে নিয়ে এসে মাস্টারমশাই য়ে চল্লিশ মিনিট ধরে বকাঝকা করেছেন ওকে। রাতে আমি শিন ছির মুখে একটা বড়ো ঘা দেখলাম আর জানতে চাইলাম ওর লাগছে কিনা। ও বললো যে লাগছে; আর বললো যে আমি যদি ওকে চুমু খাই তাহলে ওর ব্যথা চলে যাবে। আমি বললাম, ‘এ আর এমন কি।’ শও মেই আমাকে যে কুকুর ছানা পুতুলটা দিয়েছে সেটাকে তো আমি রোজ চুমু খাই। আমি শিন ছিকে দুটো চুমু দিলাম।

“জুন ৯, রোদ।

শিন ছি বলেছে যে একটা কাজই আমি ওর থেকে বেশি ভালো করতে পারি। সেটা হলো সাঁতার কাটা। আজ ইস্কুলে সাঁতারের আয়োজন ছিলো। আমি ভেবেছিলাম যে ওকে সাঁতার শেখাবো আজ। সাঁতারের পুলে নামার সময়, আমাকে চমকে দিয়ে শিন ছি বললো যে ও কিছুতেই গায়ের জামা খুলবে না। এমনটা আমি আশা করিনি। ও খুব জোর করতে লাগলো ওর কালো টি-শার্টটা পরেই ও জলে নামবে বলে। ক্লাসের সবাই হাসাহাসি করছিলো। আমি বললাম, ‘শিন ছি, আমি তোকে কক্ষণও এমন দেখি নি। ছেলেদের তো পুলে নামার সময়ে একটা স্যুইমিং ট্রাঙ্ক পড়লেই চলে।’ ও জেদ করতে লাগলো যে না হয় সাঁতারই কাটা হবে না, কিন্তু গায়ের জামাটা ও খুলবে না। আমি জানতে চাইলাম, ‘শাওয়ারে গেলে কী করিস? তখনও কী জামা পরে থাকিস?’ ও বললো, ‘হ্যাঁ, যদি না স্নানের জায়গাটা একানে হয়।’ আমি আবারও জানতে চাইলাম তাহলে সাবান মাখে কী করে। ও বললো যে জামার ওপর দিয়েই মাখে, তাতে জামাটাও পরিস্কার হয়ে যায়, এক ঢিলে দুই পাখি মারা পড়ে। 

আমি এমন লাজুক ছেলে আর একটাও দেখি নি। রাতে লাইব্রেরিতে কেউ ছিলো না। তাই আমি ওকে আবার জিজ্ঞেস করলাম আর জানতে পারলাম যে ওর বুকে একটা লম্বা দাগ আছে ক্ষতের। শিন ছি বললো যে ডাক্তার আর নার্স ছাড়া কাউকে ও ওখানটায় হাত দিতে দেয় না; আর ও চায়ও না যে ক্ষতদাগটা কেউ দেখুক। যদি আমার খুব কৌতুহল হয়, তাহলে আমি ছুঁয়ে দেখতে পারি ক্ষতদাগটা।

— “সু তিয়াঁর ডায়েরি”

ইন্টারনেটে খুঁজে মিন হুয়ে দেখলো যে উত্তর-পুবের সীমান্ত শহরে সত্যিই একটা “ইয়াংছেনজেন শিশু কল্যাণ সংস্থা” ছিলো। এখন আর নেই। প্রশানিক রদবদল, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, পুরোনো শহরের সারাই, তাছাড়া অনেকবার ঠাঁই নাড়া হতে হতে একটা পড়শী শহরের আরেকটা অনাথ আশ্রমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ইয়াংছেনজেন শিশু কল্যাণ সংস্থাকে। সেই অন্য অনাথ আশ্রমটা হলো লংহুই কাউন্টির হাইয়ুয়ান শহরের দু নম্বর শিশু কল্যাণ প্রতিষ্ঠান। জ্যাংঝৌ থেকে হাইস্পিড ট্রেনে যেতে লাগবে পনেরো ঘন্টা। মাঝে বেজিং-এ নেমে গাড়ি বদলাতে হবে।




সেই দুপুরেই মিন হুয়ে ট্রেনে চেপে পড়লো। তাড়া ছিলো তার। সে দিনটা যে জুলাই মাসের ছয় তারিখ। শিন ছির সাথে যেদিন দেখা করার কথা সু তিয়াঁর, তার আর একদিন মাত্র বাকি আছে। 

ট্রেনে বসে মিন হুয়ে আবার সু তিয়াঁর ডায়েরি খুলে ফেললো পড়ার জন্য। খুব মন দিয়ে পড়তে লাগলো। ডায়েরিটাতে সু তিয়াঁ নামের একটা মেয়ের ছ বছর বয়স থেকে বাইশ বছর বয়সের নানান কথা লেখা আছে। দেখে মনে হয় যেনো একটা মোটা বই। কিন্তু তার ভেতরে অনেক কথা লেখা নেই। 

প্রথম যা নজরে পড়লো তা হলো ডায়েরিতে লেখা অধ্যায়গুলোর দৈর্ঘ্য। অধ্যায় থেকে অধ্যায়ে লেখার দৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। প্রত্যেক অধ্যায়ে গড়ে দুশোটা করে শব্দ আছে। তারপরে যা নজরে পড়লো তা হলো লেখাগুলো অনিয়মিত। সবথেকে বেশি লেখা হয়েছে লি চুন মিয়াও-এর সাত থেকে বারো বছর বয়সের মধ্যে, কিন্তু রোজ লেখা হয় নি। সপ্তায় দুবার লেখা হলে খুব পরপর লেখা হয়েছে। তারপর হয়তো মেয়েটাকে আলসেমি ধরেছে, একটানা তিনমাস আর কিচ্ছু লেখে নি। বারো বছর বয়সের পরে অধ্যায়ের সংখ্যা কমে গেছে ভীষণ রকম, বছরে দশটারও কম অধ্যায় লেখা হয়েছে। তারপর এমনও ঘটেছে যে বছরের পর বছর কিচ্ছু লেখা হয় নি ডায়েরিতে। 

একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলো মিন হুয়ে। এই ডায়েরিটা লেখা হয়েছে মূলতঃ “শিন ছি” নামের ছেলেটার জন্য। ছেলেটার কথাই লেখা হয়েছে প্রায় প্রত্যেক অধ্যায়ে। শিন ছি চলে যাবার পর সু তিয়াঁর লেখার উৎসাহ চলে গেছে যেনো। তার শব্দগুলো ক্রমশ অস্পষ্ট আর অগোছালো হয়ে গেছে।

 ডায়েরির সবটা পড়ে ফেলার পর মিন হুয়ে কতকগুলো ধারণা পেলো। প্রথমত, সু তিয়াঁ আর কেউ নয়, সে হলো লি চুন মিয়াও। চুন মিয়াও ইয়াংছেনজেনের শিশু কল্যাণ সংস্থায় থাকতো যখন সে ছোটো ছিলো। অনাথাশ্রমে থাকার সময় তার নাম ছিলো সু তিয়াঁ। শিন ছি আর সু তিয়াঁ সমবয়সী ছিলো আর তারা এক সাথে অনাথাশ্রমে থাকতো।

দ্বিতীয়ত, যখন সু তিয়াঁর বারো বছর বয়স তখন শিন ছিকে কেউ দত্তক নেয়। শিন ছি অনাথাশ্রম ছেড়ে “অনেক, অনেক দূরে” কোথাও চলে যায়। তিন মাস পরে, সু তিয়াঁর মা এসে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিজেদের দেশে হেচিতে। সেই থেকে শিন ছি আর সু তিয়াঁর সব যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যায়।

তৃতীয়ত, দশ বছর পরে, জুলাই মাসের সাত তারিখে, সু তিয়াঁ গিয়ে ছিলো শিন ছির সাথে দেখা করতে। অপেক্ষাও করে ছিলো দেখা করার জায়গায়। কিন্তু শিন ছি আসে নি। সে কথাই ডায়েরির শেষ অধ্যায়ে লেখা আছেঃ

“জুলাই ৭, রোদ

শিন ছি, আমি তোর জন্য সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে থেকেছি, আমি দাঁড়িয়ে থেকেছি ভোর পাঁচটা থেকে, পরের দিন ভোর একটা পর্যন্ত। তুই আসিস নি। সারাদিন একটাই দূর্ভাবনা আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে, ‘তুই কি মরে গেছিস?’ তোর কি এখনো ফ্যাং শাও কুইকে মনে আছে? যে রোজ আড্ডা দিতো সুঁ হাও-এর সাথে? চল, ঠিক করে বলি। তুই চলে যাবার ঠিক দুদিন পরে ও আমার কাছে আসে আর বলে আমি যেনো তোর কথা আর একদম না ভাবি। ও মাস্টারমশাইদের থেকে শুনে ছিলো যে ডাক্তাররা নাকি বলেছে যে তুই বড়ো জোর পনেরো বছর বয়স অবধি বাঁচবি। এটা যেনো সত্যি না হয় আমি সেই আশাতেই আছি। আমি আরো তিন বছর তোর জন্য অপেক্ষা করবো। দয়া করে সময় মতো আসিস। চিন্তা করিস না। আমি তোকে বাধ্য করবো না আমাকে বিয়ে করার জন্য। আমি শুধু এটুকুই জানতে চাই যে তুই ভালো আছিস।

এই অবধি পড়ে মিন হুয়ে একটু মরিয়া হয়ে উঠলো। আসলে যে কোথায় দেখা করার কথা দুজনের, তা না লেখা আছে শিন ছির চিঠিতে, না আছে সু তিয়াঁর ডায়েরিতে। পুরো ডায়েরি তন্ন তন্ন করে খুঁজে কেবল দুটো কাজের কথা পাওয়া গেল;

১) জায়গাটাতে তারা প্রথমবার আইসক্রিম খেয়ে ছিলো।

২) জায়গাটার কাছে একটা সাঁকো আছে।

ট্রেন ইয়াংছেনজেনে পৌঁছোলো যখন, তখন সকাল দশটা, জুলাই মাসের সাত তারিখ। 

মিন হুয়ে ভেবে রেখে ছিলো যে প্রথমেই যাবে লংহুই জেলার শিশুকল্যাণ সংস্থায় যদি সেখানে ইয়াংছেনজেনের শিশু কল্যাণ সংস্থার কোনো মাস্টারমশাই বা দিদিমণিদের কেউ তখনও কাজে বহাল থাকেন, তবে তাঁরা হয়তো বলতে পারবেন যে অনাথাশ্রমের বাচ্চারা সাধারণত কোথায় আইসক্রিম খেতে যেতো।

মিন হুয়ে ট্রেন থেকেই অনেকগুলো ফোন করে ছিলো। কেউ সাড়া দেয় নি। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। মিন হুয়ের কোনো উপায় ছিলো না আর। একটা স্টপেজ আগেই সে নেমে গিয়ে ছিলো ট্রেন থেকে। পরে নিয়ে ছিলো নকশা ছাপা সাদা টি-শার্টখানা। হাতে ধরে রেখে ছিলো শিন ছির নাম লেখা এনামেলের জল খাওয়া কাপখানা। তারপর ঘুরে বেড়াচ্ছিলো ইয়াংছেনজেনের শিশুকল্যাণ সংস্থাটা যেখানে ছিলো সেই জায়গাটার আশেপাশে।

অনাথাশ্রমের বাচ্চারা চট করে অনেক দূরে যায় না। আইসক্রিম খাবার জায়গাটা নিশ্চয়ই অনাথাশ্রমের পুরোনো ঠিকানার কাছে পিঠেই হবে। ইয়াংছেনজেন খুব বড়ো শহর নয়, কয়েকটা মাত্র নদী আর হ্রদ আছে। গাড়ির থেকে নামার আগে, ম্যাপ খুলে মিন হুয়ে খুব মন দিয়ে দেখে নিচ্ছিলো। পুরোনো অনাথাশ্রমের কাছে কুড়ি মিনিটের হাঁটা পথে, তিনটে সাঁকো আছে। তার মধ্যে একটা হাইওয়ের ওপর। সেটার কাছে আইসক্রিমের দোকান থাকার সম্ভাবনা কম। 

অন্য দুটো সাঁকোর ওপর মিন হুয়ে একঘন্টা করে অপেক্ষা করলো। কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারলো না। সে তক্ষুণি একটা গাড়ি ডেকে ড্রাইভারইকে বললো যে তাকে কাছাকাছি সমস্ত সাঁকোতে নিয়ে যেতে হাঁটার জন্য।  মিন হুয়ে সব কটা সাঁকোর ওপরে এমাথা ওমাথা হাঁটল। সাঁকোর দুমাথায় দশ মিনিট করে দাঁড়ালো। সন্ধ্যে ছটা নাগাদ গাড়ির ড্রাইভার মিন হুয়েকে জানালো যে ইয়াংছেনজেনের সমস্ত সাঁকো মিন হুয়ে দেখে ফেলেছে।


এই সময়ে মিন হুয়ের পেট খিদেয় গড়গড় করছে। কিন্তু সে তার চেষ্টায় একটুও ঢিলে দিতে ভরসা পাচ্ছিলো না। রাস্তার ধারে দুটো সসেজ কিনে সে আবার একটা ট্যাক্সি নিলো। এমন সময় তার মনে হলো যে সু তিয়াঁ যে সাঁকোর কথা বলেছে সেটা হয়তো জলের ওপরে নয়, রাস্তার ওপরে। 

ট্যাক্সি ড্রাইভার জানতে চাইলো, “কোথায় যাবে?”

মিন হুয়ে প্রশ্ন করলো “শুশু, এখানে কোনো ওভার পাস আছে?”

ঘটনা হলো যে ওভারপাসটাও সঠিক সমাধান নয়।

ড্রাইভার ম্যাপে নয়, নিজের মগজে খুঁজতে লাগলো ওভারপাস। পুরোনো অনাথাশ্রম যেখানে ছিলো সেই জায়গাটাকে মধ্যে রেখে, কাছে দূরে ছটা ওভারপাসে ঘুরে বেড়াল মিন হুয়ে। কোথাও শিন ছির দেখা পেলো না। ভোর রাতে, একটার পরে সমস্ত ওভারপাস দেখা সম্পূর্ণ হলো।

এই পুরো খোঁজাখুঁজির সময়টায়, মিন হুয়ে অনেকবার পেরিয়ে গেছে পুরোনো অনাথাশ্রম যেখানে ছিলো সেই জায়গাটা। অনেকদিন আগেই জায়গাটা থেকে অনাথাশ্রম চেঁছে ফেলে দিয়ে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর তৈরি করা হয়েছে। এমন কি কাছাকাছি যে প্রাইমারি আর সেকেন্ডারি ইস্কুলগুলো ছিলো, সেগুলোও গেছে। 

ড্রাইভার জানালো যে এই জায়গাটা দশ বছরেরও বেশি আগে পুরোনো শহরের অংশ ছিলো। পরের দশ বছরে, রাস্তাঘাট, বাড়ি ঘরদোর সব এমন করে তৈরি হয়েছে যে জায়গাটার এক্কেবারে ভোল বদলে গেছে। এক্কেবারে চেনার উপায় নেই।

সারাদিনে এতো ধকল গেছে যে হোটেলে ফিরে মিন হুয়ে সোজা বিছানায় গেলো, পাও ধুল না।

পরের দিন ঘুম ভাঙতেই মিন হুয়ের মনে হলো যে সে যদি সু তিয়াঁ হতো সেকি বারো বছরের একটা ছেলের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করতো? সে কি সাঁকোতে ফিরে যেতো আর তেরো বছর পরে আবার অপেক্ষা করতো?

আর সেই ছেলেটা, যে অনেক দূরে চলে গেছে, সেও কি আর তার প্রতিশ্রুতি রাখতে ফিরে আসবে? বিয়ে করবে সু তিয়াঁকে, ভালো বাসবে সু তিয়াঁকে, আর বাকি জীবন ধরে সু তিয়াঁর যত্ন নেবে?

তার কি আপশোস হবে যখন সে জানতে পারবে যে সু তিয়াঁ আসলে অন্য লোকের পা ধোবার কাজ করতো?


তিন বছর আগে সু তিয়াঁ তো গিয়ে ছিলো দেখা করার জায়গায়। কিন্তু শিন ছি তার অপেক্ষায় ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো না। 

এর থেকেই বোঝা যায় যে ছেলেটার কথায় ভরসা করা যায় না। 

তাছাড়া ডাক্তাররাও কি বলে নি যে সে পনেরো বছরের বেশি বাঁচবে না?

শিন ছি হয়তো এতোদিনে মরেই গেছে।



~~~~~~~~~~~~

সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96

Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/07/jpda-chapter-03.html

Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/07/jpda-chapter-05.html


No comments:

Post a Comment

Readers Loved