৫৯. ফুটি
যদিও সমস্ত মুখটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, তবুও শিন ছি মেজাজ হারালো না। গাড়ির চালকের থেকে একটা নরম কাপড়ের টুকরো নিলো আর সিটের ওপরে পড়ে থাকা কাচের টুকড়োগুলো ঝেড়ে ফেলে দিলো মেঝেতে। এক ঝলক দেখলো জানলার দিকে, বাইরে বৃষ্টির দিকে, বললো, “ভেতরে আয়, কথা আছে।”
মিন হুয়ের মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। ও জানে না কেনো যে চেং ছিরাং-এর গাড়ির লোকটা হঠাৎ করে শিন ছি হয়ে গেলো।
একটু ক্ষণ খুব ভালো করে ভাবলো, তবে বুঝতে পারলো যে জায়গাটা কোম্পানির গেটের থেকে খুব দূরে নয়। চেং ছিরাং একটা বড়ো গ্রুপের সিইও-ও বটে। ওর পক্ষে জনসমক্ষে মিন হুয়ের পিছু নেওয়াটা অসম্ভব। হতে পারে যে ও গাড়ি নিয়ে চলে গেছে।
মিন হুয়ের অদ্ভুত অভিব্যক্তি দেখে শিন ছি বোধ হয় ওর পিছু পিছু এসেছে। দুটো গাড়িই কালো রঙের, আর ভারি বৃষ্টির মধ্যে স্পষ্ট করে দেখারও উপায় নেই …
বাধ্য মেয়ের মতো বসলো মিন হুয়ে, শিন ছির মুখের ওপর রক্তের ফোঁটা দেখে, ওর সাদা শার্টের ওপরে দগদগ করতে থাকা রক্তের ফোঁটা দেখে অপ্রস্তুত মিন হুয়ে বললো, “দ্যুইবুচি, আমি সওয়ারি চিনতে ভুল করেছি, এখনই হাসপাতালে চল।”
বলা হয়ে গেলে, মিন হুয়ে বসে রইলো শিন ছির পাশে, কাঁধগুলো দুমড়ে আছে যেনো, ঠোঁট কামড়ে, চুপচাপ।
সত্যি বলতে কী মিন হুয়ের গায়ে খুব জোর নেই, আর ইঁটের টুকড়োর ঘায়ে যে গর্তটা হয়েছে সেটাও বড়ো নয়। কাচগুলো তৈরি করার সময় গলন্ত লোহা মেশানো আছে কাচে। যদি বাইরে থেকে ঘা দেওয়াও হয়, তাতে কাচটা কয়েক খন্ডে ভাঙার কথা। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, মানুষের শরীরে আঁচড় কাটার কথা নয় এই কাচের ভাঙা টুকড়োর।
কিন্তু শিন ছিকে বেশ ভয়ানক দেখাচ্ছে। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে মিন হুয়ে বুঝলো যে অনেকগুলো ছোটো ছোটো ঘা আছে, কিন্তু সব কটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে গলগল করে, তাতে মনে হচ্ছে যেনো ‘পুরো মুখটা রক্তে ঢাকা’।
গাড়িতে কোনো ফার্স্ট এইড কিট নেই। শিন ছির মতে ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। তাই ও চালককে বললো যে একটা ওষুধের দোকানে যেতে যেখানে ও ব্যান্ড-এইড কিনে নিলো। সঙ্গে নিলো চিকিৎসায় ব্যবহারের অ্যালকোহল, ক্ষতগুলো পরিষ্কার করার জন্য। তারপর একে একে ক্ষতগুলোতে ব্যান্ড-এইড এঁটে দেওয়া হলো।
মিন হুয়ে একটা ভিজে টিস্যু দিয়ে শিন ছির মুখের বাকি রক্ত মুছিয়ে দিলো। মুখটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। কিন্তু খানিক পরে ব্যান্ড -এইড ছাপিয়ে আবার রক্ত গড়াতে লাগলো, পড়তে লাগলো ফোঁটা ফোঁটা করে।
“রক্ত বন্ধ হচ্ছে না কেনো?”
উদ্বিগ্ন স্বরে বললো মিন হুয়ে, “দশ মিনিটের বেশি হয়ে গেলো, তোর একটা হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ। ক্ষতগুলো ভালো করে পরিষ্কার করা দরকার। ওগুলোতে কাচের টুকড়ো থেকে যেতে পারে।”
“আমি রোজ অ্যান্টিকোয়াগুলান্ট খাই। রক্ত বন্ধ হতে সময় লাগবে।" বললো শিন ছি, “কিন্তু বন্ধ হবে। চিন্তার কিছু নেই।”
মিন হুয়ে বসে ছিলো শিন ছির পাশে, লজ্জায়, হতাশায়। ভাবছিলো যে মিন হুয়ে উইচ্যাটে ব্লক করে রেখেছে শিন ছিকে, তাই শিন ছির এতো কাছে বসাটা ঠিক নয়। তাই ও জানলার ওপরে হেলে রইলো শক্ত হয়ে।
শিন ছি তখনো একই জায়গায় বসে আছে যেখানে জানলার কাচটা ভেঙে পড়ে ছিলো। বাইরে থেকে বৃষ্টির ছাট এসে পড়ছে। ওর স্যুটের অর্ধেকটা ভিজে গেছে। কলারে রক্ত লেগে, ওকে অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিলো।
মিন হুয়ের নিজের অবস্থা যে খুব সুবিধের তা নয়। ওর চুলগুলো মাথার পেছিনে নুটি নুটি হয়ে জড়ো হয়ে আছে। তার থেকে সমানে জল পড়ে চলেছে।
“আমি সব সময়ে ভেবেছি যে তোর মেজাজ আমার থেকে শান্ত, কিন্তু আমি কখনো ভাবি নি যে রাগলে তুই এমন ভয়ানক হয়ে উঠিস।”
“...”
“তুই বললি যে তুই গাড়ির সওয়ারি চিনতে ভুল করেছিস, আমাকে তুই কে মনে করে ছিলি?”
“... চেং ছিরাং।”
শিন ছি চোখ সরু করে দেখতে লাগলো মিন হুয়েকে, এক মুহুর্ত, তারপরে বললো, “তুই যদি বলতে চাস যে ওর সাথে তোর কী হয়েছে, আমি শুনতে পারি।”
মিন হুয়ে মাথা ঝাঁকালো, “আমি বলতে চাই না, জোর করিস না।”
শিন ছির ফোন বেজে উঠিল। পকেট থেকে একটা ওষুধের বোতল বার করে মুখে একটা বড়ি ঢেলে দিলো, গিলেও ফেললো, বললো, “যা হোক, তুই যে ওকে ঘেন্না করিস, সেটা আমি বুঝতে পারছি।”
“...”
“কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তুই যদি ওকে এতো ঘেন্নাই করবি, তাহলে তোকে গুয়ান ছাওতে ফিরে যেতে হলো কেনো কাজ করার জন্য?”
অজান্তেই, ওর গলার স্বরে বিদ্রুপ মিশে গেলো, “কেনো, জুতো বেচছিস না? তুই তো তুই সুখে ছিলিস, তাই না?”
“চেং ছিরাং আমাকে হুমকি দিয়েছে যে ও আমার টিমের বাকিদের ছাঁটাই করবে।”
মিন হুয়ে থেমে গেলো, ও দেখতে পেলো যে শিন ছি ব্যাপারটা বুঝেছে বলে মনে হয় না। তারপর শিন ছি প্রশ্ন করলো, “জিএস১.০-এর কাজ?”
“চিন্তা করিস না, এখনো সময় হয় নি। অনেকগুলো লোকের একটা না একটা ঝামেলা আছে বাড়িতে। ওদের দরকার আছে লাগাতার রোজগারের। তাছাড়া জিএস প্রজেক্টটা কেবল আমরাই বানিয়েছি। আমরা এটাকে আরো সম্পূর্ণ করতে চাই ভার্সান আপগ্রেড করে। আমি অনেকগুলো ধারণা আর সমাধান ভেবেছি। আমি যদি এখন ছেড়ে দি, তবে এটা অন্যদের হাতে পড়বে। আর আমিও ভাবতে পারি না তাহলে এটা কেমন দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত। হয়তো এটা ধ্বংস হয়ে যাবে, অথবা এটাকে সরিয়ে দেওয়া হবে অন্য কোনো প্রোডাক্ট দিয়ে। আমি চাই না এটার শেষ অমন করে হোক।”
“তাহলে তুই লোককে কেবল পাথর ছুঁড়ে মারিস?”
শিন ছি মাথা নাড়লো, “ভাগ্যক্রমে, আমি ছিলাম, যদি আমার জায়গায় ও থাকতো, তবে তুই জেলে যেতিস, জানিস তো?”
“বুঝেছি।”
“সামনে একটা মল আছে। গিয়ে জামা কিনে নে। তোর জামাকাপড় ভিজে সপসপ করছে।” বললো শিন ছি।
মলটা বিনচেং-এর সমস্ত কেনাকাটার জায়গার মধ্যে সব চেয়ে খরচ সাপেক্ষ। ওখানে প্রচুর আন্তর্জাতিক বিলাসবহুল ব্র্যান্ডও আছে। মিন হুয়ে ভালোই বাসে জামাকাপড় সাজগোজের জিনিস কিনতে, তবে ওর নজর শুধু জিনিসিটা কেমন দেখতে তার ওপরে, তাই এই মলে ও কোনো দিন আসে নি।
একবার ওর জন্মদিনে ঝৌ রু জি ওকে কয়েকটা জামা আর জুতো কিনে দিয়ে ছিলো এখান থেকে কারণ ও জানতো যে মিন হুয়ে বেশি খরুচে নয় আর ওকে দামও বলে নি জামাজুতোর।
একবার একটা ক্রিসমাসের অনুষ্ঠানের জন্য, সাও মু ওকে ধরে এনে ছিলো এখানে। মিন হুয়ে ছোট্টো একটা ব্যাগ কিনে ছিলো গুচির। তারপর অনেক দিন অবধি সাও মু ওকে নিয়ে মজা করেছে কারণ সাও মু অন্তত দুটো ব্যাগ তো কেনেই প্রতি বছরে।
“দরকার নেই।” ধড়ফড় করে বললো মিন হুয়ে, “বাড়ি গিয়ে বদলে নেবো।”
“আমার জামাও নোংরা হয়ে গেছে।”
বললো শিন ছি, “চল রাতের খাবার মলেই খাই। আর আমি ড্রাইভারকে বলি গাড়িটা বদলে আনতে, তারপরে আমাদের নিয়ে ফিরবে আবার।”
“আজ তো তোর দেখা করার দিন, তাই না?”
ঘাড় নাড়লো মিন হুয়ে।
“সু ছনের আঁকার লাওশি একদল বাচ্চাকে নিয়ে একটা শিল্প প্রদর্শনীতে গেছেন। তাই সু ছন আটটা পর্যন্ত ফিরবে না।”
মিন হুয়ে বাধ্য চোখে শিন ছির রক্তমাখা কলারের দিকে তাকালো, ওর নিজেকে বড়ো অপরাধী লাগলো, ঘাড় নেড়ে বললো, “চল, দোকান বাজারও করি। আমি কিন্তু তোকে একটা সাদা শার্ট কিনে দেবো।”
****
মিন হুয়েকে নিয়ে শিন ছি সোজা গেলো ডায়র-এ।
মিন হুয়ে জানতো যারা ফিনান্সে কাজ করে তারা নিজেদের জামাকাপড়ের ব্যাপারে খুব মনোযোগী। তাই মিন হুয়ে ধাক্কাটা হজম করে নিলো আর চললো শিন ছি সঙ্গে সঙ্গে।
উৎসাহ নিয়ে একজন মহিলা কর্মী এগিয়ে এলেন, “আপনাদের দুজনের, কোনো সাহায্য লাগবে?”
“আমি ওঁকে একটা সাদা শার্ট কিনে দিতে চাই।" মিন হুয়ে বললো শিন ছিকে দেখিয়ে, “যেমনটা পড়ে আছেন ঠিক তেমনটা।”
শিন ছি জুড়ে দিলো, “আমার ঠিক এই স্টাইলটাই চাই।”
বলা শেষ করেই শিন ছি স্যুটের জ্যাকেটটা খুলে ফেললো, মহিলা কর্মী সেটা নিয়ে বললো, “এটা তো ভিজে গেছে। আমি কী এটা আপনার জন্য ইস্ত্রি করে শুকিয়ে আনবো?”
“ঠিক আছে, ধন্যবাদ।”
মহিলা কর্মী অন্য আরেকটি মেয়েকে স্যুটের জ্যাকেটটা দিয়ে দিলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনি যে ধরনের সাদা শার্ট পরে আছেন সেটা আমাদের কাছে আছে। আমি কী একই সাইজে আনবো?”
“বেশ, আপনি তবে এঁর জ্ন্য কিছু জামা আর জুতো দেখুন।" বললো শিন ছি।
“ঠিক আছে।" বললেন সুশিক্ষিত মহিলা কর্মী, তাঁর সশ্রদ্ধ আচরণে কোনো চাটুকারিতা নেই, “আপনার চেহারা তো দারুন, ফুরেঁ। আমাদের এখানে গোলাপ ছাপা স্কার্ট আছে। ওঁকে বেশ মানাবে।”
মিন হুয়ে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে তন্ন তন্ন করে দেখে তবে একটা পছন্দ করলো। একটা সুতি আর লিনেন মেশানো টি-শার্ট নিলো আর একটা ছাপা লম্বা স্কার্ট, কোনোটার ওপরেই দাম কিছু লেখা ছিলো না। মনে মনে মাপলো মিন হুয়ে, যেটা সব থেকে সস্তা বলে মনে হলো, সেটা নিলো। দোকানের কর্মীর জোরালো সুপারিশে এক জোড়া জুতোও নিলো, এই ভাবতে ভাবতে যে একমাস আগে যে বড়োসড়ো বোনাসটা পেয়েছে সেটা তো খরচাই হয় নি, ও নিজেকে কিছু পুরস্কার দিতেই পারে।
ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে মিন হুয়ে ব্যাঙ্ক কার্ড বার করে যেই দাম দিতে যাবে, অমনি সোজাসুজি শিন ছি বললো, “আমি দেবো।”
“না, না, আমি দেবো।" শিন ছির হাতের কার্ডটা ফের ওর হাতের মধ্যে গুঁজে দিলো মিন হুয়ে।
মিন হুয়ে দাম দেবার জন্য যেরকম জবরদস্তি করছিলো তা দেখে শিন ছি আর দোকানের কর্মী দুজনেই চমকে উঠলো।
মিন হুয়ে একটা গভীর শ্বাস নিলো। খুব তুচ্ছ দেখতে জিনিসগুলোর দাম দাঁড়ালো আশি হাজার য়ুঁআরো বেশি …
“তুই যদি আমাকে একটা সাদা শার্টই দিবি, তাহলে শুধু শার্টটার দামটাই দে।" উপায় না দেখে বললো শিন ছি।
শার্টটা - শুধু একটা শার্টই - সাত হাজার য়ুঁআরো বেশি। ঠিক আছে? মনে মনে বিড় বিড় করলো মিন হুয়ে, কিন্তু মুখে বললো, “দরকার নেই! আমি ঠিক পারবো দিতে। আমাকে গতমাসেই একটা বড়ো বোনাস দিয়েছে, আমি সেটা এখনো খরচ করি নি।”
“তেমন হলে -" ভ্রূ কুঁচকোলো শিন ছি, “আমি না হয় তোকে একটু সাহায্য করি খরচ করতে? খরচা কর, আমার এই শার্ট লাগবে এক ডজন।”
“নে তাহলে এক ডজন।”
মিন হুয়ে মনস্থির করে ফেলেছে, এই ঔদার্য্য ও শেষ পর্যন্তই টেনে নিয়ে যাবে।
দোকানের কর্মীর মুখে অপ্রস্তুত হাসি, “বু হাইসা, আমাদের কাছে এখন এক ডজন শার্ট নেই। এই সাইজে কেবল পাঁচ পিস আছে। অন্য ওয়্যারহাউস থেকে বাকিগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হবে না হয়। ছিং, একটা ঠিকানা দিয়ে যান। দু থেকে তিন দিনের মধ্যে আপনাদের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। ঠিক আছে?”
“হহ্।”
মিন হুয়ে ভাবছেঃ এর থেকে অনেক বেশি খরচ ও করেছে চেন জিয়া জুনের জন্য, আর শিন ছি তো সু তিয়াঁর প্রেমিক, তাহলে ওকেও সমান কদর করা উচিৎ। পয়সা বাঁচানোর কথা ভাবা যাবে না এক্ষেত্রে ও বেশ পয়সাওয়ালা লোক বলে। তাছাড়া, এখন, সু ছনের জীবনের যাবতীয় খরচ, সমস্ত কিছু শেখার খরচ, আর থাকার খরচ, সবই শিন ছি দিচ্ছে। ওকে কয়েকটা ভালো শার্ট কিনে দেওয়াই ঠিক কাজ।
মিন হুয়ে টাকাটা মিটিয়ে দিলো, ড্রেসিং রুমে গেলো। সমস্ত ভেজা জামাকাপড় বদলে নতুন জামা পরলো। বেরোনোর পরে দেখলো যে শিন ছির মুখের থেকে রক্ত ঝরা অবশেষে বন্ধ হয়েছে। নিশ্চিন্তির শ্বাস ছাড়লো দুজনেই। দুজনে তিনতলার পশ্চিমী খানার রেস্টুরেন্টে গেলো হাতে ব্যাগ নিয়ে।
রেস্টুরেন্টের ব্যবসা ওরা খারাপ করতে চায় না। ভেতরে বেশি খদ্দের ছিলো না। খাবার দিতে বলার দশ মিনিটের মধ্যেই খাবার সব এসে গেলো।
দুজনেই স্টেইক চেয়ে ছিলো, চুপ করে খেতে লাগলো, শুধু ছুরিতে মাংস কাটার শব্দ হচ্ছিলো।
“জানিস তো,” হঠাৎ যেনো কিছু মনে পড়ে গেলো শিন ছির, বলতে লাগলো মাংসের টুকরোটা সসে চোবাতে চোবাতে, “আমি তোকে আর জিয়া জুনকে এক বাক্স ফুটি পাঠিয়েছি। দিন দুয়েকে পৌঁছে যাবে। খেয়ে দেখিস।”
ফুটি |
মিন হুয়ে অবাক হলো। এটাই ফুটি খাবার মরশুম। ওগুলো বিক্রিও হয় বিনচেং-এর সর্বত্র। পাঠানোর কী দরকার, “তোর পাঠানো ফুটির কী কোনো বিশেষত্ব আছে?”
“আমি চাষ করেছি ওগুলো।”
মিন হুয়ে ভাবলো শিন ছি বুঝি ঠাট্টা করছে।
“তোর কী মনে আছে মিংশুই কাউন্টিতে যখন গিয়ে ছিলাম সেই সময়টার কথা? আমি একটা ফুটির ক্ষেত দেখে ছিলাম?”
মিন হুয়ের মনে আছে, “সেতো মাত্র তিরিশ মু মানে দু হেক্টর (প্রায় একশো ঊনষাট কাঠা) বা কুড়ি হাজার স্কোয়ার মিটারের এক টুকড়ো জমি … সঙ্গে একটা দোতলা বাড়ি?”
“ওটাই। আমি কিনে নিয়েছি।”
“এটা আবার কবে হলো?”
“কয়েক বছর আগে, আমি একটা ফুটির চাষাকে কাজে রেখে ছিলাম আমাকে শেখানোর জন্য কেমন করে ফুটি ফলাতে হয়।”
ব্যাপারটা যেনো বড্ডো উদ্ভট হয়ে যাচ্ছে। মিন হুয়ে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো, “কখন সময় পাস এতো এই সব করার তোর এই এতো ব্যস্ততার মধ্যে?”
“আমি তো আর রোজ যাই না। আম কয়েক জন লোককে রেখেছি জায়গাটার দেখাশোনা করার জন্য। যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন আমি কয়েক দিন থেকে ক্ষেতে কাজ করি। ফুটিগুলো সব প্রাকৃতিক, কোনো পোকা মারা ওষুধ নেই, মিষ্টি বাড়ানোর জন্য কিছু দিই না। ছন ছনেরও ভালো লাগবে নিশ্চয়ই।”
মিন হুয়ে তাকালো শিন ছির দিকে, নিঃশব্দে হাসলো, “শিন ছি, কখনো কখনো তোকে বুঝে উঠতে বেশ কঠিন লাগে।”
“সে তো তোকেও বোঝা মুস্কিল হয়ে যায় মাঝে মাঝে।" দুম করে বলে দিলো শিন ছি, “তোকে চার বছর আগে প্রথম বার দেখি। এক রকম। যখন তোর সঙ্গে বিনচেং-এ দেখা হলো তখন অন্য রকম। এই মূহুর্তের তুই, আরেক রকম। কোন রকমটা তুই?”
“এই এখনকার আমিটাই আসল আমি। আমি বদমেজাজী। প্রেমটা সত্যি। আসলে আমরা খুব এক রকম।”
“কী করে জানলি আমার ব্যক্তিত্বটা কেমন?”
“আমি জানি না। আমি একটা কল্পনা করে নি তুই আমার সামনে যেমন আচরণ করিস তার থেকে -”
“আমি তোকে ইচ্ছে করে যতোটা জানতে দিই, তুই ততোটাই জানিস। যা আমি তোকে জানতে দিই না, সেটার কিস্যু তুই জানিস না।”
“ঠিকই। যেমন, আমি জানি না তুই কেনো ফুটি ফলাতে চাস।”
“কারণ আমার মনে হয় যে আমার জনক-জননী মা আর বাবা ফুটি চাষ করতো।”
“নাও হতে পারে তো? তোকে তো আর ফুটির ক্ষেতে কুড়িয়ে পাওয়া যায় নি।”
“আমি যখন একদম বাচ্চা ছিলাম, আমি তখন মাঝে মধ্যেই স্বপ্ন দেখতাম যে আমি ফুটির ক্ষেতে খেলা করছি।”
ওর চিন্তাগুলো অন্য দিকে বয়ে গেলো, “আসলে, অনেক আগেই তোকে আমার সন্দেহ করা উচিৎ ছিলো। সু তিয়াঁ আমার এই স্বপ্নের কথা জানতো, ও বলতো যে আমার মা-বাবা আমার মধ্যে একটা স্বপ্নের বিশ্বাস গেঁথে দিয়েছে, ওঁরা হয়তো ফুটি ফলাতেন।”
“...”
“এই কথাটা সু তিয়াঁ ডায়েরিতে লেখে নি, তাই তুই জানিস না। তুই যদি সত্যি সু তিয়াঁ হতিস তাহলে তুই ফুটির বাগানের কথা শুনে অবাক হতিস না।”
“তুই কী রক্তের একটা নমুনা পেতে চাস?" মিন হুয়ে হঠাৎ বলে উঠলো, “আজকাল ডিএনএ পরীক্ষা খুব তাড়াতাড়ি হয়। তোর জন্মদাতা মা-বাবা হয়তো এখনো তোকে খুঁজছেন, হতে পারে যে তোকে ফেলে দেন নি তাঁরা। তোর পাশে যে লেখাটা ছিলো, সেটা হয়তো জাল …”
“না।”
“একটা মানুষের জীবনে দুয়েকটা আত্মীয়স্বজন থাকা ভালো।”
“আমার সু তিয়াঁ আছে, জিয়া জুন আছে, একটা সন্তান আছে।" শিন ছির দু চোখ নরম হয়ে এলো, “স্বজন যদি কারো না থাকে সে তো তোর - তোর মা-বাবা দু জনেই মারা গেছেন, আর তোর জেদ, মেজাজ। চেষ্টা করেছিস কখনো? আরেকটু ভালো থাকার?”
“সু তিয়াঁ যদি বেঁচে থাকে তবে ও তোর কথা জেনে খুশি হবে।”
শিন ছি দীর্ঘশ্বাস না ফেলে পারলো না।
মিন হুয়ে হঠাৎ হেসে উঠলো।
“এতো হাসির কী আছে?”
“আমরা সু তিয়াঁর কথা বললাম, কিন্তু ঝগড়া করলাম না - এমন বোধ হয় প্রথম বার হলো।" মিন হুয়ে বললো, “আজকে আমি তোকে খাওয়ালাম।”
“তার মানে আজ তুই সত্যিই পয়সা খরচা করলি।”
***
চালক গাড়িটা বদলে আরেকটা গাড়ি এনেছে, ওদেরকে ছ্যুনতাং গার্ডেন্স-এ নিয়ে যাবে বলে। অ্যাপার্টমেন্টে কেউ নেই। সু ছন তখনো বাড়ি ফেরে নি।
“আমি আগে চান করবো। কিছু মনে করবি না তো?" জানতে চাইলো শিন ছি, “আমার সারা গা থেকে রক্তের গন্ধ বেরোচ্ছে যেনো।”
“না, কিছু মনে করবো না।”
দুটো জামাকাপড় নিয়ে ও চানে চলে গেলো। একটা সাদা টি-শার্ট আর একটা ঢিলা ক্রপড প্যান্ট। ওর মুখ থেকে রক্ত বেরোনো এক্কেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কাচ লেগে ছড়ে দাওয়ার দাগগুলো খুব স্পষ্ট।
মিন হুয়ে বললো, “বোস, তোর মুখের ক্ষতগুলোতে ব্যান্ড-এইড লাগিয়ে দি।”
যেমন কথা, শিন ছি বসলো সোফাতে, আর মিন হুয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওর মুখটা ধরে প্রথমে একটা তুলোর টুকড়ো চুবিয়ে নিলো অ্যালকোহলে।
ক্ষত পরিষ্কার করা হয়ে গেলে, বুড়ো আঙুলের ডগার মাপে ব্যান্ড-এইড কেটে একে একে ক্ষতগুলোতে এঁটে দিলো।
দুজনে খুবই কাছাকাছি, শিন ছি একটা দারুণ গন্ধ ছড়াচ্ছে শাওয়ার জেলের। মাথার চুলের কিনারায় খুলির সাদা চামড়া অবধি দেখতে পাচ্ছে মিন হুয়ে। মিন হুয়ের আঙুলের ডগা ওর মুখের ওপর দিয়ে, ভ্রূর ওপর দিয়ে বুলিয়ে গেলো পাখির পালকের মতো হালকা চালে। হতে পারে এই জন্য যে ও কিছু সময় আগেই একটা বই পড়েছে, আর তার কালির গন্ধ লেগে আছে।
অন্য একটা কারণে মিন হুয়ে ঘামতে শুরু করলো, “শিন ছি।”
“হুঁ?”
“আমি প্রেম করতে চাই।”
“কী?”
“দয়া করে মাথায় কোনো গভীর মনস্তাত্ত্বিক বোঝা নিস না ।” , বললো মিন হুয়ে, “আমার এখন নিরাপদ কাল চলছে।”
“না।”
“আমি তোকে এই মাত্র বারোটা শার্ট কিনে দিয়েছি।”
“না।”
“তুই সু তিয়াঁকে পাস না কাছে, সেটা খুবই দুঃখের। তুই আমাকেও পাস না। তাও দুঃখের।”
“তুই ঠিক বলেছিস। সেটা দুঃখের। কিন্তু -”
শিন ছি অন্তর্ভেদী চোখে তাকালো মিন হুয়ের দিকে, “যদি আমি আমার শপথ ভুলে যাই, তবে সেটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-58.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-60.html
No comments:
Post a Comment