Thursday, October 3, 2024

JPDA - Chapter 58

৫৮. ইঁট 


মিন হুয়ের কাজ ছেড়ে দেবার কথা শুনে হাসলো য়িন শু কিন্তু কিছু মনে করলো না, “আমি ভেবে ছিলাম যে তুমি টেনে টুনে এক সপ্তাহ আমার সঙ্গে কাজ করলেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আমি আশাই করি নি যে তুমি এক মাস টিকে যাবে। খুব সহজ নয়। এটা তোমার ঘরের মাঠ নয় -”

য়িন শু একটা খাম বার করে মিন হুয়ের হাতে দিলো, “আমি তোমাকে এক মাসের মাইনে দিলাম, সঙ্গে রইলো একটা ডিসাইন ফি। ‘দোখোয়ো নি’ আমার অনলাইন দোকানটা সাজিয়ে দেবার জন্য আর দোকানটা চালাবো কী করে সেটা আমাকে শিখিয়ে দেবার জন্য।”

মিন হুয়ে এ সব কথার কোনো উত্তর দিলো না, “আমি টাকা চাই না।”

“স্বাগত। কিন্তু এটা তো শ্রমের পারিশ্রমিক।”

কাউন্টারের ওপরে ঝুঁকে হাসি মুখে বললো, “তুমি তো যা হোক কুড়ি দিনের বেশি কাজ করেছো।”

“কারণ আমি তোমার থেকে অন্য কিছু চাই।”

মিন হুয়ে বললো, “আমি শুনেছি যে স্পোর্টস অ্যাকাডেমিতে টেনিস খেলা ছাড়াও তুমি নাকি সানডা করতে পারো খুব ভালো।”

“হ্যাঁ। আমি তো আন্তঃশহর প্রতিযোগিতাও জিতেছি খান তিনেক।”

ঘাড় নেড়ে বললো য়িন শু, “তুমি কী চাও আমি কাউকে মারি, বলো না?”

“আমাকে শেখাতে পারবে? আমার বেশ ভালো রকম সানডা শেখা দরকার।”

মিন হুয়ে বলে গেলো, “বদলে আমি তোমার অনলাইন দোকানটার দেখাশোনা করে দেবো বিনা পারিশ্রমিকে, আর যে কোনো সময়ে যতোটা প্রযুক্তিগত সাহায্য লাগবে সেটাও করবো।”

য়িন শু তীব্র কৌতুহল নিয়ে দেখতে লাগলো মিন হুয়েকে। ভ্রূ কুঁচকে উঠলো, “অবশ্যই আমি তোমাকে শেখাতে পারি। তবে আমি পরামর্শও দেবো যে সমস্যার সমাধান মারপিট করে করতে যেও না, তাতে তুমি ঝামেলায় জড়িয়ে যাবে।”

“দুশ্চিন্তা করছো।”

সানডা

তারপর একটু ভেবে বললো, “ঠিক আছে। আমি তো এখন একা। আমি কাজও করি না। আমার প্রচুর সময় আছে। কবে শুরু করতে চাও?”

“আজই।”

“কতোটা শিখতে চাও?”

“আমারে ওপরে কোনো হামলা হলে আমি যেনো নিজেকে বাঁচাতে পারি।”

“তুমি কী বলছো ‘লাং ফাংয়ু’ - নেকড়ের মতো আত্মরক্ষা?”

“হ্যাঁ।”

য়িন শু তাকিয়ে দেখলো মিন হুয়ের দিকে, “তাহলে তোমার আরো বেশি করে খাওয়া উচিৎ যাতে গায়ে জোর বাড়ে। হাত-পা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করার কায়দাটা একটা দিক মাত্র। খুব ভারি, বড়ো চেহারার কাছে যতোই কুশলী হও না কেনো,সেটা আর কাজে লাগে না।”

“বুঝলাম।”

মিন হুয়ে মাথা চুলকে বললো, “আমাদের তো একটা জায়গা লাগবে।

“সেটা সহজ। আমার এক বন্ধু একটা জিম খুলেছে। ঐ জায়গাটাই ওর থেকে ধার করে নেবো।”

অলসভাবে জানালো য়িন শু, “আমি ওর জন্য অনেক কিছু করেছি।”

“তাহলে এটাই ঠিক হলো।”

**************

প্রথম দুটো সপ্তাহ সব খুব চুপচাপ কাটলো। 

যেমন কথা দিয়ে ছিলো, চেং ছিরাং একটা পদ তৈরি করলো সাও মুয়ের জন্য। নাম রাখলো “প্রজেক্ট ম্যানেজার”। ওর কাজ হলো জিএস২.০ ভার্সান-এর রিসার্চ আর ডেভেলপমেন্টের তত্ত্বাবধান করা আর নেতৃত্ব দেওয়া।

এভাবে মিন হুয়েকে সরাসরি দিঁ য়িফঁয়ের কাছে কাজের হালহকিকত নিয়ে জবাবদিহি করতে হয় না। যদিও মিটিং-এ ওর মুখোমুখি হওয়াটা এড়ানো যায় না।

সাও মু অনেক চেষ্টা করলো জিএস টিমটাকে একসাথে বসতে দেবার। কিন্তু গুয়ান ছাও-এর ভেতরে জায়গার অভাব খুব। যে আগে আসবে সে আগে বসার জায়গা পাবে এমনটাই বন্দোবস্ত। তাই সাও মু পুরোনো কর্মীদের কাউকে ঠেলে সরাতে পারলো না যাতে নতুনরা একসাথে বসার জায়গা পায় একই তলায়। মিন হুয়ে জানলার কাছে একটা কোণের দিকে অফিস পেয়েছে। ছোটো কিন্তু চুপচাপ। দিনের বেশিরভাগটাই মিন হুয়ে কাটায় অফিসে বসে প্রোগ্রাম লিখে। ও শুধু বেরোয় দুপুরে খাবার জন্য।

গুয়ান ছাও-এর নিজের কর্মীদের জন্য খাবার জায়গা আছে। সেখানে খাবার যা পাওয়া যায় সেসব ভালোই, সস্তায় পাওয়া যায়, নানান পানীয়ের দাম লাগে না।

অধিকাংশ কর্মীই খাবার জন্য রেস্টুরেন্টে যায়।

মিন হুয়ে ঠিক করে নিয়েছে যে ও সস্তার লোভে পা দেবে না, ও মজায় অংশ নেবে না। তাই ও রোজ সাও মুকে ডেকে নিয়ে নিচের তলার ছোটো দোকানে যায় ভিয়েতনামের ‘ফো’ খেতে।

ভিয়েতনামের ‘ফো’


“বিবিজির পুরোটাই এখানে চলে এসেছে।” সাও মু নিজের ঝোলে চুমুক লাগিয়ে বললো রাস্তার উল্টো পাড়ের উঁচু বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে, “ভেতরের সাজগোজ খুবই নজরকাড়া, কেতাদুরস্ত।”

“কেমন ধাঁচে?”

স্প্রিংরোলে একটা কামড় বসিয়ে জানতে চাইলো মিন হুয়ে।

“তা আমি বলতে পারবো না। মূল রংটা হালকা ধূসর, অনেক ফ্রেম আর কাচ, মাঝে মাঝে কয়েকটা সবুজ গাছ। বেশ একটা হিম হিম ভাব।”


হাইতিয়াঁ বিল্ডিং-এর ভেতরের সাজগোজ


মিন হুয়ের মনের গভীরটা ঘাড় নাড়লো যেনো। এটাই তো শিন ছির প্রিয়তম সাজের ধাঁচ।

হাইতিয়াঁ বিল্ডিং-এর পুরোটা হালকা নীল কাচে ঢাকা। একদম ওপরে কয়েকটা সাদা বাঁক আছে।

আবহাওয়া ভালো থাকলে, বাড়িটা দেখায় আকাশী নীল রঙের, আকাশের সঙ্গে যেনো মিশে থাকে, দূর থেকে দেখলে বোঝাই যায় না যে অতো বড়ো একটা বাড়ি আছে ওখানে।


হাইতিয়াঁ বিল্ডিং - দিনের বেলা

রাতে ঝলমলে আলোতে, বাড়িটার ছ কোণা স্টিলের কাঠামোটা ফুটে ওঠে, যেনো মৌচাক, ভেতরের লোকগুলোকে দেখায় ব্যস্ত কর্মী মৌমাছির মতো, বেশ শান্ত আর প্রাকৃতিক চেহারা, ঝলমলে আবার ঠান্ডাও।


হাইতিয়াঁ বিল্ডিং - রাতের বেলা


“যারা বাড়িটার ভেতরের নকশাটা করেছে তারা কে জানে কোথা থেকে দুটো ভাস্কর্য এনে বসিয়েছে, সে দুটো এক্কেবারে আশ্চর্যরকম।” জুড়ে দিলো সাও মু।

“তাই নাকি?”

“তুমি যাও নি ওখানে?”

মিন হুয়ে মন দিলো ঝোলের মধ্যেকার বিফ ব্রিস্কেট খুবলে খাওয়াতে, “না।”

ওর সাথে শিন ছির ঠান্ডা লড়াইটা চলছে একমাসেরও বেশি সময় ধরে। প্রথম দু সপ্তাহে ও যখন সু ছনের সঙ্গে দেখা করতে যেতো, ওর সাথে শিন ছির দেখা হয়ে যেতো। দুজনেই কেবল সাধারণ কথা বলে এড়িয়ে গেছে একে অপরকে।

তারপরে গেলে ওর সাথে ন্যানির দেখা হয়েছে কিংবা ইয়ুন লুয়ের। শিন ছি গায়েব হয়ে গেছে সমস্ত সম্ভাব্য সাক্ষাতের জায়গা থেকে।

মিন হুয়ে ভেবে ছিলো যে শিন ছি বুঝি ফিরে গেছে নিউ ইয়র্কে। যখন কথাটা ও জানতে চাইলো, তখন ইয়ুন লু জানালো যে শিন ছি কোথাও যায় নি বিনচেং ছেড়ে। কিন্তু সব সময়ে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়িয়েছে যে মিন হুয়ে যে সময়টাতে সু ছনের কাছে যায়, সেই সময়টাতে শিন ছি কখনো থাকে না।

মিন হুয়ের রাগ হচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে যে শিন ছি জোর করে এসব কায়দা করছে। তাই তারপরে যখন ও গেছে সু ছনের সঙ্গে দেখা করতে, তখন ও শিন ছির ব্যাপারে কোনো প্রশ্নই করে নি কাউকে। 

হাইতিয়াঁ বিল্ডিং রাস্তার এক পাড়ে আর অন্য পাড়ে চেনঝঁ বিল্ডিং। আর রোজ মাত্র পনেরো মিনিট লাগে মিন হুয়ের সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে হেঁটে অফিসে পৌঁছোতে। রোজ দিনে দু বার ও বিবিজির বাড়িটার পাশ দিয়ে চলে যায়। কিন্তু কখনো ভেতরে যায় না।

দুটো বাড়িই কাচে মোড়া। মিন হুয়ের অফিসও দুই বাড়ির মধ্যেকার রাস্তার দিকে। যখনই ওর চোখ ভারি হয়ে আসে, ওর চোখের বিশ্রামের দরকার পড়ে, ও অভ্যেসবশত জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। কখনো কখনো ভাবে ও যে শিন ছি কাজ করে উল্টোদিকের বাড়িটায়, কিন্তু ও জানে না কোথায়, কোন তলায়।

শিন ছি কখনো আসে নি ওকে খুঁজতে।

********

ফো খেয়ে ফেরার পথে মোবাইল ফোন মনে করিয়ে দিলো যে একটা মিটিং আছে। মিন হুয়ে সোজা মিটিং-এর ঘরে চলে গেলো। 

মিটিং-এ যাবার মিনিট দশেক আগে মিন হুয়ে যাচ্ছিলো বাথরুমে। একটা মাঝবয়সী লোক হুড়মুড়িয়ে এসে বললো, “অ্যাই, ওদিকে একটা বাক্স করে কোল্ড ড্রিংক্স রাখা আছে। ছিং, সকলকে দিয়ে দাও। একেক জনকে একেক বোতল।”

মিন হুয়ে কেমন যেনো জমে গেলো, হাত-পা-চিন্তা-মন সব অচল হয়ে গেলো যেনো। তারপরে ওর মনে পড়ে গেলো যে কনফারেন্সের ঘরে ও একাই মেয়ে। আর লোকটা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে যে ও একজন সেক্রেটারি হবে।

“আমি জিএস টিমের লিডার।" বললো মিন হুয়ে।

“আমি জানি।" লোকটা বিশেষ গুরুত্ব না দিয়েই বলে উঠলো, তারপরেও বলে গেলো, “কোল্ড ড্রিংক্স ওদিকে আছে, তাড়াতাড়ি যাও, মিটিং-টা এক্ষুণি শুরু হতে যাচ্ছে।”

“তোমার নিজের হাত আছে তো, তুমি নিজে যাচ্ছো না কেনো?" বললো মিন হুয়ে।

বলার পরে লোকটা বসে পড়লো সহজভাবে, “কারণ তুমি জোয়ান, তুমি নতুন এখানে।”

“আমি নতুন টিম লিডার, নতুন সেক্রেটারি নই।”

লোকটা ভাবেও নি যে ওকে এতো প্রতিবাদের মুখে পড়তে হবে। অতোগুলো মানুষের সামনে ও হালও ছেড়ে দিতে পারছে না। তাই ও টেবিল ঠুকে, পিছনের সারিতে আঙুল দেখিয়ে বললো, “তুমি ওই সারিতে বসো, এই সারিটা বিভাগীয় প্রধানদের।”

“আমি এখানেই বসবো।" মিন হুয়ে পিছনে হেলে বসলো, আর পা জোড়া সোজা করে নিলো, “এই চেয়ার খুবই আরামের।”

এরপরে কানে ইয়ার প্লাগ গুঁজে ও গান শোনার ভান করলো। লোকটা রাগে পা ঠুকলো মেঝেতে, কিন্তু ওকে নিজেকেই কোল্ড ড্রিংক্স বয়ে আনতে হলো।

এরকম ঘটনা মিন হুয়ের কর্মজীবনে বার বার ঘটেছে, বিশেষ করে ও যখন প্রথম কোম্পানিতে যোগ দিয়ে ছিলো তখন। স্বভাব দোষে কিছু পুরুষ সহকর্মী ধরেই নেয় যে কোম্পানিতে বেশ কিছু কাজ যেমন - কফি বানানো, বিলি করার জন্য তথ্য লেখা কাগজ প্রিন্ট করা, উৎসব অনুষ্ঠানের জোগাড় করা, অনুষ্ঠান হয়ে গেলে উদ্‌যাপণের জায়গাটা পরিষ্কার করা - এই সবই মেয়েদের কাজ, যদিও মেয়েটা সেক্রেটারির কাজ করে না আর এমন একজন সহকর্মী যে পদমর্যাদায় সমতুল।

মিটিং-এর সময়ে মেয়েদের বক্তব্যে থেকে থেকে ব্যাঘাত করবে আর মেয়েদের মতামত অগ্রাহ্য করবে কিংবা সেগুলো নিজেদের বলে চালিয়ে দেবে। যদি মেয়েরা রেগে যায় বা চেঁচামেচি করে, তবে অল্প বয়সীদের বলা হবে, ‘মাসিমা এসেছেন।” আর বয়স্কদের মনে করা হবে, “ঋতুজরার হতাশা দেখাচ্ছেন।”

মহিলার যদি সন্তান থাকে, তবে ঐ ধরনের পুরুষদের মনে হয় যে মেয়েদের মন সারাক্ষণ বাড়িতে পড়ে থাকে আর মেয়েটা কাজে কিছুতেই মন দিতে পারে না। যদি মেয়েটা সব্বার থেকে বেশি ওভারটাইম করেও থাকে, আর কোনো কাজ নির্ধারিত দিনে শেষ করে দিতে কখনো ব্যর্থ নাও হয়, তাও।

তখন ও কাজে সবে যোগ দিয়েছে, কাজটা পাকাও হয় নি।

জীবনের নানান পরিস্থিতির ব্যাপারে অনভিজ্ঞ, কিন্তু মাইনের ব্যাপারে উৎকন্ঠিত, যতোই খারাপ লাগুক, ও তখন সব সহ্য করে নিতো। যদিও জানতো যে ওকে অপমান করা হচ্ছে, আর ওকে নোংরা কথা বলা হচ্ছে, তবুও ও সবার কথায় জোর করে হাসতো।



মিন হুয়ে ফোনে ব্যস্ত। চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো কাজের সমস্ত খবরাখবরে, কাজের যে সমস্ত গ্রুপ আর ফোরাম আছে সে সবে, কয়েকটা উইচ্যাট মেসেজেরও জবাব দিলো। ওর পিছনে জোর আলোচনার গুনগুন আওয়াজ কানে এলো, “ওয়াও, এই সেই প্রবাদপ্রতিম মিন হুয়ে! ওর সাথে ঝামেলা কোরো না- সেকালে সে নাকি চেং জঁয়ের সাথে মামলা লড়ে ছিলো।”

“সে সুন্দরী বটে। চেহারা খুবই আকর্ষণীয় …”

“এখনো একলাই আছে, পিছনে লাগবি ভাবছিস?”

“ওর কিন্তু একটা বাচ্চা আছে।”

ছেলেদের গল্পগুজব মেয়েদের গল্পগুজবের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ানক।

দুম করে মিন হুয়ে ঘাড় ঘোরালো। চেষ্টা করছিলো খুঁজে বার করতে যে কে বিদ্রুপটা করলো, কিন্তু গুনগুন শব্দটা উবে গেলো।

বড়ো বড়ো পা ফেলে ঘরে ঢুকল দিঁ য়িফঁ। স্পষ্ট দুটো খালি জায়গা ছিলো প্রথমের সারিতে। কিন্তু ও বেছে নিলো মিন হুয়ের ডান পাশের চেয়ারটা। গলা খাঁকারি দিয়ে সাফ করে নিয়ে বললো, “এখন মিটিং। সব বিভাগের প্রজেক্ট টিম নিজের নিজের কাজ কতো দূর এগিয়েছে সে কথা জানাবে। কোনো সমস্যা থাকলে তাও জানাবে।”

তিরিশ জনেরও বেশি মানুষ বসে ছিলো ছোটো ঘরটাতে, মিটিং-এ। ‘লিডার’-এর কাছে প্রথম সারিতে একটু ভিড় বেশি। দুটো পাশাপাশি চেয়ারের দূরত্ব হাতের একটা পাঞ্জার দৈর্ঘ্যের থেকে বেশি নয়। 

গুয়ান ছাও-তে প্রচুর নিয়মিত মিটিং হয় - মিন হুয়ের ভালোই অভিজ্ঞতা আছে কয়েক বছর আগে কোম্পানিটাতে কাজ করার কারণে। এখন অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। একদিনে তিন থেকে পাঁচটা মিটিং তো হয়ই স্বাভাবিকভাবে, সাত-আটটা মিটিং হলেও অবাক হবার কিছু নেই। কারণ কোম্পানিটা নানান বাড়িতে ছড়ানো, কাজের বিভাগগুলো জটিল, আর অনেক কনফারেন্স কলও চলে।

সময়টা দীর্ঘ আর একঘেয়ে লাগে। একের পরে এক বিভাগ নিজেদের কাজের খবর দিয়ে চলেছে। আর দায়িত্বে থাকা প্রত্যেকটা লোক একগোছা করে ফর্ম ধরে আছে আর একটা যান্ত্রিক সুরে পড়ে যাচ্ছে।

ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে শুনতে মিন হুয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পড়ে ছিলো। কফিতে কয়েকটা চুমুক লাগাতে হলো ঝরঝরে হবার জন্য। 



শরীরে গরম কফি ঢুকতেই ও টের পেলো যে ওর শরীরের কোথাও একটা কোনো গোলমাল চলছে। মাথা নিচু করে একটু মনসংযোগ করলো, বোঝার চেষ্টায় যে ঠিক অস্বস্তিটা শরীরের কোন অংশে, কোন অঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো। সাদা টেবিলক্লথের আড়ালে দিঁ য়িফঁ-এর উরু ছুঁয়ে আছে ওর ডান পা।

প্রথমে ভাবলো দিঁ য়িফঁ হয়তো ইচ্ছে করে উরু দিয়ে ওর পা-টা ছোঁয় নি। কারণ চেয়ারগুলো খুব ঘেঁষাঘেঁষি করেই রাখা আছে। 

তাই মিন হুয়ে নিজের ডান পাটা একটু বাঁদিকে সরিয়ে নিলো। এক সেকেন্ড পরে দিঁ য়িফঁয়ের উরুও সরে এসে চেপে বসে পড়লো মিন হুয়ের ডান পায়ের কোলে। 

মিন হুয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে একটু কাশলো। যেনো ইশারায় দিঁ য়িফঁকে বললো উরু সরিয়ে নিতে।

দিঁ য়িফঁ একটা আধাখানা হাসি নিয়ে তাকালো মিন হুয়ের দিকে, কিন্তু ওর পা একটুও নাড়ালো না। একটু পরে আলতো করে নিজের জুতোর ডগা ঘষতে লাগলো মিন হুয়ের ডান পায়ের জানুতে। 

লম্বাঝুলের টেবিলক্লথ সবই আড়াল করে রেখেছে। মিন হুয়ে একটা ধূসর রঙের কোট আর স্কার্ট পরে আছে, পায়ের ওপরে ঢাকা শুধু একটা পাতলা স্টকিং। মিন হুয়ের গা গুলিয়ে উঠলো দিঁ য়িফঁয়ের অসভ্যতায়। 

জুতোর ডগাটা বার বার ঘষছে মিন হুয়ের জানুর মাঝামাঝি। টেবিলের ওপরের দিকে, দিঁ য়িফঁ বসে আছে শিড়দাঁড়া সিধে করে, একহাতে একটা মার্কার ধরা, মূল বক্তব্যগুলোতে দাগ দিয়ে চলেছে কাগজের ওপরে, যেনো টেবিলের নিচে কিছুই হচ্ছে না।

হঠাৎ মিন হুয়ের হাত একটা ঝাঁকুনি দিলো। কফির কাপটা উল্টে গেলো ঢাকা খোলা অবস্থায়, বাদামী কফি চলকে পড়লো, সোজা দিঁ য়িফঁয়ের ঊরুসন্ধিতে।

খালি কাপের মতো চেহারার থার্মোসটা থেকে তখনো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কফিটা থার্মোসে সবেই ঢালা হয়েছে তো, প্রায় আশি বা নব্বই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। দিঁ য়িফঁ কিছুতেই আটলাতে পারলো না, ওর মুখ দিয়ে একটা ‘ওহ্‌” বেরোলো। ওর ঊরু জ্বলে যাচ্ছে। ও যন্ত্রণায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।

কপাল জোরে পরণের প্যান্ট কালো রং-এর। শুধু ভেজা দাগটুকু ছাড়া ও কিছুই বলতে পারলো না। ও দৌড়ে গেলো বাথরুমে।

মিন হুয়ের পিছনে আরেক প্রস্থ গুঞ্জন উঠলো। মিন হুয়ে শান্তভাবে কফির কাপটা নিয়ে উঠে গেলো সব থেকে কাছের চায়ের ঘরে ওর কফির কাপটা ফের ভরে আনার জন্য। কাপে ঢাকা দিলো না। বসে রইলো একই চেয়ারে।

ও জানে না কে যে বাইরে গিয়ে ছিলো চুপি চুপি ধোঁয়া টেনে নিতে। মিটিং-এর ঘরে কড়া নিকোটিনের গন্ধ। পরিবেশটা কেমন যেনো ঝিমোনো। কর্ণধার নেই। কেউ কথা বলছে না কারণ একজন গোমড়ামুখো মহিলা বসে আছে টেবিলে।

মিন হুয়ে ফোনে ফিরে গেলো। নানান তথ্য ঘাঁটতে লাগলো কাজের জন্য, কিছুই যেনো হয় নি এমন একটা মুখ করে।

কয়েক মিনিট পরে দিঁ য়িফঁ ফিরে এলো মিটিং-এর ঘরে। তাড়াহুড়ো করে বললো, “আজকের মিটিং-এর কথা হোক আগে।”

তারপর ধড়ফড় করে মিটিং শেষও করে দিলো।

মিন হুয়ে নিজের অফিসে ফিরলো বিজয়ীর মেজাজে। ও স্থির হয়ে বসতে না বসতেই দমকা হাওয়ার মতো তেড়ে এলো দিঁ য়িফঁ, দরজা বন্ধ করে দিলো, মুখে লেশমাত্র আবেগের চিহ্ন নেই, বললো, “মিন হুয়ে এক্ষুণি যেটা করলে সেটা ইচ্ছে করে করলে।”

“তুমিও তো ইচ্ছে করেই করেছো।”

“হ্যাঁ।”

“তুমি আমাকে আঘাত করেছো।”

ভ্রূ তুলে বললো দিঁ য়িফঁ, “তোমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তাই না? বেশ কাজের পরে রাতের খাবার খেতে চলো আমার সঙ্গে, যাবে?”

“দিঁ য়িফঁ, তুমি কিন্তু আমাকে আবার ওস্কাচ্ছো -" উপহাসের সুরে বললো মিন হুয়ে, “আমি কিন্তু জিনিসটা কেটে একটা লোহার স্কিউয়ারে গেঁথে, মাটন কাবাবের মতো রোস্ট করব!”

মিন হুয়ে বুঝতে পারলো না ওর কথাগুলোর দৃশ্যগত প্রভাব খুব জোরালো নাকি ওর গলার স্বরটা খুব উঁচু, নিজের অচেতনেই দিঁ য়িফঁ এক পা পিছিয়ে গেলো, কিন্তু ওর চোখমুখে কোনো অভিব্যক্তি ছিলো না।

ও স্বীকার করলো আর হুমকি দিলো নিচু স্বরে, “মিন হুয়ে, আমার পরামর্শ হলো যে উচ্ছ্বসিত হয়ে বেপরোয়া আচরণ করো না! তুমি আমার অধস্তন, তোমাকে শেষ করতে আমার এক মিনিটও লাগবে না।”

“আমি যেনো তোমার ভয়ে কেঁচো! আমি পরে তোমার নামে এইচআর কমপ্লেন করবো।”

“যাও, যাও না।" উপহাস করলো দিঁ য়িফঁ, “তুমি তো এইচ আরে থেকে থেকেই যাও, তাই না? এর আগে তো তুমি চেং ছিরাং-কেও ছাড়ো নি। কিন্তু এখন ওরা আরো ভালো পারে বোবা কালা হয়ে থাকতে। দূর্দান্ত।”

“দূর হ।”

দিঁ য়িফঁ নাক দিয়ে বিদ্রুপ উগরে দিলো, ঘুরে দাঁড়ালো দরজার দিকে, দু পা এগোলো, হঠাৎ করে ‘স্যুইশ’, একটা খেলনা তির ওর কানে সিটি বাজিয়ে গেলো, আর দরজায় গিয়ে গেঁথে গেলো তিরের ফলাটা। ও মাথা তুলে দেখলো, দেখতে পেলো একটা কাঠের তিরন্দাজির নিশানা ঝুলছে দরজায়।

ঘুরে তাকালো, মিন হুয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাতে আরেকটা তির নিয়ে, একটা আধখানা হাসি নিয়ে বললো, “দ্যুইবুচি, প্রোগ্রাম লেখার সময় এটা একটা ছোটো সময় কাটানোর খেলা, পরে ফোন কোরো না হয়, আমাকে কিছু বলার থাকলে, দুমদাম করে যে কোনো সময়ে এখানে এসে পোড়ো না। যদি আমার নিশানা ফস্কে যায়, আর তাতে তোমার লাগে, অন্ধ হয়ে গেলে খুব চাপ হবে তোমার, তাই না?”

ঘর ছেড়ে চলে গেলো দিঁ য়িফঁ, এক বারও ফিরে তাকালো না। তাকালে দেখতো মিন হুয়ের দু চোখে জ্বলতে থাকা ঘেন্নার আগুনে ওর সবটাই পুড়ে রোস্ট হয়ে যেতে পারে।

যদিও অনেক বড়ো একটা যুদ্ধের একটা ছোট্টো লড়াই জিতে গেলো মিন হুয়ে, তবুও ও সতর্ক হলো যাতে ব্যাপারটা ও হালকাভাবে না নেয়। দিঁ য়িফঁ একটা কথা ঠিকই বলেছে। যে কোনো কাজের জায়গায়, যদি ঊর্ধতন ঠিক করে যে অধস্তনকে শাস্তি দেবে, তার অনেক উপায় আছে। চেং ছিরাং-এর তুলনায় দিঁ য়িফঁ একটা সাধারণ এলেবেলে মাত্র, ওর পদমর্যাদাও অনেক নিচে। মিন হুয়ে বরং দশটা দিঁ য়িফঁর সাথে ঝুঝবে, একটা চেং ছিরাং-এর বদলে।

দেখা গেলো যে মিন হুয়ে বড্ডো শিগগির হেসে ফেলেছে।

ও যখন কাজের থেকে বেরোলো তখন জানলার বাইরে বিদ্যুতের ঝলক, বাজ পড়ার শব্দ। বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো ঝমঝম করে।

ট্যাক্সি ডাকা যাবে না। মিন হুয়ে ভেবে দেখলো অফিসবাড়িটা থেকে সাবওয়ে পর্যন্ত হেঁটে যেতে খুব বেশি হলে পনেরো মিনিট লাগবে। তাড়াতাড়ি যদি হাঁটে ও, তাহলে দশ মিনিটেই পৌঁছে যাবে। দৌড়ে চলে যাবে না হয় বৃষ্টিতে।

পাঁচ মিনিটও হাঁটে নি মিন হুয়ে, একটা কালো গাড়ি এসে ধীরে ধীরে থেমে গেলো ওর পাশে। পিছনের সিটের দরজাটা ঠেলে খুলে দিলো কেউ ভেতর থেকে। মৃদু স্বরে কে যেনো বললো, “উঠে এসো, আমি তোমাকে পৌঁছে দেবো।”

বাজ পড়ার শব্দ, বৃষ্টি পড়ার শব্দ মিলে মিশে কথাগুলোকে চাপা দিয়ে দিলো প্রায়, কিছুই স্পষ্ট করে শোনা গেলো না। ঘাড় ঘুরিয়ে মিন হুয়ে দেখলো গাড়ির ভেতরে …

ভেতরে একটা পুরুষ বসে আছে, কালো রঙের উইন্ডব্রেকার পরে, কলার তোলা, তাতে বারবেরি নকশা ফুটে উঠেছে।

বারবেরি নকশা


তার মানে চেং ছিরাং।

পাত্তা না দিয়ে মিন হুয়ে হাঁটতে লাগলো। 

গাড়িটা পুরো রাস্তাটা ওর পিছু পিছু চললো, দরজাটা খুলে রেখে, চেং ছিরাং বলে যেতে লাগলো ভেতর থেকে, “এতো ঝড় বৃষ্টির কী আছে? আমরা দুজনে তো একসাথে কাজ করি, তুমি তো আমাকে চিরকাল এড়িয়ে যেতে পারবে না।”

মিন হুয়ে কোনো উত্তর দিলো না। সোজা হেঁটে যেতে লাগলো।

“যা হোক, কাল বাদ পরশু তুমি আমার সাথে ব্যবসার কাজে বাইরে যাচ্ছো। বেজিং-এর একটা হাসপাতাল আমাদের জিএস১.০ কিনতে চায়। তাই বোঝাপড়া করার জন্য তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছো।”

“আমি যাবো না।”

“এটা কাজ। তোমাকে যেতেই হবে।”

ওর গলার স্বর উঁচুও নয়, নিচুও নয়, কিন্তু কর্ত্তৃত্বে ভরপুর।

মিন হুয়ে আবার ওকে পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে লাগলো। 

হাঁটা নয়, ছোটা, ঘোড়ার মতো লাফিয়ে।

ওর পিছনে গাড়ির চাকার গড়ানোর আওয়াজ। খানিক পরে বোধ হয় অবশেষে অধৈর্য হয়ে গেলো গাড়িটা, গাড়িটা হঠাৎ গতি বাড়িয়ে ওকে পেরিয়ে ওর রাস্তা জুড়ে দাঁড়ালো।

পিছনের জানলার কাচ আধখানা নামানো, “খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছে। উঠে এলে গাড়িতে, আমি পৌঁছে দিতে পারি।”

“যা ভাগ। যতো দূরে পারিস ভাগ।”

হাওয়ার তোড়ে প্রায় উড়ে যাওয়া ছাতাটাকে নেড়ে নেড়ে গাড়ির দিকে চিৎকার ছুঁড়ে দিতে লাগলো মিন হুয়ে, “তুই যদি আর ঘ্যান ঘ্যান করিস, বিশ্বাস করিস আর না করিস, আমি তোকে পিটিয়ে মেরে ফেলবো।”

গাড়িটা ওর পিছু পিছু চলতে লাগলো। মিন হুয়ে রাগে ফেটে পড়লো। মাটিতে একটা ইঁট পড়ে থাকতে দেখে, বেড়ালের মতো কোমর ঝুঁকিয়ে ঝট করে মিন হুয়ে সেটা তুলে নিলো, আর সেটা ছুঁড়ে ভেঙে দিলো গাড়িটার জানলার কাচ।

একটা ‘ক্লিক’ শব্দে গাড়িটার জানলার কাচে একটা গর্ত হয়ে গেলো, একটা পরিচিত মুখের অর্ধেক প্রকাশ হলো, রক্তে মাখামাখি। গাড়ির সওয়ারি মিন হুয়ের হাতে ইঁটটা দেখতে পেয়ে ছিলো। ভেবে ছিলো মিন হুয়ে ইঁটটা ওদের দিকেই ছুঁড়বে, অবচেতনে নিজের মাথা জাপটে ধরে ছিলো। 

মিন হুয়ে চমকে উঠলো, আর ইঁটটা মাটিতে পড়ে গেলো, “শিন ছি?”




~~~~~~~~~~~~

সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96

Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-57.html

Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-59.html

No comments:

Post a Comment

Readers Loved