৬১. এরোপ্লেনে
ইয়াও ঝি ঝুয়ের শরীর কেবলই খারাপ হচ্ছে। মিন হুয়ে তিন দিন কিংবা পাঁচ দিন ছাড়া ছাড়া ওর সাথে হাসপাতালে দেখা করতে যায়।
যখনই ঝৌ রু জিকে জিজ্ঞেস করে যে ঝি ঝুয়ের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে কিনা, ও অস্পষ্ট ইঙ্গিত দেবে মাত্র এই যে কোনো উন্নতি হচ্ছে না আর যে ওষুধগুলো ওকে এখন দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো মূলত ওর যন্ত্রণা উপশমের জন্য।
হাসপাতাল ওকে এক মাসের ছুটি দিয়েছে ওর রুগ্ন বউয়ের দেখাশোনা করার জন্য।
অনকোলজি ডিপার্টমেন্টে কর্মী কুলানো দায়। ঝৌ রু জি সেখানে প্রধান চিকিৎসক। অপরেসনের ঘরে যাবে না আর ব্যস্ত সহকর্মীদের সাহায্য করবে না সেটা অবাস্তব। তাও ঝৌ রু জি প্রস্তাব দিয়েছে যে ও রোজ অর্ধেক দিন কাজ করবে।
সমস্ত অপেরাসনের ব্যবস্থা করেছে রাতে যাতে দিনের বেলার সবটা ও বউয়ের সাথে কাটাতে পারে।
দ্বিতীয়ত, রাতে ঝি ঝু ঘুমোয়। আর ডাক্তারেরাও ক্লান্ত থাকে। এভাবে সবার জন্য একটা করে অতিরিক্ত রাতের শিফ্ট করে ঝৌ রু জি।
অপেরেসনের ঘর চার তলায়। একই তলায় অ্যানাসথেসিওলজি, ইমেজিং, প্যাথোলজি ল্যাবরেটরি, ব্লাড ব্যঙ্ক, সার্জারি, ফার্মাসি আর অন্যান্য বিভাগ।
ঝি ঝুয়ের ওয়ার্ড পাঁচ তলায়। পাঁচ তলাতেই ঝৌ রু জির অফিসও। দুটোই কাছাকাছি।
মিন হুয়ে ভাবছিলো যে চার দিন হয়ে গেলো ও ঝি ঝুয়ের কাছে যায় নি। আবার পরের দিনই ও একটা ব্যবসার কাজের জন্য বাইরেও যাবে। তাই সন্ধে সাতটা নাগাদ ও হাসপাতালে এলো। ও যখন নার্সের স্টেশনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো তখন নার্স ওকে চিনতে পারলো, সম্ভাষণ করলো আর জানালো, “ঝৌ ইশঅ সার্জারিতে আছেন।”
“ঝি ঝু কী ঘুমিয়ে পরেছে?”
“এখনো না।”
ঝি ঝুয়ের ওয়ার্ড গলিপথের একেবারে শেষে। পুরো গলিটা হেঁটে পেরিয়ে দেখলো একজন শক্তপোক্ত চেহারার মানুষ বসে আছেন চেয়ারে গলিপথের পাশে। ও ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ কিছুই ভাবলো না। ভেবে নিলো যে লোকটি নিশ্চয়ই কোনো রোগীর পরিবারের লোক হবেন।
অপ্রত্যাশিতভাবে, মিন হুয়ে দরজায় টোকা দিতে যাচ্ছে দেখে, লোকটা হঠাৎ দৌড়ে এসে ওকে বাধা দিলো, রুক্ষ্ম স্বরে জানতে চাইলো, “দাঁড়ান, আপনি কী ঝৌ ইশঅকে চেনেন?”
লোকটা ম্যান্ডারিন বলছে খুব জোর দিয়ে। মিন হুয়ে লোকটার দিকে ভালো করে দেখলো। লোকটার বয়স তিরিশের কোঠায়, লম্বা মুখ, চওড়া নাক, গায়ের রং চাপা।
যে কোনো কারণেই হোক লোকটার চুলে সামান্য পাক ধরেছে। একটা ডুরে শার্ট পরনে, হাজারো ধোলাইতে ধুয়ে গেছে জামার আসল রং, কিছুতেই বলা যাবে না আর সেটা যে কী ছিলো। জিন্সও খুব নোংরা, তাতে বড়ো বড়ো গর্ত অনেকগুলো। পরে আছে এক জোড়া ছেঁড়াখোঁড়া স্নিকার, তাও কাদা মাখা।
মিন হুয়ে সততার সঙ্গেই উত্তর দিলো, “হ্যাঁ।”
“আপনি কী ওঁর পরিচিত?”
“প্রাক্তন স্ত্রী।”
শুনেই লোকটা থপ করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো, “জিয়ে, আমি চাই আপনি ঝৌ ইশঅকে বলুন আমার ছেলের অপেরেসন করতে। আপনি কী আমার হয়ে ওঁকে রাজি করাতে পারবেন? আপনি যদি না পারেন তবে আমার ছেলে মরেই যাবে।”
লোকটা কথা বলার সময়ে ফোঁপাচ্ছিলো। ওর গলার স্বরটা কর্কশ আর কথার সুরটা বেদনাদায়ক।
মিন হুয়ে থমকে গেলো মূহুর্তটাক। বুঝতে পারছে না এমন সময়ে কী বলা উচিৎ।
ঝৌ রু জির সঙ্গে যখন একসঙ্গে থাকতো, অনেক সহকর্মী মিন হুয়েকে অনুরোধ করেছে যদি ঝৌ রু জি ওঁদের রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে সাহায্য করেন ঠিক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে, বিছানার ব্যবস্থা করে, এমনকি এও অনুরোধ করেছে যে ঝৌ রু জি যদি নিজে উপস্থিত থেকে অপরেসনের তত্ত্বাবধান করেন। যদি ব্যাপারটা খুব ঝামেলার না হয়, তবে ঝৌ রু জি সব সময়ে খুব চেষ্টা করেছে সকলকে সন্তুষ্ট করার।
“গ্যগ্য, উঠে দাঁড়ান আগে।”
লোকটাকে টেনে তুলে চেয়ারে বসিয়ে, নরম সুরে বললো মিন হুয়ে, “দুম করে সার্জারি তো আর করা যায় না। যদি আপনার ছেলের সত্যিই সার্জারি দরকার আর এই হাসপাতালে ওকে ভর্তি করে নিয়েছে, তা হলে ব্যবস্থা করা যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনাকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”
“না! হাসপাতাল কিছুতেই নেবে না।”
লোকটা বিশ্রি রকম কাঁদতে লাগলো, “আমার ছেলে খুবই অসুস্থ, কোনো হাসপাতাল ওকে নেবে না, কোনো ডাক্তার ওর অপরেসন করবে না … কিন্তু এ বছরে ওর পাঁচ বছরও বয়স হয় নি। ও এখনো প্রাইমারি ইস্কুলেও যায় নি! আমি এমন করে আমার প্রাণের টুকড়োটা দেবার জন্য রাজি নই! আমার হৃদপিন্ডে যেনো একটা বড়ো ছ্যাঁদা হয়ে গেছে।”
“গ্যগ্য, আপনার ছেলের কী … মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স করা আছে?”
“শিনং … ওরা আমাকে পরে টাকা দিয়ে দিতে পারে। আমি অনেক টাকা ধারও করেছি। আমি অপরেসনের খরচা দিয়ে দিতে পারবো। ঝৌ ইশঅ যদি অপরেসন করতে রাজি থাকেন, তবে আমি আজীবন ওঁর খিদমত খাটতে রাজি আছি! জিয়ে, দয়া করে সাহায্য করুন আমাকে, আমাকে সাহায্য করুন ঝৌ ইশঅকে রাজি করাতে! ওঁকে দয়া করতে বলুন! আমি ভিক্ষে চাইছি আপনার কাছে … আমার ছেলেকে অপেক্ষা করিয়ে করিয়ে মেরে ফেলবেন না!”
লোকটা এক দশমিক সাত কিংবা এক দশমিক আট মিটার মানে প্রায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা। মিন হুয়ে ধৈর্য ধরে অনেক কথা জিজ্ঞেস করছে দেখে লোকটার বোধ হয়ে মনে হলো যে সামান্য আশার আলো আছে, লোকটা আবার হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো আর সাষ্টাঙ্গে ভয়াবহ গড়াগড়ি দিতে লাগলো মিন হুয়ের সামনে।
“গ্যগ্য, এমন করবেন না।”
এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়ে নি মিন হুয়ে। খুব ভয় পেয়ে ও এক পাশে লুকিয়ে পড়ার কথা ভাব ছিলো, “আমি ডাক্তার নই, আমার সামনে এমন করার কোনো মানে নেই।”
লোকটা কোনো কথা শুনবে না কিছুতেই, সমানে সাষ্টাঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর সাদা মার্বেলে ছিটে ছিটে রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে, ইঁটে মুখের ঘষা লেগে। মিন হুয়ে চাই ছিলো লোকটাকে টেনে তুলে দিতে, কয়েক বার চেষ্টা করেও পারলো না। ভয়ের চটে মুখ তুলে তাকালো যেই অমনি দেখতে পেলো যে একজন নার্স দৌড়ে আসছে একজন নিরাপত্তা কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে।
নার্স চাপা স্বরে ধমক লাগালো, “ঝ্যাং ইয়ং গেন, আবার আপনি এখানে কেনো? এটা রোগিদের থাকার জায়গা। আর এখানে রোগিরা সবাই গুরুতর অসুস্থ। চলে আসুন, এখানে ঝামেলা পাকাবেন না, এতে বাকি সব রোগিদের অসুবিধে হবে যে!”
“দয়া করে বাচ্চাটাকে বাঁচান! আমি অবশেষে একটা পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছি, ওর মা অন্য লোকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে, ওর পেচ্ছাপ পায়খানা পরিষ্কার করেছি নিজে হাতে, এই আমার একমাত্র চারা, দয়া করে আমাকে উদ্ধার করুন, আমি ভিক্ষে চাইছি, আমাকে সাহায্য করুন।”
ঝ্যাং ইয়ং গেন মাটিতে মুখ ঘষে ঘষে সাষ্টাঙ্গ ভঙ্গিতে প্রার্থনা করতেই লাগলো। নার্স শ্বাস ফেলে ইশারা করলো নিরাপত্তা কর্মীকে, নিরাপত্তা কর্মী ওকে জোর করে ধরে এলিভেটরে পুরে দিলো।
মিন হুয়ে একটা টিস্যু বার করে মেঝের থেকে রক্ত মুছে দিলো। আর নিচু গলায় জানতে চাইলো, “কেমন অসুখ হয়েছে ওঁর ছেলের? কেনো আপনাদের হাসপাতাল ওর ছেলেকে ভর্তি নিচ্ছে না?”
“ও ওর বাচ্চাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য যায় নি এমন জায়গা নেই। কাছেপিঠে যতো হাসপাতাল আছে সব জায়গায় গেছে, কিন্তু কেউ নেয় নি ওর ছেলেকে। এমন নয় যে আমরা লোককে বাঁচাতে চাই না, কিন্তু সার্জারিতে জীবনের ঝুঁকি খুব বেশি, একবার গেলে বেঁচে বেরোনোর সম্ভাবনা প্রায় নেইই। সাহায্য করতে পারলে কে না সাহায্য করবে? শিশুর বয়সটা নিতান্ত কম, এতো দুঃখজনক।”
“ওর বোঝা উচিৎ?”
“ও বুঝবে না। ও কিছুতেই বুঝবে না। যে ভাবেই আমি ওকে বোঝাই না কেনো, কিছুতেই কিছু হবার নয়। আমি জানি না ও কোথা থেকে শুনে এসেছে যে ঝৌ ইশঅ একই রকম অপরেসন করেছেন আগে, সেটা সফলও হয়েছে, তাই ও এখানে এসেছে। এখানে এসে ও ঘ্যান ঘ্যান করছে এক সপ্তাহের বেশি। ঝৌ ইশঅ রোগির সমস্ত তথ্য পড়ে দেখেছেন, আর জানিয়েও দিয়েছেন যে অপরেসন খুব বিপজ্জনক আর ফলও দেবে না কোনো, তাই অপরেসন করতে উনি বারণ করেছেন। কিন্তু এই লোকটা শুনবেই না। রোজ এসে ভিক্ষে করে যেনো। ওকে আমরা এও বলেছি যে ঝৌ ইশঅ-র নিজের স্ত্রী অসুস্থ এখনো, ওঁর এখন অপরেসন করার মতো মানসিক ইচ্ছে নেই এখন, তাই ও এখন অন্য কারুর মাধ্যমে ঝৌ ইশঅকে বলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে ওর ছেলের অপরেসন করেন ঝৌ ইশঅ, ও কিছুতেও যাবে না এখান থেকে। সত্যি বলতে কী আমার মাথায় আর বলার মতো ভালো কিছু আসছে না। আমি কিছু করতেও পারবো না। … আমাদের এই তলার বিভাগে আমরা ওর জন্য চাঁদাও জড়ো করেছি। ঝৌ ইশঅ নিজেও অনেকটা চাঁদা দিয়েছেন।”
একটা অসুস্থ ছেলের কথা, মিন হুয়ে অবস্থাটা যেনো খুব বেশিই বুঝতে পারছে। ভাগ্যের কোনো তুলনা নেই বেয়াড়া রোগের সামনে। তাই মিন হুয়ে কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারলো মাত্র।
যখন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো, তখন দেখতে পেলো ঝি ঝু হেডফোন লাগিয়ে বাজনা শুনছে। মিন হুয়েকে দেখে খুশি হয়ে বললো, “হাই।”
ওর মুখে আজ অনেকটা রক্তাভা। বেশ চনমনেও দেখাচ্ছে ওকে। আধঘন্টাটাক দুজনে মিলে গল্প করার পরে ঝি ঝু হঠাৎ করে বললো, “যা হোক, মিন হুয়ে, আমি তোমাকে একট কাজ করতে বলবো। আমি শুনেছি শিন ছির বাড়ি মেগুওয়াতে?”
“দোয়ে।”
“ও কি প্রায়ই যায়?”
“ওর বাড়ি নিউ ইয়র্কে, বিবিজির হেডকোয়ার্টার্সও নিউইয়র্কে। আর ও প্রায়ই যায় ওখানে। মূলত মাসে এক বার বা দু বার।”
“আমি ওকে বলতে চাই আমার জন্য দু জোড়া জুতো আনার জন্য।”
মিন হুয়ে মনমরা হয়ে গেলো। ওর মা যে মারা যাওয়ার ঠিক আগে কফিনে ঢাকা দেবার কাপড় কিনতে চেয়ে ছিলো। ওর মা জানতেন যে মিন হুয়ে জীবনে এসব কাজ করে নি, তাই উনি নিজেই এক প্রস্থ কফিনে চাপা দেওয়ার কাপড় কিনে ছিলেন আগে ভাগে আর চুপি চুপি রেখে দিয়ে ছিলেন ওঁর নিজের ব্যাগে। মারা যাবার আগে কথাটা নিজেই মিন হুয়েকে বলে ছিলেন, আর বলে ছিলেন যে তিনি এক জোড়া খুব নরম জুতো কিনে রেখেছেন, সেগুলো মিন হুয়ে যেনো পায়ে পরে দেখে ওঁর জন্য। পায়ে হচ্ছে কিনা।
মিন হুয়ের বোকার মতো জুতো জোড়া বার করে পায়ে পরে দেখে ছিলো, তখনই ওর মা অচৈতন্য হয়ে পড়েন, আর কখনো চেতনা ফেরে নি ওঁর, সেই রাতেই মারা গিয়ে ছিলেন।
“আহ্?” মিন হুয়ে অবাক হবার ভান করলো, হাসলো, “এখানে পাওয়া যাবে না এমন কি জুতো আছে? তোমাকে বলেছি, য়িন শু একটা জুতোর দোকান খুলেছে? তুমি যদি কোনো জুতো কিনতে চাও, তবে ওর কাছে যাও, ও আমদের প্রচুর ছাড় দেয় দামে। কেমন?”
“আসছে মাসে রু জির জন্মদিন। তাই আমি ভাবছিলাম যে ওকে কী উপহার দেওয়া যায়? সে দিন অ্যানাস্থেসিওলজি ডিপার্টমেন্টের লি ইশঅ এসে ছিলেন আর বললেন যে উনি এক ধরনের জুতোর ব্র্যান্ড দেখে ছিলেন যখন মেগুওয়াতে ট্রেনিং-এ গিয়ে ছিলেন, ঐ জুতোগুলো বিশেষ করে সার্জেনদের জন্য বিশেষ উপযোগী। ব্র্যান্ডের নাম ড্যান্সকো। ওগুলো তৈরিই করা হয়েছে চিকিৎসাক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের কথা ভেবে, যাতে অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও ক্লান্ত না লাগে।”
“সত্যিই? আমি প্রথম শুনছি এগুলোর কথা।”
মিন হুয়ে গোপণে নিজেকে ‘লজ্জিত’ বলে মেনে নিলো, ও কয়েক বছর থেকেছে ঝৌ রু জির সঙ্গে, কিন্তু কখনো খেয়ালই করে নি ঝৌ রু জি কেমন জুতো পরে। কিন্তু ও অনেক বার ঝৌ রু জিকে বলতে শুনেছে যে অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ও ক্লান্ত হয়ে গেছে।
য়িন শু একটা হাওয়া ভরা দৌড়োনোর জুতো ঝৌ রু জির জন্য ঠিক হবে বলে জানিয়ে ছিলো। সেটাই সার্জারির জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“ওর পায়ের পাতার বাঁকটা উঁচু। পুরো ওজনটা গিয়ে পড়ে আঙুলের নিচে আর গোড়ালির নিচে। এক একটা অপরেসনের জন্য ওকে প্রায় পাঁচ ছ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বয়স যখন কম ছিলো, তখন সব ঠিক ছিলো, কিন্তু এখন ও কেবল বলে যে ওর পিঠে ব্যাথা করছে। আমি শুনেছি যে ঐ ধরনের জুতোগুলো বিশেষভাবে পায়ের পাতাকে রক্ষা করে, আর মেগুওয়ার অনেক হাসপাতালের সার্জেনরাই ঐ রকম জুতো পরেন। তুমি কী শিন ছিকে বলতে পারবে আমার জন্য দু জোড়া এনে দেবার কথা? নয় নম্বর সাইজ, সাদা বা কালো দু রকমই চলবে। চিন্তা কোরো না। আমি ওর জন্মদিনের ঠিক আগে আগে এনে দেবো।”
মিন হুয়ে চটপট রাজি হয়ে গেলো, “কোনো সমস্যাই নেই। আমি যাবো আর ওকে বলবো যে ও যদি এ মাসে নাও যায় তো তবে যেনো ওর কোনো বন্ধুকে বলে ওখান থেকে ক্যুরিয়র করে তোমাকে পাঠিয়ে দেবার জন্য।”
“রাং হৌ, ছিং, শিয়া শিয়া।" ওর চোখ জ্বলজ্বল করছিলো, ও খুব বিশ্বাসের হাসি নিয়ে বললো, “রু জিকে বোলো না কিন্তু। আমি ওকে ‘জিংসি’ দিতে চাই।”
“ওকে।”
ঝি ঝুয়ের মুখে একটা বিরল গোলাপী আভা দেখা দিয়েছে, ও এমনিতেই সুন্দরী, যদিও ও রোগা আর দূর্বল, ওকে অন্যান্য রোগিদের থেকে একটু যেনো বেশি ভালো দেখতে। ঝৌ রু জি বলেছে যে ওর যখন খুব শরীর খারাপ থাকে তখন ও শব্দের ব্যাপারে খুব সজাগ হয়ে থাকে, ওর পক্ষে ঘুমোনো মুস্কিল হয় যদি সিলিং থেকে ঝোলা ফ্লুওরোসেন্ট আলো থেকে বিদ্যুত চলাচলের সামান্যতম শব্দও হয়।
ওকে প্রায় বাড়ির আরামে রাখার জন্য রু জি, বিশেষ করে বাড়ির থেকে এনেছে ঝি ঝুয়ের প্রিয় টিফানি টেব্ল ল্যাম্প আর দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছে ওর প্রিয় তেল রঙের ছবিগুলো। এমন কি লেপ, কম্বল বালিশও বাড়ির থেকে এনে দিয়েছে।
মুখটা দেখাচ্ছে একটা অসম্পূর্ণ কাদার ভাস্কর্যের মতো |
কেমোথেরাপির চোটে ওর ভ্রূ আর চোখের পাতা খসে পড়ে যাচ্ছে। ওর পুরো মুখটা দেখাচ্ছে একটা অসম্পূর্ণ কাদার ভাস্কর্যের মতো, কিন্তু মুখের পরিসীমা জুড়ে এখনো অটুট সৌন্দর্য। টিফানি ল্যাম্পের রঙীন কাচের ছটায় ওর মুখটা যেনো ক্লিম্ট-এর আঁকা কোনো তেল রঙের ছবির মতোই সুন্দর।
ক্লিম্ট-এর আঁকা কোনো তেল রঙের ছবি |
***
পর দিন সকালে, এয়ারপোর্টে চেং ছিরাং-এর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যাওয়া এড়াতে মিন হুয়ে ইচ্ছে করে চেক-ইন করতে দেরি করলো, চেক-ইন করলো ফ্লাইট ছাড়ার মাত্র চল্লিশ মিনিট আগে। ও মনে মনে ভাব ছিলো কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ও যাবে ইকোনমি ক্লাসে, চেং ছিরাং যাবে বিজনেস ক্লাসে। আর বিনচেং থেকে বেজিং ফ্লাইটে যেতে লাগবে দু ঘন্টা। তাহলে এই লোকটাকে সহ্য করার কোনো ব্যাপারই নেই।
অপ্রত্যাশিতভাবে, কেবিনে পা রেখে দেখলো যে চেং ছিরাং আসলে ওর পাশের সিটেই বসেছে। ও জানলার ধারে, চেং ছিরাং আইলে। যখনই মিন হুয়ে ঢুকবে বা বেরোবে চেং ছিরাংকে উঠে দাঁড়াতে হবে, রাস্তা দেবার জন্য।
কী আপদ?
মিন হুয়ে চারপাশে দেখতে লাগলো। অন্য কোথাও একটা ফাঁকা সিট যদি চোখে পড়ে। কিন্তু যতো দূর ও দেখতো পেলো, সবই ভর্তি।
একজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডান্ট দেখতে পেলো যে ওর হাতে একটা স্যুটকেস আর ও দাঁড়িয়ে আছে অনেক ক্ষণ, তাই সে এগিয়ে এসে বললো, “শওজিয়ে, আপনার কোনো সাহায্য লাগবে।”
তৎক্ষণাৎ মিন হুয়ে বললো, “আমি আপগ্রেড করতে চাই, পারি কী?”
“দ্যুইবুচি, বিজনেস ক্লাস ভর্তি, এর মধ্যেই।" তারপরে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডান্ট বললো, “প্লেন এখনই উড়বে। আপনি শিগগির বসে পড়ুন।”
আর কোনো উপায় রইলো না মিন হুয়ের ব্যাগটা তুলে রেখে চেং ছিরাং-এর পাশে বসে পড়া ছাড়া।
ও উঠে দাঁড়িয়ে মিন হুয়েকে রাস্তা করে দিলো।
“এতো দেরি করলে যে?”
চেং ছিরাং এক ঝলক তাকালো মিন হুয়ের দিকে, “ট্র্যাফিক জ্যাম?”
আজ একটা হালকা ধূসর রঙের স্যুট পরে আছে, সঙ্গে গাঢ় নীল রঙের টাই, ঝকঝকে সুদর্শন দেখাচ্ছে।
“হম্ম্।”
মিন হুয়ে ইয়ার ফোন বার করে গুঁজে দিলো কানে। কোনো দ্বিধা না করে চেং ছিরাং সেগুলো টেনে খুলে দিলো, গুঁজে রাখলো একপাশে, “গান শুনো না।”
“কী চাই আপনার?”
চেং ছিরাং-এর দিকে ফাঁকা চোখে তাকালো মিন হুয়ে।
“এসো কথা বলি।”
ওর গলার স্বর খাদে আর প্রচুর কায়দা তাতে, “মিন হুয়ে, আমি এই মূহুর্তটার জন্য অপেক্ষা করে আছি অনেক সময় ধরে।”
মিন হুয়ে ফোনটা তুলে নিলো আর গলার স্বরে জাগিয়ে তুললো ফোনের রেকর্ডারটাকে, “আসুন কথা বলি, আমি সবটা রেকর্ড করে রাখবো।”
“দুষ্টু।”
একটা উপহাস করে ফোনটা কেড়ে নিলো চেং ছিরাং। আর মেশিনটাকে তারপর বন্ধ করে দিলো, “সাধারণ বুদ্ধি, প্লেনের ভেতরে তুমি ফোন ব্যবহার করতে পারো না।”
“ফাk।” মনের গভীরে গাল পাড়লো মিন হুয়ে।
মিন হুয়ের দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলো চেং ছিরাং, “কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম ব্যবহার করো তুমি, কী ভালো গন্ধ? আমাকে বসন্তের কথা মনে করিয়ে দেয় গন্ধটা। আমি আমার বউয়ের জন্য একটা কিনতে চাই।”
মিন হুয়ে উদাস, নিরুত্তাপ। আপনমনে বলে যেতে লাগলো, “বেশ, আমি না হয় আন্দাজ করি - বারবেরি - ‘হার ব্লসম’ - তাই না? ছিটিয়ে দাও আর মনে হবে যে তুমি যেনো লন্ডনের একটা ফুলে ঢাকা রাস্তায় হাঁটছো …”
অন্য আর যে কোনো লোকের সঙ্গে চেং ছিরাং-এর সব চেয়ে বড়ো তফাত এই যে চেং ছিরাং-এর তীব্র ঘ্রাণ শক্তি, প্রায় নেকড়ের মতো। বিশেষ করে গায়ের গন্ধের ব্যাপারে ওর নাসা খুবই স্পর্শকাতর। ওর সচিব আর সহায়কদের ও কিছুতেই লিক, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ দেওয়া ঝোল খেতে দেয় না কাজের সময়ে।
বিনচেং-এ বার্বিকিউ-এর ছড়াছড়ি আর খুব জনপ্রিয়ও বটে, কিন্তু জিরের গন্ধ এড়ানোর জন্য লোকটা নানা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যায়।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়েও ওর অনেক বাতিক। টেবিলে নোংরা থাকলে ও সচিব আর পরিষ্কারের কাজ করার মহিলাকে একসাথে বরখাস্ত করে।
শোনা যায় যে ওর সাথে ওর বৌয়ের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে যখন ওর বৌ কুকুর পুষতে শুরে করে।
পশুর গন্ধ পছন্দ নয় চেং ছিরাং-এর। পশুর চুল সর্বত্র পড়ে থাকাটাও ওঁর অপছন্দ। ও বিড়াল পছন্দ করে না, কুকুর অপছন্দ করে আরো বেশি।
তাই লোকটা সব ধরনের ভালো গন্ধের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করেছে, গন্ধের ব্যাপারে বিশারদ হয়ে উঠবে বলে, ও জানে নানান ফুলের গন্ধ, বাকলের গন্ধ, নানা খাবারের দহনের গন্ধ। ও মহিলা কর্মীদের প্রসাধন সুগন্ধীর প্রশংসা করে থাকে, ও সব সময়ে ভালো অনুমান করতে পারে। প্রত্যেক বছরে আটই মার্চ মহিলা দিবসে ও নিজে পছন্দ করে এক বোতল সুগন্ধী উপহার দেয়।
মিন হুয়ের বারবেরির ‘হার ব্লসম’-এর বোতলটা সাও মু-এর থেকে পাওয়া উপহার। আর বোতলটা এখন প্রায় তলানিতে। মিন হুয়ে বোতলটা ফেলে দিতে চায় না। মিন হুয়ে তাই শেষ ফোঁটাটাকে জলে গুলে একটা শাওয়ার জেলে মিশিয়ে নিয়েছে।
সাও মু বলে ছিলো কলেজে পড়ার সময় থেকেই চেং ছিরাং সুগন্ধী ভালো বাসে, “জানোই তো ছেলেদের ডরমিটরিতে কী দূর্গন্ধ ছাড়ে!”
চেং ছিরাং-এর মনোযোগ পাবার জন্য ডরমিটরির মেয়েরা পুরো গ্রীষ্মের রোজগার খরচ করে ফেলতো সুগন্ধীতে, যদি চেং ছিরাং-এর মন পাওয়া যায়।
“তুমি কী জানো, চেং ছিরাং,পৃথিবীতে সব চেয়ে জোরালো গন্ধ ছড়ায় কী থেকে?”
উপহাস করলো মিন হুয়ে, “চরিত্র থেকে। দূর্গন্ধটা কোনো সুগন্ধী দিয়েও ঢাকা দেওয়া যায় না।”
চেং ছিরাং-এর মুখটা হঠাৎ বিষন্ন হয়ে গেলো, ও মুখটা প্রায় খুলতেই যাচ্ছিলো প্রতিবাদ করার জন্য, এই সময় একটা লোক হড়বড় করে ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ওকে একটা ধাক্কা দিলো, হাতে করে যে কম্পিউটারটা বইছিলো সেটা দিয়ে।
ধাক্কা দিয়েই লোকটা দুম করে মুখ ঘুরিয়ে বললো, “ছিরাং?”
মিন হুয়ে মুখ তুলে তাকালো আর অবাক হলো। শিন ছি। একটা সাধারণ সাদা জামা আর খাটো ঝুলের ধূসর প্যান্ট পরে আছে। সবার থেকে শেষে প্লেনে চড়েছে ও, পুরো রাস্তাটা দৌড়ে দৌড়ে এসে, ওর মুখটা ঘামে ভেজা।
“ইথান?”
দুজনে বিনয়ের সঙ্গে করমর্দন করলো।
“তায় ছাওলা? তোমার সাথে প্লেনে দেখা হয়ে গেলো?”
হাসি মুখে শিন ছি বললো, “মিন হিয়ে, কিছু মনে না করিস যদি তবে তুই কী আমার সিটে গিয়ে বসবি? কতকগুলো প্রজেক্ট আছে আমার, সেগুলো নিয়ে চেং জঁ-এর সাথে আমার ভালো করে কথা বলা দরকার। এইটা আমার ব্যাগ। নিয়ে চলে যা।”
মিন হুয়ে একটু থতোমতো খেলো, তারপর খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো, “না, না। কিচ্ছু মনে করবো না। কিছুই মনে করবো না। কথা বল তোরা।”
বলেই শিন ছির থেকে ব্যাগ আর টিকিট নিয়ে নিলো, হেঁটে সামনে এগিয়ে গেলো। একজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডান্ট এগিয়ে এসে দেখলো পরীক্ষা করে ওর টিকিটটা, বললো, “সোজা যান, তারপরে ডানদিকে বাঁক নেবেন, বিজনেস ক্লাস।”
মিন হুয়ে একটু ইতস্তত করলো, ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো বেশ খোশ মেজাজে শিন ছি কথা বলছে চেং ছিরাং-এর সাথে। ভাবলো, মিন হুয়ে আর কেনো বেশি ভাবে যদি শিন ছি কিছু না ভাবে তো? তাই একটা বসার জায়গা পেলো আর মাথা ঠান্ডা করে বসলো।
দু ঘন্টা একটা মুভি দেখতে যতোটা সময় লাগে ঠিক ততোটা। মিন হুয়ে একটা অর্থহীন কমেডি বেছে নিলো। দেখা শেষ হওয়ার আগেই প্লেন মাটি ছুঁলো। ও নিজের আসল জায়গায় ফিরে গেলো, মালপত্র নেওয়ার জন্য, আর শিন ছির ব্যাগটা ফিরিয়ে দিলো। শিন ছি তখনো কথা বলে চলেছে চেং ছিরাং-এর সঙ্গে, নিচু স্বরে।
“মিন হুয়ে,” ওকে দেখা মাত্রই আদেশ করলো চেং ছিরাং, “সন্ধে সাতটা তিরিশে হাসপাতালের ডিরেক্টর আমাদের ডিনারে ডেকেছেন। ঠিকানাটা তোমার মোবাইল ফোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
“ওকে।”
“তুমি প্রজেক্টের জন্য তৈরি হয়ে নিও।”
“রাতের খাওয়া হয়ে গেলে পর, ওঁরা তোমার থেকে প্রোডাক্টের কথা শুনবেন।”
“সব তৈরিই আছে।”
“আমি হোটেলের লবিতে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো সাতটা দশে, একসাথে যাবো।”
আবার বললো চেং ছিরাং।
“ওহ্ - ছিরাং।” শিন ছি বলে উঠলো, “মিন হুয়ে হোটেলে থাকে না।”
“ওহ্?” অখুশি ভরে গেলো চেং ছিরাং-এর চোখে, তারপরেও হেসে বললেন, “ইথান, এবারে আমরা ব্যবসার কাজে এসেছি।”
“আমি বেঁচে আছি।”
“আমার ছেলের অসুখের কথা জানো না? আমি একজন বয়স্ক চিনে ডাক্তারের সঙ্গে একটা যোগাযোগ করেছি। ছেলের মা তো বড়ো একটা বেজিং-এ আসে না। আমি সেই ডাক্তারের সাথে দেখা করে পরামর্শ নিতে চাই।”
শিন ছি ভান করলো যেনো ও চেং ছিরাং-এর অভিব্যক্তি দেখতেই পায় নি, “মিন হুয়ে বলে নি তোমাকে?”
“না।”
“ভুলে গিয়ে ছিলাম।" জুড়ে দিলো মিন হুয়ে।
“জায়গাটা একটু দূরে। কথাবার্তা হয়ে গেলে আমি মিন হুয়েকে পৌঁছে দেবো তোমাদের মিটিং-এর জায়গায়। কী বলো, ঠিক হবে তো? আমি কথা দিলাম, তোমাদের বিকেলের কাজে, ব্যবসায়ে ব্যাঘাত হবে না।”
চেং ছিরাং অবশ্যই অবাক হয়ে যাচ্ছিলো। ওর কোনো ধারণাই নেই যে শিন ছি ঠিক কী করছে। ঘাড় নেড়ে সায় দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না ওর, “ঠিক আছে। আজ রাতে দেখা হবে তোমার সাথে।”
ট্যাক্সিতে বসে শিন ছি বললো, “জিঁরঁ জিয়ে চলুন।”
মিন হুয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোর পুরো কোম্পানিটা বিনচেং-এ চলে যায় নি?”
“আমার অ্যাপার্টমেন্ট যায় নি।”
“ওটা ভাড়ার নয়?”
“না।" বললো শিন ছি, “আগে ঘরে ফিরি, বিশ্রাম নি। তারপর সন্ধেবেলা আমি তোকে নিয়ে যাবো ডিনারে, আমি তোকে নিয়েও আসবো।”
এতোগুলো দিন ধরে দুজনের ঠান্ডা লড়াই চলছে। মিন হুয়ের অস্বস্তি হতে লাগলো হঠাৎ শিন ছি এতোটা মনোযোগী হতে, “দরকার নেই এতো ঝামেলার। কোম্পানি তো আমার জন্য হোটেল বুক করেইছে।”
“তুই চেং ছিরাং-এর সঙ্গে যেতে চাস না, তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে ওর থেকে দূরে থাক। আমার সঙ্গে থাক।”
“...”
“মিন হুয়ে আমি জানি তুই লোকটাকে ঘেন্না করিস।”
শিন ছির চোখমুখ খুব গম্ভীর, “যতোই ঘেন্না করিস না কেনো, কোনো হিংস্র কাজের কথা ভাবিস না, প্রাণ নেবার কথা তো ভাববিই না, বুঝলি?”
মিন হুয়ে ঘাবড়ে গেলো, “আমি খুন করার কথা ভাবলাম কখন?”
“তোর মনমেজাজ ভালো নেই আজকাল, তাই তোকে একটু চোখে চোখে রাখতে চাই।" বললো শিন ছি।
মিন হুয়ে আরো বিভ্রান্ত হয়ে গেলো, “আমার মেজাজ তো বেশ ভালোই আছে।”
“তাহলে মাত্রা ছাড়া ঔদ্ধত্যের মানে কি, ইয়ালু নদী পেরোনোর ব্যাপারটা কী?”
প্রায় একটা ঘোরের মধ্যে শিন ছি বললো, “ব্যাগটা এদিকে নিয়ে যায়, আমাকে দেখা যে ওতে কোনো এমন অস্ত্র লোকানো নেই যা দিয়ে খুন করা যায়, তাই না?”
পুরো দু সেকেন্ড মিন হুয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে, তারপর খুব জোরে হেসে উঠলো, হাসলো বেদম হয়ে পড়া পর্যন্ত, “শিন ছি, তুই না হাস্যকর! তুই কী চিন্তায় পড়ে গেছিস যে আমি চেং ছিরাং-কে মেরেই ফেলব? সেটা কী করে সম্ভব? আমি একটা বাচ্চার মা। শুধু বাচ্চাটার জন্যই আমি উল্টোপাল্টা কিছু করবো না।”
“ভালো যে তুই সে কথা ভাবতে পারিস।" ধীরে ধীরে বললো শিন ছি।
“কিন্তু ব্যাপারটা ভেবে দেখে মনে হচ্ছে, যদি আমার এখন একটা ভালোমন্দ কিছু হয়েও যায়, তবুও আমি বেশ নিশ্চিন্ত যে সু ছনের বাবা তো থাকবে।”
শিন ছি হঠাৎ হাতব্যাগের গায়ে পুঁতে রাখা একটা পেন দেখিয়ে জানতে চাইলো, “এটা কী?”
“বলপয়েন্ট পেন।”
পেনটা ধাতব। সাধারণ পেনের থেকে মোটা। হাতে নিলে বেশ ভারি লাগে।
“এটা একটা সাধারণ বলপয়েন্ট পেন নয়, তাই তো?" প্রশ্ন করলো শিন ছি।
“এটাকে বলে বহুমুখী কাজে সক্ষম আত্মরক্ষার কৌশলানুগ কলম।”
মিন হুয়ে পেনের ঢাকাটা মুচড়ে দিলো, তার ভেতরের যন্ত্রাংশগুলো একে একে দেখাতে লাগলো, “এই যে খোঁচা মাথাটা আছে একে বলে ‘টাংস্টেন স্টিলের আক্রমণের মাথা’, এটা দিয়ে জানলা ভাঙা যায়। এটা একটা ‘ভাঁজে থাকা করাত’, এটা একটা ছোটো কাটারির মতো, এটা আক্রমণেও কাজে দেয়, আত্মরক্ষাতেও কাজে দেয়। এখানে আরেকটা ‘খুব জোরালো ফ্ল্যাশ লাইট’ আছে লেজের দিকে, যাতে আক্রমণকারীকে দেখাও যায় আবার আক্রমণকারীর চোখও ধাঁধিয়ে দেওয়া যায়। তাছাড়াও এটা একটা কলমও - যা দিয়ে লেখা যায় - খুব সস্তা বটে, তাওবাওতে বিক্রি হয়। তুই কী চাস আমি তোকে একটা কিনে দি?”
শিন ছি ফাঁকা চোখে তাকালো মিন হুয়ের দিকে, “তুই সিকিউরিটি চেক পেরোলি কী করে?”
“এগুলো ছোটোখাটো জিনিস, কেউ দেখে না।”
“মিন হুয়ে -”
শিন ছি আরো কথা বলতে চাই ছিলো ওর ব্যাপারে, কিন্তু গাড়িটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। ড্রাইভার বললো, “বু হাইসা, গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে, আমি কী আপনাদের আরেকটা গাড়ি ডেকে দেবো?”
ইন্স্যুরেন্স পলিসি খুঁজতে লাগলো। মিন হুয়ে চটপট করে বললো, “আমাকে দেখতে দিন। আপনার কাছে গ্লোভস্ আর তোয়ালে আছে কী?
ড্রাইভার তো হাঁ, “আপনি গাড়ি সারাতে পারেন?”
ভেতরে দেখতে দেখতে, ড্রাইভার ধড়ফড় করে গেলো মিন হুয়ের পিছু পিছু, মাথা গলালো এখানে সেখানে।
“জল আছে?" জানতে চাইলো মিন হুয়ে।
“ট্রাঙ্কে আছে।”
“এক বালতি নিয়ে আসুন।”
মিন হুয়ে হাতে গ্লোভস্ পরে নিলো, জলের ট্যাঙ্কটার স্ক্রুটা সাবধানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে ফেললো, তোয়ালে দিয়ে চেপে ধরে। তারপর এক বালতি জল ঢেলে দিলো।
তারপর যখন গাড়িতে ফিরে এলো, তখন গাড়ি তৈরি।
ড্রাইভার মিন হুয়েকে ধন্যবাদ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। এও বললো যে ও টোলের পয়সা নেবে না।
“তুই তো গাড়ি চালাস না।” শিন ছির কৌতুহল ফুটে উঠলো।
“আমি যখন ঝৌ রু জির সঙ্গে ছিলাম তখন গাড়ি চালানোর দায়িত্ব ছিলো ঝৌ রু জির। আমার দায়িত্ব ছিলো গাড়ি সারানো। আমি তো নিজেই ইঞ্জিন অয়েল চেঞ্জ করতাম।”
“তুই এতো পুরুষালি, তোর পাশে কোনো পুরুষ থাকলে কোন কাজটা আর সে করবে?”
“সে তো সোজা ব্যাপার। আমি সামনে থাকলে আমাকে ‘গ্যগ্য’ বলে ডাকবে।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-60.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-62.html
No comments:
Post a Comment