Monday, October 7, 2024

JPDA - Chapter 62

 ৬২. জিতং শু-এর তলায়



অ্যাপার্টেমেন্টে ফিরে, মালপত্র রেখে শিন ছি কাছের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো । মিন হুয়ে নিলো জিরে দেওয়া পাঁঠার মাংস আর একবাটি ফরাসী পেঁয়াজের ঝোল। দশ মিনিটের মধ্যে সব পরিষ্কার করে ফেললো।

অন্য দিকে শিন ছি ওর লেবু দেওয়া মাছের তন্দুরির অর্ধেক খেয়ে শেষ করতে পারে নি। অর্ধেকের বেশি রয়ে গেছে আনাজের স্যালাড।

ও ধীরে ধীরে খায়। মুখে খাবার থাকলে কখনো কথা বলে না। খাবারটা পুরো গেলা হয়ে গেলে তবে মুখ খোলে। 

মিন হুয়ে এক গ্লাস বিয়ার নিলো শিন ছিকে সঙ্গ দেবার জন্য।

“এর মধ্যে আর নিউ ইয়র্কে গিয়ে ছিলি?”

মিন হুয়ের মনে পড়ে গেলো ঝি ঝুয়ের অনুরোধের কথা।

“না।" শিন ছি মন দিলো মাছ কাটতে লাগলো, “ব্যাপারটা কী?”

“আমি দু জোড়া জুতো কিনতে চাই, ব্র্যান্ডটার নাম ‘ড্যান্সকো’। শুনেছিস এটার কথা?”

“হ্যাঁ, চিকিৎসা ক্ষেত্রের লোকেরা অনেকে ব্যবহার করে ওই ব্র্যান্ডটা।”

“তুই যদি মেগুওয়াতে ফিরে না যাস এর মধ্যে, তা হলে তুই কী কাউকে বলতে পারবি আমার জন্য কিনে পাঠিয়ে দিতে?”

“কোনো ব্যাপারই নয়। কবে নাগাদ লাগবে?”

“আসছে মাসে পঁচিশ তারিখের আগে হলেই হবে। ন নম্বর সাইজ, একজোড়া সাদা, আর এক জোড়া কালো।”

শিন ছি দুম করে বললো, “ঝৌ রু জির জন্য।”

“হ্যাঁ। ওর জন্মদিন আসছে মাসে।”

শিন ছি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো যেনো, ছুরিটা ঠকাস করে প্লেটটাকে কাটতে গেলো, রুক্ষ আওয়াজটাতে মনোযোগ ফিরে আসতেই “সরি” বললো চট করে, “তোদের ডিভোর্স হয়ে গেছে না?”

“ওর বৌ আমাকে আনাতে বলেছে জুতোজোড়া।”

শিন ছি আর কিছু জানতে চাইলো না। একটা কাঁটা দিয়ে বিঁধে বিঁধে আনাজের পাত্রটা থেকে একে একে আনাজ নিতে লাগলো, স্যালাড ড্রেসিং-এ চুবিয়ে চুবিয়ে পুরে দিতে লাগলো মুখে।

মিন হুয়ের পাত খালি হয়ে গিয়ে ছিলো। মিষ্টি তখনো এসে পৌঁছোয় নি। তাই মিন হুয়ের কিছু বলার ছিলো না, “তুই কী চেং ছিরাং-এর সঙ্গে কাজ করছিস? আমার মনে হলো যে তোদের কথাবার্তা বেশ ভালোই হয়েছে।”

“শুধু সময় কাটাতে।”

“চুক্তিতে অনেক কিছু করা আছে। ওর পারিবারিক ব্যবস্থাটা মজবুত, আমি উৎসাহী।”

মিন হুয়ে ঘাড় নেড়ে বললো, “আমি চেং ছিরাং-এর চরিত্র নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে প্রযুক্তি আর ব্যবসার ব্যাপারে ও পাকা খেলোয়াড়। ওর অন্যকে প্রভাবিত করার দক্ষতাটাও আরেকটু উঁচু দরের। ওর সঙ্গে ব্যবসা করার সময়ে খুব সতর্ক থাকবি।”

উৎসাহ নিয়ে মিন হুয়ের দিকে তাকালো শিন ছি, “ভয় পাচ্ছিস নাকি যে ওর হাতে পড়ে আমি রসাতলে যাবো?”

“আমি তোর কোম্পানির কথা জানি না। তবে সাও মু বলে তুইও কাজের ক্ষেত্রে খুব ভালো।”

মিন হুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো, “কিন্তু বিনচেং তো আর নিউ ইয়র্ক নয়, বেজিং-ও নয়, যেখানে গুয়ান ছাও জন্মেছে আর কুড়ি বছর ধরে বড়ো হয়েছে। যদিও কোম্পানিটা শুরু করে ছিলেন ঝেং ল্যান, কিন্তু ওঁর সাত থেকে আট বছর সময় লেগে ছিলো বাজারের দখল নিতে, তৈরি করতে।”

সে কথা তো সবাই নিশ্চয়ই জানে।

“বিশেষ করে এখন, ঝেং ল্যানের বড়ো রকমের একটা স্ট্রোক হয়ে যাবার পরে, নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে যখন, হাসপাতালে, বেঁচে থাকার জন্য যখন নানান রকম যন্ত্রের সাহায্য নিচ্ছে, ঝেং য়ি তিং-এর যে ঔদ্ধত্য ছিলো চেং ছিরাং-এর ওপরে, সেটাও নিস্তেজ হয়ে আসছে - ব্যবসা তো বোঝেই না, জলের মতো টাকা খরচ করে, কিন্তু নির্বোধ তো আর নয়, বুঝতে পারছে যে ওর বাবার দিন গেছে, গুয়ান ছাও-এর চেং ছিরাং-কে ছাড়া চলবে না।”

“তাহলে, তুই গুয়ান ছাও-কে ভালোই চিনিস।”

“আমি তো বলি নি যে কোম্পানিটা খারাপ। আমি তো বলি নি যে চেং ছিরাং ব্যর্থ ম্যানেজার। বরং উল্টো রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের বাজারে প্রথম সারিতে, অনেক দিন ধরেই গুয়ান ছাও দূর্দান্ত, ওদের প্রাপ্তি আর নামডাক ইন্ডাস্ট্রিতে সব্বাই মেনে নেয়। যাই হোক, গুয়ান ছাও-এর ভেতরের ব্যাপার, কর্পোরেট সংস্কৃতি - বিশেষত মহিলা কর্মীদের প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়া - বেশ গুরুতর চেহারা নিয়েছে। সমস্ত নিয়ম নীতিকে ইচ্ছে করে অবজ্ঞা করা হয়। এতে মেয়েরা ভোগে আর সেটা আমার অসহ্য লাগে।”

“তাহলে তোর ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?” শিন ছি প্রশ্ন করলো।

“আমি গুয়ান ছাওতে কাজ করবো খুব বেশি হলে দু বছর। যেই নন-কম্পিটিসন এগ্রিমেন্টের সময়টা কেটে যাবে, আমি আর আমার টিম - আমরা গুয়ান ছাও ছেড়ে দেবো।”

“তোর প্রজেক্টের কী হবে? যেমন জিএস১.০? ২.০?”

“আমার কিস্যু যায় আসে না। আমি ছেড়ে দেবোই। সাও মু আর আমি শুরুর থেকে শুরু করবো। এআই দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। আমাদের টিমের অভিজ্ঞতাও অনেক। আমরা খুব শিগগির নতুন প্রজেক্ট পেয়ে যাবো।”

“তাহলে বিবিজিতে কাজ কর। আমি তোকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেবো, টাকা দেবো আর সম্মান যতোটা তুই চাস।”

মিন হুয়ে অনেক ক্ষণ উত্তর দিলো না। ওর মনে পড়ে যাচ্ছিলো শিন ছির সাথে সাও মুয়ের দরাদরির কথা। অনেক ক্ষণ ভেবে বললো, “সেটা নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপরে।”

শিন ছি আপন মনে হাসলো, “তুই জানিস কী, মিন হুয়ে, তোকে খুশি করা মুস্কিল?”

মিষ্টি যখন উপস্থিত হলো তখন দেখা গেলো দু প্লেট রঙীন ম্যাকারন, গোল করে সাজানো, মিন হুয়ে হাসলো, “ওয়াও, আমি সব সময়ে মিষ্টির দোকানে এগুলো দেখি, কিন্তু কখনো খাই নি।”

ম্যাকারন


"কেনো?”

“এমন নয় যে আমি কিনতে পারি না, আমার কেনার ক্ষমতা নেই তাও নয়, কেবল মনে হয় এতো অল্প, এতো দাম। খাবার জন্য যথেষ্ট নয়, কেনার মানে হয় না।”

“কী যে বলিস, আয়, পরিচয় করিয়ে দি, এখানে পাঁচটা স্বাদ আছে।”

শিন ছি আঙুল দিয়ে দেখালো, “সব থেকে ঘন রঙেরটা চকোলেট, এইটা ভ্যানিলা, এটা স্ট্রবেরি, সবুজটা
মাচা, তারপর কফি।”


মাচা


“তোর সব চেয়ে বেশি ভালো লাগে কোনটা?”

“পেস্তা।”

“পেস্তা?”

“হ্যাঁ। আমার মা বানাতে পারে। কিন্তু বাজে ব্যাপার হলো যে ওটা দোকানে নেই।”

ও বলতে লাগলো, “আমার মা কিউবেকে বড়ো হয়েছে তো। তাই ফ্রেঞ্চ বেকিং-এর অনেক কিছু জানে। মা প্রায়ই এগুলো বানাতো আমার জন্য আর আমার দাদার জন্য যখন আমরা ছোটো ছিলাম। এমনকি এখনো, যদি একবার জানতে পারে যে আমি বাড়ি যাবো, তো আগে থেকেই একটা বড়ো প্লেট বানিয়ে রাখে। আর অপেক্ষা করে আমি কখন খাবো ফিরে গিয়ে।”

“তার মানে তো তুই অনেক খেয়েছিস?”

“হ্যাঁ।”

মিন হুয়ে নিজের কাছে টেনে নিলো প্লেট দুটো, দুষ্টু হেসে বললো, “তাহলে এগুলো সবই আমার।”

শিন ছি ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “খা। আমি তোর সাথে কাড়াকাড়ি করবো না।”

মিন হুয়ে একটা টুকড়ো তুলে নিয়ে মুখে দিলো, হালকা কামড় বসালো, “অ্যাই, এতে আমন্ডের গন্ধ পাচ্ছি কেনো?”

“কারণ এর মূল উপাদান হলো আমন্ড পাউডার।”

মিন হুয়ে একে একে সব কটা নিজের মুখে পুরে দিলো। ও সব থেকে শেষটা মুখে পুরতে তবে শিন ছি নিজের পাতের শেষ শাকপাতাটা খেলো।

ঝির ঝির করে বৃষ্টি নেমে এলো আকাশ থেকে। রুক্ষ বাতাসে একটা বিরল শীতলতা ছড়িয়ে পড়লো। 

ওরা খেতে এসে ছিলো পায়ে হেঁটে। মিন হুয়ে গাড়ি ডাকতে চাইলো না। তাই ও পায়ে হেঁটে ফেরার প্রস্তাব দিলো ।

রাস্তায় লোক যাতায়াত করছে। রাস্তার দু ধারে উঁচু চৌকো বাড়ি। তার মধ্যে দিয়ে হাঁটা যেনো দানবিক বাড়ি ঘেরা এক চৌহদ্দিতে এসে পড়া।

মিন হুয়ের পেটটা একটু বেশিই ভরা যেনো। পায়ে হাই হিল, ও খুব আস্তে আস্তে হাঁটছে। শিন ছিরও তাড়া নেই, আর চুপচাপ চলেছে মিন হুয়ের সঙ্গে, মাঝে মধ্যে একটা আধটা গল্পের কথা বলছে। সব সময়ে ওর গা থেকে কমলালেবুর গন্ধ বেরোয়। কোনো কারণে বৃষ্টির সময়ে যেনো একটু বেশিই পাওয়া যায় গন্ধটা, যেনো এখনই গাছগুলোর শিকড় গেড়ে যাবে মাটিতে, আর যে কোনো মূহুর্তে কুঁড়ি ফুটে উঠবে। ও কিন্তু বলে নি যে ও কেনো এসেছে বেজিং-এ, কয়েক দিন থাকবে কিনা, কিংবা ওর কী কাজ আছে, যেনো ও বিশেষভাবে এসেইছে মিন হুয়েকে সঙ্গ দেবার জন্য।

মিন হুয়েও অনেক কথা জিজ্ঞেস করে নি। বৃষ্টিতে এমনভাবে মিলে মিশে শান্তিতে হাঁটার সুযোগটা একেবারেই দুর্লভ, কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই, কোনো তর্ক নেই, কোনো বিদ্রুপ নেই - মিন হুয়ে ভীষণ খুশি।

“তোর মেজাজ আগের থেকে অনেক ভালো আজকাল।”। মিন হুয়ে আধা প্রশংসায় আধা রসিকতায় বললো। বলেই ওর মনে পড়ে গেলো যে ওদের মধ্যে পস্পরের মেজাজ নিয়ে কথা বলার মতো নৈকট্য নেই। আর ওর মুখটা লাল হয়ে উঠলো।

“যখন আমি নিউ ইয়র্কে ছিলাম তখন আমি একটা ক্লাস করেছি। অ্যাংগার ম্যানেজমেন্ট। চিনে ভাষায় কী বলিস তোরা?”
“আবেগ সামলানো।”

“আমার মেজাজ যতোটা খারাপ তুই মনে করিস ততোটাও খারাপ নয়। বিশেষত কাজের জায়গায়।”

“তাহলে তোর রাগ শুধু আমার ওপর।”

ওর মুখ থেকে কথাগুলো বেরিয়ে এলো আর ওগুলোকে আটকানোর কোনো উপায় রইলো না।

“আমি প্রায়ই নিজেকে বোঝাই অমন না করতে।” বললো শিন ছি শান্তভাবেই, “আমার উচিৎ এই মনে করা যে তুই যেনো একটা গরু।”

“কী?”

“কারণ যদি ওটা একলা থাকে তবে ওটা গুঁতোবে না।”

“হাম্বা হাম্বা” - দু বার ডেকে উঠলো মিন হুয়ে, খুব ছোটো করে, শিন ছির কানের কাছে।

শিন ছি প্রায় ভস্ম করে দিলো মিন হুয়েকে, পর মূহুর্তেই হেসে উঠলো।

ওরা লাইফ সেন্টারের দিকে হাঁটছিলো। যখন ওরা চৌমাথাতে পৌঁছোলো তখন লাল আলো জ্বলছে। রাস্তার অন্য মাথা থেকে লোকজন বৃষ্টির মধ্যেই পায়ে হেঁটে পেরোচ্ছে উল্টোপারে। 

মিন হুয়ের চোখ আটকে গেলো হলুদ জ্যাকেট পরা এক মহিলার ওপরে।

খুব ফর্সা। ঝাঁপিয়ে পড়া কোঁকরা চুল আর একটা ফুলে থাকা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে কাঁধ থেকে লম্বা হয়ে। ওঁর চেহারাটা ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, মিন হুয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। মিন হুয়ের কেবল মনে হচ্ছে যে মহিলার হাঁটার ভঙ্গীটা পরিচিত, বিশেষত জ্বলজ্বলে কোটটা।

মহিলার পিছু না নিয়ে মিন হুয়ে থাকতে পারলো না। যেই দু পা ফেলেছে ও, অমনি কার একটা শক্ত হাত ওকে জাপটে ধরে টেনে নিলো পিছনে। চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে চালক গালি দিয়ে গেলো, “তুমি মরতে যাচ্ছো!”

মিন হুয়ে চোখ খুলে দেখলো শিন ছি ওকে জড়িয়ে ধরে আছে শক্ত করে। 

“তুই ঠিক আছিস?” সন্দেহের চোখে ওকে দেখতে লাগলো শিন ছি, “লাল আলো এখনো জ্বলে আছে। তুই দুম করে রাস্তা পেরোতে গেলি কেনো?”

মিন হুয়ের চমক তখনো কাটে নি। ও মাথা ঘুরিয়ে যখন দেখলো, তখন হলুদ জ্যাকেট পরা মহিলা মিলিয়ে গেছে। উদ্বেগ নিয়ে ও চারপাশে দেখতে লাগলো, শিন ছি জানতে চাইলো, “কী হয়েছে? কাকে দেখলি?”

“সু তিয়াঁ।”

মিন হুয়ের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো, “আমি সু তিয়াঁকে দেখেছি।”

শিন ছির চোখমুখের ভাব বদলে গেলো, “কোথায়?”

“রাস্তার ওপারে, হলুদ জামা পরে একজন।”

মিন হুয়ে আঙুল তুলে দেখাতে লাগলো আর হলুদ জামা পরা মহিলা আবার জেগে উঠলো ভিড়ের মধ্যে, ওদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে, যাচ্ছে শপিং সেন্টারের দিকে।



হলুদ রঙের জামা চট করে চোখে পড়ে যায় এতো স্পষ্ট। শিন ছিও দেখতে পেলো, “তুই ঠিক দেখে ছিস?”

হলুদ জামা পরা মহিলা শপিং মলে ঢুকে পড়বে দেখে শিন ছি একটা লাফ মেরে গিয়ে আটকালো ওঁর রাস্তা, “শওজিয়ে, দয়া করে থামুন -”

অবাক হয়ে হলুদ জামা পরা মহিলা থামলেন। ঘুরে দাঁড়ালেন, “কোনো গন্ডগোল হয়েছে?”

শিন ছি যখন কথা বলতে যাবে, তখন চট করে মিন হুয়ে বললো, “বু হাইসা, আমরা ভুল করেছি আপনাকে আমাদের চেনা একজন ভেবেছি।”

মহিলা নরম হেসে বললেন, “ঠিক আছে।” তারপর সুচারু ভঙ্গিমায় চলে গেলেন।

শিন ছি ফিরে তাকালো মিন হুয়ের দিকে, না বলে থাকতে পারলো না, “ওঁকে সু তিয়াঁর থেকে ভীষণ আলাদা রকম দেখতে নয় কী?”

“হ্যাঁ, মহিলার মুখটা খুব চোখা চোখা, এক ঝলক দেখলে উইগহ্র মহিলা বলে মনে হয়, বড়ো চোখ, গভীর চোখ। চোখ আর জন্মগত স্বাভাবিক তেলা কোঁকড়ানো চুল। ওঁকে সু তিয়াঁর থেকে বেশি ভালো দেখতে। যদিও ওঁর চেহারায় যত্নের ছাপ, কিন্তু তবুও বোঝা যাচ্ছে যে ওঁর বয়স চল্লিশে ঘরে।”

“চুলের ধরনে আর চেহারার গঠনে মিল আছে। আর দুজনেই একই রঙের জ্যাকেট পরে আছে।”

– – বার বার করে মনে করে করে, মিন হুয়ে তো থানাতেও গিয়ে ছিলো তথ্যগুলো লিখে নেবার জন্য। এখনো পর্যন্ত মিন হুয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনে করতে পারে ওর সাথে সু তিয়াঁর দেখা হওয়ার পুরো ঘটানাটা, বিশেষত সু তিয়াঁর হলুদ কোট। উজ্জ্বল হলুদ কোট, তাতে রুপোলি টেপা বোতাম, একটা টুপিও আঁটা ছিলো। হাতের তালুর মাপের পকেটও ছিলো ডান আর বাঁদিকে বুকের কাছে, আর একটা পাকানো দড়ি কোমরের কাছে যা দিয়ে জামাটাকে দরকার মতো শক্ত করে বাধা যায়।

“বলিস কী, ওগুলো চার বছর আগেকার জামাকাপড়।”

“সু তিয়াঁর ওগুলো ফেলে দিতে ইচ্ছে করবে না।" দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিন হুয়ে।

শিন ছি মলের ভেতরে গেলো আর মিন হুয়ের জন্য একটা বরফ দেওয়া দুধ চা কিনে নিয়ে এলো। বললো যে চা-টা নাকি ওকে শান্ত করবে আর ওর শরীরে মাকারন থেকে জমা মিষ্টির গাঢ়ত্ব কমিয়ে দেবে। 

“আজ কাল আমি প্রায়ই সু তিয়াঁর স্বপ্ন দেখি।" বললো শিন ছি, “স্বপ্নে দেখি যে ও একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের জামা পরে আছে, ওর মুখটা সব সময়েই অস্পষ্ট, ও আমার পাশে বসে আছে, তাই ওকে খুব স্পষ্ট দেখা যায় না।”

“ও কিছু বলে না?" মিন হুয়ে তাকালো শিন ছির দিকে, “কোনো আভাস দেয় না তোকে, ও কোথায় আছে সে ব্যাপারে?”

“আমার আশঙ্কা, ও আর বেঁচে নেই।”

পথের ভিড়ের দিকে, চলতি গাড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবনায় টইটুম্বুর শিন ছি বললো, “অথবা আমি একটা সমান্তরাল দেশ আর কালে চলে এসেছি … ও আর আমি … হয়তো আমদের অন্য কোনো মহাবিশ্বে দেখা হবে।”

“না। ও নিশ্চয়ই এখনো বেঁচে আছে। যখন ঘটনাটা ঘটে ছিলো, তখন ওখানকার পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে ছিলো। তুই যাওয়ার পরে ওরা যা যা করা সম্ভব তার সবটা করেছে, তিন ফুট করে গর্তও খুঁড়েছে - ও যদি সত্যি মারা গিয়ে থাকবে, এতগুলো লোক ওর দেহটাকে খুঁজছে, খুঁজছে এতো দিন ধরে, সব জায়গায় বিজ্ঞাপণ দেওয়া হয়েছে, বিশাল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে … ওর দেহটাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় নি। ও নিশ্চয়ই বেঁচে আছে।”

নিশ্চয়তার সুরে বললো মিন হুয়ে, “তোরা নিশ্চয়ই আবার একসাথে হতে পারবি।”

“তোর কী হবে?”

হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো শিন ছি, “তুই কী করবি?”



“বেশ, আমাকে আমার মতো থাকতে দে, যাই হোক, আমি … যাই হোক, আমার সু ছন আছে, খুব বেশি হলে আমি ওকে একটা বাবা খুঁজে দেবো।”

“শুভেচ্ছা রইলো।" হালকা সুরে বললো শিন ছি।

হঠাৎ মিন হুয়ের চোখে ব্যথা করতে লাগলো। দু চোখ ছাপিয়ে নেমে এলো কান্না। এমন সময় বৃষ্টিটাও ঝেঁপে এলো। মিন হুয়ে মুখ তুলে ওপর দিকে চাইলো যাতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সোজা এসে ওর মুখে পড়ে।

শিন ছি খেয়াল করলো না এসব। বলে চললো, “যখন আমি ছোটো ছিলাম, তখন সু তিয়াঁর সঙ্গে নানান খেলা খেলতাম। যেমন বৃষ্টি পড়লে আমি আর সু তিয়াঁ একে অপরের হাত ধরে পিঠের দিকে হাঁটতাম। কম্পিউটার ছিলো না, গেম কনসোল ছিলো না, তখন, মনে হতো ঐ খেলাটাই ভীষণ মজাদার।”

খুব জোরে নাক টেনে, মিন হুয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলো, “গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগতো না?”

“খেলার মাঠে তো।”

“অনাথাশ্রমে একটা বড়ো খেলার মাঠ ছিলো, ওখানে দোলনা চাপতে ভালো বাসতো সু তিয়াঁ, ভালবাসতো রাবার টিউবে চড়তে, আর প্যারালাল বারে চড়তে। ও হলুদ জামা পরতে ভালো বাসতো। কারণ লাল, সবুজ আর হলুদ রঙ তিনটে চট করে চোখে পড়ে। ইস্কুলে লাল জামা পড়া মেয়ে অনেক ছিলো, ক্যাম্পাস ভর্তি ছিলো সবুজ গাছ। ও যদি হলুদ রঙ পরে তাহলে আমি চট করে ওকে চিনে নিতে পারবো, যদি আবছায়া হয় তাও।”

মিন হুয়ে ভাবলো, সু তিয়াঁ তো জানে না যে শিন ছির চোখ দুটো সেরে গেছে। হয়তো ঐ হলুদ জ্যাকেটটা ও শিন ছির সাথে যখন দেখা হবে তখন পরবে এমন ভেবেই কিনে ছিলো। কথাটা ও যতো ভাবতে লাগলো ততো সু তিয়াঁ ওর মাথার মধ্যে গেঁথে বসতে লাগলো। যখন ও জেগে উঠলো ওর ভাবনার গভীর থেকে তখন যেনো একটা অন্য জগতে, আরেকটা সময়ে, আরেকটা জায়গায় এসে পড়লো।

এক মূহুর্তের জন্য ও বুঝতেও পারলো না, ওর অনুভূতিটা আনন্দের না বেদনার। ও অস্থির উন্মনা হয়ে গেলো, বুকের মধ্যে চাপ লাগতে শুরু করলো, শিন ছি যে কী বলে গেলো ওর পাশে চলতে চলতে সে সব ও কিছুই শুনলো না।

মিন হুয়ে দুপুরটা কাটালো শিন ছির অ্যাপার্টমেন্টে। ওর ক্লান্ত লাগছিলো। ও একটু ঘুমিয়ে নিলো। জাগতে দেখলো ছটা বেজে গেছে, সেটা অপ্রত্যাশিত। চটপট করে একটু স্নান করে নিলো, হালকা সাজগোজ করে নিলো, একটা সাদা জামার ওপরে একটা কোট চড়ালো। হাসপাতালের পাশে একটা ক্লাবে গেলো শিন ছির গাড়িতে চেপে।

শিন ছি বললো যে ও একটা কাছাকাছি কাফেতে অপেক্ষা করবে আর কিছু কাজও করবে ব্যবসার। খাওয়া হয়ে গেলে মিন হুয়ে যেনো ওকে ফোন করে।

হ্যাংঝৌ


ক্লাবটা সদস্যদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নানান পরিষেবা দেয়। বাইরে থেকে দেখে ছোটো বলে মনে হয়, ভেতরটা গহ্বরের মতো, নানা অলিগলিতে ভরা। বাগান আছে, পাথরের ঢিবি দিয়ে সাজানো, উইপিং উইলো আর পুকুরও আছে। ভেতরের সাজগোজ ঝকঝকে আর দুর্দান্ত। বেজিং-এর ডাক্তাররা সে সব সামাজিক মেলামেশার জায়গায় ওঠাবসা করেন, এই ক্লাবটা তার মধ্যে সবচেয়ে বিলাসবহুল আর খরচসাপেক্ষ। ডিন এবং তাঁর সহকারীরা যাঁরা আজকের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেছেন তাঁরা সবাই হ্যাংঝৌ-এর লোক। দারুণ ভালো হ্যাংঝৌ-এর পদ রান্না করে এই ক্লাবের রাঁধুনি। পাশের দালানে একটি মেয়ে গুঝেং বাজাছে। পুরো ব্যবস্থাটা ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত আর উপভোগ্য। ডিন নাকি খুব ভালো পান করতে পারেন শুনে চেং ছিরাং দু বোতল মৌতাই এনেছে। খুব চেষ্টাও করছে ডিনকে সঙ্গ দেবার। মিন হুয়ে এক ফোঁটাও পান করলো না। আর মিটিং-এর সময়টাতে একটা খুব গম্ভীর ভাব নিয়ে পরিচয় দিলো জিএস১.০ প্রজেক্টের।

গুঝেং


খাওয়ার পরে দুই দল প্রাথমিক বেচাকেনার কথা বলতে লাগলো। মিন হুয়ে কথা দিলো যে ও নিজের টিমকে সঙ্গে আনবে জিএস১.০ ইন্সটল করে ব্যবহারের জন্য চালু করে দেবার জন্য। চেং ছিরাং প্রতিশ্রুতি দিলো দামে ছাড় দেবার। 

মৌতাই


খাওয়া-দাওয়া, কথাবার্তা শেষ দেখে সবাই সবাই কে বিদায় জানাতে শুরু করলো। 

মিন হুয়ে ফোন করলো শিন ছিকে, আর শিন ছি জানালো যে ও এখনই আসছে আর পার্কিং লটে অপেক্ষা করবে মিন হুয়ের জন্য।

“আমার গাড়িও পার্কিং লটে আছে। এসো একসঙ্গে যাই।”

বললো চেং ছিরাং, “আমি তোমার সাথে কয়েকটা কথাও বলতে চাই, কাজের ব্যাপারে।”

ক্লাবের বাড়ি থেকে পার্কিং লট পর্যন্ত যেতে মিন হুয়েকে একটা পুকুর আর একটা বাগান পেরোতে হবে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। পথের পাশের য়িনশিং শুয়ের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির জল পড়ছে টুপটাপ করে। 


য়িনশিং শু (GingkoTree )


ওরা একটা জিতং শুয়ের ফুলের ঝাড় পেরিয়ে গেলো আর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো চেং ছিরাং, মিন হুয়েকে বললো, “এইচআর-এর লোকেরা আমাকে বলেছে যে তুমি দিঁ য়িফঁয়ের নামে নালিশ করেছো। আমি এর মধ্যেই ওর সাথে কথা বলেছি। ব্যাপারটা চেপে যাও, ওটাকে আর বাড়িও না।" বললো ঠান্ডা গলায়।


জিতং শু (Wisteria Tree)


“কী বলতে চান ‘চেপে যাও’ মানে? ছেড়ে দেবো কিচ্ছু না করে?”

“আমি ওকে সতর্ক করে দিয়েছি যে তোমার সঙ্গে কোনো ঝামেলা যেনো ও না করে। আমি তোমাকে খুঁজে বার করেছি, টেনে বার করেছি, তবে তুমি গুয়ান ছাওতে এসেছো, আর তুমি অনেক বড়ো কাজ করবে।”

“মিন হুয়ে হাসলো, “হেহ্‌।”

বললো, “স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন, চেং ছিরাং। আমি আপনাকে কোনো বড়ো কিছু করতে কোনো সাহায্য করবো না, না হয় থাক -”

“বেশি কথা বোলো না, মিন হুয়ে।”

মিন হুয়ের কথা শেষ হবার আগেই থামিয়ে দিলো চেং ছিরাং। ওর গলার স্বর নিচু কিন্তু দামামার মতো গম্ভীর, “হ্যাঁ, একজন প্রতিভাধর মানুষ অহঙ্কারী, যথেচ্ছারী হতেই পারে। কিন্তু নিজের বুদ্ধিতে আইনের মারপ্যাঁচে খেলতে যেও না। আমি তোমাকে যেমন নজরকাড়া করে তুলতে পারি, তেমনই আমি তোমাকে মুখ থুবড়ে ফেলে দিতেও পারি। কারণ আমি আর তুমি -”

মিন হুয়ের নাকের দিকে তাক করে বললো, “এক জোড়া আত্মার দোসর, তোমার লেখা কোড কেবল মাত্র আমি বুঝতে পারি কয়েক সেকেন্ডে। যদি আমি তোমার কোড বদলাই, তাতে তুমি সম্মত হও। কখনো কথাটা ভেবে দেখেছো? তুমি আর আমি একসাথে অনেক দিন ঝলমল করতে পারি, তাহলে আর ঘেন্না করি কেনো একে অপরকে? যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করি তবে আমরা একটা পৃথিবী বানিয়ে ফেলতে পারি!”

“না!”

“আমাকে দরকার তোমার, মিন হুয়ে। প্রযুক্তিতে তুমি ভীষণ ভালো, কিন্তু যুক্তিতে নয়। যৌক্তিকতা ছাড়া তুমি সেই স্বাধীনতা কোনো দিন পাবে না, যা তুমি খুঁজছো।”

“আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চাইছেন।”

“নিয়ম আমি ঠিক করবো। এটার গঠন, এটার নিয়ম, এটার ব্যবস্থা সব আমার তৈরি। তুমি যদি আমার সঙ্গে স্বাধীন হতে চাও, তোমাকে এই ব্যবস্থার সঙ্গে খাপখাওয়াতে হবে। আর যদি তুমি কিছুই শিখবে না, তবে আমার পৃথিবীতে তুমি হয় পিছিয়ে যেতে পারো, নাহলে ডুবে যেতে পারো। কিন্তু মনে রেখো তুমি একটা মাছ আর তুমি কেবমলাত্র জলেই বাঁচতে পারো। তুমি যদি জল থেকে ঝাঁপ দিয়ে তীরে লাফিয়ে উঠতে যাও, তবে তুমি মরবে।”

চমকে তাকালো মিন হুয়ে লোকটার দিকে।

“তোমাকে যেটা করতে হবে, সেটা খুবই সহজ।” চেং ছিরাং আবার বলতে শুরু করলো চাঁদের আলোয়, ওর চোখদুটো মিন হুয়ের সমস্ত ভাবনাকে আটকে রেখেছে কব্জার মতো, “আত্মসমর্পণ করো। যতো পূর্ণভাবে সম্পর্পণ করবে, ততো ভালো।”

“নিজেকে আপনার হাতে তুলে দেবো, কবে এমন নির্বোধ হলাম আমি?”

দাঁত বের করে হাসলো মিন হুয়ে আর উপহাস ছুঁড়ে দিলো, “আপনি ভাবলেন যে আপনি আমাকে মাছ বললেন, আর আমি আপনার নিজের হাতে খোঁড়া পুকুরটাতে রয়ে যাবো আর মনে করে নেবো এটাই আমার মহাবিশ্ব? আমি খুশি যে আমি ঝাঁপ দিয়ে বার হয়েছি, আরো একটা উত্তেজনাময় পৃথিবী দেখেছি, একটা বৃহত্তর জায়গা দেখেছি, আর পরিচ্ছন্ন বাতাসে শ্বাস নিয়েছি! যদি আপনার দেওয়া পৃথিবীটা আমাকে আপনার ওপর নির্ভরশীল করে রাখে, আপনার বশে থাকতে বাধ্য করে, আর আপনি যেমন চালাবেন কেবল তেমনটাই চলতে হয়, তবে আমি বরং মরে যাবো, ঝাঁপও দেবো না! আমার দরকার নেই আপনার ব্যবস্থার, আর আমি আপনার শেখা মন্ত্রও আপনাকে পড়ে শোনাবো না। যে ভাবে আমি বেঁচে আছি পৃথিবীতে, সেটাই আমার একমাত্র স্বীকারোক্তি পৃথিবীর কাছে।”

কথাগুলো বলে, মিন হুয়ে মাথা ঘুরিয়ে হেঁটে চলে যেতে শুরু করলো। কিন্তু ওকে জাপটে ধরলো চেং ছিরাং হঠাৎ, আর টেনে নিয়ে গেলো বাইরের দিকে য়িনশিং শুয়ের নিচে, জিতং শুয়ের ফুলের ঝাড়ের নিচে। মিন হুয়ের হাতে ব্যাথা করছে, যেনো কেউ সাড়াশি দিয়ে চেপে ধরে আছে হাত দুটো। ও যেই নিজের সেল ফোন বের করে সাহায্যের জন্য কাউকে ডাকতে যাবে, অমনি চেং ছিরাং ওর ছোট্টো ব্যাগটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। 

এই সময়ে ওকে কষে জড়িয়ে ধরলো চেং ছিরাং।

মিন হুয়ে অনেক লড়াই করলো নিজেকে ছাড়ানোর জন্য, কিন্তু চেং ছিরাং ওর মুখে চাপা দিয়ে রেখেছে। একই সঙ্গে চেং ছিরাং নিজের মুখটাকে চেপে ধরে আছে আর ওর জিভ বুলিয়ে দিচ্ছে মিন হুয়ের গলায়, আর ভীষণ জোরে চুষে নিচ্ছে মিন হুয়ের কানের গোড়াটা।

একটা তীব্র মদের গন্ধ মিন হুয়ের চেতনাকে আঘার করলো, সঙ্গে একটা ভীষণ পাশব গন্ধও।

“আমার সঙ্গে দেখা করার আগে তুমি ইচ্ছে করে পেঁয়াজ খেয়েছো তাই না?” দুশ্চরিত্র লেপে প্রশ্ন করলো চেং ছিরাং, “আমি তোমাকে দেখা মাত্র গন্ধ পেয়েছি। আর জিরে আর পাঁঠার গন্ধ, তুমি ইচ্ছে করে ওসব খেয়েছো যাতে আমার ঘেন্না করে, সত্যি? আমার গা গোলানো আটকানোর জন্য আমাকে এতো মদ খেতে হলো অসহায়ের মতো!”

চেং ছিরাং জোর টান লাগালো মিন হুয়ের মাথার চুলে, নিজের মুখটা চেপে ধরলো মিন হুয়ের মুখের ওপর, আর ঘষতে লাগলো সমানে, “তুমি কী মনে কোরো এতো সহজে আমার খোঁড়া পুকুর থেকে লাফিয়ে ওঠা যায়? আমার হাতের তালু থেকে? অকৃতজ্ঞ জীব! আমি তোমাকে পছন্দ করি, তাই তোমাকে প্রশ্রয় দি, বাধ্য হও, আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো।”

ওকে ভীষণ জোরে ঠেলা দিলো চেং ছিরাং, মিন হুয়ে পড়ে গেলো কাদায়। চেং ছিরাং-এর শরীর চেপে বসতে গেলো মিন হুয়ের ওপরে যাতে ওকে মাটির সঙ্গে চেপে রাখা যায়, কিন্তু মিন হুয়ের মনে পড়ে গেলো য়িন শুয়ের কাছে শেখা আত্মরক্ষার কায়দাগুলো। ও গড়িয়ে সরে গিয়ে তীব্র লাথি কষালো চেং ছিরাং-এর উরুতে।

“ও-ও” ককিয়ে উঠলো চেং ছিরাং, একটা বলের মতো গুটিয়ে গেলো।

মিন হিয়ে বেপরোয়াভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো চেং ছিরাং-এর ওপরে। চেপে বসলো ওর শরীরের ওপরে। একটা জোর ঘুঁষি কষিয়ে দিলো চেং ছিরাং-এর নাকে। 

নাকি সুরে চেঁচিয়ে উঠলো চেং ছিরাং। নাসা সন্ধি ভেঙে গেছে ওর। নিজের দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো যন্ত্রণায়। 

ছেড়ে না দিয়ে, মিন হুয়ে একের পর এক ঘুঁষি মেরে চললো যতোক্ষণ না চেং ছিরাং অসাড় অচেতন হয়ে পড়লো। মাটির থেকে মুঠো করে কাদা তুলে মাখিয়ে দিলো চেং ছিরাং-এর মুখে, ঠুসে দিলো মুখের ভেতরে। 

চেং ছিরাং-এর নড়াচড়া একদম বন্ধ দেখে মিন হুয়ে উঠে দাঁড়ালো, দু পা সরে এলো, ফের পিছিয়ে এলো।

ফিরে কষে লাথি দিলো চেং ছিরাং-এর পেটে, দু বার।

লাথির চোটে মিন হুয়ে হাই হিল জুতোটা হারিয়ে গেলো, মিন হুয়ে আর খোঁজারও প্রয়োজন বোধ করলো না। খালি পায়ে ছুটতে শুরু করলো। ছোটো ব্যাগটা তুলে নিলো মাটি থেকে, ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে দৌড় লাগালো, দৌড়ে পৌঁছোলো পার্কিং লটে।

একটা মূর্তি চটপট দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো।

“মিন হুয়ে?”

ওর হাতে রক্ত, সারা গায়ে কাদা, মিন হুয়ে কাঁপছিলো আর চিৎকার করে কাঁদছিলো ওর বাহু ডোড়ে। ও ভাবলো মিন হুয়ের বুঝি খুব লেগেছে, ও ভয় পেয়ে কোলে তুলে নিলো মিন হুয়েকে, শুইয়ে দিলো গাড়ির পিছনের সিটে। হিটার চালিয়ে দিলো, ভালো করে দেখতে লাগলো কোথায় চোট লেগেছে। 

“ফাk”

ও ধমকে উঠলো, “চেং ছিরাং?”

কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়লো মিন হুয়ে।




“ওর আঙুলের ছাপ আছে তোর হাতের ওপরে?”

রাগে গর্জে উঠলো, “এখানে বোস, নড়িস না, আমি ওকে আজকে পিটিয়ে মেরে ফেলবো।”

কথা শেষ করেই ও গাড়ির দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে গেলো, কিন্তু মিন হুয়ে ওকে শক্ত করে ধরে রাখলো, “যাস না, শিন ছি! আমার লাগে নি। আমি ওকে মেরেছি খুব, মারতেই থেকেছি, ও আর নড়ছে না, আমার ভয় … ও মরে গেছে।”

মিন হুয়ে কাঁদতে লাগলো ভয়ে।

“শিন ছি, আমি যদি জেলে যাই, তবে আমার ছেলেটাকে দেখিস কিন্তু।”

“না, তুই জেলে যাবি না, খুব বেশি হলে এটা আত্মরক্ষা। আমার কথা ভাবিস না। আমি সেরা উকিল রাখবো তোর জন্য।”

ও দুহাতে জড়িয়ে ধরলো মিন হুয়েকে।

মিন হুয়েকে স্বান্তনা দিতে লাগলো নরম স্বরে, “কোথায় ও? আমি যাবো এক বার দেখে আসবো।”

মিন হুয়ে আঙুল দিয়ে দেখালো একদিকে। ও গাড়ির দরজাটায় চাবি দিলো। বাগানের ভেতরে গেলো, খুব বেশি সময় না নিয়েই ফিরে এলো, গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি পিছোতে শুরু করলো। 

“কেমন? বেঁচে আছে না মরে গেছে ও?”

“ও এর মধ্যেই চলে গেছে। আমি সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম। বললো যে ও খুব মদ খেয়ে ছিলো, নেশার চোটে পড়ে যায়, পড়ে গিয়ে নাক ভেঙে গেছে, সামনের একটা দাঁতও হারিয়ে গেছে, বাকিটা থেঁতলানো মাংস আর রক্ত। লেগেছে। ওরা একটা গাড়ির ব্যবস্থা করছে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”

ভালো যে লোকটা এক্কেবারে মরে যায় নি। মিন হুয়ে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো।

“তুই ওকে সত্যিই খুব মেরেছিস!”

শিন ছি গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে এক বাক্স টিস্যু এগিয়ে দিলো মিন হুয়ের দিকে, “সিকিউরিটি গার্ড বললো যে ওর মুখটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওর মুখের ভেতরে কাদা ভর্তি। আর ও প্রচুর মদ খেয়েছে, মাটির ওপরে বমি করেছে অনেক ক্ষণ ধরে …”

চেং ছিরাং যাতে কোনো মামলা করতে না পারে, সেই জন্য মিন হুয়েকে একটা কাছাকাছি হাসপাতালে শিন ছি নিয়ে গেলো মিন হুয়ের আঘাতের একটা পরিমাপ নেওয়ার জন্য। প্রায় রাত বারোটার সময়ে ওরা অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলো।

তখনো মিন হুয়ের সারা শরীর কাঁপছে।

শিন ছি বাথটাবে জল ভরে নিলো, ছড়িয়ে দিলো বাথ সল্টস্‌, জলটা কতোটা গরম সেটা দেখে নিলো, মিন হুয়েকে সাহায্য করলো জামাকাপড় ছাড়তে, আর বাথটবে বসতে।

নিজের দুপা কষে জড়িয়ে ধরে মিন হুয়ে বসে রইলো জলে, ওর মগজ যেনো খালি হয়ে গেছে। কী হয়ে গেলো সেটা ভেবে ও ভয় না পেয়ে থাকতে পারলো না অনেক ক্ষণ, ওর দাঁতে খটখটি লেগে গেলো।

শিন ছি বেরিয়ে যেতে চাই ছিলো, কিন্তু মিন হুয়কে জলে স্থির বসে থাকতে দেখে ও ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, “আয়, আমি পরিস্কার করে দিচ্ছি তোকে।”

মিন হুয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ঘাড় নাড়লো।

ওর চুল ভরতি কাদা। লাছি লাছি হয়ে পাকিয়ে আছে চুল।

শ্যম্পুটা নিজের হাতে চিপে নিয়ে বার বার ঘষে দিলো চুলে। 

ধীরে ধীরে ওর পিঠটা ঘষে দিলো, শক্ত হয়ে থাকা পেশিগুলোকে আরাম দেওয়ার চেষ্টায়।

যাই হোক, মিন হুয়ের সমস্ত শরীর লোহার মতো শক্ত হয়ে আছে, যেনো গুটিয়ে একটা দলা হয়ে গেছে, সেটাকে ছাড়ানো কঠিন।

শিন ছির কোনো উপায় রইলো না আর ওর বাঁ হাতের তালু দিয়ে মিন হুয়ের কপালটা চেপে ধরে, ডান হাতের পাঁচটা আঙুল দিয়ে ওর চুলটা কপাল থেকে ঘাড় বেয়ে মাথার পিছন পর্যন্ত আলতো হাতে বার বার আঁচড়ে দেওয়া ছাড়া। 

জলটা খুব শিগগির ঘোলা হয়ে গেলো। নোংরা জল বার করে দিয়ে আবার শুরুর থেকে শুরু করলো। 

মিন হুয়ের নখেও কালো কাদা জমে ছিলো। দাঁত মাজা ব্রাশ আর সাবান দিয়ে ও যত্ন করে ঘষে দিলো প্রত্যেকটা নখ আর আঙুলের আগা যতোক্ষণ না সেগুলো স্বচ্ছ সাদা হয়ে উঠলো।

পুরো কাজটা করার সময়ে শিন ছি চুপ করে ছিলো। দুজনের কেউই কোনো কথা বলে নি।

খুব যত্ন করে বার তিনেক মিন হুয়েকে ধুয়ে দিয়ে, মিন হুয়ের শরীর শুকনো করে দিলো, মাথার চুল শুকিয়ে দিলো, নিজের পাজামা পরিয়ে ওকে পৌঁছে দিলো অতিথির শোবার ঘরে, “অনেক রাত হয়ে গেছে। শুই জা।”

মিন হুয়ে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলো, খুব ক্লান্ত, কিন্তু ঘুমোতে পারছে না কিছুতেই, তাকিয়ে আছে জানলার বাইরের রাতের আলোর দিকে, বড়ো বড়ো চোখ করে।

রাত দুটো। মিন হুয়ে ছুটে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট খেলো।

রাত তিনটে বসার ঘরে গিয়ে টিভিতে একটা এপিসোড দেখলো।

ভোর চারটে, শিন ছির শোবার ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে দেখলো ঘরের দরজা খোলা। চুপচাপ ঢুকে পড়লো, বসলো বিছানার পাশে কার্পেটের ওপরে, আর চুপ করে অন্ধকারে দেখতে লাগলো শিন ছিকে। 

শিন ছির শ্বাসপ্রশ্বাস হালকা, শান্তিতে ঘুমোচ্ছে।

মিন হুয়ে কিছুতেই হাত বাড়িয়ে শিন ছির মুখটা না ছুঁয়ে পারলো না।

যখন ওর আঙুল শিন ছির ঠোট ছুঁয়ে গেলো তখন অদ্ভুত একটা পেলবতা টের পেলো। নিজেকে আটকাতে পারলো না, ঝুঁকে পড়ে আলতো চুমু দিলো।

তক্ষুণি কেশে উঠলো শিন ছি।

“শিন ছিয়া, আমি ঘুমোতে পারছি না।”

মিন হুয়ে ওর কানে ফিস ফিস করে বললো, “তুই কী দাবা খেলতে চাস?”

“আমার পাশে শুয়ে পড়।” বলে খালি জায়গাটা দেখালো।

মিন হুয়ে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লো। জোরে জাপটে ধরলো শিন ছিকে, নিজের মুখটা গুঁজে দিলো ওর বুকে, মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলো।




~~~~~~~~~~~~

সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96

Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-61.html

Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-63.html

No comments:

Post a Comment

Readers Loved