৬৬. মুখর
ওরা তিনজনেই বাইরে এলো। শিন ছি বললো যে ও একবার গাড়িতে ফিরে যেতে চায় কয়েকটা জিনিস সঙ্গে নেওয়ার জন্য। মিন হুয়ে ওর সঙ্গে চললো যেখানে ওরা গাড়িটা রেখেছে সেখানে। মিন হুয়ে দেখলো যে শিন ছি ট্রাঙ্ক খুলে তিনটে ফ্ল্যাশ লাইট নিলো আর নিলো কুমীরের চামড়ার একটা বাক্স।
মিন হুয়ে আবার চলতে লাগলো শিন ছির সঙ্গে।
শু ঝি হুয়া হাঁটা দিলো নলখাগড়ার বনের দিকে।
নদীর ধারে হাওয়া বইছে তেজে, ঢেউয়ের আওয়াজের সঙ্গে যেনো গলা মিলিয়ে গান গাইছে। চাঁদের আলোয় নলখাগড়াগুলো চকচক করছে রুপোর মতো, হাওয়ায় নাচছে। দূরের খাড়া পাহাড়টা নিশ্চুপ। পাহাড়ের দিকে এক সারি সাদা খামার বাড়ি সার দিয়ে যেনো দাঁড়িয়ে আছে, কয়েকটায় এর মধ্যেই আলো জ্বলে উঠেছে, তাতে চারপাশটা আরো বেশি অন্ধকার দেখাচ্ছে।
রাস্তাটা ঢাকা বড়ো বড়ো ঘাসে। আর মিন হুয়ে নদীটাকে দেখতেপাচ্ছে না, কিন্তু পচা জোলো গাছের গন্ধ পাচ্ছে, শুঁকছে সেই গন্ধ। জলের ঘড়ঘড় শব্দে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে মিন হুয়েরা নদী বরাবরই চলছে।
কিন্তু মিন হুয়ে ভুল ভেবেছে।
সু তিয়াঁর সমাধি মোটেই গ্রামের মুখের কাছে নলখাগড়া বনে নয়, আরো কোনো গভীর এলাকায়, দূরে কোথাও। শু ঝি হুয়া ওদেরকে নিয়ে নদীর ধারের একটা কাদায় পেছলা জায়গায় এলো, চল্লিশ মিনিট চলার পরে, অবশেষে থামার আগে।
চারপাশ দেখে নিয়ে ও উত্তরের একটা উঁচু জমির দিকে এগিয়ে গেলো।
শিন ছি আর মিন হুয়েও চললো ওর পিছন পিছন।
উঁচু এলাকাটা আসলে একটা জঙ্গল। আরো ওপরের দিকে একটা বড়ো পাহাড় আছে। নানা ধরণের ঘাস আর গাছপালা থেকে লতাপাতায় হাওয়া চলার আর পোকামাকড়ের শব্দ ভেসে আসছে। হাওয়াটা স্যাঁতস্যাঁতে, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আসতে থাকা হাওয়াটা ঠান্ডা আর মুখের ওপর চটচটে লাগছে। জঙ্গলের মধ্যে অনেক বিশাল বিশাল পাথর উঁচিয়ে আছে, গাছের শিকড়ও তাই মাটির গভীরে যেতে পারে না, সেগুলো প্রায় মাটির ওপর দিয়েই পাথরের পাশ কাটিয়ে এঁকে বেঁকে যায়। পা দিয়েই জঙ্গলটাতে মিন হুয়ে থমকে গেলো, ওর মনে হলো যেনো পায়ের নিচে একপাল সাপ কিলবিল করছে।
শু ঝি হুয়া একটা বড়ো পাথরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো, মাটিটা বেলচা দিয়ে খোঁচালো, বললো, “এখানেই হবে।”
শিন ছি চারপাশ দেখলো। পাথরটা আশেপাশের পাথরগুলোর থেকে কিছুমাত্র আলাদা নয়। ভ্রূ না কুঁচকে ও থাকতে পারলো না, “তোমার চিহ্ন আছে তো।”
“দরকার নেই। আমি এখানে বড়ো হয়েছি। আমি এলাকাটা খুব ভালো চিনি। আমি তোমার নিফঙিয়োর জন্য একটা ভালো জায়গাও বেছেছি। দেখো -”
শু ঝি হুয়া আপন মনে বলে চললো, “সামনে জল আছে, পিছনেও জল আছে। একটা পাহাড়ও আছে, পাহাড়ের মাথাটা গোল। একে বলে, ‘নিমন্ত্রক আর নিমন্ত্রিত পরস্পরকে অভিবাদন জানাচ্ছে আর সুঝাকু ঘন্টি দোলাচ্ছে।’ ওকে যদি এখানে কবর দেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যত প্রজন্ম তার আশীর্বাদ পাবে …”
হয়তো ওর মনে হচ্ছিলো যে আবহাওয়াটা বড্ডো খাপছাড়া, ও জোর করে হাসলো নিজেকে নিরুদ্বিগ্ন দেখাতে, কিন্তু শিন ছির চোখ ভরা ঘেন্না ওকে তাড়া করতে লাগলো। আর ওর মুখের হাসি দপ করে শুকিয়ে গেলো।
“এতোই যখন ভেবেছো তাহলে আমাকে আরো আগে খবর দাও নি কেনো? আমি ওকে আরেকটু সম্মানজনক পরিস্থিতিতে কবর দিতে পারতাম।" বললো শিন ছি।
“এখানে অনেক মেয়েয়ানুষের মরদেহই ভেসে আসে ওপরের খাত থেকে। জলে অনেক লতাপাতা। তাতে আটকে যায়। লোকে মনে করে যে ওসব দূর্ভাগ্য। তাই সবাই লতাপাতা কেটে নদীর স্রোতে যাতে ঐসব মরদেহ ভেসে চলে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করে দেয় … আমিও তখন তাই করতেই গিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমি আবার ভাবলাম ব্যাপারটা। ওকে দেখতে পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। তাই আমি ওকে টেনে নিয়ে এসে ছিলাম ওপরে। আর কবর দিয়ে ছিলাম যাতে আমি নিজের জন্য কিছু পুণ্য অর্জন করি।”
মানেটা দাঁড়ালো এই যে যদি ও দয়া না করতো, তবে শিন ছি কিছুতেই সু তিয়াঁকে খুঁজে পেতো না সারা জীবনে।
এমন সময় আকাশ থকে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির ফোঁটা নেমে এলো। বৃষ্টির ফোঁটা ক্রমশো বড়ো হতে লাগলো।
“চটপট খোঁড়ো।” বললো মিন হুয়ে।
শু ঝি হুয়া মাটিতে বেলচার মাথা দিয়ে একটা বর্গাকার এলাকা চিহ্নিত করলো। তারপর শিন ছির সঙ্গে দুজনে মাটি খুঁড়তে লাগলো, একজন ডান দিক থেকে অন্য জন বাঁ দিক থেকে।
মিন হুয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মধ্যিখানে, ফ্ল্যাশ লাইট হাতে। আলো দিতে লাগলো ওদের দুজনকে।
মাটি ভিজে আর আলগা। অল্পক্ষণের মধ্যেই দুজনে একটা বড়ো গর্ত খুঁড়ে ফেললো, প্রায় এক বর্গ মিটার পরিমাণ লম্বা-চওড়া। একটা ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে মিন হুয়ে দেখতে লাগলো ভেতরটা। ভেতরে প্রায় কিছুই নেই কাদা আর ঘাসের শিকড় ছাড়া।
“কত গভীরে পুঁতে ছিলে?" জানতে চাইলো শিন ছি।
“খুব গভীর নয়, এই এখানেই তো … আধ মিটারটাক নিচে। কী হচ্ছেটা কী?”
মাথা চুলকে ও বললো, “মানুষটা গায়েব হয়ে গেলো কী করে!”
“এটা কী ভুল জায়গা?”
মিন হুয়ে বললো, “খুব অন্ধকার বলে?”
“আমাকে একটু ভাবতে দাও।”
শু ঝি হুয়া মাটিতে রেখে দিলো বেলচাটা, দু চক্কর ঘুরে এলো পাথরটাকে, ডান দিক দেখলো, বাঁ দিকে দেখলো, দুম করে চাঁটি লাগালো নিজের মাথায়, “ভুল। ভুল। এই পাথরটাই নয়। তোমরা এখানে দাঁড়াও আমি আশেপাশে দেখে আসছি -”
শিন ছি কিছু করার আগেই লোকটা তড়িৎ বেগে উধাও হয়ে গেলো।
গর্ত ছেড়ে এগোনোর আগে দুজন মানুষ দেখলো একে অপরকে।
ঘন অন্ধকার ঘিরে আছে সব দিকে, বৃষ্টির দাপট কেবল বেড়েই চলেছে।
“তুই কী ঠগের পাল্লায় পড়লি?”
মিন হুয়ে না বলে থাকতে পারলো না, “এই লোকটার ওপরে ভরসা করাই যায় না, চেকটা ওকে অতো তাড়াতাড়ি না দিলেও চলতো।”
ওর মনে আরো খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। শু ঝি হুয়া হয়তো সু তিয়াঁকে দেখেই নি, ও জানেও না সু তিয়াঁর অবশেষ কোথায় আছে। শুধু দশ লাখ য়ুআঁ পাবার জন্য ওদেরকে ছল করে এনেছে এখানে টাকার জন্য, ওদেরকে মেরে ফেলার জন্য।
মনে হয় শিন ছি বুঝতে পেরেছে মিন হুয়ের অনুমান, ও মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “ওর সাহস হবে না।”
"কেনো হবে না? ও তো আগেও অপরাধ করেছে।”
“কাল দেঁ চেন এখানে আসবে। যদি ও কিছু ভয়ানক কিছু করে থাকে তো ও কিছুতেই পালাতে পারবে না।”
মিন হুয়ে কথা ভেবে দেখলো। ওর মনে হলো যে শিন ছির কথাটা ঠিকই।
যাই হোক, শু ঝি হুয়া নিশ্চয়ই সু তিয়াঁর শরীরটা দেখে ছিলো। চুনো মাছ লাগানো ব্রেসলেট আর মৃতদেহের ছবি তো আর জাল হতে পারে না। কিন্তু কী করে যে অবশেষে দেহাবশেষের নিষ্পত্তি হবে - দেহাবশেষ আদৌ পাওয়া যাবে না - সে কথা বলা মুস্কিল।
এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই, নরম গলায় শু ঝি হুয়া ডাকলো, খুব দূর থেকেও নয়, “এদিকে এসো। এই পাথরটা হওয়া উচিৎ।”
দুজনে বেলচা উঠয়ে নিলো মাটি থেকে আর এগিয়ে গেলো যে দিক থেকে ডাক এসেছে সেদিকে।
একশো পা চলার পরে, ওরা দেখতে পেলো যে শু ঝি হুয়া আরেকটা পাথর দেখাচ্ছে।
“এই পাথরটাই হবে।”
শিন ছি যেনো একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছে, “তুমি নিশ্চিত?”
শু ঝি হুয়া ঘাড় নাড়লো, “এখানে খোঁড়ো।”
একটা এক মিটার গভীর গর্ত খোঁড়া হলো আর ফ্ল্যাশ লাইটে তার মধ্যে কিছুই পড়ে নেই দেখা গেলো।
কোনো সূত্র যদি নজর এড়িয়ে যায় সেই আশঙ্কায় মিন হুয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো যাতে খুঁটিয়ে দেখতে পারে, শিন ছি আর শু ঝি হুয়া আলাদা আলাদা ভাবে মাটিটা খাবলে খাবলে দেখতে লাগলো। শেষে নিশ্চির হওয়া গেলো যে গর্তের মধ্যে সু তিয়াঁর কিছুই নেই।
“তাহলে এবারেও তুমি তোমার ভুল স্বীকার করছো?" ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করলো শিন ছি।
“এমন করলে কেমন হয় - চলো আগে ফিরে যাই?”
শু ঝি হুয়াকে অপরাধীর মতো দেখাচ্ছে, “ভোর হবার পরে ফিরে এলে হয়। এখন আলো খুব কম, আশেপাশে দেখে কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না, সেই জন্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হচ্ছে।”
“এতো অজুহাত খাড়া কোরো না!" উদ্বিগ্ন হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো শিন ছি, ওর বুঝি এক্ষুণি হার্ট অ্যাটাক হবে, “তুমি জানো, নাকি জানো না?”
“আমি যদি নাই জানি, তবে আমার অতগুলো ‘ছেয়া’ নেবার সাহস হবে কী করে? ব্যাপারটা হলো যে এখন এতো অন্ধকার যে -”
“তুমি যদি আমাদের বোকা বানাবার সাহস দেখাও -”
দুজনে ঝগড়া শুরু করবে বুঝি, মিন হুয়ে ধড়ফড় করে থামালো দুজনকে, “শু গ্য, ভালো করে মনে করে দেখুন, তখন কেমন করে পুঁতে ছিলেন শরীরটা? এই জায়গাটা নদীর থেকে অনেক দূরে।”
মিন হুয়ের মনে হচ্ছিলো যে সু তিয়াঁর দেহটা শু ঝি হুয়া দেখতে পাবার পরে, ও এতো দূরে অতো ভারি দেহটা বয়ে নিয়ে আসবে কবর দেবার জন্য তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
“এখন এটা দূর মনে হচ্ছে, কিন্তু দূর্ঘটনার দিনে ভীষণ বৃষ্টি পড় ছিলো। আর নদীটা এমন ফুলে ফেঁপে উঠে ছিলো যে ওটা পাহাড়ের নিচেটা ছাপিয়ে গিয়ে ছিলো।”
বললো শু ঝি হুয়া, “আমার মনে আছে, আমি ওকে কবর দিয়ে ছিলাম নদীর কাছে একটা পাথরের পাশে। তখন আমার একটু ভয় কর ছিলো। তাই আমি দৌড়ে বাড়ি গিয়ে একটা বেলচা নিয়ে আসি। কাছাকাছি একটা গর্ত খুঁড়ে ওকে কবর দি।”
“সেই থেকে একবারও জায়গাটাতে এসেছো তুমি?" প্রশ্ন করলো মিন হুয়ে।
“না, আমি কাজে গিয়ে ছিলাম, বাইরে।”
শু ঝি হুয়া বললো, “কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে যে ওকে একটা উঁচু জায়গায় কবর দিয়ে ছিলাম, যেখানে সচরাচর জল ওঠে না। আমার ভয় ছিলো যদি মাটি ধসে দেহটা আবার ভেসে যায়।”
“একটা উঁচু জায়গা? এটাই তোমার কবরের জায়গা বলে মনে পড়লো?”
শিন ছি কলার চেপে ধরলো শু ঝি হুয়ার, চেঁচিয়ে উঠলো, “আমাকে তুমি খেলাবে?”
বলেই ও মুঠি ছুঁড়ে দিয়ে মারলো শু ঝি হুয়াকে, কিন্তু মিন হুয়ে ওকে চেপে ধরে রাখলো।
শু ঝি হুয়া জানতো যে ওর ভুল হয়েছে। ও কয়েক পা পিছু হঠলো, হাত তুললো সমর্পণের ভঙ্গিমায়, “আমি তোমাকে মিথ্যে বলি নি! আমি মিথ্যে বলি নি! দিব্যি গেলে বলছি যে ওকে এখানেই কাছে পিঠে কোথাও কবর দিয়ে ছিলাম। এলাকাটা আমার মনে আছে। জায়গাটা একটা বড়ো পাথরের ঠিক পাশে। উত্তরে, পাথরের ঠিক গায়েই একটা হয়াই শু আছে। যদি দিনের বেলা হোতো তবে আমি নিশ্চিত ওটা খুঁজে পেতাম একবারের চেষ্টায়। এখন বড্ডো অন্ধকার। যে জায়গাগুলো এখনো পর্যন্ত খুঁড়েছি, সেগুলো বাদে আর দুটো মাত্র পাথর আছে। সব থেকে ভালো হয়, যদি আমরা আলাদা আলাদা খুঁড়ি। ঐ দুটো পাথরের একটার নিচে ওকে নিশ্চিতভাবে কবর দিয়েছি।”
শিন ছির কোনো উপায় রইলো না বেলচা তুলে নিয়ে খুঁড়তে শুরু করা ছাড়া, শু ঝি হুয়া যে দিকটা দেখিয়ে দিয়ে দিলো সেই দিকে। আর মিন হুয়ে একটা ফ্ল্যাশ লাইট ধরে রইলো ওকে আলো দেবার জন্য।
আরো এক ঘন্টা খোঁড়ার পরে হঠাত থেমে গেলো শিন ছি।
“আমাকে ফ্ল্যাশ লাইটটা দে।" বললো শিন ছি।
উবু হয়ে বসলো গর্তের নিচে ফ্ল্যাশ লাইটটা মুখে চেপে ধরে, খুব আলতো করে মাটিটা উল্টে পাল্টে দিতে লাগলো হাত দিয়ে।
শু ঝি হুয়া একটা বেলচা হাতে এসে জানতে চাইলো, “তুমি কী পেয়েছো কিছু?”
শিন ছি মাথা ঝুঁকিয়েই রইলো। একটু পরে চুপচাপ ঘাড় নাড়লো, সদর্থক।
“আমি আসছি তোমাকে সাহায্য করতে।”
শু ঝি হুয়া গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললো, “আমার ন্যানার একটা কফিন আছে, বাড়িতে, কিনে ছিলো নিজের জন্য। আমি ওঁর সাথে কথা বলবো পরে, অনুরোধ করবো যে উনি যদি কফিনটা আগে তোমার নিফঙিয়োর জন্য দেন …”
শিন ছি মাথা নিচু করে রইলো, অনেক ক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ করলো না।
শু ঝি হুয়ার পিঠে চাপড় মেরে বললো মিন হুয়ে, “আগে ফিরে যাও, যন্ত্রপাতিগুলো রেখে যাও।”
“বু খেছি। আমি সাহায্য করতে চাই।”
বললো, শু ঝি হুয়া, “চেনদ্য।”
“দরকার নেই, শিয়া শিয়া।" বললো মিন হুয়ে।
বৃষ্টির তোড় বেড়েই চললো সমানে। গর্তের মধ্যে জল দুদ্দাড় করে বেড়ে প্রায় এক ফুট গভীর হয়ে গেলো।
শিন ছি হাঁটু মুড়ে গর্তের মেঝেতে বসে পড়লো, দু হাতে মাটি খাবলাতে লাগলো।
শেষ হেমন্তের আবহাওয়া, বৃষ্টিটা বরফের মতো ঠান্ডা। ওর ঠান্ডা লেগে যেতে পারে এমনটা আশঙ্কা করে মিন হুয়ে তুলে নিলো শু ঝি হুয়ার রেখে যাওয়া লোহার বালতিটা। গর্তের পাশে শুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কী নিচে আসব? জল ছেঁচে তুলে দেব?”
আদতে গর্তটা খুবই ছোট্টো। মধ্যিখানে শিন ছি হাঁটু মুড়ে বসে আছে। যদি মিন হুয়েও নিচে নামে, তাহলে কারুরই নড়াচড়া করার জায়গা থাকবে না।
শিন ছি মাথা তুলে ওকে দেখলো, মাথা নাড়লো, “দরকার নেই। বালতিটা আমার লাগবে। তুই গাড়িতে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারিস, বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য। আমি এখানে কাজটা নিজেই করতে পারবো।”
“তা কী করে হবে? আমরা একসাথে এসেছি।”
নরম সুরে বললো মিন হুয়ে, “আমরা আগে ফিরে যাই না কেনো,আর পরে ফিরে আসবো যখন বৃষ্টি থেমে যাবে, ভোর হবে।”
শিন ছির শরীর ভালো নয়। সর্দিকাশির অনেক ওষুধই ওর চলবে না, রক্ত জমাট না বাধার জন্য যে ওষুধটা খায় সেটার কার্যকারিতা যাতে না নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু উপস্থিত পরিস্থিতিতে মিন হুয়ে সাহস করলো না কোনো যুক্তি দিয়ে শিন ছিকে বোঝানোর, বরং, চুপচাপ, হাত বাড়িয়ে লোহার বালতিটা দিয়ে দিলো শিন ছির হাতে।
ও নিয়ে নিলো, রেখে দিলো ওর পাশে। কথা বন্ধ করে মন দিলো দু হাত দিয়ে মাটিটা খোঁড়ার কাজে।
খানিক ক্ষণ পরে মিন হুয়ে শব্দ পেতে লাগলো, “ডিং ডং, ডিং ডং" হয়তো ও দেহাবশেষ খুঁজে পেয়েছে। আর এক এক করে তা তুলে রাখছে লোহার বালতিতে, নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ডিং ডং ডিং ডিং শব্দটা ঘন্টির মতো বেজে চললো, মিন হুয়ের হৃদয়ে যেনো দুন্দুভি হয়ে বাজতে লাগলো। মিন হুয়ের পিঠ জুড়ে বয়ে গেলো একটা ঠান্ডা স্রোত। আর ওর সারা শরীর কেঁপে উঠলো। ও না ভেবে থাকতে পারলো না সেই বৃষ্টির দিনটার কথা যে দিন ওর সাথে সু তিয়াঁর প্রথম দেখা হয়ে ছিলো। বাসে ওর পাশে বসে সু তিয়াঁ অনেকবার ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মিন হুয়ে একবারও হাসে নি অবধি। যদি অন্য কেউ হোতো, মিন হুয়ে ভাবতেও পারে না যে সে কী ভীষণ রেগে যেতো।
অপ্রত্যশিতভাবে, মানুষটা এতোই সাধারণ ছিলো, ওর সাথে কোনো লেনাদেনা ছিলো না, সে রাতে শুধু ওর প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে ও শুধু শুধু নিজের জীবনটা দিলো।
কতোগুলো অপূর্ণ ইচ্ছে এক সঙ্গে উবে গেলো এক লহমায়।
ওর আঙুলের আগায় লেগে থাকা খুশি, লেগে থাকা সুখ। হাত ধরাধরি করে ভাগ করে নেবার সুযোগটুকু পেলো না।
এক হিতকারী যাকে মিন হুয়ে সারা জীবনে ভুলবে না তার সঙ্গ মিন হুয়ের ভাগ্যে জুটে ছিলো মাত্র এক দিন।
যখন সু তিয়াঁ সবে মাত্র স্নান সেরে বেরিয়ে এলো, ওর মুখটা লাল হয়ে ছিলো, ওর গলার স্বরে আর হাসিতে প্রসন্নতা মাখামাখি হয়ে ছিলো, অন্তত মিন হুয়ের চোখে প্রসন্নতাই ধরা পড়ে ছিলো, কিন্তু এখন সে হারিয়ে গেছে, মানুষ আর স্বর্গের ব্যবধান তৈরি করে।
লোহার বালতিটা বড়ো নয়। তাড়াতাড়ি ভরে গেলো ওটা। মিন হুয়ে অবশেষগুলো নিয়ে নিলো, ওর অনুভবে কেবল ভীতি, ওর ভয় হচ্ছিলো খুঁটিয়ে দেখতে, তাই ও চাদরটা খুলে বিছিয়ে দিলো বালতির ওপরে, তারপর সবটা রেখে দিলো একটা গাছের নিচে, একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ খুঁজে নিয়ে বাড়িয়ে দিলো শিন ছিকে, যাতে শিন ছি ওর হাতে উঠে আসা অবশেষ গুছিয়ে তুলতে পারে।
আরো এক ঘন্টা পরে ও শুনতে পেলো যে শিন ছির ভারী শ্বাসের শব্দ আসছে গর্তের মধ্যে থেকে। ফ্ল্যাশ লাইট তুলে ধরে জানতে চাইলো, “সব ঠিক আছে তো?”
ও মাথা নেড়ে বললো, “এখনো কিছু কম।”
“মানুষের শরীরে দুশো ছটা হাড় থাকে। আমি মাত্র একশো বারোটা পেয়েছি। এখনো অনেক হাড় আছে।”
শিন ছি বিড়বিড় করতে করতে ঝুঁকে পড়লো, কাদা জল খাবলাতে লাগলো দু হাত দিয়ে।
মিন হুয়ে কালো আকাশের দিকে তাকালো যার থেকে ঝরে পড়ছে হৈমন্তী বৃষ্টি, একটা ফ্ল্যাশ লাইট নিয়ে লাফিয়ে নামলো গর্তে, “আমি তোর সাথে খুঁজি। দুজনে মিলে খুঁজলে তাড়াতাড়ি হবে।”
যদি প্রত্যেকটা হাড়ে আত্মার খানিকটা থাকে, তবে, যতো দূর মিন হুয়ে বুঝেছে, শিন ছি চায় সু তিয়াঁর আত্মার সবটা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটু মুড়ে বসলো কাদা জলে, ঠান্ডা বৃষ্টিতে ভিজে সপ সপ করতে লাগলো, যদিও দুজনেই কোট পরে আছে।
দুজনেই কেঁপে উঠতে লাগলো, ইচ্ছের লাগাম ছিলো না সেই কেঁপে ওঠায়, দাঁতে ঠোকাঠুকি লেগে গেলো ঠান্ডায়।
কিন্তু দুজনেই খুঁড়ে চললো, কেউই থামলো না।
মাটিতে একটা বিটকেল গন্ধ। মিন হুয়ে পেয়েছে গন্ধটা। আর অল্প কল্পনাতেই ওর গা বমি বমি করতে লাগলো।
আর ওর পাশে শিন ছি ওকে উপেক্ষা করেই চললো। মন দিয়ে খুঁজতে লাগলো।
মিন হুয়ে না কেশে পারলো না। জানতে চাইলো, “কোথায় ওকে কবর দিবি ভাবছিস? এখানে? বিনচেং-এ? নাকি ওর নিজের শহর গুয়াঁইশির হেচিতে?”
“বিনচেং-এ" বললো শিন ছি, “তাহলে আমি থেকে থেকে যেতে পারবো ওর কাছে।”
“বিনচেং বেশ ভালো।”
মিন হুয়ে মাথা নাড়লো, ও একমত শিন ছির সঙ্গে। ও একটা মসৃণ কঠিন বস্তু ছুঁলো। ওর ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে দেখলো। একটা ছোটো হাড়। ও জানে না মানুষের শরীরের কোথায় থাকে ঐ হাড়টা। ও তাড়াতাড়ি হাড়টা শিন ছিকে দিয়ে দিলো, “আমি একটা টুকড়ো পেয়েছি।”
ও খুঁটিয়ে দেখলো, ছুঁলো আবার, “তুই খুবই সাহসী।”
“নাস্তিক।”
মিন হুয়ে চাই ছিলো দুয়েকটা হালকা কথা বলে ভারি আবহাওয়াটায় একটু বদল আনতে। কিন্তু বার বার কথা বলাটা বেমানান হবে বলে মনে হলো। তাই ও চুপ করেই রইলো।
আরো এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে দুজনে খুঁজে চললো। চুপচাপ। আরো সাতটা হাড় খুঁজে পেলো। দিনের আলো এলো। বৃষ্টি থেকে থেকে থেমে গেলো। গর্তটা থেকে থেকে বড়ো হলো।
শেষে শিন ছি বললো, “এই অবধি থাক। ওর কবরটা বড্ডো অগভীর। এতোগুলো হাড় খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।”
দু জনে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে এলো গর্ত থেকে। অনেক ক্ষণ হাঁটু মুড়ে বসে থাকার ফলে হাঁটুর জোড়ে অসহ্য ব্যাথা। মিন হুয়ে অনেক ক্ষণ পর্যন্ত সোজা দাঁড়াতে পারলো না। দু জনে দু জনের ওপর ভর দিতে বাধ্য হলো, ঠেসান দিলো গাছের ডালে।
ভোরের রশ্মি দেখা দিলো আকাশে, সময় হলে ভোরের আলো ছুঁলো শিন ছির মুখ। আর মিন হুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, দৃষ্টিতে কোনো অনুভব নেই।
ওর সারা শরীর ভিজে জবজব করছে, ওর স্যুট আর শার্ট - দুটোতেই পুরু কাদার আস্তরন, মুখটা ফ্যাকাসে, ওকে ভীষণ অসুস্থ দেখাচ্ছে। চোখের পর্দার নিচের রক্তক্ষরণের দাগটা আরো বড়ো হয়েছে, আরো স্পষ্ট হয়েছে, চোখের সাদা অংশের পুরোটা প্রায় ঢেকে গেছে।
“তোর চোখ -”
“আমি দেখতে পাচ্ছি।”
ও বালতিটা আর প্লাস্টিক ব্যাগটা যাতে হাড়গুলো রাখা আছে, সেগুলো সব তুলে নিলো হাতে, মিন হুয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুই বাক্স এনেছিস, সব ওর মধ্যে পুরে দিবি তো?”
বাক্সটা রাখা আছে বালতিটার পাশে। দেখে মনে হচ্ছে ওটাতে জল লাগবে না এমন পুরু ঢাকা দেওয়া আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেনো ওটার ওপরে এক ফোঁটাও জল পড়ে নি।
শিন ছি উত্তর দিলো না প্রশ্নটার, কিন্তু বললো, “তুই আগে যা।”
“তুই যাবি না?”
“আমি নদীতে যাবো। হাড়গুলো ধুয়ে পরিস্কার করবো।”
“তোর কী নিজে হাতে পরিস্কার করা একান্তই জরুরি?”
মিন হুয়ের মনে হচ্ছিলো যে দেহাবশেষ খুঁজে বার করাটাই মৃতের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রকাশ করা। শিন ছির জন্য ব্যাপারটা নিষ্ঠুর। এই মূহুর্তে ওর ভেঙে পড়তে এক চুল বাকি। ও যে কোনো সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
“সু তিয়াঁর বসত ভিটা যে শহরে সেখানে রীতি হলো হাড় ধুয়ে কবর দেওয়া, যাকে বলা হয় দ্বিতীয় সমাধি।”
বললো শিন ছি, “ও বলে ছিলো আমাকে আগে, ওর ঠাকুমা আর দিদিমাকে এরকম করেই কবর দেওয়া হয়ে ছিলো।”
মিন হুয়েকে অবাক হতে দেখে শিন ছির মুখে বাঁকা হাসি দেখা দিলো, একই সুরে বললো, “এতো বিশদে জানার প্রয়োজন তোর নেই। এই কাজটা আত্মীয়রাই করে।”
“তাহলে, আমিও তোর সাথে ধোবো হাড়গুলো।”
“তোর এ কাজে হাত লাগানোর দরকার নেই।”
"কেনো?”
“তুই ওর আত্মীয় নস।”
কথাটা সামান্য হলেও আহত করে, কিন্তু মিন হুয়ে তর্ক করতে চায় না, “তাহলে আমি নদীর পাড়ে তোর জন্য অপেক্ষা করবো। ধোয়া হয়ে গেলে একসাথে ফিরবো।”
“আমি একলা থাকতে চাই।”
“আমার কথা মাথাতেই নিস না, ঠিক আছে?" নরম স্বরে বললো মিন হুয়ে।
“তোর কথা মাথাতেই নেবো না?”
বিদ্রুপ করে উঠলো শিন ছি, “তাহলে, সব কিছুই তোকে ঘিরে ঘটছে? তুই মহাবিশ্বের কেন্দ্র?”
মিন হুয়ে গাড়িতে ফেরার পথে সারাটা পথ কাঁদলো।
নটা দশে দেঁ চেন আর জিয়া জুনের গাড়িও এসে পৌঁছোলো। ওদের ট্রেনে আসার কথা ছিলো, কিন্তু ওরাও ঠিক করেছে যে নিজেরাই গাড়ি চালিয়ে আসবে। ওদের দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো যে শিন হয়তো দুঃখে খুবই ভেঙে পড়বে। তাই শিন ছিকে সাহায্য করার জন্য ওরা তড়িঘড়ি চলে এসেছে।
“আমরা পুলিশে খবর দিয়ে দিয়েছি।”
হোটেলে পৌঁছে বললো দেঁ চেন, “যাই হোক ওরাও তো তদন্ত করে দেখবে। এটা যদি সত্যিই সু তিয়াঁ হয়, তাহলে ওদেরও তদন্তের খাতাটা বন্ধ করার দরকার।”
“শু ঝি হুয়া চায় না যে পুলিশ জানুক।”
“ওর দিকটা আমি বুঝে নেবো।”
এক ঘন্টা পরে শিন ছি ফিরলো হোটেলে, সঙ্গে কুমীরের চামড়ার স্যুটকেস। ও অনেক ক্ষণ ধরে স্নান করলো। একটা ঘন কালো স্যুট পরলো, রেস্টুরেন্টে গেলো সকালের খাবার খেতে।
মিন হুয়ে, দেঁ চেন, জিয়া জুন সবাই ওর দিকে তাকালো দুশ্চিন্তা নিয়ে।
“শিন ছি, ওষুধ খেয়েছিস?” মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “ওয়ারফারিন?”
“আমি আনতে ভুলে গেছি।" জানালো শিন ছি।
“তা হলে চলবে কী করে!”
উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো মিন হুয়ে, “আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাই না হয়? তোর চোখটাও তো দেখাতে হবে ডাক্তারকে।”
“দু দিনের মধ্যে ফিরে যাবো।”
হালকা সুরে বললো ও, “আমি কিছু লোককে লাগাতে চাই, ওর অবশেষ খুব ভালো করে খুঁজে দেখার জন্য। যতোগুলো সম্ভব ততোগুলো হাড় খুঁজে পেতে চাই।”
“ব্যাপারটা কী? তোকে ফিরে যেতেই হবে! আমি থেকে যাচ্ছি অন্ত্যেষ্টির কাজ করার জন্য।”
“তুই কেনো থাকবি? সু তিয়াঁর অন্ত্যেষ্টির দায়িত্ব ওর আত্মীয়দের। তুই না থাকলেও চলবে।”
মিন হুয়ের দিকে একটা হিংস্র চাহনি দিয়ে বললো, “তোকে আমার কথা ভাবতে হবে না। তোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তুই যেতে পারিস।”
ওর গলার স্বর সামান্য কর্কশ। আর ওর চোখ রক্তাভ।
মিন হুয়ের হৃদয়েও হঠাৎ জ্বালা করে উঠলো যেনো অম্লতায়, চোখ ছাপিয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা, “আমি জানি তুই আমাকে ঘেন্না করিস, শিন ছি। কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করে কিছু করি নি। আমি তো সু তিয়াঁর ক্ষতি করতে চাই নি, আমার কোনো অসদুদ্দেশ্যও ছিলো না। দূর্ঘটনাটার পরে আমি রোজ দূর্ঘটনাটার কথাই ভেবেছি। আমি কী এমন করে ছিলাম যে সু তিয়াঁর মনোযোগ আমার ওপরে এসে পড়লো? যে কারণে ও ওর প্রাণটাই বিসর্জন দিলো আমার জন্য? - - আমি তো কিছু করি নি, সত্যিই, আমি সত্যি ওর কোনো ক্ষতি করি নি।”
মিন হুয়ে ফোঁপাতে লাগলো, “আমরা সবাই সকলের কাছে অপরিচিত। আমি তো ওর প্রতি সহানুভূতিও দেখিয়ে ছিলাম। বাসে ও বাথরুমে যেতে চাইলো। আমি ওর জিনিসপত্র পাহারা দিলাম। বাস থেকে নামার পরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। ও আমার সাথে হোটেলের ঘরে থাকতে চাইলো, আমি রাজি হয়ে ছিলাম। তুই আমাকে স্বার্থপর বলিস, আমি খারাপ, সত্যিই আমি খুব খারাপ। যদি যথেষ্ট বাজে হতাম তাহলে আমি কিছুতেই ওকে আমার সঙ্গে রাতে থাকতে দিতে রাজি হতাম না, ওর অনুরোধ উপেক্ষা করতাম। তাহলে ও কিছুতেই টের পেতো না যে আমি মুশুই হে-তে গেছি। আমাকে বাঁচাতোও না, আর ভালো ভাবে বেঁচে থাকতো! সারাটা পথ আমি ওর সাথে এক্কেবারে কথা বলি নি, মন দিই নি ওর কথায়, ওর দিকে ভয়ানক বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, তাও ও আমাকে ঘেন্না করে নি … আমি জানি না ও আমাকে কেনো বাঁচিয়েছে, আমি সত্যিই জানি না কেনো!”
“কারণ ঐ দিন, বাসে, প্রত্যেকটা লোক জানতো যে তুই মরতে চাইছিলি!”
কথাগুলো কেটে কেটে বললো শিন ছি, “তুই কাঁদছিলি বাসে উঠে থেকে। অনেকেই দেখে ছিলো সেটা। পরে একটা ধস নেমে ছিলো। বাস থেকে সবাই নেমে পালানোর পথ খুঁজছিলো। কেবল মাত্র তুই বসে ছিলি বাসে, নামতে রাজি হোস নি কিছুতেই। নড়ে বসতে অবধি রাজি হোস নি, এমনকি ড্রাইভার তোকে ধরে টেনে নামাতে গিয়ে ছিলো, তুই তখনো নামিস নি! তোর মনে আছে সেই আইয়ে-কে যার সাথে সু তিয়াঁ গল্প করে ছিলো? সে সু তিয়াঁকে বলে ছিলো যে তুই যে রকম কান্নাকাটি করছিস, তাতে মনে হয় যে তোর জীবনে এমন কিছু ঘটেছে যা তোর দুরূহতম কল্পনাতেও ছিলো না। ওকে বলে ছিলো তোর সাথে আরো কথা বলতে যাতে তোর মনের ভার একটু হালকা হয়ে যায়। সু তিয়াঁ শুধু চেয়ে ছিলো তোকে বাঁচাতে, সেই জন্য ও যতো ভাবে পেরে ছিলো চেষ্টা করে ছিলো তোর ঘনিষ্ঠ হতে। নিজেকে ক্ষমা করার কারণ খুঁজিস না। যখন তুই শুধু নিজের কথাই ভেবেছিস, যখন তুই এক মনে নিজের যন্ত্রণার দুঃখে মজে থেকেছিস, তখন দয়া করে বাকিদের কথাও ভাবিস! ও হয়তো তোর মতো চালাকচতুর নয় বা ওকে দেখতে তোর মতো সুন্দর নয় অথবা ও তোর মতো মোহময়ী নয়, কিন্তু তোকে বাঁচানোর মূহুর্তে ও একবারও নিজের কথা ভাবে নি একটুও। আমি তোকে এ সব বলছি , এই জন্য নয় যে যাতে তুই কক্ষণো নিজেকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র বলে মনে না করিস, বরং এইটা বোঝাতে কেউই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়।”
“আমার কোনো অজুহাত নেই। আমি শুধু একটু ভালো করে বাঁচতে চাই। আমার জীবনের বাকিটার সবটাই সু তিয়াঁর আমাকে যা দিয়েছে তা, আমি সেটা নষ্ট করতে পারবো না। আমি নয়ছয় করে কাটাতে পারবো না, আমি সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চাই, জীবনের আনন্দে, উত্তেজনায়, সুখে। আমি চাই না সু তিয়াঁ স্বর্গে বসে অনুশোচনা করুক আমাকে জীবন দান করার জন্য! তাই, শিন ছি -”
মিন হুয়ে নিজের চোখের জল মুছে নিলো, “আমি আমার জীবনের বাকিটা তোর মতো অসন্তোষ করে আর অনুশোচনা করে কাটাবো না।”
“ওয়াও, মিন হুয়ে, অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে তুই এমন সুন্দর জীবন কাটাচ্ছিস। কারণ তোর নিজেকে ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতাটা চমৎকার!" বিদ্রুপ করে উঠলো শিন ছি।
মিন হুয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে, বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে গেলো দরজা দিয়ে।
দেঁ চেন আর জিয়া জুন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
“ইথান, আমার মনে হয় -" দেঁ চেন সোজাসুজি বললেন, “এই মাত্র যা বললে, সেটা বেশ বাড়াবাড়িই হয়ে গেলো।”
“আমি তো খুব বেশি কিছু বলিই নি!" রাগ দেখিয়ে বললো শিন ছি।
“শিন ছি গ্য," লাজুক ভঙ্গীতে বললো জিয়া জুন, “আমারও মনে হয় যে আপনি মিন হুয়ে জিয়েজিয়ের সাথে বেশ খারাপ ব্যবহার করলেন। সু তিয়াঁ জিয়েজিয়ে যা করেছেন তার বদলে উনি তো কিছু চান না। তাঁর তো প্রয়োজন ছিলো না আপনাকে মেগুওয়া থেকে ফিরিয়ে আনার, সব ক্ষতি পূরণ করে দেবার জন্য, আর সু তিয়াঁ জিয়েজিয়ের যা পাওনা সেটা ওকে পাইয়ে দেবার জন্য। ও তো কখনো ভাবে নি যে আপনি ওকে একটা সুখের জীবন দেবেন। ও শুধু এই জানতে চেয়ে ছিলো যে আপনি ভালো আছেন কিনা, ও কেবল চেয়ে ছিলো আপনি যেনো সুখে থাকেন। তেমনই চার বছর আগের সেই রাতে কাঠের সেতু থেকে উনি যখন বাণের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিলেন কাউকে বাঁচানোর জন্য, তখনও তার বদলে উনি কিছুই চান নি। কারণ এটা কোনো লেনদেন নয়, এটা একটা উপহার, উনি আপনাকে দিয়ে গেছেন নিজের জীবন দিয়ে। আপনি শুধু ভালো করে সেটা গ্রহণ করলেই হবে। মিন হুয়ে জিয়েজিয়ের কোনো ঋণ নেই সি তিয়াঁ জিয়েজিয়ের কাছে, আপনারও কোনো ঋণ নেই সি তিয়াঁ জিয়েজিয়ের কাছে। সু তিয়াঁ জিয়েজিয়ের কিছুই পাওনা নেই। মিন হুয়ে জিয়েজিয়ে আপনার কাছেও কিছু ধারেন না। আপনি অন্ততকাল ধরে ওঁকে দোষারোপ করে যেতে পারেন না, ওঁর অপরাধবোধটাকে আরো দগদগে করে তোলার কোনো দরকার নেই, কারণ উনি নিজেই ভীষণ রকম অপরাধবোধে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে আছেন।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-65.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-67.html
No comments:
Post a Comment