Sunday, October 13, 2024

JPDA - Chapter 68

৬৮. নির্লিপ্ত একাকীত্ব

 


“ওর পিছনে তাড়া করিস না।" এক মূহুর্ত নষ্ট না করে বললো মিন হুয়ে, “এরকম জঘন্য লোকের পেছনে সময় নষ্ট করার মানে হয় না, বিশেষ করে তোর সময় যখন ভীষণ দামী।”

শিন ছি কোনো উত্তর দিলো না, শুধু ঠোঁট দুটোকে শক্ত করে কুঁকড়ে গোল করে ফেললো আপত্তি জানিয়ে, খানিক পরে বললো, “যখন বয়স খুব অল্প ছিলো আমার, তখন আমি খুবই বদমেজাজী ছিলাম। আমার আশেপাশে কেউই আমাকে সহ্য করতে পারতো না। কেবল তিয়াঁ তিয়াঁ আমাকে ছাড় দিতো, তাও আমি কখনো কখনো রেগে যেতাম। যখন ও রেগে যেতে শুরু করতো, আমি তক্ষুণি ঠান্ডা হয়ে যেতাম …”

শিন ছি হাসলো, ওর দু চোখে নম্রতা, যেনো সু তিয়াঁ ওর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, “কারণ আমি ভয় পেতাম যে ও যদি সত্যিই রেগে যায় আর আমাকে উপেক্ষা করতে শুরু করে এবার থেকে, তাই আমি উদ্যোগ নিয়ে ওকে খুঁজে বার করতাম। আর আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতাম ওকে খুশি করার, কারণ ও আমার একমাত্র আত্মীয় আর সম্পর্ক।”

স্মারকস্তম্ভে সু তিয়াঁর একটা ছবি আছে, হাসি মুখে দাঁত জেগে আছে, আঙুলে ইংরেজি ‘ভি’ আকৃতি করে একটা ভঙ্গিমা নিয়েছে, সমস্ত ভ্রূ জুড়ে অনেক চিন্তা …

“তুই কী জানিস, কেমন লাগে কেবল একটা মাত্র মানুষের ওপরে সমস্ত ভরসা করে বেঁচে থাকতে?”

ও মৃদু স্বরে বলে চললো, “অন্য সবাই, আমার সঙ্গে একবার বোঝাপড়া করেছে, আমার সঙ্গে ঝগড়া হবার পরে, কেউ কেউ দু বার। আমি যদি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও থাকি, তবুও তাদের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলেছি। কেবল সু তিয়াঁ, আমি জানতাম, যাই হোক না কেনো, ওর সঙ্গে যতোবারই আমি ঝগড়া করি না কেনো, প্রত্যেকবার ফিরে তাকালেই দেখবো যে ও আমার পিছনেই আছে, ও আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে, হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ লোকটাই তো আমার।”

অবশ্যই মিন হুয়ে বুঝতে পারছে, কারণ ওর তো নিজের মা-বাবা ছিলেন, তাঁরা ওঁকে ভালো বাসতেন।

“তিয়াঁ তিয়াঁ নিজের চোখে দেখে ছিলো যে ও আর ওর দিদি চুরি হয়ে যাচ্ছে। তখন, ও জানতো না যে ওর মাকে কেউ ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে, তাই ও কেবল বলতো আমাকে যে ওর মা খুব উদাসীন ছিলো। মা শুধু ঘুমোতো আর সেই জন্যই ওকে আর ওর দিদিকে হারিয়েছে। সেটা অসহ্য। তখন, আমি ভেবে ছিলাম, আমি অবশ্যই একজন ভরসার যোগ্য মানুষ হয় উঠবো, না হলে তিয়াঁ তিয়াঁ আমার সঙ্গে সহজ হতে পারবে না … যখন আমি মেগুওয়াতে পৌঁছোলাম, আমি কঠোর পরিশ্রম করে ছিলাম শুধু এই জন্যই, আর আমি কিছুতেই ব্যাপারটা ছেড়ে দিই নি। ব্যাপারটা ভেবে দেখলে এরকম দাঁড়ায় যে ওর সমস্ত আত্মীয়ের মধ্যে, আমিই সব থেকে অবিশ্বাসী, আমি যদি আমার কথা রাখতাম এসে ওর সাথে দেখা রাখার ব্যাপারে, ও তাহলে হয়তো -”

“-- এটা তোর দোষ নয়।" ওর কথা শুনতে শুনতে মিন হুয়ের গলা বুজে এলো, ও তড়িঘড়ি বললো, “নিজেকে দোষ দিস না।”

“অবশ্যই, এটা আমার দোষ।”

হাত মুঠো করে ফেললো ও, খুব জোরে দাঁতে দাঁত চিপে বললো, “এক সময়ে আমরা এক মত হয়ে ছিলাম যে আমরা যখন বড়ো হবো, তখন যদি আমাদের বাচ্চাকে একটা উষ্ণ আরামদায়ক ঘর না দিতে পারি আমরা, তাহলে বরং আমরা বাচ্চাকে এই পৃথিবীতে একদম আসতেই দেবো না। আমি কঠিন পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করলাম, কারণ আমি ভেবে ছিলাম টাকা দিয়েই আমি ওকে আর আমাদের সন্তানদের প্রচুর সুরক্ষা আর নিরাপত্তা দিতে পারবো … ভুল ভেবে ছিলাম! এই সবে সময় নষ্ট করা উচিৎ হয় নি আমার, টাকা রোজগার করা, এসবের কোনো শেষ নেই। আমার ওকে ছেড়ে যাওয়াই উচিৎ হয় নি। জীবন যদি কঠিনও হোতো আমরা একসঙ্গে ভুগতাম। অন্তত ওকে একলা বইতে হোতো না কষ্টের বোঝা, অন্তত ওর পাশে একটা কেউ থাকতো ওকে ঝড়ে বাদলে রক্ষা করার জন্য।”

“এ রকম করে ভাবিস না, শিন ছি, এ রকম কিছু মোটেই চায় নি সু তিয়াঁ।”

“যে দিন তোর সাথে ওর দেখা হয়ে ছিলো, সে দিনটা আমাদের দেখা করার দিনের খুব কাছাকাছি। কিন্তু ও টি-শার্টটা কিংবা এনামেলের গ্লাসটা সঙ্গে নিয়ে আসে নি, যার মানে দাঁড়ায় যে ও হয়তো ইয়ং’আন সাঁকোতে আমার সাথে আর দেখা করার কথাটা ভাবেই নি … ও নিশ্চয়ই আমার আশা ছেড়ে দিয়ে ছিলো।”

কথাটা মিন হুয়েও ভেবেছে আগে।

সু তিয়াঁ নিখোঁজ হয়ে গিয়ে ছিলো সাতাশে জুন, ওদের দেখা করা কথা ছিলো সাতই জুলাই - মাঝে ছিলো মাত্র দশটা দিন। ইয়াংছেনজেন আর জ্যাংঝৌ - একটা উত্তরে তো আরেকটা দক্ষিণে, আবার মুশুইহে তো হুবেই-এর পশ্চিমে। মুশুইহে থেকে বিনচেং-এ পৌঁছোতে ট্রেনে লাগে চার ঘন্টা, আবার তারপরে পাঁচ ঘন্টা লাগে বিনচেং থেকে জ্যাংঝৌ।

জ্যাংঝৌ থেকে বিনচেং হয়ে ইয়াংছেনজেন

জ্যাংঝৌ থেকে ইয়াংছেনজেন যাওয়া, সঙ্গে টি-শার্ট আর এনামেলের গ্লাস নিয়ে, যেগুলো ওকে নিয়ে যেতেই হবে দেখা করার জন্য, ব্যাপারটা দাঁড়াবে পুরো মাতৃভূমির ভ্রমণ, দক্ষিণতম বিন্দু থেকে দৌড়ে উত্তরতম বিন্দুতে। সু তিয়াঁর খরচ করার অভ্যেসে ও প্লেনে চড়ে যাবে এমনটা ভাবা অসম্ভব। আর ট্রেনে লাগতো দেড় দিন। তার মধ্যে ওকে বিনচেং-এ থাকতে হোতো জিয়া জুনকে খুঁজে বার করার জন্য। অবশ্যই, অনেক সময় আছে মনে করা যায় যদি কোথাও না থেমে ও কেবল যাতায়াত করতে থাকে তো। কিন্তু মিন হুয়ে যদি সু তিয়াঁ হোতো আর হঠাৎ শুনতে পেতো যে ওর ভাই আছে ইউকং-এ, আর এ দিকে শিন ছির সঙ্গে দেখা করার সময়ও এগিয়ে এসেছে, তাহলে সু তিয়াঁ নিশ্চয়ই টি-শার্ট আর এনামেলের গ্লাসটা সঙ্গে করে নিয়ে যেতো, যাতে আবার ট্রেনে চেপে ফিরে এসে ওগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে না হয়।

তখন সু তিয়াঁ কী ভেবে ছিলো সে কথা অজানাই রয়ে গেছে।

“নিশ্চয়ই ও তোর সঙ্গে দেখা করবে ভেবে ছিলো! এমনটাও হতে পারে যে ও ধরে নিয়ে ছিলো যে তুই মারা গেছিস।”

মিন হুয়ে নরম সুরে স্বান্তনা দিতে লাগলো, “ও ডায়েরিতে লিখে ছিলো তো তুই হয়তো পনেরো বছরের বেশি বাঁচবি না, তাই না?”

“ডায়েরিতে ও তো লিখে ছিলো – যাই হোক না কেনো, ও আমার জন্য অপেক্ষা করবে আরো তিন বছর! ও নিশ্চয়ই মরিয়া হয়ে উঠে ছিলো, তিন বছরের পরে ও আর অপেক্ষা করতে চায় নি আমার জন্য। হয় ও ভেবেছে যে আমি মরে গেছি অথবা আমার মন বদলে গেছে। আমি সহ্য করতে পারছি না কিছুতেই যে ও এই সব ভাবনা নিয়ে স্বর্গে গেছে, আর আমাকে বুঝিয়ে বলার একটা সুযোগ অবধি দিলো না যে আমি মরেও যায় নি, আমার মনও বদলায় নি, আমি করি নি কিছুই।”

হঠাৎ শিন ছি কান্নায় ভেঙে পড়লো।

মিন হুয়ে খালি চোখে তাকি রইলো ওর দিকে। কিছুক্ষণ শুধু দুঃখ হতে লাগলো। বরং শিন ছি ওকে ভয়ানক দোষারোপ করতো, এ ভাবে নিজে দুঃখ পাওয়ার চেয়ে, এ ভাবে নিজেকে দোষী ভাবার থেকে।

“ও নিশ্চয়ই তোর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে ছিলো।" মিন হুয়ে কাঁধ চাপড়ে দিলো শিন ছির, স্বান্তনা দেবার মতো আর কোনো শব্দ খুঁজে না পেয়ে, “এই নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই।”

“বালি-সিমেন্ট, লোহা বওয়ার কাজ, জুতোর কারখানায় কাঠের পাটায় ঠুকে ঠুকে জুতোর শুকতলা লাগানোর কাজ, জামা ইস্ত্রি করার কাজ আর বোতাম বসানোর কাজ জামার কারখানায় … শেষে গিয়ে ছিলো পা ধোওয়ানার দোকানে কাজ করতে, যেখানে কোনো জানলা ছিলো না, প্রায়ই খদ্দেররা যেখানে উত্যক্ত করতো … এই ছিলো ওর জীবন, দিনের পর দিন, অবনত আর অসাড় … এই জীবন এই ধরনের ভোগান্তি আসলে আমি বইতাম …”

“না। যে সু তিয়াঁকে আমি দেখেছি, সে খুবই হাসিখুশি প্রাণবন্ত দরাজ মনের একটা মেয়ে। সহজেই অচেনা লোকের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলতে পারে। আমার জন্যও খুব সহানুভূতি ছিলো ওর। আমার মাথায় চুল কম দেখে ও আমাকে একটা হেয়ার মাস্ক লাগাতেও বলেছে। তুই যেমন ভাবছিস ও মোটেই তেমন মনমরা আর অসাড় ছিলো না।”

“সেই জন্যই ও আমার থেকে আলাদা। যতোই যন্ত্রণার হোক না কেনো জীবন, ও হাসবেই, ও আপ্রাণ চেষ্টা করবেই। কিন্তু আমি কিছুতেই ওর মতো নিজেকে ঠকাতে পারবো না। তোর কী মনে হয় আমরা জীবনকে বেছে নি যাপণের মধ্যে দিয়ে? ভুল। জীবন আমাদের বেছে নেয় যাপণ করিয়ে নেবার জন্য। যখন তুই অনেক মানুষের মুখোমুখি হবি যাদের কারুর ওপরেই ভরসা করা যায় না, এমন কী তোর মা-বাবার ওপরেও নয়, তুই খুব অল্প বয়সেই নিক্তি মেপে সজাগ হয়ে দিতে শিখবি। কারণ তুই কখনো নিঃশর্ত ভালোবাসো পাস নি। তোর প্রত্যেকটা ভালোবাসা যখন তোকে অর্জন করতে হয়েছে, যত্ন করে লালন করতে হয়েছে, তখন তুই তোর অনুভূতির ব্যাপারে খুব উদার হতে পারিস না …”

ও ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো মিন হুয়েকে, “আমার ভয় হচ্ছে যে তুই বোধ হয় আমার কথার এক বর্ণও বুঝতে পারছিস না। কেমন যেনো সব সময়ে ‘সজাগ’ হয়ে থাকাটাই ধীরে ধীরে জমা হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা যত্ন আর প্রত্যেকটা আনন্দ অমূল্য আর সেগুলোকে যত্নে আগলে রাখতে হয়। নিজের হাতের তালুতে, শক্ত করে ধরে রাখতে হয়, সজাগ সচেতন না হলে মূহুর্তে ভেঙে যায়। যে বছরে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো, সু তিয়াঁ আসলে আমাকে ছেড়েই দিয়ে ছিলো। কারণ ও জানতো আমার স্বভাবটা কেমন আর আমার সব কিছু ধ্বংস করে ফেলার ক্ষমতা কতোটা। আমি যদি অনেকগুলো সুযোগ পাই বেছে নেওয়ার মতো, তাহলে আমি বিগড়ে যাবো, কিন্তু ও যাবে না। আসলে আমি যখন প্রথম বার মারপিট করি, তখন ও আমাকে বলে ছিলো যে আমি অন্যদের থেকে কিছু মাত্র আলাদা নই। যখন আমি শক্তিশালী, তখন আমিও অন্যদের উত্যক্ত করি।”

“না।”

মিন হুয়ে মাথা নাড়লো। “সু তিয়াঁ তোকে চলে যেতে দিয়ে ছিলো কারণ ও তোকে ভালো বাসতো। ও তোর ভবিষ্যতটা কী হবে সেটা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে ছিলো, ও তোকে উৎসাহ দিয়ে ছিলো বড়ো হয়ে ওঠার। ও তোকে ভরসা দিয়ে ছিলো নতুন পৃথিবীকে চেনার। আর বিশ্বাস করে ছিলো যে তুই এক দিন ফিরে আসবি আর ওর সাথে এক হয়ে যাবি। ও তোকে ভীষণ গভীরভাবে ভালো বেসে ছিলো। একই কারণে, আমিও যা করেছি তা করেছি।”

শিন ছি কোনো উত্তর দিলো না, স্মৃতি ফলকের দিকে তাকিয়ে ছিলো, নিজের চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গেছে।

আরো কিছুক্ষণ পরেও শিন ছি চুপ করে আছে দেখে ওর পাশের খালি জমিটাকে দেখিয়ে মিন হুয়ে প্রশ্ন করলো, “শিন ছি, ঐ জমিটা দেখেছিস?”

ও চোখ তুলে দেখলো , ঘাড় নাড়লো, ওটাতে একটা ছোটো কবর ছিলো।

“আমি কিনেছি ওটা।”

“তুই কিনেছিস?" শিন ছি ভ্রূ কোঁচকালো।

“হ্যাঁ। মারা যাবার পরে আমাকে এখানেই কবর দেওয়া হবে। মৃত্যুর পরেও আমি তোদের পাশে থাকব।”

“তুই কী পরের জন্মেও আমাদের ছাড়বি না?”

“হ্যাঁ, আমি তোদের সঙ্গে আমার জীবনের খানিকটা কাটিয়েছি যে!”

শিন ছি একটা অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মিন হুয়ের দিকে, অনেক ক্ষণ, কোনো কথা বললো না, একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো, বললো, “দেরি হয়ে গেছে। চ।”

দুজনে এক সঙ্গে সমাধিক্ষেত্র ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ফটকের বাইরে গাড়ি রাখার জায়গায় পৌঁছোলো।

“তুই কী সোজা বাড়ি যাবি?" জিজ্ঞেস করলো শিন ছি।

“হ্যাঁ।”

“আমি নিয়ে যাবো তোকে।”

“না। ট্যাক্সি ডাকা বেশ সুবিধের।”

মিন হুয়ে ফোন বার করে ট্যাক্সির অ্যাপে ক্লিক করলো।

“আমারও খুব সুবিধেই হবে তোকে বাড়ি পোঁছে দিলে।”

“দরকার নেই।” হেসে বললো মিন হুয়ে, “শিন ছি, আমি ঠিক করে নিয়েছি যে পুরোনো সব কিছু ঝেড়ে ফেলে শুধু সামনে এগোবো, সেটা না হয় এখন থেকেই শুরু হোক।”

শিন ছি সামান্য চমকে উঠলো যেনো, মিন হুয়ের দিকে চুপচাপ তাকালো, ভ্রূ তুলে জানতে চাইলো, “তুই আবার কী খেলতে চাইছিস, মিন হুয়ে?”

“কোনো কিছুই বদলানো যাবে না, যা পড়ে আছে তা শুধু মূল্যবান সময়। সু তিয়াঁ আমাকে যে আশীর্বাদ দিয়ে গেছে, আমি তা উদযাপণ করবো।”

মিন হুয়ে তাকালো শিন ছির দিকে সারা মুখে শূণ্যতার অভিব্যক্তি নিয়ে, “আমি খুশি যে তুই সামলে উঠেছিস। আমরা সবাই নিশ্চিন্ত যে তুই সামলে উঠতে পেরেছিস। আমি তোর সাফল্য কামনা করি, নিজের যত্ন নিস -”

বলেই মিন হুয়ে হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দিলো, “আশা করবো যা হারিয়ে গেছে তোর জীবন থেকে, সে সবই কোনো না কোনো ভাবে ফিরে আসুক আবার তোর জীবনে।”

খুব জোরের সঙ্গে কথাগুলো শিন ছিকে বলতে লাগলো মিন হুয়ে। দুজনে হাত মেলালো, তারপর পিঠ ফিরিয়ে মিন হুয়ে একটা সিগারেট ধরালো, একটা গাছের ছায়ায় হেঁটে গেলো, আলস্য ভরে সিগারেটটা উপভোগ করতে লাগলো।

শিন ছি এক ঝলক দেখলো মিন হুয়েকে, নিজের গাড়ি অবধি হেঁটে গেলো, আলো জ্বালালো আর ঝটপট চলে গেলো।

গোধূলি ছেয়ে আছে চারপাশে, সুর্যাস্তের ম্লান ছটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসছে গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে। 

যে গাড়িটার অপেক্ষায় ছিলো মিন হুয়ে, সেটা কখনোই এসে পৌঁছোলো না। মিন হুয়ে পর পর দুটো সিগারেট খেয়ে ফেললো, ওর মেজাজ চড়লো, পড়লো, ও বুঝতে পারলো না যে ওর মনটা ভারি নাকি হালকা। 

মিন হুয়ে খুব ভালো করে আত্মসংযম আর আত্মনিয়ন্ত্রণ করার ভানও করতে পারে না।

****



পুরো হেমন্তকাল জুড়ে বিনচেং-এ খুব বৃষ্টি পড়ে। কিন্তু ভারি বৃষ্টি পড়ে না বা খুব বাজ পড়ে না। বেশ কয়েক দিন ধরে একটানা বৃষ্টি পড়ে চলে।

মিন হুয়ের নেতৃত্বে জিএস২.০ প্রজেক্ট তার গঠনশৈলীর আর তথ্যভান্ডারের নকশার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। গুয়ান ছাও ইন্টারন্যাশন্যাল সত্যিই প্রযুক্তিক্ষেত্রে সামনের সারিতে আছে, এর ক্ষমতা আর উপায়ের যোগান বা’অ্যান মেডিটেকের তুলনায় বহু গুণ বেশি। চেং ছিরাং বলে ছিলো মিন হুয়েকে মূল নকশাটাকে উন্নত করতে আর বিস্তারিত করতে যতোভাবে বিস্তারিত করা সম্ভব ততোভাবে, বুদ্ধিমত্তাকে টক্কর দেওয়া কাজ আর প্রবল পরিশ্রমের কাজও।

অধিগ্রহণের পরে থেকে বহু দিন মিন হুয়ে প্রজেক্টটাতে মন দিতে পারে নি। তাই মন দিয়ে শেষ দফার ত্রুটিগুলো সারিয়ে ফেলার পরে ওর হঠাৎ খেয়াল হলো যে দু দপ্তাহের ওপরে ও নিজের ছেলের সাথে দেখা করে নি।

সমাধিক্ষেত্র ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে শিন ছি কখনো কোনো গরজ দেখায় নি মিন হুয়ের সাথে যোগাযোগ করার, মিন হুয়েও কোনো গরজ দেখায় নি ও সাথে যোগাযগ করার। এই পুরো সময়টাতে ও শিন ছির অ্যাপার্টেমেন্টে নিয়মিত গেছে ছেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য। ও গেছে নির্দিষ্ট সময়ে, বেরিয়ে এসেছে নির্দিষ্ট সময়ে, কখনো দেরি করে নি, ঢিলে দেয় নি সময়ানুবর্তিতায়। যে ওকে অভ্যর্থনা করেছে সে হয় ন্যানি নয়তো ইয়ুন লু। শিন ছি নিজে কখনো সামনে আসে নি। ইয়ুন লুও কথা বার্তায় খুব অস্পষ্ট, বলতে থাকে যে কাজ নিয়ে আজকাল খুব ব্যস্ত শিন ছি, কিন্তু যতোই ব্যস্ত থাকুক না কেনো, ও প্রত্যেক দিন খানিকটা সময় কাটায় নিজের ছেলের সঙ্গে এবং বাবা আর ছেলের একসঙ্গে কাটানো “ভালো সময়”-টা কখনোই তিন ঘন্টার কম নয়। অনেক সময় ও কিছুতেই কাজ ছেড়ে বেরোতে পারে না, তাই ও ছেলেকে, ন্যানিকে আর ইয়ুন লুকে সঙ্গে করে নিয়েই যায় ব্যবসার কাজে বাইরে গেলে।

ব্যাপারটা নিয়ে খুব গভীর কিছু ভাবে নি মিন হুয়ে। ও জানতো যে শিন ছির ওপরে ভরসা করা যায়, যতোক্ষণ ও শিন ছির দায়িত্বে রাখছে ছেলেকে, ততোক্ষণ ও ছেলের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করবে না। 

ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যে ও নিজেও দু সপ্তাহ খুব ব্যস্ত ছিলো আর শিন ছিও ব্যবসার কাজে প্রায়ই অন্যত্র ছিলো আগের দুটো সপ্তাহ। সু ছন ওর সঙ্গেই ছিলো, তাই মা আর ছেলের দেখা হয় নি একদম।

এর মধ্যেই সু ছন শিখে গেছে ওর বাবার মোবাইল ফোন দিয়ে কী করে ছবি তুলতে হয়। এমন কী ওদের তিনজনের ভাগের অ্যালবামে ছবি আপলোডও করে ফেলে। 

মিন হুয়ে প্রায়ই দেখতে পায় ছবির প্রেক্ষাপটে হয় ডিসনি না হলে মিউজিয়াম, অথবা চিড়িয়াখানা কিংবা সি ওয়ার্ল্ড। বাবা আর ছেলে দারুণ সময় কাটাচ্ছে।




মেয়েরা কী সত্যিই আবেগপ্রবণ জীব? মিন হুয়ের খুবই সন্দেহ হতে থাকে যে ও মোটেই সেই মেয়েগুলোর মতো নয় যাদের কথা আবেগমথিত গল্পে উপন্যাসে লেখা হয়। যতোই হোক ও মা, ও সারাক্ষণ ওর বাচ্চার কথাই ভাববে, সেটাই স্বাভাবিক।

হতে পারে যে অনেক দিন ধরে ও একাই ছেলের দায়িত্ব সামলেছে বলে, অথবা অনেকগুলো জিনিস নিয়ে সারা দিন ব্যস্ত থাকে তাই, ছেলের জন্য তেমন করে মন কেমন ওর করে না। অবশেষে ওর হাতে এখন অনেকটা সময়, আর ওর জীবন অসাধারণ রকমের সহজ। যতোক্ষণ ও কাজের মধ্যে নেই, ততোক্ষণ ওর শরীর আর মন জুড়ে থাকে একটা সর্বগ্রাসী শূণ্যতা। কাজের পরে হয় ও য়িন শুয়ের কাছে সান্ডা শিখতে যায়, নয়তো সহকর্মীদের সঙ্গে খেতে যায়, অথবা সাও মুয়ের সঙ্গে তাস খেলতে খেলতে গল্পগুজব করে কাটায়। এক কথায়, ও যতোক্ষণ খুশি খেলতে পারে, যখন খুশি তখন বাড়ি ফিরতে পারে, এমন কি সারা রাত খেলতে পারে।

যখন ঝৌ রু জি শুনলো যে মিন হুয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চায়, তখন পর পর দুজন অল্প বয়সী ডাক্তারের সঙ্গে মিন হুয়ের আলাপ করিয়ে দিলো। ঝৌ রু জি ভালোই জানে মিন হুয়েকে, “আমি তোমার পছন্দটা জানি। এরা দু জনেই ডাক্তার, জার্মানিতে পড়াশোনা করেছে। নিজেদের কাজে দক্ষ, সুরসিক, আর দু জনেই খুব ভালো পরিবারের ছেলে। ওরা দু জনে কম্পিউটারে গেমস্‌ খেলতে ভালো বাসে।”

দু জনের সঙ্গে একসঙ্গে দেখা করলে অশ্রদ্ধা দেখানো হবে। তাই মিন হুয়ে ওদের প্রত্যেকের সঙ্গে দেখা করলো, দু জনের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে দেখা করলো বারে। দু জনের সম্পর্কেই ওর ধারণাটা ভালোই হচ্ছিলো। কিন্তু যেই বাচ্চার কথা এলো তখনই দু জনে একমত, দ্বিতীয় বিয়েতে ওদের আপত্তি নেই, কিন্তু ওদের ইচ্ছে যে বাচ্চা ভবিষ্যতে বাবার সঙ্গেই থাকবে। 

উহ্‌ - না।

এই ঘটনার পরে পরেই মিন হুয়ে পুরো ব্যাপারটা সাও মুকে বললো। সাও মু টেবিলে চাপড় দিয়ে বললো, “আগে বলবে তো। আমার তো একজন তৈরিই আছে! আমার দিদি, পদবী লু। আগে পড়াতো হুয়াছিং ইউনিভার্সিটিতে, পরে সমুদ্রে চলে গিয়ে ছিলো, ঘর সংসারও করেছে। এখন প্রযুক্তি ব্যবসায় আছে, এআই নিয়ে কাজ করে, স্বয়ংচালিত গাড়ির সফ্‌টওয়্যার নিয়ে কাজ করে। ব্যবসাটা বেশ ভালোই চলছে। তোমার মতোই ও একবার বিয়ে করে ভেঙে ফেলেছে, কিন্তু বাচ্চা নেই কোনো। ওর বয়স একটু বেশি, তবে বেশ আমুদে। আমি যদি য়িন শুতে মজে না যেতাম, তাহলে আমি ওকেই বিয়ে করতাম।”

“সুদর্শন?” মিন হুয়ে জানতে চাইলো, মিন হুয়ের নিয়ন্ত্রণ ভীষণ কড়া।

“ওকে যদি দেখতে সুন্দর না হোতো, তা হলে আমি কী উৎসাহ দেখাতাম? অবশ্যই সুদর্শন, তবে যারা খেলাধূলো করে তাদের মতো চেহারা নয়, ওকে দেখতে সুন্দর … এক ঝলক দেখলেই টের পাওয়া যায় যে ও খুবই বুদ্ধিমান আর অনেক কিছু জানে।”

মিন হুয়ে একটু ক্ষণ ভাবলো, তারপর ঘাড় নেড়ে বললো, “ঠিক আছে। তুমি কথা বলো। জিজ্ঞেস করে নিও যদি ও কিছু মনে করে যে আমার একটা ছেলে আছে যে পরে হয়তো ওর সঙ্গে থাকতেও পারে।”

“আমার মনে হয় না ও কিছু মনে করবে। কিন্তু একটু সাবধানে এগোনোই ভালো, জিজ্ঞেস অরে নেবো।”

অপর পক্ষ খুব চটপট উত্তর দিলেন যে তিনি কিচ্ছু মনে করবেন না।

তখন দু জনে ঠিক করলো যে সাশিমি খেতে যাবে। সেই সময়েই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে নেবে। লু জঁ নিজের চেহারা সম্পর্কে বেশ গর্বিত, তবে সেটা তিনি কথায় কথায় প্রকাশ করেন না। উনি মিন হুয়ের গবেষণার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেখালেন। দু জনে অনলাইন চ্যাটে খুব সুন্দর সময় কাটালো। হুয়াছিং ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন মানে নিশ্চয়ই খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। ওর মেজাজও খুব সুস্থির। উনি খুব মন দিয়ে মিন হুয়ের সমস্ত কথা শোনেন। এবং মাঝে মাঝে সহমত হয়ে ঘাড়ও নাড়েন। আত্মকেন্দ্রিক নন একেবারেই।

রাতের খাওয়া সেরে লু জঁ প্রস্তাব দিলেন কেক খাওয়ার। কাছাকাছিই একটা একটা বিখ্যাত কেকের দোকান আছে। ওঁর ইচ্ছে সেখানে দু জনে মিলে যাওয়ার। মিন হুয়ে জানালো যে ও ক্লান্ত আর বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিতে চায়। কিন্তু মিন হুয়ে আর ওঁর সাথে আবার যোগাযোগ করার জন্য কোনো মাধ্যমের কথা তুললো না।

সবাই বোঝে যে এটা নরম করে জানানো যে সে আর থাকতে চায় না। লু জঁ একটু অবাকই হলেন, স্বাভাবিক ভাবেই ছলনাটা বুঝলেনও। তখনো পর্যন্ত যে কথাবার্তা হয়েছে সে দিকে তাকিয়ে উনি বুঝতে পারলেন না যে উনি ভুলটা কী বলেছেন। তাই উনি সঙ্গে সঙ্গে জানালেন যে উনি কেক খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আর জোর করবেন না। কিন্তু খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “ঠিক আছে। সত্যি বলতে কী, তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়ে ছিলো যে তুমি আমার আগে থেকে চেনা মুখ।”

“হ্যাঁ, তাই তো। আগে কোথাও কী তোমার সাথে আমার দেখা হয়ে ছিলো, পরিচয় হয়ে ছিলো কোনো ভাবে?”

“না, না।”

“বেশ, ভারি আপশোসের কথা।”

বেশ ভদ্রতা করেই উনি মিন হুয়ের সঙ্গে করমর্দন করলেন, “কিন্তু তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে বেশ ভালো লাগলো।”

“আমারও।”

করমর্দন হয়ে গেলে পরস্পরকে বিদায় জানালেন। মিন হুয়ে জানালো যে ও কাছে পিঠে একটু পায়চারি করে দেখতে চায়, তাই লু জঁ নিরুপায় হয়ে একাই গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন।

ও এক পা এগোনোর আগেই ফোন ডিং করে উঠলো, ঝৌ রু জির টেক্সট মেসেজ, “তুমি কী জিঁ হু স্ট্রিটে?”

ওর তখন মনে পড়ে গেলো ও যখন ঝৌ রু জির সঙ্গে থাকতো, তখন ওরা একে অপরের অবস্থান জানতে পারতো ফোনে, তারপরে ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কিন্তু ফোনের এই ফিচারটা বাতিল করা হয় নি। কারণ সু ছন থেকে থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়তো। হাসপাতালে ভর্তি করা অসুবিধেজনক ছিলো, প্রায়ই ও ঝৌ রু জির কাছে নিয়ে যেতো সু ছনকে হাসপাতালে ভর্তির নিয়ম এড়িয়ে। তাই ঝৌ রু জি কোথায় আছে সেটা জানতে লাগতো ওর।

“হ্যাঁ।”

“সাও মু বললো যে তুমি ব্লাইন্ড ডেটে গেছো একটা? কী খবর? দেখার মতো কিছু?”

“না, তেমন কিছু না। ওটা সবে শেষ করে বেরিয়েছি।”

“উৎসাহ হারিও না। দেখতে থাকো।”

ঝৌ রু জি বললো, “আমি কাছাকাছি আছি। একটা সিনেমা দেখতে যাবো। সঙ্গে যাবার কেউ নেই। যাবে এক সাথে?”

“ঠিক আছে।”

ঝি ঝু মারা যাবার পরে, যদিও ঝৌ রু জি ভেঙে পড়ে নি, কিন্তু ও মনমরা হয়ে ছিলো। একই সময়ে মিন হুয়েরও মন খারাপ ছিলো সু তিয়াঁর মৃত্যু নিয়ে আর শিন ছির রাগ নিয়ে। দু জন হতভাগ্য লোক একে অপরকে সঙ্গ দিতো, উষ্ণতা দিতো, প্রায়ই একসাথে ফ্রায়েড চিকেন কিংবা ফ্রায়েড স্কিউয়ার খেতো। দু জনের একটাই শখ মেলে, সেটা হলো সিনেমা দেখা। তাই মাঝে মধ্যে দু জনে একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যায়।

ছবিটা কার্টুন হলে মিন হুয়ে সঙ্গে নেয় সু ছনকে। যেনো ফিরে এসেছে আগেকার সেই তিন জনের পারিবারিক জীবন।

কিন্তু মিন হুয়ে জানে যে ফিরে যাওয়া যাবে না।

সু তিয়াঁ আছে মিন হুয়ে আর শিন ছির মাঝে। একটা বেগুনী পুঁতিও আছে ঝৌ রু জি আর মিন হুয়ের মধ্যে। দু জন পুরুষই মিন হুয়ের আর সু ছনে সঙ্গে ভীষণ ভালো ব্যবহার করে। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে মিন হুয়ে কারুর জীবনেই প্রথম নয় …

ঝৌ রু জির সঙ্গে গেলে, মিন হুয়ের জীবন এক ঘেয়ে লাগে, জীবনটা একই রকম রয়ে যায়।

শিন ছির সঙ্গ নিলে, জীবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, জীবনে ভীষণ পরিবর্তন আসে।

ছবিটা সাম্প্রতিকতম হলিউড হরর ঘরানার। কোনো নামী অভিনেতা নেই। চিত্রনাট্য টান টান। পুরো ছবিতে বাইরে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। ছবিটা যখন শেষ হলো তখন রাত দশটা বেজে গেছে। ঝৌ রু জি নিজেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এলো মিন হুয়েকে মিংসেন কমিউনিটিতে, কাছের একটা দোকানে ঝাল মশলা দেওয়া ঝোল খাবার পরে।

গাড়ির থেকে নেমে মিন হুয়ে হেঁটে গেলো গেটে। মোবাইল ফোনটা বার করলো। দেখতে পেলো একটা মিস্‌ড কল। কলটা শিন ছির, মিন হুয়ে জবাবী ফোন করলো তড়িঘড়ি।

“হাই, শিন ছি,” ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গীতে বললো, “আমি একটা মুভি দেখতে গিয়ে ছিলাম একটু আগে, তাই ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখা ছিলো।”

“হম্‌ম্‌,” উল্টোদিকের গলার স্বরে আলস্য।

“কিছু দরকার আছে?”

“তোর ছেলে তোকে দেখতে চায়।”

“ওহ্‌? এখন? তোরা বাড়িতে আছিস? তাহলে আমি এখনই আসছি।”

ও ভাবছিলো ওরা হয়তো এখনো শিন ছির ব্যবসার কাজে বাইরে আছে।

“আমি ওকে এখানে নিয়ে এসেছি তোর খোঁজে। কিন্তু তুই অনেক ক্ষণ কল ব্যাক করিস নি। ও গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।" বললো শিন ছি।

রাস্তার বাঁদিক ধরে অনেক গাড়ি পার্ক করে রাখা আছে। তার মধ্যে একটাতে আলোর ঝলকানি দেখা গেলো। ও হেঁটে গেলো আর দেখতে পেলো শিন ছি গাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসছে সু ছনকে দু হাতে জাপটে ধরে। 

ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও যেনো এই মাত্র একটা ব্যবসায়িক বোঝাপড়া সেরে ফিরে এলো। পরনে স্যুট আর চামড়ার জুতো। মাথার চুলও ঘেঁটে নেই।

সু ছন, শিন ছির হাতের বাঁধনে, পরণে শুধু ভালুক ছাপ পাজামা, খালি পা, কম্বলে জড়ানো, শিন ছির হাত ধরে আছে শক্ত করে একহাত দিয়ে। অন্য হাত জড়ানো শিন ছির গলায়। 

“আমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে দে।” মিন হুয়ে ছেলেকে নিয়ে নিলো, নিজের দু হাতে জড়িয়ে, না বলে পারলো, “খুব ভারি হয়ে গেছে, আমি আর কোলেই নিতে পারবো না।”

“আমাকে দে।”

শিন ছি আবার নিয়ে নিলো।

বাচ্চাটা ঘুরপাক খেলো ওদের দু জনের হাতে হাতে। অতো নড়াচড়াতেও ওর ঘুম ভেঙে গেলো না, শিন ছির কোলেই গভীর ঘুমে তলিয়ে রইলো।

দু জনে হাঁটতে হাঁটতে যখন রাস্তার আলোর নিচে এলো, তখন মিন হুয়ে ছেলের মুখটা হাত দিয়ে ছুঁলো, বললো, “তোরা তো কদিন আগেই ব্যবসার কাজে বাইরে গিয়ে ছিলি না? আমি তো কালই দেখেছি যে তোরা সাংহাইতে আছিস …”

“আজই দুপুরে ফিরেছি।”

“আমার কাছে রেখে যা। আমি খেয়াল রাখতে পারবো।”

“আমি যতোই কাজের মধ্যে থাকি না কেনো, বাচ্চার জন্য সব সময় আমার সময় থাকে।”

ও কথাটা বললো, চোখ কুঁচকে মিন হুয়েকে দেখতে দেখতে।

আজকের ব্লাইন্ড ডেটের কারণে মিন হুয়ে খুব যত্ন করে সেজেছে। একটা সাদা রঙের উলের কোট পরেছে ওপরে, আর তার ভেতরে পরেছে ম্যাগনোলিয়া লেস দেওয়া জামা, যেটা শিন ছি ওকে দিয়ে ছিলো।

আবহাওয়া খুবই ঠান্ডা। কোটটা ভালো করে ঢাকা দেওয়া, কিন্তু ও সবে মালাটাং খেয়ে এসেছে, ওর খুব গরম লাগছিলো তাই ও বেল্টটা আলগা করে দিয়েছে।

“কী অনুষ্ঠান ছিলো? এতো গুছিয়ে জামাকাপড় পরেছিস, সেজেছিস?" জানতে চাইলো শিন ছি।

“ব্লাইন্ড ডেট।”

সামান্য ভ্রূ কোঁচকালো, “তোকে যে জামাটা আমি দিয়েছি সেটাই পরে যেতে হবে ব্লাইন্ড ডেটে?”

মিন হুয়ে অবাক হলো, “পরা সম্ভব নয়?”

শিন ছি খুব গম্ভীরভাবে দেখলো মিন হুয়েকে, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ালো, “না। এক্কেবারেই না।”

দমকা ঠান্ডা হাওয়া দিল একটু। অসচেতনভাবে মিন হুয়ে কোটটা জড়িয়ে নিলো, বেল্টটা বেঁধে ফেললো বিশেষ কিছু না ভেবেই, “আচ্ছা, পরের বার মনে রাখবো।”

“লোকটা কেমন?” আবার প্রশ্ন করলো শিন ছি।

“কোন লোকটা?”

“যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ছিলি।”

“ওহ্‌, কিছুই বুঝলাম না। সাও মু যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে ছিলো। যখন দেখা করলাম, তখন মনে পড়ে গেলো যে লোকটা আমার আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ক্লাসে প্রথম বছরে অঙ্কের মাস্টার ছিলো। আমাদের লিনিয়ার অ্যালজেবরা পড়িয়ে ছিলো।”

“এটা বেশ ভালো না?”

শিন ছি খুশি খুশি মুখে তাকালো মিন হুয়ের দিকে, “দু জনেই ভালো ছাত্র।”

“ঐ ক্লাসে লোকটা আমাকে ভীষণ কম নম্বর দিয়ে ছিলো। আর সে কথাটা আমি এখনো ভুলতে পারি নি।”

“কতো কম দিয়ে ছিলো?”

“ঊননব্বই।”

“সেটা কী কম বলে ধরা হয়?”

“আমি ক্লাসের সব পরীক্ষায় পুরো নম্বর পেয়েছি। ওর ক্লাসে অ্যালার্জির ওষুধ খেয়ে গিয়ে ছিলাম একবার, দূর্ঘটনাবশত ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম, নাক ডাকিয়ে, ও বলে ছিলো আমি নাকি ইচ্ছে করে ওর প্রতি অভক্তি দেখিয়েছি।”

মিন হুয়েকে দেখতে দেখতে না হেসে পারলো না শিন ছি, “তুই এখন আর লোকটাকে ঘেন্না করিস না, নাকি করিস?”

“যদি কোনো ক্ষোভ নাও থাকে, ওকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবো না। আমি সহ্য করতে পারি না।”

“কিন্তু সহ্য না করলেও মুভি তো দেখতে যাওয়া যায় ওর সাথে?”

“আমি তো ঝৌ রু জির সঙ্গে মুভি দেখতে গিয়ে ছিলাম।”

এক মূহুর্তের জন্য চমকে উঠলো শিন ছি। সেটা ওর নিজের বুঝতেও খানিকটা সময় লাগলো, “তাহলে তুই আর ঝৌ রু জিও আবার মেলামেশা করছিস?”

“ওর সঙ্গে যাই হোক, সেটা ধরা যাবে না। ওর আজকাল মনমেজাজ ভালো নেই। এ রকম মেলামেশায় ওর কোনো উৎসাহও নেই।”

“যদি ও উৎসাহ দেখায়, তবে কি তুই ওর সাথে যাবি?”

“হ্যাঁ। ভাবতে পারিস তাই।”

খুব গম্ভীর হয়ে মিন হুয়ে বললো, “ঝৌ রু জি ভীষণ ভালো মানুষ। সু ছনের প্রতিও খুব ভালো আচরণ করে। ভবিষ্যতে, আমরা তিনজনে …”

“মিন হুয়ে, চুপ কর এবার!”

শিন ছি রেগে গেলো হঠাৎ, “তোরা দুজন … তিন জনের আবার কী হলো?”

“আমরা চার বছর এক সঙ্গে ছিলাম, কোনো তর্ক হয় নি। এখন যখন ঝি ঝু মারাই গেছে, আমার মনে হয় আমাদের আশা আছে আবার একসাথে থাকার।”

শিন ছি ওপরে আকাশের দিকে তাকালো, এবং বেশ খানিকক্ষণ পরে বিদ্রুপের সুরে বললো, “মিন হুয়ে, তুই যদি আমার ছেলের জন্য সৎবাবা খুঁজবি তো, তাতে আগে আমার সম্মতি থাকতে হবে।”

“কেনো শিন ছি? কেনো আমি তোর কথা শুনতে যাবো?”

“যাই হোক, ঝৌ রু জি চলবে না। ও তোদের মা-ছেলেকে ফেলে দিয়ে চলে গিয়ে ছিলো।”

“মোটেই তা নয়। ডিভোর্সের উদ্যোগ তো আমি নিয়ে ছিলাম —”

“সেটাই ঠিক নয়। ভালো ঘোড়া কখনো পিছনে ফেরে না।”

মিন হুয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, “এরকম হলে কেমন হয়, তুই আমার জন্য কাউকে খুঁজে নিয়ে আয়, তোর পছন্দ হলেই, আমি রাজি হয়ে যাবো?”

শিন ছি চোখের চাহনিতে ভস্ম করে দিতে চাইছে মিন হুয়েকে, আবার রেগে উঠেছে, “কবে তুই মানুষ হবি? আমার পছন্দে কী যায় আসে? ব্যাপারটা এরকম হওয়া উচিৎ যে তুই নিজে বুঝতে পারবি কাকে বিয়ে করা যায় আর কাকে যায় না।”

“আমি তোর বিচারে বিশ্বাস করি।”

“...”

“শিন ছি, আমি তোকে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের ভার দিলাম, খুব যত্ন করে কাজটা করবি, চেষ্টা কর বছর শেষ হওয়ার আগেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে, যাতে বসন্ত উৎসবের সময়ে আমি সার্টিফিকেট বার করে ফেলতে পারি। আমি সু ছনকে একটা মেইমেই দেবো।”

“...”

“তোর কী আর কিছু বলার আছে?”

ও ঘড়ির দিকে তাকালো, “আমাকে এবারে যেতে হবে।”

শিন ছি দুম করে প্রসঙ্গ বদলালো, “তুই কী চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারবি?”

“কেনো?”

“আমার ভয় যে চেং ছিরাং আবার তোর ওপরে হামলা করবে, কোনো ঝামেলায় ফেলবে তোকে।”

“ও এখন ব্যস্ত আছে। আমার সাথে কথা বলার সময় নেই ওর। নি ফাংসি, আমার কিচ্ছু হবে না।”

ঠোঁটটা কুঁচকে গোল করে শিন ছির পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বললো, “তাছাড়া জিয়া জুন আর অন্যরাও ঝামেলা পাকাচ্ছে। খবরের কাগজের লোকেরা যখন তদন্তে নেমেছে, তখন একটা ব্লকবাস্টার আর্টিক্ল ধেয়ে আসছে ওর দিকে। আর ওর জীবনে ভালো কিছুই হবে না।”

শিন ছি চুপ করে তাকিয়ে রইলো মিন হুয়ের দিকে, নরম সুরে বললো, “মিন হুয়ে, কাল কাজটা ছেড়ে দে, কথাটা শোন।”

মিন হুয়ে জোরে মাথা নাড়লো, “না।”

ও দীর্ঘশ্বাস ফেললো, ঘুরে দাঁড়ালো, নিঃশব্দে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।

******

মিন হুয়ে পরের দিন যথা সময়ে কাজে গেলো, যেমন রোজ নিজের অফিসে ঘাঁটি গেড়ে বসে প্রোগ্রাম লেখে, তেমনই লিখতে লাগলো।

যখন দুপুরে খাবার সময় হলো, তখন সাও মু ওকে টানতে টানতে নিয়ে এলো নিচের তলার স্ন্যাক্স বারে, ভিয়েতনামী নুডল্‌ খাবার জন্য আর নিচু গলায় বললো, “সারা সকাল কী করছিলে তুমি? এই ব্যাপারটা কী?”

“প্রোগ্রাম লিখছিলাম।”

মিন হুয়ে বাটির গরম খাবার ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করছিলো। লেবুর রসটা চিপে নিলো নুডল্‌-এর ঝোলে, “তাছাড়া আর কী করতে পারি?”

“আজকের ফিনান্সিয়াল হেডলাইন্‌স দেখেছো? - বিবিজি ব্র্যান্ড - গুয়ান ছাও ইন্টারন্যাশনাল।”




~~~~~~~~~~~~

সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96

Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-67.html

Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/10/jpda-chapter-69.html

No comments:

Post a Comment

Readers Loved