২৫. সু ছনের চোখের জল
“তার মানে ঝি ঝু এখনো হাসপাতালে? কে দেখাশোনা করছে?” জানতে চাইলো মিন হুয়ে।
“ওর অপরেসন হয়ে গেছে। এরপর রেডিওথেরাপি হবে। কেমোথেরাপি হবে।”
পালং-এর ঝোলে একটা চুমুক দিয়ে বললো ঝৌ রু জি, “ওর মা-বাবা থাকেন শিনজিয়াং-এ। আমার সাহস হয় নি ওঁদেরকে জানানোর। হাসপাতালেই সব ব্যবস্থা আছে, আলাদা কোনো যত্ন তো লাগবে না। তাছাড়া, ও আছেও আমাদের হাসপাতালে। ওয়ার্ডের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার। ওর যদি কিছু খেতে ইচ্ছে করে বা কোনো জিনিসের দরকার পরে সে তো আমি তক্ষুণি আনিয়ে দিতে পারবো ওর জন্য।”
বিনচেং - শিনজিয়াং |
“অ্যাই, এখন তো প্লাস্টিক সার্জারি খুব উন্নত হয়েছে। তাহলে স্তন বানিয়ে দেওয়া যাবে না? সিলিকোন বা ওরকম কিছু দিয়ে।”
যাই হোক, মিন হুয়ে অনেক বছর ধরে ব্রেস্ট ক্যানসার শনাক্ত করার নানান পদ্ধতি সম্পর্কে পড়াশোনা করেছে। ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়ার পরে কী কী করা যায় সেটা ওর অল্পস্বল্প জানা আছে।
“হ্যাঁ, আমি তো করবও ভাবছিলাম।” মাথা নেড়ে বললো ঝৌ রু জি, “কিন্তু ওর তো রক্ত জমাট বাধার অসুখ আছে। তাই ওর এসব চলবে না।”
“এতে কী নাচের ওপর প্রভাব পড়বে?”
“না” বললো ঝৌ রু জি, “স্তন বড়ো হলে নাচতে অসুবিধে হয়। তাছাড়া, সৌন্দর্যের ওপর স্তন না থাকার কোনো প্রভাব নেই। ইন্টারন্যাশন্যাল সুপারমডেলদের কথাই ধরো না, তারা তো অধিকাংশই স্তনহীন প্রায়। স্তন পেশা বিশেষে বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়।”
“তাও বটে।”
যদিও মিন হুয়ে বললো কথাটা, কিন্তু ও তো জানে যে ফিরে ব্রেস্ট ক্যানসার হবার সম্ভাবনা কী প্রচন্ড বেশি, এমনকি দুটো স্তন বাদ দিয়ে দেবার পরেও। তার পরেও জীবন বাঁচানো যায় না। মিন হুয়ে চেষ্টা করেও মন খারাপ হয়ে যাওয়া আটকাতে পারলো না।
পরদিন মিন হুয়ে এক ক্যান ভর্তি করে হালকা বার্লি বানাল, কুঁচো চিংড়ি দিয়ে। সঙ্গে নিলো ছাঁচি কুমড়োর ঝোল। ঝৌ রু জিকে বললো ইয়াও ঝি ঝুয়ের জন্য খাবারগুলো নিয়ে যেতে।
সন্ধেবেলা ঝৌ রু জি ক্যান ফেরত নিয়ে এলো যেমনকে তেমন। বললো যে ঝি ঝুয়ের মেজাজ খুব খারাপ ছিলো, খায় নি কিছুই, কারুর সাথে কথাও বলে নি, শুধু কান্নাকাটি করেছে সারাদিন।
“ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছো?”
মিন হুয়ের আর কোনো উপায় ছিলো না, ছাঁচি কুমড়োর ঝোলটাকে আরেকবার গরম করে সবাইকে একবাটি করে দিলো।
“তুমি ওকে ভোলানোর চেষ্টা করো নি কেনো? তুমি শুধু শুকনো কথা বলো।”
ঝৌ রু জি একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললো, “এটা তো আসলে শিয়া য়ি হ্যাং-এর কাজ। আর এ ছোকরা জানেও না নিজে যে ও কোথায় গায়েব হয়ে গেছে। প্রথম কয়েক দিনে ঝি ঝু রোজ জানতে চাইতো যে একবারও য়ি হ্যাং এসেছে কিনা। খুব রেগে ছিলো। কয়েকবার জিজ্ঞেস করে ছিলো কিন্তু কেউই দেখে নি য়ি হ্যাং-কে, তারপর জিজ্ঞেস করা বন্ধ করে দিয়ে ছিলো। ওর নাচের দলের লোকেরাও খারাপ নয়। ওঁরা সব সময় কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে দেন ঝি ঝুকে সঙ্গ দেবার জন্য।”
“তোমারও উচিৎ ওর খেয়াল রাখা। যাই হোক, তোমরা স্বামী-স্ত্রী।” মিন হুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
“হ্যাঁ” ঝৌ রু জি বাটির ঝোলটা খেয়ে নিলো, “ছাঁচি কুমড়োর ঝোলটা খেতে বেশ। ছন ছন, ভালো লেগেছে?”
খেতে খেতে হাসলো সু ছন, “বেশ খেতে। আমি আরেকটু চাই এটা, বাবা।”
“ইয়ো, ও কথাটা বলো না। বাবা এক ঢোকে সবটা খেয়ে ফেলেছে। এটা ভালোই। মা বরং তোমাকে আরেক বাটি বানিয়ে দিক।”
মিন হুয়ে ঝোলটার রেসিপি ইন্টারনেট থেকে দেখে নিয়ে বানিয়ে ছিলো, একবারের জন্য। মিন হুয়ে নিজের ফোনটা খুলে রেসিপিটা আরেকবার দেখে নিলো, “আমি তো মনেও রাখি নি।”
“আমাকে বানাতে দাও।” ঝৌ রু জি উঠে পড়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।
মিন হুয়ে রাঁধতে জানে না। কলেজে পড়ার সময়ে রোজ রোজ ক্যাফেটেরিয়ায় খেতো। কাজ করার সময় নিচের তলায় গিয়ে খাবার অর্ডার করতো বা খাবার কিনে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে খেতো। ও মাসে একবারও রাঁধে নি কখনো। ওর মা-বাবা দুজনেই ভালো রাঁধতে জানতেন, বিশেষত মা।
যখন আত্মীয়-বন্ধুরা বিয়েবাড়িতে একত্র হতেন, আর বিয়েবাড়িতে খানাপিনার আয়োজন হতো, সেখানেই মিন হুয়ের মায়ের নেমতন্ন হতো রান্নার দলকে নেতৃত্ব দেবার জন্য। গ্রামের লোকেরা রেস্টুরেন্টে ব্যাঙ্কোয়ে দেওয়া পছন্দ করতো না মোটে। তাঁরা সাধারণত নিজেদের উঠোনে একটা তাঁবু খাটিয়ে একটা উনুন পেতে নিতো। মিন হুয়ের মা কয়েকজনকে ডেকে নিতেন হাতে হাতে জিনিসপত্র আনার কাজ আর রান্নার জোগাড় করে দেবার জন্য। একটা পুরো দিনে খুব খাটলে তিনি একডজনের বেশি টেবিল ভরা মানুষকে খাইয়ে খুশি করে দিতে পারতেন।
বিয়ের পরে ঝৌ রু জি বা মিন হুয়ে কচ্চিৎ কদাচিৎ রান্না করেছে। যদিও রেঁধেও থাকে তো ঝৌ রু জিই রান্নটা করেছে বেশির ভাগ সময়ে। কারণ তারই খাবার নিয়ে খুঁতখুঁতুনি বেশি। মিন হুয়ে বা সু ছনকে খাইয়ে তৃপ্ত করা খুব সহজ। ওরা দুজনেই যা পায় তাই খায়, এমন কি ওরা দুজনে ইন্সট্যান্ট নুডল্স পেলেও খুব আনন্দ করে খায়। মিন হুয়ে কেবল মাত্র তিনটে পদ ভালো করে বানাতে পারে - হালকা আঁচে ঝলসানো মুর্গির ডানা, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে শুয়োরের মাংসের কুঁচি, আর ঠান্ডা পালং শাক, যেনো চেং ইয়াও জিঁর তিনটে কৌশল, সব সময়ে ওগুলোই রান্না করে। ঝৌ রু জি অনেকটা খাবার পরেও নালিশ না করে পারে না, কিন্তু সু ছনের কিছুতেই তৃপ্তি হয় না যতোই খাক না কেনো।
কাকতালীয়ই হবে, সেদিনই মিন হুয়ে গিয়ে ছিলো বিনচেং ইউনিভার্সিটির হাসপাতালে যেহেতু বা’অ্যানের সঙ্গে ঐ হাসপাতালের অনেকগুলো প্রজেক্ট আছে, সেহেতু প্রজেক্টের ডেটা হাসপাতাল থেকে বা’অ্যানে পাঠানোর কোনো একটা কাজের জন্য। ঘটনাচক্রে ও অনকোলজি ডিপার্টমেন্টের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। ভেবে ছিলো যে ঝৌ রু জির সাথে একবার দেখা করবে।মায়ের মৃত্যুর পরে অনেক দিন অবধি মিন হুয়ে ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যেতো ‘অনকোলজি ডিপার্টমেন্ট’ শব্দজোড়া শুনলেই।
বিয়ে হয়ে ইস্তক, সু ছনের অসুস্থতার কারণে, বার বার হাসপাতালে গেলেও, মিন হুয়ে অনকোলজি ডিপার্টমেন্ট এড়িয়েই যেতো। সেদিনই ওর মনে হয়ে ছিলো ঝৌ রু জির সাথে দেখা করবে। যখন নার্সকে ও ঝৌ রু জিকে কোথায় পাবে জিজ্ঞেস করলো, তখন জুনিয়র নার্স জানালো, “ঝৌ ঝংজিয়ে আগে চলে যাবেন বলেছেন আজকে। ওঁর বাড়িতে নাকি কী অসুবিধে আছে। শু ইশঁ সব সার্জারি করবেন।”
অথচ যখন ঝৌ রু জি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলো তখন বলে যে ওর একটা অপেরেসন আছে সেদিন, ও রাত দশটা অবধি বাড়ি ফিরতে পারবে না।
মিন হুয়ে উত্তর দিলো, “আমি ওঁর স্ত্রী।”
“ওহ্” বলে মুখে হাত চাপা দিলো জুনিয়র নার্স।
“আমি এখানে এসেছি ইয়াও ঝি ঝু-কে দেখতে।” মিন হুয়ে বললো।
কৌতুহলের সঙ্গে জুনিয়র নার্স জানালো, “আমিই তো ডিসচার্জের কাজ করেছি।”
“উনি কী সেরে উঠছেন?”
“হ্যাঁ, ওঁর শরীরের অবস্থা খুব খারাপ নয় -” বলতে বলতে নার্স মাথার দিকে দেখালো আঙুল দিয়ে, “মনের ওপর চাপ খুব গুরুতর। উনি কিছুই খান না, এমনকি জলও না। চিকিৎসা করাতে চান না। চুপি চুপি হাতের কব্জি কেটে ফেলেন। ভাগ্য ভালো যে ঝৌ ঝংজিয়ে দেখে ফেলে ছিলেন। ঝৌ ঝংজিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় থাকতেন, প্রায়ই আসতেন ইয়াও ঝি ঝুকে একটু আরাম দেবার জন্য। ইয়াও ঝি ঝুয়ের মনের অবসাদ অনেকটাই কেটে গিয়ে ছিলো গত কয়েক মাসে। না হলে আমার তো সাহসই হতো না ওঁকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেবার।”
ইয়াও ঝি ঝু হলো ঝৌ রু জির প্রাক্তন স্ত্রী আর বিনচেং-এর এক বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। ডিপার্টমেন্টের সবাই জানে।
মিন হুয়ে আর কোনো প্রশ্ন করলো না। সোজা ফিরে গেলো কোম্পানিতে আরেকটা মিটিং-এর জন্য আর প্রোগ্রাম লেখার কাজে।
দুপুরের খাবার পরে মিন হুয়ে আর থাকতে পারলো না ঝৌ রু জিকে ফোন না করে, “কোথায় তুমি?”
ঝৌ রু জি হাঁপাচ্ছিলো কিন্তু গলার স্বরে মনে হলো না যে ও অবাক হয়েছে, “আমি ঝি ঝুয়ের এখানে।”
মিন হুয়ে বললো, “ওহ্" তারপর জানতে চাইলো, “কোনো সমস্যা আছে? গোলমাল হয়েছে কিছু?”
“না, তেমন কিছু না, একটু …”
একটু দ্বিধা করে বললো ঝৌ রু জি, “একটু আগে আমার সাথে শিয়া য়ি হ্যাং-এর ভয়ঙ্কর মারপিট হয়েছে।”
“ঝগড়া?” মিন হুয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলো, “হাতে লাগে নি তো তোমার? ঝৌ রু জি যুক্তি দিয়ে ভাবো, তোমাকে সার্জারি করতে হয়।”
“শিয়া য়ি হ্যাং-ও সার্জারি করে। আমি কী কাউকে ভয় পাই নাকি!”
মিন হুয়ের অস্বস্তি হলো খুব। ছুটি নিয়ে বেরিয়ে গেলো ইয়াও ঝি ঝুয়ের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে। দরজা খুলতেই দেখলো যে রক্ত লেগে আছে ঝৌ রু জির কপালে আর ঠোঁটের কোণে।
“রু জি!” মিন হুয়ে এতো ভয় পেয়ে ছিলো যে ও হাত দিয়ে ঝৌ রু জির মুখটা ছুঁয়ে দেখলো কতোটা লেগেছে, “এখানটা একটা হাঁ হয়ে আছে। তোমার কী সেলাই করতে লাগবে?”
“না না, এটা একটু মাংস কেটে গেছে মাত্র। ব্যান্ড-এইড লাগালেই হবে।”
“দ্যুইবুচি, মিন হুয়ে, সব আমার দোষ।”
ইয়াও ঝি ঝুয়ের চেহারা জুড়ে ক্ষমার প্রার্থনা জেগে উঠে ছিলো। সতর্ক হয়েই বলছিলো মিন হুয়েকে, “আমি ওদের বারণ করে ছিলাম, ওরা যেনো মারপিট না করে, চেষ্টাও করে ছিলাম ওদের ছাড়ানোর, কিন্তু দুজনের কেউই আমাকে পাত্তাই দিলো না, রু জির খুব লেগেছে। হাসপাতালেই যাচ্ছিলো ও, আমিই ওকে ছুটি নিতে বলেছি, ওর আঘাতের পরিচর্যা করার পরেই আমরা হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়েছি … এই মাত্রই বাড়ি এসে পৌঁছেছি।”
মাসের পর মাস ইয়াও ঝি ঝুকে দেখে নি মিন হুয়ে। তার ওপর ওর রোগ - সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো যে ওর শরীর যেনো এক সাইজ ছোটো হয়ে গেছে। ওর মলিন মুখে কোনো ঔজ্জ্বল্য নেই, আগে যে ত্বক থেকে গোলাপী আভা ঠিকরে বেরোতো সেটাও চলে গেছে। চোখগুলো বসে গেছে কোটরে, চিবুকের সমস্ত মাংস যেনো গলে গেছে, চামড়াটা যেনো টান করে হাড়ের ওপরে সাঁটা আছে আর খুলির রেখাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাথায় একটা নরম লাল টুপি পরে আছে ও, সম্ভবত কেমোথেরাপির কারণে মাথার থেকে খসে পড়া চুলের অবস্থাটা ঢাকার জন্যই।
“ঠিক আছে।” দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিন হুয়ে, “শিয়া য়ি হ্যাং গায়েব হয়ে গিয়ে ছিলো না কয়েক মাস আগে? আবার কী করতে তার উদয় হলো?”
“মিন হুয়ে, দরজায় দাঁড়িতে থেকো না। ভেতরে এসো, বসো।” মিন হুয়েকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিলো ঝি ঝু, “যখন আমি রোগে পড়লাম, ও তখন বলে ছিলো যে ও বিদেশে যাচ্ছে ওর বাবাকে গবেষণায় সাহায্য করার জন্য। ও ইউরোপে চলে গিয়ে ছিলো, ওখানেই ছিলো অনেকগুলো মাস, আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করে নি। পরে আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে ছিলো, আমিও রাজি হয়ে ছিলাম টেক্সট মেসেজেই সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে।”
ইয়াও ঝি ঝু গম্ভীর চোখে মিন হুয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “অপরেসনের সময় আমি খুব ভেঙে পড়ে ছিলাম মনে মনে। রু জিকে ধন্যবাদ … আর নাচের দলের সহকর্মীদেরও যাঁরা আমার যত্ন নিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ। তার ফলে আমি কাল ফিরেছি। আমি যখন অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলাম তখন একটা কাগজ পেলাম যার থেকে জানতে পারলাম যে অ্যাপার্টমেন্টটা বিক্রি হয়ে গেছে। আর আমাকে বলা হয়েছে এক মাসের মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে … আর আমি হতবাক হয়ে যাই।”
“তোমরা অ্যাপার্টমেন্টটা কেনো নি আগেই?” মিন হুয়ে ঘাবড়ে গেলো।
“শিয়া য়ি হ্যাং কেনার পয়সাটা দেয়। আমরা বিবাহিত নই। সেই জন্য সম্পত্তির কাগজে শুধু ওর নাম লেখা আছে।”
বাঁকা হাসি দেখা গেলো ঝি ঝুয়ের মুখে, “আসলে আমি তো ওর সাথে সম্পর্ক ভেঙেও ফেলেছি। আমি ওর অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেও চাই না। ব্যাপারটা হলো আমার অসুখের জন্য আমি হাসপাতালে ছিলাম আর অন্য একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে নিতে পারি নি। আমি ভেবে ছিলাম ও বোধ হয় আমাদের এতোদিনের সম্পর্কের কথা ভেবে আমাকে খানিক সময় দেবে। আমি আশা করি নি যে আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হবে। আমি বাড়িটা পরিষ্কার করে দিয়েছি গতকালই আমার জিনিসপত্র সব সরিয়ে নিয়ে। আর য়ি হ্যাং-কে আসতে বলে ছিলাম। যেহেতু আমরা অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, তাই আমি জানতে চাই ছিলাম যে ও কিভাবে জিনিসপত্র ভাগ করতে চায়। এখানে এখনো ওর নিজের অনেক জিনিস রয়ে গেছে, কিছু গয়নাগাটি, বাও, এরকম কিছু আরকি। তাই ওকে আমি বলে ছিলাম যে আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই। রু জি ভয় পাচ্ছিলো যে আমি হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়ব, হয়তো য়ি হ্যাং কিছু বললে আমার মাথা গরম হয়ে যাবে, তাই রু জি আমার সাথে এসে ছিলো। একেবারে কোথাও কিচ্ছু নেই, আমি কথা বলতেও শুরি করি নি য়ি হ্যাং-এর সাথে, রু জি মারপিট করতে লেগে গেলো য়ি হ্যাং-এর সাথে, আর আমি ওকে আটকাতে পারলাম না … মিন হুয়ে, এই পুরো ব্যাপারটায় আমি খুব ভালো কাজ করি নি, আমার রু জিকে এখানে নিয়ে আসাই উচিৎ হয় নি। তবে তুমি দুশ্চিন্তা কোরো না মোটেই, রু জির অন্য কোনো ইচ্ছে নেই, ও খুবই ভালো মানুষ, ও শুধু আমার হয়ে লড়াই করতে চায়।”
“না, আমি খুব বেশি কিছু ভাবছি না।” মিন হুয়ে নরম হয়ে বললো, “তুমি কী ক্লান্ত? তুমি কী খানিক ক্ষণ শুয়ে নেবে?”
“না। আমি অনেক ভালো আছি। আমি একটা বাসাও খুঁজছি। এখন আমার হাতে দুটো অ্যাপার্টমেন্ট আছে - দুটোই শহরের দক্ষিণে, এখান থেকে অনেক দূরে। আমি … শিগগির চলে যাবো।”
ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে ঝি ঝু হাঁপাতে হাঁপাতেই অনেক কথা বলে গেলো মিন হুয়ের হাত ধরে রেখে, উত্তেজনায় লাল হয়ে।
মিন হুয়ের নজরে পড়লো ঝি ঝুয়ের কব্জির ওপরে একটা গোল লাল দাগ। আস্তে আস্তে বোঝাতে লাগলো ঝি ঝুকে মিন হুয়ে, “ঠিক আছে। সব ঠিক আছে। তোমাকে অতো দূরে যেতে হবে না। তুমি যদি কাছাকাছি থাকো, তাহলে আমরাও আসতে পারবো, তোমার কিছু লাগলে সেটা দেখতে পারবো। যা হোক, এ জায়গাটা হাসপাতালের কাছেও বটে।”
ঝি ঝুয়ের চোখ লাল হয়ে উঠলো, “শিয়া শিয়া নিয়া, মিন হুয়ে।”
“ভুল -ভাল কিছু করবে না। এখনো তোমার মা-বাবা বেঁচে আছেন।”
“হ্যাঁ,” ঝি ঝুয়ের গলা বুজে এলো, “করবো না।”
সেই রাতে মিন হুয়ের ঘুম হয় নি, সারা রাত ঝৌ রু জিও বিছানায় ছটফট করেছে।
সকালের শুরুতেই জানলার বাইরে ভোরের আলো দেখে মিন হুয়ে নরম স্বরে জানতে চাইলো, “রু জি, তুমি এখনো ঝি ঝুকে ভালোবাসো, তাই না?”
ঝৌ রু জি উত্তর দিলো না।
“চলো ডিভোর্স করি।” বললো মিন হুয়ে।
"কেনো?” উঠে বসে পড়লো ঝৌ রু জি, “আমি তো শুধু ঝি ঝুয়ের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছি।”
“ও যে ভাবে তোমার দিকে তাকায় … তাতে আমার মনে হয়” অন্ধকারে মিন হুয়ে তাকালো ঝৌ রু জির দিকে, “আমি তোমাকে যথেষ্ট ভালোবাসি না।”
- যেমন, ঝি জু বেশ লেগে থাকতে পারে, ও যখন ঝৌ রু জিকে বেশিক্ষণ কাজ করতে দেখে তখনই ওর রাগ হয়, মিন হুয়ের কখনোই রাগ হয় না। মিন হুয়ের কখনো ঝৌ রু জিকে ভীষণ “দরকার” পরে নি। আর ঝৌ রু জির অস্তিত্ব তেমন স্পষ্ট নয়।
- যেমন মিন হুয়ে দাবা খেলতে পছন্দ করে, কিন্তু রু জির মনে হয় কেবল অবসরপ্রাপ্ত বুড়ো লোকেরা দাবা খেলতে পারে। রু জি অপেরা শুনতে পছন্দ করে, মিন হুয়ে যতোবার থিয়েটারে গেছে ঝৌ রু জির সাথে, প্রত্যেকবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
- যেমন ঝৌ রু জি একটা টেক্সট মেসেজ পাঠালে তাতে অন্তত তিনটে লাইন লেখা থাকে, কিন্তু মিন হুয়ের জবাবের দৈর্ঘ্য প্রায় সময়েই তিনটে শব্দের বেশি হয় না।
- যেমন প্রত্যেক তারা নিজের নিজের মাসমাইনে নিজেরা বুঝে নেয়, আর প্রত্যেক মাসের শুরুতে মাইনের একটা অংশ একটা ড্রয়ারে রাখে দুজনেরই লাগে এমন সব জিনিসের বা কাজের প্রয়োজনে খরচা করার জন্য। বড়ো খরচ দুজনে আলোচনা করে নেয়।
- যেমন দম্পতির দিনের মূল আলোচনার বিষয় হলো যে কিভাবে দিনটা কাটাবে যাতে কোনো ডেডলাইন পেরিয়ে না যায়। কিভাবে সময়ের অভাব আর পার্থক্যকে অতিক্রম করবে যখন দুজনেই ওভারটাইম কাজ করবে। পরের দিন কাজ থেকে ফেরার পথে বাচ্চাকে কে নিয়ে আসবে। কে রাতের খাবার বানাবে। বাচ্চা অসুস্থ হলে তার রোগশয্যার পাশে কে থাকবে/
সত্যি বলতে কোনো ভুল নেই। সারা পৃথিবীর সব দম্পতি এই বয়সে এরকম ব্যাপার নিয়েই মেতে থাকে। কিছু লোক কিছু না পেলেও সারা বছর ব্যস্ত থাকে, অন্তত তারা এই পর্যন্ত তাদের “কাজের ক্ষেত্রে সফল”।
***
মিন হুয়ের জোরাজুরিতে ঝৌ রু জি বিচ্ছেদে রাজি হয়ে গেলো। খুব তাড়াতাড়ি দুজনে মিটিয়ে নিলো কাগজের কাজ। আর মিন হুয়ে কিছুই চায় নি শুধু সু ছনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছাড়া। সে সু ছনকে একলা বড়ো করবে এটাই তার একমাত্র শর্ত। ঝৌ রু জি জোর করে ছিলো বাচ্চার জন্য খরচা দেবে বলে। এমনকি ও চেয়ে ছিলো হাসপাতালের কল্যাণ প্রকল্পে পাওয়া বাড়ির অর্ধেক মিন হুয়েকে দিতে তাদের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ সম্পত্তি হিসেবে। মিন হুয়ে স্থির করে নিয়ে ছিলো যে এই সম্পত্তি ও নেবে না। এই নিয়ে আলোচনা করে দুজনে অনেকটা সময় কাটিয়েছে, শেষে মিন হুয়ে বলে, “রু জি, ব্যাপারটা এতো স্পষ্ট করার কী আছে? তুমি আর আমি -আমরা কেউই কম মাইনে পাই না। আমাদের জীবনযাপণে কোনো অনটন নেই। সু ছন অসুস্থ, আর তুমি ডাক্তার। আমি অনেক সময়েই তোমার সাহায্য চেয়ে থাকি। যদি আমরা সব হিসেব নিক্তি মেপে মিটিয়ে ফেলি, তাহলে আমি ভবিষ্যতে তোমার থেকে সাহায্য নিতে আমার যে খুব লজ্জা করবে।’আবার করে বিয়ে করার পরে ঝি ঝু আর রু জি তিয়াঁরাঁ কমিউনিটিতে এসে থাকতে শুরু করে। মিন হুয়ে আর সু ছন থাকে আইভি গার্ডেনের অ্যাপার্টমেন্টেই। মিন হুয়ে আর রু জির প্রায়ই দেখা হয় কাজের সুবাদে, বাচ্চার অসুস্থতার কারণে আর বাচ্চার নানা ধরনের স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য।
কখনো মিন হুয়ে ওভার টাইম কাজ করে, বাচ্চাকে সময় মতো নিয়ে আসতে পারে না বাড়িতে। এই সময় রু জি সাহায্য করে মিন হুয়েকে, বাচ্চাকে সময় মতো বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে। মিন হুয়ে কোনো কাজে শহরের বাইরে গেলে সু ছনকে সে পাঠিয়ে দেয় হয় সাও মুয়ের বাড়ি না হলে ঝি ঝুয়ের বাড়িতে। দুজনেই খুব আনন্দের সঙ্গে মিন হুয়েকে সাহায্য করে ওর বাচ্চার দেখাশোনা করে।
মাঝে মাঝে একলা লাগে মিন হুয়ের। তা বাদে খুব তাড়াতাড়ি মিন হুয়ে মানিয়ে নেয় একক মায়ের জীবনের সাথে।
ঝৌ রু জি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পরে, খুব অখুশি হয়ে ছিলো সু ছন।
এটা মিন হুয়ে আশা করে নি, ওর কোনো মানসিক প্রস্তুতিও ছিলো না এই অবস্থাটার জন্য।
যখন সু ছন টের পেলো যে ঝৌ রু জি চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে, ও খুব চীৎকার করে কাঁদতো, উদ্ভট স্বরে চেঁচামেচি করতো আর রোজ বাবাকে দেখার জন্য বায়না করতো। মিন হুয়ে আশা করে নি যে সু ছনের এতো টান থাকবে ঝৌ রু জির প্রতি। যখনই ঝৌ রু জি দেখা করতে আসতো সু ছনের সাথে, তখনও ও এতো খুশি হতো যেনো কোনো উৎসব লেগেছে, জাপ্টে ধরতো রু জির উরু, কিছুতেই ছাড়তে চাইতো না, কিছুতেই যেতে দিতে চাইতো না রু জিকে। এমনকি রু জির সঙ্গে বাথরুমে অবধি যেতো যাতে এক মূহুর্তের জন্য রু জির কাছছাড়া না হয়।
রু জিকে নতুন নতুন কায়দা ঠাউরাতে হতো পালাবার জন্য।
দুজনের কারুরই মা কিংবা বাবা হবার অভিজ্ঞতা ছিলো না। দুজনেই হাক্লান্ত হয়ে থাকতো কাজ থেকে ফিরে আর বাচ্চার অসুখ নিয়ে।
সাধারণত সু ছন চুপচাপ বসে লেগো নিয়ে খেলতো। ও বলতেও পারতো না ওর কাছে কে আছে।
অপ্রত্যাশিতভাবে, ডিভোর্সে সব চেয়ে আহত হয়ে ছিলো বাচ্চা। মিন হুয়ের অনুতাপের শেষ ছিলো না। তার কেবলই মনে হয়েছে যে ঝৌ রু জি সু ছনের জনক নয়, আর কাজের দিনে ঝৌ রু জি অনেকটা সময় বাড়ির বাইরেই থাকে, সেই জন্য বাচ্চা আর বাবার মধ্যে নিশ্চয়ই খুব জোরালো সম্পর্ক হবে না। কিন্তু একটা কথা তার নজর এড়িয়ে গিয়ে ছিলো। জন্মের প্রথম দিন থেকে সু ছন ঝৌ রু জিকে পাশে পেয়েছে, আন্তরিক উৎসাহের সঙ্গে বাবার ভূমিকা পালন করেছে ঝৌ রু জি। পাউডার দুধ খাইয়ে, ডাইপার বদলে, কথা বলতে শিখিয়ে, খেলার সময় সঙ্গ দিয়ে, খেলতে নিয়ে গিয়ে … রু জি, মিন হুয়ের মতোই সি ছনের সব চেয়ে কাছের লোক।
“মা, তুমি আমার বাবাকে তাড়িয়ে দিলে কেনো?”
যদি ও ঝৌ রু জিকে একটানা এক সপ্তাহ দেখতে না পায় তো, সু ছন কেঁদে ভাসাবে, ঘুমোতে যাবে না কিছুতেই, “আমার বাবাকে চাই! আমি বাবার সঙ্গে ঘুমোব।”
মিন হুয়ের দিনে এক ঘন্টা যায় ওকে ভোলাতে। গল্প বলে, গান শুনিয়ে, মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে গিয়ে, তবে সু ছন ঘুমিয়ে পড়ে জল ভরা চোখে।
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-24.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-26.html