২৬. হিমেল চাঁদনিতে একটা দিন
শীতের মাসগুলো বিনচেং-এ তেমন ঠান্ডা নয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আছে যে হালকা তুষারপাত হতে পারে সোমবার। সকাল সকাল যখন মিন হুয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলো যে সত্যি মাটির ওপরে তুষারকুঁচির একটা হালকা আস্তরন। মিন হুয়ে অনেককিছু জানে, কিন্তু গাড়ি চালাতে জানে না। এমন নয় যে ও গাড়ি চালাতে পারবে না একবারেই। কিন্তু ওর সাহসে মোটেও কুলোয় না। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে গিয়ার বদল করে, স্টিয়ারিং ধরে, ক্লাচ, অ্যাক্সেলেটর বা শুধু অ্যাক্সিলেটর নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ি পার্কিং থেকে রাস্তায় নিয়ে চলে যেতে নিশ্চয়ই পারবে, কিন্তু দশ মিনিট পরেই অন্য মনস্ক হয়ে যাবে এটা সেটা ভাবতে ভাবতে, হয়তো লাল আলো পেরিয়ে যাবে বেখেয়ালে, বা কোনো পথচারীকে মারবে ধাক্কা। মিন হুয়ে ঠিক করে নিয়েছে যে এ জীবনে ও গাড়ি চালানো শিখবে না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে কবে ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি বাজারে আসবে। কোনো চটজলদি কাজ যদি এসে পড়ে, তাই মিন হুয়ে একটা ই-ডঙ্কি কিনে রেখেছে। ওটাতে করে সু ছনকে নিয়ে যাওয়া সহজ।
ছ্যুনতাং গার্ডেনটা একটা সরগরম ব্যবসায়িক এলাকায়। ইউনিভার্সিটি আর হাসপাতাল কাছাকাছি, বা’অ্যানও কাছাকাছি। জীবনে অসুবিধে প্রায় কিছুই নেই। যদি মিন হুয়ে গাড়ি চালায় তবে গাড়ি পার্ক করার জায়গার অভাব এবং খরচও সাংঘাতিক বেশি। তাই গাড়ি না থাকাটা বড়ো সমস্যা বা বিশেষ দুঃখের দশা নয়।
অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিন্ডারগার্টেনে হেঁটে যেতে লাগে দশ মিনিট। সারাটা পথ সু ছন খুব উত্তেজিত হয়ে আকাশ থেকে নেমে আশা তুষারকুঁচিগুলোকে ধাওয়া করতে লাগলো, দৌড়ে, লাফিয়ে, এক প্রতিবেশীর সঙ্গেও দেখা হয়ে গেলো, উনি কুকুরকে হাঁটাতে নিয়ে বেরিয়েছেন, তাই সু ছন কুকুরের সাথেও খেললো অনেকক্ষণ, তারপর কিন্ডারগার্টেনে গেলো। দশ মিনিটে বা’অ্যানে পৌঁছে যাবে দেখে মিন হুয়ে রাস্তার মোড়ের স্টারবাক্সে ঢুকে এক কাপ কফি থেকে ওম নেবে ঠিক করলো যেহেতু ওর গায়ে যথেষ্ট গরমজামা নেই তাই বাকি পথটুকু হেঁটে পেরিয়ে কাজে যাবার প্রস্তুতি আরকি।
কাফের ভেতরে পুরো দমে গরম হাওয়া চলছে। হাতে কফি নিয়ে মিন হুয়ে একটা একানে সোফাতে বসলো, কম্পিউটার খুলে কয়েকটা ইমেলের জবাবও দিয়ে দিলো। আধ কাপ কফি পেটে যেতেই, ওর অসাড় আঙুলগুলো স্বাভাবিক উষ্ণতা ফিরে পেলো।
এই মূহুর্তে, কাঁচের রিভলভিং দরজা দিয়ে একজন লম্বা পুরুষ ঢুকলো। যদিও কেবল ছায়াটুকু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মিন হুয়ে যেখানে বসেছে তার খুব কাছে বলে মিন হুয়ে তৎক্ষণাৎ নজর করলো আর সারা শরীর জমে হিম হয়ে গেলো ওর।
লোকটা লম্বা আর গম্ভীর। পরনে লম্বা ঝুলের কালো রঙের উলের কোট, নরম উলে বোনা, বুকের ওপর একটা একানে নকশা। ভেতরে ধূসর স্যুট, সাদা শার্ট, ঘন নীল চেককাটা টাই, আর একটা ধূসর রঙের চেককাটা রুমাল। বেশ উঁচু মানের ব্যবসায়িক কেতা।
লোকটা এক কাপ কফি অর্ডার করলো, একটা খবরের কাগজ তুলে নিলো, একটা জায়গা দেখে বসবে যেই অমনি নজরে পড়ে গেলো মিন হুয়ে। লোকটা সোজা গিয়ে মিন হুয়ে যেখানে বসে ছিলো তার উল্টোদিকের সোফায় বসে পড়লো।
মিন হুয়ে মুখটা এতো কালো হুয়ে গেলো যে তাতে দেবার জন্য আর এক পোঁচ রঙও বাকি রইলো না। ওর প্রথম ইচ্ছে হলো লাথি মেরে লোকটাকে দরজার বাইরে বের করে দেয়। তবে যতো সময় কাটলো, মিন হুয়ে ততো সংযম ধরে রাখলো। যাই হোক, সেও তো একটা টেকনোলজি কোম্পানিতে মাঝারি ধরনের ম্যানেজার আর সংস্থাটার মূল প্রযুক্তির মেরুদন্ড আর সে বাচ্চার মা। মনে হচ্ছিলো যেনো ঐ মূহুর্তে মিন হুয়ে পাগল হয়ে যাবে, ভদ্রতা আর সংযমের সব বাধ বুঝি ভেঙে যাবে।
শান্তভাবে কফিতে চুমুক লাগালো মিন হুয়ে, ভান করলো যেনো সামনে বসা লোকটাকে ও চেনেই না।
লোকটার মুখটা সরু, শক্তিশালী চোয়ালের পেশী, চোখজোড়া যেনো ইগলের মতো। লোকটা সুদর্শন, তার সাথে খানিক যেনো রাজকীয় মহিমা আছে। চোখের দৃষ্টিটা এমন যেনো বহুদূর থেকে দেখছে।
“মিন হুয়ে” লোকটা হাতের কাগজটা নাড়াল, যেনো মিন হুয়েকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে তার সামনে কে বসে আছে, “অনেক দিন পরে …”
“ এখনো রাগ আছে আমার ওপরে”
মিন হুয়ে নিঃশব্দ উপহাসে জবাব দিলো।
“চার বছর আগে, যদি তুমি আমাকে কোণঠাসা না করতে, তাহলে আমি তোমার শত্রু হতাম না আজ। বিরক্তির কী আছে, মিন হুয়ে?”
“...”
“বলে ছিলাম তোমাকে প্রথম সাক্ষাতে : সফল ব্যক্তির দুটো সম্পদ - মুখের হাসি, আর বন্ধ মুখ?
“...”
“শিখতে পারলে না কেনো? কেনো তোমাকে রাগারাগি চীৎকার চেঁচামেচির রাস্তা নিতে হলো?”
“...”
“বলে ছিলাম তোমাকে ‘প্রাপ্তবুদ্ধি হবার মানে হলো যে যখন তুমি বুঝতে পারবে যে অন্যে মিথ্যে বলছে, তখনও তুমি হাসি মুখে থাকার রাস্তটাই নেবে আর ভান করবে তুমি কিচ্ছু জানো না’? তুমি ভান করতে পারো না কেনো? তোমার নিজের নিয়তির জন্য, তোমার ভবিষ্যতের জন্য?”
“চেং ছিরাং।”
“মিন হুয়ে, আমি তোমাকে হেনস্থা করি নি।” চেং ছিরাং তাকিয়ে রইলো মিন হুয়ের দিকে, এক ঝলক অনুতাপ যেনো জেগে উঠেই মিলিয়ে গেলো তার চোখে, “আমি তোমাকে সত্যিই পছন্দ করতাম, আমি সত্যিই তোমাকে কাছে পেতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি কিছুতেই তোমার প্রতি আমার অনুরাগের ওপরে ভরসা রাখতে না পেরে মানুষের ওপরে ভীষণ চাপ তৈরি করলে … আমি জানি তুমি কী চাও, কিন্তু তার জন্য ঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হয়।”
“চেং ছিরাং, আমি আপনাকে আর একটা মাত্র মিনিট সময় দিচ্ছি। তার পর আর যেনো আমি আপনাকে দেখতে না পাই।” মিন হুয়ের হাতের কফির কাপটাকে উঁচিয়ে ধরলো, “না হলে, আমি এই কাপ ভর্তি কফিটা আপনার গায়ে ঢেলে দেবো। সেটাই আজকের ফিনান্সিয়াল খবরের মুখ্য আলোচনা হবে।”
“এতগুলো বছর পরেও, তুমি সেই একইরকম আবেগপ্রবণ। উচিৎ শিক্ষা নিতে তোমার এখনো অনিচ্ছে।”
অনুতাপের সঙ্গে মাথা নাড়লো চেং ছিরাং, “আমি শুনেছি বা’অ্যান হাই টেক-এ তুমি খুব ভালো কাজ করেছো। গুয়ান ছাও এসব কাজ অনেকদিন ধরে করছে। আমরা হয়তো একসাথে কখনো খেতে যেতে পারি, কাজের কথা বলতে পারি, দেখতে পারি কিছুদিন পরস্পরের সহযোগিতা করতে পারি কিনা।”
“সহযোগিতা?” মিন হুয়ে কফিতে চুমুক লাগালো, “তুমি আমার শত্রু।”
“একটা পুরোন প্রবাদ আছে, তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ : বন্ধুর কাছাকাছি থেকো, তার থেকেও বেশি কাছে রেখো শত্রুদের।”
চেং ছিরাং হালকা হাসলো, “এটাই যুদ্ধ জেতার একমাত্র উপায়।”
“চেং ছিরাং, অপেক্ষা করো।” মিন হুয়ে সোজা উঠে, হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো চেং ছিরাং-এর সামনে, স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে, বললো, “একদিন আমি আপনাকে হারাবো, আপনাকে সেদিন আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসতে হবে। সেদিন আপনার গলা দিয়ে ‘বাপ, বাপ’ শব্দ বেরোবে।”
কিছুই করার নেই দেখে চেং ছিরাং “হম্” বলে মিন হুয়ে আপাদমস্তক দেখলো, “যেমন আশা করেছি, যে মানুষটাকে আমি বেছে নিয়েছি, তার সুরটা আমার সুরের সাথে দারুণ মেলে। মনে রেখো কী বললে, আমি অপেক্ষায় থাকবো, আমিও দেখবো।”
গলায় স্কার্ফটা জড়িয়ে বললো, “তোমার সৌভাগ্য কামনা করি, মিন হুয়ে।”
“আমি চাই আপনি শিগগির মরে যান।”
চেং ছিরাং হাসি চাপতে পারলো না, “দুষ্টু” বলে নিজের কফি নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
***
রাগ নিয়েই মিন হুয়ে কাজে গেলো। ভাবতে লাগলো কিছুতেই ও ওর দিনটা চেং ছিরাং-এর জন্য নষ্ট হতে দেবে না। তাই প্রথমেই ও চলে গেলো আর অ্যান্ড ডি ডিপার্টমেন্টে, ওর অধস্তনদের সঙ্গে কাজের কথা আলোচনা করার জন্য। চার বছর আগে, MIST আর ব্রেস্ট ক্যানসার স্ক্রিনিং প্রজেক্টের জন্য মিন হুয়ে একা হাতে পাঁচজনের একটা টিমকে তালিম দিয়ে ছিলো যার মাথায় ছিলো ঝ্যাং শও হান। এখন তারা প্রত্যেকে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ প্রোডাক্ট বানানোর কাজ করে আর সেই সংক্রান্ত গবেষণার কাজ করে।
এই দলটাতে সবাই খুব খোশমেজাজে থাকে আর এদের সবার বয়স খুব অল্প। যখনই মিন হুয়ে এদের সাথে কাজ করে, তখনই প্রচুর ইতিবাচক উৎসাহ পায়।
“সাও! ল্বব্যাঁ!” মিন হুয়েকে দরজা ঠেলে ঢুকতে দেখে মাথার চুলে ক্র্যু কাট করা একটা গোলগাল ছেলে মিন হুয়ের হাতে একটা নথি দিলো, “আমাদের টিমের এই মাসের প্রজেক্ট প্রোগ্রেস স্টেটমেন্ট।”
এ হলো ওয়াং ছিং উয়াঁ, বায়োকেমিস্ট্রির ডক্টরেট।
“শিয়ালা।”
“হুয়ে জিয়ে! আজ এতো কম গরম কাপড় পরেছেন?”
একটা মেয়ের পরিস্কার গলা শোনা গেলো পিছন দিক থেকে। মিন হুয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো তাঁ শিন নিং। মেয়েটা সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, তার গোলমুখে কৌতুক মাখা সারাক্ষণ, বাদামী রঙের খাটো চুল, লম্বায় চওড়ায় জামাকাপড় পরতে ভালোবাসে। এইমাত্র ফিরলো বাইরে থেকে, হাতে ধরা একটা মোটা কাগজের ব্যাগ, ব্যাগটা তেলে ভিজে সপসপ করছে, তার থেকে ভাজা রুটির গন্ধ বেরোচ্ছে। শিঙের বোতাম লাগানো কোট খুলতে খুলতে কাগজের ব্যাগটকে দেখিয়ে বললো, “ তাওয়ায় ভাজা গরম গরম রুটি। খাবেন নাকি একটা?”
“না, ঠিক আছে।” হাত নেড়ে জানালো মিন হুয়ে।
“ল্বব্যাঁ, আপনি কী সকালের মিটিং-এ যাচ্ছেন? এখনো খানিকটা কোড লিখতে বাকি আছে।”
আরেকজন সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কম্পিটারের সামনে বসে আছে, দু হাতে টাইপ করে চলেছে তাড়াতাড়ি। ওর নাম জিয়াঁ হেং, বেশ রোগা চেহারা, কালো টি-শার্ট পরে আছে, তার জিনসে দুটো বড়ো ছ্যাঁদা আছে, মাথার চুল সব সময়ে ঘেঁটে থাকে, ওকে দেখে মনে হয় যেনো ও এখনো জাগে নি। ও পাশ করেছে হুয়াছিং ইউনিভার্সিটি থেকে, কম্পিউটার সায়েন্সে ব্যাচেলর ডিগ্রি আছে, মিন হুয়ের থেকে দু বছর পরে, মনে করা যেতে পারে মিন হুয়ের ভাই।
“তোমাকে যেতে হবে না।” মিন হুয়ে ঘাড় নাড়লো, “কিন্তু তোমাকে দুপুরের মিটিং-এ যেতে হবে।”
মুখে কিছু না বলে, ও মাথা ঝাঁকালো, তারপর খুশিতে নাচলো কথা বলতে বলতে। মিন হুয়ে ওর কাছে এগিয়ে গেলো, ওর পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বললো, “সাই দং ইয়াং, তুমি কী করছো?”
“কাল রাতে আমি ওভারটাইম করেছি আর তাই কাল রাতের ডেট মিস করেছি। কেটি রেগে গেছে। আমি মরিয়া হয়ে ক্ষমা চেয়েছি। আমি হাঁটু মুড়ে বসেছি, এমনকি মাটি ছুঁয়ে চুমুও খেয়েছি আনুগত্য দেখাতে।”
“অ্যালার্ম দিয়ে রাখো নি যাতে তোমার মনে পড়ে?” মিন হুয়ে বললো, “কেটিকে বলো যে সামনের সপ্তাহান্তে আর অ্যান্ড ডি হট স্প্রিং ভিলাতে যাবে। জিয়াঁ ওকে সঙ্গে নিয়ে এসো। আমরা পাহাড়ের ওপরে বার্বিকিউ করবো, হট স্প্রিং-এ ভিজবো তিনদিন টানা আর কেউ কোনো কম্পিউটার নিয়ে যেতে পারবে না …”
“ইয়ে।” সবাই উচ্ছাস জানালো।
“সবাই বাড়ির লোকজন বা বন্ধু আনতে পারবে দুজন করে। যারা অবিবাহিত কিংবা একলা তারা মা-বাবাকে আনতে পারে।”
“আই নি, ল্বব্যাঁ।” জিয়াঁ হেং একটু বাড়াবাড়ি করে একটা চুমু ছুঁড়ে দিলো।
মিন হুয়ের অধস্তনেদের অর্ধেক তার থেকে বয়সে বড়ো আর শিক্ষাগত যোগ্যতায় তার থেকে আগিয়ে আছে, কিন্তু সব্বাই ওকে শ্রদ্ধা করে, নিখাদ পছন্দ করে। সাও মুয়ের সাথে কাজ করে মিন হুয়ে শিখেছে যে সক্ষম শক্তিশালী কায়দায় সাও মু তাঁর অধীনস্থ কর্মীদের রক্ষা করেন। মিন হুয়ের তীব্র ইচ্ছে আছে ওর টিমের সব্বাইকে সুরক্ষিত রাখার। মিন হুয়ের সব সময়ের চেষ্টা হলো যাতে ওর টিমের সব্বাই প্রাণ খুলে বাঁচে কাজ করার সময়, যাতে প্রশাসনিক নিয়মনীতিতে তারা বেদম না হয়ে পড়ে। এই জন্যই সে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হে হাই শিয়াংকে প্রশাসনিক নিয়মনীতি বদলাতে বলে যাতে এই নব্বই সালের পরে জন্মানো প্রজন্মের লোকেদের সহজ সরল কায়দাটা কোম্পানির প্রশাসনিক রীতিনীতির সাথে খাপ খেয়ে যায় আর এই প্রজন্মের কর্মীদের সৃজনুশীলতা অবাধে এগিয়ে যায়।
তা হলেও, মানুষের সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে সাও মু যতোটা কৌশলী মিন হুয়ে ততোটা নয়। তাই মিন হুয়ের সঙ্গে হে হাই শিয়াং-এর লাগাতার বিরোধ লেগে থাকে মিন হুয়ের টিমের কাজের ব্যবস্থা নিয়ে। গত কয়েক বছর ধরেই হে হাই শিয়াং-এর মিন হুয়ের সম্পর্কটা টান টান উত্তেজনার।
হে হাই শিয়াং-এর কাজের ধরন-ধারণ ভীষণ গুরুগম্ভীর আমলাদের মতো। উনি চারপাশে চাটুকারদের চক্র তৈরি করেন আর চাটুকারদের প্রশস্তি উপভোগও করেন।
গত কয়েক বছরে, মিন হুয়ে কোম্পানিতে ঢোকার পর থেকে কোম্পানিতে স্পষ্ট দুটো শিবির তৈরি হয়ে গেছে। একটা দল হেই হাই শিয়িয়াং-কে ঘিরে মূলত প্রশাসনিক কাজ যাঁরা করেন তাঁরা। এঁদের সব্বাইকে হে হাই শিয়াং হেডকোয়ার্টার্স থেকে আনিয়েছেন এবং এঁরা সবাই তাঁর ঘনিষ্ঠ। এই দলে আছে সমস্ত প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, বিক্রয় এবং কর্মী সংক্রান্ত বিভাগের লোকেরা। হে হাই শিয়াং নিজেও সব সময় হেডকোয়ার্টার্সের নেতৃস্থানীয় মানুষদের সঙ্গে, যাঁরা “ওপরতলার মানুষ’ বলে পরিচিত, তাঁদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন।
অন্যদলটা “প্রযুক্তির দল” সাও মুকে ঘিরে। এর মধ্যে আছেন মূলত প্রযুক্তিতে কাজ করেন যাঁরা, তাঁরা। অর্থাৎ মিন হুয়ে আর তার আর অ্যান্ড ডি টিম। যেহেতু এঁরা কোম্পানির মূল প্রযুক্তির ধারক বাহক আর শিল্পক্ষেত্রে কোম্পানির প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানটাও এঁরাই ধরে রেখেছেন তাই কোম্পানিতে এঁদের জায়গাটা বেশ শক্তপোক্ত। বিশেষ করে মিন হুয়ের টিমের কাজের ফলে কোম্পানি অনেকগুলো সার্টিফিকেশন পেয়েছে, পেটেন্ট পেয়েছে, সফট্ওয়্যারের স্বত্ত পেয়েছে যবে থেকে, তবে থেকে সমস্ত ব্যবসায়িক প্রচার আর মূলধনের ব্যবহার এই টিমকে ঘিরেই চলে।
প্রত্যেক কোম্পানিরই নিজের নিজের সমস্যা আছে। যদিও মিন হুয়ের সাথে হে হাই শিয়াং-এর সম্পর্ক ভালো নয়, কিন্তু মধ্যে সাও মু থাকায় মিন হুয়ে বেশ আরামেই কাজ করে। বহু বছর ধরে, মিন হুয়েও চেষ্টা করে চলেছে অন্য মানুষের সাথে কথাবার্তা বলার কাজে আরো দক্ষ হয়ে ওঠার জন্য। ও সব সময়ে চেষ্টা করে খেয়াল করতে যে ও নিজে কিভাবে কথা বলছে অন্যদের সাথে। অনেক সময় নিজেই উদ্যোগ নেয় হে হাই শিয়াং-এর সাথে কথা বলার। ঠাট্টাও করে, যাতে দুজনের মধ্যেকার টান টান উত্তেজনাটা একটু কমে। যতক্ষণ না ও নিজেকে বা ওর টিমের লোকেদের বিব্রত করছে, ততক্ষণ ও চেষ্টা করে হে হাই শিয়াং-এর দেওয়া কাজগুলোতে টিমের সকলকে সাহায্য করতে আর যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজগুলো শেষ করে ফেলতে। এই জন্যই হে হাই শিয়াং অবাধ্যতা আর মুখে মুখে কথা বলার প্রবণতার ছাড়া মিন হুয়ের আর বিশেষ কোনো দোষ দেখাতে পারেন না। মিন হুয়েকে ছাড়া অনেক ব্যবসায়িক প্রচার বা বোঝাপড়া করাও সম্ভব হয় না হে হাই শিয়াং-এর পক্ষে। না হলে অনেক সময়েই খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করা যায় না। মোদ্দা কথাটা হলো, কোম্পানির ভেতরে যতোই টানাপোড়েন চলুক না কেনো, ওপর ওপর কোম্পানি বেশ শান্তির আবহাওয়া বজায় রাখে।
সকালের একটা মিটিং-এর পরে সাও মু ধরলো মিন হুয়েকে করিডরে, হাসি মুখে বললো, “আজ মনে হচ্ছে তোমার মেজাজ ঠিক নেই।”
“আজ সকালে আমার সাথে চেং ছিরাং-এর দেখা হয়ে ছিলো স্টারবাক্সে।” বললো মিন হুয়ে।
সাও মু অনেক চেষ্টা সত্তেও অবাক না হয়ে পারলো না। যদিও এঁরা তিনজনেই সহকর্মী আর সতীর্থ, কিন্তু মিন হুয়ে আগের চার বছরে কখনো সাও মুকে বলে নি চেং ছিরাং-এর সাথে তার সমঝোতার পুরো ব্যাপারটা। সাও মু জানতো এই বিষয়ে কথা বলা উচিৎ হবে না, কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করা তো দূর।
সাও মু অনেক সংযমের সাথে “ওহ্” বললেন। আর কিছুই বললেন না। মিন হুয়েও আর কিছু বললো না, হাত ব্যাগে একগোছা নথিপত্র গুঁজে নিলো, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো তার অফিসের দিকে।
সাও মু চটপট জানতে চাইলেন, “কি হয়েছে চেং ছিরাং-এর সঙ্গে দেখা হয়েছে তো?”
“তুমি জানতে চাও না থেকে থেকে যে আমি হাসি না কেনো?” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো মিন হুয়ে, “কারণ আমার সাথে চেং ছিরাং-এর দেখা হয়েছে।”
“ও এখন গুয়ান ছাও ইন্টারন্যাশন্যালের সিইও। জানো তুমি?”
মিন হুয়ে মাথা নাড়লো, “ঝেং ল্যান সিইও না? এতো তাড়াতাড়ি অবসর নিলেন?”
“গত মাসে ঝেং ল্যানেরর স্ট্রোক হয়েছে। এখন সে হাসপাতালে শুয়ে। পুরো কোম্পানি এখন চেং ছিরাং-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।” বললো সাও মু।
“ঝেং য়িতিং-এর সিইও হবার কথা না?” মিন হুয়ে জিজ্ঞেস করলো।
ঝেং ল্যানের স্ত্রী মারা গিয়ে ছিলেন অল্প বয়সে। তাঁদের একমাত্র মেয়ে ঝেং য়িতিং, চেং ছিরাং-এর স্ত্রী। যখন মিন হুয়ে কাজ করতো গুয়ান ছাও-তে, তখন ঝেং য়িতিং গুয়ান ছাও-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু আসলে উনি আসল কাজ কিছুই দেখতেন না। যখন মিন হুয়ের দুর্ঘটনাটা ঘটে ছিলো, তখন ঝেং য়িতিং-এর বয়স তিরিশের কোঠার শুরুর দিকে। ওঁর বাবা ঝেং ল্যান শুরু করে ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে একজন নেতৃস্থানীয় হিসেবে এবং সত্যিই বিজ্ঞান প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তিনি সামনের সারিতেই ছিলেন। চেং ছিরাং, যিনি সেই সময়ে প্রচারের কেন্দ্রে ছিলেন, তাঁকে ঝেং ল্যানের সুযোগ্য অনুচর বলে মনে করা হতো, তিনি আবার হুয়াছিং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবাদপ্রতিম ছাত্র ছিলেন।
যতো লোকের সাথে মিন হুয়ের এ যাবৎ সাক্ষাত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে একজনের লেখা কোডেরই সমাদর মিন হুয়ে সর্বান্তকরণে করতে পেরেছে। সেই একজন চেং ছিরাং।
“ঝেং ল্যান তাঁর সুযোগ্য জামাইকে খুব বিশ্বাস করেন নিশ্চয়ই। তিনি শুধু গুয়ান ছাওটাই চেং ছিরাং-এর হাতে তুলে দেন নি, ওঁর হাতে কোম্পানির অনেক শেয়ারও দিয়েছেন যাতে চেং ছিরাং বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্-এ যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিজের মতামত জানাতে পারেন। নিশ্চয়ই ঝেং য়িতিং সিইও নন, তবে তিনিও কোম্পানির অনেক শেয়ারের মালিক। যদি চেং ছিরাং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধতা করার সাহস দেখান, তবে ঝেং য়িতিং মিনিটের মধ্যে চেং ছিরাং-কে গুয়ান ছাও থেকে বার করে দিতে পারবে।”
“হ্যাঁ।” শত্রুর ক্ষমতা কেবলই বেড়ে চলেছে আর মিন হুয়ের কিছুই বলার নেই।
“চেং ছিরাং যা উদ্ধত, কোনো মেয়ের পক্ষে ওর প্রেমে পড়া কঠিন। তখন আমার রুমমেট নিজের এক পরত চামড়া প্রায় ছাড়িয়ে ফেলে ছিলো, ওর পিছনে তাড়া করতে করতে। সম্পর্ক ভেঙে যাবার অনেক পরেও মেয়েটা শান্ত হতে পারে নি। দুঃখের কথা, আমার এখনো মনে হয়ে যে মেয়েটা যেনো এখনো হাইস্কুলের ছাত্র। মেয়েটা খুব সুন্দরী ছিলো, প্রায় তোমার মতোই সুন্দরী ছিলো। সম্পর্ক ভেঙে যেতে ও এতো ভেঙে পড়ে ছিলো যে ও নিজের শহরে ফিরে যায়, সেখানে একটা মিডল স্কুলে পড়ানোর কাজ নেয়। স্থানীয় প্রশাসনের একজন কর্মীকে বিয়ে করে। দুটো বাচ্চাও আছে। এখন আর ও স্মৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বলে মনে হয় না।”
“প্রাণবন্ত হওয়া ভালো নয়, সাধারণ হওয়াটা আশীর্বাদ।” বললো মিন হুয়ে, “সেটা মোটেও খারাপ কিছু নয়।”
“গত বছরে যখন আমি একটা বিজনেস ট্রিপে ওর বাড়ির কাছে গিয়ে ছিলাম, আমি ওকে আমার সাথে খেতে আসতে বলে ছিলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কিছুতেই ‘চেং ছিরাং’ এই শব্দ তিনটে বলা যাবে না। বললেই ও চোখের জলে ভাসাবে, এতো বছর পরেও। চেং ছিরাং-এর ডাকনাম ছিলো ‘ফুলখুনী’। সেটা নেহাৎ ভিত্তিহীন নয়।”
মিন হিয়ে ভ্রূ কোঁচকালো, “ফুলখুনী? কতগুলো খুন করেছে লোকটা? হুহ্?”
“আমি দুজনের কথা জানি। তার সঙ্গে তুমি। তিনজন।”’
“সে কি! আমাদের ডিপার্টমেন্টে মেয়ে কোথায়?”
“তোমার মন পাবার জন্য নিশ্চয়ই বেশ কয়েকজন চেষ্টা করেছে। তুমি ইউনিভার্সিটিতে কাউকে পেলে না কেনো?”
“এখন আর আপশোস করে কী হবে! অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
দু হাত ছড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিন হুয়ে। সেই সময়ে মিন হুয়ে খুবই অহঙ্কারী ছিলো। ও চাইতো এমন কাউকে যে ওর চাইতেও অনেক বেশি বুদ্ধিমান হবে। কিন্তু অনেক খুঁজেও কাউকে পায় নি।
কথা বলার সময়ে ফোনটা কেঁপে উঠলোল। মিন হুয়ে ফোনটা বার করে দেখলো একটা টেক্সট মেসেজ, যার বয়ান, “হাই সু তিয়াঁ, রক্তের যে নমুনা তুমি দিয়েছিলে, তার ডিএনএ-র একটা ব্লাইন্ড কম্প্যারিসন করা হয়েছে। তাতে একটা তুলনার তথ্য পাওয়া গেছে। এখনই যোগাযোগ করো, ছিং।”
যে মেসেজটা পাঠিয়েছে সে শাও ওয়ান, পরিজন খুঁজে বার করার ওয়েবসাইটের স্বেচ্ছাসেবকদের একজন। যখন মিন হুয়ে আর শিন ছি খুঁজছিলো সু তিয়াঁর ভাইকে, এই শাও ওয়ানই দায়িত্ব নিয়ে সমানে মিন হুয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে ছিলো। শিন ছি চলে যাবার পরে, মিন হুয়ে শাও ওয়ানকে বলে ছিলো যে ও সু তিয়াঁ নয়। ও বিশদে ব্যাখা করে বুঝিয়ে ছিলো শাও ওয়ানকে যে সু তিয়াঁ কিভাবে হারিয়ে গেছে। আর জানিয়ে ছিলো যে ও আশা করছে যে ও সু তিয়াঁর ভাইকে খুঁজে বার করবে, সু তিয়াঁকে খোঁজার বদলে। শাও ওয়ানও জানিয়ে ছিলো যে সে সু তিয়াঁর ভাইকে খোঁজার বিষয়টার ওপরে নজর রাখবে। কিন্তু হে শিয়ান গুয়ের সাথে দেখা করার পর থেকে সব সূত্র ছিঁড়ে যায়। শাও ওয়ানও আর কখনো যোগাযোগ করে নি। এখন রক্তের নমুনার ডিএনএ তুলনায় হঠাৎ একটা তথ্য এসেছে। ডিএনএ পরীক্ষার নির্ভুলতার হারও খুব বেশির দিকে। মিন হুয়ের এতো আনন্দ হলো যে ওর চোখ জলে ভরে উঠলো। দৌড়ে অফিসে চলে গেলো, দরজা বন্ধ করে ফোনটা করেই ফেললো।
“তার নাম চেন জিয়া জুন। ওকে ফৌঝৌতে বেচে দিয়ে ছিলো ছেলেধরারা। ওর পালক মা-বাবা ওর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে ছিলো। তাই ও চোদ্দোবছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। নানান জায়গায় কাজ করেছে। শেষে ও বিনচেং-এ যায় আর কয়েকটা কোম্পানিতে আর শপিং মলে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে।”
ফৌঝৌ |
অল্প কথায় শাও ওয়ান বোঝালেন পরিস্থিতিটা।
মিন হুয়ে আনন্দ ধরে রাখতে পারলো না, এতো সহজে সু তিয়াঁর ভাইকে পাওয়া গেলো! এতো জায়গায় খোঁজার পরে, সু তিয়াঁর ভাই থাকে বিনচেং-এই! তার সঙ্গে একই শহরে।
“খুব ভালো! আপনার কাছে ওর ঠিকানা আছে? আমি এখনই ওর সাথে যোগাযোগ করবো।” মিন হুয়ে প্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়লো।
“বেশ, তবে পরিস্থিতিটা আরেকটু বুঝিয়ে বলা দরকার -”
ফোনের অন্যপ্রান্তে শাও ওয়ানের গলার স্বর খাদে নেমে গেলো।
“কি সমস্যা?”
“ও এখন জেলে। ইচ্ছে করে মারার জন্য ওর এক বছরের সাজা হয়েছে। আসছে দু মাসের আগে ও ছাড়া পাবে না।”
শাও ওয়ান আরো বললেন, “আপনি যদি ওর সাথে দেখা করতে চান তাহলে আপনাকে বিনচেং জেলে যেতে হবে।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-25.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-27.html
No comments:
Post a Comment