২৮. জেলের বাইরে
তিরিশ মিনিটের সাক্ষাৎ মিটতে বেশি দেরি হলো না। চেন জিয়া জুন বারবার বললো যে মিন হুয়ের “সাহায্য” তার চাই না।
শেষ বাক্যটা ছিলো, “যেদিন আমি বের হবো এখান থেকে, সেদিন এখানে আসবেন না।”
“কিন্তু -”
“আপনার ফোন নম্বর দিয়ে যান। যদি আমার সত্যিই দরকার করে তো আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করে নেবো।”
মিন হুয়ে চটপট ওর বিজনেস কার্ডের ওপরে লিখে দিলো নিজের মোবাইল ফোন নম্বর, উইচ্যাট আইডি, আর কিউকিউ নম্বর।
কিউকিউ নম্বর |
“তাহলে আমি আপনার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করবো?”
“কোনো দরকার নেই যোগাযোগ করার। আমি যদি আপনার সাথে যোগাযোগ না করি, আপনারও দরকার নেই আমার সাথে যোগাযোগ করার।”
“এক তরফা?”
চেন জিয়া জুনকে সাক্ষাতের ঘর ছেড়ে চলে যেতে দেখলো মিন হুয়ে।
***
বাড়ি ফেরার পরে মিন হুয়েকে দেখে মনে হলো যেনো ওর শরীরে মুর্গির রক্ত ঠুসে দিয়েছে কেউ। এক সপ্তাহের মধ্যেই ছ্যুনতাং গার্ডেনের কাছে মিংসেন কমিউনিটিতে মুখোমুখি দুটো অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলো। সাজগোজ ছ্যুনতাং গার্ডেনের মতো দামী আর বাহারি নয়। তবে একটা শোবার ঘর, একটা বসার ঘর - মাপে খাটো যদিও - কিন্তু আধুনিক, সাদামাঠা, পরিষ্কার, স্বাচ্ছন্দ্যময়, উজ্জ্বল - সাদা জানলা আর সাদা দেওয়ালের কারণে -, ঘন ধূসর রঙের মেঝে, রান্নাঘর আর স্নানের ঘর তুলনামূলকভাবে বড়োই বলা চলে - বন্দোবস্ত ভালোই, কাজ চলে যায় -, কোণাগুলো খোঁচা নয়, বরং ঢেউ খেলানো, থাকার জন্য মানানসই বাড়ি, কিন্ডারগার্টেন কিংবা হাসপাতালও কাছে।
শরীরে মুর্গির রক্ত ঠুসে ... |
দেখেই পছন্দ হয়ে গেলো মিন হুয়ের। একটা তার নিজের জন্য। অন্যটা চেন জিয়া জুনের জন্য। একবছরের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে, মিন হুয়ে বাস করতে শুরু করলো তখনই। ছ্যুনতাং গার্ডেনের বাসায় দুটো শোবার ঘর ছিলো একটা বসার ঘর ছিলো। যখন ঝৌ রু জি বাসা ছেড়ে গিয়ে ছিলো, সে সঙ্গে করে কোনো আসবাবই নিয়ে যায় নি। তাই মিন হুয়ের সব জিনিসই একটা করে বেশি ছিলো। সেগুলো সবই চেন জিয়া জুনের বাসায় সাজিয়ে ফেলা গেলো। মিন হুয়ে প্রচুর বাজারও করলো। নতুন পর্দা কিনল, সোফা কিনল, কার্পেট, রঙিন টিভি, খাবার টেবিল, ওয়াশিং মেশিন, রেফ্রিজেরেটর আর গেরস্থালির নানান জিনিস। ঢেলে সাজালো ঘরদোর, বাসনপত্র সব মেজে ঝকঝকে করে রাখলো চেন জিয়া জুনকে অভ্যর্থনা করার জন্য।
যদিও চেন জিয়া জুন বারবার করে বলেছে যে মিন হুয়ের কোনো সাহায্যই তার লাগবে না, কিন্তু মিন হুয়ে ভাবছে যে চেন জিয়া জুনের কোনো ধারণা নেই একটা জোয়ান ছেলে জেল থেকে ছাড়া পাবার পরে সমাজ তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে পারে, তার ওপরে যদি সে এক্কেবারে একলা হয়। সে জেলে যাবার আগে, তার নিজের বাড়ি ছিলো না, ইউনিটের দেওয়া ডরমিটরিতে থাকতো। সেই জন্যই মিন হুয়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালো, অন্তত সে সাবলীল ভাবে স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে ফেরা অবধি, একটা কাজ করতে শুরু করা অবধি, তারপরে সে যেখানে খুশি যাক না।জিয়া জুনের সাথে জেলে দেখা করার পরের দিনের পরের দিন মিন হুয়ে শাও ওয়ানকে ফোন করলো। তার আরো জানা দরকার কেনো জিয়া জুনের জেল খাটার সাজা হয়েছে।
“আমি খুব স্পষ্ট জানি না।”বললেন শাও ওয়ান, “যেটুকু খবর আমি পড়েছি, তাতে দেখলাম যে তিন বছর আগে জিয়া জুনকে বডিগার্ডের কাজ দিয়ে ছিলেন একজন সাংবাদিক যিনি মূলত বিনোদনের খবরের ব্যবসা করেন। এই সাংবাদিক পাপারাজির পর্যায়ে পড়েন। তাঁর কয়েকটা পাব্লিক অ্যাকাউন্ট আছে যেগুলো দিয়ে উনি বিখ্যাত মুভিস্টার আর টিভিস্টারদের কী কী দোষ সেই সব খবর প্রকাশ করেন যে খবরে অনেকেই চটে যায়। চটে যাওয়া লোকেদের মধ্যে একজন উঠতি তারকা আছেন। কয়েকটা ছবির জন্য তাঁর জনপ্রিয়তা রাতারাতি পড়ে যায়। তাঁর ক্যারিয়ার প্রায় শেষ হয়ে যায়। আমি জানি না তারকা নিজে নাকি তার ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নাকি অন্য কোনো সত্ত্বভোগী, গুন্ডা ভাড়া করে সাংবাদিকের সঙ্গে বোঝাপোড়া করার জন্য। এই সাংবাদিক জন্তুটিও খুব খরচ করতে কসুর করেন না। তিনিও হাওয়া বুঝে বডিগার্ডের সংখ্যা বাড়ান। যখন গুন্ডারা সাংবাদিক য়ু জিকে ঘিরে ধরে, তখন গুন্ডাদের সঙ্গে য়ু জির বডিগার্ডদের খুব মারপিট হয়। চেন জিয়া জুন খুবই দক্ষ। ও য়ু জিকে মারপিটের মধ্যে থেকে টেনে বার করে আনে। ওর হাতে যে মার খেয়ে ছিলো, অনেক দিন হাসপাতালে শুয়ে ছিলো …”
“এটা আত্মরক্ষা নয়? জিয়া জুন জেলে গেলো কেনো?” মিন হুয়ে জানতে চাইলো।
“চেন জিয়া জুন খুব জোর মেরে ছিলো। লোকে ওকে ধরতে পেরে ছিলো। তাছাড়া সে সময়ে কোনো সারভেইল্যান্স ছিলো না। দু পক্ষই বলে যে অপর পক্ষ আগে মারতে এসে ছিলো। দু দলে সমসংখ্যক লোক ছিলো। সেই জন্যই পুরো ব্যাপারটাকে মারপিট বলে ধরা হয়ে ছিলো। সেই জন্য ধড়পাকড় হয়, জরিমানাও হয়, আর চেন জিয়া জুনের মতো যারা অন্য কাউকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে ছিলো, তাদের সাজা হয়।”
“য়ু জি কে?”
“ছিয়াঁ ঝি, শুনেছেন তার নাম?”
মিন হুয়ে মাথা নেড়ে বললো, “না।”
“বাইদু করুন। বেশ নাম আছে। আমিও জানি।”
বাইদুতে দেখা যাচ্ছে ছিয়াঁ ঝি বেশ নামজাদা সাংবাদিক, বিনোদন ক্ষেত্রে। নতুন মাধ্যমে খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। একশো জনেরও বেশি লোক কাজ করে তাঁর ব্যবসায়। তাঁর অনেকগুলো বড়ো বড়ো ভিডিও চ্যানেল আছে, পাব্লিক অ্যাকাউন্টও আছে। ইন্টারনেটে তিনি বেশ প্রভাবশালী।
পাব্লিক অ্যাকাউন্ট |
ছিয়াঁ ঝি খুব ব্যস্ত মানুষ। মিন হুয়ে যোগাযোগ করে দু সপ্তাহ অপেক্ষা করলো তবে তাঁর সময় হলো। দেখা করার জায়গা হলো বেজিং-এর ছাওইয়াঁ ডিস্ট্রিক্ট। পরের দিন মিন হুয়ের একটা প্রোডাক্ট টেস্ট ছিলো। তাই মিন হুয়েকে প্লেনে যাতায়াত করতে হলো ছিয়াঁ ঝির সাথে দেখা করার জন্য।
“চেন জিয়া জুনের ব্যাপারে আপনি কী জানতে চান?” শিল্পকাজে ভরা একটা অফিসে বসে সোজাসুজি জানতে চাইলেন ছিয়াঁ ঝি। দেখে মনে হলো তাঁর বয়স চল্লিশের শুরুর দিকে, মাঝারি উচ্চতা, রোগা মুখের গড়ন, দাড়ি আছে, এবং চতুর।
অ্যাসিট্যান্ট বলে দিয়েছে যে উনি কেবল মাত্র পনেরো মিনিট সময় দিতে পারবেন।
“আপনি জানেন নিশ্চয়ই যে ও জেল থেকে ছাড়া পাবে এক মাসের মধ্যে।” নরম সুরে বললো মিন হুয়ে, “ওঁর জিয়েজিয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আপনার সাথে যোগাযোগ করার।”
“হ্যাঁ, ও তো প্রায় বছরখানেক হলো জেলে আছে। বেরোনোর সময় হয়ে এলো প্রায়।”
ছিয়াঁ ঝি সোজাসুজি চাইলো মিন হুয়ের মুখের দিকে, “আমি কখনো শুনি নি যে ওর জিয়েজিয়ে আছে। ও তো বলে ছিলো যে ও বাড়ির বড়ো ছেলে।”
“দত্তক নেওয়া ছেলে তো, এই সেদিন অবধি ওর কোনো ধারণাই ছিলো না ওর অতীতের বিষয়ে।”
“ওহ্” বলে ধীরে ধীরে কফিতে চুমুক দিলেন ছিয়াঁ ঝি।
“আমি শুনেছি যে ও আপনার কাছে দু বছর কাজ করেছে। মূলত নিরাপত্তার কাজ, আর আপনার পিছু পিছু ঘুরে বেরিয়েছে। আপনি ভালো জানেন নিশ্চয়ই। আপনি কী জানেন যে ভবিষ্যতে কী ধরনের কাজ জিয়া জুন করতে চান?”
“আপনি তো নিজেই ওঁকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, সেটাই ভালো নয় কী?” ঘুরিয়ে প্রশ্ন রাখলেন ছিয়াঁ ঝি।
“আমি ওঁকে ভালো জানি না। উনিও আমাকে অনেক কথা বলতে চান না।” দীর্ঘশ্বাস পড়লো মিন হুয়ের।
“ও” খুব গাম্ভীর্য ভরে বললেন ছিয়াঁ ঝি, “এখনো আদর্শে খুব বিশ্বাস রাখে। আগে, ও ভালো মার্শাল আর্ট জানে বলে, ভালো লড়তেও পারে বলে, অনেকেই ওকে বডিগার্ড রাখতে চাইতো। আমার সাথে আলাপ হবার পরে ও আমার সাথে দু বছরের ওপরে ছিলো। ও আমার অনেক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। সাংবাদিকদের নিয়ে ওর খুব কৌতুহল। ছবি তোলার উৎসাহ আছে ওর। পয়সা বাঁচিয়ে এসএলআর ক্যামেরা কিনেছে। কিছু করার না থাকলে ফোটোগ্রাফারদের সঙ্গে সময় কাটায়। ও খুব বাধ্য নয়, কিন্তু বিশ্বস্ত। সংকটের মূহুর্তে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেক সময় যথেষ্ট লোক না থাকলে, আমি ওকেই পাঠিয়েছি খোঁজখবর করার জন্য, কোনো ফিল্মিং লোকেশনে বা অন্যত্র বসে বসে খবর তৈরি হবার অপেক্ষা করার জন্য, ও প্রায় সব কিছু জানে, শেখেও খুব তাড়াতাড়ি। একবার বলে ছিলো আমাকে যে ও আমাদের মতো কাজ করতে চায়। জানতে চেয়ে ছিলো তা সম্ভব কিনা। আমি বলে ছিলাম যে সবই সম্ভব। যতক্ষণ এখানে আছো শিখতে থাকো, আর প্রচুর আর্টিক্ল প্রকাশ করতে থাকো। যদি তুমি ভালো সাড়া পাও, তোমাকে কাজ দেওয়া হবে। কতরকম নিয়মনীতি আছে। ও প্রচুর পান্ডূলিপি পাঠিয়ে ছিলো আর তার অনেকগুলোর জন্য আমার থেকে টাকাও পেয়ে ছিলো।”
হয়তো তাড়ায় আছেন, কথা বলতে বলতে বারবার ঘড়ি দেখছেন, কফিও খাওয়া হয়ে গেছে।
“তাহলে জেল থেকে বেরোনোর পরে - ও কী আপনার সঙ্গে কাজ করে যাবে?”
শেষ পর্যন্ত মিন হুয়ে বলেই ফেললো যা ও বলতে চাই ছিলো।
“বডিগার্ড?” ছিয়াঁ মাথা নাড়লেন, “নিশ্চয়ই।”
“আমি বলছিলাম য়ু জির কথা।”
“যা হোক” মাথা ঝাঁকালেন ছিয়াঁ ঝি, “ও জেলে ছিলো যে …”
“সে কথা সত্যি। কিন্তু ও তো জেলে গেছে আপনাকে বাঁচাতে। না হলে তো আপনি যেতেন।”
“আপনি ওভাবে বলতে পারেন না। বডিগার্ডের কাজে বেশ ঝুঁকি আছে আর আমি ওকে মাইনেও দিতাম যেটা সেটা খুব কম নয়। কিন্তু এটা আমার দোষ নয় যে ও কাউকে আহত করে ফেলেছে ঘটনাচক্রে। ও নিশ্চয়ই জানে যে ওর কী করা উচিৎ, তাই না?”
ছিয়াঁ জির দুটো হাতে জটিল মুদ্রা দেখা দিলো, “আপনি যদি ওকে দোষ দিতে চান, তবে দোষ দিন এই জন্য যে ও সহজে শেখে না।”
“ও আপনার প্রাণ বাঁচিয়েছে আর তার জন্য আজকে ও জেলে-” বিদ্রুপে ফেটে পড়লো মিন হুয়ে, “আর শেষে আপনি বলছেন যে ও জীবনের পাঠ পড়তে পারে নি? ছিয়াঁ জঁ, আপনার ব্যক্তিত্ব তো চমকপ্রদ।”
ছিয়াঁ ঝি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তাকালেন মিন হুয়ের দিকে, তখনও তাঁর মুখে কোনো প্রতিক্রিয়ার ছাপ নেই, “আপনি এখানে হুমকি দিয়ে পয়সা আদায় করতে আসেন নি তো? চেষ্টাও করবেন না। আমি এ ধরনের চাতুরীর ফাঁদে পড়ি না।”
“সে তো জেলে। আপনি একবছরে তাকে দেখতেও যান নি কখনো।”
“না তার দরকার নেই।” দুম করে বললেন ছিয়াঁ ঝি, “ঠিক কী আপনার চাই আমাকে সোজাসুজি বলুন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলবেন না।”
“যদি আপনি ওকে এখানে ফিরে আসতে বলেন বিনোদনের সাংবাদিক হয়ে, আমি প্রথম তিন বছরের মাইনে দেবো। ও এখানে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করবে। তিন বছর পরেও ও আপনার সাথেই কাজ করবে।”
“তিন বছরের মাইনে?” ছিয়াঁ ঝি এমন হাসলেন যেনো কল্পকথা শুনছেন, “ও কিন্তু পেশাদারী স্তরের থেকে অনেক দূরে এখনো। চলবে তো?”
“ছিয়াঁ জঁ, ও আপনার প্রাণ বাঁচিয়েছে।”
“তিন বছরের মাইনের সাথে পঞ্চাশ হাজার কাজ শেখানোর খরচ বাবদ, আপনি ওকে ডাকতে পারেন আর ওকে আমার উপহার হিসেবে দেখতে পারেন।”
ছিয়াঁ ঝি তাঁর কফির কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন, “যদি এমনটা না হতো যে ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, আমি তাহলে এমন নির্বুদ্ধিতা কক্ষোণো করতাম না। আপনি জানেন ও কেবল জুনিয়র হাইস্কুল অবধি পড়েছে?”
“যে খবরের দায়িত্বে আছেন, তার মধ্যে বিনোদন জগতের গুজব ছাড়া আর কী পড়ে?”
“সমাজের খবর, ফ্যাশন, জনতা, দৃষ্টিকোণ …”
“তিন বছরের মাইনে, পঞ্চাশ হাজার কাজ শেখানোর খরচ আমি দিতে পারি” মিন হুয়ে সুর বদলালো, “কিন্তু ওকে সমাজের খবরের বিভাগে দিতে হবে।”
"কেনো? বিনোদনে বিভাগ খারাপ কিসে?”
“আমি ভয় পাচ্ছি যে ভবিষ্যতে ও আপনার মতো হয়ে যাবে আর প্রতি বাঁকে মার খাবে।”
ছিয়াঁ ঝি নাক দিয়ে আওয়াজ করে একটা শুকনো হাসি হাসলেন, “রাজি।”
“আমিও রাজি।” মিন হুয়ে খুব জোরে ছিয়াঁ ঝির হাত ঝাঁকাল, “শেষ শর্ত, ওকে বলবেন না যে আমি টাকা দিয়েছি।”
“বুঝলাম।”
***
সব ব্যবস্থা সারা হতে, মিন হুয়ে মন দিলো নতুন প্রোডাক্টের ডিবাগিং-এ। আর সময় কেটে গেলো এক ঝলকে।
চোখের পলকে সেই দিনটা এসে গেলো যে দিন জিয়া জুন জেল থেকে ছাড়া পাবে। মিন হুয়ে ভয় পাচ্ছিলো যে ও হয়তো সময়ে পৌঁছোতে পারবে না, জিয়া জুন ওর জন্য অপেক্ষা করবে না। তাই মিন হুয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লো ভোর ভোর। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলো যাতে জেলের সামনে পৌঁছোতে পারে সকাল আটটা বাজার আগেই। জেলের ফটকের সামনে অপেক্ষা করতে লাগলো।
নটার সময় একটা কালো টয়োটা এসে হাজির হলো। বড়ো গাড়ি, ক্রস-কান্ট্রি মডেলের মতো। হয়তো কাউকে নিতে। ড্রাইভার তার থেকে নেমে এলো, মুখটা ফোলা, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। কোমরে একটা মোটা রুপোলি শিকলের মতো পরে আছে, সিগারেটে টান দিতে দিতে চারপাশটা দেখছে থেকে থেকেই। মিন হুয়েকে দেখে তার চোখে জ্যোতি বেড়ে গেলো। চোখ রাখলো মিন হুয়ের বুকে তারপর শিস দিলো জোরে।
এমন একটা সময়ে মিন হুয়ে কোনো ঝামেলায় যেতে রাজি নয়, বিশেষ করে যখন সে জানে যে যারা এই জায়গাটাতে এসেছে তারা নির্দয়। মোবাইল ফোন বার করে, আপিসের উইচ্যাট গ্রুপে কয়েকটা মেসেজের জবাব লিখল, ইচ্ছে করেই। যখন ও চোখ তুলে তাকালো, তখন দেখতে পেলো যে কয়েকটা চ্যাঙড়া জোয়ান টয়োটা থেকে নেমে পড়েছে কোনো সময়ে, দাঁড়িয়ে বা বসে, চিৎকার করে আড্ডা মারছে, একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছে। এর ঠিক পরেই গাড়ির ভেতর থেকে কাশির শব্দ এলো আর একটা লম্বা লোক বেরিয়ে এলো। পরনে একটা হালকা নীল রঙের ক্যাজুয়াল স্যুট কিন্তু গলার টাইটা খুব গুরুত্ব দিয়ে বাধা। তাকে বেরোতে দেখে সাদা জামা পরা একটা চ্যাঙড়া জোয়ান তার হাতে একটা সিগারেট দিলো, আবার সিগারেটটা জ্বালিয়েও দিলো।
সূর্য ঝলসাচ্ছিলো চতুর্দিক। লম্বা লোকটা রোদ চশমা বার করে পরে নিলো। মাথার চুলের ধরনটা অদ্ভুত, দু দিক চাঁছা, আর মাথার ওপর থেকে একফালি চুল উঁচিয়ে আছে। বুকে ঝুলছে এক আঙুল চওড়া একটা সোনালি হার, শিকলের মতো দেখতে, যেনো গ্যাংস্টার।
ওই দলটার থেকে মিন হুয়ের দূরত্ব অনেক। ওরা যে কী কথা বলছিলো, তা মিন হুয়ে শুনতে পাচ্ছিলো না।
হাবে ভাবে মনে হচ্ছিলো, অন্তত মিন হুয়ের অনুমান, গ্যাং-এর কোনো বড়ো নেতাকে নিতে এসেছে এরা।
আরো একঘন্টা অপেক্ষা করতে করতে মিন হুয়ে কাজের উইচ্যাট গ্রুপে আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলো। তারপর যখন মাথা তুললো আবার, তখন খুব সজাগ না হয়েই ও গুণে ফেললো টয়োটা থেকে নেমে আসা লোকগুলোর সংখ্যা। ড্রাইভারকে নিয়ে মোট সাতজন।
বা’অ্যানের একটা এরকমই গাড়ি আছে। সেই জন্যই মিন হুয়ের মনে পড়ে গেলো যে গাড়িতে আটজনের বসার জায়গা আছে। মনে হচ্ছে যে দলের বড়দাটির কদর খুব, এবং মনে হচ্ছে যে বড়দাটির বড়ো রকমের সম্বর্ধনা লাগবে যখন সে বেরোবে জেল থেকে।
এই সময় একটা “ক্যাঁচ” করে শব্দ তুলে লোহার ফটক খুলে গেলো। প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে চেন জিয়ে জুন বেরিয়ে এলো। প্রায় একই সঙ্গে সবাই মাথা তুললো, আটজোড়া চোখ একসাথে তাকিয়ে তার দিকে।
চেন জিয়া জুন না থেমে পারলো না। হতবাক হয়ে ভিড়টার দিকে দেখতে লাগলো।
“জিয়া জুন!” মিন হুয়ে নরম স্বরে ডাকল। চটপট পা চালাল জিয়া জুনের কাছে যাবার জন্য, “আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
জিয়া জুনের কাছে পৌঁছোনোর অনেক আগেই মিন হুয়ে একটা ঠেলা দিলো সোনালি হার পরা লোকটা।
মিন হুয়ে ধাক্কাটা সামলে সোজা দাঁড়াতে পারলো না। হোঁচট খেলো। পড়েই যাচ্ছিলো হুমড়ি খেয়ে। এমন সময়ে চেন জিয়া জুন ধরে ফেললো মিন হুয়েকে আর টেনে নিয়ে আড়াল করলো নিজের শরীরের আড়ালে।
“চেন জিয়া জুন” সোনার হার পরা লোকটা চোখ থেকে রোদ চশমা খুলে ফেললো, চেন জিয়া জুনের দিকে চাইলো যেনো উস্কাচ্ছে চেন জিয়া জুনকে।
“শাও গ্য”
“শেষ মারপিটটা, শেষ হয়নি যে, তুই তার আগেই জেলে চলে গেলি।”
“ওহ্”
“কেমন হয়, যদি একটা সময় দাও বাকিটা শেষ করার জন্য? আজই?” বললো শাও দা।
“এখানেই?” চেন জিয়া জুন গেটের ওপরের ক্যামেরার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো। “এটা কী সুবিধেজনক?”
মিন হুয়ে তাকিয়ে দেখলো চেন জিয়া জুনের দিকে, তারপর দেখলো শাও দা-এর দিকে। তখন বুঝতে পারলো যে যে গ্যাংস্টার টয়োটা গাড়ি থেকে নেমে ছিলো, সে এখানে কাউকে বাড়ি নিয়ে যেতে আসে নি, বরং সে এসেছে কাউকে ধরে মারতে।
“আমার ভাইয়ের পা-টা তুই ভেঙে দিয়ে ছিলি। এখনো হাঁটতে গেলে খোঁড়াচ্ছে।” শাও দা মাটিতে একগাদা থুতু ফেললো, “চেন জিয়া জুন, এবার হিসেবটা মিটিয়ে নিলে হয় না?”
“কি ভাবে?”
“হয় তুই আমাকে বলবি তোর একটা পা ভেঙে দিতে, অথবা হাসপাতাল খরচা বাবদ তুই আমাকে দু লাখ দিবি।”
“যদি আমি কোনোটাই না করি তাহকে কী হবে?”
“দুঃখিত, এরপর থেকে তুই বেঁচে থাকবি, কিন্তু তোর দিন কাটবে খুবই দুঃখে।”
“আমি যদি দুঃখে থাকি, তাহলে তুমিও সুখে থাকবে না কিন্তু।” জোড়হাতে বিদ্রুপ করলো চেন জিয়া জুন, “আমি যদি তোমার ভাইয়ের পা ভেঙে দিয়ে থাকি, তবে আমি তোমারটাও ভাঙতে পারি।”
“কিন্তু তুই একা। তোর সাথে কেউ নেই।”
শাও দাদা মুখটা কাত করে চেন জিয়া জুনের বুকে নিজের আঙুল দিয়ে একটা খোঁচা দিলো, “আজকেই বোঝাপড়া হয়ে যাক।”
“গ্য, ঝামেলা করবেন না। আমি পুলিশ ডাকব।” চেঁচিয়ে উঠলো মিন হুয়ে, “জিয়া জুন, ওঁকে বাদ দিন, গাড়িতে উঠুন, চলুন বাড়ি যাই।”
কথা বলা শেষ করেই, জিয়া জুনের হাত ধরে গাড়িতে উঠে পড়লো মিন হুয়ে। ট্যাক্সি ড্রাইভার এর মধ্যেই দেখে ছিলেন যে কোনো একটা গন্ডগোল পাকিয়ে উঠছে, ব্যাপার সুবিধের নয়। যেই দেখলো যে দুজনে বসেছে, অমনি তিনি গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে চললেন মিংসেন কমিউনিটির দিকে।
গাড়ির আয়না দিয়ে মিন হুয়ে দেখতে পেলো যে টয়োটা ক্রস-কান্ট্রি গাড়িটা খুব কাছাকাছি দূরত্ব রেখে অনুসরণ করছে।
“আমি বলি নি আপনাকে যে আমাকে নিয়ে যেতে আসবেন না। আপনি কিছুতেই কথা শুনলেন না।”
“এ জায়গাটা শহরের থেকে অনেক দূরে, আমার আশঙ্কা ছিলো যে আপনি এখান থেকে কোনো ট্যাক্সি পাবেন না।”
“আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নিতে পারতাম।”
“আপনি কিছুতেই মানতে পারছেন না যে আমি এসেছি আপনাকে নিতে। সেটা কিন্তু ভালোই হয়েছে। না হলে ঐ লোকগুলো তোকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত। তাছাড়া -”
চেন জিয়া জুন হঠাৎ করে থামিয়ে দিলো মিন হুয়েকে, ড্রাইভারকে বললো, “শিফু, গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করান প্লিজ। আমি নেবে যাবো। তারপর ওঁকে বাড়ি ফেরত নিয়ে যাবেন।”
"কেনো?” জিজ্ঞেস করলো মিন হুয়ে।
“ওদেরকে কিছুতেই আপনার বাড়ির ঠিকানা জানতে দেবেন না, ওরা আপনার ওপরে চড়াও হবে।” বললো চেন জিয়া জুন।
“তাহলে আপনি কী করবেন?”
“আমি ট্রেন স্টেশনে খাবো আর শোবো, যেখানে পুলিশে পাহারা দেয়। ওরা আমাকে কিছু করতে সাহস করবে না।”
“সে তো ভারি ধকলের ব্যাপার হবে!”
“খুব ধকলের হবে না। আমার কোনো কাজ থাকবে না। প্রচুর সময় থাকবে।”
ট্রেন স্টেশন সামনেই। যেই ড্রাইভার গাড়িটা দাঁড় করালো, মিন হুয়ে নেমে পড়লো চেন জিয়া জুনের সাথে।
“আপনি আমার সঙ্গে আসছেন কেনো?” চেন জিয়া জুন থামালো মিন হুয়েকে, “আমি আমার ব্যাপারটা সামলে নিতে পারি। দয়া করে বাড়ি ফিরে যান আর আমাকে আমার মতো থাকতেন দিন। ঠিক আছে?”
“না।” মিন হুয়ে জাপটে ধরলো চেন জিয়া জুনের হাত, “এখন আপনি ভয়ানক বিপদের মধ্যে আছেন, আমি আপনার সঙ্গেই থাকব।”
“আপনি কেনো আমার সঙ্গে থাকবেন? আপনি কী আমার জন্য মারপিট করতে পারবেন?” গর্জে উঠলো চেন জিয়া জুন। তার ধৈর্যের অভাবটা প্রকট হয়ে উঠলো। সে ঝেড়ে ফেলে দিলো মিন হুয়ের হাত, “আমাকে বিরক্ত করবেন না। পারবেন এইটুকু মনে রাখতে? আমি কী আপনাকে চিনি? আপনি কী ভীষণ বিরক্তিকর মেয়েমানুষ, জানেন সেটা?”
“আপনি অবশেষে বেরিয়েছেন জেল থেকে। আমি কিছুতেই আপনার হাত-পা ভাঙতে দিতে পারি না।” মিন হুয়ে আবার জাপটে ধরলো চেন জিয়া জুনকে আর কিছুতেই ছাড়াতে দিলো না বাঁধন।
“শিংজ্যো-”
দুজনে মিলে মনের সুখে তর্ক চালিয়ে গেলো, যেই না ফিরে তাকালো অমনি দেখলো যে সাত গ্যাংস্টার তাদের থেকে মাত্র তিন মিটার মানে দশ ফুটেরও কম দূরে। ঘুরে দাঁড়িয়ে চেন জিয়া জুন জামার হাতা গোটাতে লাগলো।
মিন হুয়ে ঘাবড়ে গেলো, “চেন জিয়া জুন, কী করতে চাও তুমি?”
“মারপিটের জন্য তৈরি হও।”
“দাঁড়া।” চেঁচিয়ে উঠলো মিন হুয়ে, “আমাকে বোঝাপড়া করতে দে ওদের সাথে। তুই দাঁড়া এখানে, আমি যাবো আর আসবো।”
“বোঝাপড়া? এটা কী ব্যবসা নাকি? ওরা একদল বখাটে গুন্ডা। ওরা তোমার সাথে বোঝাপড়ায় যাবে না।”
“আগে চেষ্টা তো করতে দে। যদি কাজ না হয়, তখন বলিস। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে, যাও চেষ্টা করো।”
মিন হুয়ে চেন জিয়া জুনের হাত ছেড়ে দিলো। পা চালিয়ে গেলো শাও দাদার সামনে, মোবাইল ফোন বার করলো, আর খুব নিচু স্বরে বললো, “দু লাখ? যদি আমি দু লাখ য়ুআঁ দিয়ে দি আপনাকে এখন, আপনি আর কোনো দিন আসবেন না আমাদের কাছে, তাই তো?”
আধখানা হাসি হেসে বললো শাও দাদা, “হ্যাঁ, তাই বটে।”
“আসুন, আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি, আলিপে।”
শাও দাদা এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেলো, আশাই করে নি যে মিন হুয়ে এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে।
টাকার পরিমাণটা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই বেশি, তাই মিন হুয়ের সব ব্যবস্থা করতে একটু বেশি সময়ই লাগলো। শেষে টাকাটা অবলীলায় পাঠানোও গেলো।
“পেয়েছেন?”
“পেয়েছি।” মাথা নাড়লেন শাও দাদা।
“আপনি কী যেতে পারেন এবার?”
“আমরা এক্ষুণি উবে যাবো এখান থেকে।”
শাও দাদা যা বললেন তা করলেনও। তখনই ছয় সাগরেদকে নিয়ে গিয়ে উঠলেন টয়োটাতে আর মিশে গেলেন অগুণতি গাড়ির ভিড়ে।
মিন হুয়ে ফিরে গেলো চেন জিয়া জুনের কাছে, ওর কাঁধে চাপড় দিয়ে হাসি মুখে বললো, “সমাধান হয়ে গেছে। চ।”
“কী করে সমাধান হলো?”
“আমি ওদের দু লাখ য়ুআঁ দিয়ে দিলাম।”
“কী?” চেন জিয়া জুনের মাথায় যেনো বাজ পড়লো, “দু লাখ? কী করে দিলেন?”
“মোবাইল ফোন দিয়ে।”
“তুমি মাথামোটা!, তুমি! কেনো দিলে ওদের দু লাখ য়ুআঁ? আমি এক বছর জেলে ছিলাম, আমি ওর থেকে এখনো অবধি দু লাখ য়ুআঁ চাই নি …”
“সত্যিই?”
“দু লাখ য়ুআঁ তোর পায়ের জন্য? আমার হিসেবে টাকাটার মূল্য কিছুই না।”
“পাগল”
“কী বললি?”
“তুমি পাগল!”
“আয়, আমার সঙ্গে, বাড়ি চল।” মিন হুয়ে হাত ধরলো চেন জিয়া জুনের, খুশিতে হাসতে লাগলো নরম নরম, “ঠিক যেমনটা লাগবে তেমন একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছি তোর জন্য তুই থাকবি বলে।”
“তুমি কী বিবাহিত?” হঠাৎ প্রশ্ন করলো চেন জিয়া জুন।
“এখনকার অবস্থাঃ বিবাহবিচ্ছিন্না। যা হোক, তুই শুশু হয়েছিস। তোর একটা ভাগনে আছে, নাম সু ছন। এখন ওর তিন বছর বয়স।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-27.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-29.html