৪৮. মিটিং-এর আগে
সেই রাতেই সাও মু বা’অ্যানের ম্যানেজমেন্ট টিমকে ফোন করে একটা কনফারেন্স করে নিলো। অল্প কথায় সকলকে বুঝিয়ে বললো শিন ছির প্রস্তাব। এক এক করে সবাই পর পর, নিজেদের মতামত জানালো।
“বিবিজির এসিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের খুবই নামডাক আছে। যদি ওরা নিয়ে নেয় কোম্পানি, ওরা হয়তো ভবিষ্যতে নিয়ে নেবার কথাও ভাবছে। তেরো কোটির কথা না হয় বাদই দিলাম। আর দামটাও খারাপ নয়।” বললো ইয়ান চেং লি, “কিন্তু ম্যানেজমেন্ট টিমের অংশীদারী শুধু তেইশ শতাংশ - এটা একটু কম হয়ে যাচ্ছে। তুমি কী ওর সাথে আবার কথা বলতে পারবে? আমার মনে হয় পঁচিশ বা ছাব্বিশ শতাংশ হলে যথেষ্ট হয়।”
“এটা ওঁর শেষ কথা।”
“আমার মনে হয় ছাব্বিশ শতাংশও কম।” বললো হে হাই শিয়াং, “চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ম্যানেজমেন্ট টিমটাই কোম্পানির সমস্ত কর্মকান্ডের মেরুদন্ড, সেটা তো কোনো একবারে চুকে যাবে এমন ব্যাপার নয়। তাদের জন্য যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক কিছু নেই এই প্রস্তাবে। ফলে কেউই লড়াইটা করতে চাইবে না। আমি বলব আটাশ থেকে তিরিশ শতাংশ অংশীদারী। কার কাছে এই অংশীদারী চাওয়া হচ্ছে তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। তোমার এই সংখ্যাগুলোই বলা উচিৎ।
“অন্য দুটো ব্যক্তিগত লগ্নিকারী আমাদেরকে কতো অংশীদারী দিচ্ছে?” জানতে চাইলো মিন হুয়ে।
“আটাশ শতাংশ।”
মিন হুয়ে ভাবতে লাগলো ব্যাপারটা নিয়ে। ম্যানেজমেন্ট টিমের জন্য পাঁচ শতাংশের পার্থক্যটা বড়ো পার্থক্য।
“আমি জানি না, হেডকোয়ার্টার্স কতো দাম আশা করছে।” বললো সাও মু, “হে জঁ, আপনি কী খোঁজখবর করতে পারবেন এ ব্যাপারে?”
“আমি চেষ্টা করেছি। কাজটা বেশ কঠিন।” বললেন হে হাই শিয়াং, “আমি কাই বিং জিয়েকে চিনি। যাঁরা বিক্রির জন্য কাজ করছেন, তাঁদের দলের নেতা। ওঁর পেশাদারী দক্ষতা আর্থিক ব্যবস্থাতে। কিন্তু মুখটা একদম বন্ধ। উনি খুব অভিজ্ঞও। ওঁর কাজই হলো সমস্ত ক্রেতাকে নিলামে অংশ নিতে উৎসাহিত করা। যতো লোক ওঁর সাথে যোগাযোগ করে ততোই ভালো। যদি তুমি কিছু জানতে চাও, তাহলে ওঁর উত্তর খুব গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া যাবে না। বিশেষত, জিএস১.০ ঘোষণা করার পর আর্থিক পরিস্থিতি হেডকোয়ার্টার্সের অনুকূলে তাই ওঁর এখনকার কৌশল হলো চুপচাপ অপেক্ষা করা, সঠিক দরের জন্য।”
“আগামী কাল যে দুজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছো, তাঁদের মনোভাব কী?” প্রশ্ন করলো শু গুয়াং জিয়াঁ।
“দুজনেরই মনোভাব ইতিবাচক, তবে সবই নির্ভর করছে ওঁরা কী শর্ত দেন তাঁর ওপরে —-” জানালো সাও মু, “এই দুটো কোম্পানির কোনোটাই বিবিজির মতো বড়ো নয়। আর এঁদের অতো নামডাকও নেই শিন ছির মতো। আমি এঁদের সাথে আগেও যোগাযোগ করেছি, এঁরা খুবই বাস্তববাদী আর এঁরা কথার খেলাপও করেন না। এঁরা বলেছেন যে এঁরা পরে আমাদেরকে আমাদের মতো ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক যাতে আমরা স্বাধীনভাবে এগোতে পারি। তা বাদে যে পরিমাণ লগ্নি আমরা চাইছি, সেটাও খুব বেশি নয়। আমার মনে হয় এঁদের সাথে বোঝাপড়া হয়ে যাবে। — যদি নাও হয়, বিনচেং-এর অনেকগুলো লগ্নি কোম্পানি আছে যাঁরা উৎসাহ দেখিয়েছে। এখানে কোনো রফা না হলে, ফিরে যাবো, গিয়ে ওঁদের সাথে কথা চালিয়ে যাবো।”
“তোমরা কী একটা কথা ভেবেছো?” বলে উঠলো ইয়ান চেং লি, “আমরা যদি বিবিজির সাথে আজ করি, তাহলে আমাদের শুধু শিন ছির সাথে বোঝাপড়া করতে হবে। আমরা যদি তিনটে আলাদা আলাদা কোম্পানির সাথে কাজ করি, তাহলে আমাদের তিনটে আলাদা লোককে জবাবদিহি করতে হবে। প্রত্যেকটা লোকের মেজাজ-মর্জি আলাদা আলাদা। যদি ওঁদের মধ্যে কোনো বিরোধ হয়, সেটা আমাদের জন্য ঝামেলার হয়ে যাবে। যদি যোগাযোগ রাখার খরচের দিকটা দেখি, তবে আমার ভোট যাচ্ছে বিবিজির দিকেই। আর্থিক পরিস্থিতি প্রায় রোজই বদলে যাচ্ছে, তাও শিন ছির সুনাম একটুও কমে নি ইন্ডাস্ট্রিতে। তাছাড়া, ও ইচ্ছে দেখিয়েছে যে পুরোটা ও একাই ব্যবস্থা করবে ওর সাহস আর মনোভাব দিয়ে। এটাই সব এখানে।”
“শিন ছি বিশ্বাসযোগ্য, আমি হলফ করে বলতে পারি।” মিন হুয়ে বলে উঠলো, “ভরসার যোগ্যও বটে।”
“ভরসার যোগ্য, কিন্তু কিপ্টে। তেইশ শতাংশ? বড্ডো ঝামেলার। দরকার নেই, চলো।” হে হাই শিয়াং-এর গলার স্বরে জোর ছিলো, “কেক একটাই, ও এক কামড় কম খেতে পারে না? আমাদের আরেকটু দিতে ক্ষতি কী? যাই হোক, আমরাই জোয়ালটা বইবো আর ওকে পয়সা রোজগার করতে সাহায্য করবো। এই তেইশ শতাংশে, আমি জোরের সাথে আপত্তি জানাচ্ছি।”
“তাহলে চলো ভোট নি। বিবিজি আমাকে শুধু মাত্র আজকের রাতটা দিয়েছে ভাবার জন্য।” সাও মু নিজের ঘড়িতে দেখলো, “এখন প্রত্যেকে নিজের নিজের মতামত জানাও।”
মিন হুয়ে জানালো, “উও থোঙ্গি।”
“উও বু থোঙ্গিয়া” বললো হা হাই শিয়াং।
“উও য়িএ বু থোঙ্গি।” বললো শু গুয়াং জিয়াঁ।
“উও থোঙ্গি।” বললো ইয়ান চেং লি।
দুই পক্ষে, বিপক্ষে দুই, সবাই অপেক্ষা করে আছে সাও মুয়ের জন্য।
“আমিও সমর্থন করি না।”
শেষে সাও মু বললো, “তিন বিপক্ষে, দুই পক্ষে। আমি কাল ফোন করে জানিয়ে দেবো শিন ছিকে যে ওঁর প্রস্তাব আমরা গ্রহণ করছি না। মিন হুয়ে, কাল তোমাকে আসতে হবে আমার সাথে ঐ দু জন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলার জন্য। আজ যে রিপোর্ট আমরা দিয়েছি, সেটাই কাল ওঁদের দুজনকে আবার দিতে হবে।”
“কোনো অসুবিধে নেই।” জানালো মিন হুয়ে।
“মিটিং শেষ। ওয়া আ’ন সকলকে।”
***
ঘরে ফিরে এসে মিন হুয়ে তাড়াহুড়ো করে চান করে নিলো এটাই ভাবতে ভাবতে যে ব্যপারটা বোধ হয় ভালোই হলো যে ম্যানেজমেন্ট টিম কাজ করতে চাইলো না শিন ছির সঙ্গে। এখনো ওর আর শিন ছির মধ্যে অনেকগুলো অস্পষ্ট জট রয়ে গেছে। যদি একজন ঊর্ধতন আর অপরজন অধস্তন হিসেবে কাজ করতো, তবে ঐ সব জটিল আবেগ নিয়ে কাজ করা মুস্কিল হতো। শিন ছির প্রস্তাবটা সেরা নয়, কিন্তু খারাপও নয়। তেরো কোটি খুব কম নয়, হয়তো টাকাটা অন্য কাউকে দেওয়াও হবে না। আর টাকাটা তুলে আনতে অনেক পরিশ্রমও করতে হবে। ও যে রকম ঝট করে টাকাটার কথা বললো, যাই হোক, এটা এরকম সাহায্যই।
সারা রাত ট্রেনে বসে, এক ঘন্টা ধরে একটা রিপোর্ট দিয়ে, মিন হুয়ে একটু যেনো ক্লান্তই হয়ে পড়েছে। বিছানায় শুয়ে ও যে পিপিটিটা মিটিং-এর জন্য তৈরি করেছে সেটা দেখছিলো।
ঝিমোতে ঝিমোতে ও প্রায় ঘুমিয়েই পড়ছিলো, এমন সময়ে ওর ফোন বেজে উঠলো খুব জোরে। ডিসপ্লেতে দেখলো, শিন ছি।
“ঘুমিয়ে পড়েছিস?” শিন ছি জানতে চাইলো।
“এখনো না।”
“এখানে আসতে পারবি?” ওর গলায় খানিক হতাশা। “ছন ছন কিছুতেই ঘুমোবে না। যে ভাবেই ভুলোনোর চেষ্টা করি না কেনো,ও তোকে ছাড়া ঘুমোবে না।”
ফোনের ওপাড় থেকে সু ছনের কান্নার শব্দ আসছে। অনেক ক্ষণ কাঁদার পরে ওর গলার স্বরটা কর্কশ হয়ে গেছে, শুকনো চিৎকারের মতো শোনাচ্ছে।
“সত্যিই? ওর তো চেনা অচেনা আছে বলে মনে হয় নি। এখন মনে হচ্ছে যে ও অচেনা লোক দেখলে ভয় পায়, বা অচেনা বাড়িতে থাকলে, বিশেষ করে প্রথমবার তো বটেই।”
“আমি এখনই আসছি।” মিন হুয়ে তক্ষুণি উঠে পড়লো।
“আমি ড্রাইভারকে বলছি তোকে নিয়ে আসতে।”
“আমি রাস্তায়।”
হয়তো কাজের সুবিধের জন্যই শিন ছির অ্যাপার্টমেন্ট ফিনান্সিয়াল স্ট্রিটের একে বারে মধ্যিখানে।
মিন হুয়ে এলিভেটরে করে একদম সব থেকে ওপরের তলায় উঠে গেলো। যেই এলিভেটরের বাইরে পা রাখলো দেখতে পেলো শিন ছিকে। শিন ছি ওকে নিতে এসেছে এলিভেটরের কাছে। কোলে ছন ছন। বাবা আর ছেলে দুজনেই কালো পাজামা পরে আছে, একই ধরনের। দুজনেরই কন্ঠার হাড়ের নিচে, বুকের ওপরে লম্বা ক্ষত দাগ।
তার ওপরে, দুজনকার মুখশ্রীতে খুব মিল। দুজনে ঝকঝকে চেহারায় মিন হুয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো যেনো তারা একই লোকের শিশু দশা আর প্রাপ্তবয়স্ক দশা। একটা ব্যাখ্যাতীত আনন্দের অনুভূতি।
“ম-অম!” সু ছন ডেকে উঠলো আর ঝাঁপিয়ে পড়লো মিন হুয়ের কোলে।
“ও এখনই ঘুমিয়ে পড়বে। ও ঘুমোনোর আগে বায়না করবেই, সবসময়।”
মিন হুয়ে ছেলে নিয়ে নরম গলায় বললো, “ছন ছন, মমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।”
সু ছন দুবার হাই তুললো। মিন হুয়ের বুক ছুঁলো ওর ছোট্টো হাত দিয়ে। মিন হুয়ে একটা কালো রঙের বটমিং শার্ট পরে ছিলো। সু ছন ছুঁতে পারলো না, খামচাতে লাগলো রাগ করে।
শিন ছি তাড়াহুড়ো করে বললো, “দাঁড়া। এক মিনিট। আমি তোকে পাজামা দিচ্ছি।”
মিন হুয়ে বসার ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচুর জায়গা অ্যাপার্টমেন্টটাতে। সাজগোজে একটা হিম হিম ভাব, সরল নকশা, একটা শীতল ঔদাসীন্য আছে। সদরের সামনেটা কালো মার্বেল দিয়ে ঢাকা মেঝে। বসার ঘরে অর্ধবৃত্তাকার রূপোলি-ধূসর সোফার সেট আছে, একটা ব্রোঞ্জের চায়ের টেবিল, ধবধবে সাদা কার্পেট, দুপাশে আধমানুষ উঁচু রূপোর মোমবাতিদান। সব আসবাবের পা গুলো ধাতুর, এমনকি দেওয়ালের ছবির ফ্রেমগুলোও ধাতুর আর খাবার ঘরের ঝুলন্ত আলোটাও ধাতুর - হিমেল জেল্লা সমেত। নানা জ্যামিতিক আকারের বাতি নানা রঙের আর নানান ঔজ্জ্বল্যের আলো আর ছায়া দিচ্ছে চতুর্দিক থেকে। পুরো দক্ষিণের দেওয়াল জুড়ে মেঝে থেকে ছাদ অবধি কাঁচের জানলা আর ফিনান্সিয়াল স্ট্রিটের রাতের পুরো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
শিন ছি নিয়ে গেলো মিন হুয়েকে শোবার ঘরে। মিন হুয়ে জামাকাপড় বদলে পাজামা পরে নিলো। ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে, নিজে তার পাশে শুয়ে পড়লো। সু ছন নিজের দু হাত দিয়ে মায়ের দু হাত জড়িয়ে ধরলো, সন্তুষ্টির হাসি হেসে, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিন ছিকে বললো, “পাপা, এখানে ঘুমোও।”
শিন ছিকেও শুতে হলো। মা-বাবা দুজনের মাঝে বাচ্চা যেনো স্যান্ডউইচ।
“বাবা, আমি তোমাকে একটা নার্সারি রাইম শোনাবো, এটা আমাকে আমার মা শিখিয়েছে -”
সু ছন শিশু কন্ঠে গেয়ে উঠলো, “দুধেল গাই ফুলে ভরা, আর দুধ দেয় হাজারো পরিবারকে। আমি রোজ খুব খাটি আর কাজে লাগি খুব, ঘাস কাটার জন্য ‘শিয়া শিয়া নিয়া’ -”
শুনে চোখ পাকিয়ে শিন ছি বললো মিন হুয়েকে, “এ কী ভুতুড়ে ছড়া?”
“খারাপ কী? আমি তো রোজ এই ছড়ার ভরসাতেই ওকে ঘুম পাড়াই।” মিন হুয়ে হাসতে হাসতে বললো, “বাচ্চা তো শুধু মায়ের গলার স্বর শুনতে চায়, ঘুমোনোর জন্য।”
“আমার মনে হয় যে ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ার বদলে আরো তেজী হয়ে উঠছে,” বাঁকা হেসে বললো শিন ছি, “বাবার জন্য আরেকটা গান, ছন ছন।”
“বড়ো চালকুমড়ো, ছুঁলে ঠান্ডা লাগে। ছোট্টো ভালুক ফুটি জড়িয়ে শুতে গেলো বিছানায়। খুব গরম কিনা, বড়ো ঠান্ডা ফুটি জড়িয়ে ছোট্টো ভালুক গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।”
তার সঙ্গে হাত-পা নাড়িয়ে দোল দেবার ভঙ্গী করলো।
“শুই জাও, আমার চালকুমড়ো।” দীর্ঘশ্বাস ফেললো শিন ছি।
সু ছন চোখ কুঁচকোলো, মুখ রাখলো মিন হুয়ের কাঁধে, শিন ছি যদি পালিয়ে যায় সেই ভয়ে, পা-টা তুলে দিলো শিন ছির পেটে, আর বিড়বিড় করতে লাগলো, “ছোট্টো হাঁস, সব হলুদ। চ্যাপ্টা ঠোঁটটা লাল। পায়ের তলাটাও। জোরে জোরে গান গেয়ে, নেচে বেড়ায় পুকুরে …”
শেষে, গলার স্বর আস্তে আস্তে পড়ে গেলো।
হাঁসের কথা শুনে মিন হুয়ে অন্য মনস্ক হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য, আরো খানিক ক্ষণ পরে নরম ভঙ্গিমায় বললো, “শিন ছি, তোর কী এখনো মনে আছে আঁয়া গ্রামের গুহুয়া য়ুর কথা?”
শিন ছি হাই তুললো, “হ্যাঁ।”
“অনেক দিন খাই নি। চিরকাল মনে থাকবে স্বাদটা।”
শোবার ঘরের আলোটা নিস্তেজ। মিন হুয়ের শূণ্য দৃষ্টি গিয়ে পড়লো ছাদে, “সুগন্ধী আর মশলাদার।”
“ইয়ুন লু জানে কেমন করে রাঁধতে হয়। তোর খেতে ইচ্ছে করলে ওকে বললেই পারিস।”
“মাছটা আলাদা।”
“কেবল পোনা মাছই তো তাই না?”
“স্বাদে তফাৎ আছে। যে পোনাটা গুহুয়া খেয়েছে, আর যে পোনাটা উপত্যকার ফুল খায় নি তাদের স্বাদ এক রকম হয় না।”
“ওকে, আমি পরে আবার একবার খাবার সুযোগ করে নেবো।”
“শিন ছি?”
“হুহ,?”
“তোর কী নিফঁইয়ো আছে?”
“না।”
“কী করে? এতোগুলো বছর কেটে গেছে। আমি বিয়ে করেছি, ডিভোর্সও হয়ে গেছে। আর তোর একটা গার্লফ্রেন্ডও নেই?”
“না।”
“তাহলে কতোগুলো ব্যাপার … কী করে সমাধান হবে?” মিন হুয়ে পাশ ফিরলো, অন্ধকারে চোখ কুঁচকে তাকালো শিন ছির দিকে।
“এসব জিজ্ঞেস করছিস কেনো?" শিন ছির গলায় আলস্য।
“কৌতুহল।” মিন হুয়ে ঢোঁক গিলল, বললো, “আমি জানতে চাই তুই কী করে অটল অবিচল আছিস।”
“আমি অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকি।”
“অন্যান্য … ব্যাপারটা কী?”
“উদাহরণঃ টাকা করা।”
“আরেকটা উদাহরণঃ সু তিয়াঁর জন্য অপেক্ষা করা।”
মিন হুয়ে বেশ খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “অপেক্ষা - সেটাও একটা ব্যাপার? তুই কিছুই করিস নি।”
“নিশ্চয়ই অপেক্ষা করা একটা ব্যাপার। সু তিয়াঁর জন্য অপেক্ষা করা আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো ব্যাপার।”
ওর গলার স্বর চড়লো, ওকে দেখে মনে হলো যেনো ও প্রস্তুত যে কোনো মূহুর্তে ঝগড়া করার জন্য।
ও যেই বললো এটা অমনি মিন হুয়ের ইচ্ছে হলো ওর সামনে থেকে চলে যেতে। ছেলের দিকে একবার তাকালো, বললো, “আমার মনে হচ্ছে ছন ছন ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“দাঁড়া। ও ঘুমিয়ে পড়ে ছিলো তুই আসার আগেই। তারপর জেগে উঠে ছিলো যেই আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে গেলাম।”
“ঠিক আছে।”
একটা শব্দও ব্যয় না করে, দুজনে কথা বলে গেলো বিছানায়, আস্তে আস্তে চোখও বুজে এলো দুজনের।
ভোরে মিন হুয়ে টের পেলো যে ও কুঁকড়ে শুয়ে আছে শিন ছির বাহুপাশে। শিন ছি এমনভাবে আঁকড়ে আছে মিন হুয়েকে যেনো একটা মানুষ সমান বালিশ আঁকড়ে আছে।
গরম, মিন হুয়ে ঘামছে।
মিন হুয়ে অল্প চেষ্টা করলো নিজেকে ছাড়ানোর, কিন্তু ভেঙে বেরোতে পারলো না। শিন ছি গভীর ঘুমে ডুবে আছে। ওর চুলগুলো ঝামড়ে পড়েছে কপালে। মুখটা চেপে আছে মিন হুয়ের কানের ওপর। শ্বাস শান্ত আর দীর্ঘ। শ্বাসের হাওয়ায় মিন হুয়ের কানে হালকা কুটকুট করছে।
আর কোনো উপায় না দেখে মিন হুয়ে হাত দিয়ে শিন ছির গালে হালকা হালকা চাপড় দিলো, “শিন ছি, জাগ, ওঠ।”
হঠাৎ ও চোখ খুললো, আধা ঘুমে আচ্ছন্ন অবস্থায় মিন হুয়ের দিকে দেখলো, তারপর চারপাশে দেখলো, “হুহ? তুই চলে যাস নি?”
“তুই আমাকে একটুক্ষণ শুতে বললি। আমি ক্লান্ত ছিলাম, আগের রাতে ট্রেনে কাটিয়েছি, আমি ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম।”
“তুই …কিছু করিস নি তো, করেছিস?” বললো শিন ছি।
মিন হুয়ে রেগে গেলো। লেপের নিচে শিন ছিকে একটা কষে লাথি মারল, “আমি কী করতে পারি? আমি তো জিজ্ঞেস করি নি তুই কী করেছিস!”
“দ্যুইবুচি, আমি ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম।” ক্ষমা চেয়ে হাসলো, কোমর সোজা করে উঠে বসলো, আর ওর মুখের ফ্যাকাশে হয়ে গেলো, “ছন ছন কই?”
চমকটা গুরুত্বহীন। মিন হুয়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো, চারপাশে দেখলো, কোথাও ছেলেকে দেখতে পেলো না, চীৎকার না করে পারলো না, “ছন ছন, কোথায় গেলে? যাহ্ চলে গেছে!”
“জলদি! জলদি! পুলিশে ফোন কর! এক এক শূণ্য!”
উদ্বেগে শিন ছি অসুস্থ বোধ করতে লাগলো হঠাৎ। বললো, “তাড়াতাড়ি কর! লেপটা ঝট করে তুলে দেখ। এর নিচে চাপা পড়ে যায় নি তো!”
শুরুতে মিন হুয়েও খুব ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু শিন ছির ফ্যাকাসে মুখ আর বেগুনী ঠোঁট দেখে একটা জোর শ্বাস নিলো। তারপরে এক ঝটকায় লেপটাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। খালি বিছানার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো, “ও লেপের নিচে নেই! শিন ছি, চুপ করে বোস। এখনই ফোন করিস না। আমি বসার ঘরে যাচ্ছি, গিয়ে দেখছি ও ওখানে আছে কিনা, হতে পারে বাথরুমে আছে।”
“বাথরুম তো সামনেই, ওর ভেতর থেকে কোনো শব্দও আসছে না।”
শিন ছি পাগলের মতো চেঁচালো, বুকটা খামচে ধরে, হাঁপাতে হাঁপাতে, “ও বাথরুমে নেই, বাথরুমে নেই ও, ও গেছে, আমার ছেলেটা গেছে, হারিয়ে গেছে, আমার নিজের বাড়ির বিছানা থেকে গায়েব হয়ে গেছে, হে ভগবান!”
ও লাফাতে লাগলো আতঙ্কে, চেঁচাতে লাগলো, প্রায় কাঁদতে লাগলো।
মিন হুয়ে ওর কাঁধ চেপে ধরে নরম সুরে বললো, “না, ছন ছন বেশ চালাক চতুর, অ্যাপার্টমেন্টটাও নিরাপদ, ও হারিয়ে যায় নি, আমি ওকে ঠিক খুঁজে পাবো। চিন্তা করিস না, শিন ছি, আমার দিকে দ্যাখ - - একটা লম্বা শ্বাস নে, শান্ত হ।”
ভয়ার্ত চোখে শিন ছি তাকালো মিন হুয়ের দিকে। ওর মুখ আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ওর ঠোঁটের রং আরো গাঢ় যেনো, শ্বাস পরছে ঘনঘন।
মিন হুয়ে ভাবছে, সু ছনকে যদি খুঁজে পাওয়া না যায় তো, এ লোকটাও অসুস্থ হয়ে পড়বে। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে মিন হুয়ে জোর করে ভাবতে লাগলো। দু সেকেন্ড পরে মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে খাটের তলাটা এক নজরে দেখে নিলো। সু ছন খাটের তলায়, অনেকটা ভেতর দিকে শুয়ে আছে। মিন হুয়ে জানে না যে ও কিভাবে ওখানে গেলো। মিন হুয়ে দুম করে চেঁচিয়ে উঠলো, “আমি পেয়েছি ওকে। আমি পেয়েছি, খাটের তলায়, ও আছে খাটের তলায়।”
শুনেই শিন ছি খাট থেকে নেমে এলো। খাটের নিচে দেখলো, আরো ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো, “ও নড়ছে না কেনো? ওর কী হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, ও মরে গেছে? মিন হুয়ে, আমার ছেলে মারা গেছে … আমার ছেলে মারা গেছে …”
“না, মারা যায় নি, ঘুমিয়ে আছে, এখনো জাগে নি।”
“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। অনেকগুলো সেকেন্ড কেটে গেছে, ও একবার চোখ পিটপিটও করলো না …”
এতো ভয় পেলো শিন ছি যে ও মিন হুয়েকে কষে জাপটে ধরলো, কাঁপতে লাগলো থরথর করে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে, যেনো শ্বাস ফেলতেও ওর ভয় করছে।
মিন হুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, কোনো উপায় না দেখে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলো খাটের নিচে। টেনে বার করে আনলো সু ছনকে।
অবাক কান্ড, ছেলেটা এতো গভীর ঘুমে মগ্ন যে ওকে যে টেনে বার করে নিয়ে এলো মিন হুয়ে খাটের তলা থেকে সেটা ও টেরও পেলো না।
শিন ছির মুখ ক্রমে ক্রমে ধূসর হলো -
মিন হুয়ে তাড়াহুড়ো করে ছেলেকে বুকে আঁকড়ে নিয়ে এলো শিন ছির সামনে, “ও মরে যায় নি, দ্যাখ নিজে, ওর হাতগুলো গরম। আর, এই যে, ছুঁয়ে দ্যাখ, হৃদস্পন্দন।”
শিন ছি কাঁপতে কাঁপতে ওর হাতটা সু ছনের বুকে রাখলো। ওর হৃদস্পন্দন অনুভব করলো। তারপর স্বস্তিতে ঘাড় নাড়লো। কিন্তু তখনো হাঁপাচ্ছিলো।
মিন হুয়ে ছেলেকে ফের খাটে শুইয়ে দিলো। টেনে শিন ছি কে তুলে বসালো। নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো, “অক্সিজেন কোথায়?”
শিন ছি ক্যাবিনেটের দিকে দেখালো। মিন হুয়ে ক্যাবিনেট খুলে একটা হালকা মেডিক্যাল অক্সিজেন সিলিন্ডার বার করলো, তার স্ক্রু খুলে ফেললো, শিন ছিকে একটা অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে শ্বাস নেবার ব্যবস্থা করে দিলো।
“ঠিক আছে?” মিন হুয়ে বসলো শিন ছির পাশে। চোখ বড়ো বড়ো করে দেখলো শিন ছিকে, “ডাক্তারকে ফোন করার দরকার আছে?”
শিন ছি মাথা ঝাঁকালো।
মিন হুয়ে দশ মিনিট চুপ করে শিন ছির পাশে বসলো। ওর মুখের রং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে দেখে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো, হাসি মুখে বললো, “আমি বরং ছেলেটাকে নিয়ে যাই। সাও মু ওর খেয়াল রাখবে না হয়। তুই বরং আজকে ছেড়ে দে ওকে।”
“দরকার নেই। আমার তো বেশ ভালোই লাগছে। আমি খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবো।”
শিন ছি নরম স্বরে বললো, “আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। ও খাটের তলায় গেলো কী করে?”
“মেঝেতে ঘুমোতে লাগল?”
মিন হুয়ে বললো, “সেই জন্যই আমার খাটের পায়াগুলো নিরেট। আমি ভাবতেই পারি নি যে তোর খাটের পায়াগুলো এতো উঁচু হবে আর নিচেটা এতো খালি হবে। ওখানে তো তিনটে —”
“আমি ভয়ে মরেই যাচ্ছিলাম।” শিন ছির চোখে মুখে তখনো আতঙ্কের ছাপ।
ওর হৃদপিন্ডের অসুখটা সু ছনের অসুখের তুলনায় অনেক বেশি গুরুতর। ওর ভয়ে মরে যাবারই কথা।
উল্টোদিকের দেওয়ালে সূর্যের আলো এসে পড়লো। মিন হুয়ে টের পেলো যে ওখানে অনেকগুলো ছবি লাগানো রঙীন ফ্রেমে আছে। সবকটাতেই সু তিয়াঁর ছবি, যেগুলো সু তিয়াঁ পোস্ট করে ছিলো মোমেন্টসে। মিন হুয়ে অনেকক্ষণ বুঝতে পারে নি কারণ ছবিগুলো বড়ো করে তেলরঙে আঁকা ছবির ঢঙে বানানো হয়েছে।
হঠাৎ করে ওর পিঠে যেনো একটা কাঁটা বিধল।
“তোর মিটিং কখন?”
শিন ছি বিছানার পাশে রাখা ইলেকট্রনিক ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললো, “তাড়াতাড়ি কর। আমি ড্রাইভারকে বলছি তোকে ছেড়ে দিয়ে আসতে।”
মিন হুয়ে চলে যেতেই চাই ছিলো, কিন্তু দুশ্চিন্তাও হচ্ছিলো ওর, “তুই একলা পারবি? তুই শেন হানকে ডেকে নিচ্ছিস না কেনো,তোর দেখাশোনার জন্য?”
“আমি ঠিক আছি।”
তারপর বললো, “এই মিটিংটায় আমিও যাবো। কিন্তু তার আগে আমাকে কোম্পানিতে যেতে হবে কয়েকটা ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে। যাবো তোর সঙ্গে সঙ্গেই, ঠিক আছি আমি।”
“তাহলে আমি আগেই চলে গেলাম। হুইতৌ জিয়াঁ।”
কোট হাতে নিয়ে ও উঠে দাঁড়ালো।
“ওকে।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-47.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-49.html