৪৭. বেচা কেনা
শিন ছি ঠিক করে ছিলো যে মা আর ছেলেকে ফরাসী খানা খাওয়াতে নিয়ে যাবে। কিন্তু সু ছনের আপত্তি ছিলো। ওর ইচ্ছে ও চিকেন ম্যাকনাগেটস্ খাবে। সেই জন্য ওদেরকে যেতে হলো কাছাকাছি ম্যাকডোনাল্ডসে।
আশাতীতভাবে ভেতরে প্রচুর লোকের ভিড়। ওদেরই বয়সী মা-বাবাদের ভিড়। পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হলো একটা বসার জায়গা পাবার জন্য।
মিন হুয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলো শিন ছিকে। শিন ছির অধৈর্য স্বভাবে এতো লোক দেখে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে পারে। তার ওপরে একটা বাচ্চা ছেলে এক কাপ কেচাপ উল্টে দিলো শিন ছির জুতোতে। শিন ছি রাগ করে নি, শুধু মিন হুয়েকে বললো সু ছনকে আগলাতে। এগোলো সেলফ্-সার্ভিস অর্ডার দেবার মেশিনে গিয়ে খাবার অর্ডার করতে।
“কতো দিন চলবে তোর মিটিং?” শিন ছি জিজ্ঞেস করলো মুখের মধ্যে পোরা মাছ খেতে খেতে।
“দু দিন। আমার অংশ একদিনের, সেটা কালকে।”
“সকালে না দুপুরে?”
“সকালে একটা ফোরাম, দুপুরে রিপোর্ট।”
“ওয়াও, এআই ম্যাক্স বেশ বড়ো জাতের কনফারেন্স ইন্ডাস্ট্রিতে। তুই একলাই একটা রিপোর্ট দিবি, তার মানে তুই খুবই পটু।”
মিন হুয়ে ওর দিকে তাকালো আর হাসলো, “আমি খুবই পটু।”
“কিন্তু যথেষ্ট বিনয়ী নস।” জুড়ে দিলো শিন ছি।
“তোর সামনে বিনয়ের দরকার নেই।" মিন হুয়ে একটা কামড় দিলো বিফ বার্গারে, “তোর চোখে আমি সব সময়েই খারাপ। তাই আমি নিজেকে একটু বেশি ভালো করে দেখাই, যাতে তুই একটা সঠিক গড় পাস।” ও বললো আবার। আর দু চোখ দিয়ে ঝলসে দিলো শিন ছিকে।
“বাবা, আমি আর খেতে পারবো না।”
সু ছনের এতো খিদে পেয়ে ছিলো যে ও চিকেন ম্যাকনাগেটস্-এর সাথে একটা চিজ বার্গারও অর্ডার করে ছিলো। কিন্তু ম্যকনাগেটস্ খেয়ে নিয়ে, চিজ বার্গারে কয়েক কামড় দিয়ে ও আর খেতে পারলো না।
শিন ছির হাতে গুঁজে দিয়ে বললো, “খেয়ে নাও এটা। নষ্ট কোরো না।”
শিন ছি আনমনে নিয়ে নিলো, বকি বার্গারটা দু কামড়ে চালান করে দিলো পাকস্থলীতে।
মিন হুয়ে এক মূহুর্তের জন্য অবাক হয়ে গেলো, ওর দিকে তাকিয়ে, ওর মন যেনো একটু টলে গেলো।
ঝৌ রু জির ভীষণ তীব্র সংস্কার আছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে। ও কোনো এঁটো খাবার খায় না, আধ-খাওয়া খাবারের কথা তো বাদই দেওয়া যায়, সেটা মিন হুয়েরই হোক আর সু ছনের।
কী খাবে তাই নিয়ে শিন ছির ভীষণ খুঁতখুঁতুনি। কিন্তু এইবারে ও দুবার ভাবলো না, কিছু মনেও করলো না।
“আমি ম্যাকডোনাল্ডসে খায় নি অনেক বছর। দশ বছর তো হবেই।" হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেললো শিন ছি, “যখন আমি হাইস্কুলে পড়ি, তখন আমাদের ইস্কুলের কাছেই ম্যাকডোনাল্ডস্ ছিলো। আমি তো রোজ খেতে যেতাম ওখানে। কিছুতেই অরুচি হতো না। আমার ওজন বেড়ে গিয়ে ছিলো এক সময়ে। আমার বাবা তাড়াহুড়ো করে ব্যবস্থা নিয়ে ছিলো।”
“তুই? মোটা?”
“হ্যাঁ। এদিকে আমি বেশি ধকলের ব্যায়াম করতে পারবো না। আমি বাড়িতে থাকতাম রোজ, আরো খেতাম, আরো মোটা হতাম।”
“তারপর?”
“আমার বাবা চটপট সিন্ধান্ত নিলো, আমার ইস্কুল বদলে দিলো। ইস্কুলে একটা গ্রীক রেস্টুরেন্ট ছিলো কেবল। তাও আমি রোজ খেতে যেতাম। আর আমার ওজন কমে গিয়ে ছিলো।”
শিন ছি কেবলমাত্র তখনই ফেলে আসা দিনের কথা বলে যখন ও খুব নিরুদ্বিগ্ন থাকে। মিন হুয়ে হাসলো, চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো।
ও এখনো সুদর্শন, তাজা আর ঝলমলে যেখানেই বসুক না কেনো, একটা আত্মমগ্ন মহিমা থাকে ওর প্রত্যেক ভঙ্গিমায়।
আজ একটা ঘন নীল রঙের স্যুট পরেছে, হালকা নীল শার্ট, গাঢ় ধূসর রঙের চৌখুপি কাটা টাই, কালো অক্সফোর্ড জুতো। বুক পকেটে একটা সিল্কের স্কার্ফ ওয়ান-লাইন ভাঁজে সাজানো। চুল খুব গুছিয়ে আঁচড়ানো। ব্যবসার জন্য মানানসই প্রথামাফিক সাজগোজ যেনো এক্ষুণি বসে একটা চুক্তি করে ফেলবে যে কোনো সময়ে।
কালো অক্সফোর্ড জুতো |
রোগা চেহারা হলেও ওর মুখটা ছোট্টো অ্যানিমে চরিত্রদের মতো। মুখের সমস্ত অঙ্গ খুব জীবন্ত। খুব নিষ্পাপ হাসিও শীতল আর উদ্ধত দেখায়।
নিচের ঠোঁট আর চিবুকের মধ্যে একটা গর্ত আছে। তার সঙ্গে একজোড়া স্পষ্ট কঠিন চোয়ালের হাড়, গোল আর মসৃণ করোটি। ত্রিমাত্রিক আর কৌতুকে ভরা। পাশের দিক থেকেও মুখটাকে সুন্দর দেখায়।
যাই পরুক না কেনো, ওকে যেমনই দেখাক না কেনো, চারপাশের সব কিছুর মধ্যে ওর ওপরে নজর পড়বেই।
এমনকি সু ছনও মনে করে যে ওর সঙ্গে থাকাটা মজার, একটা ব্যাপারেই ও খুব সজাগ, ও ওর বাবার সঙ্গে আছে কিনা।
মিন হুয়ে একটু খাপছাড়া বোধ না করে পারলো না।
“কোন হোটেলে আছিস?” জানতে চাইলো শিন ছি, “আমি বাচ্চাকে ফেরত পাঠাব যাবার সময়ে।”
“শেরাটন। আমি একটু পরে তোকে ঠিকানা আর ঘরের নম্বর দিচ্ছি।”
ও ঘাড় নাড়লো, টিস্যু দিয়ে মুখ মুছলো, জলে একটা চুমুক দিলো, হঠাৎ প্রশ্ন করলো, “তুই লিন শি য়ুয়ে কে চিনিস?”
মিন হুয়ে শুধু একটা “হুম্” শব্দ বেরোতে দিলো। আর নামটা শোনা মাত্রই ওর খারাপ লাগতে শুরু করলো।
“ও বিবিজির সেলস্ ডিরেক্টর। চেন য়ুআঁ ওকে চাকরি দিয়েছে।”
“ওকে চেং ছিরাং ছেড়ে দিলো কেনো?”
“তাহলে তুই জানিস যে ও কাজের?”
“হ্যাঁ।”
“আমরা ওকে কাজ দিয়েছি বেশি মাইনে দিয়ে।” শিন ছি কৌতুহল নিয়ে মিন হুয়ের প্রতিক্রিয়া দেখছিলো, “তোর কী কোনো অসন্তোষ আছে ওর প্রতি?”
“হ্যাঁ” মিন হুয়ে স্বীকার করলো, “কিন্তু তার সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নেই।”
“আমি কী জানতে পারি এটা কী ধরনের অসন্তোষ?”
“আমার বলতে ইচ্ছে করে না। কেউ আমাকে বিশ্বাস করে না। আর ঐ দিনগুলো আমি কাটিয়ে এসেছি।” মিন হুয়ে এড়িয়ে গেলো শিন ছির সোজা দৃষ্টি, “আমরা বন্ধু ছিলাম।”
“তাহলে এখন -”
“আমাদের মুখ দেখাদেখি নেই।”
শিন ছি চমকে উঠলো, “এতো গুরুতর?”
মিন হুয়ে নাক ডাকিয়ে ঠান্ডা সুরে বললো, “পৃথিবীতে দু রকমের লোক হয়। প্রথম ধরনের লোকের স্বভাব অপরকে সন্দেহ করা। এদেরকে কিছু বিশ্বাস করানো খুব কঠিন, একবার বিশ্বাস করলে এরা শেষ পর্যন্ত সেই বিশ্বাসটাই আঁকড়ে থাকে। আর বিশ্বাস যাকে করেছে তার সাথে ঘনিষ্ঠতাও তৈরি করে। আর দ্বিতীয় ধরনের লোক ঠিক এর উল্টো। তারা সহজেই বিশ্বাস করে, সব কিছু বিশ্বাস করে, মনে করে অপরে যা বলছে তার সব সত্যি। কিন্তু একবার যদি তারা জানতে পারে যে তাদের মিথ্যে বলা হয়েছে, তারা আর মিথ্যেবাদীর একটাও শব্দ বিশ্বাস করবে না। আর সমস্ত ক্ষতি বন্ধ করার জন্য মিথ্যেবাদীর সঙ্গে সব সম্পর্ক তুলে দেবে। ঈশ্বরও ঠিক করেছেন, এই দু ধরনের লোকেদেরই ন্যায্য প্রাপ্য দেবেন। তাই এদের নিজের নিজের লাভও আছে, ক্ষতিও আছে। শেষে কারোরই বেশি ক্ষতি হয় না। আমি দ্বিতীয় ধরনের।”
“আমি প্রথম দলে।” শিন ছি ঘাড় ঝাঁকালো, “আমি শুনেছি তুই নাকি বা’অ্যানের এমবিও-তে আছিস? তোর বস সাও মু আজ রাতে আমার সাথে কথা বলতে চায় বলে জানিয়েছে।”
“এমবিও?”
“ম্যানেজমেন্ট বাই আউট, মানে হলো, ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ বাই আউট।”
“হ্যাঁ।”
“আমি সাও মুকে বলেছি যে আমি বা’অ্যানের সায়েন্টিফিক রিসার্চ করার ক্ষমতার কথা বিশেষ জানি না। আমি আশা করছি যে তুই আমার একার জন্য একটা প্রেজেন্টেসন দিতে পারবি। সাও মু বললো যে তুই আসতে চাইছিস না। উনিই প্রেজেন্টেসনটা দেবেন যদিও পিপিটিটা তোর বানানো।”
“তা বটে।”
“মিন হুয়ে -” শিন ছি একটু যেনো ধাঁধায় পড়েছে, “আমি তোর মনোভাবের প্রশংসা করতে পারছি না। তোর আর আমার মধ্যের ব্যাপারটার সঙ্গে ব্যবসার কোনো সম্পর্ক নেই। তুই এমবিও চাস, আমি সম্ভাব্য ক্রেতা, এ নিয়ে এতো মাথাব্যাথা করছিস কেনো?”
“...”
“ – কারণ আমি তোকে অপ্রস্তুত করতে চাই না।”
শান্তভাবে বলে উঠলো মিন হুয়ে, “লগ্নিতে ঝুঁকি আছে। আমি চাই না যে তুই ভাবিস যে আমি তোর থেকে সুবিধে নিচ্ছি।”
“তুই সত্যিই বেশি ভাবছিস।”
“তাছাড়া, তোর এতো মাথা গরম, তুই প্রত্যেক পদে খোঁটা দিস, খুঁত খুঁত করিস। আমি কিছুতেই তোর জন্য বেশি দিন কাজ করতে পারবো না। যখন সময় ঘনাবে, তখন প্রবল রাগে আমি কাজ ছেড়ে দেবো … আমার ভয় এই যে তাতে তোর ক্ষতি হবে।”
“কী রকম ক্ষতি হবে?”
“আমি মূল প্রযুক্তিওবিদ।”
শিন ছি চমকে গেলো এক মূহুর্তের জন্য, তারপর হাসলো, বললো, “আমি বদমেজাজী। আর তোর মেজাজ ভালো। প্রত্যেকবার তুই ঝগড়া করিস, তাতে তুই আমাকে তোর ভেতরটা দেখতে দিস। অনেক দিন কেটে গেলে, তুই এটাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবি। সত্যিই একবারও চেষ্টা করে দেখবি না? এমনও হতে পারে যে আমরা ভালো সহকর্মী?”
“আমিও বদমেজাজী।” সোজাসুজি বললো মিন হুয়ে, “আমি তোকে মেজাজ নিতে দিচ্ছি শুধু সু তিয়াঁর জন্য। আমি জানি না আমি আর কতো দিন এটা করতে পারবো।”
“তার দরকার নেই। তুই তোর মতো। সেই জন্য তোর অন্য কারুর ভূমিকা পালন করার দরকার নেই।”
“আমি অন্য কারুর ভূমিকা পালন করি নি। আমি সেই মানুষ যে বদমেজাজী আর আমিই সেই লোক যে মেজাজ হজম করে ফেলে সু তিয়াঁর ঋণ শোধ করার জন্য।”
“ওকে।” শিন ছি হেলান দিয়ে বসলো আর সরাসরি বললো, “তাহলে আমি এটাই বুঝলাম যে তুই আমার সাথে কাজ করতে অস্বীকার করছিস, তার মানে, আমি আজকে সাও মুয়ের সাথে কথা নাও বললে চলে?”
“তা নয় …” মিন হুয়ে মাথা চুলকে বললো, “তুই সাও মুয়ের সাথে কথা বলতেই পারিস, তুই বা’অ্যান কিনেও নিতে পারিস। আমি এটাই বলতে চাই যে আমি তোর কাছে কাজ করতে পারবো না বেশি দিন কারণ তুই বদমেজাজী। তাই ভালো করে মেপে নে। দুম করে বা’অ্যান কিনে ফেলিস না।”
“আমি কখনো কিচ্ছু দুম করে করি না যখন ব্যাপারটা ব্যবসার।”
“তা ভালো।”
ও অনেক ক্ষণ কথা বললো না, তারপরে প্রসঙ্গ বদলালো, “তুই যদি এমবিওতে আছিস, তাহলে ম্যানেজমেন্ট টিমের তো ব্যক্তিগত পুঁজি লগ্নি করতে লাগবে। পরিস্থিতি হলো মূল দামের দশ শতাংশ। তাতে তোর কুড়ি লাখ য়ুআঁর বেশি লাগবে। তোর কী টাকাটা আছে?”
“খানিকটা। না …কিছুটা, খুব বেশি নয়, আমি বন্ধুদের থেকে ধার নিয়েছি কিছু।”
“যেমন?”
“ঝৌ রু জি আমাকে দশ লাখ য়ুআঁ দিয়েছে।”
“তাই নাকি?”
শিন ছির মুখ হঠাৎ করে কালো হয়ে গেলো। তারপরে ও যখন কথা বললো তখন বিষন্নতার আবহাওয়া, “এখনো ওর বাড়িতে একজন রুগী আছে না? তোর সাহস হলো কী করে ওর থেকে টাকাটা চাওয়ার?”
“দুঃখিত। ও টাকাটা নিজে থেকেই দেবে বলে ছিলো। আর পরের দিনই টাকাটা আমি পেয়েও গেছি।”
শিন ছি অবিশ্বাসের চোখে তাকালো, “তুই টাকাটা খরচ করতে চাস?”
“আমি সুদ দেবো।”
“আর কতো বাকি?”
“দশ লাখ।”
“কার থেকে টাকাটা তুই ধার করতে যাচ্ছিস?”
“এমবিও হয়তো সফল হবে না। টাকাটা দরকারও লাগবে না হয়তো। তাই ভাবছি যে অল্প মেয়াদের ব্যক্তিগত ধার নেবো, যাতে সুদের হার কম, তাড়াতাড়ি মঞ্জুরি আর তাড়াতাড়ি টাকাটা পেয়েও যাবো।”
“ব্যবস্থা কর।” আকাশের দিকে তাকালো শিন ছি।
“চিন্তার কিচ্ছু নেই, এখনো সময় আছে।” বললো মিন হুয়ে, “কিছু না কিছু একটা রাস্তা হয়ে যাবে।”
“ঠিক কথা, রাস্তার কাটাকুটি তো কখনো হয় না।” শিন ছি কাগজের কাপটা গোলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলো খাবারের পড়ে থাকা থালার ওপরে।
শেষে রাতে সাও মুয়ের লাগাতার ঘ্যানঘ্যানানি সহ্য করতে না পেরে, মিন হুয়ে সাও মুয়ের সঙ্গে গেলো শিন ছির সাথে দেখা করতে।
যাই হোক, বা’অ্যানের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের দায়িত্ব ওরই। আবার পিপিটিটাও বানিয়েছে ও-ই। তাই ও বা’অ্যানের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কথাগুলো বললে বলবে সাও মুয়ের তুলনায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে। শিন ছিরও সুবিধে হবে প্রশ্নগুলো রাখতে আর উত্তর পেতে।
সাও মুকে লগ্নি জোগাড় করার জন্য ভীষণ পরিশ্রম করতে দেখে মিন হুয়ে মনে করলো যে ওরও কিছু দেবার আছে কারণ ও-ও তো ম্যানেজমেন্ট টিমের সদস্য। “এতো মানসিক চাপ নিতে হবে না তোমাকে।” বললো সাও মু।
“পুবে আলো নেই, পশ্চিমে তো আছে। আমি অন্যান্য লগ্নিকারীদের সঙ্গে কালকে দেখা করবো। কিছু যায় আসে না যদি শিন ছি রাজি না হয়। আমাদের জিএস১.০ আছে। অনেক লোকই আসবে আমাদের কাছে। আমরা তাদেরকে বেছে নেবো, যদি তারা আমাদের বেছে নেয় তো।”
কথাবার্তা হলো বিবিজির কনফারেন্স রুমে। বিবিজির তরফে শিন ছি ছাড়াও ছিলেন সিএফও চেন য়ুআঁ, চিফ টেকনোলজিক্যাল অফিসার লিং জিয়াঁ বো।
প্রথম দশ মিনিট সাও মু সাধারণ একটা পরিচিত দিলেন বা’অ্যানের। তারপরে চল্লিশ মিনিট ধরে মিন হুয়ে কোম্পানি মূল প্রোডাক্টগুলোর কথা বললো আর জানালো আর অ্যান্ড ডির কৃতিত্বের কথা।
তারপরে আরো দশ মিনিট সাও মু বললো কোম্পানির আর্থিক পরিস্থিতির কথা আর বিক্রিবাটা কেমন চলছে সেই সব।
প্রশ্নোত্তর পর্বে কুড়ি মিনিট ধরে মিন হুয়ে উত্তর দিয়ে গেলো লিং জিয়াঁ বোয়ের একের পর এক প্রশ্নের।
তারপরে শিন ছি জানতে চাইলো, “আপনাদের প্রোডাক্টগুলোর জন্য কী সিএফডিএ সার্টিফিকেটের দরখাস্ত জমা দেওয়া হয়েছে? ঐ সার্টিফিকেসন ছাড়া তো বাজারে বিক্রির কোনো যোগ্যতা থাকবে না। অনেক বড়ো হাসপাতালও কিনতে পারবে না, মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স সিস্টেমে যে ঢুকতে পারবে না প্রোডাক্ট সে কথা না হয় বাদই দিলাম।”
“আপনাদের থেকে এইমাত্র এখানে বসে যা শুনলাম তাতে দেখা যাচ্ছে বা’অ্যানকে চালানোর খরচা অনেক। কোনো সার্টিফিকেসন না থাকলে আমাদের একটাই চিন্তা যে কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী উন্নতিতে প্রভাব পড়বে।” জানালেন চেন য়ুআঁ।
শিন ছি সত্যিই দুম করে কেনে না। মিন হুয়ে ভাবলো যে যারা কেবল এই শিল্পক্ষেত্রকে খানিকটা বোঝে তারাই এই গিঁটগুলোর কথা বলবে, আর এই গিঁটগুলো নিয়েই সমস্ত মেডিক্যাল এআই কোম্পানিগুলোর যতো মাথাব্যথা।
সিএফডিএ মানে চায়না ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেসন। নিরাপত্তা আর দক্ষতা নিশ্চিত করতে দেশে কতকগুলো কড়া নিয়মনীতি আছে ওষুধ আর যন্ত্রপাতির গঠন ও ব্যবহার নিয়ে। মেডিক্যাল এআই একটা উঠতি শিল্পক্ষেত্র। তাই দেশে এখনো কোনো একটা মাপকাঠি তৈরি হয় নি। তৈরি হয় নি নিয়ম বা নীতি এই নতুন প্রযুক্তির প্রভাব মাপার জন্য।
“আমাদের প্রোডাক্টগুলোর ক্লাস টু মেডিক্যাল ডিভাইসের সার্টিফিকেট আছে। কতকগুলো প্রোডাক্ট ক্লাস থ্রি ডিভাইস হিসেবে ঘোষিত হবার পথে। আপনারা জানেন নিশ্চয়ই যে ক্লাস টু মেডিক্যাল ডিভাইস সরাসরি প্রাদেশিক ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেসনে দাখিল করা যায়। কিন্তু ক্লাস থ্রি ডিভাইসগুলোর জন্য আগে রাষ্ট্রীয় ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেসনের ছাড়পত্র পাওয়া আবশ্যিক। আর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও লাগে। আমাদের প্রোডাক্টগুলো এখনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে।” জানালো সাও মু।
“চলতি পদ্ধতি অনুযায়ী এআই প্রোডাক্টগুলোকে ছটা ধাপ পেরোতে হয় দরখাস্ত জমা দেওয়া থেকে - প্রোডাক্ট ফাইনালাইজেসন, টেস্টিং, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, রেজিস্ট্রেসন ডিক্লেরেসন, টেকনিক্যাল রিভিউ আর প্রশাসনিক সম্মতি। ছটা ধাপ একসঙ্গে পেরোনো যায় না। একে একে পেরোতে হয়। পরের ধাপের কাজ তবেই করা যাবে যদি আগের ধাপের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়ে থাকে। এখন আমাদের সব ধরনের দরখাস্ত আটকে আছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে। যেহেতু দেশে চিকিৎসার জিনিসের নিরাপত্তার আর দক্ষতার চাহিদা খুব বেশি এই মূহুর্তে, সে জন্য প্রশাসনিক সম্মতি দেবার ব্যাপারে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। এখনো পর্যন্ত কোনো এআই কোম্পানি তিন ধরনের যন্ত্রেরই ছাড়পত্র পায় নি …” বললো মিন হুয়ে।
“কত সময় লাগবে আপনাদের প্রোডাক্টের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হতে, গোণাগুনতি দিন, মাস, বছরের হিসেবে?” প্রশ্ন করলো শিন ছি।
“ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয় দুটো ধাপেঃ প্রস্পেকটিভ আর রেট্রোস্পেকটিভ। আমাদের প্রোডাক্টের প্রয়োজন অনেক বেশি সংখ্যক কেসের, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটা খরচ সাপেক্ষও -”
“খরচ কতো?” জানতে চাইলেন চেন য়ুআঁ।
“প্রায় এক কোটি।” উত্তর দিলো মিন হুয়ে, “আরো দু থেকে তিন বছর লাগবে সব কাজ শেষ হতে।”
“একটা প্রতিষ্ঠিত মেডিক্যাল ডিভাইস কোম্পানি, যা বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, এদের অনেক প্রোডাক্টও নিশ্চয়ই সিএফডিএর ছাড়পত্র পেয়েও যাবে। তবে, বিক্রি করা সহজ হবে যদি যন্ত্রগুলোতে এআই-এর সুবিধে থাকে।” বলে উঠলো শিন ছি।
“য়ুআঁলাই এই ব্যাপারে বিশেষ নজর দেয় নি। তবে আমরা সহযোগিতা করেছি জিনিসটা ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে। ভালো ফলও পাওয়া গেছে।”
একগোছা কাগজ ফোল্ডার থেকে বার করে শিন ছির হাতে তুলে দিলো মিন হুয়ে, “এগুলো হলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। বিজনেস প্ল্যানের সাথে জুড়ে দেওয়া আছে।”
“বিবিজির দং চেং টেকনোলজি যে চিকিৎসার যন্ত্রগুলো বিক্রি করে সেগুলো বেশ দামী। ওরা তিন ধরনের ছাড়পত্রই পেয়েছে। আমরা এই দেশের বাইরেও কাজ করি, ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেসনের ছাড়পত্র মেডিক্যাল এআই-এর ক্ষেত্রে গতি আনতে পারে। যদি আপনাদের প্রোডাক্টগুলো বিবিজিতে যোগ হয়, তাহলে মেগুওয়াতে এফডিএ ছাড়পত্রের জন্য দরখাস্ত করা যেতে পারে আর বিক্রি করা যেতে পারে দং চেং টেকনোলজির যন্ত্রগুলোর সঙ্গে।” বললো শিন ছি।
“হ্যাঁ।” সাও মু হাসলো। প্রায় ঘন্টা দেড়েক কথা বলার পরে, শিন ছি বললো, “সাও জঁ, লগ্নির বন্দোবস্ত কেমন চলছে?”
“আমাদের এখনো ছ কোটি য়ুআঁর লগ্নি লাগবে।”
“বিবিজি তেরো কোটি য়ুআঁ লগ্নি করতে পারে, আর ম্যানেজমেন্ট টিমকে কুড়ি শতাংশ অংশীদারী দিতে পারে।”
শিন ছি খুব সংক্ষেপে জোর দিয়ে বললো, “কিন্তু আমরা লগ্নি করবো একচেটে হিসেবে। অন্য দুটো লগ্নিকারীকে সরে যেতে বলতে হবে।”
সাও মু একটু দ্বিধা নিয়ে বললো, “এ ব্যাপারে … আমাকে একটু ভাবতে হবে।”
“আমি আপনাকে কেবল একটা দিন দিতে পারি ভাবার জন্য।”
“আমাদের ম্যানেজমেন্ট টিমের তিরিশ শতাংশ অংশীদারী লাগবে।”
“যেহেতু আমরা এই মাত্র আলোচনা করলাম যে আপনাদের প্রোডাক্টগুলো এখনো ক্লাস থ্রি যন্ত্রের ছাড়পত্র পায় নি, আর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আরো দু থেকে তিন বছর লেগে যাবে, তার মানে বেশি লগ্নি, কম ফলন। এটা লগ্নিকারীর জন্য ছোটো ঝুঁকি নয়। কুড়ি শতাংশটাই যুক্তিযুক্ত।” স্থির হয়ে বসে রইলো শিন ছি।
“আটাশ শতাংশ। আমি একজন লগ্নিকারীকে পিছিয়ে যেতে রাজি করে ফেলবো। অন্য দুটো লগ্নি সংস্থা আপনার থেকে বেশি অংশীদারী দিচ্ছে।”
“কিন্তু তাঁরা কেউ আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। তেইশ শতাংশ, দুটো লগ্নি সংস্থাকেই চলে যেতে হবে।”
“যদি দুটো কোম্পানিই চলে যায় , পঁচিশ শতাংশ।”
“তেইশ শতাংশ, একচেটে, আমার শেষ প্রস্তাব। আগামী কাল রাত আটটার আগে আপনাকে উত্তর দিতে হবে। না হলে আমার প্রস্তাবটা মূল্যহীন হয়ে যাবে। আর আমি ভবিষ্যতে কখনো এটার কথা ভেবেও দেখবো না।”
মিন হুয়ে চুপ করে দেখছিলো শিন ছিকে। ওর মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। ওর চোখ শান্ত আর শীতল।
সাও মু কিছুক্ষণ ভাবলো আর বললো, “ধন্যবাদ। আমি ফিরে যাই, টিমের সাথে কথা বলি। আমি আপনাকে কাল উত্তর দেবো।”
“ওকে।”
সবাই করমর্দন করলো, মিটিং শেষ হয়ে গেলো বেশ বন্ধুত্বের আবহাওয়াতেই।
এটা বেজিং-এর একটা ঠান্ডা রাত। হোটেলে ফিরে সাও মুকে জিজ্ঞেস করলো মিন হুয়ে, “তুমি বিবিজির প্রস্তাব নিয়ে কী ভাবছো? মেনে নেওয়া যায়?”
ও বিত্ত, অর্থের ব্যাপারে বিশেষ জানে না। কিন্তু ওর মনে হচ্ছিলো যে তেরো কোটি য়ুআঁ, তেইশ শতাংশ অংশীদারী বেশ ভালো শর্ত।
“আমাকে ইয়ান চেং লির সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে যে আমাদের পক্ষে এই প্রস্তাবটা নেওয়া কঠিন হবে।” বললো সাও মু।
"কেনো?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো মিন হুয়ে।
“এটা একটা প্রারম্ভিক প্রস্তাব। উনি বলেছেন তেরো কোটি য়ুআঁ। কিন্তু চূড়ান্ত চুক্তি এই সংখ্যাতে নাও হতে পারে। কারণ এখনো অনেক কাজ বাকি। ও বা’অ্যানে আর্থিক ব্যবস্থা আর বিক্রিবাটার ফাঁক-ফাঁকিগুলো খুঁজে বার করবে। সেসব ভিত্তি করে ও লগ্নির পরিমাণ কমিয়ে দেবে বা লগ্নি করবেই না। যেহেতু ও একচেটে লগ্নি করবে, সেহেতু ও ছেড়ে গেলে, আর কাউকে সময় মতো খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হবে।” বললো সাও মু “এটা অনেক কারণের একটা।”
“তাছাড়া অন্য দুটো লগ্নি কোম্পানির ল্বব্যাঁদের সাথে আমার মৌখিক কথা হয়েছে। ওঁদের একজন আবার আমার পুরোনো বন্ধু। উনি আমাকে সাহায্য করেছেন আমার স্বভাব চরিত্রের জন্য। আমি এখন আমার নিজের দেওয়া কথা ফিরিয়ে নিতে পারি না, যাতে ওঁরা মনে করেন যে বড়ো মাছ পেয়ে আমি ছোটো মাছ ছেড়ে দিয়েছি।”
“তাও ঠিক।”
“কাল দুপুরে আমি আরো দুজন লগ্নিকারির সঙ্গে দেখা করবো আর দেখবো যে ওঁদের প্রস্তাব কী কী। সেই প্রস্তাবগুলো শিন ছির প্রস্তাবের থেকে ভালোও তো হতে পারে।”
“ভালো, শুনলাম তোমার যুক্তি।”
“সব দিক দেখলে, এটা একটা ভালো প্রস্তাবই বলা যায়।”
সাও মু একটা হাসি নিয়ে বললো, “অন্য দুটো ব্যক্তিগত লগ্নিকারীর ব্যাপার না থাকলে, আমি হয়তো তখনই রাজি হয়ে যেতাম।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-46.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-48.html
No comments:
Post a Comment