৭. ভিলা হোটেল
সেই মূহুর্তে মিন হুয়ের মনে হচ্ছিলো যে ও কিছুতেই শিন ছিকে বিয়ে করতে পারে না। ও মাত্র কয়েকদিনের জন্য সু তিয়াঁর ভান করে আছে। ও কিছুতেই শিন ছিকে বিয়ে করতে পারবে না। নিশ্চয়ই সু তিয়াঁর ঋণ মেটাতে যদি শিন ছিকে বিয়ে করতে হয় তাতে ভুল বা দোষ কিছু নেই। সু তিয়াঁ তার জীবন দিয়ে মিন হুয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছে বলে কথা, সু তিয়াঁর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করলে, হয়তো তার করুণার প্রতি খানিক সম্মান করা যাবে।
কিন্তু সমস্যা হলো এই যে বিয়ের ভিত্তিতে থাকে সত্যিকারের প্রেম। আর মিন হুয়ের হাতের সবকটা তাসের পাতা নকল। তার ভয় একটাই, নকল দেখনদারিটা একদিন সত্যি হয়ে যাবে। তার থেকেও বেশি ভয়ের ব্যাপার হলো যে সত্যিটা প্রকাশ হলে শিন ছি কিছুতেই মিন হুয়ের সমবেদনা মেনে নিতে পারবে না, কোনো দিন ক্ষমা করতে পারবে না মিন হুয়ের মরিয়া চেষ্টাটা যে মিন হুয়ে সু তিয়াঁর কাছে জীবনের ঋণ মেটাবার ইচ্ছেতেই সব কিছু করেছে।
আরেকটা সম্ভাবনাও আছে। যদিও এই মূহুর্তে নিতান্ত ক্ষীণ, কিন্তু তবু আছে : কি হবে যদি সু তিয়াঁ এখনো বেঁচে থাকে? শিন ছির কাছে ফিরে আসে? এসে যদি দেখে যে যার জন্য সে নিজের জীবনের পরোয়া করে নি, সেই মানুষটাই তার ছেলেবেলার প্রেমিকের সঙ্গ ভোগ করছে, তাহলে মিন হুয়ে কী আজন্মের মতো পাপী হয়ে যাবে না?
“বিয়েটা এক্ষুণি করে কাজ নেই।”
তার মতটাকে জোরালো করার জন্য শেষে একটা “ঠিক আছে?” বলে প্রশ্ন মিন হুয়ে রাখলো না।
জানতে চাইলো না, “চলবে?” কিংবা, “তোর কি মত?”
শিন ছির মুখ অন্ধকার করে হতাশা এলো দেখে, ঢোঁক গিলে মিন হুয়ে যোগ করলো, “আগে সার্জারিটা হয়ে যাক। যতো শিগগির সম্ভব তুই নিউইয়র্কে ফিরে যা। আমি আমার ভাইকে খুঁজে বার করি ততো দিনে।”
মিন হুয়ে চাই ছিলো যে শিন ছি কালই ফিরে যাক। তাহলে তাকে আর এই অভিনয় করে যেতে হবে না। ধরা পড়ার ভয় ওকে গিলে খাচ্ছে।
এই ব্যাপারে ভাবলেই মিন হুয়ে বুঝতে পারছে যে সে নানান অজুহাত খুঁজে বার করছে যাতে তাকে শিন ছির সঙ্গে থাকতে না হয়। যতো নির্বোধই হোক না কেনো ও নিজে, মিন হুয়ে নিজের ভাবনাটা খুব টের পাচ্ছিলো।
শিন ছি খালি চাউনিতে মিন হুয়ের দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ, একটাও কথা না বলে। অনেকটা সময় যাবত ওর মুখটা লাল হয়ে ছিলো। তারপর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। মুখের রং লাল থেকে ফ্যাকাসে হবার সময়টুকুর মধ্যে শিন ছি ঘাড় নেড়ে বললো, “তুই বিয়েটা পরে করতে চাইলে ঠিক আছে। কিন্তু আমি তোর ভাইয়ের খোঁজে তোর সঙ্গে যাবো।”
মিন হুয়ে তর্ক জুড়ল, "কেনো?”
শিন ছি নিজের আশঙ্কা প্রকাশ করলো, “পথে তুই পাচার হয়ে যাবি।”
মিন হুয়ে তর্কটা চালিয়ে যেতে লাগলো, “সেটা কী করে সম্ভব?”
শিন ছির যুক্তি, “তুই আগেও চুরি হয়ে গিয়ে ছিলি।”
মিন হুয়ে তৈরি ছিলো জবাব নিয়ে, “সে তো শিশু বয়সে।”
শিন ছি তর্কে ইতি টেনে দিলো, “সে যা হোক, না, তোকে আর ভাবতে হবে না। আমি তোর সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে চাই। ভাইকে খুঁজবো একসাথে, নিউইয়র্কে ফিরবো একসাথে, সব মিটে গেলে। আমি তোর অপেক্ষা করেছি এতো বছর, এখন কিছুতে আমি তোর থেকে আলাদা হবো না আবার।”
মিন হুয়ের সব কথা, এতোক্ষণের সব চেষ্টা মাটি হয়ে গেলো।
শিন ছির কথা আর থামে না, “তিয়াঁ, তিয়াঁ, বললে হবে, আমরা তেরো বছর একে অপরকে দেখি নি। প্রত্যেকে বদলে গেছি অনেক। আমি খুব শিগগির তোর সাথে মানিয়ে নিতে পারব। কিন্তু মনে হচ্ছে যে আমার সাথে মানিয়ে নিতে তোর অনেক সময় লাগবে। সে তুই নে না সময়, চিন্তার কিচ্ছু নেই।”
শিন ছি হাসলো। তারপর একটু নড়ে চড়ে বসলো। নিজের হাতের মধ্যে মিন হুয়ের দু হাত নিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, “দ্যুবুছি। আমি বড্ডো অধৈর্য হয়ে পড়েছি আর কেবল নিজের অনুভূতির কথাই ভেবেছি।”
মিন হুয়ে শূণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শিন ছির দিকে। কি যে করবে সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলো না।
শিন ছি তারপর জানতে চাইলো, “এখানে উঠেছিস কোথায়? কাছাকাছি না দূরে?”
মিন হুয়ে স্বাভাবিক সত্যি বললো, “কাছাকাছি। একটা হোমস্টে। পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তা।”
য়েহুয়া লেক শুধু একটা দেখার জায়গা তো নয়, গ্রীষ্মকালে বেড়ানোর জায়গাগুলোর অন্যতম। কয়েকটা হোটেল আর ভিলা আছে এখানে। কাছাকাছি গ্রামের মানুষজন হোমস্টে চালিয়েও বেশ রোজগার করেন। কম খরচে, দিনে তিনটে খাবার সমেত, পরিষ্কার পরিচ্ছন থাকার দিব্যি বন্দোবস্ত।
শিন ছির পরামর্শ, “তুই যদি ঠিক মনে করিস তো তুই আমার হোটেলে চলে আয় আগে। হোটেল রেলস্টেশন অবধি একটা গাড়ি দেয়। কাল হোটেল থেকে একসাথে সুইহুয়া রওয়ানা দিতে পারি আমরা, তোর ভাইয়ের খোঁজে।”
মিন হুয়ে তেড়ে ফুঁড়ে বললো, “এতো ঝামেলায় যেতে হবে না। আমি তো হোমস্টেকে পুরো ভাড়া দিয়ে রেখেছি। আমি খুব সহজে ট্যাক্সিতে রেল স্টেশনে পৌঁছে যাবো। চল, রেল স্টেশনে দেখা করি।”
শিন ছি থমকে গেলো প্রথমে। চুপ করে মিন হুয়েকে দেখতে লাগলো। দুচোখ ভর্তি দুঃখ। খানিক পরে মৌনি ভেঙে জানতে চাইলো, “তিয়াঁ, তিয়াঁ, আমি কি কিছু ভুল করেছি?”
এই মূহুর্তে মিন হুয়ে ডুবে গেলো অনুতাপে। নিজের ওপর ওর ভীষণ ঘেন্না হতে লাগলো ওর নিজের কৌতুহলের বাড়াবাড়িতে। শিন ছিকে দেখতে ওর এতো দূর আসাটা উচিৎ হয় নি মোটেই। সু তিয়াঁর অপেক্ষা করতে করতে, একসময় শিন ছিকে হাল ছেড়ে ফিরে যেতে হতো নিউইয়র্কে, হার্টের সার্জারি করানোর জন্য। একাই ফিরে যেতে হতো ওকে, নিজের জীবনে। তাতে অন্তত ওর মনের মধ্যে সু তিয়াঁ বরাবর বেঁচে থাকতো। মনের মধ্যে একটা দারুণ সুন্দর স্মৃতি থেকে যেতো। তাই নিয়ে শিন ছি মিশে যেতে পারতো মানুষের সমুদ্রের মধ্যে।
শিন ছির অভিব্যক্তিতে বুক ভেঙে যায়। মিন হুয়ে আর সহ্য করতে না পেরে বললো, “ঠিক আছে, চল তোর হোটেলেই যাবো না হয়।”
শিশুর মতো আনন্দে উচ্ছাস জানালো শিন ছি, “ইয়েহ……”
মিন হুয়ের সঙ্গে শিন ছি হোমস্টেতে গেলো মিন হুয়ের জিনিসপত্র নিতে। বিশেষ কিছুই ছিলো না। একটা মাত্র ট্রলি ব্যাগ। তারপরে দুজনে আবার হাঁটা দিলো ইয়ং’আন সাঁকো পেরিয়ে য়েহুয়া লেক গার্ডেন ভিলা হোটেলের দিকে, যেখানে শিন ছি আছে।
সারা পথটুকু শিন ছি খুব সজাগ, সাবধান হয়ে কথা বলতে লাগলো মিন হুয়ের সাথে। খুব বেশি কথা বলতে যেনো সাহসও করছিলো না, পাছে মিন হুয়ে অসন্তুষ্ট হয়। মিন হুয়ের মনের মধ্যে একটা দুঃখ গুমরে উঠছিলো। কিন্তু মিন হুয়েরও মনে হচ্ছিলো যে শিন ছির সাথে তার একটা দূরত্ব থাকাই ভালো, যাতে, কিছু হলে দুজনের পক্ষে এগোনো বা পেছোনো সহজ হয়।
যাবতীয় খিটিমিটি সত্ত্বেও শিন ছির মেজাজ বেশ আনন্দে ডগমগ। এমনকি সে হাঁটছে অবধি হালকা চালে। মনে হচ্ছিলো যে ও এতো খুশি যে তখনই যেনো নাচতে পারে, যেখানে আছে সেখানেই। মিন হুয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে ছিলো, সত্যিটা থেকে শিন ছিকে অন্ধকারে রেখেছে বলে।
অন্ধকারে থাকা মানুষটা একটা হানিমুন স্যুইট ভাড়া নিয়েছে। সেটা আসলে পাহাড়ের মাথায় একটা ভিলা। কার্ড সোয়াইপ করে লিভিং রুমে ঢুকে পড়ে মিন হুয়ে অবাক হয়ে গেলো সুগন্ধী ফুলের কুয়াশা দেখে। একটা বিশাল কাচের বাতি ঝুলছে বিশাল লিভিং রুমের ছাদ থেকে। কাচের এক পাশে সোনালি রং করা আছে। প্রত্যেকটা পাতার মধ্যে দিয়ে আলো ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে। পুরো ঘরটাতে বাস্তব আর অবাস্তব একাকার হয়ে আছে, অনেক বৈষম্যে, অনেক পরতে।
একটা লম্বা টেবিলে গোলাপ রাখা আছে - লাল, হলুদ, সাদা, বেগুনী ………
আর না পেরে মিন হুয়ে থমকে থেমে গেলো। সুগন্ধটা একটা দেওয়ালের মতো তার পথ আগলে ছিলো। তার শ্বাস নিতে ভয় লাগছিলো। কারণ এই সুগন্ধ তো সু তিয়াঁর।
ব্যাপারখানা দাঁড়াচ্ছে যে শিন ছি সব গুছিয়ে রেখেছে - দেখা, বিয়ে, মধুচন্দ্রিমা আর ফেরা ……
কিন্তু সু তিয়াঁ সবই হারালো মিন হুয়েকে বাঁচাতে গিয়ে।
মিন হুয়ে ভাবতে লাগলো। আর তার চোখ লাল হয়ে উঠতে লাগলো।
এমন সময় গলার স্বরে রহস্য মাখিয়ে শিন ছি বললো, “এদিকে আয়। এখানে তোর পছন্দের জিনিসটা আছে।”
মিন হুয়ের হাত নিজের এক হাতে ধরে, শিন ছি অন্য হাতে দরজাটাতে টান লাগালো। দরজায় ঠিক বাইরেই খোলা হাওয়ায় ব্যবহারের একটা স্পা টাব রাখা আছে।
মিন হুয়ে কাঁদতে চাই ছিলো। তার গলায় না ছিলো হাহাকার, না ছিলো চোখে জল। কেবল ভাবছে, “সব শেষ, সব শেষ। এই কি একসাথে একটা বাব্ল বাথ নেবার ছন্দ?”
হাতে টেনে ধরে শিন ছি বাব্ল বাথ পেরিয়ে নিয়ে গেলো মিন হুয়েকে। মিন হুয়ের সামনে একটা ছোট্টো ব্যক্তিগত ব্যবহারের স্যুইমিং পুল জেগে উঠলো।
বাড়াবাড়ি রকমের মুখভঙ্গি করে, হাত নেড়ে, যেনো এক ধনভাণ্ডার উজাড় করে দিচ্ছে - এরকম একটা ভাব করে, শিন ছি বললো, “টা-ডাহ। তোর ভীষণ প্রিয় স্যুইমিং পুল।”
মিন হুয়ে কিছু বলার আগেই মিন হুয়ের হাত ধরে শিন ছি ঝাঁপিয়ে দিলো স্যুইমিং পুলে। দুজনে একসাথে পড়লো পুলের মধ্যে।
মিন হুয়ে সাঁতার কাটতে পারে না। ফলে সে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। সাঁতার কাটতে না পারা মানুষের জলের মধ্যে বেঁচে থাকার জান্তব প্রবৃত্তিতে গলা জড়িয়ে ধরলো শিন ছির, লেপ্টে রইলো শিন ছির শরীরে সাথে।
যা হবার কথা তাই হলো। শিন ছি বহু বছর বিদেশবাসের পর দেশে এসেছে। তার রকমসকম সাধারণ বোধবুদ্ধির বাইরে। শিন ছি বললো, “জেগে উঠেছে।”
মিন হুয়ে ভীষণ সন্দেহজনকভাবে লাফ ফেরে সরে গেলো শিন ছির থেকে দূরে। তারপর পাগুলোকে সোজা করে, পুলের মেঝেতে পা রাখলো। মনে মনে চেঁচাতে লাগলো, “কী লজ্জা! কী লজ্জা!” মুখে বললো, “জলটা ঠান্ডা। আমি একটু আগে আইসক্রিম খেয়েছি। আমার পেটটা কেমন ভিজে গেছে। পেটে ব্যথা করছে।”
শিন ছি ব্যস্ত হয়ে উঠলো, “বু হাইসা। আমার দোষ। ঠাট্টা করতে পেলে আমি আর কিছুই খেয়াল রাখতে পারি না।।”
তাড়াতাড়ি পাড়ে উঠে পড়লো শিন ছি। মিন হুয়েকে টেনে তুললো জল থেকে। জিজ্ঞেস করলো, “পেটে খুব ব্যাথা করছে? ডাক্তারের কাছে যাবি?”
মিন হুয়ে আশ্বাস দিলো, “ঠিক আছে। গরল জলে চান করলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
অপ্রস্তুত চাউনিতে একে অপরের দিকে দেখলো। দুজনেরই শরীরের ওপরের ভাগে পাতলা সাদা টিশার্ট। জলে ভিজে দুজনেরই টিশার্ট স্বচ্ছ হয়ে গেছে। চোখ ফিরিয়ে আবার এক পলক দেখলো একে অপরকে। যেই শিন ছির চোখ নেমে এলো মিন হুয়ের বুকের ওপর, মিন হুয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, জানতে চাইলো, “বাথরুম কোথায়?”
শিন ছি বললো, “ডান হাতে তিন নম্বর দরজা।”
তারপর বললো, “আমিও স্নানে যাবো।”
চোখে ভয় নিয়ে মিন হুয়ে তাকালো শিন ছির দিকে, ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “অ্যাঁ!”
শিন ছি তৎক্ষণাৎ বুঝিয়ে বললো, “দুটো বাথরুম আছে।”
ঝটপট চান সেরে নিলো মিন হুয়ে। চুল শুকিয়ে, একটা হালকা বেগুনি ল্যাভেন্ডার রঙা জামা পরে গেলো লিভিংরুমে। শিন ছি সোফায় বসে আছে। সাদা শার্ট আর গ্রে স্ল্যাক্স পরে। পায়ে কালো চপ্পল। মিন হুয়েকে দেখে চটপট উঠে দাঁড়ালো, “তোকে কিছু ড্রিংক্স দি। কী নিবি? এখানে রেড ওয়াইন আছে, বিয়ার আছে, জুস আছে, কোলা আছে, আর মিনারেল ওয়াটার আছে।”
মিন হুয়ে পছন্দ জানালো, “জুস। শিয়া শিয়া।”
শিন ছি আপ্যায়ন করলো, “যেখানে খুশি সেখানে বসে পড়।”
মিন হুয়ে সোফার এক কোণে বেশ বিশ্রীভাবে বসলো। কফি টেবিলের ওপরে দুটো বাতি জ্বলছে। তার পাশে ছিলো শিন ছির জিনিসপত্র - সেল ফোন, কয়েকটা ব্যাটারি, ল্যাপটপ, একটা চামড়ায় মোড়া নোটবুক, একটা দাবার বোর্ড যার ওপরে গুটিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে।
দাবার বোর্ড |
মিন হুয়ে একটা গুটি তুলে নিলো দাবার বোর্ড থেকে। হাতের মধ্যে রেখে গুটিটা হালকা হাতে ঝাঁকাতে লাগলো। বসে রইলো নির্বোধের মতো। জানে না কি করা উচিৎ। তাই গুটিগুলো বেছে ফেললো প্রথমে। তারপর দাবার ছকে সাজিয়ে ফেললো, লাল আর কালো দিক বরাবর।
রান্নাঘরে অনেকক্ষণ ধরে কাজ করার পরে শিন ছি দু কাপ গরম পানীয় নিয়ে এলো, “খেয়ে দেখ, গরম অ্যাপলসিডার। গরম আপেলের রস। এতে পেটটা গরম রাখে।”
মিন হুয়ে হাতে নিয়ে দেখলো একটা হালকা হলুদ কাপ। কাপের মধ্যে ধোঁয়া ওঠা একটা তরল। মধ্যে চেরির মতো দেখতে লরেল বেরি আর এক টুকরো আপেল। চুমুক দিয়ে প্রশংসা না করে পারলো না, “দুর্দান্ত।”
লরেল বেরি |
শিন ছি নিজের কাপটা নিয়ে মিন হুয়ের পাশে বসে জানালো, “আমার মা আমাকে শীতের সময় মাঝে মধ্যেই বানিয়ে দিতেন।”
মিন হুয়ে চমকে উঠলো, “তোর মা?”
শিন ছি অনুতাপের স্বরে বললো, “ওহ্! আমি ভুলে গেছিলাম আমাদের চুক্তির কথা যে আমরা অতীতের কথা বলব না।”
হাসলো শিন ছি, “মানে আমার পালক মা।”
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “কেমন কাটল তোর ওখানে?”
শিন ছি সন্তুষ্টি জানালো, “চমৎকার।”
মিন হুয়ের আরো প্রশ্ন ছিলো, “উনি ম্যান্ডারিন বোঝেন?”
শিন ছি অকাতরে উত্তর দেয়, “মোটেই না।”
মিন হুয়ের প্রশ্ন শেষ হয় না, “তাহলে তুই কী করলি যখন প্রথম ইউনাইটেড স্টেটসে পৌঁছোলি?”
শিন ছি উত্তর দিয়ে যায়, “প্রথম তিনমাস খুব কষ্টকর ছিলো। আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। তিন মাস পরে আমি মোটামুটি কথাবার্তা চালিয়ে নিতে পারতাম।”
মিন হুয়ের কৌতুহল বাধভাঙা। কিন্তু ও আর প্রশ্ন করতে সাহস করলো না। ভয়ে। যদি শিন ছিকে একই ভাবে ওর মতো প্রশ্ন করা থেকে আটকানো না যায়, তাহলে মিন হুয়ের আসল কথাটা বেরিয়ে পড়বে।
কিন্তু শিন ছি জিজ্ঞেস করলো অন্য কথা, “তা হলে শেষ অবধি তোর ভাইকে খুঁজে পাওয়া গেছে যা হোক। চল, সুইহুয়া গিয়ে নিশ্চিত হয়ে আসি। তাই না?”
এই ব্যাপারে কথা বলার জন্য মিন হুয়ে ভীষণ তৈরি। এটা নিয়ে সে বিশদে কথা বলতে পারবে। তার কারণ শিন ছির সাথে দেখা হবার আগেই মিন হুয়ে পরিজন খুঁজে বার করার ওয়েবসাইটের একজন ভলান্টিয়ারের সাথে ফোনে কথা বলে ছিলো। ভলান্টিয়ার মিন হুয়েকে যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে দিয়ে ছিলো। বহু বছর ধরে সু তিয়াঁ রেজিস্ট্রেশন করে রেখে ছিলো ফ্যামিলি ফাইন্ডিং ওয়েবসাইটে। এই প্রথমবার কোনো সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। সু তিয়াঁর ছোটো ভাই যখন হারিয়ে যায়, তখন তার বয়স ছিলো মাত্র দেড় বয়স। তার কোনো পোষাকি নাম তখনো ছিলো না। তাকে ডাকা হতো “আজিএ” বলে।
মিন হুয়ের যুক্তি হল, “ছেলেটার নামটা প্রায় একরকম। অন্য পরিবারটা একই সময়ে একটা ছেলে দত্তক নিয়ে ছিলো। দত্তক নেবার দিনক্ষণ আমার ভাই কিডন্যাপ হবার দেড় মাসের মধ্যে। দিন তারিখগুলো বেশ কাছাকাছি। তারওপর সুইহুয়া ইয়াংছেনজেনের কাছাকাছি। দুটো একই পথে পড়ে।”
ভ্রূ কুঁচকে শিন ছি সন্দেহ উগরে দিলো, “এই দুটো কারণ কি যথেষ্ট যে সুইহুয়ার ছেলেটাই তোর ভাই? এর ওপর কি ভরসা করা যায়?”
মিন হুয়ে জানালো, “ওরা রক্তের নমুনা নিয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য। কয়েক দিনের মধ্যেই ফলাফল জানা যাবে।”
মিন হুয়ে কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললো, “এখন আমি যাচ্ছি একটু খোঁজখবর করে সাধারণ অবস্থাটা বুঝে নিতে।”
শিন ছি আরো প্রশ্ন করলো, “তোর ভাইয়ের কী কোনো দাগ আছে শরীরে? বিশেষ চিহ্ণ? জন্মদাগ?”
মিন হুয়ে বললো, “না। বাচ্চাটাকে এক বছর বয়সে কেমন দেখতে ছিলো তার কোনো ছবিও নেই।”
শিন ছি বললো, “তা হলে ডিএনএ ছাড়া আর কিছুর ওপরেই ভরসা করা যাবে না।”
মিন হুয়ে মেনে নিলো, “হ্যাঁ। তাতো বটেই।”
হঠাৎ শিন ছি বলে উঠলো, “তিয়াঁ তিয়াঁ, তুই যদি তোর ভাইকে খুঁজে পাস, তাহলে তুই ভাইকে ফেলে বিদেশে যেতে চাইবি না। আমি কিন্তু চিনে ফিরে এসে তোর সাথে থাকতে পারি। এতো দিনের পরে ভাইকে খুঁজে পেলে, আমি চাইবো না যে তোর সাথে তোর ভাইয়ের ছাড়াছাড়ি হোক।”
মিন হুয়ে জানে না যে এই কথার কী জবাব হয়। সে শুধু ঘাড় নাড়ে।
শিন ছি অন্য কথায় চলে গেলো, “তোর কি খিদে পেয়েছে? আমরা বাইরে রেস্টুরেন্তে যাবো ডিনারের জন্য? নাকি ঘরেই বলব, রুম সার্ভিস?”
মিন হুয়ে হাতঘড়ি দেখলো। শেষ বিকেলে পাঁচটা বাজে মাত্র। বললো, “ এখনো অনেক সময় আছে। আমার খিদেও নেই এখন।”
শিন ছি আবার অন্য কথায়, “এই, আমি দেখছি যে তুই দাবার বোর্ডে সব ঘুটি সাজিয়েছিস। একবোর্ড খেললে হয়। খেলবি, আগের মতো?”
মিন হুয়ে শিন ছির দিকে তাকালো, চোখ পিটপিট করে বললো, “ঠিক আছে। খেলবো।”
এবারে খেলতে আধঘন্টা লাগলো। শুরুতে শিন ছি যেনো অপ্রতিরোধ্য, তখন মিন হুয়ে প্রত্যেক চালে ধীর স্থির। এক নজরে, শেষ পর্যন্ত খেলাটা অবিচ্ছিন্নভাবে চলছে।
শিন ছির চাল, “দুটো গাড়ি নিয়ে, নদী পেরিয়ে, আমি আশঙ্কা করছি যে এই খেলাটা শেষ হয়ে যাবে। আমি কামানের মধ্যে যাচ্ছি।”
মিন হুয়ে দুদিকের সৈন্য সাজানোর দিকে দেখলো, দুদিকের অনেক ফাঁদ।
“গাড়িটা খেলাম।”
“এতো দেরিতে গাড়ি খাবি? আমি তো দপ্তরী হয়ে গেছি।”
“অবাক কান্ড। অপরূপ সুন্দর হতে যাস না। তুই অপরূপ সুন্দর হলে, আমি তোর দিকে ছুটে যাবো আর তোকে মেরে ফেলবো।”
“আমিও বড়েগুলো খাব আর ঘোড়াটাকে মেরে ফেলবো।”
“তাহলে অপরূপ সুন্দরে পদোন্নতি নেবো।”
“কামান পাঠালাম।”
“সৈন বল দিলাম।”
“তোর দপ্তরীকে কাটলাম।”
“জিন সেনাধ্যক্ষ।”
“সেনাদল ধ্বংস। খেলা মাত।”
চোখ বড়ো বড়ো করে শিন ছি চেয়ে রইলো মিন হুয়ের দিকে। তার মুখে একটা অবিশ্বাস্য অভিব্যক্তি, “ও মা! আমি এর মধ্যেই হেরে গেছি!”
মিন হুয়ে প্রশ্ন করলো, “জানিস কি গন্ডোগোলটা কোথায়?”
শিন ছি আগ্রহী, “বল।”
মিন হুয়ে ব্যাখ্যা করলো, “এক্ষুণি যখন দুটো গাড়ি যুদ্ধে, সামনের সারিতে, তখন তোর সামনের গাড়ি দিয়ে সেনাপ্রধানকে ডাকা উচিৎ হয় নি। বাজে চাল। তোর পিছনের সারির গাড়ি দিয়ে সেনাধ্যক্ষকে ডাকা উচিৎ ছিলো। তাতে তোর জেতার সম্ভাবনা থাকতো।”
শিন ছির উৎসাহ বেড়ে গেছে, “চল আরেকবার খেলি।”
মিন হুয়ে রাজি হয়ে গেলো, “ঠিক আছে।”
দুজনে আবার খেলতে লাগলো দাবা। হঠাৎ করে শিন ছি হাত দিয়ে গুটিগুলো আড়াল করে দিলো, মিন হুয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “তিয়াঁ তিয়াঁ, তুই কী সত্যিই সু তিয়াঁ?”
মিন হুয়ের নজরও একটু ট্যারা হলো। তার মনে একটা সন্দেহ ঘনিয়ে উঠল : এই ছেলেটা কি আসলে শিন ছি? এমন কী হতে পারে যে আসল শিন ছি মরে গেছে আর সামনে বসে থাকা মানুষটা নকল শিন ছি?
মিন হুয়ে প্রশ্ন রাখলো, “তোর ব্যাপারটা কী, তুই কী আসলে শিন ছি?”
শিন ছি গায়ের জামাটা খুলে ফেললো। ওর বুকের মধ্যিখানে গাঢ়, লম্বা ক্ষতটা জেগে উঠলো। “তুই এইটা সব সময়ে চিনতে পারবি, বল?”
মিন হুয়ে হাঁ হয়ে যাওয়া মুখটা বন্ধ করলো, হাসলো, বললো, “আরে, ঠাট্টা করছিলাম, তোকে এতো গুরুত্ব দিতে হবে না।”
জামার বোতাম এঁটে, শান্ত স্বরে শিন ছি বললো, “আমি গুরুত্ব দিই নি।”
খেলতে খেলতে বললো, “আমি তো খুলে ফেলেছি। এবার তোর পালা।”
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-06.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-08.html
No comments:
Post a Comment