১৭. সত্য
“তা কী করে সম্ভব?” শিন ছির স্থির দৃষ্ট সোজাসুজি দেঁ চেনের মুখের ওপর।
“তুমি আর সু তিয়াঁ অনাথাশ্রম ছাড়ার আগে ফুগুয়াঁ রোডের ২নং প্রাইমারি ইস্কুলে পড়তে, তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু এই মিন হুয়ে পাশ করেছে হুবেই প্রদেশের নানঝাং কাউন্টির আঁপিং প্রাইমারি ইস্কুল থেকে। উত্তর-পুবের অনাথাশ্রম আর হুবেই-এর পশ্চিমাঞ্চল - ভূগোল ভাবো, জায়গা দুটো বেশ দূর হয়ে গেলো না পরস্পরের থেকে?”
হুবেই প্রদেশের নানঝাং কাউন্টি |
শিন ছি এমন করে ভ্রূ কোঁচকালো যে দেখে মনে হচ্ছিলো গিঁট পড়ে গেছে, “হুবেই-এর পশ্চিমে?”
“আমার খবর অনুযায়ী মিন হুয়ে তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান আর জন্মে থেকে সে মা-বাবার সাথেই থেকেছে, কখনো কোনো অনাথাশ্রমে থাকে নি। ওর বাবার নাম মিন ওয়েনছিং, রুপোর গয়না আর বাসনের কারিগর ছিলেন, গত হয়েছেন যখন মিন হুয়ের বয়স দশ বছর। ওর মায়ের নাম ছিন দংইউ, সব্জি বেচে সংসার চালাতেন অসুখে মারা গেছেন।”
হুবেই প্রদেশের নানঝাং কাউন্টি - ইয়ংছুয়াঁ |
শিন ছি খানিক ভাবলো। কিন্তু তারপরেও খুব বিভ্রান্ত হয়ে রইলো, “মিন হুয়ে নামটার খুব চল আছে। সু তিয়াঁর দেশের বাড়ি হেচিতে, গুয়াঁইশি প্রদেশে। এখন ও বিনচেং-এ থাকে।”
“তুমি জানো কি ও কী ধরনের কাজ করে?”
“না, আমি জানি না …”
শুরুতেই সু তিয়াঁ ওর অতীত নিয়ে কথা বলায় আপত্তি করে ছিলো। শিন ছি একটু অবাকই হয়ে ছিলো। তবে সামান্যই খাপছাড়া লেগে ছিলো। উন্মাদনায় ঢেকে গিয়ে ছিলো সমস্ত সম্ভাবনার কল্পনা। তেরো বছরের ফাঁকটার কথা তো ভাবাই হয় নি। এই ফাঁকটাই যুক্তির সবচেয়ে বড়ো ফাঁক। যে কোনো গল্প, যে কোনো পরিবর্তন ভরে দেওয়া যায় ঐ ফাঁকে। যে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া যায় যে কোনো বর্ণনার।
“ও বিনচেং-এ থাকে। পেশায় সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।”
শিন ছি চমকে উঠলো এক মূহুর্তের জন্য, “তার মানে ও কলেজে পড়েছে।”
দেঁ চেন তাকালেন শিন ছির দিকে, “তুমি জানতে না ও কলেজে পড়েছে?”
“...”
“ও হুয়াছিং ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ডিপার্টমেন্ট থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে পাশ করেছে।”
সব্বাই জানে যে হুয়াছিং ইউনিভার্সিটি চিনদেশে বিজ্ঞান প্রযুক্তি পড়াশোনার সব চেয়ে সেরা ইউনিভার্সিটি।
“নিশ্চয়ই নামটাই একরকম।”
শিন ছি বেশ শান্ত, “সু তিয়াঁর পারিবারিক অবস্থা যা তাতে হাইস্কুল পাশ করাটাই সৌভাগ্যের ব্যাপার।”
দেঁ চেন নিজের মোবাইল ফোনটা বার করলেন। আঙুল চালিয়ে দুটো ছবি বার করলেন, “তোমার কী মনে হয় এই মেয়েটাই ও?”
ছবি দুটো “হুয়াছিং ইউনিভার্সিটি স্পেশাল স্কলারশিপ”-এর প্রচারের পাতা থেকে নেওয়া দুটো স্ক্রিনশট। কুড়িজন স্কলারশিপ বিজেতার প্রত্যেকের আলাদা আলদা পোস্টার আছে। তাদের মধ্যে একজন মিন হুয়ে, একটা সুন্দর দেখতে, চনমনে মেয়ে, সবুজ রঙ্গের জামা পরে। ছবির নিচে লেখা “কম্পিউটার ডিপার্টমেন্ট”। ছবিটা দেখে কয়েক বছর আগেকার বলে মনে হয়। দেখতে সরল, সাদামাটা, কচি, হয়তো যখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ক্লাসে পড়তো, তখনকার।
“আর এইটা।” দেঁ চেন আরেকটা ফোল্ডার থেকে আরেকটা ছবি টেনে বের করে আনলেন।
ছবিতে সংবাদপত্রের একটা ক্লিপিং ছিলো, যাতে লেখা, “ইস্কুলের সেরা মেয়ে দাবা খেলতে ভালোবাসেঃ কলেজে ভর্তির পরীক্ষাই জীবনের মোক্ষ নয়” সঙ্গে দাগ দেওয়া কয়েকটা কি-ওয়ার্ড - “রুপোর কারিগর" “আঁপিং প্রাইমারি ইস্কুল" “নানঝাং কাউন্টির এক নম্বর বিজ্ঞানের ছাত্র।" “প্রদেশে পাঁচ নম্বর।”
ওপরের দিকে বাঁকের কোণে একটা গ্রুপফোটো দেখা যাচ্ছে - একটা সুন্দর দেখতে মেয়ে আর তার মা, আঠার বছর বয়সেও মিন হুয়ের বেবিফ্যাট ছিলো, কিন্তু তার চেহারা প্রায় তৈরি হয়ে গিয়ে ছিলো, তাকে প্রায় এখনকার মিন হুয়ের মতোই দেখাচ্ছিলো।
এই মূহুর্তে শিন ছির চোখ কালো হয়ে গেলো। ও কিছুতেই আটকাতে পারলো না, ওর সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।
দেঁ চেন ওর কাঁধ চাপড়ালেন, পাশের সোফাটা দেখালেন, “আমরা বসে কথা বলি?”
তারপরে ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে এক কাপ চা আনতে বললেন। শিন ছি কে বললেন চায়ে চুমুক দিতে আর শান্ত হতে।
“এই সব, আপনি খুঁজে পেলেন কেমন করে?” জানতে চাইলো শিন ছি।
ওর মুখ লাল হয়ে গেছে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, একটা বাক্যকে চারটে ভাগে ভেঙে বলতে হচ্ছে। খুবই স্পষ্ট যে ও চেষ্টা করছে রাগ না করতে।
“তোমার গ্যগ্য আমাকে বলে ছিলেন নতুন নথির জন্য আবেদন করতে। তাই আমাকে নথি সংক্রান্ত সব খবর জড়ো করতে হলো। যখনই দেখলাম যে মিন হুয়ে একই প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ে নি তোমার সাথে, তখনই আমার সন্দেহ হলো।” দেঁ চেন বলতে লাগলেন, “আমি বডিগার্ড কোম্পানি চালাই। এই ব্যাপারটার সঙ্গে আমি ধাতস্থ।”
“মিন হুয়ে আর সু তিয়াঁর সম্পর্ক কী? কেনো মিন হুয়ে ভান করছে যে ও সু তিয়াঁ?”
“তা আমি জানি না।” দেঁ চেন শান্ত স্বরে বলে চললেন, “পাশ করার পরে মিন হুয়ে গুয়ান ছাও ইন্টারন্যাশন্যালে একটা কাজ পায়। আর অ্যান্ড ডি ডিপার্টমেন্টে, প্রোগ্রামার। ছ মাস কাজ করেছে। কিন্তু পুরো সময়ের কর্মী হবার আগেই ওর কাজ চলে যায়।”
অবাক কান্ড ঘটে চলেছে একের পর এক। শিন ছি একটা গাঢ় শ্বাস নিলো, “লোক হিসেবে তেমন কাজের নয় সেই জন্য?”
“আচরণের ত্রুটি।”
দেঁ চেনের মনে হলো তিনি যেনো খবরের কাগজের বিনোদনের পাতা খুলে বসেছেন।
“কোম্পানির বক্তব্য হলো যে মিন হুয়ে কোম্পানি সিটিও চেন ছিরাং-কে হেনস্থা করেছে। মিন হুয়ের বক্তব্য হলো যে চেন ছিরাং ওকে হেনস্থা করেছে। যৌন হেনস্থা। ব্যাপারটা বেশ গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়। মিন হুয়ের কাজ যায়। চেন ছিরাং বিবাহিত আর তার বৌ -”
দেঁ চেং-এর কাছে নিশ্চয়ই অনেক খবর আছে। তিনি বুঝতে পারেন নি যে মিন হুয়ের গল্পে শিন ছির কোনো উৎসাহ নেই।
“সু তিয়াঁ কোথায়?” হঠাৎ বলে উঠলো শিন ছি, “সু তিয়াঁর কী হলো?”
যে মানুষটার জন্য ওর প্রাণমন ব্যাকুল সে কেবল মাত্র সু তিয়াঁ। এই মিন হুয়ে কোন ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ, তার কী ডিগ্রি আছে না আছে, বা তার জীবনে কী ঝামেলা গেছে না গেছে তাতে শিন ছির কিচ্ছু যায় আসে না।
এই মূহুর্তে দেঁ চেনের সাথে কথা বলার সময়, এ কদিন ধরে তার মনের গভীরে যে সন্দেহগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিলো সেগুলো জেগে উঠলো এক এক করে।
ও সময়ে আসে নি
ও অতীতের কথা বলতে চায় না
ও অনেক বেশি বুদ্ধিমান
এতোগুলো ত্রুটি। এতো নিশ্চিত মিথ্যে, এতো বড়ো তফাত, শিন ছি দেখতে পায় নি।
শিশু বয়স থেকে কোনো দিন শিন ছিকে সহজে বোকা বানানো যায় না। যদি না ও নিজে চায় তো কেউ ওর থেকে সুবিধা নিতে পারে না। যতো সূক্ষ্মই হোক তথ্যের গরমিল বা বড়োসড়ো টাকার অঙ্ক - কিছুই চোখ এড়ায় না ওর।
ও কিছুতেই বুঝে উঠে পারছে না যে এবার তার এতো ভুল হলো কী করে। কী করে ওকে গুছিয়ে বোকা বানানো হলো!
এর পরেও ও নিজে বিশ্বাস করতে চায় নি যে মিন হুয়ে কখনো সু তিয়াঁ হতে পারে না। কারণটাও খুব সহজ। মিন হুয়ে খুব ভালো করে জানে সু তিয়াঁর কথা। বিশেষ করে যে সময়টায় সু তিয়াঁ আর শিন ছি একসাথে কাটিয়েছে, তাদের ছেলেবেলায়। সেই সময়কার এমন সব কথা মিন হুয়ে জানে যা সু তিয়াঁ আর শিন ছি ছাড়া আর তৃতীয় কারুর জানার কথা নয়।
“যেহেতু তোমার গ্যগ্য কাল মাত্র সু তিয়াঁর কথা আমাকে বলেছেন আমি খুব একটা সময় পাই নি সু তিয়াঁর ব্যাপারে খোঁজখবর করার। তাই আমি বলতে পারবো না সু তিয়াঁ আর মিন হুয়ের মধ্যে সম্পর্কটা কী, কেনই বা সু তিয়াঁ নিজে এলো না, কেনো মিন হুয়েকে পাঠালো তোমার সাথে দেখা করার জন্য, মিন হুয়েই বা কেনো তার আসল পরিচয় দিতে নারাজ, কেনই বা সে ভান করলো সু তিয়াঁ হবার আর তোমার সঙ্গে থাকতে রাজি হলো। এই সব -”
শিন ছির আর ধৈর্য ছিলো না কিছু শোনার। দুম করে উঠে পড়লো, “আমি ওকেই জিজ্ঞেস করবো এখন।”
কথাটা শেষ করা মাত্র, দমকা হাওয়ার মতো চলে গেলো।
***
যখন শিন ছি ঘরে ঢুকলো, তখন মিন হুয়ে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলো, ব্যাগে, স্যুটকেসে। পায়ের শব্দ পেয়ে, ঘাড় না ঘুরিয়ে, না তাকিয়েই মিন হুয়ে বললো, “শিন ছি, বাথরুমে তোর খান দুয়েক জামাকাপড় আছে। আমি কেচে, ধুয়ে দিয়েছি তোর জন্য। শুকনো করার জন্য মেলে দিয়েছি বাথটাবের ওপরে। এখনো হয়তো খুব শুকনো হয় নি ওগুলো। এখান থেকে বেরোনোর আগে মনে করে নিয়ে নিস ওগুলো।”
নিজের কথার কোনো সাড়া না পেয়ে, মিন হুয়ে ঘুরে তাকালো। দেখতে পেলো ওর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে শিন ছি, থমথমে মুখে, চেয়ে আছে ঠান্ডা চোখে।
“ব্যাপার কী?”
মিন হুয়ে মৃদু পায়ে শিন ছির দিকে এগিয়ে গেলো, কিন্তু প্রশ্নটা করলো অনেক দ্বিধা নিয়ে। এই সময়েই ওর হৃৎপিন্ড দবদবিয়ে উঠলো এলোপাথাড়ি। একটা সর্বনাশের আঁচ পেলো যেনো।
“মিন হুয়ে,” এই প্রথম শিন ছি ওকে ওর নিজের নামে ডাকল, “তোর কী আমাকে কিছু বলা আছে?”
রাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য, হৃৎস্পন্দনের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য, শিন ছি কথাগুলো বললো অস্বাভাবিক ধীর লয়ে। কিন্তু কিছুতে চাপতে পারলো ন গলার স্বরের কাঁপন।
মিন হুয়ের মুখটা যেনো কেউ ঘষে ফ্যাকাসে করে দিয়েছে। ওর হাতের তালুতে ঘাম, পায়ে কোনো জোর নেই, দাঁতের দুই পাটি জোড়া লেগে গেলো, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলো না। ভীত চোখ পিটপিট করতে লাগলো হরিণের মতো।
দুঃসহ নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। অথচ হাওয়া যেনো ফুটছে। যে কোনো মূহুর্তে বিস্ফোরণ হবে।
“সু তিয়াঁ কোথায়?”
এক পা এগিয়ে এলো শিন ছি। চোখে আগুন জ্বলছে। কেটে কেটে বললো, “আমার সাথে দেখা করতে আসে নি কেনো সু তিয়াঁ?”
মিন হুয়ের সাহস হলো না শিন ছির চোখে চোখ রেখে কথা বলার। শক্ত করে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। নরল স্বরে বললো, “সু তিয়াঁ …. হারিয়ে গেছে আমার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে।”
শিন ছি অপেক্ষা করতে লাগলো মিন হুয়ে আরো বলবে বলে। মিন হুয়ে জানে না কোথা থেকে শুরু করবে।
তোতলাতে তোতলাতে শুরুর থেকে শেষ অবধি পুরোটা বললো মিন হুয়ে - বাসে সু তিয়াঁর সাথে ওর দেখা হবার কথা - দুজনের এক হোটেলে এক ঘরে রাত্রিবাসের কথা - বৃষ্টির রাতে মুশুই নদীর কথা - খোঁজার আর উদ্ধারের চেষ্টার কথা - নীল সোনা প্রমোদগৃহের কথা - ডায়েরির কথা - অনাথাশ্রমের কথা - ইয়ে হুয়া হ্রদের কথা - ইয়ং’আন সাঁকোর কথা। নিজে যা বুঝেছে, যা জেনেছে - সব বিশদে ব্যাখ্যা করে বললো।
“আসলে আমি তোকে সরাসরি বলতেই চেয়ে ছিলাম … যে মূহুর্তে আমাদের দেখা হয়েছে, সেই মূহুর্তে। কিন্তু তুই বললি তোর গুরুতর অপরেসনের কথা। তাতে আমি ভয় পেয়ে ছিলাম যে তুই হয়তো সু তিয়াঁর মৃত্যু সংবাদের আঘাত মেনে নিতে পারবি না - আমি তোর থেকে লুকিয়ে রাখতে চাই নি - সত্যিই, শিন ছি, কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার নেই।”
যাতে শিন ছি বিরক্ত না হয়ে যায়, সেই জন্য মিন হুয়ে সাধ্যমতো নিচু স্বরে বলতে লাগলো। ভঙ্গিমাও খুব নরম। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো যে ও যেনো তখনই শিন ছিকে ধরে ফেলবে।
কিন্তু শিন ছির গর্জন জোরালো হয়ে উঠলো, “ইচ্ছে করে করিস নি? তুই বললি না, ইচ্ছে করে করিস নি? এতোগুলো দিন, রোজ আমরা একসাথে ছিলাম, তোর হাজারটা সুযোগ ছিলো আমার কাছে সত্যি স্বীকার করার। করিস নি কেনো? হম্ম্? মিন হুয়ে, কেনো বলিস নি আমাকে! খাচ্ছিস আমার সঙ্গে, শুচ্ছিস আমার সঙ্গে! কী চাস বলতো তুই?”
“আমি … … একবার … … আমি সত্যিটা বলেছি … … কিন্তু … তুই শুনিস নি … ঘুমিয়ে পড়ে ছিলি।”
“তুই যেনো সত্যিই সত্যিটা বলতে পারিস! বাজে কথা!” ধমকে উঠলো শিন ছি, “তখন বললি যখন আমি ঘুমোচ্ছি?”
“দ্যুইবুচি।” ফোঁপাতে শুরু করলো মিন হুয়ে। “আমি জানি না এরকম কী করে হলো … আমি রোজ সত্যিটা তোকে বলতে চেয়েছি। আমার মনে হয় … হয়তো … তোকে আমারো ভালো লেগে গেছে। শিন ছি, রাগ করিস না, একটু জল খা …”
শিন ছির ঠোঁট রাগে কালো আর বেগুনি হয়ে উঠছে দেখে মিন হুয়ে এতো ভয় পেলো যে, টেবিল থেকে এক গ্লাস জল তুলে বাড়িয়ে দিলো শিন ছির দিকে। গ্লাসটা নিয়ে শিন ছি সেটা আছড়ে মারল দেওয়ালে।
দড়াম করে আওয়াজ হলো। চতুর্দিকে কাঁচ ছিটিয়ে পড়লো।
“তুই ভেবেছিস সু তিয়াঁ পা ধোয়ার কাজ করে, গতর বেচে, তুই নিজেকে ওর মতো ব্যবহার করে আমার কাছে দেনা চুকিয়ে দিবি? এটাই আমার পাওনা তাইনা?”
ভয়ে মিন হুয়ে সরে যাচ্ছে দেখে, শিন ছি মিন হুয়েকে পাকড়ে ধরলো, যেমন বাজার থেকে কেনা আস্ত মুর্গিকে লোকে ধরে তেমন করে, ওর কানের ওপরে চিৎকার করে বললো, “কিন্তু একবারও ভেবেছিস কী তুই সু তিয়াঁ নস, তোকে আমার কেনো ভালো লাগবে? এমন নয় যে আমি এর আগে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী মেয়ে একটাও দেখি নি, পরীর মতো সুন্দরকেও ভালো লাগে নি আমার। তোকেও আমার ভালো লাগে নি।”
“আমি … ইচ্ছে করে ওর জীবন নিয়ে নি।” মিন হুয়ে প্রাণপণে তর্ক জুড়লো, “আমি ওকে চিনতাম না, জানতাম না। আমি ভাবিও নি যে ও আমাকে বাঁচাতে যাবে। তখন আমি শুধু মরতে চেয়েছি। আর কিছু আমি ভাবি নি …”
“মৃত্যু? বাজে কথা। তুই মরতে চাস না!”
বাজ পড়ার মতো হুঙ্কার দিলো শিন ছি, মিন হুয়ের কানে তালা ধরে গেলো, “তুই যদি সত্যিই মরতে চাস, তবে তুই এখনো বেঁচে আছিস কেনো? খুব কষ্ট করে ভান করছিস? ভেক ধরে আছিস অন্য চরিত্রের? নাকি নেশা হয়ে গেছে তোর? এখনো আমার সাথে … FUক! জঘন্য! জঘন্য! যখনই আমার একথা মনে হচ্ছে, তখনই ইচ্ছে করছে যেখানে যেখানে তোকে ছুয়েঁছি আমার গায়ের সেই সমস্ত জায়গা চামড়া ছাড়িয়ে নিতে।”
শূন্য চোখে মিন হুয়ে তাকিয়ে রইলো শিন ছির দিকে। কান্না আর থামে না। মিন হুয়ের শার্টের কলার খানা পেঁচিয়ে ধরে আছে শিন ছি দু হাত দিয়ে, মিন হুয়ের দম যেনো বন্ধ হয়ে আসছে।
“তুই ওকে মেরে ফেলেছিস, মিন হুয়ে।” হঠাৎ করে শিন ছি ছেড়ে দিলো মিন হুয়েকে, দু পা পিছিয়ে গেলো, “ও তোকে স্যুইমিং রিং দিয়ে ছিলো। তোর ওটা নেবার দরকার ছিলো না। কারণ তুই মরতে গিয়ে ছিলি। সহজে, সুন্দরভাবে মরে যেতে পারতিস। পারতিস না? FUকing জলঘোলা না করে, আরেকটা জীবন নাই নিতে পারতিস!”
“আমারই দোষ … আমার ভীষণ দুঃখ হচ্ছে … কিন্তু আমি তো ওকে মেরে ফেলতে কখনোই চায় নি। যদি আবার সেই ঘটনা ফিরে ঘটে, আমি …”
“এখনই ঘটতে পারে না?” শিন ছির চোখ লাল, “এখনই মরতে যা। সোজা মরতে যা। আর যা ফিরিয়ে নিয়ে আয় সু তিয়াঁকে। তুই যদি পারিস এটা করতে, আমি তোর সঙ্গে একমত। FUক! FUক! FUক!”
মিন হুয়ে কখনো চোখের সামনে এমন করে কোনো ছেলেকে কাঁদতে দেখে নি।
মুখ ধুয়ে যাচ্ছে চোখের জলে। শিন ছি হতাশ ভঙ্গিয়ে সোফায় বসে, কাঁদছে দু হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে, আধঘন্টা ধরে, একটাও কথা না বলে।
মিন হুয়ে জানে না কী করা উচিৎ। আস্তে আস্তে ওর কাছে গেলো, গম্ভীর গভীর অনুভূতি উজাড় করে ক্ষমা চাইতে, “শিন ছি, দ্যুইবুচি …”
“বেরিয়ে যা।”
দাঁত কিড়মিড় করে বললো, “আমার সামনে থেকে এক্ষুণি চলে যা। আমি তোকে দেখতে চাই না।”
ঘাড় নাড়লো মিন হুয়ে। চেপে রাখলো চোখের জল। স্যুটকেস খুলে তার ভেতর থেকে একটা বড়ো ব্যাগ বার করলো। সেই ব্যাগের মধ্যে একটা ভ্যাকুয়াম ব্যাগ। তার মধ্যে রয়েছে সু তিয়াঁর জিনিসপত্র, পেংলাই হোটেল আর ল্যান জি গ থেকে যা জড়ো করে ছিলো মিন হুয়ে, “এই গুলো সব সু তিয়াঁর জিনিসপত্র। এগুলো আমি তোর জিম্মায় রেখে গেলাম।”
তারপর ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করলো, “এর মধ্যে পুলিশের সব রিপোর্ট আর অন্যান্য কাগজপত্র আছে। নিখোঁজ বলে যে রিপোর্ট করে ছিলাম সেই ফর্মও আছে। পারলে দেখিস। সু তিয়াঁ হারিয়ে গেছে। আমি ওকে এখনো খুঁজে পাই নি। আমি ওর খোঁজ চালিয়ে যাবো। আশা ছাড়িস না, ও এখনো বেঁচে থাকতে পারে।”
কথা কটা শেষ করে স্যুটকেস টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মিন হুয়ে, “আমি যাচ্ছি। ঝাইজিয়ে।”
“দাঁড়া।” বলে উঠলো শিন ছি।
মুখের ওপর একটা ছায়া পড়লো মিন হুয়ের, বুকের ভেতরে একটা ব্যাখ্যাতীত মোচড় দিলো যেনো।
মিন হুয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো শিন ছি, মুখে তখনও চোখের জল মাখামাখি। কিন্তু অভিব্যক্তিতে সমাহিত ভাব ফিরে এসেছে, “মিন হুয়ে, আমার চোখের দিকে তাকা।”
মিন হুয়ে মুখ তুলে তাকালো শিন ছির চোখের দিকে, নিঃশব্দে।
চোখটা শান্ত নয়। হিম শীতে ভরা।
“এখন থেকে, তোর আর আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”
গলার স্বরে সমস্ত শৈত্য ঢেলে দিলো, “আমি তোকে চিনি না, তুই আমাকে চিনিস না।”
“...”
“আমার মুখের ওপরে এই কথাগুলো আরেকবার বল, প্লিজ।”
“এখন থেকে তোর আর আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তোকে চিনি না, তুই আমাকে চিনিস না।”
“আমি তোর থেকে এই শপথটা চাই।”
“আমি শপথ করলাম।” পিঠ শক্ত সোজা করে নিলো মিন হুয়ে।
“আমি তোকে আর দেখতে চাই না কোনো দিন।”
“তুই দেখবি না।”
“তোকে সু তিয়াঁ জীবন দিয়েছে। প্লিজ, যত্নে রাখিস।”
তারপরে বললো, “তুই আমার সম্মতি না নিয়ে মরতে পারবি না।”
একটা অদ্ভুত লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠলো মিন হুয়ের। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললো, “শিন ছি, আমার প্রাণের ঋণ সু তিয়াঁর কাছে। তোর কাছে আমার কোনো দেনা নেই।”
“ভুলে গেলি?”
“ওটা আমারও প্রথমরাত, প্রথম বার।”
“নির্লজ্জ মিথ্যুক!”
“আমি যখন খুশি মরতে পারি। তুই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবি না।”
মিন হুয়ে সমস্ত অশ্রুটুকু গিলে নিলো, নাক দিয়ে যা উপছে আসছিলো, সেটাও টেনে নিলো নাকের ভেতরে। ওর গলায় গিয়ে লাগলো। আঙুল থেকে আঙটিটা খুলে শিন ছির সামনের টেবিলে রেখে দিলো। তারপর স্যুটকেস টেনে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
ওর পিছনে দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেলো।
****
হোটেলটা বাস স্টেশন থেকে মাত্র পনেরো মিনিটের হাঁটা দূরত্বে। কিন্তু মিন হুয়ের হাঁটার উৎসাহ ছিলো না। হোটেলের দরজায় অপেক্ষা করলো পাঁচ মিনিট, কিন্তু কোনো ট্যাক্সি পেলো না। একটা ট্রাইসাইকেল পাবার চেষ্টা করছিলো যাতে চড়ে যাবে স্টেশন অবধি, যখন ওর পিছন থেকে পায়ের শব্দ এলো।
একটা স্বর জিজ্ঞেস করলো, “মিন শাওজিয়ে, আমার একটা গাড়ি আছে। আমি কী আপনাকে পৌঁছে দেবো স্টেশনে?”
মিন হুয়ে ফিরে দেখলো, দেঁ চেন।
গাড়িটা পরিস্কার। ভেতরের গন্ধে মনে হলো এয়ার ফ্রেশনার দেওয়া হয়েছে। সারাটা পথ মিন হুয়ে কোনো কথা বললো না। দেঁ চেনও চুপ করে ছিলেন।
শিগগিরিই পৌঁছে গেলো গাড়ি দূর পাল্লার স্টেশনে। মিন হুয়ে একটা টিকিট কিনে নিলো। গাড়িতে ওঠার সময়ের তখনও আধঘন্টা বাকি ছিলো। মিন হুয়েকে বসতে হলো ওয়েটিং হলে।
সারাটাক্ষণ দেঁ চেন ওকে অনুসরণ করলেন।
“আপনি ফিরে যেতে পারেন।” মিন হুয়ে বললো, “আমাকে বিদায় জানাতে আশার জন্য ধন্যবাদ।”
দেঁ চেন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, “তুমি গাড়িতে উঠলে তবে আমি যাবো।” হাতের কাপে একটা চুমুক দিলেন।
খানিক পরে, হঠাতই জানতে চাইলেন, “তোমার রেজিউমি দূর্দান্ত। তোমার ভবিষ্যতও উজ্জ্বল। তাহলে নদীতে ঝাঁপ দিতে গেলে কেনো, তুমি তো ভালো মেয়ে?”“আপনি আমার রেজিউমিও দেখেছেন!” উপহাস চোখে ভরে তাকালো মিন হুয়ে দেঁ চেনের দিকে। “নিজে একটা ব্যাখ্যা খাড়া করে নিতে পারছেন না? আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেনো?”
“আমি কতগুলো থিওরি খাড়া করতে নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু আমি তোমার ব্যাখ্যাটা শুনতে চাই।”
“আমার মা ছাড়া কেউ আমার ব্যাখ্যা বিশ্বাস করে নি।” চোখ লাল হয়ে উঠেছে মিন হুয়ের।
“তাহলে তোমার মা কী বলেছেন?”
“আমার মা মারা গেছেন।”
“যদি এরপরে কোনো ঝামেলায় পড়ো, তাহলে দুম করে মরতে যেও না। আমাকে ফোন কোরো।”
দেঁ চেন একটা বিজনেস কার্ড বার করে মিন হুয়ের হাতে দিলেন, “এমন নয় যে আমি তোমার মুস্কিল আসান করে দেবো। কিন্তু আমি তোমাকে কতকগুলো ধারণা দিতে পারি।”
মিন হুয়ে চুপচাপ কার্ডটা নিজের পকেটে পুরে নিলো।
“গাড়ি আসছে। লাইনে গিয়ে দাঁড়াও।” হালকা স্বরে বললেন দেঁ চেন।
মিন হুয়ে দাঁতে দাঁত চেপে, লম্বা ভিড়ের পিছু পিছু উঠে পড়লো বাসে।
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-15.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-17.html
No comments:
Post a Comment