সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং ………
২০০৩ ও ২০০৪ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী স্পষ্টত পাকিস্তানবিরোধী, তবুও ২০১৬-তে ভূতপূর্ব পাকিস্তানি নাগরিক সঙ্গীত শিল্পী আদনান সামি ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছেন ধারা ৬ অনুসারে ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে। এসব নিয়ে কোনও হল্লা হয় নি।
২০০৩ এবং ২০০৪ সালের সংশোধনে নাগরিকত্ব আইন বেশ কিছু প্রথম পদক্ষেপ নেয়। যেমন জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার সংজ্ঞায় শর্ত দেওয়া হয় যে জাতকের পিতা বা মাতার অন্তত একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে এবং জাতকের জন্মের সময় অনাগরিক জনক বা জননীর বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হওয়া চলবে না। আবার এও স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয় যে পাকিস্তানে (অবিভক্ত পাকিস্তানে এবং এখনকার পাকিস্তানে) এবং বাংলাদেশে জন্মানো জনক জননীর সন্তান ভারতীয় বংশোদ্ভুত বলে গণ্য হবেন না। ভারতীয় বংশোদ্ভুত বলে পরিচিতি পাওয়ার নিয়মে কিছু পরিবর্তন ২০১৫ সালেও এসেছিল। ২০১৯-এও এসেছে। দুই ক্ষেত্রেই ভারতীয় বংশোদ্ভুতের প্রাপ্য অধিকার ও সুবিধা কমেছে।
২০১৫-এর সংশোধন অনুসারে ভারতীয় বংশোদ্ভুত বলে পরিচিত কেউ যদি সেই পরিচিতি নিজে ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে রদ করে দেন কিংবা আইনি স্খলনে হারান, তবে তাঁর বিবাহিত দোসর এবং সন্তান তাঁর সাথেই সেই পরিচিতি হারাবেন। তাছাড়াও এই সংশোধনী খারিজ করে দেয় ভারতীয় বংশোদ্ভুতদের ভারতের রাষ্ট্রপতিত্ব, উপরাষ্ট্রপতিত্ব, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকার এবং সংবিধানের ধারা ১৬ অনুসারে সরকারী পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অধিকার।
২০১৯-এর সংশোধনী অনুসারে ভারতীয় বংশোদ্ভুতের ওভারসিস সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া কার্ড খারিজ হয়ে যাবে যদি এই কার্ডের অধিকারী কেউ কোনো আইন ভাঙেন। আইন এখানে শুধু নাগরিকত্ব আইন বা ভারতের আইন নয়, যে কোনো আইন। তবে ঐ মানুষটির ভারতীয় বংশোদ্ভুত হওয়ার পরিচয়পত্র খারিজ হয়ে যাওয়ার আগে তাঁকে স্বপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হবে।
নাগরিকত্ব আইনের ২০১৯-এর সংশোধন নিয়ে প্রতিবাদের খ্যাতনামা মুখ যেগুলো, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, তার অনেকগুলিই আজকের তারিখে সম্ভবত ভারতীয় নাগরিকের নয়, ভারতীয় বংশোদ্ভুতদের। ২০১৯-এর নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন সম্পূর্ণ খারিজ হয়ে গেলে, ভারতীয় বংশোদ্ভুতদের যে অধিকার ও সুবিধা খর্ব হয়েছে, সেগুলোও বাতিল হয়ে যাবে।
. ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫ সালের আগে, বেআইনি অনুপ্রবেশ নিয়ে ও অনুপ্রবেশকারীর সন্তানের নাগরিকত্বের শর্ত নিয়ে সংশোধনী ১৯৮৫ সালেও এসেছিল। ১৯৮৫ সালের সংশোধনী নাগরিকত্ব আইনের সবচেয়ে বড়ো সংশোধনী। এই সংশোধনী ১৯৫৫-এর মূল আইনে জুড়ে দেওয়া ধারা ৬ক। এই ধারা প্রণোয়নের আগে মারদাঙ্গা হয়েছিল কিছু, কিন্তু সে শুধু অসমে। অসম অ্যাকর্ড নামে পরিচিত ধারা ৬ক অনুসারে অসম রাজ্যের চিহ্নিত সীমায় বসবাসকারীদের মধ্যে কে নাগরিক আর কে বিদেশী সেই বিষয়টি নির্দিষ্ট হয়।
এই ধারা সংজ্ঞাত করে যে বিদেশী মানে সেই সব মানুষ যাঁরা ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স অ্যাক্টের সংজ্ঞানুসারে চিহ্নিত বিদেশী এবং/ অথবা যাঁরা ১৯৬৪ সালের ফরেনার্স ট্রাইবুন্যাল অর্ডার অনুসারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের রায়ে নির্ধারিত বিদেশী। এই ধারা ভারতীয় নাগরিকের সংজ্ঞায় শর্ত দেয় -
যে ব্যক্তি ১৯৮৫ সালের ধারা ৬ক প্রণয়নের আগেই ভারতীয় নাগরিক ছিলেন এবং এই ধারা প্রণয়নের ষাট দিনের মধ্যে ভারতের নাগরিকত্ব (যথাযথ পদ্ধতি মেনে) ত্যাগ করেন নি
যে ব্যক্তির পিতা/মাতা কিংবা পিতামহ/পিতামহী কিংবা মাতামহ/মাতামহীর একজন অন্তত অবিভক্ত ভারতে জন্মেছেন
যে ব্যক্তি ১৯৬৬ সালের ১লা জানুয়ারির আগে “নির্দিষ্ট এলাকা” থেকে আসামে এসেছেন, (তাঁর নাম ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্বে নির্বাচক তালিকা অন্তর্ভুক্ত করা হলেও)
“নির্দিষ্ট এলাকা”-র অর্থ কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই। ১৯৮৫ সালে ধারাটি প্রণয়নের সময় বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র, কিন্তু ধারার বিভিন্ন সংজ্ঞার কালের সময়সীমা যেমন ১৯৬৬ সালের ১ লা জানুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ -এর আগে অবধি বাংলাদেশের অস্তিত্ব ছিল না। ছিল পূর্ব পাকিস্তান বা পাকিস্তান। সেই জন্য, হয়তো, ১৯৬৬ সালের ১ লা জানুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ -এর মধ্যে ভারতের বাইরে থেকে অসমে অনুপ্রবেশের ভৌগোলিক উৎসগুলিকে “নির্দিষ্ট এলাকা” বলা হয়।
(চলবে)
লেখা : 2020
প্রকাশ : 2021, 2022
পুরো বই : https://www.amazon.com/dp/B09875SJF8