সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং ………
২০১৯-এর নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী ধর্মনিরপেক্ষতার বিচারে অসাংবিধানিক কিনা সেটা কেবলমাত্র সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারণ করতে পারে। তবে বাংলাদেশের গবেষকের গবেষণাপত্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদনে, পাকিস্তানের স্বদেশত্যাগী অভিবাসীদের সংগঠনের মুখপত্রে এবং রাষ্ট্রসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে ভারতের প্রতিবেশী শরিয়া রাষ্ট্রগুলিতে (আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে) কিভাবে অমুসলিম মানুষদের স্থাবরাস্থাবর সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে আইনসভায় আইন প্রণয়ন করে, বিচারব্যবস্থার রায়ে, কার্যনির্বাহী দপ্তরের উদ্যোগ ও তৎপরতায়।
সেই হিসেবে ২০১৯-এর নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী প্রতিবেশী শরিয়া কিংবা ইসলামিক রাষ্ট্র থেকে ভারতে এসে পড়া অমুসলিম মানুষদের আইনি পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে ২০০৩, ২০০৪ -এর সংশোধনে বাধা বেআইনি অনুপ্রবেশের সংজ্ঞার পরিসরকে সংকুচিত করেছে। কিন্তু এই সংজ্ঞার সীমার বাইরে রয়ে গেছেন আহ্মদিয়া গোষ্ঠীর মুসলিমরা। তাই ২০১৯-এর নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীটিতে মুসলিমবিরোধী প্রবণতা প্রকাশ হচ্ছে বলে কেউ কেউ মনে করেছেন। এই যুক্তিতে নাগরিকত্ব আইনের ২০১৯এর সংশোধনীটি ইহুদীবিরোধী, বাহাইবিরোধী, সায়েন্টোলজিবিরোধী, তাওবিরোধী, কনফুসিয়াসিজমবিরোধী, শিন্তোবিরোধীও বটে।
তাছাড়া আহমদীয়রা শরিয়ৎ অনুসরণ করেই জীবন যাপণ করেন যদিও তাঁরা মাহ্দি মানে মহম্মদ পরবর্তী পয়গম্বরের উপাসনা করে সুন্নী সমাজে ব্রাত্য। শরিয়ৎ মেনে চলা আহমদীয় মানুষদের শরিয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বাঁচানোর চেষ্টাটা সেই মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থীও বটে। আবার সেই চেষ্টাটা জলের মাছকে ডাঙায় তুলে বাঁচানোর চেষ্টা করার করার মতো অবাস্তবিকও বটে।
কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে ২০১৯-এর নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী সংবিধানের ধারা ১৪-এর প্রতিশ্রুত সাম্যের অধিকার অবমাননা করেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি আর ক্রিশ্চানদের একদলে করে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গেই দেখা গেছে যে, সংবিধানের ধারা ২৫-এ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন শিখদের একত্র করা হয়েছিল। তাছাড়া সংবিধানেই বলা আছে যে এই জাতীয় শ্রেণীবিন্যাস তৈরি করার দায়িত্ব এবং অধিকার দুইই সংসদের উপর ন্যস্ত আছে, সংবিধানের ১৪ নং ধারাতেই। আচার্য দূর্গা দাস বসু লিখেছিলেন যে, এই শ্রেণীবিন্যাসের প্রকৃতি, ব্যক্তি বিশেষের প্রয়োজন এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংসদ নির্ধারণ করতে পারে। আচার্য বসু কলকাতা হাইকোর্টের এক রায়কে উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে সাম্যের অর্থ হলো সম পরিস্থিতে সকলের উপর একই দায়িত্ব ও অধিকার বর্তানো। নাগরিকত্ব আইনের ২০১৯ সালের সংশোধনীতে যেভাবে নানান ধর্মের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে তাতে সম অধিকার ও দায়িত্ব অর্পণের সাংবিধানিক পদ্ধতির অবমাননা ঘটেছে কিনা তা আইনত কেবলমাত্র সুপ্রিমকোর্ট নির্ধারণ করতে পারে।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০১৯, লাগু হওয়ার পরে পরেই সংবাদে প্রকাশ পেয়েছিল যে অনধিক বত্রিশু হাজার মানুষ এই সংশোধনীর আওতায় নাগরিকত্ব পাবেন। ২০২১ সালের বাদল অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন যে এই সংশোধনী শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই ত্রিশ লাখের বেশি লোককে নাগরিকত্ব দেবে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় এই যে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০১৯ কতোটা অনুপ্রবেশকারী ভারতবাসীকে ধর্মান্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য আর কতোটা ক্ষমতার দীর্ঘমেয়াদী অভিলাষায়?
সাধারণ মানুষের জন্য আইন একটা নিয়ম যেটা লাগু থাকে একটা দেশে একটা কালে সেই দেশের ঐ কালের বাসিন্দাদের ওপর। যেমন একটা মাঠে খেলার নিয়ম থাকে খেলোয়ারদের ওপর। দেশের কালের খেলাটাকে নারাণ সান্ডেল নাম দিয়েছিলেন “দু কুড়ি সাতের খেলা”। সেটা রক্তাক্ত যদিও, তবুও সে খেলার নিয়ম বাঁধা হয়েছিল ১৯৫০-এর ২৬শে জানুয়ারি সংবিধান প্রণয়ন করে। তারপর নাগরিকত্বের নিয়ম আসে ১৯৫৫ সালে। সেই নিয়ম পর্যায়ক্রমিক সংশোধনে যা দাঁড়িয়েছে তাতে কোথাও লালকার্ড দেখিয়ে খেলোয়ারকে মাঠের বাইরে বার করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। যা আছে তা মোটামুটি হলুদ কার্ড দেখানোর বন্দোবস্ত। সেই বন্দোবস্তের যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। এই চলতে থাকা বিতর্কই গণতান্ত্রিক সমাজের জিয়নকাঠি।
লেখা : 2020
প্রকাশ : 2021, 2022
পুরো বই : https://www.amazon.com/dp/B09875SJF8