১৩. স্বীকারোক্তি
আধঘন্টা পরে অবশেষে শিন ছি আর মিন হুয়ে তং মিংহাওকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো হাসপাতালে। পরীক্ষা করে ডাক্তাররা বললেন যে হতে পারে যে অপরিচিত লোকেদের দেখে রোগী আতঙ্কিত হয়ে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওঁরা শিন ছি আর মিন হুয়েকে আরো কিছুদিন থেকে যেতে বললেন গেস্ট হাউসে, বললেন তং মিংহাও-এর সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করতে।
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “তাহলে ও কবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে?”
“সেটা নির্ভর করছে রোগের বাড়বৃদ্ধির ওপর।” ডাক্তার ভাবছে যে মিন হুয়ে হয়তো খরচের কথা ভাবছে। “আপনি যেহেতু বকেয়া টাকা মিটিয়ে দিয়েছেন, হাসপাতাল এখনো কিছুদিন রোগীকে রাখতে পারবে।”
বেশ কিছুদিন? …… কতো দিন? মিন হুয়ে অল্প হলেও উতলা হচ্ছিলো।
যা হোক, এটা বাড়ি নয়। হাসপাতালে রাখার খরচ বাবদ সাতাশ হাজার য়ুঁয়াঁ হাসপাতাল থেকে তং মিংহাওকে ছাড়ানোর জন্য দিয়ে দেবার পরে মিন হুয়ের সঞ্চয়ের সবটাই চলে গেছে। এরপর তং মিংহাও হাসপাতালে থাকলে মিন হুয়েকে হয়তো শিন ছির থেকে ধার করতে হবে।
বেরোনোর সময়ে, শিন ছি আগে বাথরুমে গেলো। ডাক্তার মিন হুয়ের দিকে তাকিয়ে একটু কেশে হঠাতই জিজ্ঞেস করলেন, “ওর কী হার্ট অ্যাটাক হয়েছে?”
মিন হুয়ে এক মূহুর্তের জন্য চমকে উঠলো। তারপর ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।
“উনি যখন ঘরে ঢুকলেন, তখন ওঁর ঠোট বেগুনী হয়ে ছিলো।”
“...... অসুখটা জন্মগত।”
“তাহলে আপনাদের সজাগ, সাবধান থাকতে হবে। কোনো ধকলের ব্যায়াম ওঁর করা চলবে না।”
“কী ধরনের ব্যায়ামে ধকল হয়?”
“দৌড়োনো, সাঁতার কাটা, বক্সিং …”
ডাক্তার আর কিছু বললেন না। আর মিন হুয়ের মনে আরো দুশ্চিন্তা ঘনিয়ে এলো। তার কেবলই মনে হতে লাগলো যে শিন ছির হার্ট একটা টাইম বোমা আর মিন হুয়ে যেনো বোম নাশ করার ওস্তাদ। ও যদি কোনো ভুল করে তো বোম ওর সামনেই ফাটবে।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে শিন ছিকে দেখে মিন হুয়ে খেয়াল করলো শিন ছির বেগুনী ঠোঁট। সে জানে না যে এটা তার অভিজ্ঞতার অভাব নাকি তার মনের ভুল। বেগুনী রংটা এতো উজ্জ্বল যেনো মনে হচ্ছে শিন ছি লিপস্টিক লাগিয়েছে। যেনো টোয়াইলাইটের এক ভ্যাম্পায়ার।
“তোর শরীর ভালো তো?”
“কী হতে পারে?”
“ডাক্তার বলছিলো তোর কোনো ধকলের কাজ করা চলবে না।”
শিন ছি যেনো শুনতেই পেলো না কথাগুলো। মিন হুয়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললো, “যা, যা, আমার ঘরে গিয়ে ফুটি খা দেখি।”
“দ্যগ্য, খাবার আগে চান তো করবি?” বলে মিন হুয়ে জামায় লেগে থাকা কাদার কালচে ছোপগুলো দেখালো।
দুজনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলো। আবহাওয়া খুব গরম। ফেরার পথে ভিজে জামা গরমের তাতে শুকিয়ে গেছে। শরীরে রেখে গেছে জোলো গাছগাছড়া আর মরা মাছের গন্ধ।
“তুই অমন করে বললে আমার সারা গায়ে চুলকুনি দেয়।” শিন ছি চোখ পিটপিট করলো। “তাহলে, পরে দেখা হবে।”
তারপর মিন হুয়ের মুখে চুমু দিলো। একজন নার্স পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদের দুজনকে পরস্পরের আদরমগ্ন দেখে মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসলো।
মিন হুয়ে চোখ দিয়ে শিন ছিকে পুড়িয়ে দিলো আর কি। শিন ছি মিন হুয়ের আঙুলগুলো নিজের মুখে পুরে দিয়ে কামড় লাগালো, “আমি এগুলো সত্যিই খেতে চাই …”
“এতো লোকজন চারদিকে… এদের সবার সামনে একটু সংযত হতে পারিস না?”
“তার মানে একান্তে সংযমের দরকার নেই? তিয়াঁ তিয়াঁ, কী মিষ্টি, কী মিষ্টি, বেবি!”
মিন হুয়ে হাসতেও পারলো না। কাঁদতেও পারলো না। যতোক্ষণ ও চললো সাথে সাথে, পাশে পাশ্ ততোক্ষণ খুনসুড়ি করতে লাগলো।
ঘরে ফিরে, স্নানঘরে গিয়ে গরম জলের ধারার নিচে দাঁড়িয়ে মিন হুয়েকে আবার উৎকন্ঠা চেপে ধরলো।
দ্বিধা দ্বন্দে সে বার বার বডিওয়াশ লাগিয়ে যেতে লাগলো গায়ে। ওর মুখ, ওর মাথা বার বার ডলে ডলে পরিস্কার করলো। জপতে লাগলো সু তিয়াঁর নাম।
যদি সু তিয়াঁ স্বর্গে গিয়ে থাকে, ও আশা করলো যেনো সু তিয়াঁ ওর স্বপ্নে এসে ওকে বলে যায় ওর কর্তব্য কী। তং মিংহাও এখন বেশ কিছু দিন ছাড়া পাবে না হাসপাতাল থেকে। শিন ছির কোনো ইচ্ছেই নেই মিন হুয়েকে ছেড়ে যাবার আর ওর হার্টের সার্জারি পেছোতে থাকবে। এই এলাকাটা বড়ো কোনো শহরের থেকে অনেক দূরে। হার্ট অ্যাটাক হলে শিন ছিকে বাঁচানো মুস্কিল হবে। এখন মিন হুয়ে নিজেকে সু তিয়াঁ মনে করতে শুরু করলো। সু তিয়াঁ ঘনিষ্ঠ, একনিষ্ঠ আর আবেগপ্রবণ। শিন ছি যদি এখন সত্যিটা শোনে তাহলে নিশ্চয়ই ভীষণ রেগে গিয়ে চলে যাবে নিউ ইয়র্কে আর সার্জারি যথা সময়ে হয়ে যাবে।
স্বীকারোক্তি, না গোপণীয়তা?
মিন হুয়ে নিজের সঙ্গে এমন যুদ্ধ বাধালো যে ওর পেটে ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। ছটফট করে দেওয়ালে কিল মারার সময় মিন হুয়ে শাওয়ারটাকে পুরোদমে চালিয়ে দিলো। গায়ে ওর গরম জল পড়তে লাগলো মুষলধারে বৃষ্টির মতো।
মিথ্যে বলা উচিৎ হয় নি। এমন কি ভালো করার মন নিয়েও মিথ্যে বলা উচিৎ হয় নি।
যুক্তির ঘোলা জল আরো গুলিয়ে উঠতে লাগলো। এক সময়ে গুলোনোর ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণও চলে গেলো। গরম জলের তোড়ে গলদা চিংড়ির মতো টকটকে লাল হয়ে যাওয়া নিজের ত্বকের দিকে চাইলো মিন হুয়ে। ভাবলো এই মূহুর্তে শিন ছি কী ভীষণ খুশি, কী বিরক্তই না হবে সত্যিটা জানতে পারলে, কী ভীষণ ঘেন্নাই যে তখন করবে।
হঠাৎ মিন হুয়ে ভয় পেয়ে গেলো। ও ভয় পেতে লাগলো যে সত্যি বলার ফলাফল খুব সুখের হবে তো নাই, উল্টে প্রচুর দুশ্চিন্তার কারণ আছে। ও ভয় পেতে লাগলো ওর নিজের অপরাধবোধের যন্ত্রণার কথা ভেবে।
যদি ও প্রথম আলাপের মূহুর্তেই শিন ছিকে সত্যিটা বলে দিতো, তাহলে ও শুধু দুসংবাদের বাহক হতো। শিন ছি খুব দুঃখ পেতো কিন্তু মিন হুয়েকে ঘেন্না করতো না এতো।
কিন্তু এখন কথাটা ভেবে মিন হুয়ে আর স্থির থাকতে পারলো না। ওকে এখনই সত্যিটা বলতে হবে।
যেভাবে হোক বলে ফেলতেই হবে সত্যিটা।
ও গরম জল বন্ধ করে দিলো। বাথরুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো, শরীর শুকনো করে নিলো। কোনো বাছাবাছি না করে একটা টিশার্ট আর একটা শর্টস পরে নিলো। ভিজে চুল শুকোনোর দরকারই বোধ করলো না। চটপট পাশের ঘরে চলে গেলো।
এবারে দরজা খুলতে অনেক সময় লাগলো।
যেই শিন ছিকে দেখতে পেলো মিন হুয়ে অমনি মিন হুয়ে বললো, “তোকে কিছু বলার আছে আমার -”
বাকি কথা বলার আগেই মিন হুয়ে নজর করলো যে শিন ছির চোখ কোঁচকানো আর মাথার চুল ভিজে। একটা কালো সিল্কের পাজামা পরে আছে। ওকে দেখে মনে হলো যে ওর ঘুম এখনো ভাঙে নি।
“তুই কী ঘুমোচ্ছিস?”
“না, আয়। বল কী বলবি।”
শিন ছি মিন হুয়েকে সোফার কাছে নিয়ে গেলো। বসলো ওর সাথে। কফি টেবিলের ওপরে কেটে রাখা ফুটির দিকে দেখালো আঙুল দিয়ে, “ফুটি খাবি?”
“কী হয়েছে তোর?”
মিন হুয়ে বেশ জোর দিয়েই জানতে চাইলো, “কী হয়েছে বল তো?”
শিন ছি আশ্বস্ত করলো, “ঠিক আছে। বিশ্রাম নিতে লাগবে শুধু।”
শিন ছিকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কথাটুকু বলেই ও সোফায় ঠেসান দিয়ে বসলো। চোখ বন্ধ করে বললো, “তুই বল, আমি শুনছি।”
নিজেকে শান্ত রাখার জন্য মিন হুয়ে এক খন্ড ফুটি তুলে নিলো। একটা কামড় দিলো। তারপর খন্ডটা আবার প্লেটে রেখে দিলো। শিন ছির মুখের দিকে তাকাতে সাহস করলো না। শিন ছির পায়ের দিকে তাকানোর সাহস হলো শুধু, “আমি, আমি সু তিয়াঁ নই।”
“সু তিয়াঁ নদীতে পড়ে যায়, নিরুদ্দেশ হয়ে যায় আমাকে বাঁচাতে গিয়ে ……”
“যখন আমাদের প্রথম দেখা হয়ে ছিলো আমি তখনই তোকে বলতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু শুনলাম তোর হার্ট অ্যাটাকের কথা। আমি দুর্ঘটনার কথা ভেবে ভয় পেয়েছি। আমি কিছু দিনের জন্য সত্যিটা তোর থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি, পরে কোনো একটা সময় দেখে বলব বলে। সেই থেকে আমি কোনো সুযোগই পাই নি।”
“আমি এটা ইচ্ছে করে করি নি। আমি আমার জীবনের জন্য সু তিয়াঁর কাছে ঋণী। তোর যদি রাগ হয় তো তুই আমাকে মারতেও পারিস, আমার ওপর চেঁচাতেও পারিস - তোর যা খুশি।”
মিন হুয়ে যতোক্ষণ সত্যিটা বললো, ততোক্ষণ ফুঁপিয়ে কেঁদে চললো। শুরুর থেকে সেই মূহুর্ত পর্যন্ত সবটা বলে ফেললো। তারপর বসে বসে ভাবতে লাগলো যে সবটা বলেছে কিনা। এই ভাবার সময়েও অনেকক্ষণ শিন ছি চুপ করে আছে দেখে মিন হুয়ে ভাবলো যে শিন ছি এতো রেগে আছে যে কিছু বলতে পারছে না। শেষ শব্দটা বলার পরে, খানিকটা সাহস করে শিন ছির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “তুই কী আমাকে ক্ষমা করতে পারবি, শিন ছি?”
“শিন ছি?” একটু ঠেলা দিয়ে দিয়ে আবার ডাকল, “শিন ছি?”
একটা ঝটকা দিয়ে সোজা উঠে বসলো শিন ছি, “হুঁ?”
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “তুই কী শুনলি আমি এতোক্ষণ তোকে যা বললাম?”
শিন ছি একটু অবাক হলো। গভীরভাবে মিন হুয়েকে দেখতে লাগলো, ওর কালো দু চোখ ঝিকমিক করছে। মাথা নেড়ে বললো, “সরি …… এই মাত্র আমি ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম।”
“আরেকবার বলবি?”
“এর মধ্যেই?”
“আমি ওষুধ খেয়ে ছিলাম। সাধারণত ওষুধের কোনো সাইড এফেক্ট হয় না। কিন্তু জানি না, এখন কেনো জানি না আমার খুব ঘুম পাচ্ছিলো।”
“এখন কী অবস্থা?”
“ঘুম পাচ্ছে এখনো।”
“তাহলে এখানে বসে ঘুমোতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হচ্ছে। চল, আমি বেরিয়ে যাই। তুই গিয়ে খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়।”
মিন হুয়ে ওকে খাট পর্যন্ত নিয়ে গেলো। শুইয়ে দিলো। গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে দিলো।
শিন ছি শক্ত করে মিন হুয়ের হাতটা ধরলো। কিছুতেই ছাড়বে না। মিন হুয়ের কোনো উপায় রইলো না শিন ছির পাশে শুয়ে পড়ে ওর পিঠে হাত দিয়ে ডলে দেওয়া ছাড়া, “এখানে অস্বস্তি হচ্ছে? এখানটায় টিপে দেব?”
“আমাকে ধরে থাক।”
মিন হুয়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো পিছন দিক থেকে। শিন ছি মুখ ফিরিয়ে শুলো, মিন হুয়ের দু হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়ে। বিড়বিড় করে কিছু বললো, নিজেও জানে না কী বলছে।
ওহ্! আবার সব বৃথা গেলো। মিন হুয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেললো। শিন ছির চুলে ওর আঙুলের চিরুণি চালাতে লাগলো, আর গুনগুন করতে লাগলো, “আমি সু তিয়াঁ নই, তুই কী শুনতে পাচ্ছিস? শিন ছি, আমি সু তিয়াঁ নই। আমি সু তিয়াঁ নই। আমি সত্যিই সু তিয়াঁ নই।”
“আমি জানি, তুই সু তিয়াঁ নস।” বিড়বিড়িয়ে উঠলো শিন ছি, “তুই চাস যে আমি তোকে মিন হুয়ে বলে ডাকি, ঠিক তো?”
“না …”
“আমার তোকে সু তিয়াঁ বলে ডাকতেই ভালো লাগে এখনো …”
হায় হায়, এর মানে কী!
মিন হুয়ে জোরে জোরে ধাক্কা দিলো শিন ছিকে, শিন ছিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টায়, যাতে সু তিয়াঁর হারিয়ে যাবার কথাটা আবার বলতে পারে। কিন্তু শিন ছি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বাচ্চাদের মতো দ্রূত ক্ষণস্থায়ী শ্বাস পড়ছে। যেনো নিজের বাড়ির আরামে ঘুমোচ্ছে শান্ত হয়ে।
ধীরে ধীরে মিন হুয়ের মনও শান্ত হলো।
সব মিলিয়ে, যা হোক, সে সত্যিটা বলেই ফেলেছে, তাই না? যদিও শিন ছি তার বিন্দু বিসর্গও শোনে নি, তবুও সাহস করে মিন হুয়ে যে বলতে পেরেছে, সেটাই তো বেশ সাহসের কাজ!
মিন হুয়ের অনেকটা হালকা লাগলো।
ঘরের ভেতরটা এয়ারকন্ডিশনারের জন্য ঠান্ডা বেশ। মিন হুয়েও অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো।
যখন মিন হুয়ের ঘুম ভাঙলো, তখন খাটের পাশের টেবিলে রাখা ইলেক্ট্রনিক ঘড়িতে রাত আটটা বেজে গেছে। এয়ারকন্ডিশিনারের শব্দটা বেশ কানে লাগছে। ঘরের পর্দাগুলো টান টান করে ঢেকে রেখেছে বাইরের দৃশ্য আর আলো।
শিন ছি আগেই জেগে উঠেছে। মিন হুয়ের পাশে শুয়ে চুপ করে দেখে চলেছে ওকে।
মিন হুয়ে একটু অপ্রস্তুত হলো, শিন ছির চেহারা দেখে। অন্য পাশে ফিরে শুলো, কিন্তু শিন ছি ওকে ফের নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো।
“সেদিন তুই বললি - তুই চাস না যে আমি তোর ফেলে আসা দিনগুলোর কথা জানতে চাই। কারণ সেই দিনগুলোতে যা ঘটেছে তা মনে করলেই তোর দুঃখ হয়। আমি সেই থেকে ভেবে চলেছি, যখন আমরা একসাথে ছিলাম, তখন ওই বয়সের বাচ্চাদের সঙ্গে যা হয়েছে সেটা কী যথেষ্ট দুঃখের নয়? আমাদের ভাগ্য কী আমাদের যথেষ্ট উৎপীড়ন করে নি? তুই আমাকে কেবল জিজ্ঞেস করতিস ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে এমন করছেন কেনো? কবে এমন জীবন - এমন জীবন যাতে ঘরবাড়ি নেই, আত্মীয় পরিজন নেই - কবে শেষ হবে?”
“আমি তোকে আজ বলছি, তিয়াঁ, তিয়াঁ, তোর যদি ফেলে আসা দিনের কথা বলতে খুব কষ্ট হয়, তুই যদি সে সব কথা বলতে না চাস, তবে আমাকে সেই সব কথা বলার দরকার নেই। যাই হয়ে থাক সেই দিনগুলোতে, যতোই খারাপ হোক না কেনো সেই সব দিনের পরিস্থিতি, আমি বুঝতে পারছি। আমি তোকে ক্ষমাও করে দিলাম। আমি তোকে ভালোবাসি। দুনিয়ার কিচ্ছু সেটা বদলাতে পারবে না। আমি এসেছি তোর কাছে তোকে এটাই বলতে যে দুর্দিন শেষ হয়ে গেছে। আমি এখানে থাকি বা না থাকি, আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো যাতে তুই স্বাভাবিক জীবন পাস একটা, তুই যেনো সুখী হোস। আমি সারা পৃথিবীর সব্বার দুঃখ দূর করতে পারবো না, আমি শুধু তোর দুঃখ ঘোচাতে চাই।”
“শিন ছি -”
“সেই জন্যই বলছি, সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে ভালোবাস, প্লিজ। আমাকে বিশ্বাস কর, আমার ওপর নির্ভর কর, আর বাকি জীবনটা কাটিয়ে দে। সব কিছু আমার ওপরে ছেড়ে দে। কারণ এখন আমি তোর চোঙ্গফু, তোর একমাত্র আত্মীয় এই পৃথিবীতে। বুঝলি?”
মিন হুয়ের গলাটা শুকনো। ওর চোখের কোণ দিয়ে একফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়লো। ভারী গলায় ও বললো, “আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু -”
“এভাবে ভাব, মৃত্যু খুব গুরতর কোনো ব্যাপার নয়। যতোক্ষণ আমরা বেঁচে আছি, বাকি সবকিছু তুচ্ছ।”
শিন ছি গভীর চোখে তাকিয়ে রইলো মিন হুয়ের দিকে। ওর কালো চোখ যেনো দেশকালের সুড়ঙ্গ। মিন হুয়ের সাহসে কুলোলো না ঐ চোখের দিকে চাইতে। ভয়ে, যদি ওর আত্মা ওই চোখের গভীরে ডুবে যায়, আর ব্যাখ্যাতীত কোনো অবস্থায় পৌঁছোয়।
মিন হুয়ের ইচ্ছে করছে ডুকরে কেঁদে ওঠে এবার। অথছ চোখ ওর শুকনো খটখটে। প্রত্যুত্তরে বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলো না। আপন মনে বার বার নিজেকে বলতে লাগলো, মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই গুরুতর নয়, মৃত্যু ছাড়া আর কিছুরই গুরুত্ব নেই, কিন্তু অবুঝ শিন ছি, তোর সু তিয়াঁ মৃত।
মরিয়া হয়ে মিন হুয়ে তাকালো শিন ছির দিকে। কিন্তু ও আশা করে নি যে শিন ছির ঠোঁটের আলতো চাপ টের পাবে। সঙ্গে সঙ্গে শিন ছি গড়িয়ে এলো কাছে, মিন হুয়ের দুহাত জড়িয়ে নিলো নিজের গলায়, আলতো চুমু দিতে লাগলো সারা শরীর জুড়ে, তলপেটেরও নিচে পর্যন্ত।
শিন ছির দু পা জড়ানো মিন হুয়ের দু পায়ে, দুহাতে জড়ানো মিন হুয়ের দু হাত, ওর পুরো শরীর বিছিয়ে আছে মিন হুয়ের শরীরের ওপরে একটা জালের মতো। মিন হুয়ে কিছুতেই নড়াচড়া করতে পারছে না।
ধীরে ধীরে জালের বাধন কঠিন হলো, মিন হুয়ে যেনো জলের ভেতরে মাছের মতো উঠে এলো, শিন ছির দু হাতের মধ্যে ছটফট করতে করতে।
শিন ছি যতো দুঃসাহসী কান্ড করে চললো, আর কেবল জিজ্ঞের করতে লাগলো, “তোর ভালো লাগছে?”
শুরুতে মিন হুয়ে শুধু সায় দিয়ে যাচ্ছিলো, শুধু চাই ছিলো শিন ছিকে খুশি করতে। ক্রমশ ও নিজে এতো উদ্দীপিত হয়ে উঠলো যে সব ভুলে গেলো। বিছানার ওপরে দুজনে গড়াগড়ি খেতে লাগলো, অ্যাক্রব্যাটের মতো নানান ভঙ্গিমায় শরীর বাঁকিয়ে চুরিয়ে। এই খেলায় ওরা দুজনে যেনো স্বর্গীয় জুটি। জৈবিক প্রবৃত্তির দেওয়া উল্লাস পূর্ণ উপভোগ করছিলো। একটা অসম্ভব উৎক্ষেপ, প্রতিপক্ষের উস্কানির উপযুক্ত সাড়া দেওয়া - মিন হুয়ে প্রায় চীৎকার করে উঠলো একসময়ে, সামলাতে জোরে কামড়ে ধরলো বিছানার চাদর।
দুজনে খেলতে লাগলো অনেকক্ষণ ধরে। গড়িয়ে গেলো খাট থেকে মেঝের কার্পেটে, কার্পেট থেকে বেয়ে উঠলো সোফায়। মিন হুয়ের আপশোস হতে লাগলো যে বাড়ির বাইরে ব্যবহারের চাদরটা আনে নি বলে।
শিন ছির মতে এমন খেলায় নোংরা হবার সুযোগই নেই। দুজনের হুঁশ ফিরলো পেট গুড়গুড় করতে। তখন মনে পড়লো যে ওরা দুপুরেও খায় নি, রাতের খাবারও বাদ পড়ে গেছে।
আবার স্নানে গেলো, দুজনেই, এবারে একসাথে, একই কলঘরে। শিন ছি ধীরে ধীরে ডলে দিতে লাগলো মিন হুয়ের শরীর। মিন হুয়ের শরীর আনাচে কানাচে শিন ছি ছড়িয়ে দিয়েছে নানান দাগ। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত গলায় জানতে চাইলো, “তং মা?”
ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা ঝাঁকাল মিন হুয়ে।
এই একটা ভঙ্গিমাই উস্কানির কাজ করলো। শিন ছি চুমু দিলো মিন হুয়েকে জলের ধারার মধ্যে, জড়িয়ে ধরলো, নির্নিমেষে, যেনো ভেবে কুল পাচ্ছে না যে আর কী করে প্রেম প্রকাশ করবে।
পর মূহুর্তেই মিন হুয়ের সমস্ত শরীরে চুমুর বর্ষণ ডেকে আনলো। আর মিন হুয়ে স্বার্থপরের মতো ভাবলো, যদি সে সু তিয়াঁ হতো তবে জীবন কী সুখেরই না হতো।
মিন হুয়ের রাজি হয়ে গেলো বাকি জীবনটা এমন করেই কাটাতে, পরিণতি যাই হোক না কেনো।
শুধু এটুকুই আশা করা যায় যে সে দিন আসতে যেনো অনেক দেরি হয়।
রাতের খাওয়া সারা হলো গেস্ট হাউস থেকে দশ কিলোমিটার দূরের একটা স্বাস্থ্যকর রেস্টুরেন্টে। গেস্ট হাউসের খাবার শিন ছির ভালো লাগে নি। সেই জন্য এই বদলি বন্দোবস্ত।
এর আগে অবধি মিন হুয়ে টের পায় নি যে শিন ছি খাবারের ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। কী দিয়ে খাবার রান্না হয়েছে সে ব্যাপারে তার পছন্দটা বেশ নাক উঁচু ধরনেরই বলা চলে।
পুষ্টি নিয়ে তার ধারণাটা বেশ স্পষ্ট। কী খাবার অর্ডার করা যায় সে ব্যাপারে বেশ ওস্তাদ শিন ছি।
মিন হুয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ছোটোবেলা থেকেই সে পয়সা জমায়। তাই তার রেস্টুরেন্টে যাবার সুযোগ খুব একটা হয় নি। যদি সে অর্ডার করে খাবার তো সেগুলো সব বিশেষ পদই হবে যেমন সিচুয়ানের পদ, হুনানের পদ বা ইউন্নানের পদ। এই ধরনের খাবারের একটা বা দুটো পদ অর্ডার করলেই পেটও ভরে, মনও খুশি হয়ে যায়। আলে-কালে এমন খাবারের সুযোগ ঘটে বলে সে খায়ও বেশি, আই-ঢাই করে তারপর, এমন কি বুকও জ্বালা করে পরে।
যে পদগুলো শিন ছি অর্ডার করলো সেগুলো সবই হালকা। খাঁটি পুষ্টিগুণে ভরা। আবার প্রত্যেকটারই কোনো না কোনো বিশেষত্ব আছে।
যেমন মাশরুম স্যুপ। এতে কেবল মাশরুম আর ব্যাক্টেরিয়া আছে। এক প্লেট অ্যাসপারাগাস, জলে ফুটিয়ে ফর্সা করে দেওয়া। এমন কি মিন হুয়ে ঝালমশলা দেওয়া খাবার পছন্দ করে সেটা জানে বলে শিন ছি এক প্লেট সানশো মরিচ আর ঝিনুক দেওয়া বেগুন সেদ্ধও অর্ডার করলো।
কথা বলার আনন্দও আছে। শিন ছি খবু ভালো জানে কথা বলার জন্য কোনো বিষয় কিভাবে বেছে নিতে হবে। খুব ভালো জানে কী করে শব্দের মানে ধরতে হবে, সহজেই পাশ কাটিয়েও যেতে পেরে সেই সব বিষয়গুলো যেগুলো নিয়ে মিন হুয়ে কথা বলতে চায় না।
কেউই অতীত নিয়ে কোনো কথা বললো না। কেউই অন্যের অতীত খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করলো না। দুজনেরই হালের বন্দোবস্তটা বেশ আরামদায়ক লাগলো।
মিন হুয়ে তো ঠাট্টাই করে ফেললো যে তারা যেনো একজোড়া নেটিজেন যারা ঘরের বাইরে পা রেখেছে যৌনতার সন্ধানে যতক্ষণ যৌনতা ভালো লাগবে ততক্ষণ পরস্পরের সঙ্গে থাকবে।
মিন হুয়ের আঙুলের আঙটিটা দেখিয়ে শিন ছি বললো যে যেই মিন হুয়ে সায় দেবে, অমনি শিন ছি যেখানেই হোক, যখনই হোক মিন হুয়েকে বিয়ে করবে।
দাবা খেলা ছাড়াও দুজনের মধ্যে আরো অনেক মিল বেরোলো। দুজনেই ইউরোপের ইতিহাস পড়তে ভালো বাসে। দুজনেরই উৎসাহ ল্যাঙ্কাস্টার আর ইয়র্কের পরিবারগুলোর মধ্যে ১৪৫৫ থেকে ১৪৮৫-এর মধ্যে হওয়া যুদ্ধগুলোর বিষয়ে, যেগুলো ইতিহাসে দ্য ওয়ার অফ রোজেস নামে খ্যাত। দুজনেরই উৎসাহ জ্যাজ সঙ্গীতে আর আমেরিকান টিভি সিরিজে। ওরা ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে গেলেও উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়ে না।
দুজনেরই খিদে পেয়েছে। তাই খুব উৎসাহ নিয়ে খেলো দুজনেই। পড়ে থাকা বিন স্প্রাউটস মুখের মধ্যে ঠুসে দিয়ে শিন ছি বললো, “তিয়াঁ তিয়াঁ, তুই কী জানিস কিসে তুই আমাকে অবাক করে দিলি?”
“কিসে?”
“তুই আমার থেকে বেশি বুদ্ধিমান।”
“মোটেই না।”
“সত্যিই, তুই হয়তো নিজে নজর করিস নি, কিন্তু আমি নজর করেছি। তুই আমার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। আমি খুব খুশি হয়েছি।”
মিন হুয়ে হেসে জানতে চাইলো, “খুশি কেনো? হিংসে নয় কেনো?”
“আমার মাথা গরম ছিলো … তার কারণ খানিকটা …… তুই ভীষণ স্লথ ছিলিস সব কাজে …… উম্ … তাতে আমার দুশ্চিন্তা হতো। অনেক সময় আমি অধৈর্যও হয়ে পড়তাম।”
“এখন?”
“প্রথমত, আমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমার আর অতো রাগও হবে না। দ্বিতীয়ত, তোর ব্যাপারে আমার ভীষণ কৌতুহল হচ্ছে। কারণ আমি গোড়ার কথা কিছুই জানি না।”
“সে তো আমারও কৌতুহল হচ্ছে।”
“কী জানতে চাস আমার ব্যাপারে। জিজ্ঞেস করলেই পারিস।”
মিন হুয়ে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো, “না, আমি কিছু জানতে চাই না।”
শিন ছি মৃদু হাসলো মিন হুয়ের দিকে তাকিয়ে, “তুই আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিস।”
ফোনটা বেজে উঠলো, একটা মেসেজ এসেছে। মিন হুয়ে উইচ্যাট খুলে দেখলো পরিবারের খোঁজখবর করার ওয়েবসাইট থেকে একজন ভলান্টিয়ার বলেছেন, “সু তিয়াঁ, ডিএনএ পরীক্ষার ফল এসে গেছে। আমরা দুঃখিত, তং মিয়াংহাও তোমার ভাই নয়। একটা ব্লাইন্ড কম্প্যারিসনে দেখা গেছে যে মিল আছে হারবিন শহরের কারুর সাথে। ওখানকার এক দম্পতি এখন মিংশুই কাউন্টিতে যাচ্ছেন।”
মিন হুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফোনটা শিন ছির দিকে বাড়িয়ে দিলো যাতে শিন ছি দেখতে পায় যে মেসেজে কী লেখা আছে।
“ও তোর ভাই নয়?”
“কী করা উচিৎ আমার?”
“খুঁজতে থাক।”
“সব সূত্র কেটে গেলো। কতোদিন লাগবে খুঁজে পেতে কে জানে।”
মিন হুয়ে হঠাৎ শিন ছির হাত জড়িয়ে ধরলো আর খুব গম্ভীরভাবে বললো, “শিন ছি, তুই আগে নিউ ইয়র্ক ফিরে যা। দুজনে কাজগুলো ভাগ করে নি। তুই সার্জারি করে নে। আমি ভাইকে খুঁজতে থাকি এখানে। যখন তুই সুস্থ হবি, ফিরে আসবি এখানে, চোঙ্গুয়াতে। আর আমরা এক সাথে ভাইকে খুঁজবো।”
“না। তোর পক্ষে একা ওর খোঁজ করা নিরাপদ নয়। আমি তোর সঙ্গে থাকবো। আর সূত্র কিচ্ছু ছিঁড়ে যায় নি। তুই ভুলে গেছিস তং তিয়াঁ হাই কী বলে ছিলো। ও বলে ছিলো যে ও যখন ওর ছেলেকে নিতে গিয়ে ছিলো তখন দুটো বাচ্চা ছিলো, দুজনেরই বয়স এক বছর। একজন রোগা, কালো। অন্যজন ফর্সা আর স্বাস্থ্যবান। হয়তো রোগা, কালো ছেলেটা তোর ভাই?”
“হু, আমি একথা ভাবি নি কেনো?”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-12.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-14.html