১২. তাড়া করা এবং পালানো
একজন মহিলা নার্স কানে কানে কিছু বলে দেবার পর তং মিংহাও তার হাতের র্যাকেট রেখে দিও নার্সের সঙ্গে এলো মিন হুয়ের কাছে।
“দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়া,” বলে হাত বাড়িয়ে দিলো এবং সামাজিক সম্বোধনও করলো, “হ্যালো।”
মিন হুয়ে যদিও ছবিতে আগে দেখেছে তং মিংহাওকে, চুলের ধাঁচ বদলানোর জন্য বা কোনো কারণে তং মিংহাওকে অন্যরকম দেখাচ্ছিলো তার ছবির থেকে। সে যেনো একটু বেশিও পুরুষালি, স্বাস্থ্যবান, ফর্সা এবং ঝকঝকে। তকে রোগীর মতো দেখাচ্ছিলো না।
তফাৎ ছিলো তার চোখের নজরেও।
অমন সংযত, লুকোচুরি ভরা মিটিমিটে চাউনি মিন হুয়ে আর আগে দেখে নি, যেনো ইঁদুরের মতো। সামনের মানুষজনের চোখে যাতে চোখ না পড়ে যায়, সেই জন্য কথা বলার সময়, সে সমানে মাথা নেড়ে যায়, যেনো সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন্য একটা কোণ খুঁজছে চারপাশে।
তারপর তার ঠোঁটে একটা চাপা হাসি খেলা করে যায় থেকে থেকে যখন সে কথা বলে, অথচ কথা বলার বিষয়ের সঙ্গে অমন হাসির কোনোই যোগাযোগ নেই., কথার বাধের মধ্যেও এমন কিছু নেই যে তার থেকে অমন হাসি কেউ হাসতে পারে। হাসিটা হঠাৎ আসে, হঠাৎ মিলিয়ে যায়, চামড়ায় ধরা ছাতার মতো।
মিন হুয়ের আশার আলো নিভে গেলো, মন খারাপ হয়ে গেলো। এই যে ভাই - এর সঙ্গে মেশা সহজ হবে না মোটেই।
যে রোগীদের বিভ্রমের অসুখ থাকে, তারা অন্যদের তুলনায় অচেনা লোকেদের বেশি সন্দেহের চোখে দেখে, তাদের সাথে তাড়াহুড়ো করে দেখা করাই যায় না। তাদের পরিচিত কেউ, যাদেরকে তারা বিশ্বাস করেন এমন কারুর মাধ্যমে তাদের সাথে আলাপ করতে হয় যাতে নতুন লোকেদের নিয়ে তাদের চিন্তার কারণ জেগে না ওঠে। এই দেখা করার আগে তাই ডাক্তার পাঠালেন নার্সকে তং মিংহাওকে ডেকে আনার জন্য। আর তিনি তং তিয়াঁ হাইকেও ফোন করে ছিলেন যাতে তং তিয়াঁ হাই এই দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ার সাথে তং মিংহাও-এর আলাপ করিয়ে দিতে পারেন। সব শেষে তিনি নিজে আগ বাড়িয়ে মিন হুয়ের সাথে তং মিংহাও-এর আলাপ করিয়ে দিলেন, যাতে তং মিংহাও সন্দিহান না হয়ে ওঠে মিন হুয়ের পরিচয় নিয়ে।
মিন হুয়ে হেসে বললো, “আমাকে হুই জিয়ে বলে ডাকতে পারো।”
তং মিংহাও শিন ছিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এ কে?”
“হুই জিয়ের উয়েহুংফু।” হার্দিক একটা করমর্দনের সাথে শিন ছি বললো, “ছি গ।”
“আমাদের কী আগে দেখা হয়েছে?” মাথা চুলকে জানতে চাইলো তং মিংহাও, “আমার বাবা কখনো আগে কোনো দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের কথা বলে নি আমাকে।”
“তার মানে এটা বেশ দূরের সম্পর্ক।”
শান্তস্বরে মিন হুয়ে জানালো, “আমরা যখন খুব ছোটো ছিলাম, তখন কয়েকবার দেখা হয়েছে আমাদের। পরে আমাদের বিশেষ দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। আমি বিনচেং-এ থাকি।”
অনেক দিন ধরে মিথ্যে বলার অভ্যেস করে, মিথ্যে বলাটা মিন হুয়ের কাছে সহজ হয়ে গিয়ে ছিলো। ঝটপট সে জুড়ে দিলো, “ইদানীং তোমার বাবার শরীর বিশেষ ভালো নেই। তাই আমাদের বললেন যে তোমাকে নিয়ে যেতে।”
ডাক্তার আর নার্সরাও ইন্ধন দিলো পরিস্থিতিটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে।
ডাক্তার বললেন, “তোমার বিয়াওজিয়ে খুব খেটেছেন তোমাকে এখানে নিতে আসার জন্য। প্রথমে ট্রেনে চেপে এসেছেন, তারপর গাড়িতে, সব মিলিয়ে দশ ঘন্টা।”
এর সাথে নার্স জুড়ে দিলো, “তোমার জিয়েফু ভোরবেলা বেরিয়ে গিয়ে তোমার জন্য সবথেকে টাটকা ফুটি নিয়ে এসেছেন।”
তং মিংহাও উৎসাহের সুরে বললো, “তাহলে আমি আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসছি।”
তারপর খানিক ডানদিক বাঁদিক দেখে বুঝলো যে সবাই চাইছে যে সে এবার হাসপাতাল ছেড়ে যাক। বললো, “আমাকে দশটা মিনিট দেবে কী?”
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “তোমার কোনো সাহায্য লাগবে?”
তং মিংহাও জানালো, “না।”
শিন ছি প্রস্তুতি এগিয়ে নিলো আরো খানিক, “আমি ড্রাইভারকে ফোন করে দিচ্ছি। গেটে জড়ো হই সবাই।”
মিন হুই ব্যাঙ্ক কার্ড হাতে নিয়ে বললো, “আমি ডিসচার্জের কাজটা শেষ করি।”
ডাক্তার যা বলে ছিলো ওকে সে কথা ওর মনে ছিলো।
সবই ভালোয় ভালোয় মিটে গেলো। তিনজনে ট্যাক্সিতে বসলো। শিন ছি সামনে বসলো। মিন হুয়ে আর তং মিংহাও বসলো পিছনে।
গাড়ি ছাড়া মাত্র মিন হুয়ে টের পেলো যে তং মিংহাও-এর মেজাজ যেনো বিগড়ে গেছে।
সে সমানে পা নাড়াতে লাগলো।
ভয় পেলে বা ভয় কাটানোর জন্য কেউ যেমন পা নাড়ে তেমন নয়। কেমন যেনো পাশে বসে থাকা মিন হুয়েকে উত্যক্ত করার জন্য ইচ্ছে করে পা নাড়ানো।
মিনিট দশেক কাঁপতে লাগলো। মিন হুয়ের ভান করলো যেনো কিছুই নজর করে নি। সামনে বসে থাকা শিন ছিকে কিছু বলার সাহস করলো না।
অবস্থাটা থেকে বেরোনোর জন্য মিন হুয়ে কথা শুরু করলো ফুটবল, ভিডিও গেমস, গানবাজনা, সাম্প্রপ্তিক ঘটনা আর রাজনীতি নিয়ে - যেসব বিষয়ে কথা বলতে ছেলেরা সাধারণত পছন্দ করে।
আবোল তাবোল বকবক করার ব্যাপারটা মিন হুয়ের নিজেরই খুব অপছন্দ। কিন্তু মৃত্যুর থেকে যখন বকবক করা ভালো, মিন হুয়ে তখন সু তিয়াঁর জন্য, সু তিয়াঁর ভাইয়ের জন্য লড়ে গেলো। সেই প্রথমবার জীবনে মিন হুয়ে দুনিয়ার বাজে কথা বলতে লাগলো, অথচ ওর সময়ও বেশ ভালো কাটতে লাগলো।
তং মিংহাও কোনো সাড়া শব্দ করলো না। তাই অপ্রস্তুত হয়েও মিন হুয়ে একাই বকে যেতে লাগলো।
তং মিংহাও কোনো উত্তর না দেওয়ায় মিন হুয়ে নানান প্রশ্ন করে যেতে লাগলো। মিংশুই-এর রীতি-রেওয়াজ থেকে শুরু করে বাজারদর অবধি কিছুই মিন হুয়ে বাদ দিলো না। খানিক পরে ওর মনে হতে লাগলো যে ও নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, তং মিংহাও খুব বেশি হলে “হুঁ” বলছে এক-আধবার। তাতে মনে হচ্ছে যে ও শুনছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে শিন ছিও টের পেলো যে কিছু একটা গন্ডগোল আছে। সেও যোগ দিলো অপ্রস্তুত আড্ডাতে। সব্বাইকে কথা বলতে শুনে ড্রাইভার ভাবলো যে তারও কিছু বলার আছে। তাই সে কথা বলতে লাগলো এলাকার নিজস্ব খবর নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে, আর এলাকাটা কিসের জন্য বিখ্যাত তাই নিয়ে। দেখা গেলো যে ড্রাইভারই সব থেকে বেশি কথা বলতে পারে। সে যেই কথা বলতে শুরু করলো অমনি বাকি সবাই চুপ করে গেলো।
এমন সময়ে তং মিংহাও-এর পা নাচানো বন্ধ হয়ে গেলো।
মিন হুয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেনো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তং মিংহাও ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বারবার দেখতে লাগলো।
মিন হুয়ে জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলো না, “কী হয়েছে? হাসপাতালে কিছু ফেলে রেখে এসেছো কী?”
তং মিংহাও গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো, “একটা গাড়ি পিছু নিয়েছে। তা প্রায় অনেকক্ষণ হবে।”
সত্যিই কালো কয়েকটা গাড়ির একটা সারি রয়েছে পেছনে। তাতে অবাক হবার কিছুই নেই। গাড়িগুলো তো রাস্তাতেই যাবে। পিছনের গাড়িটা ঠিকঠাক দূরত্ব রেখেই চলেছে।
তং মিংহাও-এর সাথে দেখা করার আগেই ডাক্তার বলে ছিলো যে বিভ্রমে ভুগতে থাকা রোগীদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে।
প্রথম শর্ত হলো যে জোর করে বলা চলবে না যে রোগীর ভাবনাটা ভুল। এদের কোনো যুক্তির বালাই নেই। ব্যাপারটা এমন যে কোনো রোগী যদি নিজেকে ইউনাইটেড স্টেটসের প্রেসিডেন্টের ছেলে বলে দাবী করে, তবে তাকে বলা যাবে না যে সে মোটেই ইউনাইটেড স্টেটসের প্রেসিডেন্টের ছেলে নয়।
দ্বিতীয় শর্ত হলো যে কিছুতেই ভান করা চলবে না যে বিভ্রমটা সত্যি। তাতে রোগীর ধারণা বদ্ধমূল হবে যে সে ঠিক ভাবছে।
তাই শিন ছি এ দুটোর কোনোটাই না করে তৃতীয় শর্তে গেলো। কয়েকটা প্রশ্ন তুললো যাতে রোগীর ভাবনার যুক্তি ফিরে আসে।
“সত্যিই? একটা গাড়ি আসছে পেছন পেছন? কিন্তু আমার তো মনে হলো না যে এটা পিছু নেবার জন্যই পেছন পেছন আসছে। তোমার কেনো অমন মনে হলো?”
তং মিংহাও জোর দিয়ে বললো, “কারণ এটা একটা কালো মার্সিডিজ - আমার গ্যগ্যর, প্রাইভেট কার।”
মিন হুয়ের হৃৎপিন্ড প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে অসুস্থ বোধ করতে লাগলো।
তাতে শিন ছি বললো, “মাস্টার শেন, গাড়ির গতিটা কমান দেখি, যাতে মার্সিডিজ বেঞ্জটা আমাদের পেরিয়ে যেতে পারে।”
ড্রাইভার তখনই গাড়ির গতি আস্তে করে দিলো। সেটা নজর করে মার্সিডিজ বেঞ্জ লেন বদলালো আর মাস্টার শেনের ট্যাক্সিটা পেরিয়ে চলে গেলো। খানিক পরে আর ওটাকে সামনে দেখাও গেলো না।
মিন হুয়ে বললো, “দেখো, গাড়িটা কোথাও আর নেই।”
একটা স্প্রাইট তং মিংহাওকে দিয়ে বললো, “গলাটা একটু ভিজিয়ে নাও।”
তং মিংহাও সংশোধন করে দিলো, “ভুল করছো। এটা ঝটপট বেরিয়ে, আগে গিয়ে, একটা অ্যাম্বুশ স্পট দেখে দাঁড়িয়ে থাকবে।”
তং মিংহাও এতো ঘাবড়ে গেলো যে নিজের ঘাড়টা বার বার চুলকোতে লাগলো আর বলতে লাগলো, “নিশ্চয়ই গাড়িতে একটা স্নাইপার আছে।”
মিন হুয়ে কিছু বলার আগেই তং মিংহাও চেঁচাতে লাগলো, “থামো। গাড়ি থামাও। এখনই।”
যেই গাড়িটা সম্পূর্ণ দাঁড়ালো, তং মিংহাও ঠেলে দরজা খুলে ফেললো, গাড়ির থেকে লাফ দিয়ে নামল, সামনের ঘাসের দিকে দৌড় লাগালো।
গাড়ির লোক তিনজনের প্রথম ধারণা হলো যে তং মিংহাও একটা সুবিধে মতো জায়গা খুঁজতে গেছে। কিন্তু শিগগির তারা বুঝতে পারলো যে, ঘাসগুলো যেহেতু খুব বড়ো, সেই জন্য তং মিংহাওকে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না।
“অ্যাই, অ্যাই, মিংহাও, দাঁড়া।”
মিন হুয়ে আর শিন ছি তার পিছন পিছন দৌড়লো।
জুলাই মাসের রোদের বেশ জোর ছিলো। গাড়ি থেকে নেমেই তারা দুজনেই একসাথে চোখে রোদচশমা পরে নিলো।
মিন হুয়ে ছুটতে ছুটতে বললো, “আজকে সকালে ও খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছে, বোধ হয় ওষুধ খেতে ভুলে গেছে।”
শিন ছি জানতে চাইলো, “ওকে ধরতে পারলে আমরা কী করব? সঙ্গে করে নিয়ে যাব? নাকি হাসপাতালে ফেরত দিয়ে আসব?”
মিন হুয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ধরতে হবে?”
শিন ছিও প্রশ্ন করলো, “তোর কী মনে হয় যে ও নিজে নিজে আমাদের সঙ্গে যাবে?”
মিন হুয়ে বলে ফেললো, “আমার মনে হয়ে না যে আমরা ওকে ধরতে পারবো না।”
কথাটা সত্যি। মাপে তং মিংহাও শিন ছির সমান হলেও, ওর গায়ের জোর শিন ছির থেকে অনেক বেশি, চওড়া কাঁধ, মোটা কব্জি, অন্তত দশ কেজি ওজন বেশি।
দশ মিনিটেরও বেশি ঘাসের ওপর দিয়ে দৌড়োনোর পরে, তং মিংহাও জঙ্গলে ঢুকে পড়লো।
খানিক তাড়া করার পর, মিন হুয়ে আর শিন ছিও জঙ্গলে ঢুকে পড়লো। আর সামনে ছুটতে থাকা তং মিংহাও হঠাৎ থামল।
“মিংহাও” মিন হুয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “দৌড়োস না। আমি তোর বিয়াওজিয়ে।”
“এগোস না এক পাও।” চেঁচিয়ে উঠলো তং মিংহাও, “আমি জানি তোকে গ্যগ্য পাঠিয়েছে।”
তং মিংহাও একনাগাড়ে বকে যেতে লাগলো। কিন্তু অনেক দূর থেকে তং মিংহাও চীৎকার করছিলো বলে মিন হুয়ে কোনো মতে প্রথম দুটো বাক্যই কেবল পরিষ্কার শুনতে পেলো। মিন হুয়ে এগিয়েও যাচ্ছিলো তং মিংহাও-এর দিকে। কিন্তু শিন ছি চেপে ধরলো মিন হুয়েকে, “যাস না। ওকে ভয় দেখাস না।”
দুজনে তাকালো একে অপরের দিকে। শিন ছি বললো, “সানগ্লাসটা খুলে ফেল।”
সেই মূহুর্তে মিন হুয়ের মনে পড়ে গেলো যে সে আর শিন ছি দুজনেই চোখে রোদচশমা পরে রয়েছে, স্পেশ্যাল এজেন্টদের মতো। তখনই রোদচশমা খুলে পকেটে ভরে নিলো মিন হুয়ে।
“কী করি বল তো?” মিন হুয়ের গলার স্বরে মাখা দুশ্চিন্তা। “এ জায়গাটা এতো বড়ো আর খোলামেলা, এখানে হারিয়ে গেলে ছেলেটা …… মুস্কিল।”
তার দোষে সু তিয়াঁ হারিয়ে গেছে। খুঁজে পাবার পরে সু তিয়াঁর ভাইকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না, কিছুতেই।
মিন হুয়ে হাত তুলে সমর্পনের ভঙ্গীতে চীৎকার করলো, “আমাদেরকে গ্যগ্য পাঠায় নি রে। আমরা এসেছি তোকে বাড়ি নিয়ে যেতে। যদি আমার কথা বিশ্বাস না করতে পারিস, তবে হাসপাতালে ফোন কর না হয়। দ্যাখ, আমাদের কাছে কোনো অস্ত্রও নেই।”
শিন ছিও সমর্পনের ভঙ্গীতে মাথার ওপর দুহাত তুলে ধীর পায়ে এগোতে লাগলো তং মিংহাও-এর দিকে, “তোর কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য আমাদের নেই। তোর যদি দুশ্চিন্তা হয় তবে তোকে আমাদের সাথে যেতে হবে না। আমাদের বল শুধু তুই কোথায় যেতে চাস। আমরা তোর সাথে সেখানেই যাবো আর তোর খেয়াল রাখব।”
“মিংহাও এখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। হারিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক এখানে। আমরা তিনজনে না হয় একসাথে হাঁটব এবার যাতে আমরা হারিয়ে না যাই।”
কথা বলতে বলতেই নিঃশব্দে কয়েক পা এগিয়ে গেলো মিন হুয়ে। বলতে লাগলো, “আমার কথা শোন -”
মিন হুয়ের কথা শুরু হবার আগেই, তং মিংহাও মুখ ঘুরিয়ে দৌড় লাগালো।
এই বারে মিন হুয়ে তাড়া করলো তং মিংহাওকে যতো জোরে সম্ভব ততো জোরে, ছিলা ছেড়ে বেরোনো তিরের মতো।
নিরুপায় শিন ছিও পা মেলালো, যদিও মনে সন্দেহ, “এই ভাবে তাড়া করা কী ঠিক হচ্ছে? ছেলেটা মনে করতে পারে যে সত্যি সত্যিই আমাদেরকে গ্যগ্য পাঠিয়েছে।”
ভারি গলায় মিন হুয়ে বললো, “আমি জানি এভাবে অসম্ভব। কিন্তু আর কোনো উপায়ও যে নেই।”
বলে চললো মিন হুয়ে, “ওকে খুঁজে পাওয়াটাই মুস্কিল ছিলো। ওকে হারাতে পারবো না। হাসপাতালকে বা ওর বাবাকে কী ব্যাখ্যা দেব!”
“আমি হাসপাতালে ফোন করে জেনে নিচ্ছি কী করা উচিৎ -” ছুটতে ছুটতেই শিন ছি মোবাইল বার করে ফোন ডায়াল করলো। খানিক পরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললো, “FUক, সিগন্যাল নেই।”
মিন হুয়ে আঙুল দিয়ে দেখালো একটা লালচে ছায়ার দিকে, “ঐ যে ও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর পিছন থেকে যাচ্ছি, তুই পাশ থেকে ধরবি ওকে। ওকে থামাতে হবে।”
বেশ জোর দিয়েই বললো।
মিন হুয়ে ভেবে ছিলো যে তং মিংহাওকে জঙ্গলের মধ্যেই আটকাতে পারবে। কিন্তু হঠাৎ কানে এলো জলস্রোতের শব্দ।
মিন হুয়ে ঘাবড়ে গেলো। কয়েক পা দৌড়েই দেখতে পেলো সামনে একটা নদী।
“ওকে নদীর পাড়েই থামা।” শব্দগুলো উচ্চারণ করেই, তাড়া করলো তং মিংহাওকে। শিন ছি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে দৌড়ে গেলো।
মিন হুয়ে প্রায় একশো স্প্রিন্টের মতো দৌড়োলো আর ধরে ফেললো তং মিংহাওকে নদীর পাড়েই। দুজনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ কমে যেতে লাগলো। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে তং মিংহাও দৌড়তে লাগলো কাছে যে কাঠের সেতু আছে সেটার দিকে।
কিছু না ভেবেই মিন হুয়ে পা মেলালো তং মিংহাও-এর সাথে। অমনি প্লপ করে আওয়াজ আর তং মিংহাও ঝাঁপ দিলো জলে।
দ্বিতীয়বার না ভেবেই মিন হুয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে।
নদীর জলটা ঝকঝকে পরিস্কার। খুব গভীরতা নেই। প্রায় দু মানুষ গভীর। স্রোত খুব ধীরে বইছে। খুব ঢেউ-এর ধাক্কা নেই। খুব খুঁটিয়ে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে নদী বয়ে চলেছে।
জলে পড়ার পরে মিন হুয়ের মনে পড়লো যে ও সাঁতার কাটতে পারে না।
অবাক কান্ড হলো যে এবারে ও ঘাবড়ে গেলো না। ও সামনের দিকে দুবার হাত ছুঁড়লো কুকুরের মতো করে। কাজটা ঠিক হলো না। খানিকটা জল সোজা ঢুকে গেলো ওর গলায়। এইবারে ও ঘাবড়ে গেলো, ওর হাতপায়ের ওপর থেকে ওর নিয়ন্ত্রণ চলে গেলো, ও শরীরটা কাত করলো যেই অমনি ডুবে গেলো।
হঠাৎ করে ওর মনে হলো যে এই সময়ে মরে যাওয়াই ভালো।
প্রথমত, ও অনেক আগেই মরে যেতে চেয়ে ছিলো। সু তিয়াঁর মৃত্যুর দায়টা ওরই ঘাড়ে পড়বে যদি না ও এখনই মরে যায়। যখন একটা জীবনের দাম কেবল আরেকটা জীবন দিয়েই মেটানো যেতে পারে, তখন এখনই মরে যাওয়া ভালো, তাতে সু তিয়াঁর মৃত্যুর দোষ বা দায় নিতে হবে না আর।
দ্বিতীয়ত, সু তিয়াঁর ভূমিকায় নাগাড়ে অভিনয় করতে করতে ও বেশ বেদম হয়ে পড়েছে। কোনো লেখাজোখা নেই আগে থেকে, গল্পের মোচড়ে আর চরিত্রদের চালচিত্রের সঙ্গে মিন হুয়ে আর খাপ খাইয়ে উঠতে পারছে না। সবটা ব্যাখ্যা করা বেশ দুরূহ। তার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।
আরো কয়েক খেপ জল খেয়ে মিন হুয়ের চেতনা, বুদ্ধি খানিক স্থির হলো। এমন সময়ে একটা হাত ওর শরীরটাকে উল্টে দিলো যাতে ওর মাথাটা জলের বাইরে উঠে আসে।
মিন হুয়ে শ্বাস নিতে চাই ছিলো। কিন্তু ওর নাক ভরে ছিলো জলে। লোকটা মিন হুয়ের শরীরের অর্ধেকটা ঠেলে জলের ওপরে তুলে দিলো অবলীলায়।
এবারে মিন হুয়ে দেখতে পেলো স্পষ্ট, শিন ছিকে।
মিন হুয়ে নিজেকে বললো যে এবার ও কিছুতেই আর অন্যদের ওপর নির্ভর করতে পারবে না। মৃত্যু টেনে নিয়ে যায় একটার সঙ্গে আরেকটা জীবন। তাই মিন হুয়ে হাত-পা না নেড়ে শুধু শ্বাস নিতে লাগলো বাধ্য হয়ে, টের পেলো যে ওর শরীর আবার জলে আছড়ে পড়ছে। আর পাশ ফিরে উঠলো আবার। শিন ছি মিন হুয়ের জামার কলার ধরলো হাতের মুঠিতে আর পা ছুঁড়ে টেনে নিয়ে গেলো ওকে পাড়ে।
ওকে বয়ে নিয়ে গেলো ঘাসে আর ওর পিঠে চাপড় লাগালো ভয়ানক জোরে। ওর নাক মুখ দিয়ে সব জল বেরিয়ে এলো যাতে ওর দম আটকে যাচ্ছে যেনো।
বেশ কয়েকবার বমি হয়ে যাবার পরে, মিন হুয়ে একটু সুস্থ বোধ করলো আর চটপট জানতে চাইলো, “তং মিংহাও কোথায়? সেও কী জলে? যা, বাঁচা ওকে!”
“ও সাঁতার কাটতে পারে।” মিন হুয়েকে উঠে বসতে সাহায্য করলো শিন ছি, “কিন্তু তোর ব্যাপারটা কী? তুই শুধু সাঁতার কাটতে ভুলে যাস নি, তুই কী বেঁচে থাকার প্রবৃত্তিটাও হারিয়েছিস? হয়েছেটা কী? নির্বোধ হয়ে গিয়ে ছিলি কী জলে গিয়ে পড়া মাত্র? তাছাড়া -”
আর বললো না শিন ছি। কারণ মিন হুয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে ওর দিকে চেয়ে আছে, দুচোখ তখন ভরে উঠেছে জলে।
“সরি, আমার ভুল হয়েছে। তুই না, আমিই নির্বোধ …” মিন হুয়েকে কাঁদতে দেখে শিন ছির কথাগুলো হোঁচট খেতে লাগলো।
মিন হুয়ের দু চোখে তখন সেই ভয়াবহ রাতের মুশুই নদী। মিন হুয়ে কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারলো না, ফোঁপাতে লাগলো।
শিন ছি ধীরে ধীরে স্বান্তনা দিতে লাগলো, “ঠিক আছে। সব ঠিক আছে। এই তো আমি।”
তারপর বলতে লাগলো, “তুই অনেকটা জল খেয়ে ফেলেছিস। তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। নদীটার স্রোত যেদিক থেকে বইছে, সেদিকে একটা কাগজ কল আছে। তুই বোধ হয় এক হাঁড়ি কাগজ কারখানার নোংরা জল খেয়েছিস। যদি ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে তবে ঝামেলা বাড়তে পারে …”
“আমার কথা বাদ দে, শিন ছি, শিগগির যা, তং মিংহাওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। আমরা কিছুতেই ওকে ফেলে যেতে পারবো না …”
মিন হুয়ে চারপাশে চেয়ে চেয়ে খুঁজতে লাগলো। দুরে একটা লালচে ছায়া দেখতে পেলো যেনো। তং মিংহাও বুঝি নদীর অন্য পাড়ে উঠে আরো দূরে দৌড় দিয়েছে।
মিন হুয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলো। কিন্তু পায়ে জোর পেলো না। নিচের দিকে তাকিয়ে নিজের দুটো খালি পা দেখতে পেলো। ওর চটি বোধ হয় নদীর জলে পড়ে গেছে। শিন ছির হাত ধরে অনুনয় করলো, “যা, যা না।”
“এই জঙ্গলের মধ্যে, তুই একটা মেয়ে, তোকে একলা রেখে আমি যেতে পারবো না।” শিন ছি মাথা নেড়ে বললো, “যদি তোর ভাই পালিয়ে যায় তো যেতে দে। দামড়া ছেলে একটা না খেতে পেয়ে মরবে না। যখন ওর হুঁশ ফিরবে, ও ফিরে আসবে ঠিক আমাদের কাছে।”
“না, মোটেই তা নয়, শিন ছি -”
শিন ছি ভ্রু কুঁচকে তাকালো মিন হুয়ের দিকে, ঠাহর করার চেষ্টা করলো যে মিন হুয়ে ঠাট্টা করছে কিনা। শেষে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলো, “আমার জন্য এখানেই অপেক্ষা করবি।”
আধ ঘন্টা পরে শিন ছি অবশেষে ফিরলো তং মিংহাওকে নিয়ে।
আরেকটা পালানোর চেষ্টা যাতে তং মিংহাও না করতে পারে, তাই ওর দুটো হাত একটা বেল্ট দিয়ে বেধে রেখেছে শিন ছি।
দুজনকারই মুখের এখানে সেখানে ছড়ে গেছে। দুজনেরই হাতের তালুতে, বাজুতে রক্ত লেগে আছে।
মিন হুয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠলো, “তোরা কি মারপিট করেছিস? তোরা ঠিক আছিস তো?”
শিন ছি চাপা গলায় হিসিহিসিয়ে বললো, “সব ঠিক আছে। কপাল জোরে ওকে ধরতে পেরেছি। ওর আবার একটা ছুরি আছে।”
পকেট থেকে বার করলো একটা ফল বা সব্জি কাটার ফোল্ডিং ছুরি। ছুরিটা বেশ বড়ো।
“তোর লাগে নি তো? লেগেছে?” মিন হুয়ে হাত বুলিয়ে দিলো শিন ছির হাতের ক্ষতের ওপর। কয়েকটা আঁচড় লেগেছে, খুব গভীর কিছু নয়।
“না। একটা মারপিট মাত্র।” কব্জিটা ঘুরিয়ে নিয়ে হাসলো শিন ছি, “তোকে ছেড়ে যাবার পর থেকে আমি আর কখনো মারপিট করি নি। মনে করে ছিলাম আমি মারপিট করতে ভুলেই গেছি। না ভুলি নি মোটেই। পেশীর মধ্যে স্মৃতি রয়ে গেছে সব।”
কথা বলার সময় শিন ছি জাপটে জড়িয়ে রেখেছে মিন হুয়েকে, গালে চুমুও দিলো আবার, “তোর হাল কী? ভালোর দিকে? বুকে ব্যাথা আছে কী? কাশি হয়েছে কী?”
মিন হুয়ে শিন ছির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো।
“চল, আমি তোকে বয়ে নিয়ে যাবো।”
“না ঠিক, আছে। আমি যেতে পারব।”
“তোর পায়ে চটি নেই।”
মিন হুয়ে জোর করে দু পা হাঁটল। শিন ছি জোর করে ওকে নিজের পিঠে তুলে নিলো। মিন হুয়ে পিঠে নিয়ে চলতে লাগলো শিন ছি।
এর আগে কখনো মিন হুয়ে কখনো এভাবে কোনো পুরুষের পিঠে চড়ে নি। বিশেষ করে আরেকটা পুরুষ মানুষের সামনে তো নয়ই। মিন হুয়ের মুখ তখনই লাল হয়ে উঠলো।
“তাহলে - ও সত্যিই তোমার বাগদত্তা?”
তং মিংহাওকে দেখে মনে হলো যে ও বেশ হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে মিন হুয়ে আর শিন ছির মধ্যেকার আন্তরিকতা দেখে। “অথবা … তোমরা দুজনে এখনো তোমাদের কাজ শেষ করো নি। তাই এখনো তোমাদের অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে।”
“আমাদের সঙ্গে আয়, কোনো চালাকি করার চেষ্টা করিস না। পালাবার কথা ভুলেও ভাববি না।” শিন ছি তার দৃষ্টি দিয়ে প্রায় ভস্ম করে দিলো তং মিংহাওকে। “তোর ছুরিটা কিন্তু আমার কাছে।”
তিনজনে ফিরে চললো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এক পা গভীরে, এক পা ওপরে।
মিন হুয়ের অপ্রস্তুত লাগছে সারাটা পথ শিন ছির পিঠে চেপে যেতে। কিন্তু শিন ছি কিছুতেই মিন হুয়েকে মাটি ছুঁতে দিলো না।
“শিন ছি, আমাকে নামিয়ে দে। একটু আগেই তুই আমাকে নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিস, তারপর তুই মারপিট করেছিস মিংহাও-এর সঙ্গে, এখন আমাকে পিঠে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিস - এতোটা তোর হার্ট নিতে পারবে তো?”
“যদি নিতে না পারতো, তাহলে আমি মরে যেতাম।”’
“...... এতো ঢং না করে, ন্যাকামো না করেও আমি যেতে পারতাম।”
“তা হলে আরো খানিকক্ষণ ঢং কর, ন্যাকামো কর না হয়।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-11.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-13.html
No comments:
Post a Comment