২১. নাগর আমার
সাও মুয়ের বাড়ি টাউনহাউস কমিউনিটির একদম বাঁদিকে, দুটো তলার প্রত্যেকটাই একশো আশি বর্গমিটার জুড়ে ছড়ানো, চারটে শোবার ঘর, দুটো বসার ঘর, দুটো স্নানের ঘর। ঘরের সাজসজ্জায় খুবই রুচিশীলতার ছাপ।
য়িন শু একতলা, দোতলা সবই ঘুরে ঘুরে দেখালো মিন হুয়ে আর ঝৌ রু জিকে। এই প্রথমবার মিন হুয়ে কোম্পানির কোনো নেতৃস্থানীয় পদাধিকারির বাড়িতে এসেছে। মিন হুয়ে একটু জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু ঝৌ রু জি বেশ সড়গড় মনে হলো এরকম পরিস্থিতির সঙ্গে। সে বেশ আসবাবপত্র দেখতে লাগলো উৎসাহের সঙ্গে। মাঝে মধ্যে য়িন শুকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো যে কোন জিনিসটা কোথা থেকে কেনা। তারপর ঝৌ রু জির উৎসাহ গিয়ে পড়লো রেফ্রিজেরাটর আর ওয়াশিং মেশিনে। জানতে চাইলো যে ওগুলো কাজ করে কেমন। য়িন শুও খুব ধৈর্য ধরে ঝৌ দু জির সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন একে একে, যেনো কোনো দুর্মূল্য সম্পদের বিবরণ দিচ্ছেন।
“য়িন শিয়েংশঁ -”
“আমাকে য়িন শু বলে ডাকলেই হবে।”
“য়িন শু, আপনি কী টেনিস খেলতে ভালো বাসেন?”
ঝৌ রুজি খুব কৌতুহলের সঙ্গে দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে দেখালো। ছবিতে য়িন শুকে দেখা যাচ্ছে টেনিস র্যাকেট ধরে।
“হ্যাঁ আমি টেনিস খেলি। আমি তো প্রদেশের দলের হয়েও খেলেছি। তবে আমি আহত হবার পরে অবসর নিয়েছি।”
“এখন তাহলে আপনি কোথায় কাজ করেন?” জানতে চাইলো মিন হুয়ে।
“আমি একটা ক্লাবে টেনিস কোচের কাজ করেছি অনেক বছর। তারপর ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের দুটি সন্তান। ওদের জন্য সাও মুয়ের সময় নেই একদম। সেইজন্য বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ আর গেরস্থালির সবটুকুর দায়িত্ব আমি নিয়েছি, যাতে সাও মু ওর ক্যারিয়ারে পুরো মনোযোগ দিতে পারে।”
য়িন শু হাসলেন, একটা ছবি হাতে নিলেন। পরনের অ্যাপ্রন থেকে আটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “মূল কারণটা হলো সাও মু আমার থেকে অনেক বেশি রোজগার করেন। যদি আমি কাজে যাই, আর ও ঘরে থাকে কাজ ছেড়ে দিয়ে, তবে আমাদের পুরো পরিবার পথে বসবে।”
মিন হুয়ে অল্প হলেও অবাক হলো। যতো পুরুষ সে এ যাবৎ দেখেছে তাদের মধ্যে কেউই স্বীকার করার সাহস দেখাবে না এ সে পুরো সময়ের জন্য বাড়িতে থাকে আর বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। য়িন শুয়ের মতো শান্ত ভঙ্গীতে সহজে সত্যিটা স্বীকার করার ব্যাপারটা না হয় বাদই দেওয়া গেলো।
“হ্যাঁ, আপনি যদি এমন করে বলেন তো আমি একটু ভয়ই পাচ্ছি যে আমার বোধ হয় একটা বাচ্চার জন্ম দেবার সাহসই হবে না।” ঝৌ রুজি মিন হুয়ের দিকে এক ঝলক না তাকিয়ে পারলো না, “সত্যি? পরিবারে দুটো বাচ্চা থাকলে এতো ভারিক্কি ব্যাপার?”
“না, তা নয়। আমি বলছি না যে বাচ্চার জন্মের ঠিক পরেই চব্বিশ ঘন্টা বাচ্চার সঙ্গে যে ভাবে থাকতে হয় সেভাবেই বরাবর কাটে। কিন্তু যদি আমাদের এখনকার পরিস্থিতির কথা ধরি, তো আমাদের ছেলের সাঁতারের ক্লাস আছে, আঁকা শেখার ক্লাস আছে, বাস্কেট বল ক্লাস আছে, বেহালা বাজানো শেখার ক্লাস আছে, তাইকোনদো ক্লাস আছে প্রত্যেক সপ্তাহে। আবার আমার মেয়ের পিয়ানো শেখার ক্লাস, আবৃত্তি শেখার ক্লাস, জিমন্যাসটিক্স, ব্যালে, আর ব্যাডমিন্টন শেখার ক্লাস আছে। আলাদা আলাদা সময়ে, আলাদা আলাদা জায়গায়। রাতের খাওয়া হয়ে গেলে তাদেরকে পড়তে পাঠাই বাড়ির বাইরে, আবার নিয়ে আসি। রাত নটার পরে। সাও মু আসলে চেয়ে ছিলো যে ওরা দুজনে একই ক্লাসে যাক, যাতে আমার জন্য একটু সহজ হয়। কিন্তু বাচ্চাদের পছন্দ হলো না ব্যাবস্থাটা। ওদের দুজনের রুচি পছন্দ বেশ আলাদা। আর বাবা-মা হিসেবে আমরা পক্ষপাত করতে পারি না। আমাদের সন্তুষ্টি আসে না ওদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিলে বা ওদেরকে ওদের ইচ্ছে মতো চলতে না দিলে।”
য়িন শু কথা বলা থামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, “কপাল ভালো আমি আজন্ম খেলাধূলো করেছি আর দৌড়ে বেড়াতে পারি। চট করে হাঁপিয়ে যাই না।”
মিন হুয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলো, “তার মানে আপনার আর সাও জঁয়ের আলাপ হয়ে ছিলো টেনিস ক্লাবে, তাই তো?”
“তুমিও শিখতে পারো। বাড়িতে ওঁকে সাও ল্বব্যানিয়াঁ নাই বা বললে। শাও জিয়ে বোলো বরং।”
য়িন শু হাসলেন আর ওঁদের নিয়ে এলেন বসার ঘরে যাতে ওঁরা সোফাতে বসতে পারেন। দুজনকে এক গ্লাস করে তরমুজের রস খেতে দিলেন, “এই মাত্র বানিয়েছি আমি, নিজে হাতে। আরো নাও। সাও মু এখনই এসে যাবে। আমি এখনো শেষ পদ দুটো বানাচ্ছি। এখনো দশ মিনিট লাগবে ওগুলো নামাতে।”
ঝৌ রু জি তৎক্ষণাৎ বললো, “আমি কোনো কাজে লাগতে পারি?”
“হয়ে গেছে।” য়িন শু কথাটা বলেই ঘুরে রান্নাঘরে চলে গেলেন। খানিক পরে কুকিং রেঞ্জের হুড বেজে উঠলো গমগম করে।
মিন হুয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। চোখ আটকে গেলো ছাদ থেকে ঝুলন্ত ঝাড়বাতিটায়। ওটা ক্রিস্টালের। দীর্ঘশ্বাস ফেললো, “বলার দরকার নেই, সাও মু জিয়ের রুচিখানা জবরদস্ত। এরকম একটা বিশাল ঝাড়বাতির দাম কতো হবে? কয়েক হাজার ডলার নিশ্চয়ই?”
“এটার দাম কয়েক হাজার ডলারের থেকে কিছু বেশি।” ঝৌ রু জি ফিসফিসিয়ে বললো, “যদিও এই এলাকাটা শহরের মাঝখান থেকে অনেক দূরে, কিন্তু ইস্কুলটা ভালো বলে, বাড়ির দাম এখানে খুব কম নয়। এরকম একটা বাড়ির দাম পড়বে নব্বই লাখ য়ুআঁর বেশি। পরিবারে একজন রোজগেরে হলে বাড়িটার জন্য ধার শুধতে বেশ চাপ হবে।”
“হতে পারে এঁদের মা-বাবা অবস্থাপন্ন। তাঁরা হয়তো ডাউন পেমেন্ট করে দিয়েছেন বা কিছু।”
“সাও মুয়ের দেশ গাঁয়ের দিকে। ওঁদের অবস্থা খুব ভালো নয়।”
“অ্যাই, ঝৌ রু জি,” মিন হুয়ে হালকা চাপড় দিলো ঝৌ রু জিকে, “আপনি এতো সব জানেন কী করে?”
“ইয়াং বেই বেই বলেছে আমাকে।”
“হতে পারে য়িন শুয়ের মা-বাবা অবস্থাপন্ন।”
“হতে পারে,” ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলো ঝৌ রু জি, “আসবাবের দিকে দেখুন। প্রত্যেকটা এক পিস করেই তৈরি হয়েছে। এমন কী স্নানের ঘরে টয়লেট পেপার রাখার তাকটাও হাতে করে খোদাই করা।”
“আপনি আবার অন্যের বাড়িতে এসে বাথরুম দেখতে গিয়ে ছিলেন?”
“এই দেখছিলাম আর কী।” ঝৌ রু জি তরমুজের রসে একটা চুমুক লাগালো, “য়িন শু ছোটোবেলায় নিশ্চয়ই অগাধ বৈভবে বাস করেছে।”
“সেটা বুঝলেন কী করে?”
“আমি যদি ওঁর মতো সারাদিন বাড়িতে বসে থাকি কোনো কাজ না করে, তাহলে আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না। ওঁকে দেখুন, নিজেকে এতো গর্বের সঙ্গে সারাদিন বাড়িতে থাকা বাবা বলে পরিচয় দিলো, যেনো নিজেকে উইম্বলডন টেনিস চ্যাম্পিয়ন বলে পরিচয় দিচ্ছে! তিলমাত্র অস্বস্তি নেই। আচরণ নিখুঁত, পরিপাটি, মোটেই মনে হচ্ছে না যে ভান করছে। মোদ্দা কথা হলো যে ওর মাথায় পয়সা রোজগারের কোনো চিন্তা নেই।”
এই অবধি বলে স্বাভাবিক ভাবে ঝৌ রু জির হাত নেমে এলো মিন হুয়ের কাঁধে। তাকালো মিন হুয়ের দিকে। এক ঝলক দেখেই নিজের দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মিন হুয়েকে। টের পেলো মিন হুয়ের শরীর খুবই আড়ষ্ট হয়ে আছে তখনও। নিজের অজান্তেই ছেড়ে দিলো মিন হুয়েকে।
“ঝৌ রু জি, আপনি বেশ পরচর্চা করতে পারেন।”
“কেউ যদি পুরো সময়ের জন্য বাবা না হতে পারে, তবে মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব তো করতে পারে, তাই না?”
হাসলো খিলখিল করে, মিন হুয়ের দিকে দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকিয়ে বললো, “আমি ভীষণ চেষ্টা করছি ব্রেস্ট ক্যান্সারের লিম্ফ নোড মেটস্ট্যাসিস নিয়ে আলোচনাটা এড়িয়ে যেতে। কিন্তু মনে হচ্ছে যে স্তন থেকে ক্যান্সারের লসিকা গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা নিয়ে কথা না বললেই নয় এবার।”
মিন হুয়ে টুক করে ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক আর বলপয়েন্ট পেন বার করে বললো, “বেশ তাই বলুন দেখি।”
“আপনি সত্যিই জানতে চান লিম্ফ নোডে কী করে ব্রেস্ট ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে ? এই পরিবেশে? মেজাজ নষ্ট হয়ে যাবে না তো?”
“আমি সত্যিই শুনতে চাই। এমনিতেই কয়েকদিনের মধ্যেই আমি এটা নিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। চিকিৎসকরা ব্যাপারটা কিভাবে দেখেন সেটা আগে থেকে জানা থাকে তাহলে ভালোই হবে। নিজে নিজে শেখার থেকে আপনার থেকে শুনে নেওয়া ভালো।”
ঝৌ রু জিকে হতাশ দেখালো।
“প্রথমে বলুন, মেটাস্ট্যাটিক ব্রেস্ট ক্যান্সার কী?”
ঝৌ রু জি নিজের নখ খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, “শুরুতে একটা মেটাস্ট্যাটিক টিউমর থাকে। ক্যান্সারের কোষগুলো শুরুতে যে কোষসমস্টিতে থাকে সে সব ছেড়ে শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে যেতে থাকে শরীরের সংবহনতন্ত্র দিয়ে। যার মধ্যে রক্ত ছাড়া আছে লসিকা। নতুন টিউমর তৈরি হয়। চিকিৎসকদের পক্ষে এই নতুন টিউমরগুলোকে সনাক্ত করা মুস্কিল। শুধুমাত্র প্যাথোলজিস্টের পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে - ষাট শতাংশ সম্ভাবনা রয়ে যায় ছোটো টিউমরগুলো স্লাইডে দেখাই গেলো না।”
“এই জন্যই এআই ব্যবহার করাটা জরুরি।”
“হ্যাঁ, এআই প্রযুক্তি যদি এই সুক্ষ্ম টিউমরগুলোকে ধরে দিতে পারে তাহলে ব্রেস্ট ক্যানসার শুরুতেই ধরা পড়ার হার বাড়তে পারে।”
কাজের কথা শুরু হতে ঝৌ রু জিকে কিছুতেই থামানো যায় না যেনো, “একটা কথা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে যে চোঙ্গুয়াতে ব্রেস্ট ক্যান্সার যে সংখ্যায় হয় তা পশ্চিমের দেশগুলোর তুলনায় সংখ্যায় কম। কিন্তু যে হারে চোঙ্গুয়াতে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সংখ্যা বাড়ছে, তা পৃথিবিতে সব চেয়ে বেশি। গত বছর, নতুন করে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে এমন মহিলাদের সংখ্যাটা ছিলো দু লাখ সত্তর হাজার। মৃত্যুর সংখ্যা ষাট হাজারের ওপর। কুড়ি বছর বয়সের ওপরে বয়স এমন সব মহিলাদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ার সংখ্যাটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। সব থেকে বেশি ব্রেস্ট ক্যান্সার দেখা যাচ্ছে যাদের বয়স পঞ্চান্ন বছরের আশেপাশে তাঁদের -”
মিন হুয়ে কিছুতেই আটকাতে পারলো না নিজের চোখ দুটোকে। নিজের উঁচিয়ে ওঠা স্তনের দিকে ওর দৃষ্টি গিয়ে পড়লো, এক মূহুর্তের জন্য হলেও।
“আপনি চাইলে আমি দেখে দিতে পারি।” ঝৌ রুজি বললো মিন হুয়ের চোখে চোখ রেখে, ঠোঁটে হালকা হাসি খেলে গেলো।
“যান দেখি।” চোখ পাকিয়ে তেড়ে ফুড়ে উঠলো মিন হুয়ে, পরের প্রশ্নের দিকে এগোতে এগোতে। এই সময়েই দরজাটা খুলে গেলো। সাও মু বাড়ির সদর পেরোলো দুটো বাচ্চার সাথে। কাউকে তাঁর চোখে পড়লো না।
প্রথম যে মানুষটার সাথে তাঁর দেখা হলো, তার গলার স্বর শোনার জন্য সাও মু যেনো ব্যাকুল, “ও গো, ‘ছিন আই দে’, অতিথিরা সবাই এসে গেছেন?”
“বসার ঘরে আছেন সব। খাবার তৈরি।” য়িন শু বললেন রান্নাঘর থেকে, “পরিবেশনের সময় এখন।”
ঝৌ রু জি আর মিন হুয়ে একে অপরের দিকে তাকালো হাসতে হাসতে। কেউই আশা করে নি যে সাও মু তার বরকে অমন অশ্লীল ভাবে ডাকবেন বাড়িতে। তবে সাও মুয়ের বাচ্চাদুটোর ওপরে চোখ পড়তে অতিথিরা সাও মুয়ের জন্য খুশি না হয়ে পারলেন না। ছেলেটা আর মেয়েটা দুজনেই খুব সুন্দর - বড়ো বড়ো চোখ, ফর্সা গায়ের রং, দুজনেরই চেহারায় আর শরীরের ধাঁচে য়িন শুয়ের ধাত পেয়েছে, সাও মুয়ের কোনো ছায়াই নেই বাচ্চাদের চেহারায়।
“আমি দুঃখিত। দশ মিনিট দেরি হয়ে গেলো আমার।” কোট ছেড়ে রেখে সাও মু এগিয়ে এলেন কথাবার্তা শুরু করার জন্য, “এই যে আমার ছেলে মেয়েরা। বড়ো, য়িন দি, সাত বছর বয়স। দ্বিতীয় জন, য়িন নিং, পাঁচ বছরে।”
দুটো বাচ্চাই খুব ছটফটে, বেশ হাসিখুশি। আইয়ে আর শুশুকে নিজেদের পরিচয় দিয়েই দৌড়ে গেলো স্নানঘরে হাত-পা ধুয়ে পরিস্কার হতে।
সবাই খাবার ঘরে গিয়ে বসলো, চারজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ আর দুটো বাচ্চা, পাঁচটা পদ আর একটা ঝোল, মাংস আর সব্জি দিয়ে ভরপুর। এর মধ্যে একটা ছিলো ম্যান্ডারিন মাছ দিয়ে বানানো কাঠবেড়ালির মতো দেখতে মাছ ভাজা। যে ছুরির দু ধারই দাঁতালো আর দাঁতের সারি একে অপরের উল্টোদিকে হেলানো তেমন একটা ছুরি দিয়ে কাঁটা ছাড়ানো ম্যান্ডারিন মাছগুলোকে খোদাই করে কাঠবেড়ালির মতো দেখতে করা হয়েছে, টেবিলের ওপরে মাছগুলো টোম্যাটো সসে জবজবে লাল। বাকি সব কিছু বাড়িতে রাঁধা পদঃ কাঁচা লঙ্কা দিয়ে কুঁচোনো শুয়োরের মাংস, গরুর মাংসের কিমার মধ্যে বড়ো বড়ো টোফুর ঘনক দিয়ে বানানো মাপো টোফু, কুঁচোনো বাধাকপি, শুকনো বাঁশের ডগা আর বেকন, সঙ্গে একটা বিশাল পাত্রে শুকনো চিংড়ি দিয়ে টলটলে হালকা ছাঁচি কুমড়োর ঝোল।
বিনচেং-এ মিন হুয়ের দিনের তিনটে খাবারই বাইরে থেকে আনানো। প্রায় কখনোই সব্জি বাজারে যায় না মিন হুয়ে। বহুকাল হয়ে গেছে বাড়িতে যত্নে বানানো খাবার খায় নি মিন হুয়ে। মিন হুয়ে খিদে আর সামলাতে পারলো না। পর পর দুবাটি ভর্তি খাবার খেয়ে ফেললো।
যদিও সাও মুয়ের পরিবারের কর্তাটি গৃহী আর গৃহিণীটি বাড়ির বাইরে রোজগেরে, তবুও এই দম্পতির মধ্য কোনো বিশেষ বোঝাপড়া বা অস্বাচ্ছন্দ্যের আভাস মাত্র পাওয়া যায় না তাদের প্রথাগত ভূমিকা দুটো উল্টে যাওয়ায়। বরং তারা পরস্পরকে দিব্যি বোঝে। একে অপরকে চুপচাপ সাহায্য করে যায়। এতে মিন হুয়ের খানিক হিংসে হয়।
খাওয়া মিটে যেতে য়িন শু বাচ্চাদের নিয়ে দোতলায় চলে গেলেন। সাও মু সেই সময়ে অতিথিদের নিয়ে বসলেন বসার ঘরে। একথা সেকথার পর বললেন, “গত দু বছর ধরে, চিকিৎসাক্ষেত্রে এআই ব্যবহার করে এমন প্রযুক্তির বাজার বেশ গরম। তবে অনেক বুদ্বুদও আছে। হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারনেট, স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলো আর যে কোম্পানিগুলো চিকিৎসায় ব্যবহারের যন্ত্র বানায় সেগুলো - এরা সব্বাই এআই-এর প্রজেক্ট শুরু করছে। যদিও সবার নিজের নিজের লক্ষ্য আছে, তবে অনেক এমন ক্ষেত্র আছে যেগুলো এদের আলাদা কাজগুলোর অনেকগুলোতেই দেখা যায়। যদিও বা'অ্যান একটা ছোট্টো কোম্পানি, যেটা খুব পুরোনও নয়, তবুও বা'অ্যান গুরুত্ব দেয় নিপুণ কারিগরিকে। আজকে আমি হেড কোয়ার্টার্সে গিয়ে ছিলাম, বসেদের সঙ্গে কথা বলতে। ওঁরা প্রত্যেকেই মনে করেন যে বা'অ্যান এখনো এআই ইমেজ অ্যানালিসিস প্ল্যাটফর্মের কাজের ওপরই নির্ভরশীল। কোম্পানিটা একগোছা প্রোডাক্ট বানিয়েছে কেবলমাত্র একটা রোগের জন্য আর লড়ে যাচ্ছে শিল্পক্ষেত্রে সেরার তকমা পাবার জন্য। যেমন ধরো - ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং। এর থেকে অন্যান্য রোগ যেমন ন্যাসোফ্যারিনজিয়াল ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, ব্রেন ক্যানসার … এমন কী রেটিনার ক্যান্সার, কার্ডিওভাসকুলার রোগ, অ্যালজাইমার্স ডিসিস - এসবের জন্যও প্রোডাক্ট বানানো যেতে পারে।”
মিন হুয়ে আপন মনে ভাবতে লাগলো, সাও মুয়ের কথাগুলো তো সাও মু কোম্পানিতে মিটিং-এর সময়েও বলতে পারতো, বাড়িতে ডেকে এনে বলছে কেনো,কে জানে।
মিন হুয়ে শুনতে লাগলো সাও মুয়ের কথা, “যদ্দুর আমি জানি, পাঁচটা কিংবা ছটা মুখ্য প্রতিযোগী আছে এআই ইমেজিং দিয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের স্ক্রিনিং করার প্রতিযোগিতায়। এই কোম্পানিগুলোর অনেকগুলো যেমন, ইউন য়িং টেকনোলজি আর ডিপ ভিউ মেডিক্যাল, ফাইন্যান্সিং-এর B রাউন্ডে পৌঁছে গেছে। স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলো যা করছে তা করছে, ত বাদে আবার গুয়ান ছাও ইন্টারন্যাশন্যাল আর ডং লি গ্রুপ -এর মতো ইন্ডাস্ট্রির মহীরুহরাও এআই নিয়ে কাজ করছে উৎসাহের সাথে। বা'অ্যানের সুবিধে ছিলো বিপুল পরিমাণ তথ্য, যা এখন ক্রমশ সীমিত হয়ে আসছে। কোম্পানিটা তো শুরু হয়ে ছিলো একটা হার্ডওয়্যার কোম্পানি হিসেবে, সফট্ওয়্যারের দিকে একেবারেই মন দেয় নি কিনা। ব্যাপারটা খুবই সরল। এআই ইমেজ অ্যানালিসিস সবে সবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, আপস্ট্রিম আর ডাউনস্ট্রিম কী করে মেলানো হবে, এবং কী করে মূল ক্লিনিক্যাল সমস্যাগুলো সমাধান হবে - কোনো ব্যাপারটাই এখনো খুব নিশ্চিত রূপ নেয় নি। এটা যেনো একটা ছ-সাত বছরের বাচ্চা। সবাই জানে ভবিষ্যত আছে একটা, কিন্তু বাচ্চাটা এখনো বড়ো হয় নি। কেউ জানে না এরপরে কী হবে।”
“শুরুর উন্মাদনা, উত্তাপ কমে গেলে, এক আধটা কোম্পানি নিশ্চিত ফুরিয়ে যাবে।” হেসে বললো ঝৌ রু জি।
“ঠিক কথা। কয়েকটা স্টার্ট কোম্পানি নিশ্চিতভাবে C রাউন্ডেও টিকে যাবে।”
সাও মু ঘাড় নেড়ে বললো, “আমি আজকে তোমাদের ডেকেছি বিশেষ করে এই ভবিষ্যতের এই দিকটার কথাই আলোচনা করার জন্য আর দেখার জন্য যে আর কতো দিন লাগবে বা কতোটা কঠিন এ ব্যাপারটা। এটা আমার প্ল্যান করার সময়। কারণ মিন হুয়ের মতোই আমারও চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞান সীমিত। এক্ষুণি পরিপূরক পড়াশোনা লাগবে। রু জি, শুনেছি যে এ বছরে তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে একটা এআই মেডিক্যাল রিসার্চ গ্রুপ শুরু করবে। তুমি কী আমাদের বলতে পারবে গবেষণা কোন দিকে যাচ্ছে আর কী কী কাজ করা গেলো?”
“ওহ! সাও জঁ -” ঝৌ রু জি নালিশ করতে লাগলো, “মিন হুয়ে আর আমি এখানে কাজের কথা বলতেই এসেছি তো।”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আপনি কাজের পরে আমাদের একটা ছোটো মিটিং-এ ডাকলেন না কেনো? কেনই বা আমাদের শওজিউজিকে দিয়ে এই জমজমাট খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করালেন?”
“বাড়িতে বসে, খেতে খেতে, পান করতে করতে, কথা বলার পরিবেশটা বেশি ভালো নয় কী?”
মিন হুয়ে চুপ করে গেলো।
ঝৌ রু জিও তাই।
এর ফলে পরের দু ঘন্টায় তিন জনে মিলে সাও মুয়ের বাড়ির বসার ঘরে বসে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়েও কথা বলে গেলো, যতক্ষণ না মিন হুয়ে আর ঝৌ রু জি নিজেদের বাড়ি ফেরার জন্য উঠলো।
****
গাড়িতে বসাত পরে ঝৌ রু জি জানতে চাইলো, “সামনের মলে একটা তাকোয়াকির দোকান আছে। ভালোই বানায় গোল গোল জাপানি ডাম্পলিংগুলো। যাবেন?”
অবাক মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “আপনার পেট ভরে নি এখনো?”
“আমরা মঙ্গলবার বিয়ে করবো। রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি একটু, একটু কেনাকাটা করি একসাথে। না হলে বিয়েটা জলো, ঢপবাজির মতো লাগবে না?”
মিন হুয়েও তাই ভাবছে। তার ওপরে য়িন শুয়ের রান্নাটা বেশ ভারি ছিলো। মিন হুয়ের একটু যেনো পেট ভার লাগছে। আবার এটা ওটা খাবার জন্য ইচ্ছেও করছে। সব মিলিয়ে মিন হুয়ে ঘাড় নেড়ে সায়ই দিয়ে ফেললো, “ওকে।”
যদিও মিন হুয়ে অনেক দিন আছে বিনচেং-এ, তবু তার ঘোরাফেরা কোম্পানির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বাধা। শহরের পশ্চিমে যেখানে সাও মু থাকে সেইদিকটা সম্বন্ধে মিন হুয়ে প্রায় কিছুই জানে না। কেবল জানে যে ঐ এলাকাতে প্রচুর শপিং মল আছে যেগুলোতে দামী জিনিসপত্র বিক্রি হয়। কিন্তু ঝৌ রু জি এলাকাটা বেশ ভালোই জানে। সে দিব্যি ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে লাগলো মিন হুয়ের হাত ধরে।
“দোতলায় অনেকগুলো ব্র্যান্ড স্টোর আছে। কোনটা পছন্দ তোমার - শানেল না গুচি?”
“তুমি শুনলে কোথা থেকে?”
“চলো দেখা যাক।”
মিন হুয়ে চেপে ধরলো ঝৌ রু জিকে, “বাদ দাও। শুধু খাবার জিনিস দেখি, চলো। আর যা চোখে পড়বে তাই দেখি।”
“না। খুব শিগগির আমরা বিয়ে রেজিস্টার করতে যাচ্ছি। আর আমি তোমাকে এখনো কোনো ভদ্রস্থ উপহার দিই নি। আমি দুঃখিত।”
বলেই ঝৌ রু জি প্রায় টানতে টানতে মিন হুয়েকে নিয়ে গেলো দোতলায়, শানেলের দোকানে। “এই কালো আর সোনালি মাঝারি মাপের লিবয়টা অনেক কাজে লাগবে।”
কর্মী মহিলাটি মিন হুয়ের হাতে একটা নমুনা তুলে দিলো, “এটা আপনি পছন্দ না করে পারবেন না।”
মিন হুয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে অনেকগুলো ভঙ্গী করে ঝৌ রু জিকে দেখালো। “তাহলে এটাই নেওয়া যাক।” বলে ঝৌ রু জি ক্রেডিট কার্ড বার করে দাম চোকাবার জন্য চেক আউট কাউন্টারের রাস্তা ধরলো। খানিক পরেই টের পেলো যে মিন হুয়ে চলা ফেরা বন্ধ করে দিয়েছে, যেনো পাথর হয়ে গেছে, যেনো ওর পিছনে একটা নেকড়ে দাঁড়িয়েছে এখনই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে, কিংবা যেনো ও ভুত দেখেছে হঠাৎ।
কাউন্টারের কর্মীর হাতে ক্রেডিট কার্ডটা দিয়ে পিছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেলো। একটা লম্বা লোক কাউন্টারের দিকে হেঁটে এলো, অন্য আরেকজন কর্মীকে বললো, “আমি এই স্যুটটা চাই। এটা আমাকে ভাঁজ করে দিন। আর এই জুতো জোড়া। শিয়া শিয়া।”
গলার স্বর খাদের দিকে আর মিঠে। দাম মেটানো হয়ে গেলো যেই অমনি তিনি চলে গেলেন।
ঝৌ রু জি লোকটার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পায় নি। শুধু দেখেছে যে লোকটা একটা হালকা ধূসর রঙের উইন্ডব্রেকার পরে আছে, লম্বা খাড়া চেহারা, আচরণে শান্ত। ঝৌ রু জি উইন্ডব্রেকার পরা লোকটাকে এলিভেটরে উঠতে দেখলো। তারপর শপিং ব্যাগ হাতে এলো মিন হুয়ের কাছে। তখনও মিন হুয়ে চমক কাটিয়ে উঠতে পারে নি দেখে ঝৌ রু জি মিন হিয়ের কাঁধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করলো, “লোকটাকে চেনো নাকি?”
মিন হুয়ে হাসলো। হাসিটা অস্বাভাবিক দেখালো। মাথা ঝাঁকাতে লাগলো।
“আমি যদি ঠিক আন্দাজ করে থাকি, তবে লোকটা চেং ছিরাং, তাই না?”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-20.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-22.html